বইমেলা থেকে ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরলাম। কাঁধে করে নিয়ে এলাম ক্ষুধার্ত
পত্রিকা এবং ক্ষুধার্ত লেখকদের বইপত্র। মাথার ভেতর ঠেসে আনলাম অরূপ
বাণী--হাও টু বি এ গুড প্রতিষ্ঠান বিরোধী ( ওরফে ক্ষুধার্ত)। শুধু মাথায়
রাখাটা যেহেতু যথেষ্ট নয় তাই সেসব জ্ঞান উগরে দিলাম যে যার কলমে। প্রকাশিত
হোতে শুরু করলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।যথারীতি বিজ্ঞাপনের তোয়াক্কা না রেখে
পকেটের টাকায়।
মনোজ রাউতের ধৃতরাষ্ট্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করা হলো শৈলেশ্বর ঘোষের প্রবন্ধ সংকলন, ‘প্রতিবাদের সাহিত্য।’ অরুণেশ ঘোষের গদ্যগ্রন্থ,‘অপরাধ আত্মার নিষিদ্ধ যাত্রা।’ গাঁটের একটা কড়িও না খরচ করে বই প্রকাশের মত মহান ঘটনা দুজনের জীবনেই সেই প্রথম।
যথারীতি তুলকালাম কান্ড ঘটে গেল উত্তরবঙ্গের সাহিত্য জগতে। আমাদের ভেতরে ক্ষুধার্ত আন্দোলনের পুনরুত্থানের ভূত দেখতে থাকলো উত্তরবঙ্গ সাহিত্য প্রতিষ্ঠান। কিভাবে আমাদের প্রতিহত করা যায় সেসবের পরিকল্পনা ভাঁজা শুরু হলো। সে এক উৎকট পরিস্থিতি। প্রতিষ্ঠানের স্ব-নিযুক্ত দালালবৃন্দ না পারছে আমাদের অস্বীকার করতে, না পারছে স্বীকার করতে।
ঘটনা প্রবাহ যেদিকে চলছিল তাতে হয়তো সত্যি সত্যিই ক্ষুধার্ত আন্দোলনের পুনারুত্থান ঘটে যেত এবং নকশাল আন্দোলনের মতো উত্তরবঙ্গই হোত তার এপিসেন্টার। কিন্তু কী আশ্চর্য, ঘটনা গড়ালো উল্টো দিকে! ক্ষুধার্তদের বই/পত্রিকা যত পড়ি তত বিভ্রান্তি বাড়ে। আবিষ্কার করি, সুভাষ এবং শৈলেশ্বরের চিন্তা ভাবনার মধ্যে থাকা বিস্তর ফারাক! প্রদীপ চৌধুরীর পত্রিকা পড়ে বিভ্রান্তি বেড়ে দ্বিগুণ হয়। অরুণেশ ঘোষের লেখাপত্র থেকে সেই বিভ্রান্তি বেড়ে দাঁড়ায় চৌগুণ। সুবো আচার্য তো শ্রীশ্রী ঠাকুরের পাদপদ্মে বিশ্বরূপ দর্শন করছেন! সুবিমল বসাক সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। কেন?
ভাবনায় পড়ে যাই, কোনটাকে বলব ক্ষুধার্ত চেতনা! কেউ লিখছেন প্রতিবাদের সাহিত্য কেউ বলছেন প্রতিবাদ নাকি প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়! কেউ একগাছা দড়ির এক প্রান্ত নিজের কোমরে বেঁধে অন্য প্রান্ত অসীমের কোমরে বাঁধার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তো অন্য জন গা-গতরের শব্দ ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছে! কেউ লিখছে জাদুবাস্তববাদী গল্প কেউ বলছে লেখাকে মিথ, মেটাফর, অ্যালিগরি মুক্ত করতে। যামু কই? একজন ক্ষুধার্ত আন্দোলনের মৃত্যু ঘোষণা করছেন, অন্যজন সর্বধর্ম সমন্বয়ের চেষ্টা করে বলেছেন, ক্ষুধার্ত চেতনা যার যার তার তার। বেশ। মেনে নেয়াই যেত কিন্তু তাহলে ক্ষুধার্ত সাহিত্য ওদের ঘোষনা মোতাবেক আন্দোলন হয় কিভাবে! বিচ্ছিন্ন কর্মসূচিকে আন্দোলন বলা যায়?
আমাদের এই দোলাচলের মাঝে ঘটে গেল আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাহিত্য সমুদ্রে মাথা চাড়া দিলো সাবমেরিন মলয়।মলয় রায়চৌধুরীকে সাবমেরিন বলার কারণ মামলার নিষ্পত্তির পর মলয় রীতিমত ডিক্লেয়ার করে ক্ষুধার্তদের সঙ্গে যাবতীয় সংশ্রব ত্যাগ করেছিলেন এবং জীবিকার উন্নতিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু উনি যে তলে তলে আক্রমণ হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেটা বোঝা যায়নি।
সব জানপহেচান চুরমার করে দিতে ‘পথের পাঁচালি’ পত্রিকায় ভেসে উঠলেন মলয়।এবং কামান দাগলেন। খানিকটা চুনসুরকি খসে পড়লো। উঁকি দিলো ইটের সামান্য অংশ। জানা গেল, শৈলেশ্বর ঘোষ নয়, মলয় রায়চৌধুরীই ছিলেন ওই আন্দোলনের মূল হোতা। জানা গেল, ক্ষুধার্তদের অনেকেই হাজতে মুচলেকা দিয়ে জামিন নিয়েছিলেন। এবং সে কারণেই মলয় রায়চৌধুরীর জামিন মিলতে ঝামেলা হয়েছিল।
সামান্য চুনসুরকির খসে পড়া থেকে খানিকটা জানা গেল বটে কিন্তু মানা গেল কি? না। সেটা সম্ভবও নয় কারণ একেই তো ভিন্ন ইতিহাস জানছি অন্যদিকে জানা ইতিহাসের মালিকরা চোখের সামনে। সেদিক থেকে মলয় রায়চৌধুরী সম্পূর্ণ অচেনা। তার ওপরে আবার বাড়তি বোঝা মলয়ের উৎকট বুক চাপড়ানি। তাছাড়াও ওই লেখায় এত আঙসাঙ কথা ছিল যে চট করে বিশ্বাস করতে অসুবিধেই হয়েছিল।
হয়ত খামতিটা মলয়ও বুঝেছিলেন তাই পরের মিসাইলটা দাগলেন ডঃ উত্তম দাশের হাত দিয়ে। ডঃ দাশ তার ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তাতে মালমশলা হিসেবে ব্যবহার করলেন মামলা সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র। কেস ডায়েরি, মুচলেকা, সাক্ষদান পর্ব, আদালতের রায়, সবকিছুর সার্টিফায়েড কপি এই প্রথমবার প্রকাশ্যে এলো। ফলে এই বিস্ফোরণটির তীব্রতা ছিল মারাত্মক। প্রকৃত সত্য জানাজানি হয়েছিল। আমরাও বুঝলাম একদা শৈলেশ্বর দ্বারা পেশ করা তথ্যের পুরোটাই ছিল গোঁজামিলে ভরা।
মহাদিগন্ত পত্রিকাটা আমার হাতে এসেছিল অদ্ভুত ভাবে। এবার সেই গল্প।
কোচবিহার থেকে অরুণেশদাকে নিয়ে আমি, রাজা, মনোজ রওনা দিয়েছিলাম মাথাভাঙার উদ্দেশ্যে।হঠাৎ মাথাভাঙা কেন? কারণ পৃথিবীতে ওটাই একমাত্র স্থান যেখানে অরুণেশদা খুব স্বচ্ছন্দ থাকতেন। এই স্বাচ্ছন্দ যোগানোর দায়ভার স্বেচ্ছায় নিয়েছিল মাথাভাঙা বয়েজগণ। কারা তারা? তারা প্রায় প্রত্যেকই বিখ্যাত কবি। যেমন নিত্য মালাকার,সন্তোষ সিংহ, অনুভব সরকার, কমল সাহা।
নবদ্বীপ থেকে মাথাভাঙায় গিয়ে থিতু হওয়া নিত্য মালাকারের কবি পরিচয় বাংলা কবিতা জগতের প্রায় সবাই জানেন। জানেন সন্তোষ সিংহের কথাও। তবে সন্তোষদা সম্পর্কে একটা বিশেষ তথ্য হয়ত অনেকের জানা নেই সেটা হলো স্বপ্নে পাওয়া বেশকিছু কবিতা নিয়ে একটা বই আছে সন্তোষদার যার ভূমিকা লিখেছিলেন ডঃ অশ্রুকুমার সিকদার।
সবচে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো স্বভূমিকায় এরা প্রত্যেকে উজ্জ্বল হওয়া সত্বেও এদের অরুণেশ অনুরাগ ছিল অসীম। প্রায় শেষদিন পর্যন্ত অরুণেশ ঘোষকে ওরা ভালোবাসা দিয়েছেন। সব রকম ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন অরুণেশ ঘোষের।
বিষয়টাকে আশ্চর্যজনক বলার কারণ অসূয়াক্লিন্ন সাহিত্য পরিবেশে এমন প্রীতি সহজে চোখে পড়ে না। বলাবাহুল্য অরুণেশদারও যথেষ্ট প্রিয়স্থান ছিল মাথাভাঙা, তা তিনি যতই বলুন না কেন জটেশ্বরের বেশ্যাপাড়ার পরিবেশই ছিল তাঁর কাছে প্রিয়তম স্থান।
মাথাভাঙার কথা বলতে গিয়ে আরও একজনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে--সুব্রত রায়। কবিতা লেখা এবং কবিতা কেন্দ্রিক জীবন যাপন, দুটো নেশাতেই বুঁদ ছিল। এমন ছেলের কাছে অরুণেশ ঘোষ যে একমাত্র অনুসরণযোগ্য কবি হবেন তাতে আর সন্দেহ কিসের?
বেশীদিন কবিতা লিখতে পারেনি সুব্রত। বেঁচে থাকলে তো লিখবে? আত্মহত্যা করেছিল। হয়ত আরো আগেই কাজটা করে বসতো নেহাত সন্তোষদা প্রতিনিয়ত তার প্রিয় ছাত্রটিকে আগলে রাখার চেষ্টা করতেন তাই কিছুদিন বাড়তি আয়ু পেয়েছিল সুব্রত।
আমরা অনন্য, ফালগুনি এবং এরকম আরও কিছু নাম জানি কিন্তু পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে ওরকম কত যুবক যে উন্মাদের মতো সাহিত্যকে ভালোবেসে সর্বস্বান্ত হয়েছে তাদের খবরও রাখি না! আজ মনে হয়, সাহিত্যকে বোধহয় পরস্ত্রীর মতো ভালোবাসতে হয়। কামনা যতই উদগ্র হোক তাতে বাধ্যতামূলক ভাবেই খানিকটা সংযম বজায় রাখতে হয়।এই সম্পর্ককে কখনও পরিণতি দিতে চাইতে নেই, চোরাগোপ্তা আকর্ষণটুকু বজায় রেখে চলতে হয়।
থাক তত্ত্বকথা, ওই সফরেই অরুণেশের ব্যাগে আচমকা পেয়ে গিয়েছিলাম ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকার সেই সংখ্যাটি। কিন্তু অরুণেশদা কিছুতেই দেবেন না পত্রিকাটা, ভালো কইরে বোঝার চেষ্টা করো হাংরি ফিলজফিটারে। আগেই এই সব ল্যাখা পড়লে সব গুলায় যাবে।
কিন্তু আমাকে রুখিবে কে! প্রায় জবরদস্তি ম্যাগাজিনটা কেড়ে নিয়ে কোচবিহার থেকে মাথাভাঙা যাত্রাপথে ভিড় বাসের মেঝেতে বসে পত্রিকাটা শেষ করেছিলাম। এবং স্বীকার করতে বাধা নেই, সত্যিই মাথার ভেতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। কারণ সেদিনই তথ্য প্রমাণে জেনেছিলাম শৈলেশ্বর ঘোষ রচিত ‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি শূণ্য বিছানায়’ কবিতাটা নয় বরং মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটাকেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। জেনেছিলাম, হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট মলয়ের নেতৃত্বেই ঘটেছিল এবং কেসটাও সাজানো হয়েছিল মলয়েরই বিরুদ্ধে।
মনোজ রাউতের ধৃতরাষ্ট্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করা হলো শৈলেশ্বর ঘোষের প্রবন্ধ সংকলন, ‘প্রতিবাদের সাহিত্য।’ অরুণেশ ঘোষের গদ্যগ্রন্থ,‘অপরাধ আত্মার নিষিদ্ধ যাত্রা।’ গাঁটের একটা কড়িও না খরচ করে বই প্রকাশের মত মহান ঘটনা দুজনের জীবনেই সেই প্রথম।
যথারীতি তুলকালাম কান্ড ঘটে গেল উত্তরবঙ্গের সাহিত্য জগতে। আমাদের ভেতরে ক্ষুধার্ত আন্দোলনের পুনরুত্থানের ভূত দেখতে থাকলো উত্তরবঙ্গ সাহিত্য প্রতিষ্ঠান। কিভাবে আমাদের প্রতিহত করা যায় সেসবের পরিকল্পনা ভাঁজা শুরু হলো। সে এক উৎকট পরিস্থিতি। প্রতিষ্ঠানের স্ব-নিযুক্ত দালালবৃন্দ না পারছে আমাদের অস্বীকার করতে, না পারছে স্বীকার করতে।
ঘটনা প্রবাহ যেদিকে চলছিল তাতে হয়তো সত্যি সত্যিই ক্ষুধার্ত আন্দোলনের পুনারুত্থান ঘটে যেত এবং নকশাল আন্দোলনের মতো উত্তরবঙ্গই হোত তার এপিসেন্টার। কিন্তু কী আশ্চর্য, ঘটনা গড়ালো উল্টো দিকে! ক্ষুধার্তদের বই/পত্রিকা যত পড়ি তত বিভ্রান্তি বাড়ে। আবিষ্কার করি, সুভাষ এবং শৈলেশ্বরের চিন্তা ভাবনার মধ্যে থাকা বিস্তর ফারাক! প্রদীপ চৌধুরীর পত্রিকা পড়ে বিভ্রান্তি বেড়ে দ্বিগুণ হয়। অরুণেশ ঘোষের লেখাপত্র থেকে সেই বিভ্রান্তি বেড়ে দাঁড়ায় চৌগুণ। সুবো আচার্য তো শ্রীশ্রী ঠাকুরের পাদপদ্মে বিশ্বরূপ দর্শন করছেন! সুবিমল বসাক সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। কেন?
ভাবনায় পড়ে যাই, কোনটাকে বলব ক্ষুধার্ত চেতনা! কেউ লিখছেন প্রতিবাদের সাহিত্য কেউ বলছেন প্রতিবাদ নাকি প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়! কেউ একগাছা দড়ির এক প্রান্ত নিজের কোমরে বেঁধে অন্য প্রান্ত অসীমের কোমরে বাঁধার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তো অন্য জন গা-গতরের শব্দ ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছে! কেউ লিখছে জাদুবাস্তববাদী গল্প কেউ বলছে লেখাকে মিথ, মেটাফর, অ্যালিগরি মুক্ত করতে। যামু কই? একজন ক্ষুধার্ত আন্দোলনের মৃত্যু ঘোষণা করছেন, অন্যজন সর্বধর্ম সমন্বয়ের চেষ্টা করে বলেছেন, ক্ষুধার্ত চেতনা যার যার তার তার। বেশ। মেনে নেয়াই যেত কিন্তু তাহলে ক্ষুধার্ত সাহিত্য ওদের ঘোষনা মোতাবেক আন্দোলন হয় কিভাবে! বিচ্ছিন্ন কর্মসূচিকে আন্দোলন বলা যায়?
আমাদের এই দোলাচলের মাঝে ঘটে গেল আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাহিত্য সমুদ্রে মাথা চাড়া দিলো সাবমেরিন মলয়।মলয় রায়চৌধুরীকে সাবমেরিন বলার কারণ মামলার নিষ্পত্তির পর মলয় রীতিমত ডিক্লেয়ার করে ক্ষুধার্তদের সঙ্গে যাবতীয় সংশ্রব ত্যাগ করেছিলেন এবং জীবিকার উন্নতিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু উনি যে তলে তলে আক্রমণ হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেটা বোঝা যায়নি।
সব জানপহেচান চুরমার করে দিতে ‘পথের পাঁচালি’ পত্রিকায় ভেসে উঠলেন মলয়।এবং কামান দাগলেন। খানিকটা চুনসুরকি খসে পড়লো। উঁকি দিলো ইটের সামান্য অংশ। জানা গেল, শৈলেশ্বর ঘোষ নয়, মলয় রায়চৌধুরীই ছিলেন ওই আন্দোলনের মূল হোতা। জানা গেল, ক্ষুধার্তদের অনেকেই হাজতে মুচলেকা দিয়ে জামিন নিয়েছিলেন। এবং সে কারণেই মলয় রায়চৌধুরীর জামিন মিলতে ঝামেলা হয়েছিল।
সামান্য চুনসুরকির খসে পড়া থেকে খানিকটা জানা গেল বটে কিন্তু মানা গেল কি? না। সেটা সম্ভবও নয় কারণ একেই তো ভিন্ন ইতিহাস জানছি অন্যদিকে জানা ইতিহাসের মালিকরা চোখের সামনে। সেদিক থেকে মলয় রায়চৌধুরী সম্পূর্ণ অচেনা। তার ওপরে আবার বাড়তি বোঝা মলয়ের উৎকট বুক চাপড়ানি। তাছাড়াও ওই লেখায় এত আঙসাঙ কথা ছিল যে চট করে বিশ্বাস করতে অসুবিধেই হয়েছিল।
হয়ত খামতিটা মলয়ও বুঝেছিলেন তাই পরের মিসাইলটা দাগলেন ডঃ উত্তম দাশের হাত দিয়ে। ডঃ দাশ তার ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তাতে মালমশলা হিসেবে ব্যবহার করলেন মামলা সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র। কেস ডায়েরি, মুচলেকা, সাক্ষদান পর্ব, আদালতের রায়, সবকিছুর সার্টিফায়েড কপি এই প্রথমবার প্রকাশ্যে এলো। ফলে এই বিস্ফোরণটির তীব্রতা ছিল মারাত্মক। প্রকৃত সত্য জানাজানি হয়েছিল। আমরাও বুঝলাম একদা শৈলেশ্বর দ্বারা পেশ করা তথ্যের পুরোটাই ছিল গোঁজামিলে ভরা।
মহাদিগন্ত পত্রিকাটা আমার হাতে এসেছিল অদ্ভুত ভাবে। এবার সেই গল্প।
কোচবিহার থেকে অরুণেশদাকে নিয়ে আমি, রাজা, মনোজ রওনা দিয়েছিলাম মাথাভাঙার উদ্দেশ্যে।হঠাৎ মাথাভাঙা কেন? কারণ পৃথিবীতে ওটাই একমাত্র স্থান যেখানে অরুণেশদা খুব স্বচ্ছন্দ থাকতেন। এই স্বাচ্ছন্দ যোগানোর দায়ভার স্বেচ্ছায় নিয়েছিল মাথাভাঙা বয়েজগণ। কারা তারা? তারা প্রায় প্রত্যেকই বিখ্যাত কবি। যেমন নিত্য মালাকার,সন্তোষ সিংহ, অনুভব সরকার, কমল সাহা।
নবদ্বীপ থেকে মাথাভাঙায় গিয়ে থিতু হওয়া নিত্য মালাকারের কবি পরিচয় বাংলা কবিতা জগতের প্রায় সবাই জানেন। জানেন সন্তোষ সিংহের কথাও। তবে সন্তোষদা সম্পর্কে একটা বিশেষ তথ্য হয়ত অনেকের জানা নেই সেটা হলো স্বপ্নে পাওয়া বেশকিছু কবিতা নিয়ে একটা বই আছে সন্তোষদার যার ভূমিকা লিখেছিলেন ডঃ অশ্রুকুমার সিকদার।
সবচে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো স্বভূমিকায় এরা প্রত্যেকে উজ্জ্বল হওয়া সত্বেও এদের অরুণেশ অনুরাগ ছিল অসীম। প্রায় শেষদিন পর্যন্ত অরুণেশ ঘোষকে ওরা ভালোবাসা দিয়েছেন। সব রকম ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন অরুণেশ ঘোষের।
বিষয়টাকে আশ্চর্যজনক বলার কারণ অসূয়াক্লিন্ন সাহিত্য পরিবেশে এমন প্রীতি সহজে চোখে পড়ে না। বলাবাহুল্য অরুণেশদারও যথেষ্ট প্রিয়স্থান ছিল মাথাভাঙা, তা তিনি যতই বলুন না কেন জটেশ্বরের বেশ্যাপাড়ার পরিবেশই ছিল তাঁর কাছে প্রিয়তম স্থান।
মাথাভাঙার কথা বলতে গিয়ে আরও একজনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে--সুব্রত রায়। কবিতা লেখা এবং কবিতা কেন্দ্রিক জীবন যাপন, দুটো নেশাতেই বুঁদ ছিল। এমন ছেলের কাছে অরুণেশ ঘোষ যে একমাত্র অনুসরণযোগ্য কবি হবেন তাতে আর সন্দেহ কিসের?
বেশীদিন কবিতা লিখতে পারেনি সুব্রত। বেঁচে থাকলে তো লিখবে? আত্মহত্যা করেছিল। হয়ত আরো আগেই কাজটা করে বসতো নেহাত সন্তোষদা প্রতিনিয়ত তার প্রিয় ছাত্রটিকে আগলে রাখার চেষ্টা করতেন তাই কিছুদিন বাড়তি আয়ু পেয়েছিল সুব্রত।
আমরা অনন্য, ফালগুনি এবং এরকম আরও কিছু নাম জানি কিন্তু পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে ওরকম কত যুবক যে উন্মাদের মতো সাহিত্যকে ভালোবেসে সর্বস্বান্ত হয়েছে তাদের খবরও রাখি না! আজ মনে হয়, সাহিত্যকে বোধহয় পরস্ত্রীর মতো ভালোবাসতে হয়। কামনা যতই উদগ্র হোক তাতে বাধ্যতামূলক ভাবেই খানিকটা সংযম বজায় রাখতে হয়।এই সম্পর্ককে কখনও পরিণতি দিতে চাইতে নেই, চোরাগোপ্তা আকর্ষণটুকু বজায় রেখে চলতে হয়।
থাক তত্ত্বকথা, ওই সফরেই অরুণেশের ব্যাগে আচমকা পেয়ে গিয়েছিলাম ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকার সেই সংখ্যাটি। কিন্তু অরুণেশদা কিছুতেই দেবেন না পত্রিকাটা, ভালো কইরে বোঝার চেষ্টা করো হাংরি ফিলজফিটারে। আগেই এই সব ল্যাখা পড়লে সব গুলায় যাবে।
কিন্তু আমাকে রুখিবে কে! প্রায় জবরদস্তি ম্যাগাজিনটা কেড়ে নিয়ে কোচবিহার থেকে মাথাভাঙা যাত্রাপথে ভিড় বাসের মেঝেতে বসে পত্রিকাটা শেষ করেছিলাম। এবং স্বীকার করতে বাধা নেই, সত্যিই মাথার ভেতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। কারণ সেদিনই তথ্য প্রমাণে জেনেছিলাম শৈলেশ্বর ঘোষ রচিত ‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি শূণ্য বিছানায়’ কবিতাটা নয় বরং মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটাকেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। জেনেছিলাম, হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট মলয়ের নেতৃত্বেই ঘটেছিল এবং কেসটাও সাজানো হয়েছিল মলয়েরই বিরুদ্ধে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন