দার্শনিক-সাহিত্যিক, কবি সমীর রায়চৌধুরী
মলয় রায়চৌধুরী
প্রাচীন ও নবীনের প্রান্তসীমা ধ’রে
গভীরে প্রবেশ তাঁর ; মধ্যমণি যাঁকে
বিহঙ্গদৃষ্টিতে মেনে, রন্ধন স্বপাকে
প্রস্তুতির বেশি কিছু ব্যর্থতার জ্বরে
বিপন্ন যে কতবার ! কিন্তু এতে সুখ
গোপন করিনি, জানে শ্বেত পারাবত ;
উদ্ডীন, তথাপি খুঁজে অগ্রদানী ক্ষত
নিরস্ত হয়েছে । তুমি প্রতিমার মুখ
সম্যক আয়ত্ত করে এই নষ্টপ্রায়
সময়ের ঊর্ধ্বে উঠে রাবণসম্মতি
অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত করেছো বান্ধব--
ঋষির পাণ্ডিত্যে তাই শিশুর সভায়
মানায় তোমাকে, তুমি স্পর্শগন্ধশ্রুতি
স্বয়ং স্বতঃসিদ্ধ -- ক্ষান্ত হলে জনরব ।
( শঙ্করনাথ চক্রবর্তী, ‘সমীর রায়চৌধুরী’ )
সমীর রায়চৌধুরী একজন দার্শনিক-সাহিত্যিক ; কেবল ভাবুক বা কবি বা গল্পকার বা প্রাবন্ধিক বললে ওনাকে বোঝানো যায় না । ইউরোপে যেমন ছিলেন স্তেফান মালার্মে, উমবের্তো একো, এজরা পাউণ্ড, জাঁ পল সার্ত্রে, আতোয়াঁ আর্তো, আলবেয়ার কামু, মিলান কুন্দেরা, টি এস এলিয়ট, অলডাস হাক্সলি, জাঁ জাক রুশো, ফিয়োডোর ডস্টয়েভস্কি প্রমুখ, যাঁদের লেখায় আমরা তাঁদের বিশ্ববীক্ষা পাই । বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতকের পর থেকে আমরা কেবল প্রাবন্ধিক বা গল্পকার বা কবি বা ঔপন্যাসিক পেয়েছি বলে সমীর রায়চৌধুরীর কাজকে বুঝে ওঠা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি -- তাঁরা সমাজকে বুঝতে চেয়েছেন কেবল বাংলা ভাষাসাহিত্যের জ্ঞানের মাধ্যমে । বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার যে বিশেষ সংখ্যা ওনার কাজ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাতেও দেখা গেছে কেউ-কেউ, অন্ধের হাতি দেখার মতন, কেবল একটি ডাইমেনশানকেই তুলে ধরেছেন, হয় তাঁর গল্প বা কবিতা বা শব্দভাবনা ; হাংরি আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে লিখতে দেখলুম না কাউকে, সম্ভবত হাংরি আন্দোলন ব্যাপারটাই এমন । দাদা, তাঁর গভীর পড়াশুনা আর ব্যাপক অভিজ্ঞতার দরুণ, ছিলেন মাল্টিডিসিপ্লিনেরিয়ান ।
অলোক গোস্বামী দাদার ছোটোগল্পের বই “খুল যা সিমসিম” আলোচনায় ( বোধ, মার্চ, ২০০৯ ) একটি ঘটনার কথা বলেছেন, “কফিহাউস থেকে বেরুনোর পথে এক প্রথিতযশা সাহিত্যিক বলেছিলেন, সমীর রায়চৌধুরী পড়েছি । তবে কী যে লেখেন, গল্পের আকারে প্রবন্ধ না প্রবন্ধের আকারে গল্প, বুঝতে পারিনি।” উমবের্তো একোর “দি নেম অফ দি রোজ” সম্পর্কে কয়েকজন আলোচক, বুঝতে না পেরে, এরকম কথাই বলেছিলেন ; এজরা পাউণ্ডের কবিতা সম্পর্কে এখনও এমনতর মন্তব্য ইনটারনেটে পাওয়া যায় । দাদা তাঁর ছোটোগল্পে অন্ধকারকে, জ্যামিতিকে, ভারসাম্যকে, সন্ত্রাসকে, ভয়কে কেন্দ্রচরিত্র দিয়েছেন, যখন কিনা বঙ্কিমচন্দ্রের পর থেকে গল্প লেখা হয়ে আসছে ব্যক্তিএকককে নিয়ে । দাদা তাঁর অন্তর্ঘাতী, ক্যাননভঙ্গকারী, সৃজনশীল রচনাগুলোয় যা ধরার প্রয়াস করেছিলেন তা হল “মানবেতিহসের প্রেক্ষিতে এই মুহূর্তের সংঘর্ষময় নবাঞ্চল”। তাঁর ইতিহাসবোধ কেবল সময়কেন্দ্রিক ছিল না । তাঁর পাঠবস্তুর শরীরেই জ্ঞানের বিকাশে অভিজ্ঞতার ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন, রৈখিক সময়ের একটিমাত্র ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, বস্তুত ‘সময়বোধ’-এ বিপ্লব আনতে চেয়েছেন, এবং চল্লিশ বছরের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংঘর্ষময় জায়গাটাকে ভরে তুলতে চেয়েছেন নবাঞ্চলের ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতা দিয়ে, অভেদের সন্ধান দিয়ে ।
১৯৬৩ সালে, হাংরি আন্দোলনের সময়ে দাদার একটা গল্প প্রকাশিত হয়েছিল ‘জলছবি’ নামে, তা শেষ হয়েছে স্বমেহনের অবিকল বাৎসায়নি বর্ণনা দিয়ে, যা বহু পাঠক ধরতে পারেননি, সম্ভবত অতো আগে তেমন পাঠক গড়ে ওঠেনি :
“উরুসন্ধিতে সাবান বোলাতেই বুক ফুঁড়ে অসংখ্য বুলবুলি উঠে যায় ।
দু’পা ফাঁক করে দাঁড়ায় । ক্ষিপ্ত মুঠোয় নির্মমভাবে সাপ ধরে ফেলে ।
শিরাউপশিরা ধমনিতে উষ্ণরক্ত টগবগ করে ওঠে । অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া
ছোটে সীমান্তের দিকে । একত্রিত অনিমেষ দ্রুত নিক্ষেপে শরীর ফুঁড়ে
ছিটকে বাইরে বেরোয় । একটা স্তব্ধ মুহূর্ত । বার্তা পৌঁছোয় ।”
যে ধরণের প্রশ্নাবলী সাধারণত বিতর্কমূলক দর্শনে আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয়, তা দাদা তাঁর কবিতা ও ছোটোগল্পে বুনে দিয়েছেন । দাদার কবিতা ও ছোটোগল্প কেউ-কেউ বুঝে উঠতে পারেননি তার কারণ বঙ্গসমাজের বর্তমান কালখণ্ডে অজ্ঞানতা ও শিক্ষাহীনতা হয়ে উঠেছে গর্ববোধের ব্যাপার । বাঙালির সমাজে পাড়ায় পাড়ায় কোমসোমোলদের চূড়ায় একজন করে ইলিয়া এরেনবুর্গ দিব্বি তাদের সাংস্কৃতিক মধ্যস্হতার পণ্ডিতিয়ানা চালিয়ে রাজত্ব করছিল, যখন দাদা হাংরি আন্দোলনের পরে, নব্বুই দশকের গোড়ায়, পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফিরলেন। দাদা বুঝতে পারলেন যে এই কলকাতা, এই পশ্চিমবাংলা, তাঁর সিটি কলেজে পড়ার সময়কার, পাণিহাটিতে থাকার সময়কার, উত্তরপাড়ার বসতবাড়ির খণ্ডহরে থাকার সময়কার বাস্তবতার শহর ও রাজ্য নয়, এই বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন । যে সমস্ত পত্রিকা সে সময়ে প্রকাশিত হচ্ছিল, সেগুলো তাঁর মনের মতো ছিল না, বেশিরভাগ পত্রিকা ছিল, আছে এখনও, বিশেষ-বিশেষ বৌদ্ধিক কমপার্টমেন্টে কিংবা গোষ্ঠীতে বিভাজিত ।
কলকাতায় ফিরে দাদা “হাওয়া৪৯” নামে একটি সাহিত্যিক-দার্শনিক পত্রিকা প্রকাশের তোড়জোড় করলেন, বন্ধুদের বাড়ি-বাড়ি গেলেন, কিন্তু কেউই আগ্রহ দেখালেন না । কোন বন্ধু ? যে বন্ধুর প্রথম কাব্যগ্রন্হ তিনি নিজের টাকায় ছাপিয়ে দিয়েছিলেন, মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ; যে বন্ধু তাঁর চাইবাসার নিমডি টিলার বাসায় টানা আড়াই বছর ছিলেন, মানে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ; যে বন্ধু মদ খাবার পরের দিন সকালে খাঁটি দুধ খেতে চান বলে দাদা তার জন্য বাড়ির সামনে দুধ দোয়াতেন, মানে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ; যে বন্ধু তাঁর বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে বিনা ভাড়ায় বছর খানেক থেকে উপন্যাস লিখে অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন, মানে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় । দাদার প্রস্তাব শুনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, “হাঃ হাঃ, সমীর চিরকাল নতুন-নতুন পরিকল্পনা তৈরি করে, ও কলেজের সময় থেকেই অমন।” বার্ধক্যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শরীর যখন ভেঙে পড়েছে, তখন ভূমেন্দ্র গুহকে বলেছিলেন, “সবাই আমার কাছে আসে, শুধু সমীরটাই আসে না, ও কি পুরস্কার চায় না !”
বয়স্ক বন্ধুদের বাড়ি না গেলেও চলতো । দাদা লক্ষ করেননি যে তাঁর অবর্তমানে কলকাতায় ও পশ্চিমবঙ্গের জেলা সদরগুলোয় নতুন প্রজন্মের কবি ও লেখকরা দেখা দিয়েছেন, যাঁদের ভাবনাচিন্তা প্রায় দাদার সমান্তরাল, যাঁরা কেবল প্রাতিষ্ঠানিক প্রথানুগত চলতি-আড্ডার গুমোট নয়, ভাষাসাহিত্যের ক্যানন অস্বীকার করতে চাইছেন, যাঁদের পাঠবস্তু ট্র্যান্সগ্রেসিভ এবং অন্তর্ঘাতী । ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে দাদা প্রকাশ করলেন “হাওয়া৪৯” পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ।
১৯৪৯ সালে, যে-বছর দাদা ম্যাট্রিক পাশ করলেন, আমার বয়স ছিল দশ, আমাকে একটা ফিল্ম দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, দাদা পাটনার এলফিনস্টোন সিনেমা হলের মর্নিং শোতে ফিল্মটা আগেও কয়েকবার দেখেছিলেন, আর ভালো লেগেছিল বলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, ফিল্মটার নাম ‘দি উইজার্ড অফ অজ’, নায়িকা জুডি গার্ল্যাণ্ড, পরবর্তীকালে এই ফিল্মটার ডিভিডি কিনে আমি আমার স্কুলপড়ুয়া ছেলে আর মেয়েকে প্রায়ই দেখাতুম । ১৯৯০ সালে, অবসর নিয়ে যখন দাদা কলকাতায় ফিরলেন, তখন বলেছিলেন, গল্প রচনার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক ক্রমশ ভেঙে পড়ছে, আর ‘দি উইজার্ড অফ অজ’ প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, সমাজের ভেতরের সংঘর্ষে ব্যক্তিজীবনের ব্যাখ্যার অতীত দুর্ঘটনাগুলো ওই ফিল্মের জাদুবাস্তব চরিত্রদের মতন হয়ে চলেছে । বস্তুত, তরুণ আর অতিতরুণদের কাছে, কলকাতায় এসে, দাদা দেখা দিলেন সাহিত্যের নবাঞ্চলের উইজার্ড হিসাবে । ২২শে জুন ২০১৬ তাঁর মৃত্যুর পরে ২৪ জুন তেইশটি পত্রিকা একত্রিত হয়ে কলকাতার অবনীন্দ্র সভাঘরে যে স্মরণসভার আয়োজন করেছিলেন, তা থেকেই তাঁর উইজার্ডরির জাদুবাস্তব খেলার সঙ্গে পরিচিত হই ।
১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনেও দাদা ছিলেন উইজার্ডের ভূমিকায়, কেবল শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখের আন্দোলনের প্রতি প্রত্যয় উৎপাদনের জন্যই নয়, অনেক সময়ে বুলেটিন ছাপার খরচ দেবার জন্যও নয়, কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যে মননভূমি আগে থেকেই গড়ে তোলা দরকার সে-বিষয়ে পরামর্শের জন্যও । এখন সকলেই জানেন যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আইওয়া থেকে চিঠি লিখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখকে হাংরি আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়ে যাবার জন্য প্ররোচিত করছিলেন, কিন্তু দাদাকে তিনি তেমন কোনো চিঠি লিখছিলেন না । ওনারা শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু দাদা হাংরি আন্দোলনে ম্যাটাডরের মতন লাল চাদর নিয়ে ষেঁড়ো লেখকদের থামাচ্ছিলেন । অবশ্য বিবিসি থেকে হাংরি আন্দোলন নিয়ে ডোমিনিক বার্নের একটি রেডিও প্রোগ্রামের জন্য অসুস্হ শরীরে উৎপলকুমার বসু সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি একজন হাংরি আন্দোলনকারী, তার মাস কয়েক পরেই উৎপলকুমার বসু মারা যান ।
ওনারা তিনজনেই যখন আমার বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষে সাক্ষী হলেন তখন দাদা বলেছিলেন, “অবাক হবার কিছুই নেই”। শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ যখন ছাড়া পাবার জন্য হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করার মুচলেকা লিখে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেল, তখনও দাদা বলেছিলেন, “ওরা সারাজীবন এই পরাজয়বোধ বয়ে বেড়াবে আর লেখালিখি করবে সেই ক্ষয়রোগের সমর্থনে।” একেবারে অব্যর্থ বলেছিলেন দাদা । দাদার বিরুদ্ধে একটা বাড়তি পেনাল কোডের সেকশান চাপানো হয়েছিল, তরুণদের বিপথগামী করার । চাইবাসার মতন ছোটো জায়গায় দাদার গ্রেপতারি বেশ অপমানজনক ছিল নিশ্চয়ই, দাদার শশুর একজন মোক্তার ছিলেন বলে, আর জেলা শাসক দাদার লেখালিখির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলে, তাঁকে লকআপে ঢোকানো হয়নি।
এখানে একটা ঘটনা বলে নিই, নয়তো লিখতে বসে ভুলে যেতে পারি । বড়োজ্যাঠা-মেজজ্যাঠার পরপর মেয়ে হবার দরুণ ঠাকুমা, বংশধরের জন্য বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন । দাদাকে ঠাকুমা তাই খুব ভালোবাসতেন। হাংরি আন্দোলনে দাদা গ্রেপ্তার হয়েছেন শুনে ঠাকুমার সেইদিনই হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল আর মারা যান । ঠাকুমার মৃত্যুর কারণে হাংরি আন্দোলনের সময়ে বাবা আর জেঠা-কাকারা জেঠিমা-কাকিমারা সবাই উত্তরপাড়ায় একত্রিত হয়েছিলেন । বড়োজ্যাঠা ন্যাড়ামাথায় গিয়েছিলেন আমাদের মকদ্দমার প্রথম দিনে, আর কোনো ভাই ন্যাড়া হননি ।
ঠাকুমা, যাঁর নাম ছিল অপূর্বময়ী, আর ঠাকুর্দা যাঁর নাম ছিল লক্ষ্মীনারায়ণ, ওনাদের ছয় ছেলে প্রমোদ, সুশীল, রঞ্জিত, অনিল, সুনীল, বিশ্বনাথ আর এক মেয়ে কমলা । বাবা ছিলেন তৃতীয়, রঞ্জিত, লাহোরে জন্মেছিলেন বলে মহারাজা রঞ্জিত সিংহের নামে ওনার নামকরণ । একান্নবর্তী পরিবারটিকে মোটামুটি একা বইতেন বাবা । নিম্নবিত্ত বলতে যা বোঝায়, তাই । থাকতুমও আমরা পাটনার অতিদরিদ্র পাড়ায় । দাদার শেষ কাব্যগ্রন্হের নাম “অপূর্বময়ী স্মৃতি বিদ্যালয়”। উত্তরপাড়ার বসতবাড়ি খণ্ডহর হবার আগে, নকাকা-নকাকিমার সবে বিয়ে হয়েছে, তখন ওনারা সাবর্ণ ভিলার দুটো বিশাল ঘরে “অপূর্বময়ী বিদ্যালয়” নামে বাচ্চাদের একটা স্কুল খুলেছিলেন ; স্কুলটা উঠে যায় ওনাদের দুজনের মধ্যে অবনিবনার কারণে, তখনকার দিনে তো কথায়-কথায় ডিভোর্স ব্যাপারটা ছিল না ।
দাদার প্রধান অবদান দুটি শতকের সাহিত্যিক-নান্দনিক বৈভিন্নকে দুই হাত দিয়ে টেনে নিজের বুকের কাছে এনে একটা সেতু গড়ে ফেলা, এবং সেকারণেই দাদা আগ্রহী করতে পেরেছিলেন আগের শতকের প্রভাত চৌধুরী, কমল চক্রবর্তী প্রমুখের পাশাপাশি পরের শতকের অনুপম মুখোপাধ্যায়, তুষ্টি ভট্টাচার্য প্রমুখকে, অথচ দাদা কোনো সংবাদপত্র বা পাবলিশারের পেটোয়া লেখক ছিলেন না ; ওপরে শঙ্করনাথ চক্রবর্তীর কবিতাটা পড়ে স্পষ্ট হয়ে গিয়ে থাকবে । দাদার এই ধরণের বক্তব্য যে, “শব্দের ভেতরে শব্দেরা পাশ ফিরে থাকে”, “একটি বাক্যের ভেতরে লুকিয়ে থাকে একাধিক বাক্য”, “গল্পেরা আমার মাধ্যমে জন্মায়, কলম থেকে নয়”, “তুমি নিজের পারিবারিক ইতিহাসের ভেতরে যেমন জন্মাও, তেমনই স্বদেশের ইতিহাসের ভেতরে” ইত্যাদি কথাগুলো তাঁর অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ।
অভিজ্ঞতা জমেছে শৈশবে পাটনা শহরে অন্ত্যজপাড়া ইমলিতলায় থাকার সময় থেকেই । তাঁর সময়ের আর কোনো বাঙালি সাহিত্যিক কি এমনতর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন, তাঁদের শৈশবে ! ছোটোবেলায় দাদার একটা চোখ ট্যারা ছিল, ট্যারা চোখ সোজা করার জন্য ডাক্তার দেখাবার মতন টাকাকড়ি বাবার ছিল না কেননা ওনাকে কুড়িজনের একান্নবর্তী পরিবার চালানো ছাড়াও উত্তরপাড়ায় ঠাকুমার খরচ আর বসতবাড়ির ট্যাক্স পাঠাতে হতো ; বাবার দোকানে আড্ডা মারতে আসতেন এক বৃদ্ধ, যিনি ছিলেন বিখ্যাত চোখের ডাক্তার দুকখন রামের ( জগজীবন রামের বাবা ) কমপাউণ্ডার, তিনি আরেকজন বালকের ট্যারা চোখ সোজা করার প্রেসক্রিপশানের নকল এনে দিলে বাবা দাদার চশমা করিয়ে দিয়েছিলেন, গান্ধিছাপ গোল চশমা, ডাঁটিটা স্প্রিঙের ; দাদার ট্যারা চোখ বছর দুয়েকে সোজা হয়ে গেল কিন্তু বাঁ-চোখটা সারাজীবনের মতন খারাপ হয়ে গেল ।
ইমলিতলা ছিল অন্ত্যজ বিহারি আর অত্যন্ত গরিব শিয়া মুসলমানদের পাড়া ; এই পাড়ায় চোর-পুলিস খেলার সময়ে যেকোনো বাড়ির ভেতরে ঢোকা যেতো, কেউই বারণ করতো না, মসজিদের ভেতরে মাদুরের আড়ালে লুকোনো যেতো, যদিও বড়োজ্যাঠামশায় তা পছন্দ করতেন না। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যে কানা গলি ছিল তার শেষে একটা বস্তি ছিল, বস্তিতে গাঁজা গাছের ঝোপ, ওই গাছের ফুল শুকিয়ে বউ-মরদরা ফুঁকতো, দাদার গাঁজা ফোঁকার হাতেখড়ি সেখানেই হয়ে গিয়েছিল, আমার আর মেজদারও । দাদার কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর বন্ধুরা গাঁজা ফুঁকতেন বলে মনে হয় না । দাদা আমাদের সঙ্গে নেপালে গেলে, হাংরি আন্দোলনের সময়ে, হিপিদের জমায়েতে, গাঁজা হ্যাশিশ আর এল এস ডি নিয়েছিলেন, মোষের কাঁচা মাংসের পদ চাল-গমের মদ রাকসির সঙ্গে খেয়েছিলেন । নেপালের সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় দাদার ছবি ছাপা হয়েছিল । পরে দাদা নেপালি কবিলেখক আর হাংরি আন্দোলনকারীদের একটা যৌথ সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন, যার প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন অনিল করঞ্জাই ।
কানা গলির শেষের বস্তিতে শুয়োর মেরে খাওয়া হতো, তাড়ি সহযোগে । সন্ধ্যাবেলায় গনগনে লোহা ঢুকিয়ে গর্তে ফেলা শুয়োর মারার আর্তনাদ পেলে দাদা পরের দিন বলতেন, চল শুয়োরের মাংস খাব তাড়ি দিয়ে, রান্নাঘর থেকে এলাচ নিয়ে নে, ফিরে এসে ফিটকিরি দিয়ে দাঁত মেজে নিস । সেই সব গরিব পরিবারের পুরুষ সদস্যরা চুরি-ডাকাতি-পকেটমারি করে সংসার চালাতো, তাদের কাউকে গ্রেপতার করার জন্যে পাড়ায় পুলিশ ঢুকলে দাদা বলতেন চল চল ছাদে চল ; ছাদে গিয়ে দেখতুম সন্দেহজনকরা গোলটালির ওপর দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে পেছনের আমবাগানে । পাড়ায় দাদার সমবয়সী বন্ধুদের মধ্যে একজনের বাবা পকেটমার ছিল, সেই বন্ধুও বাপের কাছে পকেট মারা শিখছিল, দাদা তাকে বদ্রি পাটিকমার বলে ডাকতেন । দাদা বাড়িতে এসে বলেছিলেন, বদ্রির কুঁড়েঘরে ইশকুলের মতন ব্যাপার, এ-পাড়ার আর অন্য পাড়ার অনেক ছোঁড়া শিখছে, দুআঙুলে পার্স তোলা, আধখানা ব্লেডে কাটা, এইসব ।
আমাদের বাড়িতে খাঁচাকলে ইঁদুর পড়লে বস্তির দুসাধদের দেয়া হতো, পুড়িয়ে খাবার জন্য । দাদা, মেজদা আমি শৈশবে ইঁদুরপোড়া চেখেছি । যদি জাঁতিকলে ইঁদুর পড়তো তাহলে দাদা ছাদে গিয়ে কিংবা মাঠে গিয়ে, ইঁদুরের ল্যাজ ধরে “চিল কা বাচ্চা চিলোড়িয়া” বলে ঘোরাতেন আর আকাশে চিলেরা পাক খেতে আরম্ভ করলে ছুঁড়ে দিতেন, একটা চিল ঠিকই ইঁদুরটাকে ধরে নিয়ে পালাতো । পরে আমি আর মেজদাও এই খেলা খেলেছি ।
ইমলিতলায় গুলি, টেনিসবলের ফুটবল, ড্যাঙগুলি, লাট্টুখেলায় দাদা ছিলেন ওস্তাদ, সাইকেলের টায়ারকে কাঠি মেরে মেরে গোলা রোডের শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবার প্রতিযোগীতায় দাদা জিততেন প্রতিবার । কিন্তু কাঁইবিচি মানে পাকা তেঁতুলের বিচি আর কলকে ফুলের বিচি যাকে পাড়ায় বলা হতো কানায়েল, সেগুলো গর্তে ফেলার আর টিপ করে মারার খেলায় মেজদা জিততো । টেনিসবল নর্দমায় পড়ে গেলে গুয়ের ভেতর থেকে কাঠি দিয়ে বের করে আনতে হতো, আর বাড়ির কেউ দেখে ফেললে, সন্ধ্যায়, শীতকাল হলেও, চান করে গায়ে গঙ্গাজল ছেটাতে হতো । কম বয়সে পৈতে হয়ে গিয়েছিল বলে বকুনিটা বেশি করে খেতে হতো দাদাকে । বড়দি-ছোড়দির বিয়ে হয়ে যাবার পর সন্ধ্যার সময়ে গামছা পরে চৌকাঠগুলোয় গঙ্গাজল ছেটাবার আর শাঁখ বাজাবার কাজ ছিল দাদার ।
বাবা তাই দাদাকে একটা ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন । দাদা পাড়ায় ফুটবল টিম গড়ে অন্য পাড়ার টিমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতার আয়োজন করতেন । শিল্ডটা দাদা নিজে তৈরি করতেন, পিচবোর্ডকে শিল্ডের মতন কেটে তার ওপর ব্রুকবণ্ডের রাঙতা মুড়ে আর লাল রঙের রিবন সেঁটে । মাঠে খেলতে গেলে, এখন তার নাম গান্ধি ময়দান, একদিকের গোলপোস্ট হতো দাদার দুপাটি জুতো দিয়ে, অন্য দিকেরটা বিরজু নামে দাদার এক পাড়াতুতো খোঁড়া বন্ধুর, তার মা ছাতু বিক্রি করতেন । দাদা ফেরার সময় জুতো পরে আসতে ভুলে যেতেন আর পুজো পর্যন্ত বিনা জুতোয় থাকতেন, স্কুলও যেতে হতো খালি পায়ে, কেননা বাবা সকলের জুতো বছরে ওই একবারই কিনে দিতেন, মহালয়ার আগে । খালি পায়ে স্কুলে যাওয়া এড়াতে দাদা একজন জজের জুড়িগাড়িতে, পেছন দিকে যেখানে আর্দালি দাঁড়ায়, সেখানে বসে চলে যেতেন, জজ সায়েবকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময়ে আর্দালির দাঁড়াবার জায়গা তো ফাঁকা থাকতো ।
ইমলিতলায় শাসনের ভার ছিল বড়োজ্যাঠার ওপর । ওনার খাটের তলায় শরকাঠির গোছা ছিল তা থেকে একটা টেনে বের করে হাতের চেটোয় মারতেন, শরকাঠি অবশ্য দুতিনবারেই ভেঙে যেতো । বড়োজ্যাঠা দাদার নাম ধরে হাঁক পাড়লেই দাদা আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে লাফ মেরে হুলাসবাবুদের বাড়ির ছাদে গিয়ে ওনাদের চারটে সিঁড়ির কোনো একটা দিয়ে নেমে পালাতেন, ফিরতেন বড়োজ্যাঠা অফিস চলে গেলে কিংবা ভুলে গেলে । দুটো বাড়ির মাঝের গলি ছিল অন্তত চার ফিট । হুলাসবাবু তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ নিয়ে একটা খেলা খেলতেন যা দাদার পছন্দ ছিল ; কুরুশকাঠির মতন একটা লোহার কাঠি যাকে ‘শ্রীরামশলাকা’ বলা হতো, সেটা কোনো একটা খোপে চোখ বুজে রাখা ; যেখানে-যেখানে রাখা হতো সেই অক্ষরগুলোর সাহায্যে কোনো দোহা চিহ্ণিত করে ব্যাখ্যা করে হুলাসবাবু ভবিষ্যত বলতেন । এই খেলা নিয়ে “টিনিদির হাত” নামে দাদার একটা গল্প আছে ‘খুল যা সিমসিম’ গল্পগ্রন্হে ।
স্কুলের শেষ ধাপ পর্যন্ত, অর্থাৎ ম্যাট্রিকুলেশান অব্দি, দাদার পড়ার টেবিল বলতে ছিল একটা বড়ো মাপের প্যাকিংবাক্স, বাবার ফোটোগ্রাফির দোকান থেকে আনা, তার ওপর মায়ের পুরোনো শাড়ি পাতা । দাদাকে মেঝেয় বসে পড়তে হতো, রাতে লন্ঠনের আলোয় । লন্ঠনের কাচের ভুষো দাদাকে পরিষ্কার করতে হতো । কাচ ভেঙে গেলে দাদা বাতি জ্বেলে রসুন দিয়ে জুড়ে নিতেন যতো দিন চলে । মা ছিলেন রান্নাঘরের ইনচার্জ, সুতরাং মায়ের আদেশে দাদাকে কয়লা ভাঙতে হতো, বাতিল প্যাকিংবাক্সের কাঠ টুকরো করতে হতো উনোনের জন্য, অনেকসময়ে সকালে পোড়া কয়লা বের করে উনোন সাজিয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে হতো । পোড়া কয়লার সাদা অংশ আলাদা করে রেখে দিতে হতো যাতে তার সঙ্গে ফটকিরির গুঁড়ো মিশিয়ে বাবা বাড়ির সকলের জন্য দাঁতের মাজন তৈরি করে দিতে পারেন ।
মেজজ্যাঠা জামের ভিনিগারের ব্যাবসা আরম্ভ করার তোড়জোড় করে ছিলেন, যদিও চলেনি । আড়াই-তিন ফিটের এনামেলের গামলা জামে ভরে দাদাকে তার ওপর লেফ্ট-রাইট করতে বলতেন, পরে আমিও করেছি । লেফ্ট-রাইট করার সময়ে দাদা একটা গান গাইতেন, “তুফান মেল, ইসকে পইয়ে জোর সে চলতে, অওর অপনা রাস্তা তয় করতে, সবহি ইসসে কাম নিকালে, বচ্চে সমঝে খেল, তুফান মেল”, কাননবালার গান সম্ভবত, স্মৃতি থেকে লিখছি ।
সন্ধ্যাবেলা পড়াশুনার শেষে বড়োজেঠিমা আমাদের গল্প বলতেন, ঠাকুমার ঝুলি, পঞ্চতন্ত্র, ইশপের ফেবল, আরব্য রজনীর খিচুড়ি বানিয়ে ওনার নিজস্ব গল্প । আমরা জাঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোনরা লন্ঠন ঘিরে ওনার গল্প শুনতুম । শুনতে-শুনতে দাদা লন্ঠন নিভিয়ে দিতেন, বলতেন, “আলো জ্বললে গল্পটা দেখতে পাবো না”। দাদার গল্পে যে ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তব তার উৎস বড়োজেঠিমার অবিশ্বাস্য গল্পগুলো । দাদার গল্পগুলোয় জাদুবাস্তবতার আরেকটা কারণ হলো, যেকারণে দাদা তাঁর পত্রিকার নাম রেখেছিলেন “হাওয়া-৪৯” বা ঊনপঞ্চাশ বায়ু, তা হল এই যে পাটনা কলেজিয়েট স্কুল, যে স্কুলে দাদা পড়তেন, তা এক সময়ে ছিল পাগলাগারদ, সেই বিলডিং ভেঙে স্কুলের বিলডিঙ তৈরি হয়, পরে পাগলাগারদ রাঁচিতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় । স্কুলের ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে পাগলদের সম্পর্কে নানা আজগুবি কুহকের গল্প ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে আদান-প্রদান করতো, চোর-পুলিশ লুকোচুরির বদলে পাগল আর সুস্হমগজের খেলা খেলতো । অবসরের পর বাঁশদ্রোণীতে পাকাপাকি থাকার সময়ে দাদা এক মুসলমান চাবিঅলা, ঠেলাগাড়ির সবজিঅলা আর নাপিতের সঙ্গে বাড়ির বারান্দায় খোশগল্প করতেন আর তাদের কাছ থেকে যে জাদুবাস্তব জগতের আভাস পেতেন তা তাঁর গল্পে কাজে লাগতো। “তোমাদের বাড়ির রোদ”, এই অভিব্যক্তি দাদা পেয়েছিলেন তাঁর বাংলাদেশি কাজের-বউয়ের কাছ থেকে, যে রোদ, দাদার মনে হয়েছিল, একযোগে স্হাবর ও অস্হাবর সম্পত্তি । তেমনই বাড়ির নিজস্ব অন্ধকার, যা পাওয়া যাবে দাদার ‘মেথিশাকের গন্ধ’ গল্পে ।
দাদার আরেকটি স্মৃতি ছিল পাণিহাটির রাঙাদিদুকে কেন্দ্র করে, যিনি কম বয়সে বিধবা হয়ে যাবার দরুন সংসারছাড়া হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁকে সবাই নেড়ি পাগলি বলতো, তিনি দাদাকে ভালোবাসতেন আর কোলে বসিয়ে নানারকম আজগুবি গল্প শোনাতেন । মামার বাড়ির ব্যানার্জি পাড়া রোডে যখন যার বাড়িতে ইচ্ছে খেতেন রাঙাদিদু, দাওয়ায় শুতেন, মাথা গোলমাল হলেও সমাদৃত ছিলেন, পাড়ায় পাড়ায় সারাদিন টোটো করে বেড়াতেন । উনি ছিলেন দাদামশায়ের কোনো ভাইয়ের স্ত্রী । নাপিত দেখলেই বেলতেন, ‘এই হারু, আমার মাথাটা ন্যাড়া করে দে দিকিনি’ ।
দাদার কাছে একটা খেলা শিখেছিলুম যা আমি “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” স্মৃতিকথায় লিখেছি । একটা নীল মাছিকে মেরে, সুতোর একদিকে বেঁধে দাদা ছুঁড়ে দিতো গোপাল হালুইকরের জিলিপির পাহাড়ের ওপরে, সেই পাহাড়ে ভিমরুলের ঝাঁক । একটা ভিমরুল মাছিটাকে কামড়ে ধরে মিষ্টির বদলে ননভেজ খাওয়াই পছন্দ করতো, মুখ থেকে ছাড়তে চাইতো না, পেট না ভরা পর্যন্ত । দাদা অন্য প্রান্তটা ধরে ঘুড়ির মতন ওড়াতে-ওড়াতে ইমলিতলার এগলি-সেগলি দৌড় মারতেন, পেছনে পাড়ার ছেলেরা ।
গোলা রোড দিয়ে শব গেলে শববাহকরা ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ বলতে বলতে যেতো, যা শোনা যেতো ইমলিতলার বাড়ি থেকে । মৃতের আত্মীয় শবের সামনে হাঁটতে-হাঁটতে খইয়ের সঙ্গে তামার পয়সা ছেটাতো । শববাহকদের কন্ঠস্বর শুনতে পেলে দাদা বলতেন, “চল চল পয়সা লুটবো” । আমি আর মেজদা দাদার পেছন -পেছন দৌড়োতুম, আর পয়সা কুড়োতে-কুড়োতে ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ ধ্বনি তুলতুম । দাদা পয়সা জমিয়ে আলুকাবলি খেতেন বা সিনেমা দেখতেন, একেবারে সামনের শ্রেণির, যাকে তখন বলা হতো ছওআনিয়া, বা তখনকার চব্বিশ পয়সা। সিনেমা দেখা আমাদের বাড়িতে নিষিদ্ধ ছিল, বড়োজ্যাঠা আর ঠাকুমা পছন্দ করতেন না, সিনেমাকে বলতেন লোচ্চাদের তামাসবিনি । বয়স্করা লক্ষ্য রাখতেন যে তিনটে থেকে ছ’টা টানা তিন ঘণ্টা ছোটোরা কেউ বাড়িতে অনুপস্হিত থাকছে কিনা । দাদা একটা উপায় বের করেছিলেন ; একদিন প্রথমার্ধ উনি দেখে গেটপাসটা আমায় দিতেন দ্বিতীয়ার্ধ দেখার জন্য, পরের দিন আমি প্রধমার্ধ দেখতুম আর দাদা দ্বিতীয়ার্ধ । মরনিং শো দেখতে গেলে বাড়িতে কেউ টের পেতেন না । অমন একটা মরনিং শোতে দাদা আমাকে ‘উইজার্ড অফ অজ’ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন ।
দাদার জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগণার পাণিহাটিতে, মায়ের মামার বাড়িতে, ব্যানার্জি পাড়া রোডে, এখন রাস্তাটার অন্য কোনো নাম হয়েছে ; দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কম বয়সে মারা যাওয়ায় দিদিমা ছেলে মেয়েদের নিয়ে বড়ো ভাই অনাদিনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে আশ্রয় পান । মায়ের বাপের বাড়ি, যার নাম “নিলামবাটি”, তা ছিল অনাদিনাথের বাড়ির উল্টোদিকে । পাণিহাটিতে দাদার নাম রাখা হয়েছিল বাসুদেব, সেখানে সকলে বাসু নামেই চেনে দাদাকে, মা-ও দাদাকে বাসু নামে ডাকতেন । পাটনায় আসার পর, জাঠতুতো দিদিরা দাদাকে মিনু বলে আদর করা আরম্ভ করেন, দাদা মীনরাশির জাতক বলে । সমীর নাম রাখা হয়েছিল জন্মছকে ‘স’ উঠেছিল বলে । জাঠতুতো দিদিদের বিয়ে হয়ে গেলে ওনাদের বাড়িতে ভাইফোঁটা করতে যেতুম দুজনে, মেজদা যেতো না। ইমলিতলার বাড়িতে ভাইফোঁটা হতো তার আগের দিন, প্রতিপদে, সাবর্ণ চৌধুরীদের পারিবারিক সংস্কার রক্ষার খাতিরে ।
ইমলিতলায় দাদার জিভে বাংলা আর পাটনাইয়া হিন্দির খিচুড়ি তৈরি হচ্ছিল বলে দাদাকে ভর্তি করা হয় বাঙালি পরিবার পরিচালিত মহাকালী পাঠশালায় । দাদার জন্ম যদিও ১৭ আগস্ট, কিন্তু ভর্তির সময়ে পুরুত মশায় সতীশ ঘোষালের উপদেশে দাদার জন্ম তারিখ পাল্টে করে দেয়া হয়েছিল ১লা নভেম্বর, ১৯৩৩ । ইমলিতলার বাড়িতে জন্মদিন পালনের কোনো ব্যাপার ছিল না ; দাদার জন্মদিন পালনের কোনো ঘটনা দরিয়াপুরে চলে যাবার পরও ঘটেনি । জন্মদিন যে উৎসব হিসেবে পালন করা হয় সেই সাস্কৃতিক স্তরে ছিল না আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ।
মহাকালী পাঠশালায় পড়া শেষ করলে দাদাকে ভর্তি করা হয় পাটনা কলেজিয়েট স্কুলে । এই স্কুলে দাদা পাটনার খ্যাতনামা বাঙালি পরিবারের ছেলেদের পান, যেমন বিমানবিহারী মজুমদার, গোপাল হালদারের ভাই রঙিন হালদার, প্রভাতী পত্রিকার সম্পাদক মানিক ভট্টাচার্য, জহর রায়ের বাবা সতু রায়, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত প্রমুখ । দাদার আগ্রহে একটা নাটকের দল গড়ে ওঠে, আর বন্ধুরা মিলে বড়দির শশুরের বিশাল জমিদারবাড়ির দালানে নাটক অনুষ্ঠান করতেন । দাদার পাটনার বন্ধুরা কিন্তু আমাদের ইমলিতলার বাড়িতে আসতেন না, ছোটোলোকদের পাড়া বলে।
ম্যাট্রিকুলেশানের পর দাদাকে কলকাতায় পড়তে পাঠাবার নির্ণয় নেন বাবা-মা, তার কারণ আমার মেজদা ( যাকে বড়োজেঠা এক বেশ্যার কাছ থেকে দেড়শো টাকায় কিনেছিলেন ) নিজের জন্মের কথা কোনো সূত্রে জানার পর, যাকে বলে “খারাপ হয়ে যাওয়া” তাই হয়ে যাচ্ছিল, বাংলায় কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। দাদাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় মায়ের মামার বাড়িতে । মামারা দাদাকে সিটি কলেজে আই এস সি পড়ার জন্য ভর্তি করে দেন । মামার বাড়িতে ছোটোমামা ছিলেন মার্কসবাদে আকৃষ্ট, প্রচুর বই ছিল ওনার সংগ্রহে, নিজের সংগ্রহের শতাধিক বই দাদাকে দিয়ে দিয়েছিলেন । তাছাড়া ওই বাড়িতে বৈঠকখানায় ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের একটি গ্রন্হাগার ছিল, পুরোনো আমলের পত্রিকা ছিল, দেয়ালে টাঙানো ছিল উনিশ শতকের মনীষীদের ছবি, সেই ঘরে সন্ধ্যাবেলায় পাণিহাটির বয়স্করা একত্রিত হতেন দার্শনিক তর্কাতর্কির জন্য ।
মামার বাড়ির শিক্ষা আর পারিবারিক সংস্কৃতি দাদার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পেরেছিল । দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কারকারী স্যার রোনাল্ড রসের সহগবেষক, গ্রেট ব্রিটেনের সপ্তম এডোয়ার্ডের স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন । পাণিহাটির কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন দাদামশায় । তাঁর নামে পাণিহাটিতে একটি রাস্তা আছে । ব্যাঙ্কে তাঁর ফোটো ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত টাঙানো ছিল, পাণিহাটির মিলিউ পালটে যাবার পর ছবিটি ফেলে দেয়া হয়েছে । তাঁর সঙ্গে আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরীর পরিচয় ছিল, এবং সেই সূত্রেই মা-বাবার বিয়ে । মায়ের নাম অমিতা। দাদা আর আমি দুই ভাই, নিজেদের কোনো বোন নেই।
মায়ের মামার বাড়ির শৃঙ্খলা দাদার ইমলিতলা চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না । তাছাড়া সেসময়ে ইলেকট্রিক ট্রেন আরম্ভ হয়নি, প্যাসেঞ্জার ট্রেনে শেয়ালদায় আসা-যাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময় ছিল না । শেয়ালদা স্টেশানও হাওড়া স্টেশানের তুলনায় পুর্বপাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুতে ছিল ছয়লাপ, প্রতিদিন যাদের দুরবস্হা দেখতে-দেখতে দাদার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিল । তাছাড়া ঠাকুমার পছন্দ ছিল না যে দাদা পাণিহাটিতে মায়ের মামার বাড়িতে থাকুন । দাদা চলে এলেন উত্তরপাড়ায় ঠাকুমার বারো ঘর চার সিঁড়ির খণ্ডহর সাবর্ণ ভিলায়, বেছে নিলেন চিলেকোঠার ঘর, ঠাকুমাকে এড়িয়ে এই ঘরে সিগারেট ফোঁকা যেত। পাণিহাটিতে রাতে বাড়ি ফিরতেই হতো, তার কারণ মামারা কলকাতায় চাকরি করতে যেতেন আর ফিরতেন, তা যতো রাতই হোক, ট্রেন পাইনি বলে ওজর দেবার সুযোগ ছিল না । ঠাকুমা একা থাকতেন, তাই রাতে কলকাতায় থেকে গেলে তাঁকে যা হোক কোনো গল্প শুনিয়ে দিতে পারতেন দাদা । উত্তরপাড়ার বাড়িতে আদ্যিকালের একটা পেল্লাই বিছানা দাদাকে বরাদ্দ করেছিলেন ঠাকুমা, যার পায়াগুলো ছিল বাঘের পায়ের মতন ।
উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে প্রতিবেশী অমিত মৈত্র নামে একজনের সঙ্গে দাদা “লেখা’ নামে একটা পত্রিকা আরম্ভ করেন । সিটি কলেজের দেয়াল পত্রিকায় একজনের কবিতা প্রশংসনীয় মনে হওয়ায় দাদা আর্টস বিভাগে গিয়ে সেই ছাত্রটির সঙ্গে পরিচয় করেন । ছাত্রটির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । দাদার সঙ্গে এই সময়ে পরিচয় হলো আনন্দ বাগচি, দীপক মজুমদার, শংকর চট্টোপাধ্যায়, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, শিবশম্ভু পাল, ফণীভূষণ আচার্য প্রমুখের , যাঁরা প্রায়ই ছুটির দিনে দাদার চিলেকোঠায় আড্ডা মারতে আসতেন । এনারা কেউ না কেউ দাদার জন্যে খাবার আনতেন ছুটির দিনে । কলেজের দিনে দাদা কলকাতার পাইস হোটেলে খেতেন, সাধারণত কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের পাইস হোটেলে বা শ্যামবাজারের পাইস হোটেলে । “কৃত্তিবাস” পত্রিকা আমি প্রথম দেখি দীপক মজুমদারের হাতে, শ্যামবাজারের পাইস হোটেল থেকে খেয়ে দাদা আর আমি বেরিয়েছি, ওনার সঙ্গে দেখা। দাদা ওনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দ্যান প্রখ্যাত কবি আর সম্পাদক হিসেবে ।
ইমলিতলার পরিবেশ থেকে মুক্ত করার জন্য দাদাকে সিটি কলেজে পড়তে পাঠানো হলেও পিসতুতো ভাই সেন্টু ওরফে অজয় হালদার দাদাকে কলকাতার সেই পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করাতে কার্পণ্য করলেন না । পিসেমশায় থাকতেন আহিরিটোলার শরিকি বাড়িতে, নিয়মিত সোনাগাছি যেতেন আর ধেনো মদ খেতেন। সেন্টুদার সঙ্গে পরিচয় ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের, সম্ভবত কোনো মদের জমঘটে তাঁদের প্রথম আলাপ । দাদার সঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় হলো । দাদার চিলেকোঠার ঘরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন আর দীপক মজুমদার গাইতেন হিন্দি ফিলমের গান । সেন্টুদা আর দীপক মজুমদারের তর্কাতর্কি হতো হিন্দি ফিলমের রেহানা, কুলদীপ নায়ার, সুরাইয়া, মধুবালার যৌনতা নিয়ে । একবার তর্কে হেরে যেতে যেতে সেন্টুদা হঠাৎ দীপক মজুমদারকে বলে ওঠেন “তুমি রেহানার ওখানে হাত দিয়ে দেখেছো নাকি !”
ও, হ্যাঁ, দাদার সম্পর্কে আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল, ভুলে যাবার আগে লিখে ফেলি । বেনারসে কাঞ্চনকুমার মুখোপাধ্যায় নকশাল আন্দোলনে যোগ দিলে ওর বন্ধু হাংরি আন্দোলনের ছবি-আঁকিয়ে অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় নকশাল আন্দোলনে আকৃষ্ট হয়েছিল । এই ঘটনাটা নেপাল থেকে আমরা ফেরার পর । নেপাল থেকে অনিল আর করুণা একটা করে ‘রেড বুক’ কিনেছিল, আমিও কিনেছিলুম । সস্তায় পাওয়া যাচ্ছিল বলে ওরা দুজনে চিনে তৈরি লাল টকটকে মাও সে তুঙ কোট কিনেছিল । আমি আর দাদা কিনিনি, আমার রঙচঙে পোশাকের অ্যালার্জি আছে, আর বিহারের জাতপাতে আক্রান্ত মার্কসবাদ দেখে দাদা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল । বেনারসে অনিলের বাঙালিটোলার স্টুডিওতে কিংবা কাঞ্চনের বাড়ির গ্যারাজের ওপরের ঘরে বেনারসের নকশালদের জমায়েত হতো । বেনারসের বাঙালিটোলার পেইনটারদের সঙ্গে অ্যালেন গিন্সবার্গ আর পিটার অরলভস্কির পরিচয় হয়েছিল ।
একদিন একজন সাংবাদিকের কাছে ওরা জানতে পারলো যে অনিলের স্টুডিওয় পুলিসের রেইড হতে পারে আর হয়তো ওদের গ্রেপ্তার করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে । কলকাতায় নিয়ে যাওয়া মানেই মাঝপথে কোতল । অনিল দিল্লি পাড়ি মারলো আর আমেরিকান বন্ধুনির সঙ্গে পালালো আমেরিকা, কাঞ্চনও আমেরিকা চলে গেল । করুণার বউ-ছেলে ছিল, ও এসে আমাদের পাটনার বাড়িতে লুকোলো । দাদার পরামর্শে করুণা চুল-দাড়ি কামিয়ে প্রায় ন্যাড়া হয়ে ধুতি-গেঞ্জিতে বিহারি সীতেশবাবু হয়ে গেল, আর দাদা করুণার জন্য একটা রঙিন মাছের দোকান খুলে দিলেন । মাসখানেক বাদে বউ-ছেলেকে পাটনায় ডেকে পাঠালো করুণা । বছর দুয়েক পরে অনিল দিল্লি ফিরলে করুণাও চলে গেল দিল্লি ; কাঞ্চন ফিরল কলকাতায় । নকশাল আন্দোলনের দরুণ বেনারসের বিশাল বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয় কাঞ্চনকে । অনিল আশির দশকে আইরিশ শিল্পসমালোচক জুলিয়েট রেনোল্ডসকে বিয়ে করেছিল । জুলিয়েট পরে অনিলের স্টুডিওতে গিয়েছিলেন, ওর লেখাপত্র আর পেইনটিঙ রেইডের সময় নষ্ট করে দিয়েছিল পুলিস, কিছুই উদ্ধার করা যায়নি ।
ওফ হো, আরেকটা ঘটনা মনে পড়ল, এই সুযোগে বলে নিই । ১৯৬৮ সালে আমি অফিসের কাজে গিয়েছিলুম নাগপুর, সেখানে নভেম্বরের শেষে পরিচয় হল সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে । কয়েকদিন পরে ওকে বললুম, আপনাকে বিয়ে করার জন্য আপনাদের বাড়িতে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে । সলিলা বলেছিল, বড়ো মামার সঙ্গে । ওদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলুম সলিলা রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় ছিল, ড্রইংরুমে শিল্ড আর নানা মাপের কাপ । বিয়েতে ওর মত আছে দেখে দাদাকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলুম আর বউদিকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলুম । পাটনায় বাবাকেও টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলুম । দাদা প্রথম ট্রেনেই চলে এলেন নাগপুর, সেসময়ে নাগপুরের প্লেন চালু হয়নি, হলেও দাদাকে চাইবাসা থেকে জামশেদপুর হয়ে কলকাতা গিয়ে নাগপুর পৌঁছোতে হতো । দাদা চক্রধরপুর থেকে সোজা পৌঁছে গিয়েছিলেন নাগপুর । সলিলার বড়োমামার সঙ্গে কথা বলে ফিরে গিয়েছিলেন । বিয়েও ঠিক হয়ে গেল ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৬৮ । দাদা তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেন আর বউদি, মেয়ে হনি আর দাদার শাশুড়িকে নিয়ে চলে এলেন । বাবা-মা এলেন না কেন, তখন টের পাইনি । ভেবেছিলুম প্রেমিক হিসাবে আমার কীর্তিকলাপ সম্পর্কে ওনারা রুষ্ট বলে হয়তো আসেননি । বউদিও তড়িঘড়ি চলে এসেছিলেন একই কারণে, আমার প্রেমিকত্বর সিরিজ শেষ করার জন্য । বিয়ের পর পাটনায় যাবার বদলে দাদা টিকিট কাটলো চক্রধরপুরের । চক্রধরপুর থেকে গাড়িতে চাইবাসা । চাইবাসায় গ্যাঁদাফুলে গ্যাঁদাশয্যা, খাটও এমন যে ক্যাঁচোর-ম্যাচোর আওয়াজ হয় । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রেম করার অভিজ্ঞতা ছিল খাটখানার । কয়েক দিন পরে পাটনা গেলুম। গিয়ে জানতে পারলুম যে মেজ জ্যাঠামশায় মারা গেছেন আর ওনার অশৌচ চলছে । অশৌচের মধ্যেই বিয়ে করে ফিরলুম আর যেদিন লোক খাওয়ানো সেইদিনই বউভাত হলো । দাদা সব চেপে গিয়েছিলেন যাতে বিয়েটা বানচাল হয়ে না যায় । মা সেন্টুদার হাতে একটা চিরকুট পাঠিয়ে দাদাকে লিখেছিলেন, “সিঁদুর পরিয়ে আনলেই হবে।” মানে, মাও চাইছিলেন যাতে বিয়েটা ফসকে না যায় ।
উত্তরপাড়ায় ফিরি । দাদা বি এস সি পাশ করে জার্নালিজমে ভর্তি হয়েছিলেন । বাবা ডেকে পাঠালেন পাটনায় । বাবার দোকানে আড্ডা মারতে আসতেন বিহার সরকারের মৎস্য দপতরের বিভাগীয় প্রধান মিস্টার ভর্মা । তিনি বাবাকে বলেছিলেন দাদাকে যদি ফিশারিজ ইন্সপেক্টরের চাকরিতে ভর্তি করতে চান তাহলে ডেকে পাঠাতে । দাদা পাটনায় ফিরলে চাকরিটা পেয়ে গেলেন । তাঁর নিয়োগে একটাই অসুবিধে ছিল যে তিনি বাঁচোখে দেখতে পেতেন না । মিস্টার ভর্মার সহৃদতায় ডাক্তারি পরীক্ষার সময়ে ডাক্তারই বলে দিয়েছিল কেমন করে চোখের চেকআপটা করাতে হবে । চাকরি পাবার পর দাদার পোস্টিং হল বিভিন্ন জেলা সদরে মিষ্টিজলের মাছ সম্পর্কে প্রশিক্ষণের জন্য । তারপর বিহার সরকার পাঠিয়ে দিল কোচিতে, সামুদ্রিক মাছ সম্পর্কে প্রশিক্ষণের জন্য ; এই সময়ে দাদা মাছ ধরার জাহাজে বেশ কিছুকাল আরব সাগরে কাটিয়েছিলেন ।
ফেরার পর দাদার পোস্টিঙ হল চাইবাসায় । দাদার বন্ধু বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ভাগলপুরে দাদার সঙ্গে একই মেসে থাকতেন, তাঁর বিয়ে হল চাইবাসায় মধুটোলা নিবাসী সুধীর চট্টোপাধ্যায়ের মেজ মেয়ে ডলির সঙ্গে । দাদা চাইবাসাতেই চাকরি করেন জেনে মধুটোলা বাড়ির সদস্যরা বললেন, সময় কাটাবার জন্য মাঝে-মাঝে আসতে । দাদা কবিতা আর গল্প লেখেন, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত জেনে ওই বাড়ির বড়ো মেয়ে মন্টি, যাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তিনি দাদার প্রতি আকর্ষিত হন । দাদা আর মন্টি নির্ণয় নেন যে দুজনে যেমন আছেন তেমনই থাকবেন, পরিবার ভেঙে বেরোবার প্রয়োজন নেই । এই ঘটনাটি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “কিন্নর কিন্নরী” উপন্যাসে বিস্তারিত লিখেছেন, সেখানে দাদার নাম শম্ভু আর শক্তির নাম পার্থ ।
উত্তরপাড়ার চিলেকোঠায় দাদার যে বন্ধুরা আড্ডা মারতে যেতেন, তাঁরা এবার চাইবাসায় দাদার নিমডির কুঁড়েঘরে আড্ডা মারতে যাওয়া আরম্ভ করলেন, প্রধানত হাটে সবুজ শালপাতায় করে হাড়িয়া খাওয়া, মহুয়ার মদ খাওয়া, যা তাঁরা সকলেই প্রথমবার চাইবাসায় খেলেন, আর আসেপাশের জঙ্গলে-ঝর্ণায় ঘুরে বেড়ানো । দাদার বাড়িতে কবি-লেখকরা প্রায়ই আসেন জানতে পেরে মধুটোলার বাড়িতেও তাঁরা খাবার আমন্ত্রণ পেতেন । দাদা নিমডি টিলার ওপরে একটা চালাঘরে একা থাকতেন বলে একাকীত্ব কাটাবার জন্য কলকাতা থেকে বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে থাকার জন্য ডেকে আনলেন । শক্তি তখন “কুয়োতলা” উপন্যাস লিখছিলেন । দাদা অফিসের কাজে বাইরে গেলে শক্তিকে মধুটোলার বাড়িতে অতিথি হিসাবে রেখে যেতেন । শক্তিকে মাসের পর মাস কলকাতায় অনুপস্হিত পেয়ে একবার সুনীল আর সন্দীপন চাইবাসায় গিয়ে দ্যাখেন নিমডির চালায় দাদা নেই, ট্যুরে গেছেন, ওনারা দুজনে মধুটোলায় গিয়ে শক্তিকে দেখে অবাক, দুজনের কেউ একজন বলে ওঠেন, ‘কী রে, তুই এখানে ইস্টিশন পুঁতে ফেলেছিস !’
কৃত্তিবাস পত্রিকার ২৫ তম সংকলনে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ‘চাইবাসা চাইবাসা’ নামে একটা ছোটো গদ্য লিখেছিলেন, বেশ ইনটারেসটিং, তুলে দিচ্ছি এখানে । “বিশ্বস্তসূত্রে এই উড়োখবর আমরা পাই যে শক্তি চাইবাসার সেন্ট্রাল জেলে রয়েছে, তছরুপের কথাই আমি শুনি । এটা শুনে, তখন আমরা ছেলেমানুষ ছিলুম বলে, আমার ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের খুব মনোকষ্ট হয় । আমি ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তির দুই বন্ধু, আমরা সেদিন রাত্রেই, সম্বলপুর প্যাসেঞ্জার ধরি । এটা ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ । আমি নিই হাওড়ার চেনা দোকান থেকে তিনটে খালি সোডার বোতল, চাইবাসায় এক্সচেঞ্জ করার কথা ভেবে, এটা সুনীলও যুক্তিযুক্ত মনে করেছিল । সুনীল একটা ক্যাপস্টানের টিন নিয়েছিল, যা গরাদের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে ডোরাকাটা শক্তির হাতে ওর দেবার ইচ্ছে ছিল । টিনটা আমরা ট্রেনে খুলিনি । মাইরি ।”
“চাইবাসায় গিয়ে এবারও সমীরকে পেলুম না, ট্যুরে । কিন্তু শক্তি ? পরদিন জেলে গিয়ে খবর নিলেই হবে এরকম ভেবে, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে টিনটা ও ওপরে তিনটে সোডার বোতল রেখে, ডাকবাংলো ছেড়ে আমরা বেরিয়ে পড়লুম নদীর দিকে, চাইবাসার শ্মশানের দিকে শীতের রাত্তিরে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলুম গান গাইতে গাইতে । মধুটোলার কাছে ফটাস করে একটা বাড়ির দরোজা খুলে গেল, ‘এতো রাত্তিরে চাইবাসায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় কে রে’, বলতে বলতে শক্তি বেরিয়ে এলো । এখানে হঠাৎই মনে পড়ল, এই মধুটোলার রাস্তাতেই, ‘সাইকেল কি সাঁতার কেউ কখনো ভোলে ভাই’, বলে তড়াক করে সাইকেলে লাফিয়ে উঠে ঐ বাড়ির পাঁচ বোন ও তিন বন্ধুর সামনে সুনীল উলটে দড়াম করে রাস্তায় পড়ে যায় । যাই হোক সেদিন রাতে, নভেলে-পড়া যায় এমন মধ্যবিত্ত প্রবাসী বাঙালির লাল টালির বাড়ির মধ্যে বসে আমরা দুজনে আধ ঘণ্টার মধ্যে বুঝতে পারি যে শক্তি জেলে নেই । ক্যাপ্সটেনের টিন খুলতে আমরা ডাকবাংলোয় ফিরে যাই । ঐ বাড়ির দুটি মেয়ে সমীরের ও শক্তির বান্ধবী ( একজন পরে সমীরের স্ত্রী ) এটা বুঝতে আমাদের দু’দিন সময় লেগে যায় । এটা বুঝে, মধুটোলায় ওরা সান্ধ্য চা-পান করতে গেলে আমি ও সুনীল তখন সোডার বোতলগুলি ( তখন ভর্তি ) একের পর এক জ্বলন্ত হ্যারিকেন লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারি । সমীরের লেপ তোশক ও মশারিতে আগুন লেগে যায় । আমরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে রো-রো নদীর ওপারে গিয়ে আমাদের জীবনের প্রথম আদিবাসী রমণীর কাছে জীবনের প্রথম মহুয়া খাই । তার শারীরিক সৌন্দর্য ছিল ।”
“চাইবাসা থেকে ফিরেই আমি মায়ের কাছে কাশীতে চলে গেলুম । সম্ভবত ঐ একই ট্রেনে, ডুন এক্সপ্রেসে, সুনীলের চিঠিটাও আমার সঙ্গে যায়, কারণ হিসেবমতো ১৪/১/৬০ তারিখে আমি সেবার কাশী পৌঁছেছিলুম । যাই হোক, ঐ চাইবাসা পরে আমাদের তিনজনের লেখাতেই বেশ একটা ভূমিকা নিয়েছিল বলতে হবে । আমি সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী নামে গল্প লিখি, সুনীল যুবক যুবতীরা ও অন্যান্য । শক্তির লেখার এক অংশে চাইবাসা হাহাকারের মতো ছড়িয়ে রয়েছে।”
“চাইবাসা থেকে অদূরে পাহাড়ের ওপর হেসাডির ডাকবাংলোয় বড়ো প্যাঁচে পড়েই কবি তথা লেখক হিসেবে আমাদের ডি এফ ও শ্রীকমলাকান্ত উপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল । প্রমাণস্বরূপ শক্তি ওঁর সামনে একটা ছোটো কবিতা রচনা করে, যার মধ্যে ‘ছুটে কে তুলিলে শালবন বাহুবন্ধন চারিধারে’ এরকম একটা লাইন ছিল । বস্তুত ছোটো ও বড়ো দলে চাইবাসায় আমাদের একাধিকবার যেতে হয়েছিল । শক্তি বারংবার গেছে । চাইবাসায় যাওয়ার জের আমাদের পরবর্তী জীবনেও বেশ কয়েক বছর ধরে চলে । ওখানে না গেলে আমরা হয়তো এরকম হতুম না । কী হতুম ? রাজা হতুম, আবার কী । রাজা হতুম কথার কথা । এতটা প্যাঁচে পড়তুম না ।”
শক্তি মধুটোলার বাড়ির মেয়ে শীলার প্রেমে পড়েন এবং তাকে শোনাবার জন্য অজস্র কবিতা লেখা আরম্ভ করেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই বাড়ির কিশোর সন্তুর চরিত্রটিকে নিজের কাহিনিতে ভূমিকা দিলেন, যে কাহিনিগুলোয় তিনি নিজেই কাকাবাবু । সুনীল চাইবাসাকে কেন্দ্র করে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে লিখলেন “অরণ্যের দিনরাত্রি”, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখলেন “জঙ্গলের দিনরাত্রি”, শক্তিও শীলার সঙ্গে প্রেম এবং চাইবাসা-হেসাডি-বেতলায় কাটানো অভিজ্ঞতা এনেছেন ‘‘কিন্নর কিন্নরী” উপন্যাসে।
চাইবাসার স্মৃতি নিয়ে দাদাকে একটা চিঠি ১৯৬৮ সালে লিখেছিলেন সন্দীপন, নসট্যালজিক, বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার অনুশোচনারও যেন আভাস একচিলতে ।
১৬/৯ বরানগর
৭১ কাশীনাথ দত্ত রোড, দোতলা
কলকাতা - ৩৬
প্রিয় সমীর,
অনেকদিন আগেই ঠিকানা লিখে ফেলেছিলুম, আমার মেয়ে জুলেখা টিকিটটা ছিঁড়ে নিয়েছিল । অর্থাৎ আমার মেয়ে বেঁচে আছে । ক’দিন আগে গিয়েছিলুম সুনীলের কাছে -- মদ্যপানজাত মারামারির ফলে প্রহৃত ও গুরুতর আহত হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে জেনে যাই, সন্ধের দিকে রিক্সা করে একটি ও.টি. পাঁইট এনে দুজনে খেলুম, তোমাকে নিয়ে কথা বলছি দেখলুম । সুনীল তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছে বলল ও তোমার ঠিকানা আমি চেয়ে নিলুম । স্বাতী দিল্লিতে ।
তোমাদের একটি ছেলে হয়েছে শুনলুম । তুমি অনেকদিন কলকাতা আসোনি । চাইবাসার কথা মনে পড়লে তোমার কথা মনে পড়ে । তুমি সৎ-ব্যবহার করেছিলে যা মনে পড়ে । রো-রো নদীর ধারে বসে শ্মশানে গল্প মনে পড়ে । নিমডির বাড়ির উঠোনে তেল মেখে হাঁড়িয়া-খাওয়া মনে পড়ে । বেলাদের বাড়ি মনে পড়ে । মধুটোলা, বাজারের দোকানে চা ও সিঙাড়া -- কানপুরে অস্ট্রেলিয়া হেরে গেছে তোমাদের খবর দিলুম -- হেসাডিতে এসে তুমি এক রাত্তির কাটিয়ে গিয়ে আমাদের ঋণমুক্ত করে গেলে -- এসব ও অন্যান্য মনে পড়ে।
চাইবাসা আমার মনে ইমপ্রেশান রেখে গেছে যা মোছার নয় -- তখন সরল ও ছেলেমানুষ ছিলুম । আজো তাই আছি । চাইবাসা ও তোমাকে একসঙ্গে মনে পড়ে ।
ভেবে দ্যাখো, এ-রকম হওয়া সম্ভব, এ-রকম মনে পড়া । বয়স ৩৫ হল, আজো ৩০-দিকে গড়াচ্ছি -- ২৫এর দিকে । আমার হাংরি জেনারেশান-ফেশান মনে পড়ে না । তোমাকে ও চাইবাসাকে আজও মনে পড়ে ।
তুমি অ্যাকসেপ্ট করো বা না করো আমার বাস্তবিক কিছু এসে যায় না । কাফে খালি হয়ে গেলেই আমার মাথাও খালি হয়ে যায় না ।
শুভেচ্ছাসহ
সন্দীপন
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের এই চিঠির পাশাপাশি দেবী রায়কে হাংরি বুলেটিনে ছাপার জন্য পাণ্ডুলিপি পাঠাবার সময়ে ৯ জানুয়ারি ১৯৬৩ তারিখে যে চিঠি উনি লিখেছিলেন তা পড়লে পাঠক বেশি আনন্দ পাবেন বলে মনে হয় :-
প্রিয় হারাধনবাবু,
হাংগরি জেনারেশনের জন্য লেখা পাঠালাম । প্লট, কনটেন্ট, ক্র্যাফ্ট -- এসব বিষয়ে ডেফিনিশন চেয়েছেন, আপাতত অন্য কতকগুলো ডেফিনিশন পাঠালাম, ওগুলো পরে লিখব । প্রকাশযোগ্য কিনা দেখুন ।
ছাপলে সবকটি এক সঙ্গে ছাপতে হবে --- নইলে খাপছাড়া লাগবে । ছাপার ভুল যেন বেশি না থাকে। দরকার করলে অনুগ্রহপূর্বক একটা ফ্রেশ কপি করে প্রেসে দেবেন ।
অমৃত-তে আমার বইয়ের যে-বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছে, দেখেছেন ! নইলে পাবলিশার-এর কাছে গিয়ে তার একটা কাটিং পাঠাবার ব্যবস্হা করেন তো খুশী হই । ওই বিজ্ঞাপনটা দেশে বেরোবার কথা আছে -- যদি বেরোয়, তার প্রুফটা কাইণ্ডলি দেখে নেবেন । আনন্দবাজারে কোনো লেখকদের বিবৃতি বেরিয়েছিল নাকি ? তাহলে তারও একটা কাটিং পাঠাবেন ।
সামনের মাসে বাড়ি পাল্টাব । আরো এক মাস থাকবো না ততদিন । সহজে যাব না । শরীর ভালো । ‘ছোটোগল্পে’ আবার লেখা দিতে পারলাম না , সম্ভব হলে, ক্ষমা করবেন ।
পুনশ্চ : লেখাটা প্রকাশ করার আগে আপনি ছাড়া কেউ যেন না দেখে । অনেক বাদ দিয়ে খুব নরম করে সবদিক বাঁচিয়ে লিখেছি, ভয় নেই ।
*) হাংগরি জেনারেশনের একটা সিম্বল করতে বলেছিলুম, কী হল ! পাঁচ নয়া পয়সা দাম করতে পারেন ।
**) কমাগুলো ভেবে চিন্তে দিয়েছি, ওইগুলো আসল জিনিস, যেন থাকে ।
***) শেষের তারিখটা যেখানে আছে, সেখানে প্রকাশের তারিখ দেবেন ।
****) ‘অভিযান’ পূরবীতে হয়েছিল তো ?
****) আগামী সপ্তাহে নতুন ঠিকানা পাঠাব । তার আগে চিঠি দিলে, কুমুদ বাঙলো, রুম নং ৫, টিকোর, চুনার, মির্জাপুর --- এই ঠিকানায় দেবেন । ‘আক্রমন’ বানানে কী ‘ন’ না ‘ণ’?
ভালোবাসা নিন । সুনীলবাবুকে ( হাজরা ) প্রীতি জানাচ্ছি।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
১৯৬২ সালে অ্যালেন গিন্সবার্গ ও পিটার অরলভস্কিও গিয়েছিলেন চাইবাসায় দাদার নিমডির কুঁড়েঘরে, ছিলেন দিনকয়েক । ওনারা গিয়েছিলেন চাইবাসায় উপজাতিদের তৈরি হাড়িয়া আর মহুয়া মদের কথা শুনে । দাদা ওনাদের তালশাঁস আর জাম খাইয়েছিলেন । ওনারা ওগুলোকেই ভেবেছিলেন মাদক । জাম খেয়ে জিভ বেগুনি হয়ে গিয়েছিল বলে আশঙ্কিত ছিলেন । পরে সন্ধ্যায় ওনাদের নিয়ে হাটে গিয়ে হাড়িয়া খাওয়ান দাদা আর দাদার ড্রাইভার গুলাব সিংকে দিয়ে সদ্য চোলাইকরা গরম-গরম মহুয়ার মদ আনিয়ে খাওয়ান । গিন্সবার্গ পাটনায় আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন এপ্রিল ১৯৬৩ সালে ।
ইংরেজি ভাষার ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষের স্ত্রী ডেবোরা বেকার অ্যালেন গিন্সবার্গের ভারতে থাকা নিয়ে একটা বই লিখেছেন “দি ব্লু হ্যাণ্ড” নামে ; সেই বইতে তিনি হাংরি আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছেন অথচ তিনি কোনো হাংরি আন্দোলনকারীর সঙ্গে দেখা করেননি, তাঁর বইতে তিনি ব্লার্বে লিখেছেন যে বাংলা জানেন অথচ ইনডেক্স দেখলেই টের পাওয়া যায় যে বাংলার একটিও বই-পত্রিকা-বুলেটিন তিনি পড়েননি, তিনি কলকাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে গুলগল্প লিখেছেন । বলাবাহুল্য যে হাংরি আন্দোলনকে বিদেশি পাঠকের কাছে ফালতু প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন । গিন্সবার্গের সঙ্গে যে হাংরি আন্দোলনকারীদের পরিচয় হয়েছিল, তাদের সঙ্গে দেখা করেননি বা তাদের উল্লেখ করেননি । সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে হাংরি আন্দোলনের পৃথক সংগ্রহ দেখারও আগ্রহ হয়নি ডেবোরা বেকারের । দাদা সেসময়ে কলকাতাতেই ছিলেন, দেখা করেননি কেন তা এক রহস্য । অথচ ইতালির গবেষক ড্যানিয়েলা লিমোনেলা কলকাতায় এসে দাদার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরি থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন । বিবিসির ডোমিনিক বার্নও দাদার সাক্ষাৎকার নিয়ে গিয়ে প্রচার করেছেন । ডোমিনিককে দাদা বলেছিলেন “আমি এক হাজার বছর বাঁচবো”।
দাদা মধুটোলার বাড়ির সেজ মেয়ে বেলাকে বিয়ে করেন । বরযাত্রী হিসাবে কলকাতা থেকে এসেছিলেন উত্তরপাড়ার চিলেকোঠার কবি-বন্ধুরা । বিয়ের পর দাদা নিমডি টিলার চালাঘর ছেড়ে রোরো নদীর ধারে একটা বাড়ি ভাড়া করেছিলেন । সেই বাড়িতে সন্তোষকুমার ঘোষ এবং আরও অনেকে গিয়েছিলেন । কলকাতার কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এক্সকারশানে যাবার আগে দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন আর দাদা তাদের থাকার ব্যবস্হা করতেন । হাড়িয়া আর মহুয়ার মদের কথা শুনে অচেনা তরুণ কবি-লেখকরাও পৌঁছে যেতেন ।
একদিন পাটনায় আমি অফিস যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলুম, বাবা ডেকে পাঠিয়ে বললেন, মিনু একটা মেয়েকে বিয়ে করবে বলছে, তুই দেখেছিস ? আমি মধুটোলার বাড়িতে বারকয়েক গেলেও কাউকে তেমন লক্ষ্য করিনি ; মা মধুটোলার বাড়ি গিয়েছিলেন, বললেন যে উনি মেয়েটিকে দেখেছেন, ভালো সেলাই-ফোঁড়াই, রান্নাবান্নার কাজ জানে । দাদা দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা-মা’র সামনে, আমাকে বললেন, চারপাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে নে । বরযাত্রীদের জন্য সেনটোলায় একটা বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্হা হয়েছিল। বিয়ের পর দাদার বন্ধুদের আমরা জিপে করে জামশেদপুর স্টেশান পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলুম, তখনও ওনারা সিল্কের পাঞ্জাবি আর জমকালো ধুতিতে ।
হাংরি আন্দোলনে সবাইকে জেরা করেছিল ইন্সপেক্টার অনিল ব্যানার্জি, নকশাল আন্দোলনের সময়ে যাঁর বেশ নামডাক হয়েছিল, কিন্তু দাদাকে আর আমাকে জেরা করে একটা ইনভেসটিগেটিং বোর্ড । পুলিশ কমিশনার পি সি সেনের ঘরে কমিশনার ছাড়াও উপস্হিত ছিলেন ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার দেবী রায়, যাঁর ধারণা ছিল হারাধন ধাড়া তাঁকে অপমান করার জন্যই দেবী রায় ছদ্মনাম নিয়েছেন, আর ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লিগাল রিমেমব্রানসার, চব্বিশ পরগণার ডিসট্রিক্ট ম্যাজিসট্রেট, স্বরাষ্ট্র দপতরের আধিকারিক, ফোর্ট উইলিয়ামের মিলিটারি অফিসার । বোঝা যাচ্ছিল যে আমাদের দুজনের বিরুদ্ধে বিশেষ করে অভিযোগ এনেছেন কলকাতার তদানীন্তন এলিটরা, যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য আবু সয়ীদ আইয়ুব, সন্তোষকুমার ঘোষ এবং সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র মালিক । স্বরাষ্ট্র দপতরের আধিকারিক বোধহয় জানতেন না যে হাংরি বুলেটিন বেরোয় ফালি কাগজে, তাই জিগ্যেস করেছিলেন, “আন্দোলন চালাবার জন্য কোথা থেকে টাকা পান?” ফালি কাগজ কিনতে আর ছাপাতে পঞ্চাশ টাকা লাগে শুনে পুলিশ কমিশনার বলেছিলেন “আপনারা সাহিত্য করছেন না দাঁতের মাজন বিক্রি করছেন ।”
হাংরি আন্দোলনে বন্ধুদের গোলমেলে ভূমিকার পর দাদা তাঁদের সঙ্গে সাহিত্যিক যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন করে ফেলেছিলেন । তাঁর লেখালিখির প্রথম পর্ব বলতে গেলে মামলার পর শেষ হয়ে যায় । পড়াশুনায় একাগ্র হন, পাটনা থেকে ইংরেজি বইপত্র নিয়ে যেতেন । বন্ধুরা কিন্তু কলকাতা থেকে পালাবার জন্য দাদার পোস্টিঙের জায়গাগুলোয় যেতেন, মজফফরপুর, দ্বারভাঙ্গা, ধানবাদ, দুমকা, ডালটনগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় । আমি ডেভিড গারসিয়া নামে একজন হিপি ও সুবো আচার্য আর সুবিমল বসাককে দুমকায় নিয়ে গিয়েছিলুম । দুমকার বিশাল বিহারি টাইপ বাড়িতে পায়খানা ছিল বেশ দূরে, আর পোশাক খুলে টাঁঙাতে হতো সামনের একটা কাঁঠাল গাছের ঝুলন্ত এঁচোড়ে, পায়খানায় দরোজা ছিল না, গাছটা আড়ালের কাজ করতো । তরুণরা যাতে তাঁর বাসায় দলবেঁধে যায়, দাদা একবার বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন। তাঁর লেখালিখির দ্বিতীয় পর্ব আরম্ভ হয় অবসরের পর কলকাতায় নিজের বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে পাকাপাকি থাকতে এসে, যখন ‘হাওয়া-৪৯’ পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করলেন ।
“কালিমাটি “ পত্রিকার ( ৯৩ নং ) জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে দাদাকে প্রশ্ন করেছিলুম, “তোমার কলেজজীবনের সময় থেকে দীপক মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, বিমল রায়চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখ পাটনা, উত্তরপাড়া, চাইবাসা, ধানবাদ, ভাগলপুর, দ্বারভাঙ্গা, মজফফরপুর, দুমকা ডালটনগঞ্জ ইত্যাদি বাসায় নিয়মিত যেতেন । তাঁদের স্মৃতিচারণামূলক লেখায় তোমার উপস্হিতির অভাব দেখা যায় । তা কি তুমি দীর্ঘ দিন বাইরে ছিলে বলে ? নাকি হাংরি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলে বলে ? অথবা তোমার ট্রাইবাল ইন্সটিংক্ট নেই বলে ?”
উত্তরে দাদা বলেছিলেন, “স্মৃতিচারণায় না থাকা স্বাভাবিক, কেননা অনেক তথ্য ও সত্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে, নানা ধরণের পার্থিব ভীতি তাঁদের মনে কাজ করে, হিসেব করে লেখেন, বাদ দেওয়াকেই সহজ উপায় বলে মনে করেন । আবার হয়তো দীর্ঘ দিন বাইরে থেকেছি, কলকাতার কৌশলগুলো রপ্ত করতে পারিনি । হাংরি আন্দোলন বা অধুনান্তিক চিন্তাভাবনা বা কোনো নতুন ধারণা আধুনিকতামনস্ক বন্ধুদের কাছে একটি বিশাল অন্তরায় । তাছাড়া, তাঁরা অনুগামী গড়ে তুলতে অধিক মনোযোগী । তাঁদের বেশিরভাগকে আবিষ্কারকের ভূমিকায় দেখি না, সংযোজনমনস্ক নয় ।”
লেখক-কবির কাজ সম্পর্কে দাদা বলেছিলেন, “চিন্তার মাধ্যমে ভাব ও ভাষার সামঞ্জস্য গড়া, প্রকাশময়তার সম্প্রসারণ ও ব্যাপ্তি ঘটানো, যার ফলে পূর্ব অবস্হান থেকে ভাষা আরও সমৃদ্ধ হয়ে নবাঞ্চলের সংযোজন করে নতুন প্রজন্মের ভাষা হয়ে উঠবে, সম্প্রসারণ মানেই তো অতিক্রম, আর কবি ও লেখকের প্রধান দায়বদ্ধতা ভাষার প্রতি, কেননা ভাষাকে উত্তরোত্তর সমাজের আরও যোগ্য করে তোলা । ভাষা বদলে গেলে সামাজিক প্রক্রিয়া স্বতঃপ্রভাবিত হয় । উনিশ শতকে যেভাবে প্রভাবিত হতো আজ আর সেভাবে সম্ভব নয় । বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখেরা নিজেদের লেখালিখির মাধ্যমে আইনকানুনকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, আজ যেমন অরুন্ধতী রায়কে দেখা যায় মেধা পাটকরের সঙ্গে আন্দোলন করছেন, নর্মদা বাঁধের উচ্চতা হ্রাস এবং সংলগ্ন জনবসতিগুলোর পুনর্বাসন সম্পর্কে, তাঁদের আন্দোলনের ফলে সমাজ রাষ্ট্র প্রভাবিত হয়েছে, আন্দোলন অনেকটা সফলতা পেয়েছে । মুশকিল এই যে, আজ রাষ্ট্র স্বয়ং প্রতিবাদীর ভূমিকা নেয় । যার ফলে কবি-লেখকের প্রতিবাদী ভূমিকাকে হজম করে নেয় বা বানচাল রাখে । ইনটারনেট আর ব্লগ ব্যবহার আজ অন্যতম উপায়, এবং কবি-লেখকরা আজ ঠিক তাই করছেন । আরেকটা কথা, বাংলা ভাষা ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা, প্রত্যেক শব্দের একাধিক অর্থ । কেননা, ব্যক্তি, দাম্পত্য, সমূহ সবই সেই অর্থময়তার পরিসরে অন্তর্ভুক্ত, যেকারণে শব্দগুলির অর্থময়তার বীজমন্ত্রে যথেচ্ছ সম্প্রসারণের খোলা-সম্ভাবনা । মনুষ্যসমাজ বা মানবপ্রজাতি টিকে আছে তার চিন্তাচেতনার ও ভাষার উত্তরোত্তর সম্প্রসারণের মাধ্যমে ।”
দাদার লেখায় পরিসরের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করেছিলেন অরবিন্দ প্রধান তাঁর “পরিসরের ভিন্ন মন্তাজ : সমীর রায়চৌধুরীর ছোটোগল্প” ( কালিমাটি, নং ৯৩ ) প্রবন্ধে । পরিসরের গুরুত্বের কারণেই হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কৃত্তিবাস গোষ্ঠী ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিরোধীতা দেখা দিয়েছিল । দাদা দেখিয়ে ছিলেন যে এটি একটি দার্শনিক প্রতর্ক । কৃত্তিবাস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কতৃক ইতিহাসকে একরৈখিক অনুমান করার জন্য গলদটা গড়ে উঠেছিল । ভুলটা ঘটেছিল স্পেস বা ভাবনা পরিসরকে গুরুত্বহীন মনে করে, টাইম বা ঘটনার অনুক্রমকে অতিগুরুত্বপূর্ণ মনে করার ফলে । সময়কে একটিমাত্র রেখা বরাবর এগিয়ে যাবার ভাবকল্পনাটি, যিনি ভাবছেন তাঁর ইচ্ছানুযায়ী, বহু ঘটনাকে, যা অন্যান্য দিকে চলে গেছে, বাদ দেবার অনুমিত নকশা গড়ে ফ্যালে । ফলে জসীমউদ্দিন বাদ যান, নজরুল বাদ যান । মাইলফলক কেবল একটা রাস্তাতেই থাকে না । সব রাস্তাতেই থাকে । তাবৎ মাইলফলক বরাবর একটা রেখা টানা যায় না । শ্রীরামপুরের প্রটেস্ট্যান্ট ইংরেজরা একটিমাত্র রেখা বরাবর লাইনগুলোকে কল্পনা করতে শিখিয়েছিল, যার ফলে বহু মাইলফলক বাদ যেতো । দাদা এটা প্রমাণ করার জন্য প্রথমে ইংরেজিতে সম্পাদনা ও প্রকাশ করলেন “পোস্টমডার্ন বাংলা পোয়েট্রি” ও “পোস্টমডার্ন বাংলা শর্ট স্টোরিজ” এবং হিন্দিতে সম্পাদনা ও প্রকাশ করলেন “অধুনান্তিক বাংলা কবিতা”, যে সংকলনগুলোয় সেই মাইলফলকগুলোকে তিনি পুঁতলেন যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক একরৈখিক পথের বাইরের ।
দাদার কাছ থেকে আমরা জানলুম যে ‘কৃত্তিবাস’ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ডিসকোর্সটি ঔপনিবেশিক নন্দনবাস্তবতা বা কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়ালিটি দ্বারা তাড়িত বলে তা টাইম কেন্দ্রিক । কিন্তু হাংরি আন্দোলনের ডিসকোর্সটি স্পেস বা স্হান বা পরিসরলব্ধ, কেননা তা উত্তরঔপনিবেশিক টানাপোড়েন উপজাত । ‘কৃত্তিবাস’ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কাউন্টার ডিসকোর্সরূপে উদ্ভূত হয়েছিল উত্তরঔপনিবেশিক পরিসরের হাংরি আন্দোলন, যে আন্দোলনটি আরম্ভ করার প্রধান উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন দাদা । ইউরোপীয় ভাবনার ধারকবাহক হিসাবে যে নতুন ধরণের দার্শনিকতা জন্মেছিল, তাঁরা নিজেরা ছিলেন স্হানিক বা ভূমিক পরিসর থেকে উৎপাটিত ; এই যে পরিসরহীনতা, এটা একরৈখিক দর্শনে জরুরি ছিল । দাদা বললেন ,হাংরি আন্দোলনের আনা পরিবর্তন-প্রয়াস হল চিন্তাতন্ত্রের, সময়তাড়িত চিন্তাতন্ত্র থেকে পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্রে ফিরে যাবার । ইংরেজরা আসার আগে প্রাকঔপনিবেশিক ভাবনা-পরিসরটি ছিল বিশেষ-বিশেষ মনন-প্রবৃত্তির এলাকা । দাদার বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিচলিত হয়েছিলেন, এবং তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় লেখা ১৯৬৬ সালের তাঁর এই সম্পাদকীয়তে, তখনও হাংরি মকদ্দমা আদালতে চলছে এবং কেস সাবজুডিস :
“অনেকেই প্রশ্ন করছেন বলে আমরা লিখিতভাবে জানাতে বাধ্য হলুম যে হাংরি জেনারেশান নামে কোনো প্রতিষ্ঠান বা আন্দোলনের সঙ্গে কৃত্তিবাস সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্কিত । ঐ প্রকার কোনো আন্দোলনে আমরা বিশ্বাস করি না । কৃত্তিবাসের নামও যুক্ত করতে চাইনি কখনো । ‘হাংরি’ নামে অভিহিত কোনো-কোনো কবি কৃত্তিবাসে লেখেন, বা ভবিষ্যতে অনেকে লিখবেন, কিন্তু অন্যান্য কবিদের মতোই ব্যক্তিগতভাবে, কোনো দলের মুখপাত্র হিসেবে নয় । সংঘবদ্ধ সাহিত্যে আমরা আস্হাশীল নই । পরন্তু বাংলাদেশের যেকোনো কবির প্রতিই কৃত্তিবাসের আহ্বান । হাংরি জেনারেশানের আন্দোলন ভালো কি খারাপ আমরা জানি না । ঐ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ বা পরিনাম সম্পর্কে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই । এ-পর্যন্ত ওদের প্রচারিত লিফলেটগুলিতে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি চোখে পড়েনি । নতুনত্ব প্রয়াসী সাধারণ রচনা । কিছু-কিছু হাস্যকর বালক ব্যবহারও দেখা গেছে । এছাড়া সাহিত্য-সম্পর্কহীন কয়েকটি ক্রিয়াকলাপ বিরক্তি উৎপাদন করে । পিজিন ইংরেজিতে সাহিত্য করার লোভ উনিশশো ষাট সালের পরও বাংলাদেশের একদল যুবক দেখাবেন --- আমাদের কাছে তা কল্পনাতীত ছিল। তবে ঐ আন্দোলন যদি কোনোদিন কোনো নতুন সাহিত্যরূপ দেখাতে পারে -- আমরা অবশ্যই খুশো হবো ।”
মনে রাখা দরকার যে হাংরি আন্দোলনে দাদাও চাইবাসা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, আর এই মামলা চলাকালীন সম্পাদকীয়টি লিখছেন দাদার সেই বন্ধু যাঁর “একা এবং কয়েকজন” কাব্যগ্রন্হটি দাদা নিজের টাকায় “সাহিত্য প্রকাশক” নামে একটা সংস্হা খুলে ছাপিয়েছিলেন । সুনীল কেন এই সম্পাদকীয়টি লিখেছিলেন, দাদা গ্রেপ্তার হওয়া সত্বেও তা এখন কিছুটা আঁচ করা যায় । দৈনিক পত্রিকায় চাকুরি ও লেখা প্রকাশ ছাড়াও, মনে হয়, পুলিশের চাপ ছিল । শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় “নতুন কৃত্তিবাস” পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় লিখেছেন যে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে দিয়েছিলেন। আমার চার্জশিটের সঙ্গে সেই মুচলেকাগুলোর কপি পুলিশ দেয়নি বলে ঠিক জানি না, পুলিশ আমায় কেবল শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষের মুচলেকার কপি দিয়েছিল, সম্ভবত তারা মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছিল বলে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অ্যালেন গিন্সবার্গকে লিখেছিলেন যে মোট ছাব্বিশজনকে পুলিশ জেরা করেছিল, অর্থাৎ হাংরি বুলেটিনে যাদের নাম ছিল তাদের তো জেরা করা হয়েই ছিল, দাদার সঙ্গে যাদের বন্ধুত্ব ছিল তাদেরও জেরা করা হয়েছিল, এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও । উৎপলকুমার বসুকে লেকচারারের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলে অ্যালেন গিন্সবার্গের সৌজন্যে তিনি লণ্ডনে একটি স্কুলে পড়াবার চাকরি পান ।
২ অক্টোবর ২০১৫ ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত, আবু সয়ীদ আইয়ুবকে লেখা অ্যালেন গিন্সবার্গের চিঠি দুটি থেকে ব্যাপারটা কিছুটা স্পষ্ট হবে :
প্রথম চিঠি:-
৭০৪ ইস্ট ফিফথ স্ট্রিট, অ্যাপট ৫এ, নিউ ইয়র্ক
অক্টোবর ৬, ১৯৬৪
প্রিয় আবু সয়ীদ,
আপনার কাছে পাঠানো আমার চিঠিটি নিতান্তই বোকার মতো উদ্ধত এবং বুদ্ধিহীন হয়ে গিয়েছে এবং আমি দুঃখিত যে, সেটি আপনাকে রীতিমতো ক্ষুব্ধ করেছে । আমার লেখায় যে বিরক্তিকর অসম্মান প্রদর্শন এবং ধৃষ্টতা ফুটে উঠেছে তার জন্য আমার চুপ করে থাকাই শোভন, যেমন আপনার কী করা উচিত নয়, এসব ব্যাপারে অযথা নাক গলিয়েছিলাম, হয়তো লেখার গুণগত মান না বুঝেই । এবং এক অগ্রজকে বকাঝকা করা । আমি ক্ষমাপ্রার্থী, সেই সঙ্গে অজুহাত হিসাবে এটাও জুড়ে দিই যে, আমি অত্যন্ত দ্রুত লিখছিলাম -- একই বিষয়ে, একই দুপুরে অনেকগুলো চিঠি --- এবং অবস্হাটি আমি যেমনটা বুঝতে পারছি, আপনি যেমন ভাবছেন, অল্পববসী লেখকদের কাছে সেটি আর-একটু বেশি আশঙ্কাজনক । সম্ভবত আমার লেখার পর, এতদিনে অবস্হাটি অনেক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে । কিন্তু আমি মলয়, এমনকি সুনীল গাঙ্গুলি এবং উৎপল বসুর ( শেষোক্ত দুই ব্যক্তির মনে হয় বিচক্ষণতা বেশি ) চিঠি থেকে যা বুঝতে পারছি, মলয় মানুষ হিসাবে আমার পছন্দের এবং ওর ইংরেজিদুরস্ত ম্যানিফেস্টোর প্রাণোচ্ছলতা আমার সত্যিই ভালো লাগে --- আমার মতে যেকোনো ভারতীয় ইংরেজি গদ্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত । যদিও আমি এটা বুঝেছি যে ছেলেটি অনভিজ্ঞ, আবেগপ্রবণ এবং ওঁর ম্যানিফেস্টোগুলির ছেলেমানুষি, কিংবা বলা ভাল, সারল্যের মধ্যেই তার আবেদন
( আসলে ব্যাপারটি নিছকই পছন্দ, রুচি বা ধারণার ওপর নির্ভরশীল, এবং নিশ্চিতভাবেই এমনতর সাহিত্যসংক্রান্ত ঘটনা নয় যার মীমাংসা করতে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে ); পুলিশের কাণ্ডকারখানা এমনই যে কেবল মলয়ই নন, তাঁর ভাই সমীর ( তরুণ দার্শনিক ) দেবী রায় এবং আরও দুই যুবক, যাঁদের সঙ্গে আমার কখনও আলাপ হয়নি, শৈলেশ্বর এবং সুভাষ ঘোষ, এঁরা প্রত্যেকেই গ্রেপতার হয়েছিলেন । তারপর জামিনে ছাড়া পান । এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিসের তদন্ত, উৎপলের বয়ান অনুযায়ী, “যাঁদের গ্রেপতার করা হয়েছিল তাঁদের এর মধ্যেই চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং দোষ প্রমাণিত হলে সেটি তাঁরা খোয়াতেও পারেন ।” আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে এই “অশ্লীল সাহিত্যের ষড়যন্ত্র” ব্যাপারটায় ইন্ধন যুগিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, জনতা ও অন্যান্য বাংলা সংবাদপত্রগুলি । পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের আদালতের নির্দেশমতে ‘লেডি চ্যাটার্লি’ অশ্লীল আখ্যা পাওয়ায়, আমার সংগ্রহে রাখা টাইমস অফ ইনডিয়ার একটি খবরে জানানো হয়েছে, ‘অনেক বাঙালি কবি ও ঔপন্যাসিকের রচনার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনতে বহু মানুষ এগিয়ে এসেছে।’ বসু লিখেছেন, ‘একটি চাকরি খোয়ালে আর-একটি জোটানো অসম্ভব।’ গ্রেপতার হওয়া পাঁচজনকে আটক রাখা হয়েছিল প্রায় দু’দিন । উৎপল বসুকে আটক করে পাঁচ ঘণ্টা জেরা করে পুলিশ । আমি বুঝতে পারছি, সুনীলকেও পুলিশ জেরা করেছে । যতদূর জানি, পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে কিনা, সেটি এখনও স্হির করা হয়নি এবং সেই সিদ্ধান্ত অনেকখানি নির্ভর করবে এই তরুণ লেখকরা অগ্রজ এবং প্রতিষ্ঠিত লেখক, কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম) এর মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে সমর্থন পাবেন কিনা, তার ওপর । আমি অবশ্য প্রত্যেকের কাছেই শুনেছি, কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) এ-ব্যাপারে একেবারেই মুখ খোলেনি । এই লেখকদের রচনার গুণগত মান কেউ স্বীকার করুন বা না করুন, আপনার চিঠি থেকে যা প্রকাশিত হয়, তার চেয়ে আদত পরিস্হিতিটি কিন্তু আরও অনেক ভয়াবহ । ভারতে পুলিশি তদন্তের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার -- তার অন্তহীনতা ও কাফকিয়ান নির্মমতা -- যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে, তাতে ব্যাপারটিকে আপনার মতো হালকা চালে আমি কিছুতেই দেখতে পারছি না । আপনার হয়তো মনে আছে, বেনারসে মাসের পর মাস আমায় লোক অনুসরণ করেছে, পুলিশ এসেছে, মার্কসবাদীরা হুমকি দিয়েছে, দশ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়ো নোটিস এসেছে, অশ্লীল সাহিত্য বিলি করা ও তরুণদের নষ্ট করার ভিত্তিহীন অভিযোগে । দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বন্ধুদের মধ্যস্হতায় এবং ভারতীয় কনস্যুলেট থেকে নিউ ইয়র্কে পাঠানো চিঠির সাহায্যে সব সামাল দেয়া গিয়েছিল । সাহিত্যক্ষেত্রেও একবার এহেন সাংঘাতিক আইনি ব্যবস্হা চালু হয়ে যাওয়ার পরও তা দ্রুত খারিজ হয়ে যাবে, এমন আত্মবিশ্বাস আমার নেই, বিশেষ করে যেখানে তরুণ অরাজনৈতিক অনভিজ্ঞ উৎসাহীরা জড়িয়ে । ‘Fuck the Bastards of Gangshalik School of Poetry’ -র মতো একটি বাক্য নিয়ে অশ্লীলতা সম্পর্কে আপনার যা বিশ্লেষণ, তার সঙ্গে আমি একেবারে সহমত নই । এটা যে কোন ‘স্কুল’ তা আমি জানিও না । কিন্তু প্যারিস কিংবা কলকাতার কাফেতে, ত্রিস্তঁ জারার পুরোনো ম্যানিফেস্টোতে এটাই চলতি সাহিত্যভাষা -- মুখের ভাষা এবং প্রকাশিত লেখাতেও । সাহিত্যে এই কায়দা, এই আবেগ, বুদ্ধিদীপ্ত হালকা বদমায়েসি, বিশ শতকের ‘গ্রন্হাগার পুড়িয়ে দাও’ চিৎকারের মতোই । আমি সত্যিই তেমন শকড হইনি, যখন ওনারা বলেছিলেন, জনসমক্ষে একজন মহিলা তাঁর স্তন অনাবৃত করে দিক । আপনার সত্যিই ব্যাপারটি আপত্তিকর মনে হয় ? বড়োজোর এটা আইনবিরুদ্ধ, এই পর্যন্ত । অনেকের কাছেই শুনেছি, গতবছর এডিনবরা ফেস্টিভালের উজ্জ্বলতম মুহূর্তটি ছিল ব্যালকনিতে এক সম্পূর্ণ নগ্ন মহিলার উপস্হিতি -- আমি অবশ্যই ব্যাপারটা সমর্থন করি। তবে আমি নিজে বিশ্বের অপরপ্রান্ত থেকে এটি ‘প্রোমোট’ করতে আসিনি । আর আমার এটাও মনে হয় না যে, এই ধরণের ডাডামার্কা কাজকর্মের নেপথ্যের গভীরতম প্রেরণাটি কেবলমাত্র সস্তা আত্মপ্রচার । সেকারণেই আমার মনে হয়, এঁদের প্রতি আপনি সত্যিই অবিচার করছেন, এঁদের সাহিত্যকৃতিকে আপনি যতোই নিচু নজরে দেখুন না কেন । কারণ সাহিত্যগত মান নিয়ে নানাবিধ মতামত থাকবেই । মলয়, সুনীল বা বসুকে ফারলিংঘেট্টি চেনেনও না, কিন্তু ‘সিটি লাইটস জার্নাল’-এ ওনাদের অনুবাদ প্রকাশ করছেন । এশিয়া সোসায়টির শ্রীমতী বনি ক্রাউন টেক্সট যোগাড় করে দিয়েছেন । যতো অনুবাদ তিনি সংগ্রহ করেছেন, এই লেখাগুলিও তাঁর কাছে ততটাই কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছে । এখানে KULCHUR পত্রিকাটিও -- আভাঁগার্দ কাগজ হিসেবে যার বেশ নামডাক -- তাতে আলোচ্য তিনটি ম্যানিফেস্টো ( গদ্য, পদ্য এবং রাজনীতি বিষয়ক ) চলতি বছরের গোড়ায় পুনর্মুদ্রণ করেছিল । এব্যাপারে আমার সঙ্গে যোগাযোগের কোনও প্রয়োজন হয়নি ।
“অনুবাদ পড়ে আমি এটুকু অন্তত বুঝেছি, মলয় এবং অন্যান্য কবিদের, যাঁদের গ্রেপতার কিংবা জেরা করা হয়েছে, তাঁদের কবিতা এবং ম্যানিফেস্টো যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক । সুতরাং অন্য গোলার্ধের বাসিন্দা হয়েও এবং সাহিত্যের সঙ্গে আপনার অন্তরঙ্গতা স্বীকার করেও, আমি কবি এবং সমালোচক হিসেবে ( যেহেতু আমি এখানে কেরুয়াক, বারোজ, আর্তো, এবং মার্কিন কবিদের বিভিন্ন ধারার অপ্রকাশিত লেখার সম্পাদক এবং এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছি ) আমার মতামত প্রকাশ করবই, আমার নিজের বিশ্বাসে স্হির থাকার জন্য, এবং আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এঁদের কাজে আধুনিক জীবনের নানা চিহ্ণ সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে । এঁরা জিনিয়াস বা অসাধারণ, এমন দাবি না করেও বলা যায়, সমাজব্যবস্হার প্রতি তাঁদের যে মনস্তত্বগত অনাস্হা, সেটি তাঁরা ফুটিয়ে তুলেছেন স্পষ্ট ও মৌলিক ভাষায় । অন্যদিকে, এঁদের সমসাময়িক এবং অগ্রজরা এখনই ধ্রুপদী ভক্তিভাব বা সামাজিক ‘উন্নত’ ভাবনা, মার্কসবাদ, মানবতাবাদ ইত্যাদি সম্পর্কেই অধিক আগ্রহী । আমার মনে হয় না এই লেখকদের ‘বিটনিক’ আখ্যা দেওয়া উচিত, বিট-অনুকারকও নয়, কারণ শব্দটাই অত্যন্ত কাগুজে বাঁধাধরা বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি মার্কিন ধারণা অনুযায়ী ‘বিটনিক’দের সঙ্গেও এটি খাপ খায় না ।
“আর কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) সম্পর্কে আমার কিছু ভীতি আছে, যেমন ১) সংস্হাটি সম্ভবত মার্কিন সরকারের সঙ্গে যুক্ত ফাউণ্ডেশান ফাণ্ডগুলির সাহায্য পায় ; ২) আয়রন কার্টেন অন্তর্গত শাসনব্যবস্হার চেয়ে পশ্চিমী দুনিয়ার দমননীতির বিপজ্জনক দিকগুলি সম্পর্কে এরা কম সতর্ক । আমেরিকায় সারা বছর ধরে নাট্যশিল্প, বই, চলচ্চিত্র, কবিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে আইনি যুদ্ধ চলে, যার ফলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আভাঁগার্দ চিন্তাভাবনা প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছে । মার্কিন কমিটির মাথা মিস্টার এ. রাইখম্যান-এর সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছিলাম । তিনি জানিয়েছেন, আমেরিকায় কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) এর কোনো অস্তিত্বই নেই, নিতান্তই কঙ্কালটুকু পড়ে আছে । আর এই বছর আমায় নিউ ইয়র্ক থেকে জন হান্টের যোগাযোগ করতে হয় প্যারিসের অলিম্পয়া প্রেসকে বাঁচানোর জন্য । গাফিলতি কিন্তু আছেই । আপনি যতখানি মঞ্জুর করবেন, তার চেয়ে আমার সমালোচনা খানিক বেশিই হয়ে গেল । বেশ -- নিষ্পাপ বিবেক --- অ্যালেন ।
“পুনশ্চ: আপনি সত্যিই একথা জোর দিয়ে বলছেন যে ম্যানিফেস্টোকে সাহিত্য বলা যাবে না এবং সেকারণেই ঘটনাটি সাহিত্যে দমননীতির উদাহরণ নয় ? সত্যি ???????????????
“আমি প্যারিসে অফিস এবং মিস্টার কারনিক দুজায়গাতেই চিঠি লিখব । আপনার নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, রাশিয়ানরা ব্রডস্কি, ইয়েভতুশেঙ্কো, ভজনেসেন্সকিদের তৃতীয় শ্রেণির শিল্পী হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিল, যাদের কোনো সরকারি গুরুত্ব পাওয়ার প্রয়োজন নেই । এবং মার্কিন পুলিস এজেন্সিগুলির কাছ থেকে এই একই কথা আমাদের সম্পর্কেও শুনেছি ।”
দ্বিতীয় চিঠি:-
৭০৪ ইস্ট ফিফথ স্ট্রিট, এন ওয়াই সি-৯, অ্যাপ্ট-৫এ
১৩ অক্টোবর ১৯৬৪
প্রিয় আবু সয়ীদ,
“জঘন্য ! আপনার বাগাড়ম্বর আমায় বিভ্রান্ত করে তুলেছে, মাথা গরম করে দিচ্ছে আমার । আপনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন, ‘আমার কোনও পদমর্যাদা নেই’, এসব কথার মানে কী? ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডামের উদ্যোগে চলা চতুর্মাসিক পত্রিকার সম্পাদক আপনি । আপনার নিজস্ব লেটারহেড রয়েছে । কমিটির ভারতীয় এক্সিকিউটিভদের তালিকা আপনার হাতের কাছেই আছে, ভারতে কমিটির ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কেও আপনি ওয়াকিবহাল । চিনের ভারত আক্রমণের সময় আমি কলকাতায় একটি বড়সড় সমাবেশে উপস্হিত ছিলাম, সেখানে আপনার সহসম্পাদক মিস্টার ( অম্লান ) দত্ত সাংস্কৃতিক বর্বরতা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন। যা হোক, মিস্টার বি. ভি. কার্নিককে আমি চিঠি লিখেছিলাম, যদিও আমার মনে হচ্ছিল যে, কলকাতা কমিটির কোনও সদস্য বা কমিটির সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তিরই কাজটি করা দরকার ছিল । আর বাগাড়ম্বর বলতে আমি বোঝাতে চাইছি ‘আপত্তিকর উপাদান’-এর কথা । মহাশয়, আপনি ও পুলিশই সেগুলিকে আপত্তিকর বলছেন । সেগুলি নিছক আপত্তিকর তকমা পাওয়া উপাদান মাত্র, প্রকৃত আপত্তিকর নয় । পরের দিকে যে বলেছেন ‘প্রশ্নাতীত আপত্তিকর’, তাও নয় । আমি আপনাদের আপত্তি তোলা নিয়েই প্রশ্ন করছি, তাই তা এতোটুকুও ‘প্রশ্নাতীত’ নয় । আসলে পুরোটাই হলো রুচি, মতামত ইত্যাদির ব্যাপার । পুলিশ তাদের নিজেদের ও অন্যদের রক্ষণশীল সাহিত্যরুচি চাপিয়ে দিচ্ছে জোর করে । আমার মতে এটি কালচারাল ফ্রিডাম বা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতারই বিষয় । আশা করছি, এ-বিষয়ে ইন্ডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম, বিশেষ করে সেটির কলকাতা শাখার দায়িত্বপ্রাপ্তরা-ও একমত হবেন । আমার আরও অদ্ভুত লাগে জেনে যে, এক্ষেত্রে কারওকে সাহায্য করা মানে নবীন লেখকদের বলা, তাদের মতাদর্শ থেকে পিছু হটতে, নিজেদের অবস্হান পালটাতে, ইত্যাদি । ব্রডস্কি, ইয়েভতুশেঙ্কো প্রমুখের ক্ষেত্রে যেরকম করা হয়েছিল, সেরকমই একেবারে । এমনকী, তারা যে ‘ফালতু’ লেখক, সেটাও । আমি আপনাকে ফের রাগাতে চাই না । আপনি ক্ষুব্ধ হন এমনকিছু বলছি না । কিন্তু একটি কথা বলতেই হবে যে, বর্তমান ইশ্যু নিয়ে আমার-আপনার চিঠি আদান-প্রদান আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে ওই নবীন রুশ কবিরা কেন আপত্তিকর বা ‘ফালতু’, তা নিয়ে আমার সঙ্গে রুশ আমলাদের কথোপকথন । ‘দায়িত্বহীন, ‘নিম্ন মানের লেখা’, ‘নিম্ন রুচি’। ব্রডস্কির মামলার সময়ে, আপনার মনে থাকতে পারে, বিচারক প্রায় সারাক্ষণ ব্রডস্কিকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘কোন প্রতিষ্ঠিত লেখক কবে আপনার মর্ম স্বীকার করেছে।’ বেচারা মলয় --- যদি ও একজন নিম্ন মানের লেখকও হয় --- তা হলেও ওর জায়গায় আমি থাকলে আপনার সম্মুখীন হতে আমি ঘৃণা বোধ করতাম ।
“ওরা সকলেই সম্পূর্ণ বুদ্ধিহীন, জ্যোতি ( দত্ত ) যদি একথায় আপনার সহমত হয়, তাহলে ও আপনার আত্মগরিমা তুষ্ট করার জন্য সাধুতার ভান করেছে । দলের সবাই, ছাব্বিশজন যাদের জেরা করা হয়, সুনীল উৎপল বসু, সন্দীপন, তারাপদ তো আছেই, এরা ছাড়া অন্য যারা গ্রেপতার হয় সেই সব মধ্যমানের লেখকরা -- যদিও মলয়ের নির্যাতনের প্রতি প্রতিষ্ঠানের সপসপে মনোভাব দেখে মলয়ের অনভিজ্ঞতার প্রতি আমার মমত্ব জাগছে -- এরা সবাই ফালতু এরকম দাবি করা আপনার পক্ষে বা জ্যোতির পক্ষে অসম্ভব । কৃত্তিবাস গোষ্ঠী ও হাংরি আন্দোলনের সদস্যদের -- এই মামলায় যারা সকলেই পুলিশের দ্বারা হেনস্হা হয়েছে --- সমর্থন করেন, এমন কোনও বাঙালি লেখক বা সমালোচককে যদি আপনি না চেনেন, তাহলে আপনার মতামত সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে । নিজেকে একদম আলাদা রেখেও বুদ্ধদেব বসু তাদের গুণের স্বীকৃতি দিয়েছেন, যেমন দিয়েছেন বিষ্ণু দে ও সমর সেন । আমি শুধু মলয় নয়, সমস্ত সদস্যদের কথা বলছি ।
“এর পাশাপাশি আপনার আর একটি বিরক্তিকর বক্তব্যে আমি স্তম্ভিত, যে পশ্চিমের দমননীতির বিরুদ্ধেও কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম)কে একইরকম ভূমিকা নিতে হবে । আপনি বলেছেন, ‘আমি পর্তুগাল, স্পেন ও পাকিস্তানের কথা ভাবছিলাম’। এখনও পর্যন্ত আমার শোনা আপনার বক্তব্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর এটি । লরেন্স, ফ্যানিহিল, জেনে, বারোজ, মিলার, আপনাদের কামসূত্র, কোনারকের আলোকচিত্র -- এসব ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডে ধারাবাহিকভাবে, বহুল-প্রচারিত আইনি মামলা চলছে, শায়েস্তা করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া ফ্রান্সে একাধিক সংবাদপত্র ও আলজেরিয় যুদ্ধবিষয়ক বই দমননীতির কোপে পড়েছে, পড়ছে । রাজনৈতিক কারণেই এই দমন । এমনকী কংগ্রেসও ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) এর কয়েকটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যদিও তা নিতান্ত অনিচ্ছুকভাবেই । কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) সম্ভবত আয়রন কার্টেন দমননীতির বিরুদ্ধেই সরব হতে পছন্দ করে, পাশ্চাত্য দমননীতির বিরুদ্ধে নয় --- আমার এ ধারণা আরও বেশি করে দৃঢ় হচ্ছে, বিশেষ করে আপনার প্রতিক্রিয়ার ধরণ-ধারণ দেখে । এই বিগত এক বছরেই নিউ ইয়র্ক শহরে চলচ্চিত্র, বই সম্পর্কে পুলিশি ধরপাকড় তো হয়েইছে, এমনকী কমেডিয়ানরাও ( লেনি ব্রুস-এর ঘটনা ) বাদ যাননি । আমার মনে হয়, আপনার এ-সম্পর্কে যতোটা জানা দরকার ততটা আপনি জানেন না । ভদ্রভাষায় বললে তাই দাঁড়ায় আরকী । যেমন, আপনি কি জানেন যে, ইংরেজি ভাষায় যে প্রকাশক ডুরেল, মিলার, বারোজ, নবোকভ, টেরি সাদার্ন, দ্য সাদে ও প্রাচ্য প্রণয়গাথা প্রকাশ করেছিল, সেই অলিম্পিয়া প্রেস ফরাসি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে ? এ ব্যাপারে ফরাসি কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) কিছু করতে তেমন উৎসাহী ছিল, তা নয় । অলিম্পিয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া এক আন্তর্জাতিক কেচ্ছায় পরিণত হওয়ায় একটু নড়েচড়ে বসে তারা একটি পিটিশন চালু করেছে । নিশ্চয়ই এটা জানেন যে, ভারতে লেডি চ্যাটার্লিজ নিষিদ্ধ ? ভারতীয় কমিটি কি এ বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছে ? হাংরিরা তো হালের ।
“যা হোক, এসবই তত্ত্বকথা, আমার ক্ষোভ উগরে দেওয়া -- মতের বিনিময় -- ঈশ্বরের দোহাই, মাথা গরম করবেন না --- মলয় ও তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে আনা পুলিশের অভিযোগ মনে হয় এখনও রুজুই আছে --- মলয় লিখেছে যে ২৮ ডিসেম্বর বিচার শুরু হবে --- এই অদ্ভুত পরিস্হিতি থেকে মুক্ত হওয়ার মতো প্রবীণ লেখকদের কাছ থেকে কোনও সহায়তাই পাওয়া যায়নি এখনও অবধি --- ও বলেছে, বোধহয় ওর কথাগুলো সত্যিই, যে, ‘আমাদের গ্রেপতার হওয়ার ফলে কবি ও লেখকরা এতোটাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে যে, তারা প্রায় সকলেই তাদের লেখার ধরনটাই পালটে ফেলেছে ।’ অবশ্য ও যে লেখক দলকে চেনে, তাদের কথাই বলছে, ‘প্রতিষ্ঠিত’ বয়স্কদের কথা নয় । ও জানিয়েছে কংগ্রেসকে ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) চিঠি লিখেও কোনো উত্তর পায়নি ও । আপনিও এড়িয়ে গেছেন । আর ‘আমাদের গ্রেপতার হওয়ার পর আমাদের কোনো ম্যাগাজিন বা বুলেটিন আমরা ছাপাতেই পারছি না ।’ পুলিশের ভীতি । উৎপল বসু আজ একটা চিঠিতে লিখেছে, ‘ভীষণ বাজে খবর । আজ আমার কলেজ কর্তৃপক্ষ ( যেখানে আমি জিওলজি পড়াই ) আমায় পদত্যাগ করতে বলল । আমার কোনো যুক্তিই ওরা শুনতে নারাজ । আমার তো একরকম সর্বনাশ হয়ে গেল । ওরা টাইম পত্রিকা খুলে দেখিয়ে বললে, এই তো আপনার ছবি ও বক্তব্য । আপনার মতো কোনো লোক আমাদের এখানে থাকুন, এ আমরা চাই না...আমার চিঠিপত্র পুলিস ইনটারসেপ্ট করছে । আপনি আমার শেষ চিঠিটা পেয়েছেন ?...ইত্যাদি।’ এ একেবারে অসুস্হকর এক পরিস্হিতি । এরকমভাবেই সব চলতে থাকবে, এই ভেবে চিন্তিত হয়ে আমি আসলে প্রাথমিকভাবে তড়িঘড়ি, অতি দ্রুত চিঠি লিখেছিলাম । কারণ পুলিশি শাসনতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আমার ভারতে থাকতেই হয়েছে ।এখন কিন্তু পরিস্হিতি যথেষ্ট সংকটপূর্ণ । প্রবীণ, দায়িত্ববান কোনও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হস্তক্ষেপ না করলে এর থেকে নিষ্কৃতি সম্ভব নয় । বোধহয় ক্যালকাটা কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডমের প্রতি চিঠি আপনাকে উদ্দেশ করে লেখা আমার উচিত হচ্ছে না । যদি তাই হয়, তাহলে কলকাতায় কংগ্রেসের ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) দপতরে এ-বিষয়ে ভারপ্রাপ্তের হাতে দয়া করে চিঠিটি পৌঁছে দেবেন । আপনাকে রুষ্ট করে থাকলে মার্জনা করবেন । তবে চিঠিতে অন্তত আপনাকে কথাগুলি সোজাসুজি বলছি । এই মুহূর্তে আপনার-আমার মতানৈক্যের থেকেও পুলিশ পরিস্হিতিই প্রকৃত চিন্তার বিষয়।--- অনুগত, অ্যালেন গিন্সবার্গ ।
“পুনশ্চ : আমার বিলম্বিত উত্তরের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী । পিটার ( অরলভস্কি ) ও আমি গত এক মাস হারভার্ডে বক্ততৃতাদানে ব্যস্ত ছিলাম । আমি মাত্র কয়েকদিন আগেই কেমব্রিজ থেকে ফিরেছি ।
দাদাকে সম্ভবত জ্যোতির্ময় দত্ত বলেছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে দেখা করতে । আমরা দুজনে দেখা করেছিলুম । কিন্তু আইয়ুব সাহেব এ-ব্যাপারে মুখ খোলেননি, এমন ভাব করেছিলেন যেন দুটো ভিখারি ওনার ড্রইংরুমে ঢুকে পড়েছে । দাদাও জানতো না, আমিও জানতুম না যে গিন্সবার্গ আর আইয়ুব সাহেবের মধ্যে আমাদের কেস নিয়ে কথাবার্তা চলছে । ব্যাপারটা আমরা জানতে পারি পরে যখন দাদাকে আর আমাকে কলকাতায় র্যাডিকাল হিউম্যানিস্টের দপতরে কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামের ভারতীয় সচিব এ. বি. শাহ দেখা করতে বলেন । এ. বি. শাহ পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে জেনেছিলেন যে কলকাতার এলিটবর্গের কারা আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ ঠুকেছেন । এ. বি. শাহ বললেন, তিনি কিছু করতে পারবেন না । এলিটবর্গের কলকাঠি ছাড়া তো জানার কথা নয় যে উৎপলকুমার বসু কোথায় অধ্যাপনা করেন, এবং তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে উচিত শিক্ষা দেওয়া উচিত ।
অ্যালেন গিন্সবার্গের চিঠির জবাবে আবু সয়ীদ আইয়ুব ৩১ অক্টোবর ১৯৬৪ এই চিঠিটি লেখেন । চিঠিটির কপি পরে গিন্সবার্গই আমাদের পাঠিয়েছিলেন, জানাবার জন্য যে আইয়ুব সাহেব কতোটা ক্রুদ্ধ :-
Pearl Road
Calcutta
31 October, 1964
Dear Mr Ginsberg,
I am amazed to get your pointlessly discourteous letter of 13th. That you agree with communist characterization of the Congress for Cultural Freedom as a fraud and a bullshit intellectual liberal anti-communist syndicate, did not, however surprise me ; for I never thought the Congress had any charge of escaping your contempt for everything ‘bourgeoisie’ or ‘respectable’.
If any known litteratur or intellectual had come under police repression for their literary or intellectual work, I am sure the Indian Committee for Cultural Freedom would move in the matter without any ungraceful promptings from you. I am glad to tell you that no repressions of that kind has taken place here currently. Malay Roychoudhury and his young friends of the Hungry Generation have not produced any worthwhile work to my knowledge, though they have produced and distributed a lot of self-advertising leaflets and printed letters abusing distinguished persons in filthy language ( I hope you agree that the word ‘fuck’ is obscene and ‘bastard’ filthy at least in the sentence ‘Fuck the Bastards of the Gangshalik School of Poetry’; they have used worse language in regard to poets whom they have not hesitated to refer to by name ). Recently they hired a woman to exhibit her bosom in public and invited a lot of people including myself to witness this wonderful avantgarde exhibition ! You may think your duty to promote in the name of cultural freedom such adolescent pranks in Calcutta from halfway round the world. You would permit me to differ from you in regard to what is my duty.
It was of course foolish of the police to play into the hands of these young men and hold a few of them in custody for a few days ( they have all been released now) thus giving the publicity and some public sympathy --- publicity is precisely what they want to gain through their pranks.
I do not agree with you that it is the prime task of the Indian Committee for Cultural Freedom to take up the cause of these immature imitators of American Beatnik poetry. I respect your knowledge of European literature but can not permit myself to be guided by your estimation of writers in my language --- a language of which you chose to remain totally ignorant.
With all good wishes in spite of your grave disagreements and in admiration of some of your wonderful poems.
Yours sincerely
Abu Sayeed Ayyub
আইয়ুব সাহেব যখন এই চিঠিটা লিখছেন তখন পর্যন্ত চার্জ শিট দেয়া বাকি আছে, প্রদীপ চৌধুরীকে ত্রিপুরা থেকে গ্রেপতার করে কলকাতায় আনা বাকি আছে । আইয়ুব সাহেব দাদার “ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি” কাব্যগ্রন্হ তখনও পড়েননি, উৎপলের কবিতাও পড়েননি, তা তিনি স্বীকার করেছিলেন আমাদের কাছে । তিনি জানতেনই না যে উৎপলের চাকরি চলে গেছে, জানতেন না যে দাদাকে চাইবাসায় গ্রেপতার করা হয়েছিল, আর তখনও পর্যন্ত সাসপেন্ড রয়েছেন । কারা তাঁকে খবর যোগাচ্ছিল জানি না । যারা যোগাচ্ছিল তারাই আমাদের বুলেটিন, পত্রিকা ইত্যাদি কলকাতায় ছাপাতে দিচ্ছিল না । দাদার এক বন্ধু, অদ্রীশ বর্ধনের দাদা, নতুন প্রেস খুলেছিলেন বহরমপুরে, সিগনাস প্রিন্টিং নামে, দাদা সেখানে ছাপার ব্যবস্হা করে দেন তাঁকে বলে ।
অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং আবু সয়ীদ আইয়ুবের চিঠিগুলো পড়লেন তো ? এবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দুটি চিঠি পড়ুন, একটি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা, হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে, তাতে দাদার কোনো উল্লেখ নেই, অন্য চিঠিটা এক বছর পরে দাদাকে লেখা, যাতে লিখছেন যে মলয় কবিতা লিখতে জানে না, বোঝাই যায় যে পরের দশকগুলোর কবিতায় আসন্ন বাঁকবদলের হদিশ পাননি, এমনকী তরুণীরাও যে বাঁকবদলের অন্যতম কারণ হবেন, তা আশা করেননি, নকশাল আন্দোলনের আগাম আঁচ করতে পারেননি । পরের প্রজন্মের কবিদের সম্পর্কে তাঁর হিংসে তিনি লুকোননি, বোধহয় ভেবে দেখেননি যে চিঠিগুলো কখনও প্রকাশিত হলে ছবিটার ফ্রেমে ঘুণ ধরে যেতে পারে, কিংবা হয়তো ভেবেছিলেন যে বহুল প্রচারিত পত্রিকার গদিতে বসে সময়কে রৈখিকতার বাইরে যাবার তত্বকে হাপিশ করে দিতে পারবেন ।
15 June 1964
313 South Capital
Iowa City
USA
সন্দীপন,
নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসেছি, প্রচণ্ড হাওয়া, সঙ্গে ৫ ডজন বিয়ার ক্যান, পাশে সাঁতারের পোশাক পরা একটা ধলা মেয়ে, মাঝে মাঝে তার পাছায় টোকা মারছি পায়ের আঙুল দিয়ে, এ দৃশ্য কেমন ? অবিকল এই দৃশ্যের মাঝে আমি শুয়ে আছি । চিঠি লিখছি । কিন্তু আমি এ দৃশ্যের মধ্যে নেই । হাতের তালু গোল করে খুব ছোটো করে, চোখের কাছে আনছি --- সবকিছু দূরে চলে যাচ্ছে । মেয়ের মুখও । খিদে নেই । তেষ্টা নেই । তবু বিয়ার খাচ্ছি । কারণ, এখানে বসে খাওয়া বেআইনি বলে, ঘরের মধ্যে খুব গরম । থাকতে পারিনি । ঘাসের ওপর গড়িয়ে গেলাম । একটা দূরন্ত খরগোশকে ধরার জন্য পাঁচবার ছুটে গিয়েছিলাম ।
কী ভালো লেগেছিল আপনার চিঠি পেয়ে । বিশেষত লাল পেনসিলের অক্ষর । যেন দুটো চিঠি পেলুম । গল্পটা আপনার ভালো লাগবে না জানতুম । গদ্য লিখে আপনাকে খুশি করতে পারব এমন দুরাশা আমার নেই । সত্যি নেই । কারণ, আপনি গ্রেট গদ্য লিখেছেন একসময়, এখন আর তেমন না । কিন্তু যা লিখেছেন, তার ধারে কাছে আর কেউ পৌঁছোতে পারেনি । আমি ওরকম গদ্য লিখতে পারি না । লিখবো না । কিন্তু ওই গদ্যই আমার প্রিয় পাঠ্য । আপনি পড়বেন, এই ভয়ে আমি সহজে গদ্য লিখতে চাই না । তবু, কখনও লিখি, হয়তো টাকার জন্য, টাকার জন্য ছাড়া কখনও গদ্য লিখেছি বলে মনে পড়ে না, লিখেছিলুম একটা উপন্যাস, সেটা ছাপার সম্ভাবনা নেই । আমার কবিতার জন্য আপনাকে ভয় করি না, কবিতার লেখার ক্ষমতার ওপর আমার বেশি আস্হা নেই, আপনি যেরকম কবিতা ভালোবাসেন, অথবা যাই হোক --- আমি সেরকম কখনও লিখব না । আমি কবিতা লিখি গদ্যের মতো, ওরকমই লিখে যাবো । ও সম্বন্ধে আমার কোনো দ্বিধা নেই । শক্তি অসাধারণ সুন্দর বহু লাইন লিখেছে । আমার চেয়ে অনেক বড়ো, আমি ওকে শ্রদ্ধা করি । কিন্তু শক্তির কবিতা মুণ্ডহীন, আমি ওরকম লিখতে পারবো না, চাই না, কারণ আমি ওরকমভাবে বেঁচে নেই । বরং উৎপলের কবিতা আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করেছে । কিন্তু এখানে এই শুয়ে থাকা, গাছের ছায়া মুখে পড়ছে --- তখন মনে হয় কোথাও কিছু নেই, না কবিতা, না হৃদয় ।
প্রিয় সন্দীপন, দু’দিন পর আজ সকালে আবার আপনার চিঠি পেলুম । কি সব লিখেছেন কিছুই বুঝতে পারলুম না । কেউ আমাকে কিছু লেখেনি । শরৎ ও তারাপদ কফিহাউসে কি সব গণ্ডোগোলের কথা ভাসা ভাসা লিখেছে । সবাই ভেবেছে অন্য কেউ বুঝি আমাকে বিস্তৃত করে লিখেছে । কিন্তু আপনার চিঠি অত্যন্ত অস্বস্তিজনক । তিনবার পড়লুম, অস্বস্তি লাগছে। বিছানা থেকে উঠে কলের কাছে গেলুম, ফিরে এলুম টেবিলে, আবার রান্নাঘরে, ভালো লাগছে না, কেন আমাকে এরকম চিঠি লিখলেন ? আমি তো শুয়েছিলুম । আমি তো বিছানায় রোদ ও আলস্য নিয়ে খেলা করছিলুম । কেন আমাকে এমনভাবে তুললেন ?
সন্দীপন, আপনি অনেকদিন কিছু লেখেননি, প্রায় বছর তিনেক । তার বদলে আপনি কুচোকাচা গদ্য ছাপিয়ে চলেছেন এখানে সেখানে । সেই স্বভাবই আপনাকে টেনে নিয়ে যায় হাংরির হাঙ্গামায় । আমি বারণ করেছিলুম । আপনি কখনও আমাকে বিশ্বাস করেননি । ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলেন । আমি শক্তিকে কখনও বারণ করিনি, কারণ আর যতো গুণই থাক, শক্তি লোভী । শেষ পর্যন্ত উৎপলও ওই কারণে যায় । কিন্তু আমি জানতুম আপনি লোভী নন । আপনার সঙ্গে বহুদিন এক বিছানায় শুয়েছি, পাশাপাশি রোদ্দুরে হাঁটার সময় একই ছায়ায় দাঁড়িয়েছি । সেই জন্য আমি জানতুম । সেইজন্যই বুঝেছিলুম আপনার লোভ আমার চেয়ে বেশি নয় । আমার ওতে কখনও লোভ হয়নি, হয়েছিল অস্বস্তি থেকে ঘৃণা । ইংরেজিতে রচনা ছাপিয়ে ইওরোপ আমেরিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমার বিষম বদরুচি মনে হয়েছিল আগেই, এখানে এসে আরও বদ্ধমূল হয়েছি । হাংরির গ্যাঁড়াকলের প্রতি আরও ক্রুদ্ধ হয়েছি । অপরের কৌতূহল এবং করুণার পাত্র হতে আপনার ইচ্ছে করে ? হাংরি এখানে যে দুএকজন পেয়েছে, তাদের কাছে তাই । আমি এতোদিন দেশে রইলুম --- অনেক সুযোগ এবং আহ্বান পেয়েছিলুম, কোথাও তবু একটি লাইনও ইংরেজি পদ্য ছাপাইনি । ছাপালে কিছু টাকা পেতুম, তবু না । কারণ সবাইকে বলেছি, আমি বাংলা ভাষার কবি, আমি শুধু বাংলাতেই লিখি, যে ভাষায় কথা বলে সাত কোটি লোক -- ফরাসি ও ইতালির চেয়ে বেশি । এবং ফরাসি ও ইতালির চেয়ে কম উন্নত ভাষা নয় । আমার কাজ কবিতা লেখা, নিজের কবিতা অনুবাদ করা নয়, ও কাজ অন্যের । তোমার দরকার হলে বাংলা শিখে অনুবাদ করে নাও। এই ধরণের সূক্ষ্ম পিঠচাপড়ানির ভাব লক্ষ্য করেই আমি বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদগ্রন্হের কাজ, যে জন্য আমি এখানে এসেছিলুম, এক লাইনও করিনি ।
হাংরির এই ইংরেজির মতলব ছাড়া, বাংলা দিকটা আরও খারাপ । ওর কোনো ক্রিয়েটিভ দিক নেই । শর্টকাটে খ্যাতি বা অখ্যাতি পাবার চেষ্টা --- অপরকে গালাগাল বা খোঁচা দিয়ে । আপনি মলয়কে এতো পছন্দ করছেন --- কিন্তু ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে, আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে বিশ্বাস করেন না । আমি চলে আসার পরও আপনি হাংরির পৃষ্ঠপোষকতা করছেন --- হিন্দি কাগজের জন্য আপনি কি একটা লিখেছিলেন --- তাতেও হাংরির জয়গান । ভাবতে খুব অবাক লাগে --- আপনার মতো অ্যাবস্ট্র্যাক্ট লেখক কি করে ইলাসট্রেটেড উইকলিতে ছবি ছাপাটাও উল্লেখের ব্যাপার মনে করেন । এগুলোই হাংরির গোঁজামিল । এই জন্যই এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক থাকাতে বারবার দুঃখ পেয়েছি, দুঃখ থেকে রাগ, রাগ থেকে বিতৃষ্ণা । একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমি হাংরির কখনও প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করিনি, ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করিনি । পারতুম । করিনি, তার কারণ, ওটা আপনাদের শখের ব্যাপার, এই ভেবে, এবং আপনারা ওটাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিলেন কৃত্তিবাস বা সুনীলের প্রতিপক্ষ হিসেবে । সে হিসেবে ওটাকে ভেঙে দেওয়া আমার পক্ষে নীচতা হতো । খুবই । বিশ্বাস করুন, আমার কোনো ক্ষতির কথা ভেবে নয়, আপনার অপকারের কথা ভেবেই আমি আপনার ওতে থাকার বিরোধী ছিলুম । এটা হয়তো খুব সেন্টিমেন্টাল শোনালো, যেন কোনো ট্রিক, কিন্তু ও-ই ছিল আমার সত্যিকারের অভিপ্রায় ।
এবারে নতুন করে কি ঘটলো বুঝতে পারলুম না । যে-ছাপা জিনিসটার কথা লিখেছেন সেটা দেখলে হয়তো বুঝতে পারতুম । এবং এটা খুবই গোলমেলে --- যে চিঠি আপনি চারজন বন্ধুকে একসঙ্গে লিখেছেন, যেটা চারজনকে এক সঙ্গে পাঠানো যায় না, সেটা হারাধন ধাড়াকে পাঠালেন কি জন্য, বুঝতে পারলুম না । কিংবা আমার বোঝারই বা কি দরকার ? আচ্ছা মুশকিল তো, আমাকে ওসব বোঝার জন্য কে মাথার দিব্বি দিয়েছে এই আষাঢ় মাসের সন্ধ্যাবেলা ? আমি কলকাতায় ফিরে শান্ত ভাবে ঘুমোবো, আলতো পায়ে ঘুরবো --- আমার কোনো সাহিত্য আন্দোলনের দরকার নেই । মলয় আমার চিঠি কেন ছাপিয়েছে ? আমার গোপন কিছু নেই --- বিষ্ণু দেকে আমি অশিক্ষিত বলেছি আগেও, কৃত্তিবাসের পাতায় ব্যক্তিগত রাগে, কারণ উনি ওঁর সংকলনে আমার কবিতা আদ্দেক কেটে বাদ দিয়েছেন বলে । কিন্তু মলয়ের সেটা ছাপানোর কি মতলব ? যে প্রসঙ্গে লিখেছিলুম সেটা ছাপিয়েছে তো ? আমি ওকে লিখেছি সম্প্রতি. ‘সামনে পেছনে বাদ দিয়ে, ডট ডট মেরে চালাকির জন্য আমার চিঠি যদি ছাপাও, তাহলে এবার ফিরে গিয়ে কান ধরে দুই থাপ্পড় মারব’। আপনার চিঠি সম্বন্ধেও তাই । আপনার চিঠি ওরা ছাপিয়েছে সেটাই খারাপ(*) --- যা লিখেছেন, তা নয় । বেশ করেছেন লিখেছেন --- আমি না পড়েই বলছি । ওটা আপনার, শক্তির বা আমার ঘরোয়া ব্যাপার --- আর কার কি তাতে? আপনার যা খুশি বলার অধিকার আছে ।
কিন্তু ওসব থাক সন্দীপন । আপনাকে কেউ মারবে না । কার অমন স্পর্ধা আছে ? যদি আপনি জায়গা দেন, আমি সব সময় আপনার পাশে আছি । অনেকে আছে । আপনার সঙ্গে কতো ঝগড়াঝাটি হয়েছে --- কিন্তু এই দীর্ঘদিন নিরালায় ভেবে দেখলুম, আপনাকে বাদ দিয়ে আমাদের চলে না । এক হিসেবে আপনি আমার অপরাংশ, আপনার চরিত্রের অসংলগ্নতা, ভুল এবং জোচ্চুরি --- সব কিছু আমার প্রিয় । যেন আমার না-পাওয়া জীবন । লেখক হিসেবে, ‘প্রতিভাবান’ এই শব্দটি যদি ব্যবহার করতে হয় --- তবে আমাদের পুরো জেনারেশনে তন্ময় দত্ত ছাড়া --- শুধু আপনার সম্পর্কেই আমি একথা ভাবি । আপনার ঐ সুখের সূক্ষ্ম শরীর কেউ ছোঁবে না --- কলকাতা শহরে এমন কেউ নেই । না নেই । আপনি নরম ভাবে শুয়ে থাকুন রীনার পাশে, আপনি ওঁকে মঙ্গল গ্রহের গল্প বলুন ।
আমি কলকাতায় পৌঁছোবো ১৮ই আগস্ট । নানা কারণে এখানে এক মাস দেরি হয়ে গেল । দেরি হয়ে গেল আমারই বোকামিতে খানিকটা । জুনের মাঝামাঝি বা আগস্টের প্রথমে প্যারিসে একটা থাকার জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কয়েক দিনের জন্য । আমি জুন মাসটা নষ্ট করেছি --- সুতরাং আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই । এই ঠিকানায় আছি জুলাইয়ের বারো তারিখ পর্যন্ত অন্তত, তারপর নিউ ইয়র্ক ও ইংল্যাণ্ড। এখানে থেকে এম এ পড়তে পারি আমি --- আপনার মনে এরকম ধারণা এলো কি করে ? আমি কি সম্পূর্ণ কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়েছি ? কৃত্তিবাসে আপনার লেখা নিয়ে প্রচুর গণ্ডোগোল করেছি --- তবু, এবার কৃত্তিবাসে আপনার লেখা না দেখে মন খারাপ লাগলো । এখান থেকে কোনো জিনিস নিয়ে যাবার হুকুম আছে আপনার কাছ থেকে ?
ভালোবাসা
সুনীল
(*) এটি চিঠি নয় । দেবী রায়কে লেখা -- হারাধন ধাড়াকে নয় --- নানা রঙিন পেনসিলে লেখা হাংরি বুলেটিনের জন্য গদ্য । বুলেটিনে এই গদ্যটি প্রকাশিত হয়েছিল । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবিরাম উপন্যাস লেখা আরম্ভ করলে আনন্দবাজার ও দেশ পত্রিকায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাস প্রকাশ অসম্ভব করে দিয়েছিলেন । সেকারণে সন্দীপন আজকাল পত্রিকায় যোগ দেন । দাদাও কৃত্তিবাস পত্রিকায় লেখা পাঠানো বন্ধ করে দেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্য দাদার কাছ থেকে কবিতা দাদার পোস্টিঙের জায়গায় গিয়ে নিয়ে আসতেন, তখন দাদার কবিতার ধারা কৃত্তিবাসের ধারা থেকে পালটে গেছে । এবার দাদাকে লেখা চিঠিটা পড়ুন :-
৩২/২, যুগীপাড়া রোড, দমদম
কলকাতা - ২৮
৯ নভেম্বর ১৯৬৫
সমীর,
মলয়ের ৫ তারিখের মামলার বিস্তৃত বিবরণ নিশ্চয়ই ওদের চিঠিতে জানতে পারবি, বা জেনে গেছিস । সে সম্পর্কে আর লিখলুম না ।
দুটি ব্যাপার দেখে কিছুটা অবাক ও আহত হয়েছি । তুই এবং মলয় ইত্যাদি ধরেই নিয়েছিলি আমি মলয়ের স্বপক্ষে সাক্ষী দেবো না --- বরং অন্যান্যদের বারণ করব, কোনোরকম সাহায্য করবো না । তোর অনুরোধ ছিল ‘শেষ অনুরোধ’ --- যেন আমি প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় বা চতুর্থ অনুরোধ আগে প্রত্যাক্ষ্যান করেছি । মলয়ও কয়েকদিন আগে সকালে আমার বাড়িতে এসে বললো, ওর ধারণা আমি চারিদিক থেকে ওর সঙ্গে শত্রুতা করছি এবং অপরকে ওর সঙ্গে সহযোগীতা করতে বারণ করছি !
অপর পক্ষে, মামলার রিপোর্ট কাগজে বেরুবার পর --- কফি হাউসের কিছু অচেনা যুবা, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাতে আসে । আমি নাকি খুবই মহৎ ব্যক্তি --- হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে কখনও যুক্ত না থেকেও এবং কখনও পছব্দ না করেও যে ওদের স্বপক্ষে সাক্ষী দিয়েছি --- সেটা নাকি আমার পক্ষে পরম উদারতার পরিচয় ।
ওদের ওই নকল উদারতার বোঝা, এবং তোদের অন্যান্য অবিশ্বাস --- দুটোই আমার পক্ষে হাস্যকর মনে হল । মানুষ কি স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে ভুলে গেছে ? আমার ব্যবহার আগাগোড়া যা স্বাভাবিক তাই । আমার স্ট্যাণ্ড আমি আগেই পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছি । আমি হাংরি জেনারেশন পছন্দ করি না ( সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে ) । আমি ওদের কিছু-কিছু পাজি ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছি । মলয়ের দ্বারা কোনোদিন কবিতা লেখা হবে না --- আমার রুচি অনুযায়ী এই ধারণা । অপরপক্ষে লেখার জন্য কোনো লেখককেই পুলিশের ধরার এক্তিয়ার নেই --- একথা আমি বহুবার মুখে এবং কৃত্তিবাসে লিখে জানিয়েছি । পুলিশের বিরুদ্ধে এবং যেকোনো লেখকের স্বপক্ষে ( সে লেখকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক যা-ই হোক না ) দাঁড়ানো আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক কাজ বলেই মনে করি । কারুর লেখা আমি অপছন্দ করি বলেই তার শত্রুতা করবো, কিংবা অন্য কারুকে নিবৃত্ত করবো তাকে সাহায্য করতে -- এরকম নীচতা কি আমার ব্যবহারে বা লেখায় কখনো প্রকাশ পেয়েছে ? এসব ছেলেমানুষী চিন্তা দেখলে -- মাঝে মাঝে রাগের বদলে হাসিও পায় ।
যাই হোক, আদালতের সাক্ষ্যতে আমি দুটি কথা বলেছি । মলয়ের লেখার মধ্যে অশ্লীলতা কিছুই নেই --- এবং ওর লেখাটা আমার ভালোই লেগেছে । ধর্ম সাক্ষী করে আমি দ্বিতীয় কথাটা মিথ্যে বলেছি । কারণ, কয়েকদিন আগে মলয় যখন আসে --- তখন আমি বলেছিলুম যে ওর লেখা আমি পছন্দ করি না । কিন্তু শ্লীল-অশ্লীলের প্রশ্নটি জেনারাল, এবং সেই জেনারাল প্রশ্নে আমি অশ্লীলতা বলে কিছুই মানি না । সুতরাং সেই হিসেবে মলয়ের লেখাও যে বিন্দুমাত্র অশ্লীল নয়, তা আমি সাক্ষীর পক্ষে উঠে স্পষ্ট ভাবে বলতে রাজি আছি । তখন মলয় আমাকে অনুরোধ করে, আমি যদি ওকে সাহায্য করতে চাই, তবে জজসাহেবের সামনে ওর কবিতা খারাপ লাগে এটাও যেন না বলি । আদালত তো আর সমালোচনার জায়গা নয় । বরং ওর কবিতা ভালো লাগে বললেই নাকি মলয়ের পক্ষে সুবিধে হবে ।
সাক্ষীর কাঠগড়ায় মলয়ের কবিতা আমাকে পুরো পড়তে দেওয়া হয়।(*) পড়ে আমার গা রি-রি করে । এমন বাজে কবিতা যে আমাকে পড়তে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি --- আমার সময় কম, কবিতা কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্গে মেলে না--- এসব কবিতা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না । মলয়ের তিনপাতা রচনায় একটা লাইনেও কবিতার চিহ্ণ নেই । মলয় যদি আমার ছোটো ভাই হতো, আমি ওকে কবিতা লিখতে বারণ করতাম অথবা গোড়ার অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করতে বলতাম । যাই হোক, তবু আমি বেশ স্পষ্ট গলাতেই দুবার বলেছি ওর ঐ কবিতা আমার ভালো লেগেছে । এর কারণ আমার কোনো মহত্ব নয় --- আমার সাধারণ, স্বাভাবিক সীমাবদ্ধ জীবন । যে কারণে আমি আনন্দবাজারে সমালোচনায় কোনো বাজে বইকে ভালো লিখি --- সেই কারণেই মলয়ের লেখাকে ভালো বলেছি । যাই হোক, সেদিন আদালতে দাঁড়িয়ে মনে হল, হাকিম এবং পুলিশপক্ষ এ মামলা ডিসমিস করে দিতে পারলে বাঁচে । কিন্তু মলয়ের প্রগলভ উকিল মামলা বহুদিন ধরে টেনে নাম কিনতে চায় ।
ডিসেম্বর ৮-৯ তারিখে পাটনায় আমেরিকান সাহিত্যের ওপর একটা সিমপোজিয়াম হবে । আমি তাতে যোগদান করার জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছি । ঐ সময়ে পাটনা যাবো । আশা করি ভালো আছিস ।
সুনীল ।
(*) কবিতাটির নাম ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কবিতাটি প্রথমবার পড়েন । তার আগে তিনি কবিতাটি পড়েননি ।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘কৃত্তিবাস’ দ্বিতীয় সংকলনের সম্পাদকীয় লেখার সময়েও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলনের প্রতি ঈর্ষাজনিত ক্ষতের কথা ভুলতে পারেননি । তিনি লিখেছিলেন, “অ্যালেন গিনসবার্গের প্রভাবেই কিনা জানি না, এই সময় কৃত্তিবাস লেখক গোষ্ঠীরই একটি অংশ হাংরি জেনারেশন নামে একটি আন্দোলন শুরু করে । প্রায় একই লেখক গোষ্ঠী হলেও, কৃত্তিবাস পত্রিকা ঘোষিতভাবে হাংরিদের সঙ্গে সম্পর্ক-বিযুক্ত থাকে, আমি নিজেও কখনো হাংরিদের দলে যোগ দিইনি । দু’এক বছরের জন্য হাংরি জেনারেশনের আন্দোলনের সোরগোল কৃত্তিবাসের চেয়ে অনেক বেশি প্রবল হয়েছিল এবং তা একদিকে টাইম ম্যাগাজিন অন্যদিকে আদালত পর্যন্ত গড়ায় । আমি হাংরিদের থেকে সব সময়ে দূরে দূরে রইলেও অশ্লীলতার অভিযোগে যখন শ্রীযুক্ত মলয় রায়চৌধুরীর বিচার হয়, তখন আমি তার পক্ষ সমর্থন করে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম ।”
হাংরি আন্দোলনের দেবী রায়, ত্রিদিব মিত্র, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় কারোর সঙ্গে গিন্সবার্গের দেখা হয়নি । দাদার সঙ্গে হয়েছিল ১৯৬২ সালে আর আমার সঙ্গে ১৯৬৩ সালে । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে । বস্তুত কৃত্তিবাস গোষ্ঠীই গিন্সবার্গের দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল এবং তাঁদের অনেকেরই কবিতায় সেকারণে এই সময় বাঁকবদল ঘটেছিল, যখন কিনা তাঁরা কবিতা লিখছিলেন পঞ্চাশ দশক থেকে । গিন্সবার্গের তোলা ফোটোও তাঁরা কৃত্তিবাস পত্রিকার কভারে ছেপেছেন । কোনো হাংরি বুলেটিনে গিন্সবার্গের অস্তিত্ব নেই ।
‘চন্দ্রগ্রহণ’ পত্রিকার হাংরি সংখ্যার জন্য নাসের হোসেন দাদাকে এই প্রশ্নটি করেছিলেন, “হাংরি আন্দোলন চলাকালীন নানাধরণের ঘটনা ঘটেছে । এমনকি পরস্পরের সঙ্গে বিচ্ছেদও ঘটেছে । এই ঘটনার প্রভাবে মেইনস্ট্রিমের কিছু-কিছু ভূমিকা সম্পর্কে কিছু কি বলবেন ?”
দাদা তার এই উত্তর দিয়েছিলেন, “দেখ, আমার প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে সুনীল বাইরে থেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ভাঙন ধরাতে সচেষ্ট ছিলেন । শক্তিকে নেতা করা হয়েছিল বলে সুনীল অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ছিলেন । আর প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষ মহাশয় ভেতর থেকে ভাঙন ধরাতে চেষ্টা করেছিলেন এবং অনেকটা সফল হয়েছিলেন । এগুলি যে কেউ গবেষণা করলেই টের পাবেন ।”
দাদার জন্য তাই জরুরি ছিল কলকাতায় এসে “হাওয়া-৪৯” পত্রিকার মাধ্যমে নিজের দর্শনকে প্রতিরোধ হিসাবে এসট্যাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতরূপে তুলে ধরা । এক সাক্ষাৎকারে ( চন্দ্রগ্রহণ, হাংরি সংখ্যা ) নাসের হোসেন দাদাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “হাংরি জেনারেশন থেকে আপনি অধুনান্তিক অবস্হানপন্নতায় গেলেন কীভাবে ? আমার ধারণা এ-দুটোর দূরত্ব বিস্তর।”
উত্তরে দাদা বলেছিলেন, “আধুনিকতা বা ঔপনিবেশিক আধুনিকতা থেকে উত্তরঔপনিবেশিক অধুনান্তিকতায় যাত্রাপথ চিহ্ণিত করা তোমার পক্ষেও সহজ । দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও, স্বাধীনোত্তর চেতনা তারিখের কাঁটায় সায় দিয়ে বদলে যায় না । হাংরি আন্দোলন স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে ঘটেছিল ষাটের দশকে । এবং ক্রমশ ভেদের সনাক্তকরণ থেকে অভেদের সন্ধানে যাত্রার মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে প্যারাডিম শিফট বা বাঁকবদলের অনিবার্যতা । ঔপনিবেশিক আধুনিকতা থেকে বেরিয়ে আসার পরিস্হিতি । হাংরি আন্দোলন সবার আগে এই পরিস্হিতি অনুধাবন করতে পেরেছিল ; এবং আন্দোলনের অপরিহার্যতাকে উপলব্ধি করেছিল । কেননা এই ধরণের পরিবর্তন আন্দোলনের মাধ্যমেই সম্ভব । যার ফলে পরবর্তীকালে পর পর একাধিক আন্দোলন ঘটতে থেকেছে । স্বাধীনোত্তর পর্বে ঘটলেও, সেই আন্দোলনগুলির কাঠামো ছিল ঔপনিবেশিক আধুনিকতায় আক্রান্ত । আমরা এ-কথা বুঝতে পেরেছিলাম যে আগের কাঠামো থেকে যেভাবেই হোক বেরিয়ে পড়তে হবে । এবং সাহিত্যের প্রথম শর্ত আগের ভাষাকাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ভাষার পরিমণ্ডল গড়ে তোলা । আমরা প্রত্যেকেই কবিতা-গল্প ইত্যাদিতে ভাষার পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট থেকেছি । যেমন মলয় তাঁর কবিতার নাম দিলেন ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’, শৈলেশ্বর ঘোষ দিলেন ‘ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা’, প্রদীপ চৌধুরী নাম রাখলেন ‘চর্মরোগ’, বাসুদেব দাশগুপ্ত তাঁর গল্পগ্রন্হের নাম রাখলেন ‘রন্ধনশালা’, সুবিমল বসাক তাঁর উপন্যাসের নাম রাখলেন ‘ছাতামাথা’, আমি আমার গল্পের নাম দিলাম ‘স্মৃতির হুলিয়া প্রতুলের মা অমলেট অবধি’, ‘জলছবি’, ‘অতিক্রম’, কাব্যগ্রন্হের নাম রাখলাম ‘জানোয়ার’ । প্রত্যেকের ভাষা, উপস্হাপনা, প্রয়োগ সম্পূর্ণ পৃথক । এগুলো ঠিক রাতারাতি ঘটেনি । বিষয়গুলোকে নিয়ে আমি ও মলয় দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করেছি, আলোচনা হয়েছে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়ের ( হারাধন ধাড়া ) সঙ্গে । দেবী রায়ের কবিতা প্রথম থেকেই গঠন ও মেজাজ-মর্জিতে অভিনব । আমাদের পূর্বে যাঁরা লেখালিখি করেছিলেন তাঁদের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না । ফালগুনী রায় তাঁর বইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসন’ । হাংরি আন্দোলনের মধ্যেই এবং ষাট দশকের অধিকাংশ আন্দোলনের মধ্যেই অধুনান্তিকতার বীজ অন্তর্নিহিত ছিল । কেননা যে পরিবর্তন ঘটছিল তা সময়কেন্দ্রিক প্রশ্নময়তা থেকে পরিসরভিত্তিক অবস্হানপন্নতার দিকে তার চেতনার অভিমুখ ক্রমশ রচনা করছিল । এই প্রসেসটা এমন ছিল যে সেখানে প্রাধান্য ছিল গড়ে তোলার চেয়ে উঠে আসার দিকে গুরুত্ব দেওয়ার স্বতশ্চল তাগিদ । হাংরি আন্দোলনের কোনো হেড অফিস/হাই কমাণ্ড/পলিটব্যুরো বা নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ছিল না । ঠিক যেমন অধুনান্তিকতার কোনো কেন্দ্র থাকে না, অধুনান্তিক লেখালিখির চরিত্র একটি বিকেন্দ্রিক উপস্হাপনা । ফলে ষাট দশকের অন্যান্য সাহিত্য আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল না, অধুনান্তিক বীজ সেখানে নিহিত ছিল । হাংরি আন্দোলন থেকে অধুনান্তিকতায় পৌঁছে যাওয়া যেজন্য খুব স্বাভাবিক । হাংরি আন্দোলন ছিল সর্বাত্মক আন্দোলন । সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি জীবনচর্যার সবদিকেই এই আন্দোলন মনোযোগ দিয়েছিল । “হাওয়া ৪৯” পত্রিকার সংখ্যাগুলিতে বিষয়গুলির ক্রমান্বয়কে যদি লক্ষ্য করো, তাহলে দেখতে পাবে, সমস্ত দিকেই ছিল হাংরি আন্দোলনকারীদের গভীর অভিনিবেশ । ঔপনিবেশিক শাসন থেকে কাগজে-কলমে মুক্তি পাওয়ার পর হাতেনাতে সেই মুক্তি প্রতিষ্ঠার দায় প্রবলভাবে অস্হির রাখে সমাজচিত্তকে । সঙ্গে থেকে যায় ঔপনিবেশিকতার চাপিয়ে দেওয়া খেসারতগুলো । মাথাচাড়া দেয় আত্মবিচ্ছেদগ্রস্ত সত্তার নিজস্ব ভৌমতার অনিবার্যতা । অধুনান্তিকতা সেই সময়ে আমাদের পরিকল্পনায় ছিল না, যদিও তার বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল আমাদের ডিসকোর্সে । পরিবর্তনই ছিল আমাদের প্রধান লক্ষ্য । অধুনান্তিকতা উঠে এসেছে বোধের সমস্তরকম স্বতঃস্ফূর্ততা থেকে । কোনো পরিকল্পনা থেকে উঠে আসেনি। আধুনিকতা বা মডার্নিজমের থেকে বেরিয়ে এসে তুমি যে জায়গাটায় পৌঁছোলে বা পৌঁছোচ্ছ, তার একটা নামকরণ দরকার এবং সেই ভিন্ন পরিসরটির নামকরণ করেছেন আলোচকরা । অধুনান্তিকতা একটি পরিসর ; অনেকে তাকে আন্দোলন ভেবে ভুল করেন ।”
‘হাওয়া-৪৯’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’ প্রবন্ধে ‘অধুনান্তিক’ শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন বহুভাষাবিদ প্রবাল দাশগুপ্ত ।
তাঁর “উত্তরাধুনিক প্রবন্ধ সংগ্রহ” গ্রন্হে দাদা একটা তালিকা তৈরি করে দিয়েছিলেন, স্পষ্ট করার জন্য যে আধুনিকতার সঙ্গে অধুনান্তিকতার পার্থক্য কোথায়, তুলে দিচ্ছি এখানে :
আধুনিক অধুনান্তিক
যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, যুক্তিবিপন্ন, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে
সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্কের মতো যুক্তি মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোনোর প্রবণতা,
ধাপে-ধাপে এগোয়, কবিতার আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু
আদি-মধ্য-অন্ত এই ভাবগুলো হওয়া আর শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না
বজায় থাকে, একরৈখিক দেওয়া, ছেতরানো, ক্রমান্বয়হীন, আবেগ
ক্রমঅগ্রসর, কেন্দ্রাভিগ, যুক্তির যুক্তির দ্বৈরাজ্য কেন্দ্রাভিগ, যুক্তি ও
দিকে কবিতার অভিমুখ, আঁটো আবেগের দ্বৈরাজ্যের দিকে কবিতার অভিমুখ,
সাঁটো, স্বয়ংসম্পূর্ণ । এলোমেলো দেখায় ।
বদ্ধ সূচনা, বদ্ধ আঙ্গিক, বদ্ধ মুক্ত সূচনা, মুক্ত আঙ্গিক, মুক্ত সমাপ্তি ।
সমাপ্তি ।
ডিসটোপিয়া । হেটারোটোপিয়া ।
সুনিশ্চিত মানে, পরিমেয়তা ও মানের নিশ্চয়তা এড়িয়ে যাওয়া, অফুরন্ত
মিতকথনের প্রতি গুরুত্ব, কবির মানে, যা ইচ্ছে তা মনে করে নিতে পারেন
ঠিক করে দেয়া মানে, স্হাবর । পাঠক, মানের ধারণার প্রসার, প্রচলিত মত
অস্বীকার ।
তলে-তলে মানে, বাইরে মুখোশ। যা আছে তা-ই, লুকোনোর কিছু নেই,
স্বচ্ছতার বাধ্যবাধকতা ভিতর-বাহির
আলাদা নয় ।
‘আমি’ পাঠবস্তুর কেন্দ্রে, ‘আমি’র একক আমির অনুপস্হিতি, আমির বন্ধুত্ব,
নির্মাণ, একক আমি, পূর্ব ক্যানন থেকে বেরিয়ে যাওয়া, ক্যানন
নির্ধারিত মানদণ্ড, ক্যানন দাঁড় ভেঙে দেওয়া, সীমা আবছা, সীমায় ভাঙন,
করানো, সীমা স্পষ্ট, আত্মপ্রসঙ্গই মিশ্রতা, লিমিন্যালিটি, সংকরায়ন,
মূল প্রসঙ্গ, শুদ্ধতা, ‘আমি’র সংকরত্ব ।
পেডিগ্রি ( কুলুজি )।
একক মালিকানা, স্পষ্ট মালিকানা, মালিকানার রুবরিক, মালিকানার বহুত্ব,
শেকড় -- গোপন গভীরে, কবিই মালিকানা বিপন্ন, মালিকানা বিসর্জন,
টাইটেল হোলডার । পাঠকই টাইটেল হোলডার, শেকড়
ছড়িয়ে পড়ে, রাইজোম্যাটিক ।
একরৈখিক, লিনিয়ার, লিনিয়রিটি, প্লুরালিজম, বিদিশাগ্রস্ত বহুস্বরের আশ্রয়,
দিশাগ্রস্ত, একক গলার জোর, কবি দিগ্বিদিকে গতিময়, ভাবুক, জগৎ
ধ্বনি মিল দেন, প্রগতি । আয়োজনের মেলবন্ধন উসকে দেন,
অ্যাক্টিভিস্ট ।
কবি একজন বিশেষজ্ঞ । কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত
বৈশিষ্ট্য ।
শ্রেষ্ঠত্ব, শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠ কবি, বিবেচন-প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা
একজনকে তুলে ধরা, হিরো, গুরু সরিয়ে দেয়া, কবির বদলে সংকলনের
কবির গুণগান, একসময়ে একজন গুরুত্ব, কবিতার প্রধান পাঠকৃতি বিচার্য,
বড়ো কবি, ব্র্যাণ্ডনেম তৈরি, বিশেষজ্ঞ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলা, শ্রেষ্ঠত্ববোধক
সেন্সেলাইজেশান, আইকন । ফাঁস করে দেয়া, সার্বিক চিন্তা-চেতনা,
জেনেরালাইজেশান ।
কথা খেলাপ, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, শব্দার্থকে কথা চালিয়ে যাওয়া, কথার শেষ নেই,
সীমাবদ্ধ রাখা, কবিতার জন্য কবির শ্বব্দার্থের ঝুঁকি, কবিতাকে আত্মমনস্কতা
আত্মধ্বংস, কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন । থেকে মুক্তি ।
বাদ দেবার প্রবণতা, এলিমিনেশন, জোটবাঁধা, যোগসূত্র খোঁজা, শব্দজোট,
ঝকঝকে, ছাড়া-ছাড়া স্পষ্ট শব্দ । অর্থ-জোট, বাক্যজোট, উগ্র মতকেও
পরিসর দেয়া ।
একটিমাত্র মতাদর্শ, ইজম, তন্ত্র বহুমতাদর্শের পরিসর, ভেঙে-ভেঙে
অনুযায়ী চলবে, হাইকমাণ্ড, টুকরো ইজমের সমাজ অনুযায়ী
পলিটব্যুরো-নির্দেশিত । প্রতিনিয়ত রদবদল, ক্রমাগত
পরিবর্তন, ভঙ্গুরতা, জীবন থেকে
উঠে-আসা ধারণা ।
নিটোল কবিতা, শক্তিমত্তার পরিচয়, এলোমেলো কবিতা, বহুরঙা, শক্তি
গুরুগম্ভীর, কবিতার নির্দিষ্ট মডেল জাহির করা মুশকিল, হালকা মেজাজ,
যেমন সনেট, ওড, ব্যালাড ইত্যাদি, নির্দিষ্টতার বাইরে, অপরিমেয় নাগাল ।
অনুভবের গভীরতার খোঁজ ।
কবিকে প্রকৃতির বাইরে সাংস্কৃতিক জীব সব মানুষই প্রকৃতির অংশ,
মনে করা, নিসর্গবন্দনা । ইকোফ্রেণ্ডলি কবি ।
প্রতীকের প্রাধান্য, প্রতীকের প্রতীক এড়িয়ে যাওয়া, ভেঙে দেয়া,
চমৎকারিত্ব, প্রতীকের আহামরি, যা বলার সরাসরি বলা ।
ঘুরিয়ে বলা ।
স্হিতাবস্হার কদর, পরিবর্তন শ্লথ। পরিবর্তনের তল্লাশি, প্রযুক্তির হস্তক্ষেপ
স্বীকৃত ।
নাক-উঁচু সংস্কৃতি, প্রান্তিককে অশোভন সাংস্কৃতিক বিভাজন বিলোপ, অভেদের
মনে করা, শ্লীল ও অশ্লীল ভেদাভেদ, সন্ধান, একলেকটিক, বাস্তব-অতিবাস্তব-
ব্যবধান তৈরি করা, ভেদের শনাক্তকরণ । অধিবাস্তবের ব্যবধান বিলোপ ।
‘বড়ো কবি’ বলে দেবে কাকে কবিতা যেমন ইচ্ছে হয়ে ওঠা কবিতা, বহুপ্রকার
বলে, ভালো কবিতা ও খারাপ কবিতা, প্রবণতা গ্রাহ্য, কবি বেপরোয়া ।
বাইনারি বৈপরীত্য, উতরে যাওয়া
কবিতা, কবিতা হবে সমরূপী ।
খণ্ডবাদী, রিডাকশানিজম, কমপ্লেকসিটি, জটিলতা, অনবচ্ছিন্নতার
অবিচ্ছিন্নবোধ । দিকে ।
কেন্দ্রিকতায় উদ্ভূত, গ্র্যাণ্ডন্যারেটিভ । প্রান্তিকতায় উদ্ভূত, মাইক্রোন্যারেটিভ।
পরমসত্য, অকাট্যসত্য, ধ্রুবসত্য । সাময়িক প্রত্যয়, তত্বের বহুবিধ
অনুশীলন ।
কবিতা বিষয়কেন্দ্রিক, কবিতা কবিতা ফ্লাক্স থেকে জাত, কেন্দ্রিয়
দর্শন নির্ভর । বিষয়ের অনুপস্হিতি ।
কবিতার শিরোনামের গুরুত্ব, কবিতার শিরোনাম গুরুত্বহীন,
শিরোনামের সঙ্গে কবিতার দার্শনিক না থাকলেও চলে, প্রান্তিক শব্দ, পথচলতি
বা ভাবগত সম্পর্ক, হিরো, গুরু, অভিব্যক্তি ।
প্রতিভা, মাস্টারপিস, ক্ষমতার মসনদ
তৈরি, শব্দে মহিমাযোগ, মৌলিকতার
হামবড়াই ।
একটিমাত্র বার্তার বাহক । একসঙ্গে বহুকন্ঠস্বর ও বহুবার্তা,
এমনকী বার্তাবর্জন ।
কবিতার লক্ষ্য অব্যর্থ, কবির কবিতার লক্ষ্য বহুত্ববাদী ।
ব্যক্তিসত্তার বিবেচন ।
আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা । আধিপত্যের বিরোধিতা ।
‘আমি’ যা বলব সেটাই কবিতা, ‘তুমি’ যা বলবে সেটাও কবিতা,
এককেন্দ্রিকতা, বৃক্ষশাখার মতন বহুকেন্দ্রিক বা কেন্দ্রহীন পাঠবস্তুর
ইন্টারলিংকড । অজস্র উপাদান, সংজ্ঞার সীমা
ছাপিয়ে যায়, ঘাসের মতন ইন্টারলকড,
রাইজোম্যাটিক ।
ওপরের তালিকাটা থেকে স্পষ্ট হয় যে দাদার গল্প লেখার দ্বিতীয় পর্বে অধুনান্তিক জাদুবাস্তবতা এসেছে তাঁর বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি ও পাঠ থেকে সংগ্রহ করা চিন্তাভাবনার হাত ধরে । বন্ধুদের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে দাদা লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রায় দেড় দশক । প্রথম পর্বের গল্পগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের গল্পগুলোর ভাষায় ও কাঠামোয় পার্থক্য আছে । একইভাবে তাঁর প্রথম পর্বের কবিতা ( ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি, জানোয়ার, আমার ভিয়েৎনাম ) থেকে তাঁর দ্বিতীয় পর্বের কবিতা ( মাংসের কস্তুরীকল্প, পোস্টমডার্ন কবিতাগুচ্ছ, বিদুরের খড়ম, নির্বাচিত কবিতা, আপূর্বময়ী স্মৃতি বিদ্যালয় ) সম্পূর্ণ পালটে গিয়েছে । ছোটোগল্পের যে সংজ্ঞা ইউরোপ থেকে এসেছিল, অর্থাৎ একটি হুইপক্র্যাক এনডিং থাকতে হবে এবং ব্যক্তিএককের কাহিনি হবে, তা দাদার গল্প লেখার প্রথম পর্বেও ছিল না।
রবীন্দ্র গুহ তাঁর ‘সমীর রায়চৌধুরীর গল্পের ভূবন : গাণিতিক বহুকৌণিকতা ও উপভোগের প্রতিক্রিয়া’ প্রবন্ধে ( কবিতা ক্যাম্পাস, নং ৭১, জানুয়ারি-জুন ২০১১ ) বলেছেন, “আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ছোটো গল্পের প্রধান ধারক ভাষা ও আঙ্গিক । পৃথিবী জুড়ে যা কিছু লেখালিখি হচ্ছে তার মূল শক্তি বিষয় নয়, দায়বদ্ধতা নয়, আসল হচ্ছে কাঠামোটি । শাখা-প্রশাখা বিনোদনের উপকরণ সমৃদ্ধ হলেই গল্পটি উপভোগ্য হবে এমন নয় । ভাষার গুণে এবং সুঠাম কাঠামোর জন্য অনেক তুচ্ছ বিষয়ও ভাবনার স্তরে বিস্তর অতিরিক্ত ভাবনা ফুটিয়ে তোলে । যেমন আছে ‘মেথিশাকের গন্ধ’তে, ‘শ্রীশ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বাচন’-এ এবং ‘আলজাজিরা’তে । ‘মেথিশাকের গন্ধ’তে ডিটেইলিং নেই, আছে অতি সহজবোধ্য সংকেতময়তা । অন্ধকার তুলকালাম আড্ডা জমায় । ছায়ার পিছনে বিনম্র ছায়া । আড়ালে গোছানো কথাবার্তা । নির্জনতার মোড়ক উন্মোচিত হয় এইভাবে :-
‘অন্ধকারে জুজুবুড়ি, রাক্ষস, খোক্কোস, শাঁকচুন্নি, একানড়েরা থাকে -- মা’র কথা না শুনলে খপ করে খেয়ে নেয়-- তারপর মা যখন মামার বাড়ি পাণিহাটিতে নিয়ে যেতেন-- রাঙাদিদু কাছে টেনে সবাইকে রাক্ষস খোক্কোস জয় করার রূপকথা শোনাতেন --- আমরা নিজেরাই কেউ রাজপুত্র সেজে জয়ের খেলা খেলতাম-- খেলতে খেলতে ভয় কেটে গেল --- রাঙাদিদু স্বামীর ঘর করার আগেই বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে বিধবা হয়ে গিয়েছিলেন -- ছোটোছোটো কদমছাঁট চুল -- ফর্সা রঙ -- রোগা হাত-পা --- পরনে থানকাপড় -- সবাই বলত নেড়ি পাগলি--- আমাদের রাগ দুঃখ বাড়ত --- সেই রাঙাদিদু হঠাৎ মারা গেলেন --- পরের বার পাণিহাটিতে গিয়ে আর দেখা হল না --- মা বললেন --- অন্ধকারের দেশে চলে গেছেন --- সেই প্রথম অন্ধকারের মধ্যে প্রিয়জনের বাস তৈরি হল --- তারপর এক-এক করে মা বাবা ছোড়দি মেজোজেঠা নকাকা বন্ধুবান্ধব কতো প্রিয়জন সেই অন্ধকারে চলে গেল----’ ( মেথিশাকের গন্ধ )
‘মেথিশাকের গল্প’তে অন্ধকারই প্রধান চরিত্র । অলোক গোস্বামী ‘খুল যা সিম সিম’ প্রবন্ধে ( বোধ, মার্চ ২০০৯ ) বলেছেন, “গল্পটিতে সমীর এই অন্ধকারকে, তার বহুমাত্রিকতা এবং ব্যক্তিত্ব সমেত তুলে ধরেছেন । পড়তে পড়তে বুঝি অন্ধকারকে ভয় পাওয়ার অন্যতম একটি কারণ জড়িয়ে আছে অস্তিত্ব-চেতনার সঙ্গে । যে অভিজ্ঞানগুলো মারফৎ কোনো ব্যক্তি নিজেকে সনাক্ত করে অন্ধকার নিমিষে সেসব অভিজ্ঞান হাপিস করে দিতে পারে । মুছে দিতে পারে পরিচিত ভূগোল । কেড়ে নিতে পারে সভাসামগ্রী । অর্থহীন করে দিতে পারে কোড অফ কম্যুনিকেশন, তছনছ করে দিতে পারে পারস্পরিক সম্পর্কক্ষেত্র ।
“অন্ধকারের স্বরূপসন্ধান যেহেতু সভ্যতার কাম্য নয়, তাই শেফালির মারফত সমাজ বহুবচনে বিধিসম্মত সতর্কবার্তা পাঠায়, ‘যে যেখানে আছ সেখানেই থাকো -- মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে আসছি…’।
“কিন্তু অন্ধকারই তো পারে মনকে প্রশ্রয় দিতে, কল্পনাকে বিস্তৃত করতে । সেজন্যই সৃষ্টির আধার অন্ধকার । ভুলি কেমনে বাল্মীকির আশ্রমের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম তমসা, যা সমীরের ভাষ্যে, ‘কবিতার জন্ম হয়েছিল এই নদীতীরে, আরও সহজ করে বলা যায়, মানুষ নামের প্রাণীর কবিত্বের জন্ম কবিতার জন্ম এই তমসাতীরে । যে কবিত্ব এই প্রজাতির চালিকাশক্তি ।
“হতেই পারে অন্ধকার মৃত্যুর নিজস্ব এলাকা । তার জন্য সেই স্হান ভয়ঙ্কর হবে কেন ? মৃতের তালিকায় প্রিয়জনও তো থাকেন ।
‘এখন আমার নিজেরই অন্ধকারের দেশে চলে যেতে তত দ্বিধা নেই...সেখানে বাঁধন আছে...শক্তি আছে...রাঙাদিদু মা বাবা ছোড়দি সবাই তো সেখানেই...অন্ধকার এখন প্রিয়জনের সংসার…’
“আলোকে অন্ধকারের সাপেক্ষে রেখে সমীর বলেন,
‘শীতের সকালের দিকে যেমন ব্রেকফাস্টের সময় ডাইনিং টেবিলের ডানকোনে একচিলতে চেনাজানা এ-বাড়ির নিজস্ব রোদ আসে । একটু মনোযোগ দিলেই দেখা যাচ্ছে এই অন্ধকারও সমান চেনাজানা । চলতে ফিরতে, সঙ্গ নিতে কোনো অসুবিধে নেই । এই অন্ধকার নিজস্ব বিষয়-সম্পদের বাইরে নয় ।”
আরেকটি গল্পে অন্ধকারকে কেন্দ্রচরিত্র দিয়েছেন দাদা, ‘কালো রঙের কাজ : আঁধারের অবিনির্মাণ’। অন্ধকার সম্পর্কে দাদার গল্প দুটি আলোচনা কালে বিজ্ঞানের অধ্যাপক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘সমীর রায়চৌধুরীর ছোটগল্প : কয়েকটি বিজ্ঞানময় অবলোকন’ প্রবন্ধে ( কালিমাটি, নং ৯৩ ) বলেছেন, “বিজ্ঞানে, অন্ধকার স্হানিক বা অস্হানিক দুইই হতে পারে ( আলো কেবল স্হানিক ) যে অন্ধকারের বিন্দুগুলি পরস্পরের সংযুক্ত নয়, সেই অন্ধকার স্হানিক । অস্হানিকে অন্ধকারের এক বিন্দু নড়ে-চড়ে উঠলে, অন্য এক বিন্দুতেও টান ধরে । কথক ও তাঁর স্ত্রী শেফালির মধ্যে সেই অস্হানিক অন্ধকার সেখানে যোগাযোগসূত্রটি হল রান্নাঘরে নির্মীয়মান মেথিশাকের গন্ধ।”
নীলাঞ্জন লিখেছেন, ‘মেথিশাকের গন্ধ’ গল্পে লেখক শুরুতেই অন্ধকারের পরিসরে নিজের জড়ো করা সত্ত্বার ( Acccumulating self ) বর্ণনা দিয়েছেন :-
‘অনেকদিন পর আবার হঠাৎ লোডশেডিং । যাকিছু আমার বলার মতো বিষয় সম্পদ জড়ো করেছি, সব আড়াল হয়ে গেল। টেবিল চেয়ার বেডরুম টিভি ফ্রিজ ওয়াশিং মেশিন শেফালি ঘরদোর বুকসেল্ফ সিলিংফ্যান কবিতার খাতা পাশবই, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এ-বাড়ির যাকিছু দৃষ্টোগোচর, এই মুহূর্তে নিজের নিজের অবস্হান থেকে সেই উপস্হিতি এই অন্ধকারে নিভে গেছে । যে অবস্হানগুলো নিজেদের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে এই মহাবিশ্বে আমার জলজ্যান্ত থেকে যাওয়া।
নীলাঞ্জন তারপর লিখেছেন, এর পরেই দেখি অন্ধকারের সঙ্গে আত্মীয়তা গঠনের চেষ্টা । অবশ্য তা হতেই পারে । ‘আমি আছি; এই বোধ যদি আলো হয়, তবে ‘আমি নেই’ এই বোধ অন্ধকার । দুই বোধই পাশাপাশি থাকে । কবির কাছে অন্ধকার এক গাঢ় তন্ময়তা ডেকে আনে । হয়তো বা তখনই উদ্ভাসিত হয় তৃতীয় নেত্র। দুই চর্মচক্ষুর কাজ ফুরোলেই, তৃতীয় নেত্র নড়েচড়ে ওঠে । লেখক মনে করিয়ে দিচ্ছেন তমসা নদীর কথা । তমসা সামান্য পাল্টালে তামস, যার মানে অন্ধকার । আবার তামস উল্টে দিলেই ‘সমতা’ । অন্ধকারে সবাই সমান । সেই মনের ওপর ভর করেই লেখক এগোন । চেয়ার ছেড়ে উঠে, হাতের স্পর্শে অন্ধকারকে চিনে চিনে, অন্ধকারের ভিতর কতো অলিগলি, লেন বাইলেন টেবিলের দুইপাশ দিয়ে বেরিয়েছে । অন্ধকারে ভিতর ফাটলের সন্ধান পাচ্ছেন লেখক । আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরকার অন্ধকার । দুই স্নায়ুকোষের মধ্যবর্তী ফাটল, সেও এক অন্ধকার, বিজ্ঞানীরা যাকে বলেছেন Synaptic Cleft.
অভিজ্ঞতা ছেনে দাদা পেয়েছেন স্বপ্ন-কল্পনা-বাস্তবের অন্তরালে কুহকী বাস্তবতার ইন্দ্রজাল, যেখানে ব্যক্তিক সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তব তার সত্যগুলোকে চিনে নিতে পারে, কয়েকটি গল্প সেই সময়ে লেখা যখন পশ্চিমবঙ্গে চলছে রক্তচোষার দিগ্বিজয়, যার দরুণ রাজনৈতিক সামাজিক সমালোচনা মুড়ে ফেলতে হয়েছে জাদুবাস্তবে, দ্বৈততার সংমিশ্রিত আদরায়। বাস্তব সমাজকেই দাদা গুরুত্ব দিয়েছেন, আর দ্বিতীয় পর্বে লেখা তাঁর গল্পগুলোয় বাস্তবের ভাঁজে খুলে দিয়েছেন প্যাণ্ডোরার বাক্স । প্রচলিত কৃৎকৌশল বাদ দিয়ে দাদা তাঁর গল্পগুলোয় এমন এক আবহ সৃষ্টি করেন যা আপাত-অস্বাভাবিক, পার্থিব ও অপার্থিব এবং সময় ও পরিসরকে মিশিয়ে গড়ে তোলেন এক তৃতীয় স্হিতি, দুঃখ-কষ্ট-ভয়ের পাশাপাশি সৃষ্টি করেছেন আনন্দময় পরিবেশের আকস্মিকতা । ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ গল্পে আরবি ভাষায় ছিল ‘ইফতাহ ইয়া সিমসিম’, দাদা তাই গল্পগ্রন্হের নাম রাখলেন ‘খুল যা সিমসিম’, ‘চিচিং ফাঁক’ নয়, কেননা ‘চিচিং ফাঁক’ শব্দবন্ধটির মধ্যে বিশাল পাথরের দরোজা খোলার ধ্বনিসাম্য নেই, গুহা সামান্য ফাঁক করে আলিবাবা আর চল্লিশটা চোর তাতে ঢুকতো না । নৃসিংহমুরারি দে তাঁর প্রবন্ধ ‘মূল সূত্রটাই যে অণোরণীয়ান’ ( কালিমাটি, নং ৯৩ ) প্রশ্ন তুলেছিলেন হিন্দি নামকরণ কেন । বস্তুত সিমসিম শব্দটি হিন্দি নয়, আরবি। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ বাংলায় গল্পটি লেখার সময়ে ইংরেজি ‘ওপন সিসেম’কে ‘চিচিং ফাঁক’ করে দিয়েছিলেন ।
দাদার লেখায় জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ সম্পর্কে সর্বপ্রথম লিখেছিলেন রবীন্দ্র গুহ ( কবিতা ক্যাম্পাস, নং ৭১, জানুয়ারি জুন ২০১১ ) তাঁর প্রবন্ধ “সমীর রায়চৌধুরীর গল্পের ভূবন : গাণিতিক বহুকৌণিকতা ও উপভোগের প্রতিক্রিয়া” প্রবন্ধে । রবীন্দ্র গুহর প্রবন্ধটি থেকে প্রাসঙ্গিক আংশটি তুলে দিই আপনাদের কাছে:-
“সহজ কথাটা সরাসরি বলাই ভালো, সৎ-সাহিত্যের দরোজাটা বাংলা সাহিত্যে খুলে দিয়েছে সমীর রায়চৌধুরীর পয়লা নম্বর গল্পবিশ্ব ‘খুল যা সিমসিম’। যাকে নিঃসঙ্কোচে বলা যায় রুবিক পৃথিবীর একটা মাল্টিক্রোম হাতছানি, অথবা আলো এখন বক্ররেখায় যায় । সমীরের ডায়াসপোরিক অভিজ্ঞতা থেকে আমরা পাই সোজাসাপটা সরলতা, অনুভূতির অসনাক্ত বিন্দুসকল ও কালের পরিবর্তনশীলতা । আরও পাই অজস্র কিংবদন্তি, রূপনির্মিতি, ক্ষেত্রজ জাদুবাস্তবতা ।
“আমরা যারা গদ্যের হিয়ায়, বাকশস্যে অফুরন্ত ইঙ্গিতময়তা প্রত্যাশা করি, শব্দের সম্পর্কায়ন ও দেহপুষ্টিতে যুগপৎ গুরুত্ব দিই, তাদের কাছে সমীর রায়চৌধুরী নামটির একটি একসেপশানাল গ্রামার আছে । সে শুধু সীমা ডিঙোয় না, ক্রিয়েটিভ প্রক্রিয়াকে ক্রমাগত মোচড়ায় না, তার আনতাবড়ি অন্ধকারেরও একটা শৈলীগত অর্থ আছে । যা আপাত-অচ্ছুত মনে হলেও আদৌ অচ্ছুত নয় । সে এক আশ্চর্য জাদুসৌন্দর্যের ইশারা, যেখানে অন্ধকার ততোটা অন্ধকার নয়, শূন্যতা ততো গভীর শূন্য নয় । সমীরের কাছে অন্ধকারও একটা সম্পদ, শূন্যতাও মধুময়, শব্দ ও ধ্বনিময় । ‘বহুজাতিক ভুতের গল্পের খসড়া’ একটি খসড়ামাত্র নয়, বিশ্বায়নের হাজার বাস্তব মজার মধ্যে একটি অতিবাস্তব মজা । সমীরের লেখায় এই ঐতিহাসিক ধরতাইটা সত্য, অ্যাবসলিউট সত্য । জীবনে কতো দ্বন্দ্ব সংঘাত দুর্যোগ, কতো জ্যোৎস্না মেঘ কুয়াশা । অন্ধকারের ফাটল দিয়ে সব দেখতে পায় সমীর ---উত্তরঔপনিবেশিক অন্ধকারের অংশীদার সমীর বনাম কার্তিক । কার্তিককে ভুতের গল্প লিখতে হবে । এর আগে ছোটোদের ভুতের গল্প লিখেছে অনেকগুলো । সে লক্ষ্য করেছে পাঠক আগের থেকে অনেক বেশি ভুতপ্রুফ, সহজে ভয় পায় না । তাই সে এনেছিল উপাদান-বিভোর রেডিমিক্স । কিন্তু তাতে যে শর্টহ্যাণ্ডের সংক্ষিপ্ত ছোঁয়া, সেখান থেকে ভুতের গল্প বানানো বেশ দুষ্কর, সেসব বাকমালা পড়তে পড়তে প্রায়শই অন্যকিছু দেখতে পায় । যেমন সে দেখতে পেল :-
‘অনির্বাণের কথাই হয়তো ঠিক । লাইফ সেভিং ড্রাগ এদেশে ওই গন্ধমাদন । আস্ত পর্বত । পর্বে পর্বে গল্পের ভাঁজ । বহুজাতিকে হনুমানের ঝামেলা নেই, সবাই সমান হন্যমান । যেখানে ভাঙা কার্নিশ কথা বলে কবির সঙ্গে । চৈত্রের দুপুরে কুয়োর গভীরে শুয়ে থাকে নির্জনতা ।’
বোধোদয়ের দোকান থেকে কার্তিক সেল্ফমেডের প্যাকেট নিয়ে আসে । এটা আশ্চর্য একটা প্যাকেট, প্যাকেটের মধ্যেই প্যাকেট, তার মধ্যে প্যাকেট, তার মধ্যে, তার মধ্যে । আরও ছোটো । আরও । কেবলই অনুমেয়র দিকে আরও ভুতভাবনের বহুব্রী ।
‘বড়ো প্যাকেট খুলতে না খুলতেই বেড়ে যাচ্ছে হতে-হবের ঝোঁক । আশশ্যাওড়ার মৌলিক গন্ধ । ছায়ারা খেলছে আনি বানি জানি না । সব কিছুই চাইছে হতে পারলে হয় । গড়ে উঠছে কুহককুহেলি । খসে পড়ছে নোনা ইঁট । এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্ত অবধি পোড়াবাড়ির ইতিহাসের আত্মবিলয়ের আতর । ভেসে উঠছে ভৌগলিক।’
‘রেডিমিক্সের প্যাকেট খুলতেই ছড়িয়ে পড়ছে আবছা, ক্রমশ আঁধারের তিথিমাপ বাড়ছে । কার্তিক খুঁজে দেখে মলিন না আবডাল । নক্ষত্র নিভিয়ে আসছে জোনাকি, দমকা হাওয়ায় ছাতা হারানোর বর্ষাকালীন দুঃখু । জেগে উঠছে পোড়ো বাড়ির একদা । অনুসন্ধানী প্যাঁচা সন্ত্রস্ত চামচিকে আর ইঁদুরের বাসাবদলের চিরনির্মাণ ভেসে উঠছে ইহভৌতিক ছাপিয়ে । সন্দিগ্ধ খোঁড়া হয়ে হাঁটছে ।’
‘সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে আমতা-আমতা দোটানা । সিলিঙে ঠেকছে হতভম্ব, মাটিতে গড়াচ্ছে খটকা, বুজকুড়ি কাটছে তাজ্জব, অস্হির হয়ে উঠছে খামোকা, উঁকি মারছে তালগোল । জানলার কাছে ঝুলতে শুরু করেছে কাঁচুমাচু’
গল্পটি শেষ হয়েছে একটি অবিশ্বাস্য জাদুবাস্তব-অধুনান্তিক আবহে--
‘চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে হাড়গিলে নিশুতির হামা । বাড়ছে ভুতুড়ে পুঁজির রমরমা । পরস্পরের জায়গা বদল করছে খুঁটিনাটি আর খুঁতখুঁত । কার্তিক ভেবে দেখছে এবার কি সে ভীতির মধ্যে যাবে না ভয়ের অন্তরায় হয়ে উঠবে । প্যাকেট থেকে বেরোনো ক্রমউপদ্রবী আবছায়ায় সে একা । এই মুহূর্তে ছায়া-প্রচ্ছায়া দিশেহারা । জানলায় ঝুলছে কাঁচুমাচু । হতভম্ব ঠেকছে সিলিঙে । ছড়িয়ে পড়ছে অনুপস্হিতির অনুপ্রবেশ । এলোমেলো হয়ে পড়ছে চিন্তাজনিত । মাটিতে গড়াচ্ছে খটকা । বুজকুড়ি কাটছে তাজ্জব ।’
“স্বাধীনতার পরও ভারত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হাতে অবাধ মৃগয়া ক্ষেত । তাবড় তাবড় ভারতীয় বণিকরা ভিন্নদেশীয় বন্ধুদের মদতে চমকদার সাবান, তেল, কেশকালা, দাঁতের মাজন তৈরি করছে । এইসব সামগ্রীর গুণ বিচারের জন্য কোনও কোনও বাণিজ্য সংস্হা দশ মিলিয়ন টাকা খরচ করছে বিজ্ঞাপন বাবদ । এদের সমবেত আক্রমণের ফলে আমজনতা পিতৃনাম ভুলতে বসেছে । ক্রেতারা বিগবাজারে বলিপ্রদত্ত । আজও কেউ বুঝলেন না ভোগবাদ একটি রোগ ।
“সে কলকাতাই হোক বা মুম্বাই বা শহর দিল্লি, মোড়ে মোড়ে বিশাল হোর্ডিং । বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন । কোলগেট, পণ্ডস, পেপসোডেন্ট -বিড়লা-টাটা-রিলায়েন্স-বাজাজ-হিন্দুজা-মহিন্দ্রা । কাগজে টিভিতে কতোরকম নখরা । গাজোয়ারি নয়, সব বুদ্ধির খেলা । এই বিজ্ঞাপনের খরচ তুলতে, কতো রকমের প্যাঁচ -- কতোরকম ‘শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বাচন’ ---’ওঁ হ্রী হ্রী শ্রী ওঁ লক্ষ্মীবাসুদেবায় নমঃ।” ক্রেতাকে বিব্রত না করে বাজার দখল করতে হবে । সে গল্প শোনায় পিনাকী । গল্পের নায়ক সুব্রত । কোম্পানির মাল্টিন্যাশানাল, কোম্পানিতে অনেক কবি-লেখক-ডকু ফিল্মমেকার একাধিক । সবাইকে টপকে অ্যাসাইনমেন্টটা পায় সুব্রত । অফিস থেকে ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে পুরীতে এসে হোটেলে ওঠে । সে খায় দায় আর লক্ষ্য করে কে কেমনভাবে টুথপেস্ট ব্যবহার করে । মুখশ্রীতে কেমন মহিমা খেলা করে । ব্রাশের ডিজাইন দ্যাখে, টিউবের প্যাকিং । ফেনা, গল্প, স্বাদ, মেজাজ । ব্রাশের আকার ছন্দ দ্যাখে । গাদা ব্রাশ-টুথপেস্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করে । এভাবেই সে পেয়ে যায় সূত্র । কেল্লা ফতে ---
‘স্রেফ টুথপেস্টের টিউবের মুখটা এক মিলিমিটার বাড়িয়ে দিতে হবে । গোপন থাকবে এই কৌশল । দাম মাত্র দুটাকা কমিয়ে একটা ঝুটো মিতব্যয়িতার গিমিক ধরে রাখা হবে বাজারে । অধবা গোড়ার দিকে সঙ্গে একটা গিফট বা কুড়ি পার্সেন্ট এক্সট্রা পেস্টের ভড়ং । মনোযোগের কেন্দ্র সরিয়ে দিতে । তাহলেই ফর্টি পার্সেন্ট অতিরিক্ত টুথপেস্ট ড্রেনআউট হয়ে যাবে । কেননা টিউবের মুখের ডায়ামিটার আগের চেয়ে বেড়ে গেছে । স্রেফ এক মিলিমিটার ।’ ( শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বচন )
“কালখণ্ডের চমৎকার কৌতুক হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের বাজারায়ন তথা বিশ্বপুঁজিবাদ । একথা বোধহয় বাংলা সাহিত্যে আধিপত্যবাদীরা বুঝে ওঠার আগেই বুঝে ফেলেছিলেন কতিপয় গোত্রচিহ্ণহারা দ্রোহপুরুষ, যাদের মধ্যে অন্যতম সমীর রায়চৌধুরী । শৈলী বা প্রকরণ মেনে সমীর কখনও গল্প লেখেননি । তাঁর পাঠকাঠামোয় কারো প্রভাব নেই । একেবারেই ভিন্ন এবং তাৎপর্যপূর্ণ । স্তন্যপায়িনীর পৃথিবীতে চলতে চলতে আবার সেই জাদুবাস্তবতা --- আছে আর নেই ।
“ভূখণ্ডের ক্ষয়, নিসর্গের ক্ষয়, এর মধ্যে জাদুবাস্তবতা খুব বাড়তি মনে হলেও ময়লা নয় । বিষয়টি আমাদের সাহিত্যে নতুন মনে হলেও বিশ্বসাহিত্যে নতুন নয় --
The term magic realism, originally applied in 1920 to a school of painters, is used to describe the prose fiction of Jorge Luis Borges in Argentina, as well as the work of writers such as Gabriel Garcia Marquez in Colombia, Isabel Allende in Chile, Gunter Grass in Germany, and Joh Fowels in England. These writers interweave, in ever shifting pattern, a sharply etched realism in representing ordinary events and descriptive details together with fantastic and dreamlike elements, as well as with materials derived from myth and fairy tales ( A Glossary of Literary Terms, M.H.Abrams)
“আমাদের জীবনে বাস্তবতা একাধিক । যেমন নিত্যবাস্তবতা, অদ্ভুত বাস্তবতা, রূঢ় বাস্তবতা, দিব্য বাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা । দুঃখ এবং সৌন্দর্যে ভরা এইরকম লাগামছাড়া বাস্তবতার জীব আমরা নাটকের কুশীলব, চিকিৎসক, সমাজসেবিকা, মিথ্যাবাদী, কবি, ভিখিরি, যোদ্ধা । সবার জীবনযাপনে পদ্ধতির পার্থক্য আছে । এই পার্থক্যের ব্যাপারে যিনি যতোটা সচেতন তিনি ততোটাই সার্থক বস্তুবাদী । সমীরের চোখ সরাসরি নিত্যসুন্দরের দিকে থাকলেও, মার্কেস এবং গুন্টার গ্রাসের মতো জাদু-ভেল্কি-মন্ত্র-তন্ত্র বাদ যায়নি । বিশ্বায়নের মজা বাদ যায়নি । যেভাবে কল্লোল যুগের লেখকরা নতুন ঘরানার সাহিত্য গড়ে তুলেছিলেন, নির্মাণ করেছিলেন নতুন ভাষার, তেমনি সমীর আনলেন কল্লোল পরবর্তী অধুনান্তিক টাইমস স্টাইল, প্রকৌশল । গদ্যভাবনার গুণমাহাত্ম্য ভিন্নমাত্রা পেল । বিজ্ঞজনেরা ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে তার পাঠবস্তুর মাপজোক করল, পরিসর পরিস্হিতি এবং মুক্ত সূচনা, মুক্ত সমাপ্তির লক্ষণ খুঁজল, বিবাদ সৃষ্টি করতে পারল না ।
“সময়ের ক্ষয়, আতঙ্ক, সন্ত্রাস, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বাতাবরণ মানেই উত্তরআধুনিক, একথা সমর্থন করেন না সমীর । তার চেনা-অচেনা শব্দসকল, সাবঅলটার্ন কথাবিশ্ব অধুনান্তিক বিশ্বায়নের সারবস্তু । সমীরের পাঠবস্তু ন্যারেটিভ নয়, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফর্মবর্জিত । তার রচনায় অদ্ভুত ভাষাবুলি ঝুড়িঝুড়ি, যেমন---
দিলফাড়, ঠাওর-ঠিকানা, মিল্লত, উড়ানমনস্ক, বুজরুকি, আলিশান, কাঁটোকা হার, দিল-জ্বালানি, হিট-রহস্য, দীর্ঘ জুম ফোকাস, ফিলিম, তুক মেলানো, বেপর্দা, কাঁইয়া, স্তনের ডৌল, জৈবতাপ, মনমর্জি, লালফুটকি, চিৎপুতুল, ঢালাউপুর ( ‘খুল যা সিম সিম’ গল্পগ্রন্হ থেকে )
‘গোলগল্প থেকে গালগল্প : একটি অর্বাচীন ডায়ালগ’ প্রবন্ধে ‘শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বাচন’ বিশ্লেষণকালে শাশ্বত সিকদার বলেছেন :-
“সমীরের লেখায় আমরা স্পষ্টত যা পাচ্ছি তা হল স্মৃতি আর কল্পনার দোলাচল । কোথাও বোঝার সঙ্জ উপায় নেই, কোনটা রিয়েল লাইফ ফিকশনের অংশ, কোনটা বাজিয়ে তোলা । সদ্য নোবেলপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক কোয়েটজির ‘এলিজাবেথ কোস্টেল্লো’ উপন্যাসেও আশ্চর্যভাবে বাস্তব ও মনগড়া চরিত্ররা মিলেমিশে থাকে । এর পরে, সমীর পাঠবস্তুর বাইরে থেকে সবজান্তা চালে বানোয়াট গল্প ফাঁদছেন না । পা ফেলছেন না নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে । তিনি নিজে অংশগ্রহণ করছেন রচনার অন্তবর্তী ব্যবসাবিষয়ক প্রতিবেদনে । অনেকের স্বরের সাথে চালাচ্ছেন ইনটারাপ্টেড ডিসকোর্স । নিজের বৈচিত্র্যময় ডায়াস্পোরিক অভিজ্ঞতার লক্ষ্মীর ঝাঁপি খুলে তিনি বার করে চলেছেন একটার পর একটা রসদ ।
“আমাদের মনে হয়েছে, সমীরের সব গল্পই আসলে, একভাবে, তাঁর অলিখিত আত্মজীবনীর টুকরো অংশ । পাণিহাটীর শৈশব আর কর্মসূত্রে বিহার-ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের দ্বৈত ডায়াস্পোরিক অভিঘাত সমীরের জীবনকে অনবদ্য সব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করেছে । সমীরের ভূগোল হয়েছে আশয়, তাই তাঁর ইতিহাসও হয়েছে সীমাহীন । আর তাই তাঁর গল্পে হাঁটাহাঁটি পা ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন পরিসরের ভূগোল, ইতিহাস, প্রান্তিক মানুষজনের ঘামের টাটকা গন্ধ । অবলোকন প্রতিভার জাদুতে বর্ণিত এইসব ঘটনাগুলোর চারপাশের অদ্যাবধি আলো-না-ফেলা অঞ্চলগুলো এসেছে প্রকাশ্যে । সমীর তাকে হিরের মতন শব্দের আলো ফেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা তরতরিকায় দেখেছেন ।”
দাদার গল্পের পাশাপাশি যে বিদেশি লেখকদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁরা হলেন টমাস বার্নহার্ড, পিটার হাণ্ডকে, জন ফাউলস, অ্যাঞ্জেলা কার্টার, জন বানভিল, মিশেল টোরনিয়ার, গিয়ানা ব্রাশচি, ইউলেম ব্রাকমান, লুইস ফেরন প্রমুখ --- যাঁদের গদ্য একযোগে জাদুবাস্তব ও উত্তরাধুনিক । পরাবাস্তবের প্রভাবের কথা বলব না, কেননা দাদা পাণ্ডুলিপিতে যথেষ্ট কাটাকুটি করতেন এবং স্বগতলিখন লিখতেন না, লেখার আগে কাহিনিটি নিয়ে প্রচুর চিন্তা করতেন, বিভিন্ন রেফারেন্স বই ঘাঁটতেন । “হাওয়া ৪৯”-এর যে বিশেষ সংখ্যাগুলো প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিটির বনেদে একটি গল্প বা কবিতাগুচ্ছ প্রসঙ্গক্রমে এসেছে দাদার চিন্তায়, যেমন জটিলতা, সংকরায়ন, অপর, অধুনান্তিকতা, উত্তরঔপনিবেশিকা, ইকোফেমিনিজম, সীমা, ভারতত্ব, ডায়াসপোরা ইত্যাদি। বস্তুত ম্যাজিক রিয়্যালিজম অভিধা এতো বেশি প্রয়োগ হয়েছে, বিদেশে তো বটেই, এদেশেও, যে এসকেপিস্ট ফিকশানকেও অনেকে জাদুবাস্তবের পর্যায়ে ফেলছেন, ফলে বিনোদনের জন্য বা বাজারকে সন্তুষ্ট করার জন্য যে অবজেকটিভ মেইনস্ট্রিম ফিকশান লেখা হচ্ছে. তাদেরও জাদুবাস্তব বলে চালানো হচ্ছে ।
জাদুবাস্তব এসকেপিস্ট ফিকশান নয়, বিনোদনের জন্য নয়, বাজার ধরার জন্য নয় । এই ফিকশান আমাদের জগতকে চিহ্ণিত করে এবং তাতে আমাদের অবস্হানকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় ; সত্যগুলোর বার্তা পাঠায় অথবা তাদের অন্বেষণ করে । জাদুবাস্তব অত্যন্ত সিরিয়াস ফিকশান এবং তাতে গদ্যবিন্যাসের কাজ জরুরি । লেখক চেষ্টা করেন একটি বাক্যের মধ্যেই অতীত-বর্তমান ভবিষ্যতকে উপস্হাপন করতে । প্রতিদিনের সাংস্কৃতিক বাস্তব থেকে এই বাস্তব পৃথক । জাদুবাস্তব ফিকশান চিন্তার পরীক্ষানিরীক্ষা নয়, দূরকল্পনামূলক নয়, তার বিশ্ববীক্ষা অবজেকটিভ মেইনস্ট্রিমের বাইরে ।
‘সিগারেটের তিরোভাব’ গল্পটি নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন (কালিমাটি নং ৯৩), আমি প্রসঙ্গিক অংশগুলো তুলে দিচ্ছি :-
“এই গল্পে রয়েছে কথক ও তাঁর দৌইত্রী পিংকির মধ্যে স্নেহমধুর ভাবের আদানপ্রদান ও পিংকির দাদানের ( ঠাকুরদা ) মৃত্যু নিয়ে জেগে ওঠা সামাজিক পারলৌকিক সংস্কারবাহিত কিছি চিত্র । এই গল্পে সিগারেট দেহের বিকল্প হিসাবে দেখা দিয়েছে । দাদান অবিনাশবাবু ছিলেন চেন-স্মোকার । তাঁর মৃত্যু যেন সিগারেটের তিরোভাব । তাঁর সহসা মৃত্যুতে বাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল, শোকের ছায়া নেমে এল। পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের কাজ এগোতে লাগল। পিংকির মনে নানান প্রশ্ন । দাদুকে তার উত্তর যোগাতে হয় । পরদিন সন্ধ্যাবেলায় পুরোহিত এলেন শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ব্যবস্হার জন্য । কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখে বিধান দিলেন ---’ত্রিদোষ ঘটেছে । দানদক্ষিণা বেশি লাগবে । ষোড়শদান । আত্মাদেবতার তুষ্টি । বিশদভাবে অনুষ্ঠান প্রয়োজন।’
“এক দৃষ্টিতে দেখলে ( আধুনিকতাবাদী ) এসব হল পুরোহিত অং-বং-চং । অবসলিট শাস্ত্রে এসব পাওয়া যায় । পরলোক অস্তিত্বহীন । কিন্তু তৃতীয় তরঙ্গের পোস্টমডার্ন বিজ্ঞান জানাচ্ছে, এগুলো ওরকম হুশ করে কালো কাকের মতো উড়িয়ে দিলে চলবে না, বরং এর ভিতরেও ফেলতে হবে সন্ধানী সার্চলাইট । মৃত্যু নিয়ে ভাবনার শিখা উসকে দিয়েছেন কাহিনিকার সমীর রায়চৌধুরী । লিখছেন:-
‘কিছুকাল আগে মরে যাওয়া ভাবলে কষ্ট পেতাম । যত দিন যাচ্ছে মৃত্যু নিয়ে ভাবনা পাল্টাচ্ছে । বাবা মা ন-কাকিমা ছোড়দি কিছু প্রিয় বন্ধুবান্ধব আর এই দাদান মারা যাওয়ার পর, মৃত্যুর এলাকাকে ফাঁকা লাগে না । একা বলে মনে হয় না । মনে হয় মৃত্যুও বসবাসের যোগ্য ।’
“এককালে মৃত্যুর এলাকাকে ‘অমুত্র’ বলা হতো । আমি শব্দটির মধ্যে রস পাচ্ছি তাই একে ফিরিয়ে আনতে চাইছি :
‘পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে... ন এব ‘ইহ, ন ‘অমুত্র’ ( হে পাত্র, বৈদিক কর্মত্যাগ করা সত্বেও যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি ইহলোকেও পতিত হয় না, পরলোকেও নিকৃষ্ট শরীর প্রাপ্ত হয় না ) [ গীতা, ধ্যানযোগ ৬.৪০ ]
“পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যান বলতেন, পদার্থবিদ্যার সমস্ত সমীকরণকে একটি মহাসমীকরণের মধ্যে পুরে ফেলা যায় । সেই মহাসমীকরণ হল Unworldliness = 0, সংক্ষেপে U = 0 এখন এই Unworldliness এর বাংলা করছি ‘অমুত্র’ । এই সমীকরণের অর্থ পদার্থবিদ্যার সবকিছুই ইহসর্বস্ব ( Worldly) ; ইহলোকের বাইরে কিছুই নেই ; কিন্তু এই দৃষ্টিতে অধিবিদ্যার ( Metaphysics ) সম্ভাবনাকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে । তৃতীয় তরঙ্গের পোস্টমডার্ন বিজ্ঞান কিন্তু তা চাইবে না । সে বলবে -- ‘অমুত্র’ আছে । আছে তার নির্দিষ্ট গঠন । মৃত্যুর পর সেখানে যাওয়া যেতেই পারে । একে বলি প্রেতলোকের অসমীকরণ। গল্পকার সমীর রায়চৌধুরী আন্দাজ করেছেন এই অসমীকরণের অন্ধকারে দৃষ্টি চালিয়ে--
‘যারা মারা যায় তারা বোধহয় স্বজনের মৃত্যুর দ্বিধা সংগোপনে চুরি করে নিয়ে যায় । প্রেতলোকে আর খারাপ লাগে না।
এদিকে পুরুতঠাকুর বলেছেন, বৈতরণী, চতুর্ধাশান্তি, ষোড়সদান, ভোজ্যউৎসর্গ --- শ্রাদ্ধানুকল্প -- মনোময় কোশ --- সে অনেক ব্যাপার ।’
“মনোময় কোশের পর হল বিজ্ঞানময় কোশ, যেখানে তৃপ্ত আত্মার বাস, যেখানে ‘ইহ’ (This) এবং ‘অমুত্র ( That ) -- দুই পৃথক নয়, দুই জুড়ে সন্ধি হয়ে রচিত হয়েছে ‘ইহমুত্র’ যা স্বামী বিবেকানন্দের প্রিয় শব্দ ছিল । এই ইহমুত্রই গোটা জগৎ । মনোময় কোশে এদের দুই খণ্ডকে আলাদাভাবে দেখা হয় । আলাদাভাবে দেখা হলেও এদের মধ্যে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায় না, কোয়ান্টাম দর্শন এখানে কাজে লাগে । পিণ্ডদান কিংবা ভোজ্য উৎসর্গের পদ যেন এক একটি Wave-packet । সেই পদগুলি, এক্ষেত্রে, গল্পকার জানাচ্ছেন, স্হির হল…
‘হিঙের কচুরি, বেগুনি, মোচার ঘণ্ট, কইমাছের ঝালদে, দই ইলিশ, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, এবং চা-সিগারেট’
“সিগারেট তাহলে পুরুপুরি তিরোহিত হচ্ছে না, চলছে মৃতকের সহানুকল্পে --- অমুত্রের দিকে । তবু শ্রাদ্ধদিবসের দিনে অবিনাশবাবুর প্রিয় ব্র্যাণ্ডের সিগারেট প্যাকেট খুঁজে পাওয়া গেল না, কিনেও আনা হল না, ভোজ্য উৎসর্গের থালায় একটি পদ রিক্ত থেকে গেল
“এই না পাওয়া নিয়ে সমীর রায়চৌধুরীর গল্পে দ্বিতীয় এপিসোড । স্কুলে পিংকির জামার মধ্যে শুঁয়োপোকার প্রবেশ, শুঁয়ো ফোটানো ও পিংকির জ্বর, শুঁয়োপোকা বন্ধন ও প্রজাপতি মুক্তির প্রাণময় উপস্হিতি। সেই বন্ধন ও মুক্তি ক্রমশ ‘ইহ’ ও ‘অমুত্রে’ও ।
“ স্কুলে গিয়েছিল পিংকি, তার গায়ে শুঁয়োপোকা উঠেছে, গায়ে ফুটিয়ে দিয়েছে শুঁয়ো । পিংকির বেশ জ্বর । ডাক্তারবাবু এসেছেন। সন্না দিয়ে শুঁয়ো তোলা হয়েছে, মলম লাগানো হল । দাদুকে দেখে পিংকির তোড়ে কান্না-- ‘শুঁয়োপোকা কেন স্কুলে গিয়েছিল ?’ জন্মদিনে পিংকিকে দাদু উপহার দিয়েছিলেন লতাপাতা আঁকা সবুজ জামা । সেইটি পরেই কি স্কুলে গিয়েছিল পিংকি ? উত্তর এখানে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ যাই হোক না কেন --- অন্তরালে দেখি সম-অভিযোজনের দোলা, পিংকি ও শুঁয়োপোকা একই বিন্দুতে পৌঁছোচ্ছে ।
“কথক, পিংকির দাদু, পিংকির কান্না থামানোর জন্য তার ডলপুতুল ন্যান্সির খোঁজ করেন । সেই পুতুল পাওয়া যায়, জুতোর বাক্সের ভিতরে উল্টোনো অবস্হায়, এবং কী আশ্চর্য, সেই পুতুলের বুকের নিচে -- সেই আত্মার তৃপ্তিকর রিক্ত পদ --- সিগারেটের প্যাকেট । লোভনীয় সিগারেট, তবু কথক, পিংকির দাদু সেই প্যাকেট খোলেন না শেষ পর্যন্ত -- যেখানকার বস্তু সেখানেই ফিরে যাক । ওঁ নমো ।”
দ্বিতীয় পর্বের ফিকশনে দাদার ন্যারেটিভ কেতা হয়ে উঠেছিল সহজাতভাবে অন্তর্ঘাতী, পরাভবী এবং তাতে রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষমতার প্রতি খোঁচাগুলো মজার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, যেমন, ওষুধের জন্য আমাদের দেশ সেই গন্ধমাদন পর্বেই রয়ে গেছে আর বিদেশ থেকে আনছে নানা ধরণের ক্যারদানি । একই ন্যারেটিভ কন্ঠস্বর প্রয়োগ করে তিনি বাস্তব এবং জাদুর মাঝে পর্যয়ানুবৃত্তি ঘটিয়েছেন, কিন্তু দুটির মাঝের পালাবদলকে এমনভাবে ন্যারেটিভে বুনে দিয়েছেন যে বোঝার উপায় নেই কোনটা বাস্তব আর কোনটা অবাস্তব। ফলে বাস্তব আর ইন্দ্রজালের বাইরে একটা তৃতীয় জঁর তৈরি করতে পেরেছেন, যেকারণে পোস্টস্ট্রাকচারালিস্ট তত্ত্বের মাধ্যমে বলা চলে যে তাঁর ন্যারেটিভের একাধিক ব্যাখ্যা হতে পারে । পর্যায়ানুবৃত্তির কারণে একটিমাত্র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কন্ঠস্বরকে প্রতিরোধ করে পাঠবস্তুগুলো । তাঁর ন্যারেটিভের কেতাটি সীমাগুলোকে অনুসন্ধানের পর লঙ্ঘন করে, সে সীমা রাজনৈতিক হোক বা ভৌগলিক হোক বা তাত্ত্বিক হোক বা বস্তুবর্গীয় হোক । সীমাগুলোকে ভেঙে তিনি উত্তরঔপনিবেশিক ভারতের সমাজ, গণতন্ত্র, ধর্মদ্বেষ, সন্ত্রাস, জাতিপ্রথা, দারিদ্র, দলীয় রাজনীতি, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ইত্যাদির সত্যগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন । পাঠকের মনে সন্দেহ চাগিয়ে তোলেন যে বাস্তবের বৈশিষ্ট্য যদি চূড়ান্ত না হয় তাহলে সত্য সম্পর্কে যাবতীয় অনুমানই ঝুঁকিআক্রান্ত। ক্ষমতা থেকে যাদের বঞ্চিত করা হয়েছে সেই ‘অপরদের’ বাকজগতকে প্রয়োগ করতে হয়েছে তাঁকে । ঔপনিবেশিক ও উত্তরঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রকরা, এদেশে হোক বা বিদেশে, ‘অপর’ সংস্কৃতিকে দাবিয়ে রেখে যে অবাস্তবতা সৃষ্টি করেছে, জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে তিনি তা উপস্হাপন করেছেন তাঁর ফিকশানগুলোয়।
১৯৯৯ সালে লেখা “খননকার্য” গল্পে কথকের মাসিমার শাবল হারিয়ে দিয়েছেন কোনো কবিবন্ধু কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে । শাবল দিয়ে একজন কবি কেঁচো খুড়ছেন, কেন, তাঁর কেঁচো কেন দরকার, কথক সেকথা পরে জানিয়েছেন যে খোঁড়াখুঁড়ি কবিদের কাজ, অর্থাৎ এক ধরণের কবি কেঁচোর সন্ধান করে পুরস্কৃত হন । কথক কবিবন্ধু সম্পর্কে তাঁর খোঁচাটি লুকোননি, স্ত্রীকে বলছেন :
‘তা বড়ো বড়ো নামকরা কবিবন্ধু থাকলে ওসব একটুআধটু হবে, দাড়িওয়ালা ভক্তিপ্রসাদকে তো বহুবার দেখেছ, একটু বেশি মদ খেতে ভালোবাসে, একবার বাড়ি এলে সহজে যেতে চায় না, সাহিত্য অকাদেমি আনন্দ পুরস্কার, অনেক সব প্রাইজ পেয়েছে, তুমি তো আগে দেখেছ, আর ওই ঝাঁকড়াচুল জ্ঞানপীঠ পেয়েছেন পদ্যলেখার সবচেয়ে বড়ো প্রাইজ, খুব অসাধারণ সব লোক, একটু আধটু হুঁশ কম থাকে, কবি হলে ওসব হয়, অতশত তুমি বুঝবে না, পদ্য লিখলে বুঝতে, ব্যাপারই আলাদা । ওরা সব একধরনের অমর মানুষ ।’
মাসিমার লোহার শাবলের বদলে ভালো স্টেনলেস স্টিলের শাবল কিনে এনে দেবার পর মাসিমা জানান যে পুরোনো শাবলটা ওঁর শশুরমশায়ের, ওঁর স্মৃতির, বাড়ি তৈরির সময়ের অনেক গল্প আছে পুরোনো শাবলে, নতুন শাবল তা যত ভালোই হোক মাসিমার চাই না, পুরোনো শাবলের সঙ্গে তাঁর জীবনের গল্পও হারিয়ে গেল । অর্থাৎ অন্যের পারিবারিক ঐতিহ্য সম্পর্কে কবিরা আগ্রহী নন, তাঁরা কেবল পদ্য লিখে প্রাইজ পেতে চান এবং ‘একধরনের অমর মানুষ’ হতে চান ।
১৯৯৩ সালে লেখা “টিনিদির হাত” গল্পে দাদা শৈশবের হুলাসচাচার ‘রামচরিতমানস’-এর প্রশ্নাবলীর খেলাকে এনেছেন এবং ন্যারেটিভে সংযোজন করেছেন বিভিন্ন মাত্রা, প্রেমের, হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব, ছোটোলোক-ভদ্রলোক বিভাজন এবং ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাসের গুরুত্ব, যা ঔপনিবেশিক চাপ সত্ত্বেও নিম্নবর্গের মানুষের জীবনে টিকেছিল । হুলাসচাচার ‘রমাচরিতমানস’ খেলায় একটি শলাকা দিয়ে বইতে নির্দেশ করলে হুলাসচাচা নির্দিষ্ট চৌপাই ব্যাখা করে ভবিষ্যত বলে দেন । বালক কথকের প্রতিটি ইচ্ছে পূরণ হয়েছে শুনে তার বন্ধ সুলেমানও খেলতে আসে, মনস্কামনা পূর্ণ হয় কিন্তু তার গাছে চাকা-চাকা ঘা দেখা দেয় । কথকের হিন্দু পরিবার মনে করে গোরুর মাংস খাবার কারণে হয়েছে ; সুলেমান মনে করা হিন্দুর গ্রন্হের খেলা খেলার জন্য হয়েছে । কথকের বাবা ঘায়ের ওষুধ দেন যা কথক ভুলিয়ে খাওয়ায় সুলেমানকে, খুদাবক্স ডাক্তারও ওষুধ দেন, আনোয়ারের দোকানে গিয়ে গোরুর মাংস খায় সুলেমান, টিনিদি আদর করে হাত বুলিয়ে দেন সুলেমানের মাথায় । সুলেমানের অসুখ সেরে যায় । বালক কথকের মনে সন্দেহ জেগে ওঠে যে এইগুলোর মধ্যে ঠিক কোন কারণে সেরে গেল সুলেমানের অসুখ ।
“টিনিদির হাত” গল্পটিতে জাদুবাস্তবতা হল ‘রামচরিতমানস’ এর রামশলাকা খেলা আর হুলাসচাচার ভবিষ্যৎবাণী প্রত্যেকের ক্ষেত্রে অব্যর্থ হওয়া । গল্পটির মাধ্যমে দাদা দৈব ঘটনাকে বাস্তবের রূপ দিয়েছেন, প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে উদ্ভাবনাকে গুলিয়ে দিয়েছেন, যার দরুন চাপ সৃষ্টি করেছেন বাস্তব সম্পর্কিত ধারনায় । ইউরোপের আনা বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর ‘আলোকপ্রাপ্তির’ আঠারো শতকী প্রভূত্ববাদী সংস্কৃতির চাপকে আক্রমণ করেছেন সনাতন ভারতীয় সাংস্কৃতিক আচরণের মাধ্যমে । আলোকপ্রাপ্তির ঔপনিবেশিক চাপ অনুগত করতে চেয়েছিল কেবলমাত্র বিজ্ঞান ও যুক্তির দ্বারা, যখন কিনা সাধারণ ভারতীয়রা যেযার সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের নিজস্ব সত্যকে বাতিল করতে চায়নি । ‘অপর’-এর দৃষ্টিতে দেখলে, যেটা দাদা তুলে ধরতে চেয়েছেন এই গল্পে, যুক্তিহীনতাও জীবনের বহু ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারে, এবং বাখতিনের বক্তব্য ধার নিয়ে বলা যায় এক্ষেত্রে দেখা দেয় হেটেরোগ্লসিয়া বা বহু পরস্পরবিরোধী কন্ঠস্বর, ভারতের চিন্তাভাবনার সাস্কৃতিক বহুত্ব, নানাধর্মিতা, পারস্পরিক বৈভিন্ন্যকে ফিকশনটি আলোকিত করে ।
হাংরি আন্দোলনের আগে এবং হাংরি আন্দোলনের সময়ে দাদার যে তিনটি কাব্যগ্রন্হ বেরিয়েছিল, সেগুলো নিয়ে দাদাকে একটা বই বের করতে বলেছিলুম, কিন্তু বইগুলো উনি নিজের কাছে রাখেননি, কারোর কাছ থেকে সংগ্রহ করতেও পারেননি । বইগুলো হল “ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি”, “জানোয়ার” এবং “আমার ভিয়েৎনাম”। আমি কৃত্তিবাস সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে দাদার কয়েকটা কবিতা তুলে দিচ্ছি যা থেকে স্পষ্ট হবে যে কৃত্তিবাসের লিরিকাল ধারা থেকে কীভাবে উনি ধাপে-ধাপে বেরিয়ে গেলেন ।
“ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি” পর্বের কবিতা ( দাদার মেয়ের নাম হণি, সেই সময়ের কবিতা ) কৃত্তিবাস পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল :
হণির ভিতর দিয়ে দেখা যায়
জাহান্নমে যাক গ্রহনক্ষত্রসমূহ ভেঙে পৃথিবীও যাক জাহান্নমে
লাথি মেরে সব ভেঙে চুরমার করে দিলে, কাল আমি সহাস্যবদনে
হাততালি দিয়ে মঞ্চে কোনোরূপ গ্লানিহীন নুরেমবার্গের আদালতে
তুড়ি মেরে কাঠগড়া মুঠোয় গুঁড়িয়ে তোমাদেরও পারতাম ভেলকি সুবিস্তারে ।
সৌরমণ্ডলের পথে তছনছ পৃথিবীর অন্ধকার ফেরি আবর্তন
কোনোরূপ রেখাপাত সম্ভব ছিল না গ্রন্হে হৃদয়ে মেধায়,
আমার শরীর ঘিরে ইহুদির হিন্দু শিখ মুসলিমের আততায়ী আদর্শের
ঘৃণ্য রক্তপাত--
আমাকেও জয়োল্লাস দিয়েছিল মূত্রপাতে পোষা রাজনীতি ।
তোমাদের আস্ফালনে বিনয়ী মুখোশ ঘিরে আমার হণির জন্মদিন
আমারই মুখোশ ধরে টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে আর্ত চিৎকারে--
ধান উৎপন্ন হওয়ার গন্ধ এখন পেয়েছি শুঁকে কৃষকের উর্বর শরীরে
কুমারী মহিলাদের উজ্জ্বল মসৃণ দেহে বহুবার হাত রেখে উত্তরনিশীথে
পরাগ চমকে ওঠে, স্পর্শ করে নারীর সমগ্র দেহ জুড়ে
আশ্রয় ছড়ানো আছে প্রীত এক ধরণের মিহি রুখু বালি ।
ক্রমে এই সমস্তই নাভির ভিতরে আনে রুদ্ধ আলোড়ন,
জেগে ওঠে মৃগনাভি, চেয়ারে টেবিলে গ্রন্হে অম্লান মাঠের ভিতরে
ধু-ধু রিক্ত প্রান্তরের দিকে শাবক প্রসব করে রঙিন প্রপাত,
চারিদিকে ফলপ্রসূ হয়ে গেছে রাশিরাশি প্রতিহারি ধান---
#
মনে হয় বহুক্ষণ মাঠে মাঠে গড়াগড়ি দিয়ে বিছানায় উঠে আসে নারী
ক্ষুধার্ত শিকড়গুলি ঢুকে যায় নীড় আস্বাদনে,
তখনই উৎপন্ন হওয়ার গন্ধ জাগে, কৃষকের উর্বর শরীরে
প্লুত আবছা আঁধারে তাই বারবার মনে হয় পৃথিবীর সহজ সুদিন
ফিরে এলো সুধাশান্তি
আমার হণির জন্য তোমাদের কাছে আমি ঋনী চিরদিন ।
এই কবিতাগুলো কৃত্তিবাস পত্রিকার কুড়ি নং সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল :-
ব্যক্তিগত ন্যাপথালিন
বাক্স খুললেই ভবঘুরে সুখ
ন্যাপথলিন তীব্র ন্যাপথলিন
ন্যাপথলিনের গন্ধে সংসার উন্মুখ
নিজস্ব ডেটল
ছুটে আসে হাসপাতাল অতিউগ্র তরল শেফালি
বুকে রাখা কোতোয়াল ভেদ করে তীব্র অশ্রুপাত
স্পর্শ করে লুকানো ডুমুর ।
হনির মুখশ্রীছবি আমাদের আবহাওয়া রিপোর্ট
আমাদের বুঁদ জলবায়ু
জারি রাখি উচ্ছন্ন মেয়াদ মৃত্যু বেহুঁশ টম্যাটো ।
ক্রমশ হারিয়ে যায় আমার একান্তপ্রিয়
টম্যাটোর লাল
ছুটে আসে হাসপাতাল, অতিউগ্র তরল শেফালি
ছুটে আসে তিন লক্ষ উন্মাদ কুকুর
নধর পালংশাক রেগে ওঠে হঠাৎ খুরপি লাগে বুকে--
মনে হয় বেশ আছি ছেলেপুলে নিয়ে সুখে ।
মৃতমন্ত্রীবিষয়ক নিধি
আমিও শকুন হয়ে দেখতে চাই না আর নানাবিধ মড়া
টক মিষ্টি ঝাল
ওরা সব ছিল কাল
আজ উঠে গেছে ঝাঁজ
হঠাৎ পথের মোড়ে পুলিশের পক্ষে ওই মৃত বৃদ্ধ রেখে
কিসের সুরাহা হবে ট্যাক্সিঅলা জানে
এই অবসরে আমি চলে যেতে চাই কোনো আবছা আকাশে
ঠুকরে দেখতে চাই টাটকা বিনোবা কতখানি ভেপসে উঠেছে ভেতরে
ঝ্যান্ত মানুষ ঠুকরে
দ্যাখা যায় গোপনীয় লাশ
দ্যাখা যায় বাগানের লুকানো পলাশ
এসোনা ঠুকরে দেখি তোমার প্রতিভা ।
হাংরি আন্দোলনের সময়ে প্রকাশিত হয় দাদার কাব্যগ্রন্হ “জানোয়ার”, টের পাওয়া যায় কেন তিনি কৃত্তিবাসের কোটর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, কৃত্তিবাসের লিরিকাল জগত থেকে উত্তরঔপনিবেশিক বাস্তবতায় আক্রান্ত হয়েছিল তার সংবেদ, তা “রবীন্দ্রনাথ” শীর্ষক এই কবিতাটিতে স্পষ্ট :-
১.
ঈশ্বরকে চিনে নেওয়ার জন্য আর আমার বেলপাতার দরকার নেই
কবিতাকে চিনে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন নেই ‘মতো’ আর ‘যেন’র
জন্মভূমি স্বদেশ মাতৃভূমি চিনে নেওয়ার জন্য
দেশবাসীর এখন মানচিত্রের প্রয়োজন
সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য চিনে নেওয়ার জন্য
সমাজের দরকার পোশাক-পরিচ্ছদ
নির্ধারিত উর্দি ভাগাভাগি করে গা্য়ে চড়িয়ে মানুষ
অভিনেতা পুলিশ শুশ্রুষাকারী উকিল বিচারক আর নেতা হয়ে উঠছে
আমি কলতলায় ন্যাংটো স্নান করে দেখে নিচ্ছি আমার গোপন পবিত্রতা
শান্তি আর শৃঙ্খলার জন্য মানুষকে হত্যা করা প্রয়োজন
স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের জন্য কাঁদুনে গ্যাসের দরকার
আদর্শ আর ক্ষমতার জন্য প্রয়োজন যুদ্ধ আর শান্তির শর্তাবলী
যে-কোনো ধারণার চেয়ে মানুষ আজ খাটো হয়ে পড়ছে
২.
শিল্প ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
দেশ ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
ধর্ম ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
ভাষা ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
সৌন্দর্য ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
সংস্কৃতি ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
ঐতিহ্য ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বপৃথিবী ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
সেই রবীন্দ্রনাথের জন্মমৃত্যুর পরেও তার সোনার বাংলা ভাগ হয়ে গেছে
সেই রবীন্দ্রনাথের জন্মমৃত্যুর পরেও তারই গান গেয়ে
একদল মানুষ আরেকদল মানুষকে খুন করছে
৩.
কংগ্রেস আর মুস্লিম লিগের ক্ষমতার চেয়ে
ধর্মান্ধ রাজনীতির বিশাল দাপটের চেয়ে
রবীন্দ্রনাথের ক্ষমতা অনেক অনেক কম
নজরুলকে মাসোহারা দিয়ে বিধানসভা চক্ষুলজ্জা ঢাকছে
দশ হাজার শান্তিনিকেতন খুলে রেখে পৃথিবীকে শান্ত রাখা সম্ভব নয়
দশ কোটি শান্তিনিকেতন খুলে রাখলেও
রাজনীতির হিংস্র বর্বরতা থামানো অসম্ভব
পঁচিশে বৈশাখ থেকে বাইশে শ্রাবণ অব্দি ছুটে গিয়ে দেখেছি
পৃথিবীর কিছুই সুরাহা হয়নি
মানুষকে ভালো করে তোলা আমার সাধ্যাতীত
বহুদূর পথ হেঁটে গিয়ে আমি পুনরায় ফিরে যাচ্ছি
আমারই অশ্লীল নিভৃত কোটরে ।
“জানোয়ার” এর পর প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কাব্যগ্রন্হ “আমার ভিয়েৎনাম” । এখানে যে কবিতাটি তুলে দিচ্ছি, “পালামৌ -- ১৯৬৬”, তা “আমার ভিয়েৎনাম” পর্বের। কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্য দাদা লেখা পাঠাচ্ছেন না দেখে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দাদার কর্মস্হল ডালটনগঞ্জে গিয়েছিলেন কবিতা আনার জন্য । দাদা কবিতা লিখে দিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে জিপে করে দেহরি অন শোন স্টেশানে ছেড়ে দিয়ে আসেন । দাদা ইচ্ছাকৃতভাবে হাংরি আন্দোলনকারীরা সেসময়ে যে ধরণের কবিতা লিখছিলেন, যা ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, আমার আর সুবিমল বসাকের কবিতা পড়লে স্পষ্ট হবে, সেই ফর্মেই সামাজিক-রাজনৈতিক কবিতাটি দিয়েছিলেন ।
পালামৌ -- ১৯৬৬
পাঁচ হাজার কেঁচোর সঙ্গে মাটি খুঁড়ে ভেবেছিলাম
ঘুম ভেঙে উঠে দেখব সবুজ বিশাল ভারতবর্ষ
হঠাৎ সঞ্জীবচন্দ্র ডেকে উঠবেন সমীর পালামৌ সমীর
অথচ ভোটবাক্স নিয়ে আমি খুঁজে বেড়ালাম ভারতবর্ষের ভালোবাসা
আমার গোপন তকমার লোভে কৃষকের লাঙল থেকে
খুঁটে তুললাম প্রভূত ন্যাপথলিন
কেননা পৃথিবীর সবচেয়ে নগ্ন আর মজবুত স্ত্রীলোকের নাম ভিয়েৎনাম
এখন স্রেফ পাঁচ বস্তা চাল কিনে রেখে
আমি দুর্ভিক্ষের দায়দায়িত্ব সেরে নিচ্ছি
কয়েকটা ব্যাপারে কেবল মহিলার আধিপত্য সহ্য হচ্ছে না
আত্তিলার রক্তেও ছিল না একশো ভাগ নিরেট পৌরুষ
বুঝতে পারছি না কেন আমার গর্ভধারণের ইচ্ছে হয়
কেন আমার মসৃণ বুকে হাত রেখে মাঝরাতে হঠাৎ ককিয়ে উঠেছি
আমারই যৌনতার মধ্যে খুঁজে দেখেছি নিজস্ব গোলাবাড়ি একান্ত বীজধান
আমারই বীর্য থেকে স্রেফ আমারই শরীরে প্রসব চেয়েছি আমি
অথচ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অভাবে মহিলাকে দিয়ে এলাম প্রেম আর কোকাকোলা
ঠিক এই কারণেই কোথায় কতখানি সমীর পরখ করতে
এক মহিলা থেকে ঘুরে বেড়ালাম অন্য শরীরের আনাচে কানাচে
আমার বাঁ-চোখ থেকে খুঁটে তুললাম তিনশো জোনাকির হঠাৎ জ্বলে ওঠা
গোলাপের চতুর্দিকে নিয়ন্ত্রিত কীটের উদ্বেগ অভিযান লক্ষ্য করে
আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার বিবেকের তলপেট
নিজের তৈরি বাস্তবিকতার সঙ্গে
পৃথিবীর বাস্তবিকতা মিলিয়ে দেখতে গিয়ে
আমি টের পেলাম আমার ব্যক্তিগত ছাপাখানা
কেননা প্রত্যেকবার একটা চৌরাস্তার কাছ-বরাবর এসে
আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে যাচ্ছি
বাম আর দক্ষিণ কমিউনিস্টদের খেল কসরৎ ঈর্ষা দেখতে
মার্কসের জরায়ু থেকে বের করে আনছি তিন লক্ষ সমীর
ভোরে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে কামরাজ পাতিল যেমন চোখে পড়া মাত্র
আমার মুখ তেতো হয়ে উঠছে
স্বপ্নের প্রথম শর্ত
মনে করো জেগে আছো তুমি
শব্দ আর শব্দ বিনিময়ে কবিতার ধর্ম হয়ে ওঠে
শপথের চেয়ে ঘৃণ্য কোনো পাপ নেই
প্রতিটি গলির মোড়ে অন্য এক প্রতিজ্ঞায় রুখে
এখন সাপের খেলা
ভ্রূ-আঁকা পেন্সিলে আমি মহিলার চোখের পাতায় লিখছি অশ্লীলতা, নার্সারি রাইম ।
কলকাতার বাঁশদ্রোণীতে পাকাপাকি আসার পর প্রায় দেড় দশক পর দাদা যখন লেখালিখি এবং ‘হাওয়া ৪৯’ পত্রিকার সম্পাদনা আরম্ভ করলেন তখন তাঁর কবিতাভাবনায় এবং কবিতা রচনায় বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে । তার প্রধান কারণ সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের সমাজের রাজনীতির সংস্কৃতির যে নতুন রূপের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, তার সঙ্গে তাঁর কলেজ জীবনের অভিজ্ঞতার দুস্তর ফারাক অনুধাবন করতে পারলেন, প্রত্যক্ষ্য করতে পারলেন নবোদ্ভূত কেয়সকে, দেখলেন তার কেন্দ্রটি নিশ্চিহ্ণ । ফলত তাঁর কবিতায় কোনো ডমিন্যান্ট শৈলীর প্রভাব পড়ল না, কেননা কবিতার ক্র্যাফ্টকেই তুলে আনলেন কবিতার শরীরে ; তিনি ছবির সঙ্গে ন্যারেটিভকে এবং দার্শনিক বিবেচনা, প্রতিবর্তী ক্রিয়া, মুক্ত-সমাপ্ত পরস্পরবিরোধিতা, বুদ্ধিগত সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, একই সঙ্গে একাধিক ঘটনা, দৃষ্টিভঙ্গীর পর্যায়ান্বন, প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তর, অসঙ্গতি, অপ্রত্যাশিত বাঁক, অর্থান্তর সৃষ্টিকারী ও আপাতবিচ্ছিন্ন চিন্তাপ্রবাহ মিশিয়ে দিতে লাগলেন । অনেক কবিতায় শৈলীটিকে ভঙ্গুর করে ফেলে তাকে ডায়েরির রূপ দিলেন । তাঁর কবিতাভাবনা পশ্চিমবঙ্গের তরুণদের মাঝে জলবিভাজকের কাজ করল ; একদিকে পরম্পরাবাদীরা এবং অন্যদিকে তাঁরা, যাঁরা কবিতার ক্র্যাফ্টকে কবিতারচনার প্রধান আগ্রহ করে তুললেন । কবিতায় “বিষয়”-এর মৃত্যু ঘোষণা করলেন, বললেন যে শিরোনাম হল কবিতার ‘রুবরিক’, তা কবিতাবিশেষের টাইটেল হোলডার নয় । প্রাগাধুনিক-প্রাকঔপনিবেশিক কবিতার মতন পরিসর তাঁর কবিতায় হয়ে উঠল শব্দমূল ও ধাতুকাঠামো সংক্রান্ত আগ্রহ । পাশাপাশি, যেমন তাঁর ছোটোগল্পে, তেমনই কবিতায় উঠে এলো বহুজাতিকতা ও ক্রনি পুঁজিবাদের দরুণ প্রভাবিত মানুষের অবদমন. মনোভঙ্গ, বিষণ্ণতা ; ব্যক্তিএককের বেদখল হয়ে যাওয়া চেতনা, পরিবেশ ও সংসার ।
“জীবনানন্দ : সূর্য ও তপতী” প্রবন্ধে দাদা লিখেছিলেন, “কবিতার লক্ষ্য অনুভূতিদেশ । অনুভূতির গভীরে আছে আদি স্বাগতম । আছে সর্বভূতেষু জাগরণস্পৃহা । অহং ব্রহ্মাস্মি চেতনার অপেক্ষমাণ বুদবুদ । কবি সে আসঙ্গ-যুক্ততার কাতরতাকে উসকে দেন । শব্দ যোজনার সেই কালিক চেতনাকে অতিক্রমণ কবির লক্ষ্য । ঈষৎ অনন্যসাধারণ উত্তরসমাজকে ত্বরান্বিত ত্বরান্বিত ও আরো বেগবান করে তোলার তিনি চেতনার অভিমুখের মশালবাহক । সমাজ যত বেশি একলষেঁড়ে হয়ে পড়ে, একলপ্ততার প্রয়োজন তত বাড়ে । বহুরৈখিকতা, ময়ূরপঙ্খী বর্ণময়তা সেখান থেকে মুক্তি দেয় ।”
তাঁর শেষ পর্বের কয়েকটি কবিতা এখানে তুলে দিই ।
এই কবিতা দাঁড়াতে চায় না
কিছু কিছু শব্দের সকাল হয়ে আসছে
কিছু কিছু শব্দের রিপেয়ারিং চাই দরকার জোড়া লাগানো
কার সঙ্গে কিসের জোড়া সে-কথা পেয়ারিং শব্দের মধ্যেই আছে
প্রয়োজন প্যার মহব্বত পিরিত পেয়ার
পুরুষ প্রকৃতির তত্ত্বকথা না শোনালেও চলবে
ছন্দ
প্রত্যেক শব্দের মধ্যে কিছু শব্দ পাশ ফিরে থাকে
প্রত্যেক শব্দের মধ্যে কিছু অক্ষর থেকে যায় স্বল্প উচ্চারণে
কিছু উপসর্গ প্রত্যেক ধাতুর সম্পর্কে থেকে যায় অর্থবিহীন
বুঝ আর অবুঝের মধ্যে বোঝাপড়া রাখে কার্যসাধিকা
নীলুদের সংসারে ছোটমাসি মুখ বুজে কাজ করে যায়---
জটিলতার কাছে সোপর্দ রয়েছে
গতির অরৈখিক নকশা
অংশ-প্রীতি, ঘুম
যেভাবে বিশৃঙ্খলা ছন্দের মুখোশ ।
নিজস্ব রোদের জন্য
নতুন বাড়িটিতে যেদিন প্রথম বিকেলের রোদ এসে
জীবনের খোঁজ নিয়েছিল সেদিন থেকেই এবাড়ির নিজস্ব রোদ
নিজস্ব হাওয়া বাতাস নিজস্ব মেঘলার জন্ম
সবকিছু যা একান্তই এবাড়ির
যেভাবে কিছু রোদ কিছু বৃষ্টি নিয়ে বেঁচে থাকা সংসার পাতে
যেভাবে স্হানিকতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায় মহাভাষ্য থেকে
যেভাবে ব্যক্তিগত রোদের কাতরতা নিয়ে একসময়
পশ্চিমের বারান্দায় অতসীলতাকে বাঁক নিতে দেখেছিলাম
দেখেছিলাম রোদের জন্য ঠাকুমার হাপিত্যেশ
এখনও মনে পড়ে যায় দ্বারভাঙ্গায় আমাদের ডাইনিং টেবিলে
চা পানের সঙ্গী এক চিলতে রোদ্দুর
স্কুলের ছুটির ঘণ্টার সঙ্গে চলে যাওয়া রোদের অন্য এক সম্পর্ক ছিল
যেমন কিছি কিছু ছায়ার সঙ্গে আমাদের নিভৃতের যোগাযোগ
যেভাবে কিছু রোদ কিছু ছায়া ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে জমা পড়ে
যেভাবে স্হানিকতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায় মহাভাষ্য থেকে ।
আয়নাঘর
ঘুম ভেঙে আয়নায় দেখি বাবার তিনকাল পেরোনো মুখ
রাতে খুলে রাখা দাঁতের ডিবে খুঁজছে...
ইসেবগোল খেয়ে ঘুমিয়ে ওঠা লোকটার শুকনো গলায় তেষ্টা…
কোঁচকানো গালে ছ-দিনের দাড়ি, ভুরুর বাড়ন্ত চুল চোখ ঢাকছে…
ফিটকিরির গুঁড়ো দিয়ে ঢিমেতাল মাড়ি শেষ যত্নে ধুয়ে নিচ্ছে…
সাদা পাথায় তিনটে কালো চুল দেখে নির্বিকার ফোগলা শূন্য হাসছে…
খুলে রাখা নাক কান চোখ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাঁর দলিলে নেই
বর্ণমালার ক্ষয়িষ্ণু অমৃতকণা ড্যাখে পরস্পর বর্ণগুলি মৌলকণা
করোগেটেড কপালের বলিরেখায় কেওসের চিহ্ণ…
ক’দিন বাদেই আসবে ডেটল না-রাখা টিনের কাঁচি চিরুনি…
ইমলিতলার ভ্যানওয়ালা লটারি পাওয়ার গল্প শুনিয়ে যাবে…
এমনই অনেক অনুভব ভব হয়ে উঠছে আয়নায় দেখা মুখের ভাঁজে…
পেছন ফিরে দেখি চিরযৌবন আর কবিতার খাতা নিয়ে সমীর--
শেফালির সঙ্গে বকখালিতে আজ ডেটিং
পরস্পরের ভূপ্রকৃতি বাস্তুতন্ত্র গিরিখাত আগ্নেয়মুখ চিনে নিতে এখনও বাকি…
কবিতার খাতা শেষ পাতায় লিখে রাখা ইজা
আয়নাঘরে পেছনের আয়নায় বাবা পিতামহের মুখ দেখছে…
প্রপিতামহ দেখছে প্রপৌত্রের মুখ
পাঁচ রাউণ্ডের শেষে শেষ ডিফেন্সে আমি গোলপোস্টে একা
নিশ্চিত গোল বাঁচিয়ে বিপক্ষের কর্ণার কিকের মুখোমুখি
গোলার সামনে দুই জার্সি জটলায় পজিশন নিচ্ছে
হেড-বেহেডে মাথার ওপর বল ঘুরছে ফিরছে
পক্ষ বিপক্ষ বুঝে উঠতে হিমসিম খাচ্ছি
ভয় এবার যদি পেনাক্টিকিকের হুইসল বাজে
আয়নাঘরের মাঠে…
[ রচনাকাল : জুলাই ২০১৬ ]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন