মীজানুর রহমান কে? তিনিই প্রথম ধারাবাহিক "হাংরি কিংবদন্তি" প্রকাশ করেছিলেন ।
আজ ( 26 June )মীজানুর রহমানের মৃত্যুদিবস। ২০০৬ সালের এই দিনে তিনি চলে গেছেন।
মীজানুর রহমান চলে গেলেন। কোন মিজানুর রহমান? সম্পাদক মীজানুর রহমান। কিসের সম্পাদক? ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র। এটা আবার কী রকম পত্রিকা?
সাহিত্যের বোদ্ধা পাঠক, কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চিত্রশিল্পী—সংক্ষেপে, দেশের বিদ্বৎসমাজের সদস্যরা অনুগ্রহ করে ভাববেন না মশকরা করছি। আসলে, ১৪ কোটি মানুষের এই দেশে দৈনিক পত্রিকা পড়েন যদি ৫০ লাখ, তো তাদের মধ্যে কজন চেনেন মীজানুর রহমানকে?
আমাদের এই তারকা-খচিত গণমাধ্যমে তাঁর জায়গা ছিল না বললেই চলে; আর গণমাধ্যমে যার জায়গা হয় না মানুষ তাকে চিনবে না এটাই স্বাভাবিক। গত ২৫ জুন দিবাগত রাতে কলকাতার এক ক্লিনিকে তিনি মারা গেছেন—এই সংবাদ দেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ছাপানোর জন্য তদবিরে নেমে আবিষ্কার করলাম, শুধু সাধারণ মানুষ কেন, সাংবাদিক ও সংবাদ ব্যবস্থাপকদের মধ্যেও এমন মানুষ আছেন যারা তাঁকে চেনেন না। এটাও অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। যেসব কৃতি ও দুষ্কৃতির কারণে একজন মানুষ মূলধারার সংবাদমাধ্যমে জায়গা পান, মীজানুর রহমান সাধারণ বিচারে তেমন কিছু করেননি।
তাহলে কেন প্রথম আলোর মূলব্যান পাতায় আজ তাকে এ জায়গা(টুকু) দেওয়া হচ্ছে? যে কোনো পাঠক নিশ্চয়ই এ কৈফিয়ত চাইতে পারেন, কারণ প্রায় তিন লাখ মানুষ এই পত্রিকা পয়সা দিয়ে কেনেন, পড়েন কম পক্ষে ১৫ লাখ।
কিন্তু প্রিয় পাঠক, কৈফিয়ত দেব কী করে?
মীজানুর রহমানের স্মরণে এই কথাগুলো লেখা ও ছাপা হচ্ছে ভালোবাসা থেকে। আমরা তাঁকে ভালোবাসি। ভালোবাসার কি কৈফিয়ত হয়?
১৯৮৩ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মীজানুর রহমান তার ত্রৈমাসিক পত্রিকার যে ৮০টি খন্ড সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন, শুধু সে-জন্যেই তাকে ভালোবাসা যায়। সৃজনশীলতা, মননশীলতা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের চেতনা, জ্ঞানের ও সুরুচির যে-চর্চা তিনি করে গেছেন, সে জন্য তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা করা উচিত, মনে রাখা উচিত। তিন মাস পর পর ছ/সাত ফর্মার নিয়মিত সংখ্যাগুলো ছাড়া তিনি ঢাউস আকারের যে বিশেষ সংখ্যাগুলো সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন, সেগুলোর জন্য তাঁকে আমাদের সালাম জানানো উচিত। শুধু পাখি নিয়ে প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার একটি পত্রিকা, ‘পক্ষী সংখ্যা’। এরকম আরো অনেক : বৃক্ষ সংখ্যা, নদী সংখ্যা, আবার বৃক্ষ ও পরিবেশ সংখ্যা, এবং বিস্ময় মানবেন প্রিয় পাঠক, দুই খ- মিলিয়ে প্রায় ১৪০০ পৃষ্ঠার ‘গণিত সংখ্যা’ তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। শিল্পী রশিদ চৌধুরী, পটুয়া কামরুল হাসান, কবি আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যাগুলোর কথাই বা কেন বলব না।
মীজানুর রহমান অনেক মানুষকে দিয়ে অনেক কিছু লিখিয়ে নিজের পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর উৎসাহে ও অবিরাম তাগাদায় অনেকেই অনেক কিছু লিখেছেন, যে লেখাগুলো হয়তো কখনো লেখা হতো না। যেমন, যখন পক্ষী সংখ্যার কাজ চলছিল, তখন তাঁর পরিচয় ও আলাপ ঘটে সাবেক কূটনীতিক সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেমের সঙ্গে। তিনি আবিষ্কার করেন, এই ভদ্রলোকের জানাশোনার পরিধি ব্যাপক ও বিচিত্র। সব বিষয়ে বলেনও চমৎকার। মীজান সাহেব একদিন হাশেম সাহেবকে বললেন, ‘পক্ষী সংখ্যার জন্য কিছু লিখুন না।’ সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম কুণ্ঠার সঙ্গে বলেন, তিনি সরকারি চাকরির কাজে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে অভ্যস্থ, বাংলা ভাষায় কিছু লেখার সাহস পান না। (আসলে প্রকাশ করার, কারণ তিনি বাংলায় কিছু প্রবন্ধের নোট, ভ্রমণবৃত্তান্ত ও অন্যান্য টুকিটাকি বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখে রাখতেন। কিন্তু সুধীন দত্তীয় গদ্যের ভক্ত এই বিদ্বৎজন ভাবতেন তাঁর বাংলা লেখাগুলো আজ আর প্রকাশযোগ্য নয়।) মীজান সাহেব তাঁকে সাহস দিয়ে বলেন, আপনি যখন বাংলায় এত সুন্দর বলেন, তখন লিখবেনও চমৎকার। এরকম করেই সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেমের হাতে বেরিয়ে আসে ‘সব পাখি নীরব কেন’ শিরোনামের এক অপূর্ব সুন্দর প্রবন্ধ, (পক্ষী সংখ্যায় প্রকাশিত) এবং তারপর তিনি বাংলায় আরো অনেক লিখেছেন।
নাছোড়বান্দা সম্পাদক মীজানুর রহমানের তাগাদায় আর অবিরাম পীড়নে আবদুশ শাকুর লিখেছিলেন গোলাপ নিয়ে, তার পত্রিকার বৃক্ষ সংখ্যায়। অনেকে এখন জানেন, আবদুশ শাকুরের ‘গোলাপ সমগ্র’ সেরা মননশীল বই হিসেবে ২০০৪ সালে প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের সম্মান লাভ করেছে। এরকম অনেক দৃষ্টান্তের মধ্যে থেকে আরেকটা: বামপন্থী তাত্ত্বিক নেতা ও রাজনীতিক আবদুল হালিম পিরিস্ত্রোইকার পরে যখন রাজনীতি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে নেন, এবং সম্ভবত এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক বিষাদজনিত নিষ্ক্রিয়তার শিকার হন, তখন মীজানুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। অনেক সন্ধ্যায় দুজনকে দীর্ঘ আলাপ করতে দেখেছি মীজানুর রহমানের ধানমন্ডির বাসায়। মীজানুর রহমান আবদুল হালিমের মধ্যে বিশুদ্ধ জ্ঞানের এক গভীর অনুরাগীর দেখা পান, যাঁর প্রধান আগ্রহ গণিতে। গণিত সংখ্যার জন্য আবদুল হালিমকে দিয়ে তিনি লিখিয়ে নিলেন একাধিক লেখা। এ ছাড়া তার পত্রিকার সাধারণ সংখ্যাগুলোর জন্যও আবদুল হালিম বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন, যেসবের মধ্যে বিষয় হিসেবে সঙ্গীত ছিল, সম্ভবত নৃত্যকলাও। পত্রিকার সুবাদে আবদুল হালিম শেষ জীবনে মীজানুর রহমানের সঙ্গে এমনই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন যে, সাধারণ সংখ্যাগুলো যখন ছাপা হতো, সম্পাদক-পত্নী নূরজাহান বকশীর কষ্ট কমানোর জন্য হালিম সাহেব নিজে পত্রিকার কপিগুলো প্রেস থেকে বহন করে মীজান সাহেবের বাসায় নিয়ে আসতেন ।
অবিরাম অনুরোধে আর তাগাদায় বিভিন্ন জনকে দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে লিখিয়ে, সেসব লেখা সম্পাদনা করেই মীজানুর রহমান সারা জীবন কাটিয়ে গেলেন তা কিন্তু নয়। নিজেও লিখেছেন বিস্তর। সেগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তার পত্রিকার ৮০টি সংখ্যার প্রত্যেকটিতে, ‘সম্পাদকের কড়চায়’। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে আলাদা আলাদা প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন অনেক। ইতিহাস-ভূগোলের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল তার। যেমন জানতেন শৈশব-কৈশোরের নগরী কলকাতাকে, তেমনি তার জানা ছিল ঢাকার ইতিহাসের অনেক খুঁটিনাটি বিষয়, পুরান ঢাকা অলিগলি, তস্য-গলি সব ছিল তার হাতের তালুতে। ‘সেকালের ঢাকা’ সিরিজ নামে তার বেশ কিছু লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। সেগুলো একসঙ্গে জড়ো করে ‘ঢাকা পুরাণ’ নামে একটি বই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলেন।
লিখেছেন প্রচুর, কিন্তু প্রকাশিত বই তার মাত্র দুটি। একটি ‘কমলালয়া কলকাতা’ বা তিরিশ ও চল্লিশের দশকের মহানগরীর শঙ্খরব। এটি তার কৈশোরের স্মৃতি। অন্যটি ‘কৃষ্ণ ষোলোই’ (১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতার মহাদাঙ্গার চাক্ষুষ বিবরণ)।
প্রায় সারাটা জীবনই ভুগেছেন হাঁপানিতে। প্রৌঢ় বয়েসে যোগ হয়েছিল আরও নানা রোগ-ব্যাধি। সবশেষে পড়েছিলেন চোখের এক জটিল অসুখে, খুব দ্রুত দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছিলেন। কিন্তু সমস্ত রোগ-ব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করে অবিরাম কাজ গেছেন। ৭১ বছর বয়েসে শুরু করেন অকল্পনীয় এক কর্মযজ্ঞ: এনসাইক্লোপিডিয়া। একাই তৈরি করবেন এক ‘মহাজ্ঞানকোষ’। একেবারে বিফল হননি। প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার দুটি খন্ড তৈরি করেছেন, ভূমিকাও লেখা শেষ, বাকি ছিল শুধু প্রেসের কাজ।
ক্ষীণদেহ-ভগ্নস্বাস্থ্য মীজানুর রহমানের ছিল আসুরিক পরিশ্রম করার শক্তি ও প্রেরণা। শেষের দিকে চোখ দুটি শত্রুতা শুরু করলে লেখা সম্পাদনার কাজে আঁতসি কাচের সাহায্য নিতেন। চোখের এই অবস্থা নিয়ে রসিকতা করে লিখেছেন তাঁর পত্রিকার নিজের সম্পাদিত সবশেষ সংখ্যার ‘সম্পাদকের কড়চা’য়: ‘চক্ষু যুগল সাঁট করিয়া মাস ছয়েক হইল লাগাতার ধর্মঘটে পড়িয়াছে...পড়িতে গেলে হরফগুলি ব্যালে-নৃত্যের নর্তকীদের মতো সারা পৃষ্ঠা জুড়িয়া নাচিয়া কুঁদিয়া লঙ্কাকান্ড করিয়া বসে। আবার আলস্যবিলাসে মত্ত হরফগুলি ‘রহিয়া আলিসে ঠেস্না বালিশে’ রূপ বদলাইতেও কার্পণ্য করে না। ওদিকে লজ্জাশীলা হরফেরা নেকাব পরাকে দোষাবহ মনে করে না। চক্ষুর্দ্বয় জ্বালাপোড়া করে যখন বর্ণেরা বঙ্কিম ভঙ্গিতে নাচিতে থাকে..।’
কাজ করতে ভালোবাসতেন, কাজেই আনন্দ পেতেন। আর মনে করতেন, স্বাস্থ্যের অবস্থা যতই খারাপ হোক, বাঁচবেন কমপক্ষে ৯০ বছর, কাজ করবেন আরও অনেক। ভালোবাসতেন যা কিছু ভালো ও সুন্দর। নদী ভালোবাসতেন, ফুল ভালোবাসতেন, গাছ ভালোবাসতেন। দ্বিজেন শর্মাকে ‘বৃক্ষসখা’ ডাকতেন এই মীজানুর রহমান।
মীজানুর রহমানকে ভালোবাসা যায় আরও একটা কারণে: তাঁর লেখা পড়ে বাংলা ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করি। মনে হয় আমার বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না হেন বিষয় মানবের জ্ঞানজগতে নেই। তাঁর ভাষার স্বাদ পেতে হলে বিচিত্র বিষয়ে তাঁর লেখাগুলো পড়া ছাড়া উপায় নেই। তাঁর কৈশোরের স্মৃতি নিয়ে লেখা ‘কমলালয়া কলকাতা’র ভূমিকা থেকে কয়েক লাইন এখানে তুলে দিচ্ছি:
‘বেনারসের ফণি কাকাবাবুর তোলা আমার ন’ মাসের ননুয়া-গা ফটোটার দিকে তাকিয়ে ভাবি—ঐটুকুন দেহের ওপর দিয়ে দেখতে দেখতে কেমন ষাটটি বছর পার হয়ে গেল! এই ষাট বছরের পরিসরে শৈশবের সতেরটি সবচেয়ে মধুর বছর কিন্তু কলকাতার ভাগে। ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭—বানভাসি চুনুরী অতীতের দিকে যখন ফিরে তাকাই, তখন জন্মাবধি যে শুভনগরীর কোলেকাঁখে বড় হয়েছি, কমলালয়া কলকাতার সেই সুখদ দিনমানের শঙ্খরব যেন আজও কানে এসে পশে। আমাদের তিরিশ ও চল্লিশের প্রথম পাদের গা-হাত-পা-ছেড়ে-দেয়া মহাসুখী কলকাতার কথা কোনোদিন লিখব ভাবি নি। এ তো সেই কলকাতা, যার বৌবাজার, গড়পাড় ও মির্জাপুরের পল্লীতে পল্লীতে লেত্তির হুকুমে লাট্টু ঘোরে, মাঞ্জার ডামরে আকাশ জুড়ে ঘুড়ি ওড়ে আর একটু সবুজ কি নির্জন এলাকা বুঝে বলের গায়ে লাথি পড়ে, বহু মঞ্জরী স্মৃতি আমাকে আনন্দভেলায় চাপিয়ে শৈশবের পৈথানে নিয়ে যায়..।’
খুব জনপ্রিয় একজন ঔপন্যাসিক সেদিন প্রশ্ন করলেন, ‘মীজানুর রহমানকে যদি আমরা না চিনি, সে দোষ কার? ওনার না আমাদের?’
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি। উত্তর যে নেই তা নয়। কিন্তু সে প্রশ্ন এখন অর্থহীন হয়ে গেছে। মীজানুর রহমান এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। সবকিছুর উর্ধ্বে চলে গেছেন তিনি। নিজের জন্য কী নিয়ে গেছেন কে জানে; আমাদের জন্যে রেখে গেছেন তাঁর জীবনের সমস্ত কৃতি। সেগুলো মূলব্যান।
মীজানুর রহমান, আপনাকে সালাম।#
আজ ( 26 June )মীজানুর রহমানের মৃত্যুদিবস। ২০০৬ সালের এই দিনে তিনি চলে গেছেন।
মীজানুর রহমান চলে গেলেন। কোন মিজানুর রহমান? সম্পাদক মীজানুর রহমান। কিসের সম্পাদক? ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র। এটা আবার কী রকম পত্রিকা?
সাহিত্যের বোদ্ধা পাঠক, কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চিত্রশিল্পী—সংক্ষেপে, দেশের বিদ্বৎসমাজের সদস্যরা অনুগ্রহ করে ভাববেন না মশকরা করছি। আসলে, ১৪ কোটি মানুষের এই দেশে দৈনিক পত্রিকা পড়েন যদি ৫০ লাখ, তো তাদের মধ্যে কজন চেনেন মীজানুর রহমানকে?
আমাদের এই তারকা-খচিত গণমাধ্যমে তাঁর জায়গা ছিল না বললেই চলে; আর গণমাধ্যমে যার জায়গা হয় না মানুষ তাকে চিনবে না এটাই স্বাভাবিক। গত ২৫ জুন দিবাগত রাতে কলকাতার এক ক্লিনিকে তিনি মারা গেছেন—এই সংবাদ দেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ছাপানোর জন্য তদবিরে নেমে আবিষ্কার করলাম, শুধু সাধারণ মানুষ কেন, সাংবাদিক ও সংবাদ ব্যবস্থাপকদের মধ্যেও এমন মানুষ আছেন যারা তাঁকে চেনেন না। এটাও অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। যেসব কৃতি ও দুষ্কৃতির কারণে একজন মানুষ মূলধারার সংবাদমাধ্যমে জায়গা পান, মীজানুর রহমান সাধারণ বিচারে তেমন কিছু করেননি।
তাহলে কেন প্রথম আলোর মূলব্যান পাতায় আজ তাকে এ জায়গা(টুকু) দেওয়া হচ্ছে? যে কোনো পাঠক নিশ্চয়ই এ কৈফিয়ত চাইতে পারেন, কারণ প্রায় তিন লাখ মানুষ এই পত্রিকা পয়সা দিয়ে কেনেন, পড়েন কম পক্ষে ১৫ লাখ।
কিন্তু প্রিয় পাঠক, কৈফিয়ত দেব কী করে?
মীজানুর রহমানের স্মরণে এই কথাগুলো লেখা ও ছাপা হচ্ছে ভালোবাসা থেকে। আমরা তাঁকে ভালোবাসি। ভালোবাসার কি কৈফিয়ত হয়?
১৯৮৩ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মীজানুর রহমান তার ত্রৈমাসিক পত্রিকার যে ৮০টি খন্ড সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন, শুধু সে-জন্যেই তাকে ভালোবাসা যায়। সৃজনশীলতা, মননশীলতা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের চেতনা, জ্ঞানের ও সুরুচির যে-চর্চা তিনি করে গেছেন, সে জন্য তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা করা উচিত, মনে রাখা উচিত। তিন মাস পর পর ছ/সাত ফর্মার নিয়মিত সংখ্যাগুলো ছাড়া তিনি ঢাউস আকারের যে বিশেষ সংখ্যাগুলো সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন, সেগুলোর জন্য তাঁকে আমাদের সালাম জানানো উচিত। শুধু পাখি নিয়ে প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার একটি পত্রিকা, ‘পক্ষী সংখ্যা’। এরকম আরো অনেক : বৃক্ষ সংখ্যা, নদী সংখ্যা, আবার বৃক্ষ ও পরিবেশ সংখ্যা, এবং বিস্ময় মানবেন প্রিয় পাঠক, দুই খ- মিলিয়ে প্রায় ১৪০০ পৃষ্ঠার ‘গণিত সংখ্যা’ তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। শিল্পী রশিদ চৌধুরী, পটুয়া কামরুল হাসান, কবি আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যাগুলোর কথাই বা কেন বলব না।
মীজানুর রহমান অনেক মানুষকে দিয়ে অনেক কিছু লিখিয়ে নিজের পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর উৎসাহে ও অবিরাম তাগাদায় অনেকেই অনেক কিছু লিখেছেন, যে লেখাগুলো হয়তো কখনো লেখা হতো না। যেমন, যখন পক্ষী সংখ্যার কাজ চলছিল, তখন তাঁর পরিচয় ও আলাপ ঘটে সাবেক কূটনীতিক সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেমের সঙ্গে। তিনি আবিষ্কার করেন, এই ভদ্রলোকের জানাশোনার পরিধি ব্যাপক ও বিচিত্র। সব বিষয়ে বলেনও চমৎকার। মীজান সাহেব একদিন হাশেম সাহেবকে বললেন, ‘পক্ষী সংখ্যার জন্য কিছু লিখুন না।’ সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম কুণ্ঠার সঙ্গে বলেন, তিনি সরকারি চাকরির কাজে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে অভ্যস্থ, বাংলা ভাষায় কিছু লেখার সাহস পান না। (আসলে প্রকাশ করার, কারণ তিনি বাংলায় কিছু প্রবন্ধের নোট, ভ্রমণবৃত্তান্ত ও অন্যান্য টুকিটাকি বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখে রাখতেন। কিন্তু সুধীন দত্তীয় গদ্যের ভক্ত এই বিদ্বৎজন ভাবতেন তাঁর বাংলা লেখাগুলো আজ আর প্রকাশযোগ্য নয়।) মীজান সাহেব তাঁকে সাহস দিয়ে বলেন, আপনি যখন বাংলায় এত সুন্দর বলেন, তখন লিখবেনও চমৎকার। এরকম করেই সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেমের হাতে বেরিয়ে আসে ‘সব পাখি নীরব কেন’ শিরোনামের এক অপূর্ব সুন্দর প্রবন্ধ, (পক্ষী সংখ্যায় প্রকাশিত) এবং তারপর তিনি বাংলায় আরো অনেক লিখেছেন।
নাছোড়বান্দা সম্পাদক মীজানুর রহমানের তাগাদায় আর অবিরাম পীড়নে আবদুশ শাকুর লিখেছিলেন গোলাপ নিয়ে, তার পত্রিকার বৃক্ষ সংখ্যায়। অনেকে এখন জানেন, আবদুশ শাকুরের ‘গোলাপ সমগ্র’ সেরা মননশীল বই হিসেবে ২০০৪ সালে প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের সম্মান লাভ করেছে। এরকম অনেক দৃষ্টান্তের মধ্যে থেকে আরেকটা: বামপন্থী তাত্ত্বিক নেতা ও রাজনীতিক আবদুল হালিম পিরিস্ত্রোইকার পরে যখন রাজনীতি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে নেন, এবং সম্ভবত এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক বিষাদজনিত নিষ্ক্রিয়তার শিকার হন, তখন মীজানুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। অনেক সন্ধ্যায় দুজনকে দীর্ঘ আলাপ করতে দেখেছি মীজানুর রহমানের ধানমন্ডির বাসায়। মীজানুর রহমান আবদুল হালিমের মধ্যে বিশুদ্ধ জ্ঞানের এক গভীর অনুরাগীর দেখা পান, যাঁর প্রধান আগ্রহ গণিতে। গণিত সংখ্যার জন্য আবদুল হালিমকে দিয়ে তিনি লিখিয়ে নিলেন একাধিক লেখা। এ ছাড়া তার পত্রিকার সাধারণ সংখ্যাগুলোর জন্যও আবদুল হালিম বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন, যেসবের মধ্যে বিষয় হিসেবে সঙ্গীত ছিল, সম্ভবত নৃত্যকলাও। পত্রিকার সুবাদে আবদুল হালিম শেষ জীবনে মীজানুর রহমানের সঙ্গে এমনই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন যে, সাধারণ সংখ্যাগুলো যখন ছাপা হতো, সম্পাদক-পত্নী নূরজাহান বকশীর কষ্ট কমানোর জন্য হালিম সাহেব নিজে পত্রিকার কপিগুলো প্রেস থেকে বহন করে মীজান সাহেবের বাসায় নিয়ে আসতেন ।
অবিরাম অনুরোধে আর তাগাদায় বিভিন্ন জনকে দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে লিখিয়ে, সেসব লেখা সম্পাদনা করেই মীজানুর রহমান সারা জীবন কাটিয়ে গেলেন তা কিন্তু নয়। নিজেও লিখেছেন বিস্তর। সেগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তার পত্রিকার ৮০টি সংখ্যার প্রত্যেকটিতে, ‘সম্পাদকের কড়চায়’। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে আলাদা আলাদা প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন অনেক। ইতিহাস-ভূগোলের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল তার। যেমন জানতেন শৈশব-কৈশোরের নগরী কলকাতাকে, তেমনি তার জানা ছিল ঢাকার ইতিহাসের অনেক খুঁটিনাটি বিষয়, পুরান ঢাকা অলিগলি, তস্য-গলি সব ছিল তার হাতের তালুতে। ‘সেকালের ঢাকা’ সিরিজ নামে তার বেশ কিছু লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। সেগুলো একসঙ্গে জড়ো করে ‘ঢাকা পুরাণ’ নামে একটি বই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলেন।
লিখেছেন প্রচুর, কিন্তু প্রকাশিত বই তার মাত্র দুটি। একটি ‘কমলালয়া কলকাতা’ বা তিরিশ ও চল্লিশের দশকের মহানগরীর শঙ্খরব। এটি তার কৈশোরের স্মৃতি। অন্যটি ‘কৃষ্ণ ষোলোই’ (১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতার মহাদাঙ্গার চাক্ষুষ বিবরণ)।
প্রায় সারাটা জীবনই ভুগেছেন হাঁপানিতে। প্রৌঢ় বয়েসে যোগ হয়েছিল আরও নানা রোগ-ব্যাধি। সবশেষে পড়েছিলেন চোখের এক জটিল অসুখে, খুব দ্রুত দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছিলেন। কিন্তু সমস্ত রোগ-ব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করে অবিরাম কাজ গেছেন। ৭১ বছর বয়েসে শুরু করেন অকল্পনীয় এক কর্মযজ্ঞ: এনসাইক্লোপিডিয়া। একাই তৈরি করবেন এক ‘মহাজ্ঞানকোষ’। একেবারে বিফল হননি। প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার দুটি খন্ড তৈরি করেছেন, ভূমিকাও লেখা শেষ, বাকি ছিল শুধু প্রেসের কাজ।
ক্ষীণদেহ-ভগ্নস্বাস্থ্য মীজানুর রহমানের ছিল আসুরিক পরিশ্রম করার শক্তি ও প্রেরণা। শেষের দিকে চোখ দুটি শত্রুতা শুরু করলে লেখা সম্পাদনার কাজে আঁতসি কাচের সাহায্য নিতেন। চোখের এই অবস্থা নিয়ে রসিকতা করে লিখেছেন তাঁর পত্রিকার নিজের সম্পাদিত সবশেষ সংখ্যার ‘সম্পাদকের কড়চা’য়: ‘চক্ষু যুগল সাঁট করিয়া মাস ছয়েক হইল লাগাতার ধর্মঘটে পড়িয়াছে...পড়িতে গেলে হরফগুলি ব্যালে-নৃত্যের নর্তকীদের মতো সারা পৃষ্ঠা জুড়িয়া নাচিয়া কুঁদিয়া লঙ্কাকান্ড করিয়া বসে। আবার আলস্যবিলাসে মত্ত হরফগুলি ‘রহিয়া আলিসে ঠেস্না বালিশে’ রূপ বদলাইতেও কার্পণ্য করে না। ওদিকে লজ্জাশীলা হরফেরা নেকাব পরাকে দোষাবহ মনে করে না। চক্ষুর্দ্বয় জ্বালাপোড়া করে যখন বর্ণেরা বঙ্কিম ভঙ্গিতে নাচিতে থাকে..।’
কাজ করতে ভালোবাসতেন, কাজেই আনন্দ পেতেন। আর মনে করতেন, স্বাস্থ্যের অবস্থা যতই খারাপ হোক, বাঁচবেন কমপক্ষে ৯০ বছর, কাজ করবেন আরও অনেক। ভালোবাসতেন যা কিছু ভালো ও সুন্দর। নদী ভালোবাসতেন, ফুল ভালোবাসতেন, গাছ ভালোবাসতেন। দ্বিজেন শর্মাকে ‘বৃক্ষসখা’ ডাকতেন এই মীজানুর রহমান।
মীজানুর রহমানকে ভালোবাসা যায় আরও একটা কারণে: তাঁর লেখা পড়ে বাংলা ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করি। মনে হয় আমার বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না হেন বিষয় মানবের জ্ঞানজগতে নেই। তাঁর ভাষার স্বাদ পেতে হলে বিচিত্র বিষয়ে তাঁর লেখাগুলো পড়া ছাড়া উপায় নেই। তাঁর কৈশোরের স্মৃতি নিয়ে লেখা ‘কমলালয়া কলকাতা’র ভূমিকা থেকে কয়েক লাইন এখানে তুলে দিচ্ছি:
‘বেনারসের ফণি কাকাবাবুর তোলা আমার ন’ মাসের ননুয়া-গা ফটোটার দিকে তাকিয়ে ভাবি—ঐটুকুন দেহের ওপর দিয়ে দেখতে দেখতে কেমন ষাটটি বছর পার হয়ে গেল! এই ষাট বছরের পরিসরে শৈশবের সতেরটি সবচেয়ে মধুর বছর কিন্তু কলকাতার ভাগে। ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭—বানভাসি চুনুরী অতীতের দিকে যখন ফিরে তাকাই, তখন জন্মাবধি যে শুভনগরীর কোলেকাঁখে বড় হয়েছি, কমলালয়া কলকাতার সেই সুখদ দিনমানের শঙ্খরব যেন আজও কানে এসে পশে। আমাদের তিরিশ ও চল্লিশের প্রথম পাদের গা-হাত-পা-ছেড়ে-দেয়া মহাসুখী কলকাতার কথা কোনোদিন লিখব ভাবি নি। এ তো সেই কলকাতা, যার বৌবাজার, গড়পাড় ও মির্জাপুরের পল্লীতে পল্লীতে লেত্তির হুকুমে লাট্টু ঘোরে, মাঞ্জার ডামরে আকাশ জুড়ে ঘুড়ি ওড়ে আর একটু সবুজ কি নির্জন এলাকা বুঝে বলের গায়ে লাথি পড়ে, বহু মঞ্জরী স্মৃতি আমাকে আনন্দভেলায় চাপিয়ে শৈশবের পৈথানে নিয়ে যায়..।’
খুব জনপ্রিয় একজন ঔপন্যাসিক সেদিন প্রশ্ন করলেন, ‘মীজানুর রহমানকে যদি আমরা না চিনি, সে দোষ কার? ওনার না আমাদের?’
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি। উত্তর যে নেই তা নয়। কিন্তু সে প্রশ্ন এখন অর্থহীন হয়ে গেছে। মীজানুর রহমান এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। সবকিছুর উর্ধ্বে চলে গেছেন তিনি। নিজের জন্য কী নিয়ে গেছেন কে জানে; আমাদের জন্যে রেখে গেছেন তাঁর জীবনের সমস্ত কৃতি। সেগুলো মূলব্যান।
মীজানুর রহমান, আপনাকে সালাম।#
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন