মলয় রায়চৌধুরীর প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং ক্ষমতায়নের কবিতা
শংকর সেন
মলয় রায়চৌধুরী কেবল প্রেমের কবি নন । তিনি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ক্ষমতায়নের কবিতা লিখেছেন ষাটের দশক থেকে । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করার পূর্বে তিনি লিখেছিলেন ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ নামক গ্রন্হ এবং অনুমান করেছিলেন যে সোভিয়েত দেশ ভেতর থেকে ভেঙে পড়তে পারে । সেই সময়ে একটি প্রবন্ধে মলয় রায়চৌধুরী বলেছিলেন যে কবিতা রচনা সেই দিন থেকে আরম্ভ হয়েছিল যেদিন প্রথম গুহাবাসী একটা পাথর তুলে নিয়েছিল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জন্য । হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ও ধর্মবিষয়ক ইশতাহার উত্তরঔপনিবেশিক সমাজকর্তাদের সরাসরি আক্রমণ করেছিল । মনে রাখা দরকার যে মলয় রায়চৌধুরী লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটোকাগজের মঞ্চ থেকে যাত্রা আরম্ভ করেননি । তিনি একটি অভূতপূর্ব পথ নিয়েছিলেন এবং তা হল ফালি কাগজের লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করা । ফলত কাউকে স্টলে গিয়ে পত্রিকা কিনতে হয়নি । পাঠকের কাছে ফ্রি বিলি করা ফালি কাগজ, যাকে বলা হতো বুলেটিন, তা হাতে-হাতে বুদ্ধিজীবীদের কাছে পৌঁছে যেতো । ১৯৬১ সালে আরম্ভ করা হাংরি আন্দোলনের বুলেটিনের আকর্ষণ ছিল অমোঘ এবং ত্রিশ-চল্লিশজন কবি, লেখক, শিল্পী তাঁর আন্দোলনে যোগদান করেন ।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার আওয়াজ মলয়ই প্রথম তোলেন বাংলার সংস্কৃতিতে । প্রতিষ্ঠান বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্বাস হল এমন একটি যা সমাজের প্রচলিত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নীতির বিরোধিতা করে এবং সামগ্রিক মানুষের শুভবোধের কথা বলে । মলয়ের তোলা আওয়াজের বহু পরে অন্যান্য দেশে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন চোখে পড়ে । যেমন প্যারিসের ছাত্র আন্দোলন । যেমন ২০১১ সালে, কঠোরতা বিরোধী বিক্ষোভের উত্থানের সাথে, আরব বসন্ত, আরম্ভ হয়েছিল এবং 'অ্যানোনিমাস'-এর মতো অনলাইন অ্যাক্টিভিজম এবং 'অকুপাই' বিক্ষোভের আবির্ভাব ক্ষমতাবানদের লক্ষ্য করে গর্জে ওঠে । ‘ভি ফর ভেন্ডেটা’ ফিল্ম দ্বারা বিখ্যাত গাই ফকস মুখোশটি প্রতিষ্ঠা বিরোধী প্রতিবাদ গোষ্ঠীর প্রতীক হয়ে উঠেছে।
২০০১ সালে ‘হাওয়া-৪৯’ পত্রিকায় উৎপলকুমার বসু মলয়ের প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্হান সম্পর্কে লিখেছিলেন “মলয় রায়চৌধুরী এখনকার বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট নাম । তিনি ছয়ের দশকে লিখতে শুরু করেন এবং এখনও লিখছেন । তাঁর কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, ইস্তাহার ও Polemics এর সমগ্র সংগ্রহ প্রকাশিত হলে একটি প্রয়োজনীয় কাজ হবে বলে আমার ধারণা । তিনি সাহিত্যিক নন । অর্থাৎ ‘সাহিত্যের সেবক’ বললে আমাদের স্মরণে যে-ছবিটি ভেসে ওঠে, তাঁকে সেই শ্রেণিতে ফেলা যাবে না । বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে যতটা না পূজিত হয়েছে — আক্রান্ত হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি । গত চল্লিশ বছরে, বাংলা সাহিত্যের রণক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তা লিপিবদ্ধ করার যোগ্যতা বা ধৈর্য আমার নেই । তবে, সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে মলয় রায়চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই যুদ্ধে নেমেছিলেন । তাঁর তাত্বিক প্রস্তুতি ছিল । এবং তথাকথিত বাংলা ‘সংস্কৃতি’-র ঘরে তাঁর লালন পালন নয় বলে ওই কালচারের পীঠভূমিগুলিকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন । বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ । তাঁকে পিছনে ফেলে এগিয়ে না-গেলে পরবর্তী একটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । জীবনানন্দ কয়েকটি উপাদানকে অবলম্বন করেছিলেন । যেমন অভিনব ইমেজ বা চিত্রকল্পের ব্যবহার, মহাজাগতিক সচেতনতা, মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা এবং সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি গৌণ বিষয় । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতেখড়ি হয়েছিল । কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের অন্য ধরণের পথসন্ধান শুরু হয় । বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণাত্মক প্রবণতা লক্ষ্য করি । কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন — ‘লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে ?’
কবিতা যে কতো ক্ষমতা ধরে তা অনুধাবন করা যায় হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে । কবিদের দলটিকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কোমরে দড়ি বেঁধে চোর-ডাকাতের সঙ্গে পথে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, লকাপে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে পঁয়ত্রিশ মাসব্যাপী মামলা চালানো হয়েছিল । এই মামলায় এগারোজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ছয় জন ; কিন্তু সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করে সরকার । এ থেকেই স্পষ্ট যে মলয় রায়চৌধুরীকেই প্রতিবাদী ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী হিসাবে চিহ্ণিত করেছিল তদানীন্তন বঙ্গসমাজ ।
১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটির জন্য মলয় অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন এবং ৩৫ মাসব্যাপী কোর্ট কেস চলে । কলকাতার নিম্ন আদালতে সাজা ঘোষণা হলেও, ১৯৬৭ সালে উচ্চ আদালতে অভিযোগমুক্ত হন । মলয়ের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিত দত্ত । মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, পবিত্র বল্লভ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসু ।
মকদ্দমা চলাকালীন মলয়ের খ্যাতি আমেরিকা ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে, এবং বিভিন্ন ভাষায় এই কবিতাটি অনুদিত হয় । ৪৫ বছর পরও কবিতাটি নিয়ে বিতর্ক কবিতাটিকে জীবন্ত রেখেছে, এবং এম ফিল ও পি এইচ ডি গবেষণার বিষয়বস্তু হয়েছে । গবেষণা করেছেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক কুমারবিষ্ণু দে ও রবীন্দ্রভারতী থেকে অধ্যাপিকা স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায় । ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত 'Modern And Postmodern Poetry Of The Millenium' সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে অন্তর্ভুক্ত এইটিই একমাত্র কবিতা বলে ভূমিকায় জানিয়েছেন সম্পাদক জেরোম রোদেনবার্গ। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে The Hungryalists নামে ২০১৮ সালে একটি বই লিখেছেন মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী । মলয় রায়চৌধুরীর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটিকে অধ্যাপক শীতল চৌধুরী বলেছেন এটি বাংলা সাহিত্যে একটি সার্থক ও গুরুত্বপূর্ণ কবিতা।
কবিতা রচনার আরম্ভ থেকে বইপোকা মলয়ের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, প্রতিবাদী কবিতা হল কবিতার যে কোনও রূপ যার অন্যতম প্রধান কাজ, কিছু বিদ্যমান বর্তমান ঘটনা বা পরিস্থিতিতে ত্রুটি খুঁজে বের করা। এই ধরনের কবিতা প্রায়শই একটি সরকার কর্তৃক জনগণের উপর আরোপিত অপকর্মের উপর আলোকপাত করে। এটি যুদ্ধ বা জাতিপ্রথা, ধর্মান্ধতার মতো ভয়ানক সামাজিক অসুস্থতার প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। প্রতিবাদী কবিতার সবচেয়ে কার্যকরী রূপগুলো এমন সব গুণাবলীকে একত্রিত করে যা কবিতাটিকে বিষয়ের প্রতি অকৃত্রিম আবেগ দিয়ে তৈরি করে। প্রতিবাদী কবিতা পাঠকের আগ্রহ এবং সহানুভূতিকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং কখনও কখনও তাকে চটিয়ে দিয়ে কর্মে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। মলয় রায়চৌধুরীর এই কবিতাটি পড়ুন, শিরোনাম ‘মেশোমশায় পর্ব’:
যুধিষ্ঠির
আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির
বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে
লিআয় ল্যাংবোট কৃষ্ণ ভীম বা
নকুল কে-কে আছে
পেটো হকিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন
বলেদে দ্রৌপদীকে আলসে থেকে ঝুঁকে দেখে নিক
আমার সঙ্গে আজ কিছু নেই কেউ নেই
থৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধন নেই
তোদেরই অঙ্গুলিহেলনে কেটে তর্জনীও দিয়েছি শৈশবে
দাঁড়াচ্ছি পা-ফাঁক করে দন্তস্ফুট হয়ে যাবে জয়ধ্বনি তোর
সিঁড়িতে শেকলবাঁধা মহাপ্রস্হানের কুত্তা লেলিয়েও দ্যাখ
ন্যাটা হাতে যুঝে যাব জমিন ছাড়ব না
লুমপেন বলে তোরা ঘিরে ধরবি
আরেকবার ছিটকে পড়ব ফুটপাথে মুখে গ্যাঁজলা নিয়ে
ছুটন্ত খচ্চরবাচ্চা পিঠের ওপরে খুর দেগে যাবে
নাভিতে ব্লেডের কুছি দিয়ে তোরা খোঁচা দিবি
পায়ধমুখে জ্বলন্ত সিগারেট
পাঁজরে আছড়ে পড়বে কম্বলে মোড়া সোঁটা
দেখে নিস তোরা
মাটিতে গোড়ালি ঠুকে পৃথিবীর চারিধারে জ্যোতির্বলয় গড়ে যাব ।
উপরোক্ত কবিতাটি একটি রিডল বা ধাঁধা । প্রশ্ন ওঠে মেশোমশায় কে ? শকুনি তো মামা !ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে আমরা যে মাসির কথা শুনি, তাঁর অনুপস্হিত স্বামীই মেশোমশায় অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান । বর্ণপরিচয়ে বর্ণিত গল্পটা এরকম : “দশম পাঠের শিরোনাম ‘চুরি করা কদাচ উচিত নয়’। এখানে যে-কাহিনি দেওয়া হয়েছে, আজকের দিনের পুস্তকপ্রণেতাগণ তা পড়লে শিউরে উঠবেন। এই পাঠের প্রধান চরিত্র ভুবন। শৈশবে সে পিতামাতাকে হারায়। এরপর মাসির কাছে বড় হতে থাকে। স্কুল থেকে একবার ভুবন একজনের বই চুরি করে নিয়ে আসে। কিন্তু মাসি কোনো শাসন করেনি; ফলে ভুবনের সাহস দিনে দিনে বাড়তে থাকে। গল্পের পরিণতিতে আছে, বড় হয়ে ভুবন বড় চোরে পরিণত হয়। বিচারক তাকে ফাঁসির আদেশ দেন। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভুবন তার মাসির সঙ্গে দেখা করানোর অনুরোধ করে। ভুবনের মাসিকে ফাঁসির মঞ্চের কাছে আনা হলে মাসি ভুবনকে দেখে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে থাকে। ভুবন মাসিকে বলে, ‘এখন আর কাঁদিলে কি হইবে।’ এরপর মাসির কানে কানে একটি কথা বলার জন্য কাছে ডাক দেয়। মাসি কাছে গেলে ভুবন মাসির কান কামড়ে কেটে নেয়। আর ভর্ৎসনা করে বলে, মাসি যদি আগে থেকেই তাকে সাবধান করত, তাহলে তার জীবনে এই পরিণতি হতো না।”
মলয় আক্রমণ করছেন এখনকার যুধিষ্ঠিরদের, যারা নিজেদের ধর্মের ধ্বজাধারী হিসাবে সমাজের বুকে দাপিয়ে বেড়ায় । অথচ মহাভারতের যুধিষ্ঠির ছিলেন ধর্মাবতার। মলয় বলছেন যে তিনি তাদের হুকুমে একলব্যের মতন আঙুল কেটে দিয়েছেন আর সেই আঙুল হল লেখার আঙুল, তর্জনী । বর্তমান সময়ের প্রাতিষ্ঠানিক গুণ্ডাদের তিনি চ্যালেঞ্জ করছেন । কবিতার শেষে তিনি দিয়ে দিচ্ছেন নিজের বিজয়বার্তা।
মলয় রায়চৌধুরীর নিম্নোক্ত কবিতাটি পড়ুন কবিতার নাম ব্লাড লিরিক । আপনার অসুবিধা হবে একে কোন ধরণের কবিতা বলবেন। প্রেমের, প্রতিবাদের, প্রতিরোধের না রাষ্ট্রবিরোধিতার । বস্তুত প্রেমের কবিতার বনেদে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ সমাজ সম্পর্কে বক্তব্য রাখছে কবিতাটি । এখানেই মলয় রায়চৌধুরীর বৈশিষ্ট ; তিনি অন্যান্য কবিদের মতো সহজ-সরল কবিতা লিখছেন না । তাঁর পাঠকেরা অবন্তিকার সঙ্গে পরিচিত, কেননা সে বনলতা সেন, নীরা, সুপর্ণার মতন নয় ।
ব্লাড লিরিক
অবন্তিকা, তোর খোঁজে মাঝরাতে বাড়ি সার্চ হল
এর মতো ওর মতো তার মতো কারো মতো নয়
যেন এমন যেন অমন যেন তেমন নয়
.
কী করেছি কবিতার জন্য আগ্নেয়গিরিতে নেমে ?
একি একি ! কী বেরোচ্ছে বাড়ি সার্চ করে
কবিতায় ? বাবার আলমারি ভেঙে ব্রোমাইড সেপিয়া খুকিরা
কবিতায় । হাতুড়ির বাড়ি মেরে মায়ের তোরঙ্গে ছেঁড়ে বিয়ের সুগন্ধি বেনারসি
কবিতায় । সিজার লিস্টে শ্বাস নথি করা আছে
কবিতায় । কী বেরোলো ? কী বেরোলো ? দেখান দেখান
কবিতায় । ছি ছি ছি ছি, যুবতীর আধচাটা যুবা ! মরো তুমি মরো
কবিতায় । সমুদ্রের নীলগোছা ঢেউ চিরে হাড়মাস চেবাচ্ছে হাঙর
কবিতায় । পাকানো ক্ষুদ্রান্ত্র খুলে এবি নেগেটিভ সূর্য
কবিতায় । অস্হিরতা ধরে রাখা পদচিহ্ণে দমবন্ধ গতি
কবিতায় । লকআপে পেচ্ছাপে ভাসছে কচি বেশ্যাদেখা আলো
কবিতায় । বোলতার কাঁটা পায়ে সরিষা ফুলের বীর্যরেণু
কবিতায় । নুনে সাদা ফাটা মাঠে মেটেল ল্যাঙোটে ভুখা চাষি
কবিতায় । লাশভূক শকুনের পচারক্ত কিংখাবি গলার পালকে
কবিতায় । কুঁদুলে গুমোট ভিড়ে চটা-ওঠা ভ্যাপসা শতক
কবিতায় । হাড়িকাঠে ধী-সত্তার কালো কালো মড়া চিৎকার
কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরলে না কেন
কবিতায় । মুখে আগুন মুখে আগুন মুখে আগুন হোক
কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরো
কবিতায় । এর মতো ওর মতো তার মতো কারো মতো নয়
কবিতায় । যেন এমন যেন অমন যেন তেমন নয়
কবিতায় । অবন্তিকা, তোর খোঁজে সার্চ হল, তোকে কই নিয়ে গেল না তো !
.
কেন কবিতা লেখা ও পড়া এবং শোনা প্রয়োজন ? বিশেষ করে সংকটের সময়ে ? মানুষেরইতিহাস জুড়ে, কবিতা সবসময় সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং, দুঃখজনক এবং গঠনমূলক পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ক্ষমতায়নের কথা বলেছে। মানুষের জীবনে ও সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য কবিরা চিরকাল অগ্রণী । সতেজ এবং শক্তিশালী, প্রতিবাদের মঞ্চে এবং সমাবেশে, কবিতা একটি চিরকালীন আর্ট ফর্ম। নাগরিক অধিকার এবং নারীমুক্তি আন্দোলন থেকে শুরু করে বক্তব্য রাখার স্বাধীনতা পর্যন্ত, কবিতা হাওড়া স্টেশনে, খালাসিটোলায়, কফিহাউসে, মধুসূদন দত্তের সমাধিতে ভিড় জড়ো করার জন্য যথেষ্ট – তা হাংরি আন্দোলনকারীরা করে দেখিয়েছিলেন । মলয় রায়চৌধুরী যাঁদের কবিতা অনুবাদ করেছেন তাঁদের পথেরই যাত্রী মলয় নিজেও, যেমন, উইলিয়াম ব্লেক, শার্ল বোদলেয়ার, পল ভেরলেন, জাঁ আর্তুর র্যাঁবো, জাঁ জেনে, জাঁ ককতো, অ্যালেন গিন্সবার্গ, আঁদ্রে ব্রেতঁ, স্যামুয়েল বেকেট, চার্লস বুকাওস্কি, উইলিয়াম বারোজ, জ্যাক কেরুয়াক, বুল্লে শাহ, ত্রিস্তঁ জারা, হাবিব জালিব, আরনেস্তো কার্দেনাল ,,ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি, ওসিপ ম্যানডেলস্টাম, আনা আখমাতোভা, হোর্হে লুই বোর্হেস, আদুনিস, তামিম আল বারঘুতি, রবের্তো বোলানো, পাবলো নেরুদা, গ্যারি স্নাইডার, হীরা বাণসোডে, অরুণ বালকৃষ্ণ কোলটকর, পারিজাত, নাগার্জুন, ডেনিস ব্রুটাস, পল সেলান, সিলভিয়া প্লাথ, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, ফ্রেডরিক নীৎশে, গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার, মার্ক শাগাল, পাবলো পিকাসো, জাক প্রিভের, নিকানর পাররা, আরাগঁ, স্টিফেন মালার্মে প্রমুখ ।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে মনোযোগ আকর্ষণ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। ফেসবুকে প্রায় ২০০০ কবির কবিতা পাঠ করেছেন দেবাশিস ভট্টাচার্য ; তাঁরা বিভিন্ন দেশের কবি এবং অধিকাংশ কবিতা প্রতিবাদী কবিদের । মলয় রায়চৌধুরী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিবাদী কবিদের কবিতা অনুবাদ করে গ্রন্হাকারে প্রকাশ করেছেন । বইটির নাম ‘ভিনভাষী প্রতিষ্ঠানবিরোধী কবিদের কবিতা । ভারতীয় কবি ইকরার খিলজির ‘খবিশ’ নামের কবিতাটা পড়ুন ।
আমি অশুদ্ধ, আমি নোংরা
আমি ভবঘুরেপনার প্রচারক
স্বর্গের বিশুদ্ধ পরিদের গানের
সৌন্দর্যের প্রতিমা আমি নই
আমি আমার কামনার দাসী
আমি লালসার বুদবুদ
আমি জীবন্ত, আমি ভঙ্গুর
তবু আমি অহঙ্কারের মিনার
আমি মাত্রাধিক অহমিকার মানুষী
তোমরা আমাকে কখনও ছুঁতে পারবে না
তোমাদের মনে হতে পারে আমি খড়ের বা লাঠির শব
কেনই বা আমি ভুয়ো আকাঙ্খায় গড়ব নিজেকে ?
তোমরা যতোটা স্বার্থপর, আমিও ততোই
কেনই বা আমি পরার্থতার প্রতিমা হবো ?
তোমাদের মতনই মিষ্ট আমার কথাবার্তা
আমি কেন মিছরির তৈরি সৎচরিত্রের দেবী হবো ?
আমি অতিসাধারণ
তোমাদের খাতিরে ভালো হবার ভার আমি কেন বইব ?
তোমাদের রয়েছে উন্নত হবার গর্ববোধ
কিন্তু খ্যাতি আমার কাছে সহজেই আসে
তোমাদের যদি প্রাণহীন হাসিমুখ ভালো লাগে
তাহলে শ্বেতপাথরের মূর্তি যোগাড় করে নাও
তোমাদের আনন্দের খাতিরে আমার কপালের বলিরেখা উবে যাবে না
আমার মুখমণ্ডলের ভাবভঙ্গী তোমাদের আদেশ পালন করে না
এমনকী তা তোমাদের খাতিরে নয়
আমি সৌন্দর্যের জিনিস নই
আমি বিনয়ের আজ্ঞাবহ নই
আমি লাবণ্যের কথা জানি না
আমি পুজো করা মানি না
তোমাদের স্নেহ বা মনোযোগ চাই না
মনে করার কারণ নেই যে তোমাদের ছাড়া আমি দুর্দশাগ্রস্ত
তোমাদের রাজত্বের প্রজা আমি আর নই
বাধিত নই তোমাদের কৃতজ্ঞতায়
মনে কোরো না তোমাদের প্রাসাদের আমি পাপোশ
এবার বলো, তোমাদের বিশ্বস্ততার প্রতিশ্রুতি কেমন ছিল
যখন আমি ছলনাময় তাবিজ হয়ে উঠি
যে তোমাদের জাহাঙ্গীর করে তুলেছিল
আমি আর তীরবঞ্চিত ঢেউ নই
স্বর্গের কৌতূহলে চেপে আমি উড্ডীন
ইতিহাসের পাতা আমাকে মুছে ফেললেও
বিশ্বাসীরা আমাকে আশীর্বাদ করবে
আমার দেহ আর আমার মনকে বহুকাল বোরখায় ঢেকে রাখা হয়েছে
কিন্তু এই অন্ধকার সময়ে আমার অস্তিত্ব দীপ্তিময়ী
আকাশে এমনই কানাকানি চলছে
শেকলে বেঁধে কতোকাল আমাকে পেছনে ফেলে রাখবে
আমার ক্ষমতা বহুকাল প্রদর্শিত হয়েছে
আর কতোদিন মাদ্রাসাগুলো আমাকে অপমান করবে
বহুকাল আমি পদাতিকের যুদ্ধ লড়ে চলেছি
আমার বিদ্রোহ এই পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে
আর আমার ষড়যন্ত্র দুর্বলও নয় মূর্খেরও নয়
যে ক্ষমতাপ্রাসাদ থেকে তোমরা আমাকে দাবিয়ে রাখো তাতে আমি ঢুকে পড়েছি
আমি তোমাদের জগতকে অলঙ্কৃত করার জন্যে যে সৃষ্ট নই তা তোমাদের জানার সময় এসে গেছে
উত্তরঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে, অস্পষ্ট, ম্যানিপুলেটিভ বা আরও খারাপ অবস্হা সৃষ্টির রাজনৈতিক ও মিডিয়ার চোখরাঙানো ক্ষমতার মুখের ওপর সত্য কথা বলা কবিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না । কবিরা ভয়াবহ সত্য প্রকাশ করেন, চেতনায় জাগরণ ঘটান এবং হাংরি আন্দোলনের মতো ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গড়ে তোলেন। কবিতা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। আত্মতুষ্টির বিরুদ্ধে সবাই একত্রিত হয়ে দেখাতে পারে যে কেন রাজনৈতিক সংকটের মুহুর্তে কবিতা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে । আন্তর্জাল ও সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করে গঠনমূলক সমালোচনা এবং প্রকৃত প্রতিবাদের সম্ভাবনাকে মান্যতা দিয়েছেন কবিরা। তবে মাধ্যমটি সহজলভ্য বলে ট্রোল করা হয় প্রচুর । হাংরি আন্দোলনকারীদের, আন্দোলনের ষাট বছর পরও অকারণ ট্রোল করা হয় । মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাতকারের তিনটি সংকলন পড়লে স্পষ্ট হয় যে যাঁরা সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন তাঁরা তাঁর অধিকাংশ বই পড়েননি । এই ভণ্ডামির এ বার প্রতিবাদ হওয়া দরকার । অশীতিপর মলয় রায়চৌধুরী আজও প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাই বলে হাংরিরা কোনও সমসত্ত্ব প্রজাতি নন যে, সব ঘটনায় তাঁদের সবাই একই ভাবে প্রতিবাদ করবেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মারামারি, হানাহানি ও আধিপত্যবাদের কালোছায়ার পাশাপাশি জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবার আতঙ্কে আতঙ্কিত বিশ্ববাসী। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ চায় স্বাধীনতা ও মুক্তবিশ্ব। স্বভাবতই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী কবিদের হাতে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের কবিতা হয়ে উঠছে আরও শানিত। কবিতা প্রেমের, কবিতা দ্রোহের, কবিতা ভালোবাসার। কবিতা প্রতিবাদের। আমরা নিশ্চিত যে কবিতার সবর্গ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞা নেই, অথবা কবিতাকে কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। এ যেন প্রবাহমান জলস্রোত, কখনো শান্ত, সমাহিত, স্নিগ্ধ এর রূপ। কখনো বা খ্যাপা দুভার্গা, দুকুল বিনাশী তীর ভাঙা ঢেউ, কখনো বা সোনা ফলানো পলিমাটিতে অঙ্কুরিত নানা জাতের নানা বণের্র নানা রঙের তৃণরাশি। এই যে বণির্ল চিত্র যা সহজেই অন্যকেও প্রভাবিত করে, ভিন্ন হৃদয়াবেগকে আলোড়িত করে তার রূপলাবণ্য।মানবসমাজে অস্থিরতার সময়ে, কবিতার ভূমিকা কি অগ্নিশিখার পাখা নাকি শীতল মেজাজ? কবিতা অসাধারণভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
একটি কবিতা লিখতে বসার সময় একজন কবির মনে অনেকগুলি কাজ থাকতে পারে। কবি হয়তো অন্য কারো প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করছেন, বন্ধু হারানোর জন্য বিলাপ করছেন অথবা কোনো সুন্দর দৃশ্যের বর্ণনা করছেন। যদিও বিষয়গুলি পরিবর্তিত হয়, তবে সমস্ত কবিতার মূলে এমন কিছু থাকতে হবে যা পাঠক বা শ্রোতাকে এমনভাবে জড়িত করে যা কেবল কবিতাই পারে। প্রতিবাদী কবিতা একজন কবির হাতে থাকা সমস্ত সরঞ্জামকে গুছিয়ে তোলে, যার মধ্যে থাকে ব্যঙ্গ, ছড়া, রূপক, মাত্রা, প্রাণবন্ত ভাষা এবং আরও অনেক কিছু । অনেক ক্ষেত্রে, প্রতিবাদী কবিতা একটি নির্দিষ্ট সরকারী শাসনের প্রতি অসন্তোষের সাথে যুক্ত। কবিতা কঠোরভাবে বস্তুনিষ্ঠ হবার প্রয়োজন নেই । একটি প্রতিকূল চেহারায় শাসক দলের ক্রিয়াকলাপ বা মতাদর্শ দেখানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। বৃহত্তর সামাজিক অস্থিরতার সময়ে, কবিতাগুলি প্রায়শই একক কবি দ্বারা লিখিত হয় যাতে সাধারণ মানুষের মতামত প্রতিফলিত হয়।
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে রচিত বহুবিধ সাধারণ সামাজিক অসুস্থতা নিয়েও প্রচুর প্রতিবাদী কবিতা লেখা হয়েছে। প্রতিবাদী কবিতার অন্যতম জনপ্রিয় বিষয় মানুষে-মানুষে, দেশে-দেশে, ধর্মে-ধর্মে অবনিবনা এমনকি যুদ্ধ । যতদিন কবিতা লেখা হয়েছে, কবিরা তাদের দক্ষতা ব্যবহার করেছেন দ্বন্দ্ব ও অবনিবনার ট্র্যাজেডি উপস্হাপনের জন্য। সমীর রায়চৌধুরী “হাওয়া#৪৯” পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় এই দ্বন্দ্ব ও অবনিবনাকে বিশ্লেষণ করতেন।ভিয়েৎনাম যুদ্ধের সময়ে তিনি ‘আমার ভিয়েৎনাম’ নামে একটি কাব্যগ্রন্হ প্রকাশ করেছিলেন । আরেকটি বিষয় যা প্রজন্মের জন্য কবিদের ক্রোধকে জাগিয়ে তুলেছে তা হল ধর্মবিদ্বেষ।
অনেক ধরনের কবিতা আছে যেগুলোকে প্রতিবাদী কবিতা হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়, তবে এটি এমন একটি ধারা যা কম দক্ষ কবিদের হাতে সহজেই বিকৃত হতে পারে। একজন কবিকে একটি প্রতিবাদী কবিতা লেখার জন্য কোনও ইস্যু দ্বারা আবেগগতভাবে অনুপ্রাণিত হতে হয়, চিন্তা করতে হয়, তারপরই তিনি আবেগ বর্জন করে প্রতিবাদী বা প্রতিরোধের কবিতা লেখেন । একটি ইস্যুতে আটকে পড়লে কবিতাটা শিল্পকর্ম কম আর সংবাদ প্রতিবেদন বেশি মনে হবে ।
মলয় রায়চৌধুরী (জন্ম: অক্টোবর ২৯, ১৯৩৯) কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবি এবং সর্বোপরি ১৯৬০-এর দশকের হাংরি আন্দোলন—হাংরিয়ালিজম—তথা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক এবং এ কারণে ১৯৬০-এর দশক থেকেই ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলিকাতা খ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উত্তরপাড়া শাখার সন্তান। পিতা রঞ্জিত রায়চৌধুরী (১৯০৯-১৯৯১) ছিলেন ভারতীয় চিত্রশিল্পী এবং মাতা অমিতা (১৯১৬-১৯৮২) ছিলেন পাণিহাটিস্থিত নীলামবাটির কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর (রোনাল্ড রস-এর সহায়ক) জ্যেষ্ঠ কন্যা। কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিষদ কর্তৃক সংরক্ষিত সংগ্রহশালার (জাদুঘর) তথ্য অনুযায়ী মলয় রায়ের পিতামহ লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্রশিল্পী। মলযের বড়ো ভাই সমীর রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের একজন বিতর্কিত কবি। পাটনার সেইন্ট জোসেফ কনভেন্টে প্রাথমিক এবং রামমোহন রায় সেমিনারিতে ম্যাট্রিকুলেশানের পর অর্থনীতিতে সাম্মানিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন মলয় রায়। গ্রমীণ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ দলে প্রশিক্ষনের পর প্রথমে রিজার্ভ ব্যাংক ও তারপর এঅরডিসি এবং নাবার্ডে গ্রামীণ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞের উচ্চপদে ভারতের বিভিন্ন শহরে ১৯৯৭ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। যুগশঙ্খ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের রিডার ডক্টর শঙ্কর ভট্টাচার্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন যে মলয় রায়চৌধুরী সমগ্র জীবন ভারতের চাষি, তাঁতি, জেলে ও হস্তশিল্পীদের মাঝে কাটিয়ে প্রভূত অভিজ্ঞতা লাভ করেন, এবং তা তার সাহিত্যকর্মে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতাবাদ চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে "প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার" কবিতার জন্যে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন।
মলয় রায়চৌধুরীর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সাহিত্যের সনাতন ধারা অনুশাসনের বিরুদ্ধাচারণ। এ বিষয়ে স্বপ্ন পত্রিকায় লিখিত প্রবন্ধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ডক্টর তরুণ মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, 'সাহিত্যের সনাতন অনুশাসনগুলির বিরুদ্ধে মলয় রায়চৌধুরীর বিদ্রোহ তার রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য'। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতের অধিক। তার ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১০টি উপন্যাস, দুটি ডিটেকটিভ উপন্যাস, একটি ইরটিক নভেলা, ১২টি সমালোচনা গ্রন্থ, চারটি জীবনী এবং বহু অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েঝে। উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে শয়তানের মুখ, জখম, ডুব জলে যেটুকু প্রশ্বাস,নামগন্ধ চিৎকার সমগ্র, কৌণপের লুচিমাংস, মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো, বাউল-কবিতা সিরিজ ডোমনি, অ্যালেন গিন্সবার্গের হাউল ও ক্যাডিশ কাব্য-গ্রন্থের অনুবাদ প্রভৃতি অন্যতম। তিনি বিট মহিলা কবিদের রচনা অজস্র অনুবাদ করেছেন, পরাবাস্তব কবিদের অনুবাদ করেছেন এবং জাঁ জেনের সমস্ত কবিতা অনুবাদ করেছেন । লোকনাথ ভট্টাচার্যের পর তিনি দ্বিতীয় বাঙালি যিনি জাঁ আর্তুর র্যাঁবো'র নরকে এক ঋতু এবং ইল্যুমুনেশান্স অনুবাদ করেছেন । বুদ্ধদেব বসুর পর প্রথম বাঙালি যিনি বোদলেয়ারের সমগ্র কবিতা অনুবাদ করেছেন । বিদেশি কবি ওকতাভিও পাজ, আরনেস্তো কার্দেনাল, অ্যালেন গিন্সবার্গ, ডেইজি অ্যালডান প্রমুখ ভারতে এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন । পেঙ্গুইন র্যাণ্ডাম হাউস থেকে তাঁকে নিয়ে 'দি হাংরিয়ালিস্টস নামে একটি গ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছে, যা লিখেছেন মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী । তাঁর কবিতা নিয়ে পিএইচডি করেছেন হিডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিষ্ণুচন্দ্র দে এবং উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদয়শঙ্কর বর্মা । ২০০৩ সালে অনুবাদ সাহিত্যে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৬১ সালে দাদা সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়ার (দেবী রায়) সঙ্গে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করে আবির্ভাবেই সাড়া ফেলে দেন। তার সাংগঠনিক দক্ষতায় প্রায় চল্লিশজন কবি, লেখক ও চিত্রশিল্পী এই আন্দোলনে যোগ দেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিনয় মযুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ প্রমুখ। এই আন্দোলনের মুখপত্র হিসাবে এক পাতার বুলেটিন প্রকাশ করা হতো। ১০৮টি বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছিল, যার মাত্র কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি এবং ঢাকার বাংলা একাডেমিতে সংরক্ষণ করা গেছে। ১৯৬৫ পর্যন্ত এই আন্দোলন পুরোদমে চলেছিল; বিখ্যাত হাংরি মামলার পর তা ভেঙে যায়। আন্দোলনটি নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী হাংরি কিংবদন্তি নামে একটি গ্রন্হে আন্দোলনের ইতিহাস তত্ব ও তথ্য নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। পরবর্তীকালে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় নথিপত্র, আদালতে সাক্ষ্য, আদালতের রায় এবং হাংরি আন্দোলনকারীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে হাংরি আন্দোলন গ্রন্হ। মলয় রায়চৌধুরী তিরিশ বছর যাবত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেগুলি একত্রিত করে প্রকাশ করেছেন তিনটি প্রকাশন সংস্হা, মহাদিগন্ত, প্রতিভাস এবং আলোপৃথিবী প্রকাশনী।
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর বিষ্ণুচন্দ্র দে "মলয় রায়চৌধুরী ও হাংরি আন্দোলন" বিষয়ে ৩৫০ পৃষ্ঠার গবেষণাপত্রের জন্য ডক্টরেটে লাভ করেন। ২০১৩ সালে হাংরি আন্দোলন নিয়ে আইআইটি খড়গপুর থেকে ডক্টরেট করেছেন অধ্যাপক রিমা ভট্টাচার্য। ১৯৯৭ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিষয়ে ডক্টরেট করেছেন অধ্যাপক উদয়নারায়ণ বর্মা। দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় সম্পর্কে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে এমফিল করেছেন। রূপসা দাস ২০১৮ সালে মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে গবেষণা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো হিডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন।
প্রতিটি প্রজন্মে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের দক্ষ কবি পেয়েছি আমরা । অনেকের কবিতা স্হায়ী হয়েছে,কিন্তু অনেকের হয়নি । সর্বজনীনভাবে আবেদনময় হয়ে উঠছে না অনেকের কবিতা । অনেকের কবিতা প্রতিষ্ঠানের, বিশেষকরে সংবাদপত্র ও রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষণার কারণে আড়ালে থেকে যাচ্ছে, যেমন হাংরি আন্দোলনের কবি ফালগুনী রায় এবং শম্ভু রক্ষিতের কবিতা। আমি মনে করি না যে তরুণ কবিরা সুন্দর এবং শক্তিশালী প্রতিবাদী কবিতা লিখতে অক্ষম। আপনি যদি এখনকার তরুণ কবিদের রচনা সম্পর্কে চিন্তা করেন, আর অতীতের কবিদের কবিতা পড়ি তাহলে দেখা যাবে যে বহু কবিতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এটা বিশেষ করে প্রতিবাদী কবিতার ক্ষেত্রে সত্য যেগুলো স্বভাবগতভাবে খুব কমই সর্বজনীন অথচ অনুষ্ঠান-বিশেষে পাঠকরা হয়, যেমন সুকান্ত ভট্টাচার্য, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। সেগুলো সর্বদা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মঞ্চে পাঠ করা হয়৷ আরেকটি সাম্প্রতিক ঘটনা হলো বাচিক শিল্পীদের নিজস্ব ভালো-লাগা অথবা প্রতিষ্ঠান তাঁদের কোন কবিদের পছন্দ করতে বলছে তাও বিবেচ্য ।
মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্হ শয়তানের মুখ ১৯৬৩ সালে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে গ্রন্হটিকে একটি জলবিভাজক বলে মনে করা হয়। মলয় তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্হে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার কবিতার জনকরূপে বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন। তার কবিতা বাংলাসাহিত্যের সনাতন ঐতিহ্যকে, নিয়মানুবর্তিতাকে, আমূল নাড়া দিয়েছিল। কবিতার ভাষায়, ছন্দে, অলংকারে, চিত্রকল্পে তুমূল ভাংচুর পাঠকের অভ্যস্ত চোখ ও কানকে বিব্রত করেছিল। যৌনতার সংগে তিনি এনেছিলেন ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও অসহায় মানুষের নিষগফলতার যন্ত্রণা। উপন্যাস ও ছোটগল্পে তিনি নিজস্ব গদ্য সৃষ্টি করেছেন এবং তার প্রবন্ধকে আপোষহীন বলে মনে করা হয়। তার নাটক তিনটিকে বলা হয়েছে উত্তরাধুনিক, যদিও সেগুলি হাংরি আন্দোলনের সময়ে রচিত। তার প্রবন্ধ ও পোলেমিক্সগুলি থেকে স্পষ্ট হয় কেন তাকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক বলা হয়। মলয় যাঁদের কাজ অনুবাদ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন উইলিয়াম ব্লেক, জাঁ ককতো, সালভাদোর দালি, পল গঁগা, ব্লাইজি সঁদরা, ত্রিস্তান জারা, অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, পাবলো নেরুদা এবং ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা।মলয় গ্রন্হে সম্পাদক মুর্শিদ এ. এম. ভূমিকায় জানিয়েছেন যে নব্বুই দশকের পর রচিত তার সাহিত্যকর্মকে বলা হয়েছে অধুনান্তিক।
২০১২ সালে তিনি প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস রচনা আরম্ভ করেন। তার সৃষ্ট মহিলা ডিটেকটিভ রিমা খান (নোংরা পরি) একজন ভিন্ন প্রকৃতির চরিত্রবৈশিষ্ট্যসহ উপস্হাপিত। বর্তমান যুগের পুলিশ কর্মকর্তাদের মতো রিমা খান নির্দয় ও নির্মম। মলয় রায়চৌধুরীর গোয়েন্দা উপন্যাসটির নাম ডিটেকটিভ নোংরা পরির কঙ্কাল প্রেমিক।
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা, গল্প ও উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হল যে সেগুলো মুক্ত-সূচনা ও মুক্ত-সমাপ্তি দ্বারা চিহ্নিত; এবং তা বহুমাত্রিক. আঙ্গিক-ভাঙা, ঘটমান, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত, কেন্দ্রাতিগ, অফুরন্ত অর্থময়, সংকরায়িত, রাইজোম্যাটিক. অপরিমেয়, ভঙ্গুর বাকপ্রতিমায় আপ্লুত, একাধিক বার্তাবহ এবং ক্যানন-অতিক্রমী।উত্তরপ্রবাসী পত্রিকার হাংরি আন্দোলন সংখ্যায় অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা জানিয়েছেন যে, স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পবস্তু বা 'আর্ট ফর আর্ট সেক'-এর ঔপনিবেশিক তত্বকে বর্জন করার কথা বলেছেন মলয়, যা বাংলা সাহিত্যে তার পূর্বে কেউ বলেননি ।
তরুণ কবিরা সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করেন লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটোকাগজের মাধ্যমে। ছোটকাগজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ছোটকাগজ নিজের ভাষার অতীত ও বর্তমান সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অনন্য অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে পথচলা শুরু করে এবং তার মাধ্যমে নিজস্ব সংস্কৃতিতে অন্যদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। ছোটোকাগজ লেখকদের স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে পাঠদিগন্তকে প্রসারিত করতে সহায়তা করে । পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্য-সংস্কৃতি কীভাবে তাদের থেকে পৃথক তা বিশ্লেষণ ও অবলোকন করে। প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা ছোটকাগজের প্রাণ এবং এই চারিত্র্য তারা পেয়েছে মলয় রায়চৌধুরীর আরম্ভ করা হাংরি আন্দোলনকে অনুসরণ করে । তারপরের দশকগুলিতে তরুণদের হাতে বাংলা কবিতার, গদ্যের ভাষা ও বিষয়ের বড় ধরনের যে দিক বদল ঘটেছে, একই রচনাতে কবিতার, গদ্যে ভাষার রীতি ক্রমশ দুরূহতা থেকে যোগাযোগ প্রবণ হবার প্রয়াস করেছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’ নামের দীর্ঘ কবিতাটি। ‘জখম’ এ-পর্যন্ত চারবার মুদ্রিত হয়েছে এবং মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার মতো পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
অবন্তিকাকে নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর প্রতিটি কবিতা মূলত নারীর ক্ষমতায়নের কবিতা । এরকম প্রেমের কবিতা বাংলা ভাষায় আর কেই লিখেছেন বলে মনে হয় না । অবন্তিকা নানা রূপে এসেছে তাঁর কবিতায়, ডেথমেটাল গাইয়ে-নাচিয়ে, সাংবাদিক, হিপিনি, গণিতজ্ঞ, কুৎসিত, সুন্দরী, নেশাড়ু, লড়াকু, পলাতকা, ঘরভাঙা, নর্তকী – বস্তুত অবন্তিকাকে নিয়ে ছেয়ে আছে ইউটিউব – অনেকের কন্ঠে। মলয় রায়চৌধুরীর কন্ঠেও ।
নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর অবস্হান সম্পর্কে বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “আমি তাঁর বেশ-বয়সের অবন্তিকাদের মধ্যে একজন। ডিট্যাচড, পড়ুয়া, চোখে চশমা আঁটা, উচ্চাশী অবন্তিকা। তিনি আমার পিতৃপ্রতিম। জাগতিকে তাঁকে তেমনই ভালোবাসি। আর অন্য এক জায়গায় তাঁকে ভালোবাসি, যেমন ক’রে তাঁর অসাধারণ উপন্যাস “ডিটেকটিভ নোংরা পরীর কঙ্কাল প্রেমিকে”, অনেক আগে মরে যাওয়া কঙ্কালকে, এক বৃদ্ধের কংকালকে, তার জীবনের কনসেপ্টকে ভালোবেসে ফেলেছিল ইন্সপেক্টর রিমা খান। কেন? সেই গণিতবিদ, উৎশৃংক্ষল কংকালের পৌরুষের জন্য। আমি এই অদ্ভুত আখ্যানটি লিখছি কারণ, কবে এই কিংবদন্তীস্বরূপ বৃদ্ধ ফট ক’রে মরে যাবেন। এখনো দেখা করিনি। ফোন করিনি। যদি মরে যান, একা ফ্ল্যাটে ছটফট করবো শোকে। সেই ভয়ে, এখন কিছু দিয়ে রাখা। টিকে যেতেও পারেন অনেকদিন আরো। ভীষণ জীবনীশক্তি। জীবনকে ভালোবেসে চুষে খাবার ইচ্ছে।
“মলয় রায়চৌধুরীকে দাদা বলার দূরভিলাষ হয় নি কখনো আমার। এই গ্যালিভার কেন যে লিলিপুটের সংসারে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় সারা শরীরে তাদের মই বেয়ে উঠতে দেন, সেই নিয়ে আমার এক চাপা ক্ষোভ ছিল। ইনি ভীষন পণ্ডিত। বাকি বড় বড় কবিদের মতো দূর থেকে কিছু কিছু জ্ঞানের কথা লিখলেই লোকে আশেপাশে ঘুরতো বেশী বলে আমার বিশ্বাস। তাও আমাদের মতো নতুন শিঙওলাদের, এবং আমাদের চাইতেও আরো আরো খাজা জনগণকে উনি প্রশ্রয় দেন। এই মার্কেটিঙের স্টাইলটা আমার পছন্দ নয়। কিন্তু পুরুষালী কড়া মদের মতো তীব্র আত্মবিশ্বাসে উনি যে এটা ক’রে যান, প্রচণ্ড টেক-স্যাভি, সরাসরি, আড়ালহীন প্রচার, এটাও আমার আজকাল ভালই লাগে।
“তাঁর হাত দিয়ে যে কবিতা বেরিয়েছিল, (“প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ১৯৬৩ সালে ভারতীয় কবি মলয় রায়চৌধুরী রচিত ৯০ লাইনের একটি জলবিভাজক কবিতা। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে।প্রকাশের পর সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে কবিতাটি নিষিদ্ধ করা হয়। ভারতীয় আদালতে হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তিনটি ধারায় মামলা হয় এবং মলয় রায়চৌধুরীসহ অন্যান্য আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে মামলাটি নাকচ হয়ে যায়। মামলা চলাকালীন সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপে মলয় রায়চৌধুরীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, এবং বিভিন্ন ভাষায় কবিতাটি অনুদিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত 'মর্ডান অ্যান্ড পোস্টমর্ডান পোয়েট্রি অফ দ্য মিলেনিয়াম" সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে একমাত্র কবিতা হিসেবে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।” (উইকিপিডিয়া থেকে)), সেই কবিতা কারোর হাত থেকে বেরোনো শক্ত। সারা পৃথিবীর কবিতাপ্রেমী তা জানে। আমি আর তা নিয়ে বলি কেন। ওরকম একটা কোনদিন নামাতে পারলে বুঝতাম, হুঁ, কিছু করা গেলো। হবে না। সে আধার নেই আমার। তাই বলে ওনার এখনকার অনেক কেমন-যেন কবিতাকে লাইক টাইক দিতে পারি না। প্রয়োজনও নেই। যার এত উপন্যাস আছে, তাকে কেবা কবিতায় যাচে?
“মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাসগুলি ভীষণ ভীষণ আণ্ডাররেটেড। বাংলা সাহিত্যে ঠিক ওরকম উপন্যাস বেশি লেখা হয় নি। ভালোয় মন্দে শুধু না, অদ্ভুত অন্য ধারার জন্য। কেন লেখা হয় নি তার বড় কারণ আমার মতে এই যে, ওরকম টেস্টোস্টেরন সম্বলিত প্রেমিক পুরুষ খুব বেশী নেই মনে হয় বাংলা সাহিত্যজগতে।
“এই জগতের ক্যাচাল আমি তেমন জানি না। কিন্তু মলয় রায়চৌধুরী, মাঝে মাঝেই কাজের মেয়ে না এলে স্ত্রীএর সঙ্গে মন দিয়ে রান্নাবান্না বাসনমাজা, কাপড় কাচা ইত্যাদি করে ফেলেন। করার তো কথাই। জানি না তিনি জীবনে কতটা বিশ্বাসী অবিশ্বাসী ছিলেন সামাজিক অর্থে। খালি জানি, ইনবক্সে যখন কোন প্রশ্নের উত্তরে বলেন “বলে ফ্যাল । আজকে কাজের বউ আসেনি । বুড়ো-বুড়িকে অনেক কাজ করতে হবে । লাঞ্চে খিচুড়ি । ডিনারে প্যাটিস।”, কি ভালো যে লাগে! এই বুড়ি, যাঁকে আমি খালি ছবিতে দেখেছি, একসময়ের দাপুটে হকি খেলোয়াড়, তাঁকে এই “অ-কংকাল প্রেমিক” ভীষণ দাপটে ভালোবেসে গেছেন, এমন একটা ছবি বেশ মনে মনে আঁকতে পারি, এঁকে ভালো লাগে।
“মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাসের পুরুষদের মতো প্রেমিক আমি বাংলা উপন্যাসে কম দেখেছি। তাঁর “ডিটেকটিভ নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক” উপন্যাসে, এক গণিতবিদ, বহুগামী অবিবাহিত পুরুষ, হঠাৎ এক স্বল্পপরিচিত সহকর্মী মহিলার “চলুন পালাই” ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গিয়েছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের অন্য দিকে, তামিল দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। নাগরিক সভ্যতার থেকে পালাতে চেয়েছিলেন এই উচ্চশিক্ষিতা তরুণী মায়া, আর মায়ার ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকে গেছিলেন সেই গণিতবিদ। এই উপন্যাসটি ছোট্ট, গোগ্রাসে গেলার মতো, নানান ভাবে রগরগে, আর নানান ভাবে ভীষণ ভীষণ সেরিব্রাল, মস্তিষ্কপ্রবণ। এই উপন্যাসে, জঙ্গুলে জীবনে ফিরতে চাওয়া মায়ার ঋতুস্রাবকালে, তাকে নিজ হাতে ধুইয়ে দিয়েছে তার প্রেমিক। অথচ দুজনে দুজনকে ডেকেছে “আপনির” দূরত্বের পবিত্রতায়, নিজেদের স্বত্ত্বাকে আলাদা বোঝাতে, “পবিত্রতার মতো অস্পষ্ট” শব্দকে ধূলিসাৎ করেও। এই উপন্যাসটির একটি রিভিউ আমি আগেও করেছি। বিশদে যাবো না। শুধু, এই প্রেমিকের প্রতি আমার গভীর মায়া যে বলে “চাল-পোড়া তো খাওয়া যাবে না , তাই মায়া চাল দাতাকে অনুরোধ করেছিল যে আমাদের একমুঠো ভাত দিলেই চলবে, কাঁচকলা পোড়া বা কাঁঠালবিচি পোড়া দিয়ে খেয়ে নেয়া যাবে, লঙ্কার টাকনা দিয়ে । প্রায় প্রতিদিনই ভাত পেতে লাগলুম , যদিও কলকাতায় যা খেতুম তার চেয়ে অনেক কমই, কিন্তু কম খেয়ে আর রাতে না খেয়ে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল কম খাবার । আমি চাইতুম মায়া বেশি খাক, মায়া চাইত আমি বেশি খাই । আমি একদিন বলেই ফেললুম, প্রকৃত ভালোবাসা কাকে বলে জানি না, কেবল যৌনতাই জেনে এসেছি এতকাল, আপনি ভালোবাসতে শেখালেন। জবাবে মায়া বলেছিল, অতীতকে আনবেন না প্লিজ, আপনি কী ছিলেন, কী করেছিলেন, সব ভুলে যান, সমস্তকিছু মুছে ফেলুন, আমি কি কোনো স্মৃতিচারণ করেছি?”। বা যে বলে “জীবনের বাঁকবদলগুলো, যতবার ঘটেছে বাঁকবদল, সব সব সব সব নারীকেন্দ্রিক ; নারীর ইচ্ছার, নির্দেশের, দেহের, আকর্ষণের, রহস্যের মোহে । স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভাল, সান্মানিক স্নাতকে খুব-ভাল , স্নাতকোত্তরে অত্যন্ত ভাল, তাদেরই কারণে , প্রভাবে, চাপে, আদরে । চাকরিতে যোগ নারীর জন্যে উন্নতি নারীর জন্যে, চাকরি ছাড়া নারীর জন্যে , ভাসমান জীবিকা নারীর জন্যে , অবসরে পৈতৃক বৈভবে পরগাছাবৃত্তি নারীর কারণে । কে জানে, হয়তো মৃত্যুও নারীর হাতেই হবে । জীবনে নারীদের আসা-যাওয়া, সেনসেক্স ওঠা-পড়ার মতন, না ঘটলে, আমার ব্যর্থতা, ব্যথা, পরাজয়, গ্লানি, অপরাধবোধ, এ-সবের জন্যে কাকেই বা দায়ি করতুম ! কাকেই বা দোষ দিতুম আমার অধঃপতনের জন্যে ? লোভি লম্পট মাগিবাজ প্রেমিক ফেরারি হয়ে ওঠার জন্যে ? হবার, নাকি হয়ে ওঠার ? আসলে আমি একটা কুকুর । আগের সিডিতে লিখেছি, তবু রিপিট করছি শেষনির খাতিরে । যে-মালকিনির হাতে পড়েছি , সে য-রকম চেয়েছে, যে-রকম গড়েছে , তা-ই হয়েছি । সেবার কুকুর, কাজের কুকুর, প্রজননের কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর, পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপি কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, কোলের কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর, সেই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু একমাত্র কুকুর যেটাকে আমি ভালবেসেছি, তা হল মালকিনিকে উন্মাদের মতন ভালবাসার কুকুর । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল , চিরকাল তেমনই থেকে গেছে।”।
“আমি নিশ্চিত যে, মলয় রায়চৌধুরীও এরকমই আকাশমুখো লেজের কুকুর। তিনি প্রবলভাবে, ভিতর থেকে, লিঙ্গসাম্যে বিশ্বাসী। “অরূপ, তোমার এঁটো কাঁটা” উপন্যাসে তিনি যে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মহিলা চরিত্র বানিয়েছেন, যে লোভে লালসায়, ভালোবাসায়, প্রতিশোধে, ভীষণ রকম জীবন্ত ও অসহায়, মেয়েদের সবটুকু নিয়ে সবটুকু দিয়ে ভালো না বাসতে পারলে, রূপের মধ্যে ওরকম অরূপ, আর তার এঁটো কাঁটাসহ মচ্ছগন্ধ ধরে রাখা যায় না। এখানেই মলয় রায়চৌধুরীর পৌরুষ। যে রকম পৌরুষ “দেহি পদপল্লবম উদারম” এর মতো উদাত্ত হাঁক দিতে পারতো জয়দেবের কালে, পারে একালেও। তাঁর “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” আর “ছোটোলোকের যুববেলা” তেমনই অকপট, দাপুটে, উজ্জীবিত, ভিগরস। নিজেকে বিশ্রেণীকরণ করেছেন শুধু জোর করে নয়। তিনি সেরকম হয়েও উঠেছেন। তাঁর মেজদার জন্মরহস্য পড়ে এক একবার মনে হয়েছে, সবটা বলে দেওয়া কি তাঁর ঠিক কাজ হয়েছে পরিবারের প্রতি? আবার এক একবার মনে হয়েছে, বেশ করেছেন, ঠিক করেছেন। বিহারের প্রান্তিক মানুষের জীবন, তাঁর লেখায় দারুণ উঠে এসেছে। “ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” উপন্যাস যেমন লিরিক্যাল কোথাও কোথাও, তেমনই, গভীর রাজনৈতিক চেতনায় প্রোথিত। তাঁর অনেক উপন্যাসই তাই। খুব কাটাকাটা, খুব ন্যাকামোহীন, নির্মোহ, নিজের প্রতিও, নিজের নায়কদের প্রতিও, অনেকটা নায়িকাদের প্রতিও। এরকম ধারাবিবরণী বাংলায় লেখা কম উপন্যাসেই আছে। খানিকটা সমরেশ বসুর “যুগযুগ জীয়ে”তে কাছাকাছি কিছু স্বাদ পাই। তাও, এই উপন্যাসগুলি লেখার ধরণে অনেক আলাদা। আর এই সবের পরেও রচৌকে জিগালে, তাঁর সব জীবনদর্শনের মধ্যে, সব ছাপিয়ে, হয়তো কৈশোরের ভুবনমোহিনী রাণা উঠে আসবে, প্রথম চুমুর টেণ্ডারনেস নিয়ে। কিশোর পুরুষে।
“এই লেখাটা আবেগতাড়িত। খাপছাড়া। কর্মক্লান্ত দিনের শেষে রাত দেড়টা থেকে তিনটের মধ্যে আজ লিখবোই, বলে লিখে ফেলা। পরে হয়তো সংশোধন করবো আরো। উপন্যাসগুলোর, প্রবন্ধগুলোর, কবিতাগুলোর, ইদানীং লেখা ওনার কিছু কেমন-যেন-ভাল-না কবিতাগুলোও আলোচনা করা যাবে আরো কিছু। তবে এই লেখা অনেকাংশে ব্যক্তিগত ভাবের লেখা। তাই এভাবেই অকপটে লিখছি। আমার গবেষণাপত্রটি যখন শেষও হয় নি, মলয় রায়চৌধুরী আমাকে তখনই খুব উতসাহ দিতেন। আমাকে নিয়ে তাঁর যে অবন্তিকা, তা তখনই লেখা। পরে যখন গবেষণাপত্রটি বেরোলো, আমার ক্ষীণ অনুরোধ থাকা সত্ত্বেও, ফেসবুকে প্রায় সাতশোবার শেয়ার হওয়া এই লেখা, এবং আরো অনেকবার শেয়ার হওয়া লেখার নানান রেফারেন্স কিছুতেই টুইটারের মুখ দেখলো না বাঙ্গালি সমাজে। অথচ টুইটার কাউণ্টই জার্নাল মেট্রিক গ্রাহ্য করে। এই অশীতিপর বৃদ্ধ তখন, না বলতেই, বহুবার, চুপচাপ, এন্তার লোককে, সংস্থাকে ট্যাগ করে, টুইট করেছেন আমার গবেষণার লিংক, বহুদিন। ভালোবাসি কি সাধে?”
আমরাও, যারা সাধারণ পাঠক, মলয় রায়চৌধুরীকে শ্রদ্ধা করি, তিনি বহুগুণে গুণান্বিত বলেই কেবল নয় । তিনি অমরত্বের বোধে পীড়িত নন । তাঁর শত্রুদেরও তিনি ক্ষমার চোখে দেখেছেন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন