শনিবার

সমীর রায়চৌধুরীর গালগল্পের দ্রব্যগুণ : জপমালা ঘোষরায়

 

সমীর রায়চৌধুরীর গালগল্পের দ্রব্যগুণ
------------------------------------------------------

জপমালা ঘোষরায়

# কলকাতার আদিপুরুষ সাবর্ণ চৌধুরীর বংশধর সমীর রায়চৌধুরী নামক বিস্ময়পুরুষের সাহিত্যকর্মের প্রতি আগ্রহ লালন করেছিলাম একেবারেই কলজছাত্রীবেলা থেকে। আমার বাবা, ৫০ এর দশকের রবীন্দ্র অনুসারী কবি। তাঁর কাছে শুনেছিলাম সমীর রায়চৌধুরী হাংরী সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা এবং অনেক পরে, ৯০ এর দশকে এসে জানলাম তিনি বাংলা পোস্টমডার্ন সাহিত্য আন্দোলনেরও পথিকৃৎ। তখন পড়ার সুযোগ বলতে কালে ভদ্রে কলেজস্ট্রিট গিয়ে কিছু বই সংগ্রহ করা। তাও মেইন স্ট্রিমের লেখকদের বই পাওয়া গেলেও ওঁর মতো প্রতিষ্ঠান বিরোধী কোনো লেখকের বই তেমন পাওয়া যেত না। কাজেই বুভুক্ষা থেকেই গেছিল। পরে যে আর পাঁচজন সাহিত্যসেবকের মতো আমিও তাঁর সরাসরি স্নেহ সান্নিধ্য লাভ করবো এই চমৎকারের কথা কখনো চিন্তাও করিনি। বন্ধু কবি ও প্রাবন্ধিক মৌলিনাথ বিশ্বাসের সাহায্যে এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ /ছ বছরে এসে। বলা যায় আমিই বোধ হয় শেষতম সেবক যাঁরা তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছেন। তাঁর অজস্র গল্প প্রবন্ধ এবং কবিতা পড়ার সুযোগ যত পেয়েছি, যত তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের ঝর্ণাধারায় অবগাহন করেছি, ততই খুলে গেছে সিমসিম। পরে সম্পাদক মৌলিনাথ আমার মত দীন কলমজীবীকে দিয়ে সমীরের জীবিতাবস্থায় তাঁর গল্পের আলোচনা লিখিয়ে নিয়েছিলেন "কালকথা" পত্রিকায়। কোনো জীবিত কিংবদন্তীকে নিয়ে লিখতে গেলে ভয়টা থাকেই সুতরাং পড়াশুনোয় কোনো ফাঁকি চলে না। সমীরের অনেক লেখালিখির মধ্যে "খুল যা সিমসিম" গল্পগ্রন্থ এবং "অপূর্বময়ী স্মৃতি বিদ্যালয়" কাব্যগ্রন্থ দুটি মাত্র মনোযোগ দিয়ে পড়লেই আন্দাজ করা যাবে সমীর রায়চৌধুরী নামক সমুদ্রের ব্যাপ্তি ও গভীরতা। সবচেয়ে বড় ছিল তাঁর কথা বলার অসামান্য ভঙ্গী, কখনো ব্যাপ্তি থেকে শিকড়ের দিকে আসছেন পরক্ষণেই শিকড়কে রেখে দিয়ে ঘাসবিন্যসে চলে যাচ্ছেন ব্যাপ্তির দিকে। এই বিপ্রতীপ ধরতাই থেকেই সমীর রায়চৌধুরীর লেখনবিশ্বকে জানতে হবে। সমীরের জন্ম ১লা নভেম্বর ১৯৩৩ পানিহাটিতে, পরবর্তী সময় কাটিয়েছেন বিহারের পাটনা শহরে, অর্থাৎ দুটি ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান তাঁর মননকে বায়নারি থটপ্রসেসের মধ্যে লালন করেছে, যুক্তির ফাটল বা লজিকাল ক্র‍্যাক থেকে চিন্তার বিস্তারে সাহায্য করেছে। ফলত তাঁর গল্প একটা মাল্টি অ্যাঙ্গুলার ভঙ্গিমা পেয়ে গেছে এবং ভঙ্গিমা বাঙালীর আড্ডাখানার শুরু শেষ হীন চিরকেলে গালগল্পের মতো। এ প্রসঙ্গে বলি সমীরের গল্প সম্পর্কে "গালগল্প" শব্দটি ব্যবহার করেছেন তাঁর ভাই, বিখ্যাত সাহিত্যিক "হাংরিপুরুষ" মলয় রায়চৌধুরী।

# একসময় মনে করা হত ছোটগল্পের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল তাৎপর্যে পৌঁছানো এবং তারজন্য চাই শক্তপোক্ত ঘটনা, স্থান কাল অনুযায়ী চরিত্র। কিন্তু এখন যেহেতু জীবন রিমোট কন্ট্রোলে বদলে বদলে যাওয়া চ্যানেল, হাজারো অ্যাপ এ ডাউনলোড করে ফেলা চমৎকার, তাই এখনকার গল্প অন্যরকম। এখন গল্পে নানারকম টুকরোটুকরো উদঘাটন বীজের মতো ছড়িয়ে যায়। জীবনের পাজলগুলো কুড়াতে কুড়াতে "আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে"। সমীরের গল্পে সমীর এভাবেই খোঁজেন সেল্ফ আইডেন্টিটি। খোলাখুলি বলতে কি, সমীরের লেখালিখিতে, তাঁর বোধের পুঁজিতে, গঠনকাঠামোয় কোথাও প্রাতিষ্ঠানিকতার ছোঁয়া মাত্র নেই। আছে কালখন্ডের ক্ষয়, নিরন্তর শূন্যতা, গ্লানি ও হতাশার বিরুদ্ধে দ্রোহ। কিন্তু এই দ্রোহের উচ্চারণ উচ্চকিত, মানে ফাটিয়ে দেওয়া বলতে যা বোঝায় তা নয়, এই দ্রোহ প্রত্যয়ী উচ্চারণে মজা শ্লেষ কৌতুকের রীতিতে ভাষাশব্দ ও লেখনবিশ্ব নির্মাণের। সরাসরি বলাই ভালো, সৎসাহিত্যের গুহামুখ খুলে দিয়েছে সমীর রায়চৌধুরীর গল্পবিশ্ব।

# সমীরের গল্পে অন্ধকার ততটা অন্ধকার নয়, শূন্যতা ততটা শূন্যতা নয়। শূন্যদশকে লেখা তাঁর একটি সাড়া জাগানো গল্প "মেথিশাকের গন্ধ" শুরুর আগে তিনি কোনো প্লট ভাবেন নি। তিনি ভাবেনও না। একটা বিষয়হীনতা দিয়েই শুরু করেছেন। কলকাতার নর্দার্ন পার্ক, ব্রহ্মপুরের বাড়িতে হঠাৎ লোডশেডিং এবং নিশ্চিদ্র অন্ধকার বাড়ি। তিথিগত আঁধারে আকাশের আলোটুকুও নেই। বসার ঘর থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত আপাত অদৃশ্য অথচ ঘ্রাণ আছে এমন এক "সামথিং"কে ইডিকেট করে তাঁর থটপ্রসেস বহুস্তরীয় অন্ধকারকে বহু কৌণিকতায় বিশ্লেষণ করতে করতে জীবনধর্মের মুক্তমুখে এগিয়ে যাচ্ছে।"একজায়গায় গিয়ে নিশ্চয়ই মেথিশাকের গন্ধের সঙ্গে শেফালির উপস্থিতির জৈব গন্ধ মিশবেই" এটাই জীবনমুুুুখীতা। একথা চিন্তা করতে করতে অন্ধকারের মধ্যে দিয়েই গল্পকার এগোচ্ছেন, যেখানে মেথিশাক রান্না করতে করতে হঠাৎ ঘটে যাওয়া অন্ধকারে শেফালির হাত থেকে একটি কাঁচের শিশি পড়ে ভেঙে চুড়মার হয়ে যাচ্ছে এবং শেফালি অন্ধকার ভেদ করে চেঁচিয়ে সাবধান করে দিচ্ছে "এদিকে এসো না"। অর্থাৎ অন্ধকারে একজনের অভ্যস্ত যাপনেও ভাঙচুর আসছে। আবার নিমেষেই ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হয়ে গেল দৃশ্যমান যা কিছু। সমস্ত "সামথিং" তখন "নাথিং" হয়ে গেল। এখান থেকেই উঠে আসছে একটা জাদু বাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়্যালিজম, অন্ধকারের বহুস্তর। একস্তরে শৈশবে মায়ের শেখানো সাবধানবাণীতে জুজুবুড়ি আর খোক্কস ভয়, আবার রাঙাদিদুর গপ্পে সেই খোক্কসজয়ের নির্দেশনা, এটা একটা স্তর। তার পরই রাঙা দিদুর মৃত্যুর পর মা যখন বললেন দিদু অন্ধকারের দেশে চলে গেছে, এবং সমীরের মনে হল কত প্রিয়জন সেই অন্ধকারের দেশে চলে গেল "সেই প্রথম অন্ধকারের মধ্যে প্রিয়জনের বাসা তৈরি হল" এটাও একটা স্তর। এভাবেই অন্ধকার হাতড়াতে হাতড়াতে মনে হল মা এবং ছোড়দির কথা যাঁরা মেথিশাক ভালোবাসতেন। "অন্ধকারের কত অলিগলি, অন্ধকারের মধ্যে একধরণের ফাটল"। এই প্রসঙ্গে এই অদৃশ্যের মধ্যেও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে শিল্পী অমিতাভ ধরের ছবি। ম্যাজিকাল রিয়্যালিটি। দুদিন আগে অন্ধকারে চলে যাওয়া শিল্পী বাঁধন দাসের থিওরি মনে আসছে "বাঁধনের কথা আজ খুব বেশী করে মনে পড়ছে। মাত্র দুদিন হল সে মারা গেছে।.......বাঁধন বলত অন্ধকারের স্থানিকতা। স্পেস যেভাবে সম্পর্ক গড়ে"। মেথিশাকটা আসলে এই গল্পে কোন বিষয়ই নয়। মেথিশাকের গন্ধকে কেন্দ্রকরে ভেদের শনাক্তকরণ থেকে অভেদের দিকে যাত্রা। এভাবেই বহুস্তর ভেদ করতে করতে শেষে এসে বললেন ডাইনিং টেবিলের কাছে একফালি শীতরোদ্দুর যেমন খুব চেনা এবং এবাড়ির নিজস্ব সম্পদ, তেমনি অন্ধকারটুকুও চেনা জানা, এবাড়ির নিজস্ব, যার সঙ্গ নিতে কোনো অসুবিধে নেই। সে হল "কালো রঙের কাজ"। প্রি-মডার্নের মতো আলোর বিপরীত অন্ধকার তো নয়ই, পাস্ট-মর্ডান বা আধুনিকোত্তরের মতো আলোর পরিপূরকও না। এখানে দুটোই সহজ এবং সমান (আলো= অন্ধকার)। এভাবেই যেখানে ছেড়ে দিলেন সেখানে অন্ধকার আনবাউন্ড, এন্ডলেস এবং আলোর চেয়েও আলোকিত হয়ে উঠল। এটাই সমীরের গল্পহীন গল্পের অভিনবত্ব এটাই পোস্টমডার্ন।

# সমীর রায়চৌধুরীর গল্পের নামকরণগুলিও অন্যরকম, যেমন, বহুজাতিক ভূতের গল্পের খসড়া, শ্রীশ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বচন, স্মৃতির হুলিয়া প্রতুলের মা ওমলেট অবধি, ছাতা হারানোর বর্ষাকালীন দুকখু, কবিরাজ চাঁদচুড়ামণি শ্রীব্রজেশচন্দ্র কথিত দ্রব্যগুণ, একমিনিট বিয়াল্লিশ সেকেন্ড ওসামা বিন লাদেনের ক্যাম্পে ইত্যাদি। বোঝা যাচ্ছে নামকরণের ক্ষেত্রেও তিনি অপ্রাতিষ্ঠানিক। সমীরের গল্পকে গালগল্প বলার কারণ হল তিনি কোনো প্লট ভেবে নিয়ে গল্প লিখতে বসেন না। কোনো কাল্পনিক চরিত্রও থাকে না। তিনি নিজে একজন ব্যক্তি এবং ব্যক্তি সমীরের জীবনের অভিজ্ঞতার সূতোগুলোকে টেনে টেনে এনে জুড়ে দেন গল্পের মধ্যে। প্রসঙ্গক্রমে অনেক বাস্তব চরিত্র এসে যায়। কিন্তু তারা এমন ভাবে আসে যে তাদের কোনো কৈফিয়ত ও থাকে না। বা কৈফিয়তি দায়টাও সমীরের থাকে না। যেমন শুভাপ্রসন্ন, বাঁধন দাস, অমিতাভ ধর, কালীকৃষ্ণ, শ্যামল মজুমদার প্রমুখ ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি যথাযথ ভাবেই তাঁর গল্পে আছে। আবার খুল যা সিমসিম গল্পের চাবিওয়ালা আসগর আসলে চাবিওয়ালা আসগরই। অন্য কেউ না। কিন্তু তার উপস্থিতি, ক্রিয়াকর্ম ইত্যাদি নিয়ে চরিত্রটিকে এমন অদ্ভুত ম্যাজিক্যালি রিয়্যাল করে তুললেন যে সে একটা গল্প হয়ে উঠল। প্লট বিহীন গল্প।

# "বহুজাতিক ভূতের গল্পের খসড়া" একটি খসড়া মাত্র নয়, বিশ্বায়নের হাজারো বাস্তব মজার মধ্যে একটি ম্যাজিক রিয়ালিস্টিক মজা। সমীরের লেখায় এই ঐতিহাসিক ধরতাইটাই অ্যাবসলিউট সত্য। জীবনের কত দ্বন্দ্ব সংঘাত দুর্যোগ, কত জ্যোৎস্না মেঘ কুয়াশা, অন্ধকারের ফাটল দিয়ে তিনি সব ম্যাজিকের মত দেখতে পান এবং সেভাবেই দেখান পাঠক বা শ্রোতাকে। কোনো পাব্লিশার প্লিজ আহত হবেন না! আঘাত দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। বইপাড়ার ব্যবসা নিয়ে সমীরের যা মনে হয়েছে আমি তার বিশ্লেষক মাত্র। এখানে কার্তিক নামের লোকটি বইপাড়ার পেশাদার ভৌতিক গল্প লিখিয়ে। বোধোদয় নামক দোকান অথবা সংস্থা থেকে তার জন্য রেডিমিক্স প্যাকেটে ভূতের গল্প লেখার অর্ডার এসেছে। ছবিছাবা সহ থিম দেওয়া আছে সেই অনুযায়ী গল্পের প্লট ভাবতে হবে। বাজারে কী ধরণের ভূতের গল্পের কাটতি আছে সেই অনুযায়ী অর্ডার। ছোটোদের ভূতের গল্প কার্তিক অনেক লিখেছে কিন্তু এবার তাকে লিখতে হবে বড়দের ভূতের গল্প, তাও আবার কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডকে সামনে রেখে বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে মাল্টিন্যাশনাল বা বহুজাতিক ভূতের গল্প। সমীর কোনো চরিত্রকে কখনো আঘাত করেন না বরং একটা সহজ আনন্দময়তায় ছড়িয়ে দেন। কিন্তু মুশকিলটা হল কার্তিকের ভূতের গল্পের খসড়া আর জমে না কিছুতেই। হাজার চেষ্টা করেও সে বহুজাতিক ভূতকে নামাতে পারেনা। " বোধোদয় বলে এমন তো হওয়ার কথা নয়। নামকরা ব্র‍্যান্ডনেম। সবচেয়ে বেশী কাটছে। প্রশ্ন করে আবছায়া ছিল? -- হ্যাঁ, আর পোড়োবাড়ি? -- সেও ছিল। নিশাচর চলাফেরা? -- ছিল বৈকি, ছাতা হারানোর বর্ষাকালীন দুঃখু? --- তাও তো ছিল..... তাহলে অসুবিধা টা কোথায়?.... কার্তিক বুঝতে পারে না শেষ পর্যন্ত সেল্ফমেডের প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফেরে.... কেবলই অনুমেয়র দিকে তাকিয়ে আরও আরও... ভূতভাবনের বহুব্রীহি।.... একদিন পেয়ে যাবে। ধরা ছোঁয়ায় আসবে মনের মতো ভূত..." এভাবেই একটা ফ্যান্টাসি, এক আনন্দময় জগতের চলা ফেরার কথা। একটা সমস্যার কথা বলা হল কিন্তু কোনোরকম ক্যাওস ছাড়া, তছনছ ছাড়াই একটা ম্যাজিক রিয়ালিজমের মোড়কে।

# কালখণ্ডের চমৎকার কৌতুক হল বুদ্ধিজীবীদের বাজারায়ন তথা বিশ্বপুঁজিবাদ। একথা বোধহয় আধিপত্যবাদীরা বুঝে ওঠার আগেই বুঝে ফেলেছিলেন কতিপয় গোত্রচিহ্নহারা দ্রোহপুরুষ, তার মধ্যে সমীর রায়চৌধুরী অন্যতম। "শ্রীশ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বচন" গল্পে এই বাজারায়ন আর ভোগবাদের সম্পন্নতা ও বিপন্নতা দুই ই চিহ্নিত করেছেন ডবল ডুয়ালিটিতে। তাবড় তাবড় দেশীয় বণিকদের মদতে চমকদার সাবান, তেল, কেশকালা, মাজন এসব তৈরী করছে।এই সব সামগ্রীর দ্রব্যগুণ বিচারের জন্য কোথাও কোনো বাণিজ্যসংস্থা দশ বিলিয়ন খরচা করছে বিজ্ঞাপন বাবদ। এদের সমবেত আক্রমনের ফলে আমজনতা বিভ্রান্ত হচ্ছে। বিগবাজারে তারা বলিপ্রদত্ত হয়েও বুঝতে পারছে না যে ভোগবাদ আসলে একটি রোগ। ধর্মের টোপ গেলানো হিন্দু মাঙ্গলিক বচন "ওঁ হ্রীং শ্রী ওঁ লক্ষ্মীবাসুদেবায় নমঃ"। পিনাকী বলে ক্রেতাকে বিব্রত না করে বাজার দখল করতে হবে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে অনেক কবি লেখক ডকু ফিল্মমেকার সবাইকে টপকে অ্যাসাইনমেন্টটা পায় নায়ক সুব্রত। অফিস থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে নিয়ে পুরীতে হোটেলে এসে ওঠে।সে খায় দায় আর লক্ষ্য করে কে কেমনভাবে টুথপেস্ট ব্যবহার করে। মুখশ্রীতে কেমন মহিমা খেলা করে। ব্রাশের ডিজাইন দেখে, টিউবের প্যাকিং। ফেনা গল্প স্বাদ মেজাজ ব্রাশের আকার ছন্দ।গাদা টুথপেস্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সে পেয়ে যায় বাজারায়ণের সূত্র। "স্রেফ টুথপেস্টের টিউবের মুখটা এক মিলিমিটার বাড়িয়ে দিতে হবে। গোপন থাকবে এই কৌশল। দাম মাত্র দুটাকা কমিয়ে একটা ঝুটো মিতব্যয়িতার গিমিক ধরে রাখতে হবে বাজারে। অথবা শুরুতে কোনো ফ্রি গিফট বা এক্সট্রা কুড়ি পার্সেন্টের ভড়ং। মনোযোগের কেন্দ্র সরিয়ে দিতে হবে। তাহলেই ফোর্টি পারসেন্ট অতিরিক্ত টুথপেস্ট ড্রেনআউট হয়ে যাবে। কেননা টিউবের মুখের ডায়ামিটার আগের চেয়ে এক মিলিমিটার বেড়ে গেছে।" অদ্ভুত রসময়তায় পণ্যের পৃথিবীর অসাড়তাকে তুলে ধরা হল এই গল্পে।

# " স্মৃতির হুলিয়া প্রতুলের মা ওমলেট অবধি" নামক গল্পেও যথারীতি কোনো আদ্যপ্রান্ত গল্প নেই। বর্তমান পণ্যতাড়িত সুপার ফাস্ট জীবনে প্রতুল তার মৃত মায়ের জন্য কষ্ট পেয়েও তাঁকে স্মরণ করার সময় নেই। ছবিটাও সে দেয়ালে টাঙায় নি তার পিছনের যুক্তিটা হল। ঘুরতে বেরোতে মায়ের ছবিটা তাকে আক্রান্ত করবে। মনখারাপ করলে তার কাজের গতি রুদ্ধ হবে। অথচ সে চায় মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী খুব জাঁকজমকপূর্ণ করে পালন করতে। তার ধারণা এভাবেই মাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি তার মধ্যে আর সময় পাবে না বলে আজ সে তন্নতন্ন করে মায়ের ছবি খুঁজছে। সারাবাড়ি আলমারি আনাচ কানাচ কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। খুঁজতে খুঁজতে সে অনেক দৈনন্দিন কাজ ভুলে যাচ্ছে কিন্তু মিমি, তার কয়েকমাসের সন্তান, তার শিশুখাদ্য আনতে ভুলছে না। এটাকে সমীর বলছেন "স্মৃতির হুলিয়া" হুলিয়া শব্দটি একটি মিশ্র সংস্কৃতির অপশব্দ, যা মেকিতাকে ইন্ডিকেট করে। প্রতুল অশোকের বাড়ি যেতে ভুলে যাচ্ছে, অশোক তার বাড়ি এলে সে মায়ের ছবি খুঁজতে খুঁজতেই অশোকের সঙ্গে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অ্যাডভান্টেজ ডিস অ্যাডভান্টেজ নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে সেখানে স্মৃতির মূল্য কতটুকু? এর মধ্যেই অনিমা জানাচ্ছে তার একসপ্তাহ আগে পেঁয়াজের বাক্সে ডিম রেখে ভুলে যাওয়া। প্রতুল বলে ওটাকে ওমলেট করে দিতে। অনিমা বলে মায়ের ছবি দুপুরে খুঁজবে আপাতত ওমলেট দিয়ে চা খাওয়া হোক। এভাবেই গল্পটির শেষহীন শেষ। এখানে ডিম শুধুমাত্র খাদ্যবস্তু থাকলো না, দ্বিতীয় ডায়মেন্সনে ডিম সৃষ্টি ও পরম্পরার দ্যোতক হয়ে উঠলো, কেননা ডিম থেকে দ্বিতীয় প্রজন্ম, যেমন প্রতুলের মায়ের থেকে প্রতুল, তার এবং অনিমার মিলন থেকে তাদের কন্যা সন্তান মিমির জন্ম। লেখক ককর্কশতাহীন সাংকেতিকতার মধ্যে দিয়ে দেখালেন আমাদের পণ্যায়িত জীবনের অসাড়তা।

# "কবিরাজ চাঁদ চুড়ামণি শ্রীব্রজেশচন্দ্র কথিত দ্রব্যগুণ " "আলজাজিরা" "একমিনিট বিয়াল্লিশ সেকেন্ড ওসামাবিন লাদেনের ক্যাম্পে" প্রভৃতি গল্পে দেখতে পাই কীভাবে বাংলা গল্পের ভাষাপ্রয়োগ শব্দের স্থানিকতা ও অর্থবোধকতা পাল্টে পাল্টে যেতে পারে। আলোচক কৌশিক চক্রবর্তীর ভাষায় তা হয়ে উঠতে পারে "রুবিক পৃথিবীর মাল্টিক্রোম হাতছানি"। "এই গল্পগুলিতে তিনি আতঙ্ক ও ভয়কে রিলেট করতে পারেন চমস্কি কথিত সাবভার্ট টেরারিজমের সঙ্গে। যেভাবে আমেরিকার জনগণের মধ্যে ওসামা নামক জুজুর ভয় দেখিয়ে আফগান যুদ্ধকে নৈতিক করে তোলাহয়, তার পিছনে রয়েছে আসলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। মানুষের আই ওয়াশ করা হয়, মানুষ আসলটা ধরতে পারে না। এই সূত্রটিকে তুলে ধরতে গিয়ে সমীর লিখলেন বিদেশী লাইব্রেরী তে প্রবেশ করতে গিয়ে সিকিউরিটি চেক উপলক্ষে একর ধরণের কাল্পনিক ভয়ের বাতাবরণ। এ প্রসঙ্গে এসেছে এয়ারপোর্ট এ অত্যধিক কড়াকড়ি আর হেনস্থার শিকার হয়েছে ভারত আফগানিস্থানের সাধারণ মানুষ, এমন কি ভারতে জেট ক্যাটাগরির সিকিউরিটি পাওয়া নেতা রাহুল গান্ধীর কথাও। যে ভয় কারণ বিহীন অথচ যে ভয় মিথ্যাকে সত্য করে দিতে পারে। এই ঘটনার নিরিখে বলিউডে শাহরুখ খান অভিনীত একটি চলচ্চিত্র মনে পড়ে " মাই নেম ইজ খান" এতেও দেখেছি সহজ সরল একটি মানুষ এই হেনস্থার শিকার হয়ে অত্যাচারিত হয়েও কিছুতেই প্রমাণ করতে পারে না যে " মাই নেম ইজ খান, বাট আই অ্যাম নট এ টেররিস্ট" শুধু মাত্র তার পদবী খান বলে তাকে এই হেনস্থা। সমীরের গল্পে এই ঘটনা তীব্র দংশনের রূপ না নিয়ে শুধু মাত্র অবলোকনের ধরতাইটুকু রেখে গেছে। ১১সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের সময় আগুন হানার থেকে বাঁচার জন্য এক দম্পতি জানলা দিয়ে নীচে ঝাঁপ দিচ্ছে। এটা একটা বিভ্রম ঠিক কথাই। কিন্তু পাজল্ড মানুষ মুহূর্তের বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় এই ভুল করে এবং আমরা জানি মানুষ এরকম করেওছিল। ইতিহাস তার সাক্ষী। সমীরের অবলোকন থেকে আমরা যা পাই, মনস্তত্ত্ববিদ হিসেব করে দেখেছিলেন সেই দম্পতি পতনকালীন অতিরিক্ত আয়ু পেয়েছিল ১মিনিট ৪২ সেকেন্ড যখন পতন আর উড়ান খুব কাছাকাছি। তাছাড়া অপরের আয়োজিত মৃত্যুর চেয়ে স্বেচ্ছা মৃত্যু অনেক বেশী সম্মানের। এখানে কোনো পরাজয় নেই। এটাও যেমন লেখক দেখাতে চেয়েছেন তেমনি উড়ান শব্দটাকে যোগ করে মৃত্যুর সঙ্গে মুক্তিকে যুক্ত করেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্তেও যেখানে কোনো আত্মগ্লানি নেই। হত্যা আআর আত্মহত্যায় যে যার ঈশ্বর খুঁজে নেয়। এভাবেই মুক্তমুখে ছেড়ে দিয়েছেন গল্পটা।

# সমীর রায়চোধুরীর গল্প ও কবিতার লক্ষণ নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেছেন। আমি নিজেও আগে অন্যত্র তাঁর আরও অন্যান্য গল্প নিয়ে আলোচনা করেছি। তার থেকে মূল যে বিষয়টি উঠে আসে সেটি হল, সমীর রায়চৌধুরী আদ্যপ্রান্ত একজন পোস্টমডার্ন লেখক, যেখানে লেখকের স্বাধীনতা অবাধ। তথাকথিত অদ্যাপক অনুশাসিত গদ্য নয়। ফলত তাঁর রচনা ডিক্যাননাইসড, পাঠ্যবস্তু বাঁধনমুক্ত, রাইজোমেটিক এবং ডিন্যারোটিভাইজড। অধুনান্তিকের স্বরূপ নিয়ে এখনো অনেকের জিজ্ঞাসা এটা কি কোনো দর্শন? না কি চিন্তাচেতনার স্তর বিশেষ? না কি কোনো আইন? সমীর রায়চৌধুরী বলতে চান পোস্টমডার্ন আসলে কিছু কাললক্ষণ, সময়ের প্রবহমানতার সূত্রেই এর চলন গমন। তাই একে অস্বীকার করা মানে জীবনের স্রোতকে অস্বীকার করা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন