মঙ্গলবার

হাংরি আন্দোলনের সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সমীর রায়চৌধুরীর চিঠি

  Samir Roychoudhury

Bombay
২০/৫
সুনীল
         তোর দীর্ঘ চিঠি পেলাম । তোর মানসিক অবস্হা জেনে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছি। শক্তিকে আমরাই এত বড় করে তুলেছি । এর মূল দায়িত্ব তোর, আমার ও মলয়ের । এবং এখনো আমার প্রতিটি বন্ধুকে বড় করেই তুলতে চাই আমি । শক্তিকে লেখার জন্য প্রাথমিক উৎসাহ তুইই দিয়েছিলি । বারেবারে বাহবা দিয়ে “বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি” একথা তুইই প্রথম তুলেছিস । অর্থাৎ শুধু এই যে আজ শক্তি সেকথা নিজে বলছে । চাইবাসায় থাকতেই তোকে বাদ দিয়ে শিল্পের সিংহাসনে বসার একটা ঘোরতর প্ল্যান উৎপল ও শক্তি অনেকদিন আগেই করেছিল । আমাকেও উপস্হিত থাকতে হয়েছিল এই সব আলোচনায় । পত্রিকা বের করার প্ল্যান তখনই হয়। আন্দোলনের ব্যাপারটাও মলয় বারবার তাগাদা দিতে থাকে । আমি বরাবরই কৃত্তিবাসকে ছাড়তে পারব না জানিয়েছি । নানান সেন্টিমেন্টাল কারণে কৃত্তিবাসকে আমি আমার নিজের পত্রিকা মনে করি । অনেকের মতন ‘সুনীলের কাগজ’ মনে করা সম্ভব নয় । শক্তি ও উৎপল তোকে বাদ দিয়ে ‘জেব্রা’ বার করতে পারবে কিনা মনে হয় না । অন্তত মলয় এটা হতে দেবে না। তাছাড়া সমস্ত নীচতার মধ্যেও সূক্ষ্ম বোধশক্তির দংশন শক্তিও এড়াতে পারবে না । আমাদের মধ্যে একটা ভাঙন গড়ে উঠবে এ আমার বিশ্বাস হয় না । হলে শক্তিরই প্রচণ্ড ক্ষতি হবে । টাকাপয়সার দরকার ওর শিল্পের জন্যও, শীলাও আছে, দার্শনিক ঋণও প্রয়োজন, সমীর ও মলয়কে ও সেইসঙ্গে সুনীলকে বাদ দিলে যে মারাত্মক অবস্হায় ও পড়বে তা ও জানে । আমাকে শক্তি লিখেছে ‘জেব্রা’য় তোর লেখা থাকছে । বেরোতে নাকি মাস দুয়েক দেরি । বরং উৎপলই একটু বেশিমাত্রায় তোর বিরোধী । হয়তো ঈর্ষা, হয়তো অন্য কোনো কারণ । উৎপলকে খুশি রাখতে গিয়ে হয়তো এই সব জটিলতায় শক্তি বাধ্য হচ্ছে । মলয়ের অভিমান এই যে তুই ওকে বিন্দুমাত্র স্নেহ করিস না ; নিতান্ত ছেলেমানুষী । সেবার শীলা পাটনায় ভর্তি হতে গেলে শক্তিকে পাটনায় নিয়ে যাই আমি । সেখানে মলয় ওকে এই আন্দোলন সম্পর্কে Convince করে । ছোটোগল্পে লিখেছে যে গল্পটা, তারই প্লট ও প্ল্যান মলয় শক্তিকে দেয় ( ক্ষুৎকাতর আক্রমণ )। ঠিক হয় যে কলকাতায় গিয়ে পুস্তিকা বের করে ব্যাপারটা আরম্ভ হবে । আমরা সবাই থাকবো। তুইও নিশ্চয়ই । আমাদের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা না করেই শক্তি কলকাতায় ফিরেই ব্যাপারটা আরম্ভ করে দেয় । এদিকে ট্রেনিং-এ চলে আসতে হয় আমাকে । মলয় পাটনায় । কলকাতায় শক্তি একা নানান ভাবে নিজের স্বপক্ষে সিংহাসন গড়ে তোলে ক্রমে । তুই ব্যাপারটায় যোগ না দেওয়ায়, যেটা ভুল-বোঝাবুঝিতে পেছিয়ে গেছে, আজ অবস্হা এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা মলয়ও বলেছে । মলয় এখন যেকোনো রকমে তোকে চায় । ফলে হয়তো তোকে এই ধরণের আক্রমণ চালাচ্ছে । অদ্ভুত সব জটিলতা । ‘ক্ষুধার্ত’ নামে একটা কবিতা সংকলন বার করতে চায় ও । আমাকে লিখেছে তোকে পদ্য পাঠাতে বলতে । ব্যাপারটা নিজেই সম্পাদনা করতে চায়, শক্তির জটিলতা এড়িয়ে । সন্দীপনও বোধহয় একটা গদ্য সংকলন বের করবে । আমি ‘চিহ্ণ’, ‘ছোটগল্প’ ও ‘জেব্রা’র জন্য ছোটগল্প পাঠিয়েছি ওদেরই অনুরোধে ।
         খ্যাতির প্রতি শক্তির প্রলোভন চিরদিনই আছে । ওর পরিবেশ অনুযায়ী হয়তো এটা স্বাভাবিক । আসলে মানুষ না হয়েই শিল্পী হওয়া যায়, এটাই যতো গণ্ডগোলের। ছোটোলোক, নীচ ও চোরও শিল্পী হতে পারে । শিল্পী হওয়ার জন্য বরং এসব ব্যাপার সাহায্যই করে । ফলে বন্ধুত্ব, মনুষ্যত্ব নিয়ে গণ্ডোগোল বাধে ।
         এক মুহূর্তেই হয়তো শক্তির সমস্ত দম্ভ, অহংকার, নীচতা ভেঙে চুরমার করে দেওয়া যায় বাংলাদেশের কাছে । এর উপযুক্ত নজিরের অভাব নেই আমার কাছে ; কিন্তু শক্তির বিরুদ্ধে বা কারোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় কোনোদিন । আমার কতকগুলো নিজস্ব আদর্শ আছে, তা ভুল বা ঠিক হোক আমি তা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই । প্রতিক্রিয়া হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না ।
         কৃত্তিবাসের জন্যও তোর যে আদর্শ, তাকে ধরে রাখতে হবে তোকে, আশপাশের কারো চিৎকারে বিব্রত হওয়ার কিছুই নেই । কৃত্তিবাস আমরা বের করে যাবোই । আমি ব্যক্তিগতভাবে শিল্পের চেয়ে মানুষকে বেশি ভালোবাসি । শক্তি শিল্পী হিসেবে অনেক বড়ো ও মানুষের চেয়ে শিল্পকে অনেক অনেক বড়ো মনে করে । আমি শিল্পকে পৃথক মনে করতে পারি না ।
         প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গী পৃথক হওয়াই স্বাভাবিক এবং উচিতও । শক্তি বা উৎপলের মতো কবিতা না লিখলে কবি নয়, এসব ছেলেমানুষীতে আমি বিশ্বাস করি না । শক্তির কিছু-কিছু কবিতা যেমন আমাকে উন্মত্ত  বিহ্বল করে, অলোকরঞ্জনের কোনো কোনো কবিতায় আমি তেমনই প্রস্ফূট হয়ে যাই । সেই মুহূর্তে অলোকরঞ্জনকে আমার সমস্ত সত্তার মালিক মনে হয় । কি করে তাকে অস্বীকার করি ? তেমনই হয়তো এমনও কেউ আছেন যাঁর তারাপদর পদ্যে আরোগ্য হয় । এসব শ্রেষ্ঠত্ব স্হির করার আমরা কে ? যাঁরা কবিতা পড়েন তাঁদের ওপরই, সময়ের ওপর, এসব ছেড়ে না দিয়ে নিজেদের ঢাক ঢোল নিয়ে কাড়াকাড়ি করার কি যে সুখ আমি বুঝি না । এসব চালিয়ে গেলে শক্তি অনেক বড়ো ভুল করবে । যতো বড়ো হতে পারে ও তাকে নিজ হাতে খর্ব করবে । হয়তো অ্যালেনের বিশ্বজোড়া নাম দেখে ও কিছুটা উত্তেজিত হয়েছে । একথা শক্তি কয়েকবার বলেওছে আমাকে ।
         জুনে পনেরো তারিখে এখান থেকে রওনা হয়ে সতেরো তারিখে চাইবাসা পৌঁছোব। তুই আয় না তখন । শক্তিকেও আসতে বলব । একসঙ্গে তিনজন থাকলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে যাবে আপনা থেকেই । চারিদিকে বেড়িয়ে বেড়ানো যাবে । বেলাও বেশ সুস্হ হয়ে উঠেছে।
         চিঠি দিস । হাংরি জেনারেশনের বিরুদ্ধেই না হয় কয়েকটা প্রচণ্ড গদ্য ও পদ্য লেখ । হাংরি জেনারেশনের একটা বিশেষ পুস্তিকায় বের করব আমি ; মলয়ও রাজি হবে । আসলে এই সব আন্দোলনের চেয়ে হৃদয়ের আন্দোলনটাই আগে দরকার ।
         সারা জীবন একাকীত্বের দুর্ভোগ হয়তো এভাবেই আত্মসাৎ করে যেতে হবে আমাকে । তবু এবং হয়তো এই জন্যেই শিল্পের চেয়ে আমি মানুষকে পৃথক করতে পারি না, বড়ো মনে করার বা ছোট মনে করার কারণ খুঁজে পাই না ।
                                                                       সমীর রায়চৌধুরী


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন