সত্তর দশকে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলেরই অন্যতম কার্যসূচি
ছিল ভিন্ন মতাদর্শীদের হত্যা করা। তাবলে তিনটি দলকে একাকার করে দেয়া চলবে
না। হত্যার কারণগুলো ছিল ভিন্ন ভিন্ন। পৃথিবী জুড়ে কম্যিউনিস্টদের বাড়
বাড়ন্ত দেখে আতঙ্কিত কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ছিল শাসনের পথকে নিষ্কন্টক রাখা।
সি.পি.আই. এমের কাছে আত্মরক্ষাই ছিল পাল্টা হত্যার একমাত্র উদ্দেশ্য। এ
ব্যাপারে একমাত্র নকশালদের দৃষ্টিভঙ্গীটা ছিল খানিকটা আলদা। দারুন একটা
বিশেষণের পেটেন্ট নিয়েছিল ওরা--শ্রেণীশত্রু। কারা তারা? তখন না হয় বোঝার
মতো বয়স আমার ছিল না কিন্তু যাদের ছিল তারাও কি বুঝতে পারতেন? সম্ভবতঃ নয়।
শুধু এটুকু বুঝতেন, পথে ঘাটে পড়ে থাকা লাশগুলোর পরিবার প্রদত্ত নাম যেটাই
হোক, ওদের সামাজিক নাম-- শ্রেণীশত্রু।
শ্রেণীশত্রু হওয়ার জন্য বয়স,পেশা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক মতাদর্শ কোনটাই বাধা হয়ে দাঁড়াত না। শুধু প্রয়োজন হোত চিহ্নিত করণ। সেই কষ্টটুকুও নকশালদের করতে হোত না, তাদের ভালোবেসে ওই নৃশংস কাজটুকু করে দিতেন চেয়ারম্যান। তিনিই বিভিন্ন রচনা মারফত পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতেন শ্রেণীশত্রু কাহাদের বলা যাইবেক। যদিও তিনি চীনদেশের মানুষ তবুও আমাদের জন্য এই শ্রমটুকু হাসিমুখে করতে রাজী ছিলেন কারণ দুনিয়ার মেহনতি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করাটাই ছিল তাঁর অন্যতম স্বপ্ন। তাই তিনি শুধু চীনেরই চেয়ারম্যান ছিলেন না, আমাদেরও ছিলেন। তাঁর দেয়া শ্লোগান, 'বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস' হয়ে উঠেছিল আমাদের বেদমন্ত্র।
তথ্যগুলো জেনে ছিলাম দেয়াল লিখন মারফৎ। বন্দুক সংক্রান্ত তথ্যটা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চেয়ারম্যান সংক্রান্ত তথ্যটা আমাকে চিন্তায় ফেলেছিল। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীকে চিনি অথচ নিজেদের চেয়ারম্যানকে চিনি না!
চেনার আগ্রহে দেয়ালচিত্রগুলো খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম কিন্তু টেনসিলের ওপর আলকাতরার সহযোগিতায় যে ছবিগুলো আঁকা থাকত সেসব থেকে ওঁর চেহারাটা স্পষ্ট বোঝা যেত না।টুপি পরা অবয়বটুকু শুধু বুঝতে পারতাম। চোখ, মুখ সব অন্ধকার।
অবশ্য তখন চেয়ারম্যান অনুগামীদেরই বা কতটুকু চিনতাম! কংগ্রেস, সি.পি.এমদের রাস্তায় দেখা গেলেও নকশালদের দেখতে পেতাম শুধু মৃত্যুর পর। লাশ দেখে অবাক হয়ে ভাবতাম,ওমা, মিলুদাও নকশাল ছিল!
জীবিত নকশালদের দেখা না পাবার কারণ ততদিনে প্রায় সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে। রাতের অন্ধকারে ওরা যখন মাটির তলা থেকে বেরিয়ে এসে অ্যাকশন করতো তখন উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া সবাই ঘুমঘোরে। মজার ব্যাপার হলো, এক্ষেত্রেও লাশ দেখেই আমাদের চিনতে হোত যে মানুষটি শ্রেণীশত্রু ছিল।
তাবলে জীবিত শ্রেণীশত্রু যে বিলকুল দেখিনি তা নয়, যদিও সেই দুজনকে নিহত হোতে হয়নি। বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছিলেন। সেই দুজনের একজন ছিলেন আমার বাবা। অন্যজনের প্রসঙ্গে পরে আসছি আপাততঃ বাবার শ্রেণীশত্রুতার প্রসঙ্গে আসা যাক।
নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই পরিবারের সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারি হওয়ায় খুব স্বাভাবিক কারণেই বাবার ইলেকশন ডিউটি পড়ার কথা। ততদিনে দেয়াল লিখন মারফত সবাই জেনে গিয়েছিলাম, পার্লামেন্ট মূলতঃ শুয়োরের খোঁয়াড়। কিন্তু জানাটা অর্ধেক ছিল অর্থাৎ ওই দেয়াল লিখন থেকে লোকসভা সম্পর্কে জানা গেলেও বিধানসভা মূলতঃ কী, সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। সুতরাং ত্রুটি সংশোধনার্থে কে বা কাহারা রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি যে হ্যান্ডবিলগুলো বিলি করে গিয়েছিল তাতে স্পষ্ট ভাষায় লেখা ছিল নির্বাচনের কাজে যেকোনো ভাবে অংশ নেয়া মানুষই শ্রেণীশত্রু এবং তাদের জন্য একটাই শাস্তি বরাদ্দ--মৃত্যু।
এরপর শুরু হয়ে গেল মায়ের তরফ থেকে প্রতিরোধের আয়োজন অর্থাৎ তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর পায়ে মাথা কোটা, মানত, উপবাস ইত্যাদি ইত্যাদি।এছাড়া এক সামান্য মেয়েমানুষের কী বা করার থাকতে পারে! বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেক দূরের এই শহরে রক্ষা করতে ঈশ্বরের চে বড় খুঁটি আর কে হোতে পারে!
বাবা ইষ্টনাম জপের পাশাপাশি ছুটলেন ঈশ্বরসম শক্তিমান মানুষদের দোরে দোরে, একটু দেখুন। ছেলেমেয়ে দুটো একেবারেই নাবালক। আমার কিছু হলে ওরা পথে ভেসে যাবে।
না, কেউ কটুকাটব্য করেননি। সবাই আশ্বস্ত করেছিলেন, আরে, ডিউটি তো পড়েইনি এখনও, আগেই ভেঙে পড়ছেন! দেখব, যাতে আপনার নামটা কাটিয়ে দেয়া যায়।
কিন্তু এক সন্ধ্যায় বাবা অফিস থেকে ফিরে দুখি স্বরে জানালেন, ভোটে ডিউটি পড়েছে।
কথাটা শোনা মাত্র হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল মা। সেটাই স্বাভাবিক কারণ এই সংবাদই তো প্রমাণ করে দেয় যে আমাদের পরিবারের প্রতি বরাবর সদয় থাকা দেবদেবীবৃন্দ এক্ষণে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। অর্থাৎ নাবালক পুত্র কন্যার হাত ধরে এক সদ্য বিধবার পথে গিয়ে দাঁড়ানোটাই ভবিতব্য হিসেবেই বেছে দিয়েছেন বিধাতা।
বাবা ফের ছুটে ছিলেন ঈশ্বরপ্রতীমদের দোরে দোরে। এবারও কেউ কটু কথা বলেননি। বাবাকে সাহস জুগিয়ে ছিলেন,এত মিলিটারি সি.আর.পি থাকবে,তবু এত ভয় কিসের অ্যাঁ! সবাই যদি গুন্ডা বদমাশদের ভয়ে এভাবে পেছয় তবে গণতন্ত্র কিভাবে এগোবে?
এরপর সমবেত কান্না মারফত গণতন্ত্রের যাত্রপথ পিচ্ছিল করা ছাড়া আমাদের কী বা করার থাকতে পারে!
বাবা সতর্ক করে দিয়েছিলেন ডিউটির খবরটা যাতে পাঁচকান না হয়। যদিও সেটা সতর্কীকরণ নাকি বিনীত প্রার্থনা ছিল সেটা বাবার কন্ঠস্বর শুনে সেদিন বুঝতে পারিনি।
অবশেষে এলো সে দিন। কাকভোরে চটের ব্যাগে জামাপ্যান্ট ভরে হাফশার্ট আর লুঙি পরে বাবা রওনা দিলেন পোলিং বুথের পানে। যথারীতি অত ভোরে আমাদের দু ভাইবোনের ঘুম ভাঙেনি। মা ঠেলে তুলে দিয়েছিলেন, ওঠ। বাবা যাচ্ছে। প্রণাম কর।
লাফিয়ে উঠেছিলাম। প্রণাম করতেই বাবা জড়িয়ে ধরেছিলেন। কাঁপাস্বরে বলেছিলেন, বাইরে যাস না। যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব।
মাথা নেড়ে বাবার দিকে ভালো করে তাকিয়ে ছিলাম, কে বলতে পারে এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো!
বাইরে বেরিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদায় জানাতে পারিনি কারণ তাতে দশজনের কৌতূহল সৃষ্টি হোত। খবরটা পৌঁছে যেত চেয়ারম্যান অনুগামীদের কানে। তাই ঘরের ভেতর থেকেই শ্রেণীশত্রুকে বিদায় জানিয়ে ছিলাম।হাত জোর করে নিয়তির কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যাতে গণতন্ত্রকে এগিয়ে দিয়ে এক বাপ ঠিকঠাক ফিরে আসে তার পরিবারের কাছে। পাশাপাশি চেয়ারম্যানের কাছেও মনে মনে কোনো আবেদন জানিয়ে ছিলাম কি? এতদিন পর ঠিকঠাক মনে নেই। হয়ত জানিয়ে ছিলাম কেননা চীন কতটা দূরে সেটা সঠিক ভাবে না জানলেও চীনের পথই যে আমাদের পথ, সেটা দেয়াল লিখন থেকে জেনেছিলাম।
রক্ষাকত্রা যে-ই হোক, জীবিত অবস্থাতেই ফিরে আসতে পেরেছিল বাবা। তখন গভীর রাত। আমার তখন ঘুমের অতলেই ডুবে থাকার কথা কিন্তু জেগে বসেছিলাম। জীবিত শ্রেণীশত্রু দেখার কৌতূহল আমাকে ঘুমোতে দেয়নি।
শ্রেণীশত্রু হওয়ার জন্য বয়স,পেশা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক মতাদর্শ কোনটাই বাধা হয়ে দাঁড়াত না। শুধু প্রয়োজন হোত চিহ্নিত করণ। সেই কষ্টটুকুও নকশালদের করতে হোত না, তাদের ভালোবেসে ওই নৃশংস কাজটুকু করে দিতেন চেয়ারম্যান। তিনিই বিভিন্ন রচনা মারফত পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতেন শ্রেণীশত্রু কাহাদের বলা যাইবেক। যদিও তিনি চীনদেশের মানুষ তবুও আমাদের জন্য এই শ্রমটুকু হাসিমুখে করতে রাজী ছিলেন কারণ দুনিয়ার মেহনতি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করাটাই ছিল তাঁর অন্যতম স্বপ্ন। তাই তিনি শুধু চীনেরই চেয়ারম্যান ছিলেন না, আমাদেরও ছিলেন। তাঁর দেয়া শ্লোগান, 'বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস' হয়ে উঠেছিল আমাদের বেদমন্ত্র।
তথ্যগুলো জেনে ছিলাম দেয়াল লিখন মারফৎ। বন্দুক সংক্রান্ত তথ্যটা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চেয়ারম্যান সংক্রান্ত তথ্যটা আমাকে চিন্তায় ফেলেছিল। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীকে চিনি অথচ নিজেদের চেয়ারম্যানকে চিনি না!
চেনার আগ্রহে দেয়ালচিত্রগুলো খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম কিন্তু টেনসিলের ওপর আলকাতরার সহযোগিতায় যে ছবিগুলো আঁকা থাকত সেসব থেকে ওঁর চেহারাটা স্পষ্ট বোঝা যেত না।টুপি পরা অবয়বটুকু শুধু বুঝতে পারতাম। চোখ, মুখ সব অন্ধকার।
অবশ্য তখন চেয়ারম্যান অনুগামীদেরই বা কতটুকু চিনতাম! কংগ্রেস, সি.পি.এমদের রাস্তায় দেখা গেলেও নকশালদের দেখতে পেতাম শুধু মৃত্যুর পর। লাশ দেখে অবাক হয়ে ভাবতাম,ওমা, মিলুদাও নকশাল ছিল!
জীবিত নকশালদের দেখা না পাবার কারণ ততদিনে প্রায় সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে। রাতের অন্ধকারে ওরা যখন মাটির তলা থেকে বেরিয়ে এসে অ্যাকশন করতো তখন উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া সবাই ঘুমঘোরে। মজার ব্যাপার হলো, এক্ষেত্রেও লাশ দেখেই আমাদের চিনতে হোত যে মানুষটি শ্রেণীশত্রু ছিল।
তাবলে জীবিত শ্রেণীশত্রু যে বিলকুল দেখিনি তা নয়, যদিও সেই দুজনকে নিহত হোতে হয়নি। বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছিলেন। সেই দুজনের একজন ছিলেন আমার বাবা। অন্যজনের প্রসঙ্গে পরে আসছি আপাততঃ বাবার শ্রেণীশত্রুতার প্রসঙ্গে আসা যাক।
নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই পরিবারের সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারি হওয়ায় খুব স্বাভাবিক কারণেই বাবার ইলেকশন ডিউটি পড়ার কথা। ততদিনে দেয়াল লিখন মারফত সবাই জেনে গিয়েছিলাম, পার্লামেন্ট মূলতঃ শুয়োরের খোঁয়াড়। কিন্তু জানাটা অর্ধেক ছিল অর্থাৎ ওই দেয়াল লিখন থেকে লোকসভা সম্পর্কে জানা গেলেও বিধানসভা মূলতঃ কী, সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। সুতরাং ত্রুটি সংশোধনার্থে কে বা কাহারা রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি যে হ্যান্ডবিলগুলো বিলি করে গিয়েছিল তাতে স্পষ্ট ভাষায় লেখা ছিল নির্বাচনের কাজে যেকোনো ভাবে অংশ নেয়া মানুষই শ্রেণীশত্রু এবং তাদের জন্য একটাই শাস্তি বরাদ্দ--মৃত্যু।
এরপর শুরু হয়ে গেল মায়ের তরফ থেকে প্রতিরোধের আয়োজন অর্থাৎ তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর পায়ে মাথা কোটা, মানত, উপবাস ইত্যাদি ইত্যাদি।এছাড়া এক সামান্য মেয়েমানুষের কী বা করার থাকতে পারে! বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেক দূরের এই শহরে রক্ষা করতে ঈশ্বরের চে বড় খুঁটি আর কে হোতে পারে!
বাবা ইষ্টনাম জপের পাশাপাশি ছুটলেন ঈশ্বরসম শক্তিমান মানুষদের দোরে দোরে, একটু দেখুন। ছেলেমেয়ে দুটো একেবারেই নাবালক। আমার কিছু হলে ওরা পথে ভেসে যাবে।
না, কেউ কটুকাটব্য করেননি। সবাই আশ্বস্ত করেছিলেন, আরে, ডিউটি তো পড়েইনি এখনও, আগেই ভেঙে পড়ছেন! দেখব, যাতে আপনার নামটা কাটিয়ে দেয়া যায়।
কিন্তু এক সন্ধ্যায় বাবা অফিস থেকে ফিরে দুখি স্বরে জানালেন, ভোটে ডিউটি পড়েছে।
কথাটা শোনা মাত্র হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল মা। সেটাই স্বাভাবিক কারণ এই সংবাদই তো প্রমাণ করে দেয় যে আমাদের পরিবারের প্রতি বরাবর সদয় থাকা দেবদেবীবৃন্দ এক্ষণে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। অর্থাৎ নাবালক পুত্র কন্যার হাত ধরে এক সদ্য বিধবার পথে গিয়ে দাঁড়ানোটাই ভবিতব্য হিসেবেই বেছে দিয়েছেন বিধাতা।
বাবা ফের ছুটে ছিলেন ঈশ্বরপ্রতীমদের দোরে দোরে। এবারও কেউ কটু কথা বলেননি। বাবাকে সাহস জুগিয়ে ছিলেন,এত মিলিটারি সি.আর.পি থাকবে,তবু এত ভয় কিসের অ্যাঁ! সবাই যদি গুন্ডা বদমাশদের ভয়ে এভাবে পেছয় তবে গণতন্ত্র কিভাবে এগোবে?
এরপর সমবেত কান্না মারফত গণতন্ত্রের যাত্রপথ পিচ্ছিল করা ছাড়া আমাদের কী বা করার থাকতে পারে!
বাবা সতর্ক করে দিয়েছিলেন ডিউটির খবরটা যাতে পাঁচকান না হয়। যদিও সেটা সতর্কীকরণ নাকি বিনীত প্রার্থনা ছিল সেটা বাবার কন্ঠস্বর শুনে সেদিন বুঝতে পারিনি।
অবশেষে এলো সে দিন। কাকভোরে চটের ব্যাগে জামাপ্যান্ট ভরে হাফশার্ট আর লুঙি পরে বাবা রওনা দিলেন পোলিং বুথের পানে। যথারীতি অত ভোরে আমাদের দু ভাইবোনের ঘুম ভাঙেনি। মা ঠেলে তুলে দিয়েছিলেন, ওঠ। বাবা যাচ্ছে। প্রণাম কর।
লাফিয়ে উঠেছিলাম। প্রণাম করতেই বাবা জড়িয়ে ধরেছিলেন। কাঁপাস্বরে বলেছিলেন, বাইরে যাস না। যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব।
মাথা নেড়ে বাবার দিকে ভালো করে তাকিয়ে ছিলাম, কে বলতে পারে এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো!
বাইরে বেরিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদায় জানাতে পারিনি কারণ তাতে দশজনের কৌতূহল সৃষ্টি হোত। খবরটা পৌঁছে যেত চেয়ারম্যান অনুগামীদের কানে। তাই ঘরের ভেতর থেকেই শ্রেণীশত্রুকে বিদায় জানিয়ে ছিলাম।হাত জোর করে নিয়তির কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যাতে গণতন্ত্রকে এগিয়ে দিয়ে এক বাপ ঠিকঠাক ফিরে আসে তার পরিবারের কাছে। পাশাপাশি চেয়ারম্যানের কাছেও মনে মনে কোনো আবেদন জানিয়ে ছিলাম কি? এতদিন পর ঠিকঠাক মনে নেই। হয়ত জানিয়ে ছিলাম কেননা চীন কতটা দূরে সেটা সঠিক ভাবে না জানলেও চীনের পথই যে আমাদের পথ, সেটা দেয়াল লিখন থেকে জেনেছিলাম।
রক্ষাকত্রা যে-ই হোক, জীবিত অবস্থাতেই ফিরে আসতে পেরেছিল বাবা। তখন গভীর রাত। আমার তখন ঘুমের অতলেই ডুবে থাকার কথা কিন্তু জেগে বসেছিলাম। জীবিত শ্রেণীশত্রু দেখার কৌতূহল আমাকে ঘুমোতে দেয়নি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন