মঙ্গলবার

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : অধ্যাপক তরুণ মুখোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ

বিশ শতকের ষাট বা ছয় দশক বাংলা কবিতার ইতিহাসে যে কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে, তার মধ্যে 'হাংরি আন্দোলন' অন্যতম, এ বিষয়ে দ্বিমত নেই । আর সেই হাংরি আন্দোলনের অন্যতম নেতা মলয় রায়চৌধুরী, যিনি আজও সৃজনক্ষম । কারো আনুকূল্য বা হাততালির প্রশংসা করেন না । ভুল কি ঠিক, সে বিচার করবে ইতিহাস বা মহাকাল । পরোয়াহীন এই লেখককে তাঁর নিজস্ব ভাষামুদ্রা ও ভঙ্গির জন্য অভিবাদন জানাতেই হয় । তথাকথিত বিপ্লবী কবি না হয়েও, কবিতার অস্ত্র প্রয়োগে তিনি সংগ্রামী কবি হতে পেরেছেন ।

১৯৬১ সালের নভেম্বরে হাংরি আন্দোলনের যে বুলেটিন প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে চোদ্দোদফা দাবি পেশ করা হয়। যার মধ্যে উল্লেখ্য :-
1. The merciless exposure of the self in its entirety.
2. To present in all nakedness all aspects of the self and thinking before it.
3. To challange every value with a view to accepting or rejecting the same.
4. To use the same words in poetry as are used in ordinary conversation.
5. To reject traditional forms of poetry and allow poetry to take its original forms.

আমরা জানি প্রথা ভাঙার এই স্পর্ধা তখন সরকার মানতে পারেনি । কাব্যে অশ্লীলতার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয় ।

বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পর নতুন সুর শুনিয়েছিলেন তিরিশের কবিরা । চল্লিশের কবিদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রতিবাদী ভঙ্গি আরেকমাত্রা যোগ করেছিল । আত্মকথন ও আত্মরতিকে সম্বল করে অন্য রকম স্বাদ নিয়ে এলেন পঞ্চাশের কবিরা । আর ষাটের কবিরা, বিশেষভাবে 'হাংরি আন্দোলন' আমূল নাড়া দিল বাংলা কবিতার সনাতন ঐতিহ্যকে, নিয়মানুবর্তিতাকে । কবিতার ভাষায়, ছন্দে, অলংকারে, স্তবকে, তুমুল ভাঙচুর পাঠকের অভ্যস্ত চোখ ও কানকে বিব্রত করে তুলল । বিশেষত মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় যৌনতার সঙ্গে এলো ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও অসহায় মানুষের নিষ্ফল যন্ত্রণা ।

কিভাবে মলয় রায়চৌধুরী তাঁর কবিতায় আত্মপ্রক্ষেপণ ঘটিয়েও নিরপেক্ষ হয়ে যান, সামাজিক ঘটনার দ্রষ্টা হন, নির্মম সমালোচনায় শাণিত ইস্পাত হয়ে ওঠেন, তাঁর কবিতাগুলি পড়লে টের পাওয়া যায় । তাঁর "কবিতা সংকলন"-এর নানা মেজাজের আটটি কবিতা আলোচনা করে তাঁর কবি কৃতি ও কবিস্বরূপ বুঝতে ও বোঝাতে চেষ্টা করা যাক । আলোচিত কবিতাগুলি হলো -- কামড়, ফুলিয়ার হাতটান, উৎখাত, তুলকালাম আত্মহত্যা, কপর্দকহীনতা, লোহার রড, রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা, প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ।

'কামড়' নামাঙ্কিত কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী যে ভঙ্গিতে ভারতবর্ষকে প্রশ্ন করেছেন, বিদ্রুপ করেছেন, পড়তে পড়তে মনে হয় সত্তরের কবি সুবোধ সরকার মলয়ের কাছে অধমর্ণ । ধান্ধাবাজ সুবিধাবাদী এই দেশের চরিত্র, মানুষের প্রকৃতি, নিপুণ ভঙ্গিতে তিনি তুলে ধরতে পেরেছেন--

আর কোল্কাতা এখন নিম রেনেসঁসের ভেতর দিয়ে কোথায় যাচ্ছে জানি না
ভারতবর্ষ দু'চারটে লেখা ছাপিয়ে দিন না উল্টোরথ, দেশ, নবকল্লোলে
আমিও মনীষী হয়ে যাই, কিংবা শান্তিনিকেতনে নিয়ে চলুন
সাহিত্যের সেবা করব, ধুতি-পাঞ্জাবি দেবেন একসেট
আজ বিকেলে চলুন খালাসিটোলায় বঙ্গসংস্কৃতি করি ।

শেষ পর্যন্ত মলয়ের সুতীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, "নিজের হৃৎপিণ্ড খেয়ে নিজের সঙ্গে রফা করে নিলে কেমন হয়"? এই ব্যঙ্গাত্মক মনোভাবেই তিনি দেখেন, "পায়রার বুকে টাইম বোমা বেঁধে শান্তির জন্য ওড়ানো হচ্ছে" ( ফুলিয়ার হাতটান ) । পিকাসোর আঁকা শান্তিদূতও আজ নিরাপদ নয়, প্রতারক -- অন্তত নেতাদের হাতে । এই মর্মান্তিক সত্য মলয়ই পারেন উচ্চারণ করতে ।

তাঁর অন্যান্য কবিতার মধ্যে পাই আত্মবীক্ষ্ণণ ও আত্মসমালোচনা । যেমন 'কপর্দকহীনতা' কবিতায় লিখেছেন--

আদালতের পেঙ্গুইনদের সঙ্গে খেলা করে এলুম
আমার এই কাঁতড়া চেহারা দেখে বুঝে নাও
প্রজ্ঞাহীন হতে চেয়েও কিছু হল না ।
*                 * *
কাঠমগজ কাঠমগজ
নিজেকে বিশ্বাস করা গেল না ।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মিশেল এখানে আছে । আদালত ও পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ কবি ঠাট্টা করে বলেন,

এদের পুলিশ আমার চুলে সরেজমিন তল্লাশি চালিয়েছে
এক জোড়া পাকাচুল ধরে নিয়ে গেছে  ( লোহার রড )

পৃথিবীর আকার, আয়তনের অভ্যস্ত ধারণায়  ( 'পৃথিবী গোলাকার কমলালেবুর মতন' ) পদাঘাত করে মলয় লেখেন -- "অণ্ডকোষের কাছে বাড়া-কমা শিখছে পৃথিবী" । কিরকম জীবন তিনি কাটাচ্ছেন, কোন সমাজে ও পরিবেশে বাস করছেন, তারও ছবি অকপটে আঁকেন কবিতায় ---

চশমার কাচে চুয়ে পড়ে কুয়াশায় হাওয়া-ধোনা শিশিরের ধাতুরস
পিরানহা মাছের ঝাঁকে-ঝাঁকে সাঁতার কটি মনে হয় ( উৎখাত )

যাঁরা মনে করেন আত্মরতিই এই কবির আশ্রয়, ভুল করেন । চারপাশের জীবন ও জগতকে তিনি গভীরভাবে দেখেছেন । জেনেছেন । 'বেঁচে থাকা বা প্রেম' এবং মৃত্যু তাই সমার্থক হয় তাঁর কাছে আর বুঝে যান 'হৃদয় নামে কিছু নেই' । দ্রষ্টা কবির বোধিলাভ এইরকম ---

ছাপার অক্ষরের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেল এবার
সভ্য ও সংস্কৃতিবান হয়ে মানুষের লাভ হয়নি
মূর্খ বেড়েছে  ( তুলকালাম আত্মহত্যা )

সংবাদনশীল ও সামাজিক একজন কবির পক্ষে এই অভিজ্ঞতা মর্মান্তিক । কবিতার শেষাংশে মলয়ের হাহাকার সহৃদয় পাঠককে স্পর্শ করে, কষ্ট দেয়--

এককালে সুন্দর ও শিব ছিল সত্য
যুক্তি ছিল সত্য
ঈশ্বর ছিল সত্য
অ্যাজটেকরা মৃত্যুকে সত্য বলে মনে করেছিল
এখন আত্মহত্যা ছাড়া সত্য নেই
যুক্তিহীন দেহে দায়িত্বরহিত চুমো
বাঁচতে দাও কিংবা মরে যেতে ( তুলকালাম আত্মহত্যা )

এ যেন আলবেয়ার কামুর 'মিথ অফ সিসিফাস' -- অ্যাবসার্ড জগতে অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত হওয়ার আর্তনাদ । এই সুরই যেন একটু অন্য ভাবে পাই 'রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা' কবিতায় । তথাকথিত রবীন্দ্রবন্দনা ও বিরোধিতায় না গিয়ে ষাটের কবি আত্মকথনে মগ্ন হন । চারপাশের যে ভাঙন, হত্যা, সন্ত্রাস, হৃদয়হীনতা -- দেখতে দেখতে কবি অস্হির হয়ে ওঠেন ।

হরিণের মাংস কাটা হয়েছিল কোদাল দিয়ে
আমার ছেলেমেয়েরা খরগোশের চোখ উপড়ে
                     খেলা করেছিল বেতলার দুর্গে

নতুন প্রজন্ম কিভাবে হিংসা ও হিংস্রতায় দীক্ষা নিয়েছে, এ যেন তারই দলিল । যেখানে রবীন্দ্রনাথের সত্য-সুন্দর-মঙ্গল ব্যর্থ । বেঁচে থেকে পৃথিবীকে মধুময় বলা আর সম্ভব নয় । অসম্ভব চলে যাবার আগে পৃথিবীকে প্রণতি জানিয়ে তারই মাটির তিলক কপালে এঁকে নেওয়া । বরং কবি বলতে পারেন --

অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে আমার লাশ বাঁচিয়ে তুলতে চাইছি
আমাকে ক্ষমা করুন ।

মলয় রায়চৌধুরীর খয়াত-অখ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা যে কবিতার জন্য তার নাম 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' । যে কবিতার পরতে পরতে মিশে আছে যৌনতার আমিষ গন্ধ । ১৯৬৩ লেখা এই কবিতা যখন ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়, তখন দেশকালের পরিস্হিতি কেমন ছিল, তা এক নজরে দেখে নিতে পারি ।

ক) চীনে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ।
খ) দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যাণ্ডেলার কারাদণ্ড ।
গ) চিন-ভারত যুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন ।
ঘ) হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ।
ঙ) প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর মৃত্যু ।

এই পটভূমিতে অতি-ব্যক্তিগত কবিতা লিখলেন মলয় । তাঁদের ইস্তাহারে যা বলেছিলেন -- Merciless exposure of the self বা  Nakedness of all aspects of the self --- এখানে তা পাওয়া গেল, কবিতার ভাষায়, গঠনেও প্রথাভাঙা হলো । মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করলেন, অস্বীকৃত হলো Traditional form শুধু গদ্যকবিতা রূপে নয়, শব্দ ব্যবহারে তিনি নিজস্বতা মুদ্রিত করলেন । লিখলেন --- কোর্বো, তর্মুজ, পার্ছিনা, কোল্কাতা, ওর্ফে, চুর্মার, জাফ্রান ইত্যাদি শব্দ । অকথ্য শব্দ ব্যবহারেও তিনি অলজ্জিত --- 'ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম' । কবিতার মধ্যে যৌন রসাত্মক শব্দ, বাক্য ও ভাবনা অজস্র ছড়িয়ে আছে । কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পংক্তি উদ্ধৃত করছি ---

১. আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
২. শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
৩. তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও
৪. আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ করতে দাও
৫. পায়জামায় শুকিয়ে যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে

শুভা নাম্নী নারীর কাছে এই ধরণের কাতরোক্তি কবি করলেও, আসলে যেন যৌনগাথা রচনা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না । যুগজ্বরে আক্রান্ত কবি যেন নিরাপত্তাহিনতায় ও আশ্রয় প্রার্থনায় আকূল হয়েছেন । যেমন, ষাটের আরেক কবি, ভাস্কর চক্রবর্তী নিরাশ্রয় মানসিকতায় বলেছিলেন, "শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা, আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব" । মলয় এই পলায়নী মনোভাবের বদলে অনুভব করেছেন, "নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই"। হতাশায় কবি বলেছেন, "কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই" । আমাদের সৌভাগ্য, মলয় রায়চৌধুরী কবিতার জন্য আজও বেঁচে আছেন ; যুদ্ধ করে চলেছেন । তাঁর সংগ্রামের হাতিয়ার কবিতাই ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন