শুক্রবার

অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ৭ )

Aftershock শুরু হলো তারপর । শৈলেশ্বরের হাত ঝাপটানিতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে সরে গেলেন অনেকে। অরুণেশ তো সরে গিয়েছিলেনই সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁর কিছু কাছের মানুষজনকেও যাদের কাউকে কাউকে আমরাও কাছের মানুষ ভাবতাম। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু এসে গেল না। বরং কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পের কভারে লিখে দিলাম, “সত্যের ঘাত অসহ্য হলে বুর্জোয়া ভাইরাসেরা গড়িয়ে যায় নিজস্ব ভাগাড়ের দিকে।” লিখে দিলাম, “ জানি পাঠক, তুমি পাজামা কিংবা পেন্ডুলাম নও।”
কিন্তু আমাদের কিছু না এসে গেলেও একজনের গিয়েছিল, সুভাষ ঘোষের। চটে গিয়েছিল সুভাষ-শৈলেশ্বর রসায়ন। যদিও নিজস্ব অবস্থান এবং অসহায়তার কথা বন্ধু ‘শৈলেশ’কে আপ্রাণ বোঝাতে চেয়েছিলেন সুভাষ কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই ব্যর্থতা এতটাই চরমে উঠেছিল যে খোদ কোলকাতাতেই শৈলেশ্বরের ইশারায় সুভাষকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিতও হোতে হয়েছিল। বাল্যবন্ধুর সেই লাঞ্ছনা সংবাদ উত্তরবঙ্গের অনুচরদের কাছে পৌঁছে দিতে দ্বিধা দেখাননি শৈলেশ্বর ঘোষ।
হ্যাঁ, ততদিনে এক অলিখিত নিয়মে ক্ষুধার্ত শিবির ত্রিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে যেটা আমাদের আদৌ অভিপ্রেত ছিল না। এক শিবিরের অধিনায়ক শৈলেশ্বর ঘোষ। অন্য শিবিরের অধিনায়ক মলয় রায়চৌধুরী এবং তৃতীয় শিবির কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, যার নেতৃত্বের দায় জোর-জবরদস্তি চাপিয়ে দেয়া হলো সুভাষের কাঁধে। অথচ আমরা কোনদিনই কারো নেতৃত্বকে স্বীকার করার মতো অবস্থানে ছিলাম না। সুভাষও অপচেষ্টা করেনি চেপে বসার তবু ইতিহাসের রসিকতা বোধের ফের একবার প্রমাণ পাওয়া গেল। ইতিহাসের রসিকতা বলার কারণ সেই ষাটের দশকে প্রকাশিত সুভাষের একটি গদ্যগ্রন্থের নাম ছিল,‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট।’ নামকরণের সেই ক্ষণে সুভাষ কি আদৌ ধারণা করতে পেরেছিলেন ভাবী সময় কোনদিন তাকে সত্যি সত্যি এমন জায়গাতেই এনে দাঁড় করাবে?
রসিকতা দূরে থাক, মূল সত্য এটাই যে, এরপরও সুভাষ ঘোষের কোনো নিজস্ব শিবির ছিল না। ছিল না নিজস্ব অনুচর বাহিনী। ছিল না সঙ্গী নির্বাচনের উপযুক্ত কোনো মেটাল ডিটেক্টর। এমন কী মনমতো হাংরি ইতিহাস লেখারও কোনো অ্যাজেন্ডা ছিল না। যা ছিল তা শুধু ঘাড় নীচু করে লিখে যাওয়া, নিজের লেখা পাঠ করে শোনানোর পাশাপাশি তরুণ লেখকদের লেখা শোনা এবং মতামত দেয়া। এছাড়া বেঁচে থাকার অন্য কোনো উদ্দেশ্যও ছিল না সুভাষের। যে কোনো যৌথতায় বিনা আমন্ত্রণে হাজির হোতে আপত্তি ছিল না কোনো।
আমাদের অবাধ্য হওয়ার নমুনা পাওয়া মাত্র শৈলেশ্বর ঘোষ ভিন্ন শিবিরের খোঁজার পালা শুরু করে দিয়েছিলেন। সৃষ্টিশীলতা, ইতিহাস প্রসিদ্ধি এবং ক্ষুরধার বুদ্ধির ত্র্যহস্পর্শে পেয়েওছিলেন তৃতীয় প্রবাহের সন্ধান। তবে এক্ষেত্রে খানিকটা সমঝোতা করতে উনি রাজী হয়েছিলেন। যেমন ওই শিবির কবি শৈলেশ্বরকে স্বীকৃতি দিলেও ক্ষুধার্ত আন্দোলনের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতিশীল ছিল না। অবশ্য তখন শৈলেশ্বরের তাতে আর কিছু এসে যায় না। মলয়ের লাগাতার আক্রমণে ক্ষুধার্ত আন্দোলন তখন শৈলেশ্বরের কাছে বোঝা স্বরূপ।
যথারীতি সে পর্বও দীর্ঘদিন লাস্টিং করলো না। করার কথাও নয়, জানতাম আমরা। কিভাবে জানতাম বলতে চাইছি না। অহেতুক তৃতীয়পক্ষকে টেনে কী লাভ! বরং সেসময়ের একটা শ্লোগানের কথা বলি-- “অস্তিত্ব পুড়ছে, আসুন সেই আলোয় আমরা পরস্পকে শনাক্ত করি।”

আগুন নিয়ে যতই কাব্য রচিত হোক, আগুন বেচারি বড্ড অবোধ। পুড়িয়ে ফেলেই তার তৃপ্তি, শনাক্তকরণের ধার ধারে না। আমিও তো তুষার রায় নই যে এতদিন পর ছাই ঘেঁটে বলে দেবো পাপ ছিল কিনা!
শৈলেশ্বর, সুভাষ, অরুণেশকে নিয়ে অনেক কথাই হলো, এবার অন্য হাংরিদের প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।



  • কোন মন্তব্য নেই:

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন