তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরসে
ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও।-প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার (মলয় রায় চৌধুরী)
উপরের আলোচিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি ১৯৬৩ সালে কবি মলয় রায় চৌধুরী রচিত ৯০ লাইনের একটি কবিতা। এককথায় বললে বহুল আলোচিত একটি জলবিভাজক কবিতা। কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে। আর প্রকাশের পরপর সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে কবিতাটি নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি রচয়িতাকে কাঠগড়ায়ও তোলা হয়।
রচয়িতা মলয় রায় চৌধুরী পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছিলেন কবিতার জন্য এক ক্ষুধার্ত প্রজন্মের আন্দোলন দিয়ে। যাদের লেখায় প্রকাশ্যে উঠে এসেছিল যৌনতা থেকে জীবনমুখী সংগ্রামের কথা। ইতিহাস তাকে আখ্যায়িত করেছে ‘হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট’ শিরোনামে!
এই আন্দোলন নিয়ে আলোকপাত করতে হলে যেতে হবে সেই ষাটের শতকের গোড়ার দিকে। সাল ১৯৬১। উক্ত বছরের নভেম্বরে সমীর রায় চোধুরী যিনি সম্পর্কে মলয় রায় চৌধুরীর দাদা, তার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায় এবং মলয় রায় চৌধুরী নিজেদের পাটনায় বাড়িতে বেশ কয়েকদিন ধরে আলোচনায় বসেন। আলোচনার বিষয়বস্তু উত্তর ঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যের প্রেক্ষিতে একটি আন্দোলনের সূচনা করা।
নাম দেওয়া হয় ‘হাংরি আন্দোলন’। ধারণাটির পুরো রূপরেখাই ছিল মলয় রায় চৌধুরীর। তখন মলয় রায় চৌধুরীর বয়স বাইশ। সেদিন তাদের চারজনের সহমতে শুরু হলো হাংরি আন্দোলনের বুনন। এই প্রসঙ্গে মলয় রায় চৌধুরী বলেন,
১৯৫৯-৬০ সালে আমি দুটি লেখা নিয়ে কাজ করছিলুম। একটি হল ইতিহাসের দর্শন যা পরে বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যটি মার্কসবাদের উত্তরাধিকার যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই দুটো লেখা নিয়ে কাজ করার সময়ে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা আমার মাথায় আসে।
এবার আসা যাক হাংরি শব্দটি কেন নেওয়া হলো আন্দোলনের নামস্বরূপ। মূলত: ‘হাংরি’ শব্দটি মলয় রায় চৌধুরী নিয়েছিল জিওফ্রে চসারের কবিতার একটি চয়ন ইন সাউরে হাংরি টাইম (In Sowre Hungry Tyme) থেকে এবং তাত্ত্বিকভাবে ভিত্তি হলো প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দ্য ডিকলাইন অব দ্য ওয়েস্ট (The Decline Of The West) বই থেকে।
মলয় রায় দেশভাগের পরবর্তী বাঙালির কালখণ্ডকে আসলে এখানে হাংরিরূপে রূপক অর্থে প্রকাশ করেছিলেন। তো সেদিন পাটনার বাসায় উপস্থিত তিনজনই সেই নাম অনুমোদন করেন। কার্যক্রম হিসেবে ঠিক করা হলো আপাতত প্রতি সপ্তাহে এক পাতার বুলেটিন প্রকাশ করা হবে। কলকাতার কফিহাউস থেকে শুরু করে কলেজ, সংবাদপত্রের অফিস সর্বত্র ফ্রিতে বিলি করা হবে এই বুলেটিন।
এদিকে, হাংরি নামকরণ নিয়ে শৈলেশ্বর ঘোষের মতে ‘হাংরি জেনারেশন’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ১৯৬২ সালে বিনয় মজুমদারের কবিতার সমালোচনা করতে গিয়ে শক্তি বলেছিলেন,
ওদিকে (পশ্চিমে) সামাজিক অবস্থা অ্যাফ্লুয়েন্ট,
ওরা বিট বা অ্যাংরি হতে পারে। আমরা কিন্তু ক্ষুধার্ত।
যাই হোক, আন্দোলনের শুরুতে কলকাতায় নেতৃত্ব দেওয়া হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে। যেহেতু চারজনের মধ্যে তার পরিচিতি ছিল বেশি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আন্দোলনের সূচনা হবে বুলেটিন বিতরণের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনের প্রথম বুলেটিন প্রকাশিত হয় ইংরেজীতে।
কারণ তখন পাটনায় বাংলা প্রেস ছিল না। আস্তে আস্তে আন্দোলনের চাকা সুচারুভাবে চলতে শুরু করে। ১৯৬২ সালে বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত এই চারজনই ছিলেন আন্দোলনের নিউক্লিয়াস।
এক্ষেত্রে, একটি প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই; ইউরোপের আন্দোলনগুলো গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন দশককে কেন্দ্র করে মানে টাইমফ্রেম ভিত্তিক। বাঙালিও এই চৌহদ্দি ডিঙিয়ে যাওয়ার আর সাহস পায়নি। ফলে, তৎকালীন কল্লোল গোষ্ঠী এবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী তাদের ডিসকোর্সে যে সমস্ত নতুনত্ব এনেছিলেন তা ছিল মূলত কলোনিয়াল এসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক নান্দনিক বাস্তবতাকে নিয়ে। কিন্তু এই টাইমফ্রেমকে প্রচণ্ডভাবে প্রথম চড়াঘাত করে যে আন্দোলন, সেটা হাংরি আন্দোলন!
আর ১৯৬১ সালের প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি আন্দোলন চেষ্টা করে টাইমফ্রেমভিত্তিক এই চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তাতন্ত্র গড়ে তোলার। ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য আন্দোলনগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে ব্যক্তির দাপটে বাকি সামগ্রিকতা তুচ্ছ সেখানে। যেখানে জনগণের দাপটের কোনো ভাষাই ছিল না। এমনকি দেশীয় কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও ব্যক্তিবাদের লালনে সমসাময়িক গোষ্ঠীকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়নি।
যে সাহিত্যের মূল ছিল সাধারণ মানুষের ভাবনা আর মুখের ভাষা, রচয়িতা নয়! সেটা কিনা প্রাক-ঔপনিবেশিক বলয়ে চলে গিয়েছিল ব্যক্তিচর্চার কেন্দ্রে। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিটি উপনিবেশে গিয়ে এই ফসলটির চাষ করেছে সুচারুভাবে!
হাংরি আন্দোলনের মতাদর্শিরা ছিল মার্কসবাদী। আগা-গোড়া ধর্মাবলী নিয়ে চিন্তিত ছিল না। ফলাফলস্বরূপ বুলেটিন প্রকাশের প্রথম থেকেই তাদের সাথে সংঘাত শুরু আমলাতান্ত্রিক চেতনা ধারণ করা মানুষ আর রাষ্ট্রের সাথে!
হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি, ধর্ম, উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা, দর্শনভাবনা, ছবি আঁকা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তাহার প্রকাশ করেন। উপমহাদেশে ইস্তাহারের মাধ্যমে প্রথম আন্দোলন।
উল্লেখ্য, হাংরি আন্দোলনের পূর্বে লেখকগণ ছিলেন মূলত কমিউনিস্ট প্রভাবের বলয়ে আচ্ছাদিত। এতটাই যে বাস্তব জগতের সঙ্গে তারা বিচ্ছিন্ন ছিলেন। ইউথোপিয়ান স্বপ্নে বিভোর! অথচ হাংরিরা প্রথমবার হেটেরোটোপিয়ার কথা বললেন। এমনকি হাংরি জেনারেশনের কবি অরুণেশ ঘোষ তাঁর কবিতাগুলোতে বামপন্থীদের মুখোশ খুলে দিতে শুরু করেছিলেন।
আন্দোলনের সময়কাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত, ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। অথচ এই ছোট্ট সময়কালে ছাপানো হয় শতাধিক সাইক্লোস্টাইল করা বুলেটিন; অধিকাংশই হ্যান্ডবিলের মতন ফালিকাগজ, দেয়াল-পোস্টারে, একফর্মা এবং দীর্ঘ কাগজে। একটি দীর্ঘ কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল উৎপলকুমার বসুর ‘পোপের সমাধি’ শিরোনামের বিখ্যাত কবিতাটি।
হাংরির প্রথম ইশতাহারে আগের প্রজন্মের চারজন কবির নাম থাকায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় বেঁকে বসেন। ফলে, ডিসেম্বরে শেষ প্যারা পরিবর্তন করে পুনঃপ্রকাশিত হয়। এদিকে, ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে আবার অংশগ্রহণকারীদের নামসহ এই ইশতাহারটি তৃতীয় বারের মতো প্রকাশ হয়।
এরিমধ্যে হাংরিতে একে একে যোগ দেন উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবিমল বসাক, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরূপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, সতীন্দ্র ভৌমিক, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, শৈলেশ্বর ঘোষ, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেনসহ আরো অনেকেই।
তখনকার দিনে বামপন্থী ভাবধারার বুদ্ধিজীবীদের ওপর পুলিশ নজর রাখতো। দেবী রায় লক্ষ্য করলেন পুলিশের দুজন ইনফর্মার হাংরি আন্দোলনকারীদের যাবতীয় বইপত্র, বুলেটিন ইত্যাদি সংগ্রহ করে লালবাজারের প্রেস সেকশনে জমা দিচ্ছে এবং সেখানে ঢাউস সব ফাইল খুলে ফেলা হয়েছে।
আর বাংলা সাহিত্যে এমন ইশতেহার প্রকাশ করে আগাম ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনও আগে আসেনি। ফলে, চারপাশের সবাই নড়েচড়ে বসতে শুরু করে।
হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ইশতাহার নিয়ে প্রধান সম্পাদকীয় বের হলো যুগান্তরে। মলয় রায় আর দেবী রায়ের কার্টুন প্রকাশিত হলো দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায়। হেডলাইন হলো ব্রিৎস পত্রিকায়। সুবিমল বসারের প্রভাবে হিন্দি ভাষায় রাজকমল চৌধুরী আর নেপালি ভাষায় পারিজাত হাংরি আন্দোলনের প্রসার ঘটালেন।
আসামে ছড়িয়ে পড়ল আন্দোলন পত্রিকাগোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে। ছড়িয়ে পড়ল আন্দোলনের ছটা বগুড়ার বিপ্রতীক এবং ঢাকার স্বাক্ষর ও কণ্ঠস্বর পত্রিকাগুলোর সদস্যদের মাঝে।
কিন্তু এরিমধ্যে বিভিন্ন মহলের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিল আন্দোলনকারীদের প্রতি। বিশৃঙ্খলা, অশ্লীলতা আর নৈরাজ্যের আরোপ আনা হলো হাংরিগোষ্ঠীর প্রতি। অসন্তোষকারীরা অনেকে এই আন্দোলনকে ব্রিটেনের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও আমেরিকার বিট জেনারেশনের সঙ্গে তুলনা করল। যদিও মৌলিক চেতনায় হাংরির সাথে বাকি দুটোর কোনো মিলই ছিল না।
আর সচরাচর পত্রিকা যেমন-কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস, শতভিষা ইত্যাদি থেকে বিপরীতে গিয়ে হাংরি আন্দালনকারীরা তাদের পত্রিকার নাম রাখলেন জেব্রা, উন্মার্গ, ওয়েস্টপেপার, ফুঃ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প প্রভৃতি। নামগুলো মনে করিয়ে দেয় যেকোনো আন্দোলনই হয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে। হাংরিও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
হাংরিদের নিজস্ব কোনো নিজস্ব অফিস ছিল না। ১৯৬৩ সালের দিকে হাংরির কর্মী সুবিমল বসাকের আঁকা ড্রয়িং অশ্লীলতার অভিযোগ উঠলে কফি হাউজের সামনে তাকে বেদম মারধর করা হয়।
হাংরি আন্দোলনের ১৫ নম্বর বুলেটিন এবং ৬৫ নম্বর বুলেটিন যথাক্রমে রাজনৈতিক ও ধর্ম সম্পর্কিত ইশতাহার; যেটি ক্ষুদ্ধ করেছিল শাসকগোষ্ঠীকে। ফলাফলস্বরূপ ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় মলয় রায় চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং দাদা সমীর রায় চৌধুরী।
আনুমানিক সাত মাস পরে মানে ১৯৬৫ সালের মে মাসে মলয় রায় চৌধুরীকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। মলয় রায়কে অভিযুক্ত করা হয় প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটি অশ্লীল আখ্যায়িত করে। মলয় রায়ের বিরুদ্ধে মামলাটা দায়ের করা সম্ভব হয় তার নিজের দল হাংরির দুই সতীর্থ শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সুভাষ ঘোষ রাজসাক্ষী হওয়াতে! অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে হাংরি আন্দোলন যবনিকাপাত।
আরো দুজন সাক্ষীকে আনা হয় মলয় রায়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু কৌশুলির জেরায় তারা ভুয়া প্রমাণিত হয়। প্রসিকিউশন এবার মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী তোলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। গ্রেপ্তারের ভয়ে কেউ আর এগিয়ে আসেনি।
অবশেষে মলয় রায়ের পক্ষ থেকে সাক্ষ্য দেয় জ্যোতির্ময় দত্ত, তরুণ সান্যাল আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। শক্তি আর সুনীল ছিলেন পরম বন্ধু। অথচ সুনীল হাংরি আন্দোলনের সমর্থনে ছিলেন না। হাঙ্গামা বলে তিনি পূর্বে হাংরি আন্দোলনের সমালোচনাও করেছিলেন! অথচ হিসাবের পরিক্রমায় শক্তি চলে যায় হাংরির বিরুদ্ধে আর পাশে এসে দাঁড়ায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়!
মলয় রায় চৌধুরী জেলে থাকা অবস্থায় আমেরিকার ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে সংবাদ হয়ে যায়। যুগান্তরে ‘আর মিছিলের শহর নয়’ এবং ‘যে ক্ষুধা জঠরের নয়’ শিরোনামে প্রধান সম্পাদকীয় লিখেন কৃষ্ণ ধর। যুগান্তর দৈনিকে সুফী এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় চন্ডী লাহিড়ী কার্টুন আঁকেন। মার্ক্সবাদ ধারণ করা পশ্চিমের অনেক রাষ্ট্র মলয়ের জন্য কলম ধরে।
কিন্তু বিভক্তি শেষ টীকা একে দেয় হাংরিদের কপোলে। আর এই আন্দোলনের ব্যর্থতার সূচিকাগার এই বিভেদ। বুর্জোয়াতন্ত্র এভাবেই বিভক্ত সৃষ্টির মাধ্যমে আন্দোলনকে দমন করে দেয় রক্তাক্ত ময়দান ছাড়া। যেমনটা, প্যালেস্টাইনে ফাতাহ আর হামাসের মধ্যেও দেখা দিয়েছিল।
আজো ইন্দিফাদার স্বপ্নে হাজারো তরুণ শহীদ হয়ে যায়! বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিও স্বাধীনতার সময় এমন অজস্র বুর্জোয়া ভূ-পলিটিক্সের মুখোমুখি হয়। পরপর পাঁচবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটোর সম্মুখীন হতে হয় স্বাধীনতা বানচালের অপচেষ্টাই।
সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে চিহ্ণিত করতে অস্বীকার করেছিল হাংরি আন্দোলনের কর্মীরা। তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। কবিতাকে মধ্যবিত্ত গন্ডির বলয় থেকে মুক্ত করে শ্রমিকের ভাষায় উপস্থাপন করা। সেটা প্রথম করেন হাংরির কবি ও লেখক অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখ।
যেটা তখনও অব্দি বিবেচিত হতো অশ্লীল ভাষা আর ঝগড়া হিসেবে। যে বলয় থেকে খোদ বামপন্থীরাও মুক্তি দিতে পারেননি। এখানেই হাংরির স্বার্থকতা। সাহিত্য মূল্যায়ন হয়েছে সকলের তরে।
বামপন্থীদের মতো ইউথোপিয়ান স্বপ্নে বিলিণ না হয়ে হাংরির মলয় রায় চৌধুরী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ডিসটোপিয়ার দরবারি কাঠামো। তার নভেলা ‘ঘোগ’, ‘জঙ্গলরোমিও’, ‘জিন্নতুলবিলদের রূপকথা’তে এর স্বরূপ পাওয়া যায়।
সবচেয়ে বৈপ্লবিক উত্থান ছিল সাবঅলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের লেখকদের গুরুত্ব প্রদান করা। এমনকি হাংরি আন্দোলনে বুলেটিনের সম্পাদক ছিলেন চাষি পরিবারের সন্তান হারাধন ধাড়া। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ তৎকালীন কবিরা তার এমন সমালোচনা করেছিলেন যে তিনি শেষ অব্দি এফিডেভিট করে ‘দেবী রায়’ নাম নিতে বাধ্য হোন।
মহাকালের বৈতরণীতে আজো সাক্ষ্য হয়ে আছে একদল ক্ষুদার্তের বয়ানে ‘হাংরি আন্দোলন’ শিরোনামে। উঠে এসেছিল প্রান্তিক কৃষক থেকে অন্ত্যজ শ্রেণির কথা। মলয় রায় চৌধুরী বলেন,
আমার ছোটোবেলা কেটেছে ইমলিতলা নামে পাটনা শহরের এক বস্তিতে, যে-পাড়ায় থাকতো বিহারি অন্ত্যজ আর অত্যন্ত গরিব মুসলমানরা, যারা একটা উৎসবে পরা পোশাক পরের উৎসবে পালটাতো তাদের কাজ ছিল চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমারি, পিম্পগিরি, মেয়েদের বেশ্যাগিরি ইত্যাদি । পাড়াটায় নিষিদ্ধ বলে কিছু ছিল না যার দরুন আমি মধ্যবিত্ত বাঙালি মূল্যবোধের বাইরে গড়ে উঠেছি আর তাই ওই জীবন আর বাকজগত আপনা থেকে এসেছে আমার লেখালিখিতে।
হাংরির কথা উঠে এসেছে সমসাময়িক চলচ্চিত্রেও। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘বাইশে শ্রাবণ’ চলচ্চিত্রে নিবারণরূপী গৌতম ঘোষ! যাকে সৃজিত হাজির করেছিলেন একজন হাংরিয়ালিস্ট কবির চরিত্রে। সেই তুখোড় ক্ষ্যাপাটে নিবারণ সিস্টেম নিয়ে বলেছিল,
একটা পঁচে যাওয়া সিস্টেম, প্রত্যেকটা মানুষ পঁচে যাওয়া।
কয়েকটা লাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’ কবি রফিক আজাদ রচিত কবিতা। যেখানে কবি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে পরোক্ষভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন। এভাবেই প্রতিটি প্রতিবাদের স্বর প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয় সেই ষাটের দশকের একদল ক্ষুধার্তের কথা। তৎকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে সুশীল সমাজকে মুখোশ পাঠিয়ে এক উদ্যাম রাজপথের স্বপ্নে বিভোর ছিল যারা।
যারা প্রদীপ্ত স্বরে উচ্চারিত করেছিল ‘দয়া করে মুখোশটা খুলে ফেলুন’। আর কবি সাহিত্যিকদের জন্য বলা হয়েছিল ‘Fuck the Bastards of Gungshalik School of Poetry.’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন