মঙ্গলবার

অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ২ )

‘এবং বিকল্প’ কর্তৃপক্ষ আমাদের সবাইকে একই জায়গায় রেখেছিলেন। উৎপলদা, কালীদা, নিত্যদার সঙ্গে গল্পগুজব হলেও অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলাম অরুণেশদা আমাকে এড়িয়ে চলতে চাইছেন! তা বলে কুশল মঙ্গল সংবাদ জিজ্ঞেস করেননি তা নয় কিন্তু আমাদের দুজনের সম্পর্ক তো ওটুকুতে সীমাবদ্ধ নয়। আবার কী হলো! ততদিনে ওর পথ থেকে তো আরও দূরে সরে গিয়েছি, এই বামনের ক্ষীণ ছায়া তো ওঁর উঠোনে পড়ার কথা নয়!
বিস্মিত হলেও ওই অবহেলাকে গুরুত্ব দিইনি। কারণ আমি তো জানি একটা দিনরাত, পরদিন পুরোটা এবং রাতে একই ট্রেনে ফেরা, কতক্ষণ পারবে এড়িয়ে থাকতে?
বিকেল হোতেই সবাই চলে গেলাম অনুষ্ঠান মঞ্চে। সবাই জীবনানন্দ বিষয়ে দু-চার কথা বললাম। অরুণেশদা স্বকীয় ভঙ্গীতে শুরু করলেন, জীবনানন্দ দাশ একজন ক্ষতিকর কবি। কেননা প্রথাগত পরম্পরার বিরুদ্ধে গিয়েই বিদ্রোহ করেছেন জীবনানন্দ এবং সেই যাত্রার পরিণাম হিসেবে যে অখ্যাতি ও অনিশ্চিত জীবন জুটবে তাও বোধহয় ছিল কবির কাঙ্খিত। অথচ চুপিসারে তিনি বাংলা সাহিত্যে যে বিপ্লব ঘটিয়ে গেলেন তা সাবালক হতেই সাহায্য করেছে আমাদের।
অনুষ্ঠান শেষে আমি চলে গিয়েছিলাম মালদহের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতে। বাকিদের খোঁজ রাখিনি। অনেক রাতে হোটেলে ফিরে দেখেছিলাম অরুণেশদা এক নাগাড়ে বকে চলেছেন নিত্য মালাকারকে। নিত্যদা বসে আছেন অধোবদনে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, অপরাধ খুবই গর্হিত। হাফ বোতল হুইস্কি নিত্যদার হেফাজতে রাখা ছিল, কথা ছিল অনুষ্ঠান শেষে দুজনে পান করবেন কিন্তু অসাবধানতা বশতঃ বোতলটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। আহা, ভালোমানুষ নিত্যদা, মুখ বুঁজে লড়ে যাচ্ছেন ক্যারি প্যাক থেকে খানিকটা হলেও অমৃত ছেঁকে তোলা যায় কিনা!
এতক্ষণে বুঝেছিলাম সকাল থেকে অরুণেশদার আমাকে এড়িয়ে চলার কারণ। ভাগীদার কমাতে চেয়েছিলেন।হা ঈশ্বর, বরং মুখ ফুটে বললে তো আমি একটা আস্ত বোতল উপহার দিতে পারতাম!
পরদিন শহর ঘোরাঘুরি এবং আড্ডা শেষে একসাথে ট্রেনে ফেরা। ট্রেন খানিকটা এগোতেই ফের গন্ডগোল বাঁধলো। একদিকে আমি আর নিত্যদা অন্যদিকে একা অরুণেশ ঘোষ। বিষয় রাজনীতি। তখনও তৃণমূল ক্ষমতায় আসেনি। তোড়জোর শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে থাকা অরুণেশদাও যুক্ত হয়ে পড়েছেন ওই তোড়জোরের সঙ্গে। সেটা অবশ্য খুব বড় কোনো ব্যাপার নয়। তখন পরিস্থিতিটাই তেমন ছিল। অরুণেশদা তো শুধু সমর্থক ছিলেন, যারা এতদিন বামফ্রন্টের ঘি মাখন খেয়েছেন তারাও ফ্রন্টে নেমে পড়েছেন। আমাদের আপত্তি ছিল ব্যক্তি অরুণেশ নয়, কবি অরুণেশ ঘোষকে নিয়ে যিনি বিরোধিতা করতে নেমে লিখছেন--থুঃ বুদ্ধ থুঃ/ খা কুকুরের গু/ থুঃ বিনয় থুঃ/ খা ক্যাডারের গু/ থুঃ বিমান থুঃ/ খা মানুষের গু।
ওরকম নিকৃষ্ট লাইনগুলো কিনা অরুণেশ ঘোষের কলমে, ভাবা যায়! ওগুলোকে কবিতা তো দূরের কথা ছড়াও বলা যায় কি? ভাগ্যিস তখনও কথাঞ্জলী আবিষ্কৃত হয়নি তাই অমন আপত্তি তুলতে পেরেছিলাম। এখন হলে কোনটাকে কবিতা, কোনটাকে ছড়া কিংবা কোনটা দুটোই নয় সে ব্যাপারে সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গেলে হয়ত সাতদিনের ফাঁসী হয়ে যেত!
কিন্তু অরুণেশ ঘোষকে বোঝাবে এমন বাপের ব্যাটা কে আছে! তার ওপরে আবার আমাকে সমর্থন করছিল ওঁর প্রিয়সাথী নিত্য মালাকার। ব্যস, প্রধান সাহেব রেগে ফায়ার।(প্রধান সাহেব নামকরণটা কালীকৃষ্ণ গুহর। কারণ জানতে চাওয়ায় কালীদা বলেছিলেন, ও তো হাবেভাবে পঞ্চায়েত প্রধান।যদিও কবি হিসেবে অরুণেশকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন কালীদা। ওটা জাস্ট সমবয়সীদের ইয়ার্কি।)
মনে আছে, রাগে অন্ধ হয়ে মাঝরাতে ট্রেন থেকে নেমে পড়েছিলেন অরুণেশদা,যাবেন না সি.পি.এমের দুই দালালের সঙ্গে। দুজনে বহু কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফের ট্রেনে তুলেছিলাম।
পরদিন সকাল হোতেই রণাঙ্গন ফের শান্ত। চোখ মেলে দেখি বেঞ্চে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন অরুণেশদা। আমাকে চোখ মেলতে দেখেই মুখে দুষ্টু হাসি, ঘুম হইলো?
এরপর অবশ্য টেলিফোনে মাঝে মধ্যে দুজনের কথা হোত। মৃত্যুর কিছুদিন আগে কালীপুজোর রাতে ফোন করে অরুণেশদা গর্বিত স্বরে জানিয়ে ছিলেন, হুইস্কির একটা গোটা বোতল খুলে বসেছেন এবং আমাকে মিস করছেন!
শুনে সুখী হয়েছিলাম দুটে কারণে। প্রথম কারণ, এবার আমাকে সঙ্গী পেতে চেয়েছেন এবং দ্বিতীয় কারণ, এবার বোতলটা অন্ততঃ ভাঙেনি।
এর কিছুদিন পর আচমকা অরুণেশদার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। বিবরণ জানার পর বিস্ময় হয়ে উঠেছিল চৌগুণ।
দিনটা ছিল ২৪ আগষ্ট, ২০১১। ২৩ অগষ্ট রাতেও সুস্থ ও সবল ছিলেন অরুণেশ। বইপত্র ও নিজের লেখার মধ্যে নিমগ্ন ছিলেন। পরের দিন সকালে স্নান করতে চলে যান বাড়ির সামনে একটি ছোট্ট পুকুরে। বেশিরভাগ দিন বাড়িতেই স্নান করতেন। মাঝে মধ্যে পুকুরে যেতেন। অরুণেশ স্নান করে ফিরে খেতে বসবেন তাই বৌদি খাবার সাজিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু কোথায় অরুণেশ? খোঁজ খোঁজ। বহুক্ষণ পরে দেহ আবিষ্কৃত হয়েছিল পুকুরের জলের তলায়।
কিন্তু এসব তো বহু পরের কথা! সাত তাড়াতাড়ি অরুণেশদাকে মেরে ফেলছি কেন? কথা তো হচ্ছিল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আরম্ভপর্ব নিয়ে! এরপরও তো দীর্ঘদিন বাঁচবেন অরুণেশ ঘোষ, শুরু হবে মতাদর্শগত লড়াই, তৈরি হবে দূরত্ব। সুতরাং পিছিয়ে যাওয়া যাক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন