বৃহস্পতিবার

জীবন প্রতিষ্ঠান : শৈলেশ্বর ঘোষ

জীবন প্রতিষ্ঠান : শৈলেশ্বর ঘোষ

দুঃসময়ে আমাদের জন্ম কয়েক হাজার বছরের বিশ্বাস যখন নষ্ট হয়ে গেছে। যে মূল্যবোধগুলি প্রধানতঃ ভারতীয় জীবনকে একটা ইতিবাচক ভিত্তিভূমির উপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিল তার আড়ালে কাজ করে যাচ্ছিল অবিশ্বাস ঘৃণা লোভ আর শোষণ প্রবৃত্তি—যাদের হৃদয় ও মন এই পাপগুলি দ্বারা পুরোপুরি কবলিত তারা শুধু নিজেরা মিথ্যা হয়েই থেমে থাকেনি, তাদের চারপাশে যারা আছে তাদেরকে মিথ্যায় রূপান্তরিত না করা পর্যন্ত তারা যথেষ্ট আনন্দিত হতে পারে নি। কয়েক হাজার বছরের হিন্দু সভ্যতা এবং দু’হাজার বছরের খ্রীষ্টিয় সভ্যতা মানুষের মানুষ-শোষণ প্রবৃত্তি সম্পর্কে কোন সচেতনতা দেখাতে পারে নি। পাপ ও দুঃখ সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে, অনেক উপদেশ দেওয়া হয়েছে কিন্তু সেগুলি কোন কাজে লাগেনি। অবৈধ ধারনার মতো ঈশ্বর ক্রমশঃ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। ন্যায় ও সত্যের সামগ্রিক বিনাশের মধ্যে জন্ম আমাদের। জীবনানন্দ এই অবস্থাকে বলেছিলেন, অন্তিম বিশ্বাসের মুহূর্ত—আমার মনে হয় শূন্যতার এই অতলস্পর্শী অন্ধকারে অবিশ্বাসেরও চূড়ান্ত বিসর্জন হয়ে যায়।
 

অবিশ্বাসও একটা অবলম্বনের মতো কাজ করে অনেক সময়। ‘আমি অবিশ্বাসী’—এটা তো একটা বিশ্বাসই। ফলে বিশ্বাসের ধ্বংসের পর কিছু সময়ের জন্য অবিশ্বাস মানুষকে, ইতিহাসকে, ধরে রাখে। কিন্তু শূন্যতার অতলস্পর্শী খাদে যে পড়ে তার মধ্যে আর অবিশ্বাসও থাকে না—পুরানো মূল্যবোধগুলি ধ্বংস হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু ঘটে—সে রূপান্তরিত হয় পরম শূন্যে—এরকম ভয়ঙ্কর শূন্যের মধ্যে আমিও নিজেকে আবিষ্কার করি এবং বুঝতে পারি আমারও মৃত্যু সম্পূর্ণ হয়েছে। নিজের এই অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হওয়া মাত্রই শুরু হয় যন্ত্রণা, অতল গুহা থেকে বেরোবার রাস্তাটা খোঁজা শুরু হয়—আমার কাছে এটা হ’ল জীবনের দিকে মৃতের অভিযাত্রা। আর এর প্রতি মুহূর্তের পরিস্থিতি ও ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া আমার রচনা। পুরানো ঈশ্বর মৃত এবং অপসারিত, সেই শূন্যে ঝলসে উঠছে বস্তুবিজ্ঞানের চমকপ্রদ আলোকছটা। চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে অন্ধকারের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমার সুবিধা, আমার চারপাশের অধিকাংশ মানুষকে দেখছি তারা মিথ্যা হয়েই থাকতে ভালবাসে, ফলে আমি হয়ে যাই একা, আমার সমস্ত যন্ত্রণা একাই ভোগ করতে হয়, একাই খোঁজতে হয়—আমার জ্ঞানের ভিতর এই অভিজ্ঞতা কাজ করে যে আমার মৃত্যু হয়েছিল। কে আমাকে মেরেছিল? নিঃসন্দেহে বুর্জোয়া ব্যবস্থার অসত্য মূল্যবোধগুলি। এই সত্য বুঝে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে মৃতের সক্রিয়তা। মৃত্যুর সমান এই শূন্যতার অন্ধকার চঞ্চল ও জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে আমার চেতনার সমসক্রিয়তায়। আমি মৃত কিন্তু মৃত্যু-সচেতন এই চেতনা আমাকে জীবনের দিকে নিয়ে যেতে চায়। সব হারিয়ে যে একদিন নিঃস্ব হয়েছিল আজ আর সে ততটা নিঃস্ব নয়, আজ তার আছে শূন্যতার চেতনা, গভীরতম অন্ধকারের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা চেতনাই সে মানুষকে জানাবে। জানতে চাওয়াই তার অস্তিত্বের সক্রিয়তা। সার্ত্র যখন জাঁ জেনে সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখেন : মার্কস সমাজকে বদলাতে চেয়েছিল, র‌্যাবোঁ জীবনকে বদলাতে চেয়েছিল কিন্তু জেনে কিছুই বদলাতে চান না। জেনে যদিও এরকম কোন অভিপ্রায় প্রকাশ করেন নি কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতাজাত চেতনাকে তিনি মানুষের কাছে উপস্থিত করার প্রেরণা পেলেন কোথা থেকে—নিজের চেতনাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাওয়াটাই সক্রিয়তা। যে অভিজ্ঞতাজাত-চেতনা সমস্ত মানুষের মধ্যে ঢুকে পড়বে এবং তাদের চেতনা সমুদ্রে পরিবর্তনের সম্ভবনা জাগিয়ে দেবে। মৃত যখন নিজের মৃত্যু-সচেতন হয়ে ওঠে তখনই তার পুনর্জন্মের সূচনা—পাতাল নদীর মত বহমান এক জীবনের দিকে সে এগিয়ে যেতে থাকে। এটা একটা সক্রিয় কিন্তু অবচেতনের ইচ্ছা, ইচ্ছার সৃষ্টি তার অভিজ্ঞতা চেতনা রাজ্যে।
 
আমি জীবনের উপর থেকে কুয়াশার পর্দ্দটা সরিয়ে ফেলতে চাই, মিথ্যার এই আবরণটাকে সরিয়ে ফেলতে পারলে দেখতে পাব এক অন্ধকার সমুদ্রকে—প্রকৃত ঘটনাগুলিকে চিনতে পারবো, শব্দের আসল তাৎপর্য বুঝতে পারব, অন্তত চেতনায় অবচেতন জগৎ স্পষ্ট হবে—মনুষ্যত্বহারা কুঁকড়ে যাওয়া আজকের পৃথিবীর মানুষ এটা দেখতে চায়না। কিন্তু যার না দেখে কোন উপায় নেই, আমি এরকম একজন। দেখি, দেখতে চাই।প্রথমে যাত্রা অজানার দিকে, এরপর উল্টো দিকে। অজানা থেকে সত্যকে জানার দিকে। অজ্ঞান থেকে চেতনায়। শূন্য অবস্থা থেকে হয়ে ওঠা। অজানার অতলস্পর্শী গহ্বর থেকে উঠে আসা জানায়, জ্ঞানে। একই অস্তিত্বের মধ্যে এই ভ্রমণ, তবে সুখকর ভ্রমণ নয়। রক্তক্ষয়ী অন্তঃসংগ্রামের অভিজ্ঞতা, এই ভ্রমণেরই অভিজ্ঞতা। বুর্জোয়া মূল্যবোধ জনিত ক্লান্তি অবসাদ ও মৃত্যু চেতনায় আচ্ছন্ন অবস্থা থেকে মুক্তির খোলা আকাশে উঠে আসার এই চেষ্টা। যে মুক্তি আমারই কিন্তু তা অন্যদেরও হতে পারে। একই সঙ্গে ইন্দ্রিয় থেকে চেতনায়, চেতনা থেকে ইন্দ্রিয়ে স্বচ্ছন্দ ও বাধাহীন যাতায়াত। এই হ’ল আমার প্রকৃত স্বাধীনতা। আজ দেখছি পৃথিবী কেবলই ইন্দ্রিয়পরায়নতা ও বস্তুসীমার মধ্যে সংকীর্ণ হচ্ছে এবং নিজের ধ্বংসের সম্ভাবনাকে স্পষ্ট করে তুলছে। ক্ষমতা-সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যস্পৃহা আর হৃদয়ের জাড্য এই হ’ল আজকের মানুষের সাধনা। ভালবাসা—টাকায় কেনা যায়। জীবন—বাড়ি, গাড়ি আর ব্যাঙ্কে সুরক্ষিত। ইতিহাসের নির্মমতম সময় এটা। সমাজ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ ডালপালা ধরে ঝুলে আছে এইসব মানুষেরা—ঝুলতে ঝুলতে চলছে এদের হাগামোতা মৈথুন ক্রিয়া, বংশবিস্তার, ক্ষমতাবিস্তার, শোষণ ও খুনের ষড়যন্ত্র! প্রত্যেকে প্রাণপণে ধরে আছে এক একটি ডাল। যত ক্ষুদ্রই সে ডাল হোক না কেন। প্রতিটি মুহূর্তেই এদের আতঙ্ক, বুঝি ঐ ডাল হাত থেকে সরে যায় বা সরিয়ে দেয়া হয়। এই ভয় মৃত্যু ভয়ের সমান। এরা জানে প্রতিষ্ঠান থেকে ছিটকে যাওয়া মাত্রই ঘটবে সেই সর্বনাশ! তখন সে পতিত—মূল্যহীন, নামহীন। আবার এই প্রতিষ্ঠানের ডাল যারা ধরতে পারেনি তাদের মর্মন্তুদ কান্না, যারা ডাল ধরে ঝুলে আছে তারা শুনতে পাচ্ছে। এরা মানুষ-ভাইরাস! এদের কাজ হ’ল অন্যের জীবনকে নষ্ট করা, অন্যের স্বাধীনতা হরণ করা, অন্যের সম্ভবনার দুয়ার রুদ্ধ করে দেওয়া। এই রক্ত পিপাসুর দল জানে জীবনে তারা মাত্র একবারই মরবে, কিন্তু তা তাদের জানা দরকার যে তারা ইতিমধ্যেই মৃত। এরাই জীবনের যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক প্রকাশ দেখামাত্র নিজেদের অহংসর্বস্ব দরজা ভালো করে এঁটে দেয়। এদের প্রতিষ্ঠান গণ্ডির বাইরে যা কিছু ঘটবে তাকেই এরা অপরাধ বলে চিৎকার করবে। এরা সমাজ প্রতিষ্ঠানের ডাল ধরে ঝোলে আর পায়খানা করে, এদের পায়খানার দুর্গন্ধে আবিল হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বাতাস। প্রতিষ্ঠানের তোয়াক্কা না করে যে কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ বেঁচে আছে তাদের শ্বাসকষ্টের কারণ এই। এদের পায়খানাতে ইতিহাসের আয়তন বেড়ে চলেছে। হায়, মানুষের ইতিহাস! আমাদের রক্ত আর চোখের জলে সন্তরণ এই ইতিহাসের। রক্ত? হ্যাঁ, সেই সব আত্মার—বিদ্রোহী ও সন্তের। চোখের জল? হ্যাঁ, আমাদের হৃদয়চক্ষু থেকে যে জল ঝরে। যারা দেখে তাদের চোখগুলি উপড়ে নেয়া হয়, হৃদয়ই চোখের কাজ করে, হৃদয়চক্ষু থেকে জল ঝরে। চক্ষুকোটর থেকে ঝরে আগুন। পৃথিবী তো আমাদের হৃদয়দৃষ্টি চিনতে পারে না এজন্য দীর্ঘশ্বাস… যারা গু থেকে রক্ত আলাদা করে নেয় তাদের মৃত্যুর মুখ্য কারণ এই-ই। এই অপরাধের ফলে গভীর, গভীরতর অন্ধকার ঘিরে ধরে আমাকে। ঈশ্বর নেই, কিন্তু মানুষ আছে, আছে মানুষের পৃথিবী—এটাই হ’ল এই পৃথিবীর চিত্র।
 
দুই
গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার…
আমি অনেক দিন
অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
হঠ্যাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে
বুঝতে পেরেছি আবার
ভয়পেয়েছি
অন্ধকার, সে কোন আলোর নাম? পৃথিবীতে এমন সব ঘটনা ঘটে, এমন সমস্ত শব্দ উত্থিত হয়, সন্ধিতে সন্ধিতে এমন সব অতি গোপন ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া চলে, ফলে জীবনে কোন হিসাবই ঠিকমত মেলে না। এজন্য দুঃখ হয় অনেকের কিন্তু সুনিশ্চিত নিয়ম কখনই কারও জন্য দুঃখিত বোধ করে না। জন্ম-জীবন ও মৃত্যু—এই তিন পয়েন্টের জটিলতাই এই অন্ধকার। আমাদের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই এই অন্ধকারকে বহন করে। বিভ্রান্তিকর অবশকারী ধাঁধার মত জীবনের রাস্তাকে অস্বচ্ছ করে এই অন্ধকারই। এই অন্ধকারের মধ্য থেকেই ক্রমশ জেগে উঠতে থাকে মৃত আত্মা—নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দই জীবনের ডাক, সেই ডাক যে শুনতে পায় সেই জানে জেগে ওঠার প্রকৃত অর্থ কি! তাকে বুঝতেই হয় পুনর্জন্মের এক প্রভাত অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। কিন্তু সে কি পারবে সেখানে পৌঁছাতে? সংশয় নিয়েই চলমান হতে হয়—বাস্তবে তাকে জেগে উঠতে হয় সেই একই পৃথিবীতে কিন্তু চেতনার রূপান্তরিত আলোয় উদ্ভাসিত নতুন এক পৃথিবী। জীবনকে তখন আর ‘শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর’ মনে হবে না, লোষ্ট্রের মত নিক্ষিপ্ত হয়ে সে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু নবজন্মের চেতনা তাকে গতিশীল এবং সক্রিয় করে তুলেছে। নিজের সম্পূর্ণ মৃত্যু দেখার পর সে ফিরে যাবে ঐখানেই যেখান থেকে তাকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে ফিরে গিয়ে আর ভয় কিসের? ভয়ের উৎসেই তো সে গিয়েছিল—এইসব অভিজ্ঞতার পর আর ভয় থাকে না।
 
আমার পূনর্জন্ম যদি সম্পূর্ণ হয় তবে ‘মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য’ নির্দ্দেশ কেউ আমাকে আর দিতে পারবে না। যে পৃথিবীতে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম চিন্তা কাজ—নিয়ত মৃত্যু যেখানে প্রতিটি মানুষকে চালনা করছে—সেই পৃথিবীর কাছে আমি মৃত, অনুপোযোগী। আমার হৃদয় থেকে মুছে গেছে ঘৃণা আর আক্রোশ।
 
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবীতে কোটি কোটি শূয়োরের আর্তনাদ-উৎসব চললেও আমাকে তা আর পীড়িত করতে পারবে না। সমস্ত দ্বন্দ্বের অন্তনির্হিত হাসি তখন আমি স্পষ্ট দেখে ফেলেছি। অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকে চাই না আর। এই অভিজ্ঞতার, এই সচেতনতার পর জীবন থেকে মৃত্যুর কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করা আমার কাছে নিষ্প্রয়োজন। মূল্যবোধগুলির বোঝা থেকে মুক্ত হওয়া মাত্রই অন্ধকারের অতল যোনি গর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলাম, সেটা আমি চাইনি, সেটা ঘটেছে, এইটুকু জানি—সেখান থেকেই আবার উঠে আসার, জেগে ওঠার চেষ্টা—জেগে ওঠা স্মৃতিহীন বসন্তে!
 
আমিষ অন্ধকার : বাবা ছেলেকে বলছে তুমি সকলের মত ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করতে শেখ, এই ইতিহাসই তোমার বর্তমান-ভবিষ্যৎ। চেয়ে দেখ কেউ হাগে আর কেউ সে গু বয়ে নিয়ে যায়। যে মাথায় গু তুলে নেয় সে তো আর মানুষ থাকে না, কেউ তাকে ছোঁয় না, ইতিহাস ওদের জন্য আলাদা বস্তি দিয়েছে—ওরা সেই বস্তিতে থাকবে, মাতলামি করবে বংশবিস্তার করবে—ইতিহাসের কলঙ্ক ওরা। কিন্তু তুই থাকবি সেই শ্রেণীতে, ইতিহাস যে শ্রেণীর দখলে! মা বলেছেন, মেনে নেয়াই ধর্ম। বাবাই তোমার পরিচয়, বাবার প্রতিবাদ করো না। ইতিহাসের অংশ হিসাবে নিজেকে প্রমাণ কর, এছাড়া তোমার অস্তিত্বের আর কোন অর্থ নাই। গর্ভ যন্ত্রণা পর্যন্তই তুমি সত্য ছিলে… আসুন আমরা একবার দেখি এই রোমান থিয়েটারে কি ঘটেছে : অন্ধকারের জরায়ুর মধ্যে এই থিয়েটারের অভিনয় চলছে—
 
প্রভুর খপ্পর থেকে পলাতক ক্রীতদাসকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে সেখানে দর্শকদের দাবীমত তাকে একবার হিংস্র ঘাতকের সামনে ছেড়ে দেখা হবে। ক্ষুধার্ত হিংস্র পশুর দাঁতে বিদ্রোহীদের ছিন্নভিন্ন হতে দেখে ভয়ঙ্কর যৌনপুলক হচ্ছে দর্শকদের। বন্ধনছিন্ন ক্রীতদাসের তো দৃষ্টি ছাড়া আর কোন অস্ত্র নাই—হিংস্র পশুর প্রতিটি আক্রমণে দর্শকদের মুখের বীভৎস বিকৃতি ও চাপা শীৎকার—আর তখনই বেড়ালের মুখে ধরা ইঁদুরের মুখে হাসি। যতবার ঐ জানোয়ার হত্যা করে আমাকে ততবারই নতুন জীবন লাভ করি আমি, জানি, জিতব আমিই। প্রতিটি আক্রমণে ক্রীতদাসের দাস-চেতনাই ধ্বংস হবে, অবশিষ্ট থাকবে যেটুকু তাই তার প্রকৃত জীবন, অথ্যাৎ মুক্তি চেতনা। বন্ধছিন্ন ক্রীতদাসই কেবল ইতিহাসে গু আর রক্ত আলাদা করতে পারে। লুসিফার ঈশ্বরের সাম্রাজ্য পাপে ঢেকে দাও! জন্তু-মানুষ নিজের অরণ্য সীমাকেই স্বাধীনতার চৌহদ্দী বলে মনে করে, প্রবৃত্তির ক্রীতদাসেরা প্রভুদের মুখের হাসিকেই সূর্যের মত দেখতে চায়। প্রভু খুশী হয়ে পিঠে চাপর দিলেই চরিতার্থ তাদের জীবন। অমরতা এই ক্রীতদাসদেরই!! আমাদের শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন অন্ধকার ঘিরে রাখে, আর অন্ধকারেই ক্রমশ বীতকাম হই আমরা, অপরাধ-চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে উঠে আসতে হয় আমাদের, সমুদ্র হৃদয়ের চিরন্তন পবিত্রতার কাছে।
 
তিন
ইতিহাস আমাদের বলেছিল : নিজের বিষ্ঠার দিকে তাকাবে না, নিজের যৌনাঙ্গ দেখাবে না—
দুর্ভাগ্য ইতিহাসের যে আমি তাই করেছি—
ইতিহাস বলেছিল, ভাল হও
শোষণ যুদ্ধ ধ্বংস ও মৃত্যু—এই তো ইতিহাস। জীবন প্রতিষ্ঠানের প্রধান মুখভঙ্গী এগুলিই। অসচেতন ভাবে ভাল হওয়ার অর্থই হ’ল এই প্রতিষ্ঠানের কাছে বলি হওয়া। এই ইতিহাসের উল্টোদিকের রাস্তা ধরতে হয়েছে সৃষ্টিশীল, মানুষদের—কবরের শৈত্য, শ্মশানের উৎসবের মধ্যে সুস্থভাবে শ্বাস নেয়া সম্ভব নয়। যেতে হয় এর উৎস পর্যন্ত।
ইতিহাস আমাদের বলেছিল : কবিতা-শিল্প, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দান—কবি-শিল্পীকে ইতিহাস মাথায় তুলে রাখে, পুরস্কার দেয়, ইতিহাসে তুমিও জায়গা পাবে—সৌভাগ্যবশতঃ আমরা বুঝতে পারি এই বুর্জোয়া শিল্প-কবিতা মানুষের জীবনের দুর্ভাগ্যচেতনার, অর্থহীন ধাঁধার মধ্যে কোন আলোরশ্মি ফেলতে পারে নি। বুর্জোয়ার এই খেলা জীবনের অন্তর্গত অন্ধকারকে লুকিয়ে রাখার নিকৃষ্ট চালাকি মাত্র। তাই আমরা মনে করি জীবন অভিজ্ঞতার উলঙ্গ প্রকাশই কবিতা-সত্য। অভিজ্ঞতাই চেতনা সমুদ্রকে আলোকিত করে, এই আলোড়ন ও মন্থনের ফলে উঠে আসে জীবনের তলদেশে লুকান সত্যগুলি, আর ঐ সত্যগুলির মধ্যে থাকে আমার পরিচয়। জীবন-প্রতিষ্ঠানের অপরাধীরা এই অভিজ্ঞতাকেই ভয় পায়। লরেন্স বলেছিলেন—’পৃথিবী কোন নতুন তত্ত্বকে ভয় পায় না, ভয় পায় নতুন অভিজ্ঞতা।’ এই অভিজ্ঞতাই জীবন-প্রতিষ্ঠানের ধারক বাহকদের মুখ একেবারে হাট করে খুলে দেয়। যারা অপরাধী নয় এমন কিছু মানুষ তো নিশ্চয় আছে, এই অভিজ্ঞতাগুলি তারাও গ্রহণ করে, তাদের চেতনা-আকাশ আরও সত্য করে এই নতুন অবিজ্ঞতা। যে রচনা কোন নতুন অভিজ্ঞতা নয়, তা কোনসৃষ্টিই নয়।
 
মহত্বের পাগড়ী, করুণার নামাবলী, ইতিহাসের পেচ্ছাপখানা থেকে কোন জীবিত মানুষই তুলতে পারে না।
শেষ ধ্বংসের আগে অপরাধীর সবগুলি ইন্দ্রিয় একসাথে মুক্তি চাইছে আজ।
 
চার
তোমাদের আত্মপ্রদর্শনীই তোমাদের ভালবাসা। গ্রাস করাই তোমাদের ভালবাসা; আর যা গ্রাস করতে পারে না তার উপর পেচ্ছাপ কর—কিছুই ফিরিয়ে দিতে জান না তোমরা—নিষ্কলঙ্ক জীবনকে তোমরা ভয় পাও সবচেয়ে বেশি। তোমাদের অপরাধী আত্মা আতঙ্কে শূন্য হয়ে আছে—এই গ্রহটাকেই উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের অপরাধ থেকে মুক্তি চাইছ তোমরা। নিজেদেরই ঘৃণা কর তোমরা, শেখাতে চেয়েছিলে আমাকেও তাই। তোমরা যা দেখনা আমি তাই দেখি, আমাকে তাই আক্রমণ কর তোমরা—তোমাদের প্রতি আক্রমণে আমি মরি কিন্তু হৃদয়চক্ষু দিয়ে সেই মৃত্যু ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পারি এবং তাকে প্রকাশ করতে পারি। নিজের মৃত্যু ঘটনা প্রকাশ করাই আমার বেঁচে ওঠা। এই মৃত্যু ও পুনর্জন্মই আমার ইতিহাস। আমি আর অন্য কোন মুক্তিতে বিশ্বাসী নই—প্রতিটি মৃত্যুর পর প্রতিটি জীবনই আমার মুক্তি। এখন কাজ একটাই—ফাঁসীকাঠে ঝোলান দড়িটা বিচারকের গলায় পরিয়ে দেওয়া।
 
পাঁচ
তোমরা সুস্থ পৃথিবীর কথা বল; কিন্তু পৃথিবী তো কোনদিনই সুস্থ ছিল না—প্রতি শিরায় যার অসুখ নাই তার নামই মানুষ। মানুষ এক বিশৃঙ্খল সংগঠন। তার মাথা যা ভাবে মুখ তা বলে না, হৃদয় যা অনুভব করে মাথা তা অস্বীকার করে, প্রকৃতি যা নির্দেশ করে কর্ম সে পথে যায় না, হাত যা করতে চায় মন তার প্রতিবাদ করে, মন যা স্বাভাবিক ভাবে হাত তা করতে দ্বিধা করে—এই সামগ্রিক বিশৃঙ্খলা, এই আবর্তিত দ্বন্দ্বের নাম মানুষ। কিন্তু বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে এক কেন্দ্রিয় আবেগ কাজ করছে—সেই আবেগই কবিতা। জীবন বহমান আছে বিপরীতমুখী শক্তিগুলির ঘাত প্রতিঘাতে, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায়। প্রকৃত সাহিত্য এই দ্বন্দ্বের ক্রমপ্রসারিত চেতনা। মানুষের ভিতরের নাটবল্টুগুলোর পারস্পরিক ধাক্কাধাক্কির যে প্রবলতর যন্ত্রণা, তা থেকে মুক্তি চায় মানুষ, ধর্ম তাকে একদিন এই মুক্তি দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মানুষ অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব, যন্ত্রণা ও অসুস্থতা থেকে পরিত্রাণ খুঁজেছিল ধর্মের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে। অস্তিত্বের বিশৃঙ্খল ও বিপরীতমুখী প্রবণতাগুলিকে নিয়ম ও শৃঙ্খলে বাঁধতে চেয়েছিল ধর্ম। কিন্তু কোন ধর্ম আচরণ দ্বারাই মানুষের মুক্তি আসে নি। ধর্মপ্রাণ আর ধর্মহীন আজ মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আছে এবং দু’জনের মুখাবয়কে আর আলাদা করা যাচ্ছে না। উভয়েই একই অপরাধ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়েছে। জীবনের আমিষ অন্ধকারকে অর্থদান করে তাকে স্বচ্ছ করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে তথকথিত ধর্ম-দর্শন। কবির অনুসন্ধানে এই সব দর্শন কোন আলোই ফেলতে পারে না। ব্যতিক্রম কিছুটা গৌতম, ভয়ঙ্কর অন্ধকারে নিজের শব ত্যাগ করে সে পুনর্জন্ম লাভ করে বুদ্ধ হয়েছিল।
 
কবির ধর্ম—আমি মনে করি আত্ম বিস্ফোরণ, আত্মাবিষ্কার ও আত্মউন্মোচন। অস্তিত্বের সামগ্রিক বিশৃঙ্খলাকে সত্য সৌন্দর্যে সাযুজ্য দান করে কবি নিজেই এক ধর্ম। দুরূহ পথেই তাকে আত্মধর্ম আবিষ্কার করতে হয়। আর অসত্যে জারিত জীবনকে আক্রমণ করে তবেই তাকে পৌঁছাতে হয় সত্য-ধর্মে।
 
বুর্জোয়া শোষণে আর পচামূল্যবোধগুলির চাপে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে শূন্য হয়ে মানুষ আশ্রয় নেয় ধর্মগুরুর কাছে—আর বুর্জোয়া নিজেও নিজেরই মূল্যবোধে মিথ্যায় পরিণত হয়ে আশ্রয় করে ঐ এক ধর্ম আর ধর্মগুরু। শোষিত আর শোষক একই ঘাটে জল খেতে থাকে, এটাই হল বুর্জোয়া ইতিহাসের চমকপ্রদ অধ্যায়—তালগোল পাকান এক মিলন, যা থেকে সত্যকে বের করে আনা প্রায় অসম্ভব। জীবন প্রতিষ্ঠানের লুকান মুখটি হ’ল এই সব তথাকথিত ধর্ম। বুর্জোয়া ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য একের পর এক জীবন বিরোধী সংস্কারের জন্ম দিয়ে চলে তথকথিত এই ‘ধর্ম’। কবির মৃত্যু তখনই হয় যখন সে মাথা মুড়িয়ে ফ্যালে—ধর্মতত্ত্ব বা দর্শনের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে—ব্যক্তিগত সমাধান চায়। যে কবি, তার কোন ব্যক্তিগত সমাধান নাই, কারণ সে আর কোন ব্যক্তি মানুষ মাত্র নয়। চলমান জীবনে তাকে হুটোপুটি খেতেই হয়, না হলে সে থেকে যাবে এক নঙর্থক শূন্যে। প্রবাহমান মানবচেতনার সক্রিয় অংশ সে—সেই প্রবাহমানতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মাত্রই তার অপমৃত্যু। ব্যক্তিগত সমাধান নেয়া মাত্রই সে বিচ্ছিন্ন এবং মৃত। সে তখন সমাজ রাষ্ট্রের এক সাধারণ সদস্য—এছাড়া তার অন্য কোন পরিচয় থাকে না। কবি এজন্যই জীবন প্রতিষ্ঠানের মারাত্মক গ্রাস সম্পর্কে সচেতন থাকবেন। কবির কোন ব্যক্তিগত দুঃখ, ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, ব্যক্তিগত কষ্ট থাকে না। দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা একাকীত্ব আনন্দ ভালবাসা ও ভালবাসাহীনতা—যা সে নিজের অভিজ্ঞতায় লাভ করে, সেগুলি সবই সমগ্র মানবচেতনার। কবি এই চেতনার প্রতীক। সে রূপান্তরিত চেতনা এবং সত্য-ধর্ম। জীবন প্রতিষ্ঠানে বুর্জোয়া-অপরাধ সম্পর্কে যার হৃদয়ে কোন ঘৃণার সৃষ্টি হয়নি, যে মনে প্রাণে এই ব্যবস্থাকে সেবা করে, পুরস্কৃত হয়, সে কখনই নিজেকে রূপান্তরিত করতে পারে না সত্যে। শব্দ দিয়ে ‘শিল্প’ সৃষ্টির দরকার হয় তারই। তথকথিত ধর্ম আর ‘শিল্প’ এগুলি জীবন প্রতিষ্ঠানের ছলনাময়ী হাসি মাত্র!
 
নিজের স্বাধীনতায় আমি হতে চাই আমারই ঈশ্বর—এক জীবনেই বহু জন্ম বহু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পৌঁছাতে হবে এই লক্ষ্যে—মুক্তির, জ্ঞানের উপত্যকায়!
—ক্ষুধার্ত (১৯৮৪)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন