পত্রিকাটা ফিরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম অরুণেশদাকে, এসব কী!
অরুণেশ ঘোষ সন্ত সুলভ ভঙ্গীতে বলেছিলেন,এই গুলান কোলকাত্তাই পায়জামো। বাদ্দাও এইসব। শুদু ল্যাখা গুলান পড়ো,ওইটাই আসোল।
কিন্তু এটুকু সান্ত্বনায় স্বস্তি মিললো না। ওই যে কথায় আছে “নাল্পে চ সুখ মস্তি” সেটাকে মান্যতা দিয়ে মাথার ভেতরে একগাদা প্রশ্ন উসখুসিয়ে উঠল। যেমন, পুলিশ তো হাজতে কত কিছুই ভয় দেখিয়ে লিখিয়ে নেয় সেজন্যই আদালতে সেসব মুচলেখা ধোপে টেকে না। আদালতে দাঁড়িয়ে যেটা বলা হয় সেটাই আইন সম্মত হয়। সেখানে তো প্রত্যেকেই মলয়ের পক্ষে কথা বলেছিলেন, সেজন্যই সরকারি উকিল ওদের হোস্টাইল ডিক্লেয়ার করেছিল। কেসটাও ধোপে টেকেনি, ডিসমিস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মলয় তো সে কথা কোথাও বলেননি! (আজও বলেন না মলয় রায়চৌধুরী। কী জানি কেন! হয়ত পরমবীর চক্র হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে!) তাছাড়া কে নেতৃত্ব দিয়েছিল সেটার চে’ও বড় কথা কারা সেই আন্দোলনের ধারা বহন করে চলেছে। মামলা পর্ব মিটে যাবার পর মলয় বাদে বাকিরাই ফের ক্ষুধার্ত পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন সেই ধরণেরই কবিতা/গদ্য যা কিনা একদা রাষ্ট্রর অস্বস্তির কারণ হয়েছিল। তখন কোথায় ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী? বন্ধুদের প্রতি রাগে/দুঃখে/ অভিমানে কেউ লেখালিখিই ছেড়ে দেয় নাকি! অবশ্য অভিমানবোধ কার কতটা তীব্র হবে সেটা তো মেপে বলা যায় না তবু মলয় যখন সেই অভিমানের ভার থেকে রেহাই পেয়েছেন তখন ফের পূর্বধারায় যুক্ত হয়ে ক্ষুধার্ত আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলুন না, আটকাচ্ছে কিসে!
এসব কৌতূহলের উত্তর যেহেতু খোদ মলয় রায়চৌধুরীই দিতে পারেন তাই একটা চিঠি লিখলাম ওঁকে। প্রায় চার/পাঁচ পাতার চিঠি।
কয়েকদিনের ভেতর উত্তর এসেছিল। না, চিঠির উত্তরে চিঠি নয়, এসেছিল সাক্ষাৎকার। গোটা চিঠিটাকে সাক্ষাৎকারে রূপ দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলেন মলয়।
মন্দ হোত না যদি তাতে থাকতো আমার তোলা প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু তার পরিবর্তে আমার অনুসন্ধিৎসা মলয়ের কাছে শৈলেশ্বর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের দুসরা অধ্যায় বোধ হয়েছিল। সুতরাং ছত্রে ছত্রে ছিল অবহেলা, অপমান এবং গরিলা সুলভ বুক চাপড়ানো। ওই স্ব-সৃষ্ট সাক্ষাৎকারেই মলয় আমাদের অবস্থানকে চিহ্নিত করেছিলেন,‘উত্তরবঙ্গের হাংরি ছিটমহল’ হিসেবে। বলেছিলেন, প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার এমন এক জ্বলন্ত লাভা যা ঠান্ডা হোতে কয়েক শতাব্দী লেগে যাবে।
এই অবধি ঠিকই ছিল। হয়তো সাক্ষাৎকারটি ছেপেও দিতাম কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে যদি না মলয় ওতে বলতেন,তিনি আর প্রতিষ্ঠান বিরোধী নন। এখন প্রতিষ্ঠান তাঁর বিরোধিতা করে। তিনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা টের পাবো ওই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করলে। রাতারাতি নাকি ইতিহাসভূক্ত হয়ে পড়বে আমাদের পত্রিকা!
আমাদের আপত্তিটা জেগেছিল ওখানেই। যে ইতিহাসের প্রকৃত স্বরূপ জেনে আমাদের ভেতরে বিবমিষা জেগে উঠেছে, এরপর সেই ইতিহাসের অংশ হতে চায় কে? সুতরাং অগ্রাহ্য করা হলো কল্পিত সাক্ষাতকারটিকে। পাশাপাশি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের পাতায় প্রকাশ করা হলো একটি যৌথ প্রতিবেদন যার মূল বক্তব্য ছিল কোনো আন্দোলনের পতাকা বহন করে ইতিহাসের কমা-সেমিকোলন হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমাদের। না,আমরা কারুর পিতৃত্ব স্বীকার করে নিতে রাজী নই। তাবৎ সত্যকে পরখ করে দেখে,শুনে,বুঝে নিতে চাই আমরা। আমাদের চোখ এতটাই ছোট যে শুধু মানুষকে চোখে পড়ে, মানুষের মাথার পেছনে থাকা জ্যেতির্বলয় নয়।
ব্যস,এরপরই মৌচাকে ঢিল পড়লো। রটিয়ে দেয়া হলো, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এখন মলয়ের অঙ্গুলীহেলন বন্দী। একবার ভাবুন, সময়ের চরম রসিকতাটার কথা। মলয় ভাবছেন, আমরা শৈলেশ্বরের প্রম্পট করা ডায়ালোগ মুখস্থ বলছি। শৈলেশ্বর ভাবছেন উল্টোটা। হায়রে নেতৃত্ব এবং তার লড়াই! এরপর থেকে দুই মহারথী জীবনভর শুধু কামড়াকামড়ি করে গেলেন, তুই বিড়াল না মুই বিড়াল। চালিয়ে গেলেন অনুগামী বাছাই অভিযান। আর তাই শৈলেশ্বর প্রণীত হাংরি ইতিহাস বই থেকে বাদ গিয়েছেন তারা যাদের সন্দেহ করা হয়েছিল মলয় শিবিরের লোক। মলয় প্রণীত ইতিহাস বইয়েও ঘটেছে ঠিক তার উল্টো।
সাহিত্য যেহেতু আমাদের কাছে দুলাল ভড়ের তালমিছরি ছিল না তাই ছবি এবং সহি মিলিয়ে দেখার তোয়াক্কা না করে, দুই মোরগের লড়াইকেই একতিল পাত্তা না দিয়ে প্রকাশিত হয়ে চললো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের পর পর সংখ্যাগুলো। ক্ষুধার্তদের ব্যবহৃত শ্লোগান--বুর্জোয়া নিউক্লিয়াসে কামান দাগো, তখন আমাদেরও শ্লোগান। ফারাক শুধু এটুকই যে সেই কামানের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ক্ষুধার্তবৃন্দও। পাবার কথাও নয়। কেননা ক্ষুধার্তদের লেখাপত্রই আমাদের শিখিয়ে ছিল--প্রতিষ্ঠানের চে’ও বড় শত্রু আত্মপ্রতিষ্ঠান। সেটারও বিরোধিতা করাটা একজন লেখকের অবশ্য কর্তব্য।
এসবের পাশাপাশি আমরাই প্রথম অবনী ধরের গল্প পুনর্মুদ্রণ করেছিলাম। আমরাই প্রথম প্রকাশ করেছিলাম ফালগুনি রায়ের কবিতা সঙ্কলন।
কিন্তু আমাদের কাজগুলো ক্ষুধার্তদের কাছে তো আমল পেলই না বরং আমাদের শ্লোগানগুলো ওদের কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল। নেতা হওয়াই যার জীবনের প্রধান লক্ষ্য, যিনি কোনদিনই বিরোধিতা সহ্য করতে পারেননি, মলয় হাজির হওয়ার পর যার আসন টলে উঠেছে সেই শৈলেশ্বর ঘোষ খুব স্বাভাবিক কারণেই আমাদের ওপরে চটে উঠলেন। সমস্ত কার্যকারণের প্রতিনিয়ত জবাবদিহি চাইতে লাগলেন। না, সরাসরি আমাদের কাছে নয়। অরুণেশ ঘোষের কাছে। কিন্তু অরুণেশ কী কৈফিয়ত দেবেন? আমরা তো ওঁকেও ছেড়ে কথা কইছি না! ব্যাখ্যা চাইছি ওঁর বক্তব্যের--
” সচেতন থাকার অর্থ জাগ্রত থাকা নয়,সীমাবদ্ধ থাকা। আমি এই সীমাবদ্ধতা কাটাতে চাই। একটা লেখার শুধু শব্দের দায়িত্ব কেন, তার দাড়ি-কমার দায়িত্বও একজন লেখক নেয়,যখন সে শুধু মাত্রই নির্মাণ করে। তৈরি করে। ইগো আর বুদ্ধি দিয়ে। আর যে তা করে না,যার ক্ষেত্রে একটা পুরো লেখা ‘হয়ে ওঠে’, সে শুধু শব্দের দায়িত্ব নেয়না, নেয় গোটা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের। তার জগতের। মূল কথা হল ‘লেখকের নিজস্ব জগৎ।’ সেটা ঠিক থাকলে সব ঠিক আছে। আর সেটা না থাকলে শব্দগুলো তো মৃত আবর্জনা মাত্র।”
কি বলবো এই চিন্তাকে অরুণেশদা, ক্ষুধার্ত চেতনা, নাকি হঠযোগ?
জাঁতাকল থেকে রেহাই পেতে এরপর অরুণেশ শিলিগুড়ি চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দিলেন। বন্ধ করে দিলেন কথাবার্তার সম্পর্কটুকুও। আমাদের মতো বালখিল্যদের কারণে শৈলেশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করাটা ওঁর কাছে অযৌক্তিক বোধ হলো।
কান্ডটা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেনি কারণ আমরা জানতাম দুজনের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের কথা। জানতাম শৈলেশ্বর সম্পর্কে ওঁর মূল্যায়ন,“ কিছু মানুষ, গোটা পৃথিবীতেই যাদেরকে আঙুলে গোনা যায়, যারা সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে ঘর ছেড়ে, যাদের এ কারণেই ভন্ড মিথ্যার পূজারী সমাজ পরিত্যক্ত শিশুর মতো ছুঁড়ে দিয়েছে অন্ধকারে পথের আবর্জনায়, শৈলেশ্বর তাদেরই একজন।”
আহা, ভাবতে খারাপ লাগে, আর মোটে কয়েকটা মাস বেঁচে থাকলেই অরুণেশ জেনে যেতে পারতেন বন্ধুর পশ্চিমবঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন মেলার উদ্বোধনের দায়িত্ব পাবার খবর। জেনে স্বস্তি পেতেন, ভন্ড মিথ্যার পূজারী সমাজ পরিত্যক্ত শিশুর মতো যাদের ছুঁড়ে দিয়েছে অন্ধকারে পথের আবর্জনায়, শৈলেশ্বর তাদেরই একজন নয় আর।
অরুণেশ ঘোষ সন্ত সুলভ ভঙ্গীতে বলেছিলেন,এই গুলান কোলকাত্তাই পায়জামো। বাদ্দাও এইসব। শুদু ল্যাখা গুলান পড়ো,ওইটাই আসোল।
কিন্তু এটুকু সান্ত্বনায় স্বস্তি মিললো না। ওই যে কথায় আছে “নাল্পে চ সুখ মস্তি” সেটাকে মান্যতা দিয়ে মাথার ভেতরে একগাদা প্রশ্ন উসখুসিয়ে উঠল। যেমন, পুলিশ তো হাজতে কত কিছুই ভয় দেখিয়ে লিখিয়ে নেয় সেজন্যই আদালতে সেসব মুচলেখা ধোপে টেকে না। আদালতে দাঁড়িয়ে যেটা বলা হয় সেটাই আইন সম্মত হয়। সেখানে তো প্রত্যেকেই মলয়ের পক্ষে কথা বলেছিলেন, সেজন্যই সরকারি উকিল ওদের হোস্টাইল ডিক্লেয়ার করেছিল। কেসটাও ধোপে টেকেনি, ডিসমিস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মলয় তো সে কথা কোথাও বলেননি! (আজও বলেন না মলয় রায়চৌধুরী। কী জানি কেন! হয়ত পরমবীর চক্র হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে!) তাছাড়া কে নেতৃত্ব দিয়েছিল সেটার চে’ও বড় কথা কারা সেই আন্দোলনের ধারা বহন করে চলেছে। মামলা পর্ব মিটে যাবার পর মলয় বাদে বাকিরাই ফের ক্ষুধার্ত পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন সেই ধরণেরই কবিতা/গদ্য যা কিনা একদা রাষ্ট্রর অস্বস্তির কারণ হয়েছিল। তখন কোথায় ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী? বন্ধুদের প্রতি রাগে/দুঃখে/ অভিমানে কেউ লেখালিখিই ছেড়ে দেয় নাকি! অবশ্য অভিমানবোধ কার কতটা তীব্র হবে সেটা তো মেপে বলা যায় না তবু মলয় যখন সেই অভিমানের ভার থেকে রেহাই পেয়েছেন তখন ফের পূর্বধারায় যুক্ত হয়ে ক্ষুধার্ত আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলুন না, আটকাচ্ছে কিসে!
এসব কৌতূহলের উত্তর যেহেতু খোদ মলয় রায়চৌধুরীই দিতে পারেন তাই একটা চিঠি লিখলাম ওঁকে। প্রায় চার/পাঁচ পাতার চিঠি।
কয়েকদিনের ভেতর উত্তর এসেছিল। না, চিঠির উত্তরে চিঠি নয়, এসেছিল সাক্ষাৎকার। গোটা চিঠিটাকে সাক্ষাৎকারে রূপ দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলেন মলয়।
মন্দ হোত না যদি তাতে থাকতো আমার তোলা প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু তার পরিবর্তে আমার অনুসন্ধিৎসা মলয়ের কাছে শৈলেশ্বর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের দুসরা অধ্যায় বোধ হয়েছিল। সুতরাং ছত্রে ছত্রে ছিল অবহেলা, অপমান এবং গরিলা সুলভ বুক চাপড়ানো। ওই স্ব-সৃষ্ট সাক্ষাৎকারেই মলয় আমাদের অবস্থানকে চিহ্নিত করেছিলেন,‘উত্তরবঙ্গের হাংরি ছিটমহল’ হিসেবে। বলেছিলেন, প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার এমন এক জ্বলন্ত লাভা যা ঠান্ডা হোতে কয়েক শতাব্দী লেগে যাবে।
এই অবধি ঠিকই ছিল। হয়তো সাক্ষাৎকারটি ছেপেও দিতাম কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে যদি না মলয় ওতে বলতেন,তিনি আর প্রতিষ্ঠান বিরোধী নন। এখন প্রতিষ্ঠান তাঁর বিরোধিতা করে। তিনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা টের পাবো ওই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করলে। রাতারাতি নাকি ইতিহাসভূক্ত হয়ে পড়বে আমাদের পত্রিকা!
আমাদের আপত্তিটা জেগেছিল ওখানেই। যে ইতিহাসের প্রকৃত স্বরূপ জেনে আমাদের ভেতরে বিবমিষা জেগে উঠেছে, এরপর সেই ইতিহাসের অংশ হতে চায় কে? সুতরাং অগ্রাহ্য করা হলো কল্পিত সাক্ষাতকারটিকে। পাশাপাশি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের পাতায় প্রকাশ করা হলো একটি যৌথ প্রতিবেদন যার মূল বক্তব্য ছিল কোনো আন্দোলনের পতাকা বহন করে ইতিহাসের কমা-সেমিকোলন হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমাদের। না,আমরা কারুর পিতৃত্ব স্বীকার করে নিতে রাজী নই। তাবৎ সত্যকে পরখ করে দেখে,শুনে,বুঝে নিতে চাই আমরা। আমাদের চোখ এতটাই ছোট যে শুধু মানুষকে চোখে পড়ে, মানুষের মাথার পেছনে থাকা জ্যেতির্বলয় নয়।
ব্যস,এরপরই মৌচাকে ঢিল পড়লো। রটিয়ে দেয়া হলো, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এখন মলয়ের অঙ্গুলীহেলন বন্দী। একবার ভাবুন, সময়ের চরম রসিকতাটার কথা। মলয় ভাবছেন, আমরা শৈলেশ্বরের প্রম্পট করা ডায়ালোগ মুখস্থ বলছি। শৈলেশ্বর ভাবছেন উল্টোটা। হায়রে নেতৃত্ব এবং তার লড়াই! এরপর থেকে দুই মহারথী জীবনভর শুধু কামড়াকামড়ি করে গেলেন, তুই বিড়াল না মুই বিড়াল। চালিয়ে গেলেন অনুগামী বাছাই অভিযান। আর তাই শৈলেশ্বর প্রণীত হাংরি ইতিহাস বই থেকে বাদ গিয়েছেন তারা যাদের সন্দেহ করা হয়েছিল মলয় শিবিরের লোক। মলয় প্রণীত ইতিহাস বইয়েও ঘটেছে ঠিক তার উল্টো।
সাহিত্য যেহেতু আমাদের কাছে দুলাল ভড়ের তালমিছরি ছিল না তাই ছবি এবং সহি মিলিয়ে দেখার তোয়াক্কা না করে, দুই মোরগের লড়াইকেই একতিল পাত্তা না দিয়ে প্রকাশিত হয়ে চললো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের পর পর সংখ্যাগুলো। ক্ষুধার্তদের ব্যবহৃত শ্লোগান--বুর্জোয়া নিউক্লিয়াসে কামান দাগো, তখন আমাদেরও শ্লোগান। ফারাক শুধু এটুকই যে সেই কামানের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ক্ষুধার্তবৃন্দও। পাবার কথাও নয়। কেননা ক্ষুধার্তদের লেখাপত্রই আমাদের শিখিয়ে ছিল--প্রতিষ্ঠানের চে’ও বড় শত্রু আত্মপ্রতিষ্ঠান। সেটারও বিরোধিতা করাটা একজন লেখকের অবশ্য কর্তব্য।
এসবের পাশাপাশি আমরাই প্রথম অবনী ধরের গল্প পুনর্মুদ্রণ করেছিলাম। আমরাই প্রথম প্রকাশ করেছিলাম ফালগুনি রায়ের কবিতা সঙ্কলন।
কিন্তু আমাদের কাজগুলো ক্ষুধার্তদের কাছে তো আমল পেলই না বরং আমাদের শ্লোগানগুলো ওদের কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল। নেতা হওয়াই যার জীবনের প্রধান লক্ষ্য, যিনি কোনদিনই বিরোধিতা সহ্য করতে পারেননি, মলয় হাজির হওয়ার পর যার আসন টলে উঠেছে সেই শৈলেশ্বর ঘোষ খুব স্বাভাবিক কারণেই আমাদের ওপরে চটে উঠলেন। সমস্ত কার্যকারণের প্রতিনিয়ত জবাবদিহি চাইতে লাগলেন। না, সরাসরি আমাদের কাছে নয়। অরুণেশ ঘোষের কাছে। কিন্তু অরুণেশ কী কৈফিয়ত দেবেন? আমরা তো ওঁকেও ছেড়ে কথা কইছি না! ব্যাখ্যা চাইছি ওঁর বক্তব্যের--
” সচেতন থাকার অর্থ জাগ্রত থাকা নয়,সীমাবদ্ধ থাকা। আমি এই সীমাবদ্ধতা কাটাতে চাই। একটা লেখার শুধু শব্দের দায়িত্ব কেন, তার দাড়ি-কমার দায়িত্বও একজন লেখক নেয়,যখন সে শুধু মাত্রই নির্মাণ করে। তৈরি করে। ইগো আর বুদ্ধি দিয়ে। আর যে তা করে না,যার ক্ষেত্রে একটা পুরো লেখা ‘হয়ে ওঠে’, সে শুধু শব্দের দায়িত্ব নেয়না, নেয় গোটা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের। তার জগতের। মূল কথা হল ‘লেখকের নিজস্ব জগৎ।’ সেটা ঠিক থাকলে সব ঠিক আছে। আর সেটা না থাকলে শব্দগুলো তো মৃত আবর্জনা মাত্র।”
কি বলবো এই চিন্তাকে অরুণেশদা, ক্ষুধার্ত চেতনা, নাকি হঠযোগ?
জাঁতাকল থেকে রেহাই পেতে এরপর অরুণেশ শিলিগুড়ি চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দিলেন। বন্ধ করে দিলেন কথাবার্তার সম্পর্কটুকুও। আমাদের মতো বালখিল্যদের কারণে শৈলেশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করাটা ওঁর কাছে অযৌক্তিক বোধ হলো।
কান্ডটা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেনি কারণ আমরা জানতাম দুজনের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের কথা। জানতাম শৈলেশ্বর সম্পর্কে ওঁর মূল্যায়ন,“ কিছু মানুষ, গোটা পৃথিবীতেই যাদেরকে আঙুলে গোনা যায়, যারা সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে ঘর ছেড়ে, যাদের এ কারণেই ভন্ড মিথ্যার পূজারী সমাজ পরিত্যক্ত শিশুর মতো ছুঁড়ে দিয়েছে অন্ধকারে পথের আবর্জনায়, শৈলেশ্বর তাদেরই একজন।”
আহা, ভাবতে খারাপ লাগে, আর মোটে কয়েকটা মাস বেঁচে থাকলেই অরুণেশ জেনে যেতে পারতেন বন্ধুর পশ্চিমবঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন মেলার উদ্বোধনের দায়িত্ব পাবার খবর। জেনে স্বস্তি পেতেন, ভন্ড মিথ্যার পূজারী সমাজ পরিত্যক্ত শিশুর মতো যাদের ছুঁড়ে দিয়েছে অন্ধকারে পথের আবর্জনায়, শৈলেশ্বর তাদেরই একজন নয় আর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন