বৃহস্পতিবার

হাংরি আন্দোলনের কবি ফালগুনী রায় : গৌতম ঘোষদস্তিদার

 

বাংলা কবিতায় এক সরব ও প্রকাশ্য অন্তর্ঘাত ছড়িয়ে দিয়েছেন হাংরি প্রজন্মের কবিরা। যে-পাড়ায় মহাশ্মশানে রামকৃষ্ণদেবকে দাহ করা হয়েছিল, যে-অঞ্চলে সতীর্থদের নিয়ে ডেরা বেঁধে ছিলেন তরুণ সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, সেই উপনিবেশের এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদারবাড়িতে. ৩০ রতনবাবু রোড, পিতামহ রামরতন রায়ের নামাঙ্কিত সরণি, জন্ম হয়েছিল তথাকথিত নষ্ট আত্মার কবি ফালগুনী রায়-এর ( ১৯৪৫ - ১৯৮১ )। ওই ভগ্নপ্রায় প্রাসাদোপম গৃহেই জন্মেছিলেন তাঁর অগ্রজ তুষার রায়, বাংলা কবিতায় আমরা যাঁকে ‘ব্যাণ্ডমাস্টার’ রূপে চিহ্ণিত হতে দেখেছি, যিনি এক সময়ে জনপ্রিয়তার নিরিখে শক্তি-সুনীলেরও ভাগিদার হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, অগ্রজের সঙ্গে কখনই কাব্যসম্প্রীতি বোধ করেননি ফালগুনী । তুষারের কবিতার নিরাপদ বিদ্রোহধ্বনি. তাঁর মন্ত্র কবিতাপাঠ স্বীকৃতি পেয়েছিল প্রতিষ্ঠানে । কিন্তু ফালগুনী এসব কিছুই চাননি, পাননি । সর্বোপরি তিনি ছিলেন প্রেমিকা-পরিত্যক্ত ও নেশাসক্ত । মৃত্যুর আগে কিছুদিন দীপক মজুমদার-সঙ্গ করেছিলেন । প্রথমাবধিই যুক্ত ছিলেন নৈরাজ্যবাদী, অঘোরপন্হী হাংরিদের সঙ্গে, যে-অপরাধে পাড়ায়-পরিবারে আক্ষরিকভাবেই নিগৃহীত হতে হয়েছিল তাঁকে । ফালগুনীর হাংরি-সঙ্গ এমনকী মেনে নেননি দাদা তুষার রায়ও । তুষারকে ভয় পেতেন ফালগুনী । বৃহত্তর কাব্যসমাজের কথা তো কহতব্য নয় । ফলে, চূড়ান্ত অবমাননা, প্রবল নেশাগ্রস্ততা ও সীমাহীন আত্মনিগ্রহবশে ‘নষ্ট আত্মার টেলভিসন’ ( ১৯৭৩ ) নামে এক ফর্মার একটিই কাব্যগ্রন্হ আর ছয় বছরের ব্যবধানে দুটি নাতিদীর্ঘ গদ্য লিখে, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে, নিকটবর্তী পারিবারিক শ্মশানে একদিন চিতা জুড়োয় ফালগুনীর । পরে তুষারেরও । অরুণেশ ঘোষের চেয়ে চার বছরের ছোটো হলেও, তাঁর সঙ্গে যথেষ্ট সখ্য হয়েছিল ফালগুনীর । সেই হৃদ্যতার কথা লিখেছেন অরুণেশ ঘোষ, “ওর ভাই তুষার রায়ের মতো ফালগুনীরও অকালমৃত্যু হয় । তুষার ছিলেন প্রতিষ্ঠানের কৃপাধন্য । ‘কলকাতাইয়া’ বলতে যা বোঝায় তুষার ছিল তাই । অথচ দাদার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল ফালগুনী । সে ভুলেও প্রতিষ্ঠানের পথ মাড়ায়নি । বরং সম্পর্ক গড়ে তুলেছে প্রতিবাদী হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের সঙ্গে । এজন্য তাকে বাড়িতে ও পাড়ায় শুধুই অপমানিত ও উপহাসিত হতে হয়নি, প্রহৃতও হতে হয়েছিল । আমাকে আক্ষেপকরে বলেছিল, পাড়ার ছেলেরা আমাকে কী নামর ডাকে জানো ? কী নামে ? --কবি বালগুনী রায় । বিষাদভরা মুখে আমাকে জানিয়েছিল । ওর বিষণ্ণতা আমাকে স্পর্শ করেছিল । প্রথাগত, গতানুগতিক লেখা লিখলে ওর ঠাঁই হতো প্রতিষ্ঠানের আঁস্তাকুড়েতে, অন্যদের যে-গতি হয়েছে।” আর ফালগুনী লিখেছেন ( ইট ইজ ক্রিকেট ) ‘আমি তাদের বলেছি : আমি রবীন্দ্রনাথ হতে চাই না/ রঘু ডাকাতও হতে চাই না---- আমি ফালগুনী রায় হতে চাই -- শুধু/ফালগুনী রায়/আমি জেনে গেছি এখন/ইডেনের গ্যালারি পুড়ে যাবার পরেও/পিচের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না/আসলে আমি জেনে গেছি এখন/গিলক্রিষ্টের রুদ্ররোষই পৃথিবীর সব নয়/জীবনে ওরেলের শান্ত চোখও আছে।” এভাবেই তিনি মেলাতে চেয়েছিলেন বেশ্যা আর প্রেমিকাকে, প্রসূতিসদন আর শ্মশানঘাটকে,ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়ির ভাঙা দরজাকে, ওই একমাত্র কাব্যপুস্তিকায়, যেখানে লিপিবদ্ধ আছে এক প্রবলতর অপরের, নগ্নতার ছায়া । সারা জীবন ওই তাঁর একমাত্র কবিকৃতি, ওই তাঁর অবিনাশী বেঁচে থাকা । ফালগুনীর মৃত্যুর আগে-পরে তাঁর কবিতা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংকলনের অন্তর্ভুক্ত না হলেও, ওই আপাত-অকিঞ্চিৎকর কাব্যপুস্তিকাটি পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার ছেপেছেন তরুণ কবিরা । সেই পুস্তিকার পেছন মলাটে ফালগুনী লিখেছেন, “জীবনানন্দ যেসব শূকরীর চিৎকার কানে শুনেছিলেন, তাদের সন্ততিরা -- সন্ততির সন্ততিরা আমার চারপাশে এখন চিৎকার করছে -- আমি জানি না আমার কবিতা দিয়ে সেই সব চিৎকার থামানো যাবে কি না ।” এই আত্মকথাটুকু আজও আমাদের স্তব্ধ ও পীড়িত করে রাখে । কেননা যে কবি বেমক্কা লিখে দিতে পারেন, “অলস বদ্মাস আমি মাঝে মাঝে বেশ্যার নাঙ হয়ে জীবনযাপনের কথা ভাবি,” তাঁকে অকাতরে মেনে নেওয়া, গ্রহণ করা, মাল্যভূষিত করা, অসম্ভব আমাদের পক্ষে । ফালগুনী যে-বাড়িতে জন্মেছিলেন, যে-খণ্ডহরে তিনি বেঁচে ছিলেন ৩৬ বছর, সেই বাড়ির পুরুষ-মহিলাদের সঙ্গে নিজের কোনো সম্পর্ক অনুভব করেননি তিনি । সেই ক্ষুধিত পাষাণের মতো বাড়ি বা ঐতিহ্যশালী পরিবারে তিনি যে বেঁচেছিলেন, ওই গণিকার অন্নদাসের মতোই । গণিকার ঘরে লোক এলে তাকে যেমন শ্মশানঘাটের দিকে নির্জন রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হয়, যেন সত্যিই ওই পরিবারের সঙ্গে, এই সমাজের সঙ্গে ফালগুনীর তেমনই সম্পর্ক ছিল । দোতলার সুখ ছেড়ে ফালগুনী শেষ পর্যন্ত ঠাঁই নিয়েছিলেন নির্জনতর চিলেকোঠার ঘরে । সেখানে অনেক আকাশ ছিল । অসময়ে কেউ এসে ভাতের থালা দিয়ে যেত । পরিবার-পরিজন তাঁকে তাচ্ছিল্য করত যেমন, তিনিও তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । আরো একা ও বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন সচেতনভাবেই ( হয়তো, সেই পরিপাশ আর পরিবারকে বাড়ির বহির্দ্বারে প্রস্তরীভূত সিংহের মতোই পরাক্রমী ভেবে, সেই সব সম্পর্কে শৃগালের মতো আতঙ্ক ছিল তাঁর । আর, তা ছিল বলেই ফালগুনীর কবিতায় ধরা আছে যেন প্রবল সিংহের প্রতি সন্ত্রস্ত ও ধূর্ত শৃগালের মৃত্যুগ্রস্ত বিদ্রূপধ্বনি । তাই তিনি কোনো শহিদ নন বাংলা কবিতার ; নিছকই আত্মঘাতী, জীবনাসক্ত ও প্রণয়ব্যাকুল এক কবি । বাকিটা নিশ্চিত ছদ্মবেশ । ১৯৭১ সালে বরাহনগরের গয়হত্যা দেখেছিলেন ফালগুনী । ঠেলাগাড়ি বোঝাই তরুণদের শব ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল গঙ্গায় । ওই লাশের পাহাড় তাঁকে কিছুদিনের জন্য অপ্রকৃতিস্হ করে তুলেছিল। সে-সময়ে তিনি লিখেছিলেন, “আমার রাইফেল, আমার বাইবেল” নামে টানা গদ্যের কবিতাটি, “আমার রাইফেল আমার বাইবেল এই নামের দুটো কবিতা পকেটে নিয়ে আমি গল্পকবিতার পথে হাঁটি -- এই পথে একজন অগ্নিযুগের বিপ্লবীর নামে রাস্তা ও বাজার এবং একজন সত্তর দশকের শহীদের নামে রয়েছে একটি শহীদ বেদি রয়েছে কলেজ স্কোয়ারের জলে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন গ্রন্হাগারের ছায়া রয়েছে কিছু দূরে মেডিকাল কলেজের মর্গ আর তার উল্টো দিকে দেবালয় ও গ্রন্হালয়ের মধ্যবর্তী পথ চলে গেছে স্ট্রেট গণিকালয়ের দিকে এই পথ দিয়ে আমি হাঁটি গল্পকবিতার দিকে...পেটোর বদলে দুটো কবিতা পকেটে নিয়ে গল্পকবিতার দিকে হাঁটি এই পথে একজন বিপ্লবীর নামে রাস্তা ও বাজার আছে, আছে সত্তর দশকের একজন শহীদের জন্য একটি শহীদবেদী এই পথে...।” কেবল সূর্য সেন স্ট্রিটের অস্হির পদচারণাটুকুই লিখেছিলেন ফালগুনী । লেখেননি পথের শেষে আদৌ গল্পকবিতা-র দফতরে পৌঁছেছিলেন কিনা, সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন কিনা কর্ণধার কৃষ্ণগোপাল মল্লিকের । যেন, তা পাঠককে জানানোর বিন্দুমাত্র দায় ছিল না তাঁর । একই সময়ে লিখেছিলেন ‘অন্তিম জরায়ু’ নামে একটি ছোট চিত্রনাট্যের আদল । পরে লিখেছেন ( ‘দ্বান্দ্বিক জীবনবাদ’ ), ‘তুমি যখন কবিতার ছন্দ ভাঙার মাইকেলী/বিপ্লবের কথা/ভাবো/তখন আমি অতুল গুপ্ত বা নীরেন চক্রবর্তীর বই পড়ে/শিখতে চাই মাত্রাবৃত্ত/তুমি যখন গণিকার নগ্নদেহে চোখ রেখে অভ্যাস করো সংযম/তখন আমি পাড়াতুতো দিদিবোনবৌদিদের কথা ভেবে/মেরে যাই হাত।’ এত বছর পরে ফালগুনীর কবিতা নতুন করে পড়লেও টের পাওয়া যায় সময়ের স্পন্দন । তাঁর মৃত্যুর চার বছর আগে রাজ্যে বামেরা ক্ষমতায় এসেছে । অধছ বরানগরের গণহত্যার কোনো কিনারা হয়নি । বরং মরিচঝাঁপিতে ঘটেছে রাষ্ট্রীয় গণহত্যা । তিনি যে সময়ের মধ্যে অতিবহিত করছেন নিজের সংক্ষিপ্ত জীবন, সেখানে কোনো রুপালি রেখা ছিল না, তাঁর সামনে পরিব্যপ্ত হয়ে ছিল এক দৈনন্দিন মহাশ্মশান, গঙ্গাঘাটে গাঁজা ও মদের আস্তানা, গণহত্যা ও ধ্বস্ত সময়ের সুদূরবিস্তৃত কালোছায়া । যা দেখেছেন, তিনি লিখেছেন তাইই, কোনও অসম্ভব আশাবাদের প্রত্যাশাতুর হননি কখনো । ফলে, প্রত্যাখ্যানই স্বাভাবিক প্রাপ্তি ছিল তাঁর । কোনও বিদগ্ধ সম্পাদক তাঁকে কখনো ডেকে বসতে বলেননি । মৃত্যুর পরেও কেউ তাঁর শব, অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি, ছুঁয়ে দেখেননি কোনো বিমূর্ত আতঙ্কে । ষাটের কোনো কাব্য সংকলনেও ঠাঁই হয়নি তাঁর । কেননা, সম্পাদক-প্রকাশকরা জানেন, মৃত্যুর পরেই এই সব বিদ্রোহীরা আরও জ্যান্ত হয়ে ওঠেন । তাই সেই সম্ভাবনা নাকচ করেছেন সকলে মিলে । শৈলেশ্বর ঘোষ ও অরুণেশ ঘোষের মতন ফালগুনীও বাংলা কবিতার লিরিকময়তা ও সমাজবাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । ফলে, প্রত্যাঘাতও এসেছে স্বাভাবিক নিয়মেই । এমনকী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও তাঁকে ‘অশিক্ষিত’ রূপে দেগে দিয়েছিলেন । প্রত্যুত্তরে শান্তভাবে ফালগুনী ‘ক্ষুধার্ত খবর’ ( ১৯৬৯ ) পত্রিকায় লিখেছিলেন সেই অবিস্মরণীয় ‘একজন অশিক্ষিত ও তিনজন হাংরী গদ্যকার’ শীর্ষক অস্বস্তিকর গদ্যটি এইভাবে যে, ‘সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন আমায় একদিন, আসবেন, কথা বলে বোঝা যাবে মাথায় গোবর ভর্তি কিনা, কথা বলে মানুষের সঙ্গে আমার মন্দিরে চুমু-খাওয়া কেউ ভাবছে পাপ কেউ পূণ্য মনে করছে, এটুকু বোঝা যেতে পারে কেবল অবশ্য সত্যিই গোবরের মতো সার পদার্থ যদি কাউর মাথায় থেকে থাকে, তিনি অপরের মাথাতেও তাই আছে ভাবতে পারেন যেমন আমি কফি হাউসে বসি, আবার খালাসীটোলাতেও যাই আমার মতন কেউ থাকতে পারে এ ধারণা আমার আছে।’ অথচ, উৎপলকুমার বসু বহু যুগ পরে ফালগুনীর ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসন’ পুস্তিকাটিকে ‘ভয়ঙ্কর’ ও ‘আততায়ীর হাসির মতো’ করে দেখেছিলেন ৯ দরগা রোড )। উৎপলের লেখার সূত্রে আমাদের মনে পড়তেই পারে র‌্যাঁবোর কথা । ফালগুনীর সঙ্গে র‌্যাঁবোর সাদৃশ্যটি ভিন্নরূপ । র‌্যাঁবো বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৭ বছর। ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত লিখেছিলেন দুটি মাত্র কাব্যগ্রন্হ, ‘নরকে এক ঋতু’ ও ‘মাতাল তরণী’ । ফালগুনী ৩৬ বছর বেঁচেছিলেন, লিখেছেন একটিই কাব্যপুস্তিকা । মৃত্যুর আগে দুই তিন বছর কিচুই লেখেননি । দুজনের মধ্যেই ছিল আত্মঘাতের প্রবণতা । কিন্তু, ফালগুনী বাঁচতেও চেয়েছিলেন, পারেননি । ফালগুনীকে তাই লিখতে হয়েছিল ‘শেষ বিবৃতি’ । ‘কালই বুঝি শেষ দিন/পৌঁছে যাবো শেষ জংশনে চিতায়/অথচ অনেক কাজ বাকি/ থিভস জার্নাল পড়া বাকি/ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চশমার ফাঁক দিয়ে পৃথিবী দেখা বাকি /জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুকারী রঙ পালটানো ট্রামে বসা বাকি/ মসৃণ জংঘা রমণীর সাথে সংগম বাকি/ মাইকেল-হেনরিআটার কবরে ঘাসফুল/ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হাঁটু মুড়ে কিছুক্ষণ বসে থাকা বাকি/ এখনো অনেক কাজ বাকি…’। এতকাল পরেও মনে হয়, ফালগুনীর যথাযোগ্য শেষকৃত্য করিনি আমরা । তাই তাঁর নষ্ট আত্মা এখনও মুক্তির অপেক্ষায় আমাদের চারপাশে দীর্ঘশ্বাসের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে । নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখনো পড়েননি ফালগুনীর কবিতা । যদিও এখনও সংশয় হয়, ফালগুনী যা লিখেছেন, তা আদৌ কবিতা কি না । বিশ্বাস হয়, তিনি যেন নিজের চিতারচনা কিংবা নিজের স্মরণ সভা লিখে রেখে গেছেন ওই অবিনাশী এক ফর্মায় । সেই বই এখনও আমাদের দিকে তাকিয়ে আততায়ীর মতো হাসে । প্রবল অস্বস্তি নিয়ে আমরা পড়ি জীবনানন্দ-আচ্ছন্ন তাঁর বাচনভঙ্গী, আর র‌্যাঁবো-বোদলেয়ার প্রাণিত নিজস্বতা ( আমি এক সৌন্দর্য রাক্ষস ), গণিকার বাথরুম থেকে প্রেমিকার বিছানার দিকে / আমার অনায়াস গতায়ত শেষ হয় নাই -- আকাশগর্ভ/ থেকে তাই আজো ঝরে পড়ে নক্ষত্রের ছাই পৃথিবীর বুকের ওপর/ তবু মর্গের ড্রয়ারে শুয়ে আছি এক মৃতদেহ আমার জ্যান্ত শরীর নিয়ে/ চলে গেছে তার শাঁখাভাঙা বিধবার ঋতুরক্ত ন্যাকড়ার কাছে/ প্রজাপতির চিত্রল ডানা দেখে বিরহ থেকে বিবাহের দিকে চলে যায় মানুষেরা/আমি এক সৌন্দর্য রাক্যস ভেঙে দিয়েছি প্রজাপতির গন্ধসন্ধানী শুঁড়।” সমকালীন অগ্রজ বা কবিবান্ধবরা ভুলেও ফালগুনীর কবিতা নিয়ে একটিও কথা বলেননি । ওই শীতল প্রত্যাখ্যান তাঁকে লেখা থেকে সরিয়েই এনেছিল । অথচ ফালগুনী কিন্তু অবলীলায় সুবিমল বসাক ও সুভাষ ঘোষের গল্প নিয়ে আলোচনা করেছিলেন ‘ক্ষুধার্ত খবর’ পত্রিকায় । আর, একক, নির্জন,অসহায় আততায়ীর মতো ফালগুনী লিখে রেখেছেন যেন নিজেরই এপিটাফ ( নির্বিকার চারমিনার ), ‘আমার লিভার পচে আসছে আমার পিতামহর সিরোসিস হয়েছিল হেরিডিটি বুঝি না আমি মদ খেয়ে কবিতা পড়ি আমার বাবা পুজোআচ্চার জন্য করতেন উপবাস পাড়ার দাদারা ধর্মের দোহাই দিয়ে টিপে দেন পাড়াতুতো বোনদের মাই । মা, বিদেশ ভ্রমণের দিন তোমাদের অভিজাত সমাজের অনেকেই ভদকা গিলেছেন আমি নির্বিকার তোমার চিতা থেকে ধরাবো চার্মিনার -- তোমার মৃত্যুর কথা ভাবলে আমার চোখে জল আসে তখন আমি ভূমির ভূমিকম্প কিম্বা জলের জলোচ্ছ্বাসের কথা ভাবি না কুমারী প্রেমিকার শায়ার দড়িতে হাত রেখে আমি পদাবলীর কথা ভাবিনি মা আমিও মরে যাবো একদিন।’ তবু মৃত্যু মেনে নেননি ফালগুনী । শেষ পর্যন্ত তাই তাঁকে লিখে রেখে যেতে হয় অন্যতর প্রতিবাদের ভঙ্গিমা ( ‘ব্রেনগান’ ), ‘একদিন পুরুষের মুত্ররন্ধ্র দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল মহাপুরুষের ভ্রূণ বীজ/ একদিন লেনিন বলেছিলেন, আমার গা থেকে ছালচামড়া ছাড়িয়ে/ নিলেও দু-লাইন কবিতা বেরুবে না -- আর আজ লেনিন অনুগামীরা/ কবিদের দিকে ব্রেনগান তুলে বলছে -- ‘উঁহু, ওরকম নয় এ রকম লিখুন/ আমি দেখতে পাচ্ছি রাইফেল ও কবিতা দুজনেরই ম্যাগাজিন দরকার।’ আজ, আমরা দেখি, সেই অতৃপ্ত আত্মার, ফালগুনীর, ঠোঁটে এখনো লেগে থাকে ট্রামলাইনের শীতল রক্ত, গায়ে মহাশ্মশানের ছাই । -------------------------------------------------------------------------- [ ‘নতুন কবি সম্মেলন শারদীয় ২০১৬’ সংখ্যায় “ক্ষুৎকাতরতার কবিতা, ষাটের অন্তর্ঘাত” প্রবন্ধ থেকে ফালগুনী রায় সম্পর্কিত অংশ প্রকাশ করা হলো । ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন