সোমবার

হাংরি আন্দোলনের সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা মলয় রায়চৌধুরীর চিঠি

পাটনা
১৫.১১.১৯৬২
শ্রদ্ধেয় সুনীলদা
চিঠি পেলুম আপনার । আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ঠিক বোঝানো হয়ে ওঠেনি আপনাকে । আমাদের আন্দোলনটা নিঃসন্দেহে সামাজিক -- যে অর্থে নীৎশে, লরেন্স বা গিন্সবার্গ সামাজিক । নামকরণটা ( হাংরি জেনারেশন ) আমাকে সেই জন্যেই করতে হয়েছে । এখন, এই সময়ে, এমন একজনও নেই, যাঁকে আমরা সমালোচক বলতে পারি । তাছাড়া সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিজেদের নাম দিয়েই আরম্ভ করতে হয় । এমনিতেও সিমবলিস্ট, ইমেজিস্ট, বিট অথবা এগজিসটেনশিয়ালিজম, প্র্যাগমাটিজম, হিউম্যানিজম -- এসবই প্রথমে নিজেদের নাম দিয়ে তারপর উপস্হাপন করতে হয়েছে ।
         প্রথমে সাহিত্যকে আত্মস্হ না করলে, আপনি জানেন, এ আন্দোলন কারোরই জনরে পড়তো না । আর এটাকে ঠিক আন্দোলন বলাটাও ভুল । আমি এমন অনেককে দেখলাম যিনি মার্কসের নাম শুনেছেন, স্পেংলারের নাম শোনেননি, নীৎশে যে ‘বার্থ অব ট্র্যাজেডির’ লেখক তা জানেন না । তবে ? এঁরাই আবার জয়েস কাফকার নাম করলেন ! একেবারে কিছু না জানা বা সম্ভাব্য কিছু জানার আগ্রহটাই, আমার মনে হয়, সততার লক্ষণ । সে যাক, আপনি লিখতে রাজি নন কেন, সেটার কথাতেই আসা যাক । মার্কসবাদী আপনি তো নন । তবে ? সেটার জন্যেই আমি হাংরি জেনারেশন নামটা দিয়েছি : কারণ নেরুদা আর মিলটন আমাদের একই সঙ্গে ‘ভালো’ লাগে । আপনি নিজের কথাটাই ভাবুন । লিখেছেন, “কবিতা এই নয় ওই নয় বলাবলির কি আছে জানি না” ; তারপরই বলেছেন, “কবিতা জিনিসটার নাম বদলে ওটাকে প্রাইভেট বায়োগ্রাফি করা যায় কিনা দেখতে চাই ।” অর্থাৎ আপনি একই সঙ্গে, আপনার কবিতার মতোই,
সলিপসিজমকে স্বীকার ও অস্বীকার করতে চাইছেন । হয়তো শক্তিদা জড়িত থাকায় আপনি লিখতে চাইছেন না, দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য থাকায় । কিন্তু রেক্সরথ, কেরুয়াক ও অ্যালেনের দৃষ্টিভঙ্গী তো একেবারে এক নয় । তবু ওঁদের একই ব্যানার । এবং সেটাও ওঁরা স্বীকার করেছেন। আমাদের ব্যাপারটা যদি আন্দোলনও হয়, তাহলে সেটা মতপ্রকাশের আন্দোলন । এখনকার তরুণরা অনেক বিষয়েই পরস্পরের থেকে পৃথক, তবু তারা সকলেই কফিহাউসে গেছে এবং যায়, কারণ, কোথাও তাদের মিল আছে, আর এটা নিয়ে হাংরি জেনারেশন ।
         অন্যেরা কি করে আন্দোলনের নাম আন্দোলন দিতো, যখন কিনা অন্যেরা এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের একটা ইতিহাস লিখল না, যখন কিনা অন্যেরা রুশোর নাম না শুনেও ভোট দিতে যায়, যখন কিনা অনভেরা জানে না গ্রিসের মাটি-পৃথিবীর রঙের আর য়ুরোপের রেনেসঁসের কালে ব্যবহৃত রঙের পার্থক্য থেকেই মড়া পোড়ানোর বা কবর দেবার পার্থক্য। কি করে আপনি ভাবলেন যে অন্যেরা এগিয়ে আসবে ? গল্প আর কবিতা লেখার পর সমালোচনা হয় এখনও । কেবল প্রবন্ধ লেখেন এমন একজনও নেই । প্রত্যেক তরুণই দেখি উপন্যাস লেখার কথা ভাবছে । পৃথিবীর, সমাজের, হায়েনার বাজারের দাবিকে অস্বীকার করেই হাংরি জেনারেশন ।
         কখনও, ইচ্ছে হলে, লেখা দেবেন আপনার ।
         শক্তিদার রচনাটা বোধহয় উত্তেজনায় লেখা । তাই ব্রেনের কারিকুরিতে পণ্ড হয়ে গেছে। তাছাড়া, আমার মনে হয়, রচনা ‘ভালো’ অথবা ‘খারাপ’ বা ওই ধরনের শব্দগুলো প্রাগৈতিহাসিক। অ্যাকাডেমিকও বটে । দেখা উচিত শিল্পের পর্যায়ে উঠলো কিনা । অ্যালেনের কবিতাগুলো এতো ‘খারাপ’, আর তাই সুন্দর আর শিল্পসন্মত যে, অনভেরা কেন এমন কবিতা লিখতে পারে না ভাবতে অবাক লাগে । সমালোচনার মিমিক থিয়োরিটা আসলে অ্যারিস্টটলের। আর তাই ওই কালেই ঠিক ছিল । প্র্যাগম্যাটিক, এক্সপ্রেসিভ বা অবজেকটিভ থিয়োরিগুলো কেবল থিয়োরি । আমার কেমন হাস্যকর মনে হয় ।
         আপনাকে যে টার্মগুলো পাঠিয়েছিলাম, সেগুলো কিন্তু নিজের যা ইচ্ছে তাই লিখতে বলেছিলাম । ওদেশে কোনো কবিকে ছন্দের ডেফিনিশন লিখে দিতে বলা হলে, লিখে দিতেন, ‘মারডারিং’ । এটা বোধহয় ব্যকরণের আওতার বাইরে ।
         আশা করি আর সব কুশল । প্রণামান্তে মলয় ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন