শুক্রবার

তন্ময় ভট্টাচার্য : ঢাকাইয়া সুবিমল বসাক ও তাঁর সাহিত্য

হাংরি জেনারেশন, ‘ঢাকাইয়া’ সুবিমল বসাক ও তাঁর সাহিত্য

(১)
মুর্শিদাবাদ একসময় বাংলার তাঁতশিল্পীদের অন্যতম ঘাঁটি ছিল। ইংরেজদের অত্যাচারে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে তাঁদের অনেকেই নিজের জীবিকা ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। একদল কর্মচ্যুত তাঁতি ঢাকায় বসতি স্থাপন করেন এবং পেশা হিসেবে বেছে নেন স্বর্ণকারের জীবন। সেই বংশের সন্তান হলেন সুবিমল বসাক। একটি সাক্ষাৎকারে তাঁর স্মৃতিচারণ –
“বাবা যৌবনে ঢাকা ছেড়ে আসেন, কাজের ধান্দায় নানান জায়গায় ঘুরে শেষে পাটনায় থিতু হন। ভাল কারিগর ছিলেন, উদ্যমী ছিলেন, পরিশ্রমীও ছিলেন। প্রচুর অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত মহলেও একটা আসন গড়ে তুলেছিলেন। পাটনায় দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন ১৯৩৯ সালে, আমার জন্মবর্ষে, কিন্তু গৃহপ্রবেশ করেছিলেন কয়েকবছর পর; কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে জনৈক মিলিটারি অফিসার আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। মা-কে ঢাকা থেকে নিয়ে আসার পর পাটনার স্থায়ী বাসিন্দা। আমাদের স্বজাতি অন্যান্য ব্যবসায়ীর তুলনায় আমাদের অবস্থা খুব উন্নত ছিল বলা যায়। পরিবারের অন্যান্যরা ঢাকায় থাকতেন, যৌথ পরিবারের দরুণ বাবাকে নিয়মিত খরচ পাঠাতে হতো। আমার মামার বাড়িও ঢাকায়, তখন বিয়ের সম্বন্ধ হতো কাছে পিঠে। পরে অবশ্য এক মামা আর মেসো খাগড়ায় স্থায়ী বাসিন্দা হন। মামাতো ভাই-বোনেরা খাগড়াই ভাষায় কথা বলে। ঢাকায় আমরা শেষ যাই পঞ্চাশ সনের কিছু আগে, পাসপোর্ট-ভিসার প্রচলন হয়নি, তখনও ভারতীয় টাকা চলতো – নোটের বাঁ-দিকে সাদা অংশে ‘গভর্নমেন্ট অফ পাকিস্থান’ ছাপা থাকতো, ডানদিকে ষষ্ঠ জর্জ। পঞ্চাশের দাঙ্গায় আত্মীয়-স্বজন সকলেই বাড়ি জমি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ফেলে রেখে চলে আসে। রিফ্যুজি কার্ড হোল্ডার। আমরা অবশ্য সে অর্থে রিফ্যুজি নই, কিন্তু অবস্থা খারাপ ছিল রিফ্যুজি-আত্মীয়দের চেয়েও...”

সুবিমল বসাক হলেন সেই গোত্রের লেখক, যাদের লেখা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আয়েস করে বুকের নিচে বালিশ চেপে পড়তে শুরু করা পাঠকদের জন্যে নয়। সমাজের প্রত্যন্ত শ্রেণির কথা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বারবার। সাবঅল্টার্ন রচনায় তাঁর অসাধারণ দক্ষতার অন্যতম কারণই হল প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। পাটনায় জন্ম হলেও সুবিমল বসাক দেখেছেন দেশভাগের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জনসাধারণের অবস্থা। ঢাকার প্রতি তাঁর দুর্বলতা চিরদিনের। তাই তাঁর গদ্যে কবিতায় প্রায়ই ফুটে ওঠে সেই অঞ্চলের ভাষা, আচার আচরণ ও সংস্কৃতি।

(২)
সুবিমল বসাকের প্রথম বই ‘ছাতামাথা’, প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। আদ্যপান্ত ঢাকাই কথ্যভাষায় লেখা এই বইটি। মলয় রায়চৌধুরী এ সম্পর্কে বলেছেন – “ছাতামাথা’র আগে কেউ ওভাবে আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ করেননি, টেক্সট’কে ডিন্যারেটিভাইজ করেননি, ডিক্যাননাইজ করেননি।” ‘ছাতামাথা’ বাংলার প্রথম ডি-ন্যারেটিভাইজড উপন্যাস। গতানুগতিক সূত্র ধরে ঘটনাপ্রবাহে এগিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই সৃষ্টি। যে উপন্যাস শুরু হচ্ছে এইভাবে
“আন্ধার আর সুমসাম কুঠুরিতে একলা থাকলেই আমার খালি খালি নরক আর শয়তানের কথা মনে আহে। নরক যাওনের রাস্তাঘাটগুলা চিনা নাই, চিনাজানা থাকলে মাঝেমধ্যি আওন-যাওন যাইতো। পূজা-পাইলের দিনে তেহার-পরবে ঐহানে গিয়ে দুই একদিনের লাইগ্যা ঘুইর্যা  আওন যাইতো। ... হয়তানের কথা হগল সময়ে মনে আহে, অর কথা ভাইব্যা-ভাইব্যা শরীল নিপাত করি, অথচো কোন কুলকিনারা পাই না। ক্যান জানি মনে হয়, হয়তানে আমার কাছে পিঠেই আছে। ...যারে দেহি তারেই জিগাই, ‘এখানে শ্রীযুক্ত বাবু শয়তান নামে কেউ থাকেন কি?’

সুবিমল বসাক পশ্চিমবঙ্গের হাংরি আন্দোলনের একজন প্রধান গদ্যকার। তাঁর রচনায় প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ও নতুনত্বের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ঢাকা থেকে সাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার তাঁকে সেসময় চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন – “তোমার ‘ছাতামাথা’ সম্পর্কে আগে কিছু বলেছিলাম কিনা জানা নেই। বিভিন্ন সময়ে আমি কয়েকবার বইটি পড়েছি। বইটির স্বাদ আমার রসনা তৃপ্ত করেছে। ‘ছাতামাথা’ পড়ার পর কিছুকাল আমার নিজের লেখা বন্ধ রাখতে হয়েছে। লিখতে বসলে কলমের মুখে তোমার প্রভাব নির্গত হতে শুরু করত। ... ছাতামাথা শুধু তোমাদের গোত্রীয় লোকের প্রশংসা অর্জন করুক, এটা আমি আশা করি না। বইয়ের যথাযোগ্য মূল্যায়ন হলে আমাদের চেতনার কিছু জাগৃতি হবে বোঝা যায়। ভাষার আয়ত্বের চেয়েও। পরিবেশনির্ভরভাবে তা প্রয়োগ করার শক্তিতে তুমি ঈর্ষাযোগ্য।” মৈত্রেয়ী দেবী’র মতে – “...আপনি যে ভাষায় যে সব কথা ভাবেন, তাই লিখেছেন। সেটা একটা গুণ বটে। অর্থাৎ বানিয়ে না লিখে যা আপনার কাছে সত্য তাই লেখা”।

(৩)
সুবিমল বসাকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হাবিজাবি’, প্রকাশকাল ১৯৭০। হাংরি আন্দোলনের সময় লিখিত তাঁর কবিতার সংকলন। এবং আকর্ষণীয় এই যে, প্রতিটি কবিতাই পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় লেখা, আরো নির্দিষ্ট করে বললে, ঢাকার কথ্যভাষায়। তাঁর আগে কেউ এমন সফলভাবে এই আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখতে পেরেছেন কিনা, জানা নেই। ‘হাবিজাবি-১২’ কবিতাটি –
আরশির ওই পাড়ে ফুটছে শয়তানের চ্যারা
ফিরা ফিরা প্রতিশোধ লইতে তেইড়্যা আহে
আমার উল্টাহানই আমি নিত্যি দেহি আরশিতে।
কবিতার পংক্তিগুলি দুর্বোধ্য নয় মোটেই, বরং তীব্রতার জন্য সোজা এসে আঘাত করে বুকে। “এই শহরের নিশ্বাসে আমার কইলজা পুইড়্যা গেছে / আন্ধারে কেবল বিড়ালের লাল চক্ষু জ্বলজ্বল করে”।
এ প্রসঙ্গে বাংলা কবিতার বিস্ময়পুরুষ ফালগুনী রায়ের ১৯৭১ সালে ‘কিন্তু’ পত্রিকায় প্রকাশিত গদ্যের অংশবিশেষ উল্লেখ করা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না বোধহয় –

"২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদেরা সুবিমল বসাকের মতই প্যান্ট-শার্ট বা পাজামা-পাঞ্জাবী পরে ছিলেন, বাংলা ভাষার জন্যে নিহত না হয়েও সুবিমল শহীদ হয়েছিলেন বাংলা ভাষার জন্যে - অর্থাৎ মসী অসি অপেক্ষাও শক্তিশালী এই প্রবচনের সূত্র ধরে বলা যায় কলকাতার অ্যাকাডেমিক অধ্যাপক বা আধুনিক কবি কেউ কেউ যারা বাড়ীতে মা'র সংগে বাঙাল ভাষায় এবং কলেজে কফিহাউসে খালাসীটোলায় বা বেশ্যার সংগে ক্যালকেশিয়ান ডায়ালেকট-এ কথা বলেন - তাঁরা সুবিমলের ভাষারীতি-কে প্রচণ্ড আক্রমণ করেন - কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারির শহীদরা যেমন একই সংগে শ্রদ্ধেয় সেইমত সুবিমল বসাকও শিক্ষিত কবি-সাহিত্যিকদের উপহাস গালাগালের গ্লোরী-কে ম্লান করে দিয়ে একই ভাষারীতিতে লিখে চলেছেন - লিখে চলবেন।

     ... সুবিমল গদ্য লেখেন এবং কবিতাও - সুবিমল রবীন্দ্রনাথের মত দাড়ি রাখেন না কিন্তু টাইপমেশিনের সাহায্যে অই ভদ্রলোকের একটা প্রতিকৃতি তৈরী করেছিলেন ছাত্রাবস্থায় - দেখেছিলুম। সুবিমল রবিঠাকুরের মত গান বা নাটক লেখেননি কোনদিন, সো হোয়াট? রবীন্দ্রনাথ না থাকলে সুবিমল লিখতেন না কি?

     ... সুবিমল দেখেছেন -
                   এই শহরের মাগীর কোঠায় দেহি সরকারী নিরোধ-এর বিজ্ঞাপন
                   কালোবাজারের খয়রাতী দানে না-জানি কতো মন্দির তৈয়ার হইতাছে
                   এই কিনারে বোমা পরীক্ষা - আরেক কিনারায় হাসপাতাল


সুবিমল লিখেছেন -
            সুখী মানুষেরা একতলা দুইতলা কইর্যাা উইঠ্যা যায় উপ্‌রে
            হাতের লাগল থাকে ম্যায়ামানুষ চেনবান্ধা কুত্তা, আদালতের আইন কানুন।

 
        ... এভাবেই বাংলাদেশ আন্দোলনের জোয়ার আসার আগে থেকেই পদ্মাপারের ছেলে সুবিমল দ্যাশের ভাষায় কবিতা গদ্য লিখে বিদেশে পরিচিত হয়ে গেছে, এখন আমরা যারা খুব বাংলাদেশ নিয়ে লেখালিখি মাতামাতি সভাসমিতি করি, তারা যদি সুবিমলের ভাষারীতিকে আক্রমণ করি বা এ সম্পর্কে উদাসীন থাকি তবে সেটা একটা পাপের পর্যায়ে গিয়ে পড়বে..."

(৪)
সুবিমল বসাক ঢাকার কথ্যভাষায় এবং ঢাকার পটভূমিকায় বেশ কয়েকটি গ্রন্থ লিখলেও চলিত বাংলাতেও তাঁর উল্লেখযোগ্য বই বেশ কিছু বর্তমান – ‘গেরিলা আক্রোশ’, ‘আত্মার শান্তি দু’মিনিট’, ‘দুরুক্ষী গলি’ ইত্যাদি। অপর একটি কাব্যগ্রন্থ ‘বকবকানি’। আবার পাটনায় অবস্থিত বিহারীদের উচ্চারিত বাংলায় রচনা করেছেন একের পর এক যুগান্তকারী বই – ‘প্রত্নবীজ’, ‘এথি’, ‘তিজোরীর ভিতর তিজোরী’। বাংলায় বিহারের পটভূমিকায় এবং তাঁদের উচ্চারণে লেখা উপন্যাস রচনায় সতীনাথ ভাদুড়ীর পরেই সুবিমল বসাক। অবশ্য তাঁর দেখার পটভূমি ও গভীরতা আরো বিস্তৃত।

১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় সুবিমল বসাকের গদ্য সংকলন ‘অযথা খিটক্যাল’। এটিও ঢাকার কথ্যভাষাতেই রচিত। দশটি গদ্যে সমৃদ্ধ এই বইটিতে যৌবনের ক্রাইসিস পরতে পরতে খুলে দেখানো হয়েছে। এমন বিশ্লেষণ - যেটা পুরোটাই আত্মকথনের ঢঙে লেখা - গল্পের আকার দেয়ার কোনো চেষ্টাই নেই - খুব কম পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যে। একাকীত্ব-শরীর-প্রেম-পাওয়া-না পাওয়া সব মিলিয়ে জীবনের একটি অধ্যায়, যেটি পড়তে পেলে নিজের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া নিতান্ত অস্বাভাবিক নয়। মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্ম ছোঁয়ায় সার্থক এই বইটিতে একবারের জন্যেও সহজ চলন বেসামাল হয়নি আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে। কিঞ্চিৎ উদাহরণ দেয়াই যায় – “হাত-পাও লইয়া লাড়াচাড়া করি এই পাশ ওই পাশ লাগে, কৃষ্ণা আমার লাগ হুইয়া আছে। অরে লগে লইয়া এক হেজে গুজিমুজি পাতিনার উপ্‌রে পইড়্যা আছি। আর সীনার মধ্যে আমার মুখ গুজিমুজি করে, নাক দিয়া গরম হলকা অর সীনায় ছিৎড়াইয়া পোড়ে। চাম ফাইট্যা গন্ধ-বাস বাইরয়, কড়া হইয়া পড়ে অর শরীল। ঘুম চোহে হাত গুরগুর করি – হেজপাটি খালি খালি লাগে। ওম্‌তে চন্‌ কইর্যাঘ য্যান বেবাক নিশা এক্কেরে ছুইট্যা যায়। হাতের তালুৎ বেবাক গরম নিভা যায়। চোহের পলক-টুকো খওয়াইতে মন চায় না – যদি খওয়াইয়া অরে হেজের উপরে না-দেহি!...”

(৫)
একই সালে, অর্থাৎ ১৯৮৭তেই প্রকাশিত হয় তাঁর একটি অনন্যসাধারণ গবেষণা-গ্রন্থ – “বিয়ার গীত ঢাকাই ছড়া”। লেখক তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন – “বিয়ার গীত সংগ্রহ করাটা ছিল অন্যপথে। জনৈক স্বজাতির বিয়েতে হাজির হয়ে দেখেছি, কয়েকজন প্রৌঢ়া-বৃদ্ধা তাঁদের শেষ কামড় দিচ্ছে। আমি সংগ্রহ করতে শুরু করি। নদীয়া-ফুলিয়া অঞ্চলে গিয়ে কিছু সংগ্রহ করেছি। এই রীতি-নীতি, গীত, পদ এখন লোপ পেয়েছে বলা চলে। মীজানুর রহমান ‘বিয়ার গীত’ প্রাপ্তিস্বীকারে লিখেছিলেন – ‘এই বিরাট মাপের কাজটি আমাদেরই করার কথা, আপনি কাজটি করে আমাদের স্মৃতি উসকে দিয়েছেন। বাংলাদেশে প্রত্যন্ত এলাকায় এখন মাইকেল জ্যাকসন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে’। মীজানুর রহমান তাঁর পত্রিকায় পুরো বইটি ছেপেছেন”।

বইটির প্রথম অংশ ‘বিয়ার গীত’। এখানে লেখক ঢাকার হিন্দুদের বিবাহের আচার-আচরণ, নিয়ম ও তৎসংলগ্ন গানের বর্ণনা দিয়েছেন। “ঢাকায় প্রচলিত বিয়ে উপলক্ষে গানকে ‘বিয়ার গীত’ বলা হয়। কেবল ঢাকা নয়, সমগ্র ঢাকা জেলায় ‘বিয়ার গীত’ বলে প্রচলিত... এইসব গানে তখনকার কাল যুগ পরিবেশ ইত্যাদির একটা মোটামুটি আভাস পাওয়া যায়, তখনকার সময়ের সহজ সরল অনাড়ম্বর অনুভূতির রেশ এই সব বিয়ার গীতে উপস্থিত থাকে”। হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির শেষ অস্তিস্ত্বটুকু লেখক অমর করে রেখেছেন তাঁর এই গ্রন্থে। কিছু নমুনা –

নারদ একবার জাইন্যা আও রে
          বিদ্ধি কামে কী কী লাগে?
বটপাতা গোটা গোটা
দধি লাগে ফোঁটা ফোঁটা
নারদ একবার জাইন্যা আও রে
আঠারো-গা সুপারী লাগে
আঠারো গা পান লাগে
     বিদ্ধি কামে আর কী লাগে?

কিংবা –
চল না সখি দেখিয়া আসি
      রাম সাজনের বাকী কি?
ধুতি দিয়া সাজাইয়াছি
      চাদ্দর মাত্র রেখেছি।
চল না সখি দেখিয়া আসি
      রাম সাজনের বাকী কি?
চাদ্দর দিয়া সাজাইয়াছি
     মালা মাত্র রেখেছি।


এরপর বিয়ের বিভিন্ন আচারে এবং বাসররাতে বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের মুখে-মুখে গানের উত্তর ও প্রত্যুত্তরের খেলা... লোকসংস্কৃতির সেসব অঙ্গ ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত আছে, সুবিমল বসাকের সৌজন্যে।
আরও পড়ুন
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু, ‘সব মরণ নয় সমান’
বইটির দ্বিতীয় অংশে আছে প্রচুর ছড়া, যা ঢাকার অধিবাসীদের মুখে মুখে পরম্পরায় প্রচলিত। সেসব স্মৃতিমেদুরতায় ভারাতুর, অনায়াসে হাত ধরে নিয়ে যায় শৈশবে। এখানে বেশি উল্লেখ না করে একটিমাত্র দেয়া হল –

ম্যায়ার মা লো পেঁচুরনি
ম্যায়ার বিয়া দিবি নি
ম্যায়া বইলো নদীর কূল
ফুইট্যা উঠলো চাম্পা ফুল
চাম্পা ফুলের গন্ধে
জামাই আইলো আনন্দে
খাওরে জামাই বাটা’র পান
সোন্দরীরে কর দান
দানে বইলা পাইলা কি
হুতার কাপড় হরতোকি
ম্যায়া আমার দুধের সর
কেম্‌তে লো ম্যায়া করবি পরের ঘর
পরের পুতে মারবো
ভাই গিয়া দেইহা হাইবো
বাপে গিয়া লইয়া আইবো।


(৬)
সুবিমল বসাকের আরেকটি ছোটো অথচ উল্লেখযোগ্য বই হল ‘কুট্টি’। প্রকাশ ২০০৩ সালে। ঢাকার গাড়োয়ান অর্থাৎ ঘোড়ার গাড়ির চালকদের ‘কুট্টি’ বলা হয়। কুট্টিদের রসিকতা জগৎবিখ্যাত। সেই সব রসিকতাই সংগ্রহ করে দু’মলাটের মধ্যে এনেছেন লেখক। উপস্থাপনা অত্যন্ত সরস হওয়ায় সুখপাঠ্যও বটে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক –

   সদর ঘাটে নৌকা থেকে নামতে এক কুট্টি গাড়োয়ান ঘিরে ধরে – কই যাইবেন কত্তা?
-    যামু রমনায়। কত কিরায়া?
-    আইজ্ঞা দশ ট্যাহা দিয়েন।
-    কও কি? ঐ তো এহান থিক্যা বাড়ির মাথা দ্যাহা যায়। আর তুমি কিনা দশ ট্যাহা চাইবার লাগছো?
-    আরে কত্তা, এহান থিক্যা চান্দও হাতের লাগল দ্যাহা যায়।


(৭)
‘দুরুক্ষী গলি’ সুবিমল বসাকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ২০১১ সালে এর প্রকাশ। চলিত বাংলায় লেখা হলেও বইটির পরতে পরতে মিশে আছে ফেলে আসা ঢাকা’র স্মৃতি। অভিজ্ঞতা ছাড়া এমন উপন্যাস লেখা যায় না। মলয় রায়চৌধুরী আমাদের একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই উপন্যাসটি লেখকের সেরা রচনা; এমন বিষয় নিয়ে আগে কেউ লেখেনি, পরেও কেউ লিখবে না সম্ভবত। স্বর্ণকারদের দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার এমন সূক্ষ্ম বর্ণনা অভিজ্ঞতা ছাড়া লেখা অসম্ভব। এবং ঘটনাপ্রবাহে আকর্ষণীয় করে তোলাও একটি শিল্প। বহুকাল আগে মুর্শিদাবাদ থেকে একদল তাঁতি ইংরেজদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে গেছিলেন, বিশেষত ঢাকায়। সেখানে স্বর্ণকারবৃত্তি'কেই তাঁরা জীবিকা হিসেবে বেছে নেন। তারপর, গত শতকের চল্লিশের দশকে অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন, দেশভাগের পূর্বাভাস পেয়ে। তাঁদের কয়েকজন বিহারের পাটনায় স্বর্ণকারের জীবিকা বজায় রাখেন। তাঁরাই উপন্যাসের নায়ক। সময়ের হাত ধরে এই উপন্যাসে উঠে এসেছে দেশভাগ, ঢাকা'র স্মৃতি, বিবাহের রীতি, কৈশোরের অনুভূতি, যৌনতার স্বাদ। এবং পরিসমাপ্তি চীন-ভারত যুদ্ধের আঙিনায়। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত আর কোনো উপন্যাসে ৫৯’সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পটভূমিকা আসেনি।

‘দুরুক্ষী গলি’ হল পাটনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি রাস্তা, যেখানে স্বর্ণকারদের বাস। তাঁদের আচারে কল্পনায় যাপনে উঠে আসে ঢাকা’র ফেলে আসা দিনগুলো। যে কারণে তারা বলে ওঠে – “খালি কলমের আঁচড় কাটল – ওমতে দেশভাগ। আমগো লগে থাকতে হইলে এই দ্যাশে আসতে হইব। হ। আরে, লোকজনের কত কষ্ট, কত দুর্দশা, কত ছিদরত, বাড়িঘর সাত পুরুষের ভিটা ছাইড়্যা, চিরদিনের মতো চইল্যা আসন কি মুখের কথা! নাড়ির টান পড়ে”।
সম্পূর্ণ সাবঅল্টার্ন অবস্থান থেকে লেখা এই উপন্যাসের পরিণতিতে অস্তিত্বের সংকট কী করুণভাবে বর্ণিত হয়েছে তা সত্যিই দেখার মতো। একবার ঢাকা থেকে উচ্ছেদ হলেও যেসব লোকেরা নিজেদের জীবিকা ত্যাগ করেনি, ভারত সরকারের ‘গোল্ড কন্ট্রোল’ আইনের ঠেলায় তাদের আত্মপরিচিতি কিভাবে অভাবের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে গেল – সেই বাস্তবের এক মর্মন্তুদ দলিল এই উপন্যাস।

(৮)
স্মৃতি সততই মানুষকে তাড়া করে। আর স্রষ্টাদের ক্ষেত্রে সেই স্মৃতির ছাপ পড়ে তাঁদের শিল্পে। সুবিমল বসাকও তার ব্যাতিক্রম নন। ঢাকা’র নিত্যনৈমিত্যিক আচার ও সংস্কার বংশপরম্পরায় তাঁর রক্তেও সঞ্চারিত হওয়াতেই লেখায় এমন সার্থক প্রতিফলন। তাঁর একটি সুখপাঠ্য গদ্য আছে, নাম ‘আল মাহমুদের সঙ্গে তিন ঘন্টা’। বাংলাদেশে গুলশনে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বর্ণনা। সুবিমল বসাক লিখছেন – “একবার ভাবলাম বলি, সিগারেট বা মিষ্টি খাওয়া কমানো দরকার, তারপরেই আমার নিজের বয়সের ও রুচির কথা মনে করতেই কথা বেরোয় না। ধুস্‌স্‌স্‌ - যার ভেতর এত জীবনীশক্তি, ওসব কিছুতেই কাবু করতে পারবে না”। এছাড়াও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল মীজানুর রহমান, জাহিদ হাসান মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে।

সুবিমল বসাক হলেন পশ্চিমবঙ্গের সেই সাহিত্যিক, যিনি এখনও দুর্বলতা বহন করেন ঢাকা’র সম্পর্কে, লেখায় ফুটিয়ে তোলেন আজন্ম-লালিত সংস্কৃতি, এবং কবিতায় ফুটিয়ে তোলেন ভবিষ্যতের প্রতি তাঁর সেই ঘোষণা –

সুবিমল বসাকই আমার একমাত্র হুঁশ আত্মা
সুবিমল বসাকই একমাত্র সুবিমল বসাকের উত্তরাধিকারী
সুবিমল বসাকই একমাত্র সুবিমল বসাকের ধর্ম
সুবিমল বসাকই একমাত্র সুবিমল বসাকের ইতিহাস
সুবিমল বসাকই একমাত্র সুবিমল বসাকের সংস্কৃতি।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন