মঙ্গলবার

হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ও সুভাষ মুখোপধ্যায় : মলয় রক্ষিত

 


ষাট দশকের সামাজিক ও রাজনৈতিক ধ্বস্ত পরিবেশ, অর্থনীতির ভাঙন এবং তারই ফলশ্রুতিতে তৈরি হওয়া সাংস্কৃতিক ব্যবধানের এলোমেলো চেহারাটা বাংলা কবিতায় আরেকরকম ভাবে এলো। আমি হাংরি, শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের কথা বলছি । ১৯৬১তে প্রকাশিত হলো হাংরি জেনারেশন এবং হাংরি-আন্দোলন সম্পর্কিত ইশতাহার । এই ইশতাহারগুলি পাঠ করলে বোঝা যায় হাংরিরা এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন আমাদের ঔপনিবেশিক সূত্রে প্রাপ্ত নন্দনতাত্বিক বাস্তবতার যাবতীয় বোধ অথবা চিন্তাসূত্রকে আঘাতে আঘাতে চুরমার করে দিতে । হাংরি জেনারেশন ইশতাহার নং ১০-এ এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তৃতীয় সূত্রে লেখা হয়েছে----”ঠিক সেই রকম সৃষ্টি উন্মার্গে চালিত হতে হবে যাতে আগে থাকতে তৈরি পৃথিবীকে চুরমার করে পূনর্বার বিশৃঙ্খলা থেকে শুরু করা যায়।” 


এই ইশতাহার কবিতা বা সাহিত্যের যে-কোনো ধরণের সনাতন ঐতিহ্য বা পরম্পরাকে অস্বীকার করে, প্রত্যাখ্যান করে। যে-কোনো ধরণের মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ জানায় । কবিতার নন্দনতত্বের যাবতীয় সূত্রগুলিকে অস্বীকার করেই তাঁরা কবিতার ভিন্নতর এক পরিসর তৈরি করতে চেয়েছিলেন । সে ছিল বাঙালির মনন ও চিন্তনের জগতে এমন এক ধাক্কা যার অনিবার্য পরিণতিতে হাংরি কবিদের রাষ্ট্রবিরোধী, অশ্লীল ইত্যাদি অভিযোগে গ্রেপতার হতে হয় । 


মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ তাই বৈদ্যুতিক শকের মতন আমাদের ধাক্কা দেয়, আমাদের যাপিত-জীবনের পচা-গলা-নোংরা চেহারাটা যেন আয়নার সামনে মেলে ধরে মলয় বলেন, “শাশ্বত অসুস্হতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফূলিঙ্গ/মা তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?” যখন মলয় প্রচণ্ড আত্মধিক্কারে উচ্চারণ করেন, “মরে যাবো কিনা বুঝতে পারছি না/তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়/সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাবো/শিল্পের জন্য সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোবো/কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই”, কিংবা বিস্ফোরণের তীব্র আবেগেই যখন অসহ্য উচ্চারণ করেন, “কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে ?/কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি?/কেন আমি রজোস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায়?”


হাংরির সমস্ত কবিদের যাবতীয় কাউন্টার-কলোনিয়াল এসথেটিকস রিয়ালিটির পালটা কাউন্টার----তার গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসবার বিকল্প এক পরিসর তৈরির চেষ্টা, যেন বিদ্রোহ আর আত্মবিস্ফোরণে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে-যাওয়া সব চেহারা, ছটফটানি --- মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি সেসব কিছু ধারণ করে আছে । সমীর রায়চৌধুরী, সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, অরুণেশ ঘোষ কিংবা শৈলেশ্বর ঘোষ ও মলয় রায়চৌধুরীরা, এঁরা আসলে কেউই ব্যক্তি-নাম নন, যেন সংঘবদ্ধ এক ডিসকোর্স, স্বাধীনতা-উত্তর ধ্বস্ত পচনশীল ভারতভূমির এক বিকল্প পরিসর, বিকল্প টেক্সট ।


সুভাষ মুখোপাধ্যায় এই বিকল্প পরিসরের কোথাও ছিলেন না । সুভাষ পার্টিলাইনের ধুয়ো যেমন ধরেননি, তেমনি হাংরি শিবিরের ধারও কোনোদিন মাড়াননি । আবার ষাট দশকের ওই সর্বব্যাপী হতাশা, সঙ্গে চীনের কাছে যুদ্ধে গোহারান হারার লজ্জা থেকে উদ্ভূত আত্মলাঞ্ছনা তাঁকে বিচলিত করলেও কোথাও তিনি নিজেকে সময়ের হাতে সঁপে দেননি ।

[ অনুষ্টুপ গ্রীষ্ম-বর্ষা সংখ্যা, ১৪২২ ]


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন