কোনো একটা অনুষ্ঠানে অশোক মিত্রর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বামফ্রন্টের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী, ‘কবিতা থেকে মিছিলে’র লেখক। আরও অজস্র বই আছে ওঁর কিন্তু ‘কবিতা থেকে মিছিলে’ একটি অবশ্যপাঠ্য বই। অন্ততঃ আমাদের সময়ে তেমনটাই ছিল।
সবাই জানেন উনি খুব চাঁচাছোলা গোত্রের মানুষ ছিলেন। আমি জেনেছিলাম ওর আপাত রুক্ষতার আড়ালে কোমল মনটার কথা।
সেই অনুষ্ঠানে আমিই কিছু চাঁচাছোলা মার্কা কথা বলেছিলাম, প্রধান অতিথির চেয়ারে বসে উনি শুনেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে আমাকে ডেকে কথা বলেছিলেন।
তারপর থেকে ডঃ মিত্র আমাকে পোস্টকার্ড লিখতেন, আমিও উত্তর দিতাম। কোলকাতায় এলে দেখা করতাম। দীর্ঘক্ষণ চলতো আড্ডাপর্ব। বিষয় হোত অবশ্যই রাজনীতি এবং সাহিত্য। কখনও ওঁর স্ত্রীও এসে বসতেন। আড্ডার যা নিয়ম, তর্কবিতর্কও হোত। আমাকে যারা জানেন তারা জানেন বিতর্কের সময় প্রতিপক্ষকে রেয়াত করার অভ্যেস আমার কোনো কালেই নেই। এ কারণে অনেকেই আমাকে এড়িয়ে চলেন। বলাবাহুল্য তারা কেউ অশোক মিত্র নন।
তো একবার মানিক বন্দ্যোপাধায়কে নিয়ে কথাবার্তা চলছিল। ডঃ মিত্র পদ্মা নদীর মাঝি বিষয়ে বলছিলেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। ইচ্ছে ছিল পুতুল নাচের ইতিকথা বিষয়ে কিছু কথা শোনার কিন্তু উনি উপন্যাসটিকে গুরুত্ব দিলেন না। এরপর আমার সবচে প্রিয় উপন্যাস ‘দিবারাত্রির কাব্য’ প্রসঙ্গ উঠতেই উনি বলে বসলেন, কাঁচা লেখা। ব্যস, আমারও মাথা গরম হয়ে উঠলো। ঠাস করে বলে দিলাম, আপনি সাহিত্যই বোঝেন না। সব সময় মার্কসবাদের ভূত আপনার মাথায় ঘোরে।
এক পলকের জন্য থমকালেন না অশোক মিত্র। বরং মাথা হেলিয়ে বললেন, হোতে পারে।
হুঁশ ফিরতেই আমার মাথায় বাজ, কাকে কী বললাম! কিন্তু উনি নির্বিকার, আপনার যেটা মনে হয়েছে সেটা বলতেই পারেন। অসুবিধে কীসের! হোতেই তো পারে আমার ভাবনায় কোথাও ভুল রয়েছে। কথাবার্তা নাহলে বুঝব কিভাবে!
তো একবার অশোক মিত্রকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি তো বলেছিলেন যে আপনি কমিউনিস্ট, ভদ্রলোক নন, তাহলে চৌরঙ্গী কেন্দ্রে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন কেন? কি ভেবেছিলেন, ওখানকার ভদ্রলোকেরা আপনাকে ভদ্রলোক ভেবে জিতিয়ে দেবেন?
উত্তর দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা দেখাননি অশোক মিত্র। অকপটে বলেছিলেন, আমার তো সেবার ভোটে দাঁড়ানোরই কথা ছিল না। হারের ভয়ে সিদ্ধার্থ রায়ের বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী হোতে রাজী হচ্ছিলেন না। জ্যোতি বসু আমাকে অনুরোধ করলেন, আমিও শহীদ হোতে রাজী হয়ে গেলাম।আমি তো ভদ্রলোক নই, লজ্জা কিসের!
ভদ্রলোকি প্রসঙ্গে যখন এত কথাই শুনলেন তখন নাহয় আরও খানিকটা শুনলেন। যদিও এই ভদ্রলোক প্রসঙ্গে ইতিপূর্ব কিছু কথা বলেছি কিন্তু সেটুকু ওঁর জন্য যথেষ্ট নয়। সেই ভদ্রলোক হলেন মলয় রায়চৌধুরী। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। আমি জেনেশুনেই মলয় রায়চৌধুরীকে ভদ্রলোক অভিধাটি দিচ্ছি। কারণ--
ক) উনি সাবর্ণ চৌধুরী বংশজাত।
খ) উনি ইকনোমিক্সের তুখোড় ছাত্র, লন্ডন স্কুল অফ ইকনোমিক্সে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল, ক্ষুধার্ত আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে সম্ভব হয়নি।
গ) উনি প্রাক যৌবনেই বিদেশী সাহিত্য গুলে খেয়েছিলেন।
ঘ) উনি শৈশবে পটনার ইমলিতলায় ছোটলোকদের সঙ্গে বেড়ে উঠতে বাধ্য হলেও ‘হাংরি’ শব্দটা ধার করেছিলেন চসারের লেখা থেকে। পত্রিকার নামও তাই রেখেছিলেন, ‘হাংরি জেনারেশন।’ প্রথম কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন খাস ইংরেজিতে।
ঙ) উনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অতি উচ্চপদে চাকরি করতেন। তিরাশি সালেই বেতন ছিল দৈনিক একশ সত্তর টাকারও বেশী অর্থাৎ ৫১০০/ এরও বেশী।
চ) উনি আন্তর্জাতিক যোগাযোগে রীতিমত চ্যাম্প। ক্ষুধার্ত মামলায় ফেঁসে যাবার কালে খোদ গিন্সবার্গ দিয়ে চিঠি লিখিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর সহকারীকে।
ছ) অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্টের বিগ বস।
জ) রূপোলী পর্দার আগ্রহ।
ঝ) ষাটের দশকে, যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না তখনই বিশ্বের তাবড় তাবড় মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এখন তো পৃথিবীর কোণে কোণে মে হাংরি আন্দোলন তথা নিজেকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর বদৌলতেই আজ হাংরি জেনারেশান মুভমেন্টের নিজস্ব ওয়েব সাইট রয়েছে।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, ওপরের একটি তথ্যও কিন্তু আমার স্বকপোল কল্পিত নয়, সবগুলোই সাপ্লায়েড বাই খোদ মলয় রায়চৌধুরী। এরপরও কারো কোনো তথ্য জানতে হলে সরাসরি মলয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। ভদ্রলোক উদার। ওঁর একটি কবিতা সংকলনের নাম--যা লাগবে বলবেন।
তো ভদ্রলোক চিরকাল ‘ আমি’র শব্দরূপ লিখে গেলেন। ব্যাকরণ কৌমুদী তো “ ময়ি-আবয়োঃ-অস্মাসু” অবধি লিখেই যথেষ্ট মনে করেছিল কিন্তু মলয়দা ওটুকুতে সন্তুষ্ট না হয়ে দিনের পর দিন স্টক বাড়িয়েই নিয়েছেন। আজও সমান গতিতে চলছে ওঁর বর্ধমান এক্সপ্রেস। সঙ্গে রয়েছে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের অক্ষয় তূণীর। যাকেই মনে হবে বিপরীত অক্ষের মানুষ তাকেই লক্ষ্য করবেন।
মলয়দার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনধিক ছত্রিশ বছরের। ভদ্র এবং অস্পষ্টবাদী হিসেবে আমারও তো কোনদিনই সুনাম নেই তাহলে এতগুলো বছর ধরে মলয় রায়চৌধুরীর ঝাঁঝ সামলালাম কিভাবে? প্রথম পত্রাঘাতই আমার পক্ষে যতটা অস্বস্তিকর হয়েছিল তাতে এরপর দুজনের ভেতর দুস্তর ব্যবধান জেগে ওঠাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু হয়নি।হয়নি কারণ ওঁর মনের জোর আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
মাত্র আঠাশ বছরে স্ট্রোকে আক্রান্ত মলয়দাকে আমি যে বয়সে দেখেছি তখন তাঁর শারীরিক অবস্থা এমনই ছিল যে অন্য কেউ হলে পঙ্গু বলা যেত। ওই যে বলেছিলাম, কাঁপা কাঁপা হস্তাক্ষর, কারণটা ছিল ঠিকঠাক কলম ধরতে না পারা। মুঠো করে কলম ধরতেন। আমি দেখেছি মলয়দার ঘাড় কাঁপতে। এহেন দশায় এত অজস্র লেখা, আক্রমণ শানানো, ওফ, সেরেফ মলয় রায়চৌধুরী বলেই সম্ভব। যাকে বলে দানব প্রতিভা। সাধে কী সুভাষ ঘোষ বলেছিলেন, "মলয় যদি ‘আমি’ রোগটা সারাতে পারাতো তাহলে বাংলা সাহিত্যকে খেল দেখিয়ে দিতে পারতো।”
জানি, সুভাষের এই কথা মলয়দা বিশ্বাস করবেন না কারণ সুভাষের সঙ্গে শত্রুতার ব্যাপারটা তিনি প্রায় কলতলার ঝগড়ার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। যেমন, বেশ্যার ঘরে গিয়ে সুভাষের বীরপুরুষগিরি না দেখাতে পারা কিংবা সুভাষের শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই থাকা, ইত্যাদি প্রভৃতি নানান টক-ঝাল-মিষ্টি প্রায়শই পরিবেশন করে থাকেন।
প্রথমটার কথা বলতে পারবো না কারণ আমাদের সঙ্গে সুভাষদার তেমন সম্পর্ক ছিল না। তবে দ্বিতীয়টার কথা বলতে পারবো কারণ স্টেশন চত্বরে চাটাই বিছিয়ে আনাজ বিক্রি করা জমিদার(!) শ্রীললিতমোহন সাহার রাজগৃহে আমরা থেকেছি। দেখেছি চৌধরি ললিতবাবুর একমাত্র রাজকন্যা শ্রীমতি কনক সাহা ওরফে কনক ঘোষের স্কুলে চাকরির সুবাদে টিনের চাল আর বেড়ার সেই ঘরকে এক কামরার পাকা ঘরে পরিণত করার লড়াই। দেখেছি রাজা ললিতমোহনের দীর্ঘজীবি রানীকে জীবনের শেষ কিছু বছর উন্মাদ দশায় কাটাতে। অনুভব করেছি, কনকদির মা, সন্তান এবং সুভাষদাকে দেখভাল করার প্রাণান্তকর লড়াই। দেখেছি, আচমকা আমাদের উপস্থিতিতে বিরক্ত না হোতে। মাটিতে শুতে হলেও আমরা কিন্তু প্রাসাদের তৃপ্তিই পেয়েছি।
আমরা যখন জানি এসব তখন মলয় কি জানেন না? আলবত জানেন। ওঁর স্যাটফোন ডিসকানেক্ট করার ক্ষমতা কোনো টর্নেডোরই নেই। তবু বলেন ওসব। হয়ত নিজেকে ডি-ক্লাসড প্রমাণ করতে এসব বলেন। বলুনগে। ওসব কথায় কিছু মনে করারও কারণ নেই, খোট্টা রসিকতার ধরণ এমনই হয়। মরদানি ওদের কাছে বহোত বঢ়া চিজ।
সে যাগ্গে, এরপর থেকে যেখানে যত লেখাপত্র প্রকাশিত হোত মলয়দা নিয়মিত সেসবের জেরক্স কপি আমাকে পাঠাতেন। একবার এক পোস্টকার্ডে মলয় জানিয়েছিলেন, কোলকাতায় আমার দাদা থাকে। হাওয়া ৪৯ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেখা কোরো।
ঠিকানাও দেয়া ছিল ওই পোস্টকার্ডে কিন্তু আগ্রহ ছিল না আমার। মলয়ের অহঙের রেলিঙই ডিঙোতে পারি না তার পরে আবার ওঁর দাদা! কাজ নেই। অত লোড নেয়া যাবে না। তাছাড়া যেটুকু শুনেছিলাম তাতে মানুষটাকে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি।
কিন্তু সময়ের দাবীকে অস্বীকার করবে কে? পরিচয় হলো সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে। কী আশ্চর্য, দু ভাইয়ে এত ফারাক! পান্ডিত্য, সহিষ্ণুতা, বিনয়, আন্তরিকতা, অন্যের লেখার প্রতি আগ্রহ, সবকিছু মিলিয়ে মানুষটি যেন প্রবাদ প্রতীম। আমার এই বিশেষণগুলো যে বানিয়ে বানিয়ে বলা নয় সেটা যারা সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে মিশেছেন তারা জানেন। সুতরাং সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেরী হলো না। সেই নিবিড় সম্পর্ক সমীরদার মৃত্যু অবধি জারী ছিল।
আমার সম্পাদিত গল্পবিশ্ব পত্রিকায় একটি ক্রোড়পত্রও প্রকাশিত হয়েছিল সমীরদাকে নিয়ে। সেখানে মলয় রায়চৌধুরীকে ইচ্ছে করেই লেখক হিসেবে নির্বাচন করিনি। কারণ আমি চেয়েছিলাম, সমীর রায়চৌধুরী মানে শুধুই মলয় রায়চৌধুরীর দাদা, এই গড়ে দেয়া ধারণাটাকে ভেঙে দিতে। চেয়েছিলাম পাঠক যাতে সমীর রায়চৌধুরীকে নিজ বৈশিষ্ট্যে খুঁজে নিতে পারেন।
সমীর রায়চৌধুরী প্রসঙ্গে অনেক কিছু বলার আছে কিন্তু সেসবের জন্য এই পরিসর উপযুক্ত নয়। এখানে শুধুই মলয় রায়চৌধুরী।
সমীরদা পড়তে দিয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম উপন্যাস--ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস।বেশ কিছুদিন না পড়ে ফেলে রেখেছিলাম। কারণ মলয়ের কবিতা কোনদিনই পছন্দ হয়নি আমার। এমন কী ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ পড়েও তেমন আহামরি কিছু লাগেনি। মনে হয়েছে বিদেশী কবিতার অনুসরণ। কিন্তু উপন্যাসটা পড়ে চমকে উঠেছিলাম, এ কোন মলয় রায়চৌধুরী! অনর্গল আঁচড়ানি কামড়ানির ফাঁকে ফাঁকে কিভাবে রপ্ত করলেন এই ভাষা! কর্কশ মানুষটার ভেতরে এই পেলব কথনভঙ্গী ছিল নাকি কখনও? মানুষের অন্তরকে খুঁটিয়ে দেখার মতো রঞ্জন রশ্মি ছিল নাকি ওঁর চোখে! ছিল নাকি এতটা সোহাগ, প্রশ্রয় ওঁর অন্তরে? কই, টের পাইনি তো!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন