রবিবার

সুভাষ ঘোষের চিঠি -- মলয় রায়চৌধুরীকে

শনিবার
২২/৫/১৯৬৫
মলয়
এক্ষুনি তোমার চিঠি পেলাম --- আমার লেখা যা মোট ৮ পৃ ছাপা হয়ে গেল আজ -- তোমার দেরি দেখে গত এক সপ্তাহ ধরে তোমাকে অনন্ত পাঁচটি চিঠি দিয়েছি, আমি ব্লক ফটোর অলরেডি তৈরি করেছি --- লেখা ছাপিয়েছি ২০০ --- তুমি তো সব প্ল্যান গণ্ডোগোল করে দিলে still আমি তোমার ২৫০ কভারের জন্য আগামি ,ঙ্গলবার অবধি অপেক্ষা করব । প্রেসে সব ছাপিয়ে পুরো মাল পাঠিয়ে দেবো তোমাকে -- আর যদি না পাই তাহলে ৪০০ আর্ট পেপারে আমার ফটো ও ওই লেখা extra ছাপিয়ে দেবো তোমাকে ---

হ্যাঁ, যা বলছিলাম -- ক্ষু.প্র.তে হারাধনের বইয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে বলে ওর লেখা জেব্রাতেও ছাপা হবে -- এরকম কথা আছে নাকি ? কই তোমার সঙ্গে দেখা হল যখন এরকম বললে না তো--- এই তোমার দোষ-- আমি তো তখন হারাধনের লেখা গুণগত যোগ্যতা না থাকায় ছাপতে বারণ করেছিলাম তোমাকে -- গুণও বড় কথা নয় --- আসল কথা দেবী রায়ের ক্লিক + এক্সপ্লয়টেশান+নোংরামি ।

আসলে ওর লেখা যখন ক্ষু.প্র.তে ছাপা হচ্ছে না জানল তখন মরিয়া আরকি -- আর তো --হেঁ..হেঁ । তুমি তখন জিগ্যেস করলেও আমি পরিষ্কার করতাম সব -- ফলে তুমি জেব্রা থেকে ওর লেখা withdraw করে নাও । ওর নাকি সব বিদেশি নাঙরা ১০০০-১০০০ পৃষ্ঠার প্রশংসা পাঠিয়েছে -- ওই নিয়ে থাকুক ও --- OK ---ভালোবাসা নিও
                                                 সুভাষ ঘোষ

( সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরিতে ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ এবং জেব্রা পত্রিকায় দেখা যায় যে ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ পত্রিকা থেকে মলয় রায়চৌধুরী ও দেবী রায় উভয়কেই বাদ দেয়া হয়েছিল । দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীকে অপমান করার জন্য শৈলেশ্বর ঘোষ বেনামে দেবী রায়চৌধুরী নাম দিয়ে নিম্নমানের রচনা ক্ষুধার্ত পত্রিকায় প্রকাশ করতেন । জেব্রা পত্রিকায় সুভাষ ও দেবী রায় উভয়েরই রচনা প্রকাশিত হয়েছিল । )

 

শুক্রবার

সুবিমল বসাকের চিঠি -- বাসুদেব দাশগুপ্তকে -- কলেজ স্ট্রিটে ত্রিদিব মিত্রকে সাহিত্যিকদের শাসানি

প্রিয় বাসুদেব
তোমার ১৬ তারিখের পোস্টকার্ড পেয়েছি । মলয়ের খবর জেনেছ নিশ্চয়ই । ওর আসার কথা কোলকাতায় । সুভাষের সঙ্গে গতকাল দেখা হয়েছে, জানালো মলয় অফিসে জয়েন করে আসবে -- তার জন্য সার্টিফায়েড কপির দরকার । কোলকাতা কেমন ঠাণ্ডা মেরে গেছে । আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্র হয়ে উঠেছে । ত্রিদিব আজ জানালো, ওকে ৩/৪ দিন আগে কলেজ স্ট্রিটে ধরেছিল এবং শাসিয়েছে, "এদিকে আসা বন্ধ করে দেব" বলে । এইসব চলছে ।

"জেব্রা"র পোস্টার করো তিনটে - বড় সাইজের । লেখকসূচীর নামগুলো দিও । মঙ্গলবার বা শনিবার নাগাদ বেরিয়ে পড়বে মনে হয় । ভালোবাসা নিও । শারীরিক ও মানসিক দু'দিক দিয়েই আমি ভালো নেই ।
                                                    সুবিমল
                                                ৬ আগস্ট ১৯৬৭

গল্প চেয়ে বাসুদেব দাশগুপ্তকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি

অধুনা, ১৭/১ডি, সূর্য সেন স্ট্রিট
কলকাতা -- ১২
প্রিয় বাসুদেব
"আজকের গল্প" নামে একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হবে শিগগিরই । 'অধুনা' এটি প্রকাশ করছেন । এতে সাম্প্রতিক কালের লেখকদের গল্প থাকবে, কোনোক্রমে আমি এর সম্পাদক । আমার ইচ্ছে, এতে আপনার একটি গল্প থাকুক । আপনার গল্প আমার অনেকদিন থেকেই ভালো লাগে । আপনার 'রিপুতাড়িত' গল্পটি আমি এই সংকলনে রাখতে চাই । আশা করি এতে আপনার কোনো আপত্তি হবে না । অবিলম্বে আপনার সন্মতি জানালে খুব ভালো হয় । 
                                         ভালোবাসা নেবেন
                                       সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
                                          ২৮ জুন ১৯৬৮
পুনশ্চ : যদি আপনার সন্মতি থাকে, আশা করি নিশ্চয়ই থাকবে, তবে আপনার জীবন সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য যেমন খুশি উপায়ে জানাবে ।

( বাসুদেব দাশগুপ্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেসব কথা নিজের জীবনী থেকে বাদ দিয়েছেন । )

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে হাংরি লেখক বাসুদেব দাশগুপ্তের চিঠি -- সংকলনে গল্পের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান

সুনীলবাবু
আপনার চিঠি পেলাম । নানান বাজে কাজে ব্যস্ত থাকার দরুন উত্তর দিতে একটু দেরী হল । আমার লেখা আপনার অনেকদিন থেকেই ভালো লাগে জেনে খুশি হলাম । আপনার মতো একজন নামী পাঠক পাওয়া আনন্দেরই কথা । "আজকের গল্প" কোন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদনা করছেন ? ইনিই কি তিনি যিনি আমেরিকা থেকে ফিরে এসে রূপচাঁদ পক্ষীর হয়ে হাংরি জেনারেশন সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করেছিলেন ? ইনিই কি তিনি যিনি কৃত্তিবাসের একটি সংখ্যায় হাংরিদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলেন ?
ইনিই কি ছদ্মবেশী সনাতন পাঠক যিনি দেশের পাতায় লিখেছিলেন "এদের লেখা কিশোর বয়সের ডায়েরি মাত্র" ? যদি তাই হয়, এই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার সম্পাদিত সংকলনের যোগ্যতা হারিয়েছেন ।
                                            নমস্কারান্তে
                                             বাসুদেব দাশগুপ্ত
                                             ১২ জুলাই ১৯৬৮

মঙ্গলবার

প্রদীপ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় -- হাংরি জেনারেশন আন্দোলন

প্রশ্ন : প্রদীপবাবু, আপনি ফরাসি সাহিত্যে আগ্রহী এবং ফরাসি ভাষা ভালো জানেন । শোনা যায় এই যোগাযোগের সূত্রে আপনাকে মাঝে-মাঝেই ইউরোপ আমেরিকায় যেতে হয় । শুনেছি কলকাতায় আপনি যে পত্রিকা প্রকাশ করেন, তাতে বিদেশি কবি-লেখকদের প্রাধান্য । কোনো সাহিত্যসভা বা কবিতাপাঠেও আপনাকে দেখা যায় না । আপনার প্রকাশিত পত্রিকা পাতিরাম বা ধ্যানবিন্দুতেও কখনও দেখিনি । শ্রুতি আন্দোলনের কবি পুষ্কর দাশগুপ্ত গ্রিকভাষা জানতেন এবং আগ্রহী ছিলেন । তিনি ওই দেশে চলে যাবার আগে মন্তব্য করেছিলেন -- "বাংলায় লিখে কিছু হবে না, বাংলা সাহিত্যের কোনো ভবিষ্যৎ নেই ।" আপনিও কি তাই মনে করেন?
উত্তর : প্রণব, সাক্ষাৎকারটি সম্পূর্ণ করতে খানিকটা দেরি হলো, কারণ যেসব প্রশ্ন রাখা হয়েছে, তাদের একটিরও কোনো সাহিত্যমূল্য নেই । আমি কি লিখি না লিখি সে সম্পর্কে প্রশ্নকর্তার কোনো কৌতূহল নেই । আমার বয়স এখন ৭১। এ বয়সে এরকম গালগল্প ধরণের প্রশ্নমালার জবাব লেখা আমার কাছে অভূতপূর্ব। আমি যা লিখি, অর্থাৎ কবিতা -- তা একেবারে বিশুদ্ধ, হ্যাঁ, কেমিকালি পিওর । "গ্রেপভাইন" "গুঞ্জন" এমনকী প্রাণহীন ইনফরমেটিক্স-এ যারা মজা পান আমি তাদের মনোরঞ্জনে অসমর্থ । সচরাচর আমি তাদের সঙ্গ এড়িয়ে চলি, যে সমাজ ও সংস্কৃতি এসব গুজবের উপর দাঁড়িয়ে আছে, আমার কাছে, এমনকী বর্জ্য সেই সংস্কৃতি । আমার নীরবতায় তাই "অসহায়" বোধ করার কারণ নেই । পৃথিবীর সব কবিই নীরব -- উদাহরণ হিসেবে জীবনানন্দকেই দ্যাখো না । কবি-লেখকদের সরবতা পূর্ণ প্রস্ফূটিত হয় তাদের রচনায় --- যেমন, নদী, নীরবে বয়ে চলেছে । রোজই সুনামি ঘটিয়ে তার অশেষ পরমায়ু ঘোষণা করতে হয় না । শুধু কবিরাই বা বলি কেন, এখনকার সমাজই ধীরে ধীরে নীরবতার দিকে ঝুঁকছে । রুটিরুজির চাপ, অবসাদ তার প্রাণোচ্ছলতাকে হত্যা করছে । রাস্তায় অতিশয় সরব যাদের দেখা যায় আমরা তো জানি তারা কারা। দলীয় ও নির্দল ফেস্টুনধারী, ধর্ষকামী কিংবা ক্ষমতাবানদের চাকর-বাকর । এখন সবার ঘরেই সেট টপ বক্স । কোনো আন্দোলন নেই । সব কিছুই পূর্ব নির্ধারিত ইশ্যুভিত্তিক । বিশুদ্ধ আন্দোলন নিজেই একটি কবিতা, রিলেটিভ ফোর্স । হাংরি জেনারেশন উথ্থানপর্বে সমাজ এরকম ছিল না । ঘৃণা ও ভালোবাসার কারণগুলিকে চিহ্ণিত করা যেরো । ভাঁড়ামো তখনও ছিল -- কিন্তু তাদের হোতাদের চিহ্ণিত করা যেতো । এই স্বচ্ছতার জন্যই হাংরি আন্দোলন সম্ভব হয়েছিল, এই বাংলার কোনো সাহিত্য আন্দোলনেই যা দেখা যায় না । অল ইজ ফিনিশড নাউ । পৃথিবী থেকে আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে । নীরবতা, কঠোর নীরবতাই এখন একমাত্র আন্দোলন । দুঃখজনক, কিন্তু আমার বিচারে ঘটনাটি এরকমই । চিন্তার কারণ নেই প্রণব, আমি এখনও বেঁচেই আছি ।
          সাহিত্য ও চারুকলার পৃথিবী কোনো অক্ষ ও দ্রাঘিমায় সীমাবদ্ধ নয় । ভাষা জানা বা না-জানা এটি ব্যক্তিগত চয়েসের ওপর নির্ভর করে । আমি ফরাসি সাহিত্যের একজন নিয়মিত পাঠক । আগ্রহী বললেওকম বলা হবে । ঐ ভাষা বেশ খানিকটা জানি কিন্তু ফরাসি ভাষায় আমার লেখার দক্ষতা অতি সামান্য । কাজ চালাবার মতো । কিন্তু আমি সব সময় সচেতন যে এটা আমার থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ । কিন্তু আমার কাব্য রচনার ভাষা বরাবরই বাংলা --- যা আমার মাতৃভাষা । ইংরেজি ভার্শানসহ আমার বাংলা কবিতার বই ওদের দেশে যাবার কারণে ঘটেছিল। এসুবাদেই আমার ব্যাপারটি আরো মজার যে আমার ফরাসিদেশে ও সুইজারল্যাণ্ডে যাবার প্রথম আমন্ত্রণ আসে একজন সুইস ব্যালেরিনার কাছ থেকে । সে নিজে কবি, অনেক দিন ধরে আমার কবিতার ভক্ত । আমার "গ্রহণ" কবিতাটি কোরিওগ্রাফ করে এবং ইউএনও-সহ ইউরোপের নানা স্হানে তা প্রদর্শন করে । সে আমাকে জানায় যে তার বিশেষ ইচ্ছে তার নাচ শুরু হবার আগে মঞ্চে আমি কবিতাটি বাংলায় পড়ি । খরচপাতি সবই তার । একদিন জেনিভা থেকে তার স্বামী, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি হ্যারি রুডলফ উইলকেনস ব্যাপারটি পাকাপাকি করতে কলকাতায় এসে উপস্হিত । না গিয়ে উপায় ছিল না । এভাবেই এসব হয়েছে একেবারে ব্যক্তিগত স্তরে -- কখনও ফ্রান্সের কোনো মেয়ের অনুরোধে কখনও সরকারি আমন্ত্রণে পোয়েট-ইন-রেসিডেন্স হিসাবে, কখনও বা ফরাসি স্কুল-কলেজে "গীতাঞ্জলি" পড়াবার জন্য । আট-দশ বছর আমেরিকা-ইংল্যাণ্ড-কানাডায় চুটিয়ে লিখেছি । এসব নানা সূত্রে সমধর্মী কবিদের সঙ্গে বন্ধুতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে । আমি রেসিস্ট নই বলে ওদের লেখাও আমার প্রকাশিত কাগজপত্রে ছাপা হয়েছে । ১৯৬৫ থেকে ১৯৮০ সাল অব্দি আমার সম্পাদিত কাগজ "স্বকাল" এবং "ফুঃ" "ক্ষুধার্ত-৩" কাগজে বাংলা লেখাই ছাপা হয়েছে -- হাংরি জেনারেশনের বন্ধুবান্ধবদের লেখা । এরপর যখন হাংরি জেনারেশনে জমি দখলের লড়াই শুরু হয়, আমি আস্তে আস্তে ঐ আন্দোলন থেকে সরে আসি । আমার জমিদারিতে কোনও আগ্রহ নেই । কারণ আমি জানি একজন "পরিপূর্ণ" কবির খাসতালুক দীক্ষিত পাঠকের হৃদয় । এই হৃদয়ের তাড়নাতেই আমি আমার কাগজে বহু বিদেশি বন্ধুদের লেখা সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছি । তাছাড়া বহুদিন তো হলো, আমি যেধরণের লেখার ভক্ত বাংলায় সেধরণের লেখা হচ্ছে না । পরিশেষে, কেবল ভালো লেখার অভাবে কাগজগুলি বন্ধ হয়ে আসছে । বেটার টাইমের অপেক্ষা করছি । কে এই পুষ্কর ? এ বান্ডল অফ কনফিউজড নার্ভস ! 
প্রশ্ন : হাংরি আন্দোলনের সময়ে আপনার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল । আপনাকে আগরতলা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে । সেই সময়ে শান্তিনিকেতনের পাঠভবন থেকে আপনাকে বহিষ্কার করা হয় । এটা কি হাংরিদের সাথে যোগ থাকার কারণে ? কোথাও কোথাও অন্য কথাও শোনা যায় । প্রকৃত ঘটনা যদি পাঠকদের জানান ।
উত্তর : প্রকৃত ঘটনা এরকমই ।
প্রশ্ন: হাংরি মোকদ্দমায় গ্রেপ্তারের পর আপনি মুচলেকা দিতে অস্বীকার করেছিলেন বলে আপনাকে রাজসাক্ষী করতে চায়নি সরকারপক্ষ । যদি বিস্তারিত বলেন ।
উত্তর : মুচলেকা-ফুচলেকা এতোসব জানি না প্রণব । আমার কাছে যা সত্য মনে হয়েছে আমি বলেছি, লিখিত স্টেটমেন্ট দিয়েছি । এই উত্তরের সঙ্গে তুমি যদি অরিজিনাল স্টেটমেন্ট অ্যাজ ইট ইজ জুড়ে দাও তাহলে পাঠক সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে । এটা করা তোমার দায়িত্ব ।
প্রশ্ন : হাংরিরা কলকাতায় গাঁজা হ্যাশিশের ঠেক, খালাসিটোলা, সোনাগাছির মতন এলাকায় যেতেন এবং দলবেঁধে হৈ-চৈ করতেন । এ সংবাদ কি সত্য ? তাহলে জানতে ইচ্ছে করছে আপনি বিদেশে থাকার সময়ে কখনও শ্রমিকদের মদ্যপানের পাবে, রেডলাইট এরিয়ায় ককনও গেছেন ? কলকাতার খালাসিটোলা, বারদুয়ারিতে কবি-সাহিত্যিকদের অবাধ বিচরণ । বিদেশেও কি তাই ?
উত্তর: না, সত্য নয় -- অর্ধসত্য । এটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার । তাদের সাহিত্য রচনার সঙ্গে একেবারে নিঃসম্পর্কিত, তাই এসব গুজবকে গুরুত্ব দেবার মানে হয় না । এসব অভিজ্ঞতা এদেশেই এতো সব হয়েছে যে বিদেশে আর তুলনামূলক অভিজ্ঞতা নেবার প্রয়োজন বোধ করিনি । তাছাড়া, এতো সময় কোথায় ? এসব ব্যাপারকে বিদেশে খুব গুরুত্ব দেয়া হয় না । ইউরোপ আর ১৯৩১ এর মিলারের ইউরোপ নয় --- আমেরিকাতেও গ্রিনিচ ভিলেজের গুরুত্ব এখন অতিশয় নগণ্য । তোমার মাথায় এসব স্ক্যাণ্ডালাস প্রশ্ন আসে কি করে প্রণব ? অভাবনীয় ।
প্রশ্ন : কথা ও কাহিনী ও দে'জ থেকে যে হাংরি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, ওই দুটি গ্রন্হে অন্তর্ভূক্ত লেখকরা কি সবাই হাংরি আন্দোলনে ছিলেন ? নাকি প্রকাশকদের চাহিদা মেটাতে সংকলনটিকে বড়ো করার জন্য অনেক অ-হাংরি লেখকদের লেখাও যুক্ত করা হয়েছে ? তার মধ্যে অনেকে কবিদের আত্মীয়স্বজন এমনকী পাঁচের দশকের কবিদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে । এভাবে কি ইতিহাসে ভূলবার্তা দেয়া হচ্ছে না ? একটি সংকলনে আপনাকেও বর্জন করা হয়েছে । কী বলবেন ?
উত্তর: কথা ও কাহিনী ও দে'জ-বাবুদের সংকলন দুটি সম্পূর্ণ আলাদা -- প্রথমটি নির্বাচিত রচনা সংকলন, দ্বিতীয়টি ক্ষুধার্ত পত্রিকার সংকলন । "আত্মীয়স্বজন" ব্যাপারটা আমি জানি না --- যদি তা হয়েও থাকে -- লেখালিখির গুণগত মান থাকলে ছাপা হতে আপত্তি কোথায় ! প্রণব, এবিষয়ে সঠিক উত্তর যাঁরা দিতে পারতেন, বাসুদেব ও শৈলেশ্বর, তারা দুজনেই এখন প্রয়াত । কথা ও কাহিনীর সংকলনের রূপকার প্রধানত তিনজন : বাসুদেব, শৈলেশ্বর এবং সম্পাদক সমীর চৌধুরী । তিনিও মৃত । দে'জ এর সংকলনটি শৈলেশ্বরের একক তত্ত্বাবধানে হয়েছে । এ ব্যাপারে কারোর, আমার অন্তত, লিখিত অনুমতিও নেওয়া হয়নি । বইটির কোনও কপিরাইটও নেই । শৈলেশ্বরও নেই । কেন যে এতো তড়িঘড়ি করে সে এই বইটির প্রড়োজনা করল, এখন তা জানার উপায় নেই । এটা তোমাদেরই বের করা দরকার । আমার সময়, আগ্রহ, কোনোটাই নেই ।
প্রশ্ন : হাংরি কবি সুবো আচার্য একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন । সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। উল্লেখিত কবি-লেখকদের এই অবস্হান মেনে নিলেও কি তাঁদের হাংরি বলবেন? হাংরি আন্দোলন ঘোষিতভাবেই ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী, ধর্মবিরোধী -- প্রতিষ্ঠানের প্রতি এনাদের অবস্হান পরিবর্তন কি তাঁদের লেখালিখিকে প্রভাবিত করেছে বলে মনে হয় আপনার ?
উত্তর: ভারতবর্ষ একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ । হাংরি জেনারেশন কোনো একনায়কতন্ত্রী প্রতিষ্ঠান নয় । একনায়কতন্ত্র থাকলে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা থাকতে পারে না । হাংরিরা প্রতিষ্ঠানবিরোধী । কোনো সৃষ্টিশীল লেখকের রচনা কেমন হবে তা বলা কখনই সম্ভব নয় । এখানে আমার মতামতের কোনো মূল্য নেই । আমি মনে করি কোনো লেখকই ধর্ম ও রাজনীতি থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকতে পারে না । চীন রাশিয়া ভারতবর্ষে তো নয়ই । ঐসব ঘোষণা কে কখন এবং কেন করেছিল আমার তা জানা নেই । হয়তো অতিশয়োক্তি, জোক ।
প্রশ্ন: হাংরি সাহিত্য কি পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যকে প্রভাবিত করতে পেরেছে বলে মনে করেন ? পরবর্তী প্রজন্মের কবি-লেখকদের রচনায় কবিতা ও গদ্যের হাংরি বৈশিষ্ট্য চিহ্ণিত করতে পারেন ? একটু যদি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেন ।
উত্তর: অবশ্যই খানিকটা প্রভাবিত করে থাকবে । বিশেষত শব্দ, তা বাক্য ও বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা--- নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই হাংরি যা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল, এটা একটা বিরাট, অভাবনীয় জাম্প ।
প্রশ্ন : হাংরি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গ্রেপ্তারের পর মলয় রায়চৌধুরী অন্যদের মতো মুচলেকা দিয়ে চলে যেতে পারতেন । ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত জেনেও, জেল হতে পারে জেনেও, মুচলেকা দেননি, বা ২০০৪ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লিখিতভাবে ফিরিয়ে দেয়া কি মলয়বাবুর হাংরি আন্দোলনের প্রতি সততার প্রমাণ ? হাংরি উত্তর অনেক কবিই যেখানে পুরস্কার নিয়ে সন্মানিত বোধ করছেন ( শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু ) একটু বিস্তারিত যদি বলেন ।
উত্তর : মলয়ের স্টেটমেন্ট সম্পর্কে আমি একেবারে অজ্ঞ । মলয়ের সাহিট্য অকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্তি প্রত্যাখ্যানের খবর এই প্রথম শুনলাম । এ বিষয়ে প্রামাণ্য কাগজপত্র যদি এ উত্তরের সঙ্গে ছেপে দাও তাহলে পাঠকদের সুবিধা হবে । মলয় একক ও অনন্য । তাকে অন্যদের সঙ্গে উপমিত করার কোনো প্রয়োজন নেই বলেই মনে হয় । ব্যক্তি নিজেই একমাত্র তার নিজের লেখা বিচার করতে পারে । পাঠক পারে গ্রহণ ও বর্জন করতে ।
প্রশ্ন : অনেকে বলেন মূলত পঞ্চাশ দশকের কবিরাই হাংরি আন্দোলনের বিরোধিতায় ইন্ধন জুগিয়েছিলেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কৃত্তিবাসের সম্পাদকীয়, প্রকাশিত চিঠি, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি থেকে অনুমান করা যায় যে, তিনি বাইরে থেকে হাংরি আন্দোলনকে ভেঙে দেবার চেষ্টা করেছিলেন । আপনি শঙ্খ ঘোষের "শব্দ ও সত্য" প্রবন্ধটির কড়া সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আপনার কি মনে হয় যে সুনীলবাবু যে কাজ বাইরে থেকে করতে চেয়েছিলেন, একই কাজ শঙ্খবাবু ভেতর থেকে করতে চেয়েছেন ?
উত্তর : বলা শক্ত । সুনীল ও শঙ্খ দুজনেই কবি । কবিরা তো নুতন কবিতা আন্দোলনে খুশি হয় । হবতো ওনারা কোনো চাপের মুখে হাংরি আন্দোলনের বিরোধিতা করে থাকতে পারেন । কিন্তু মনেপ্রাণে ওনারা দুজনেই হাংরি রচনার ভক্ত বলেই জানি ।
প্রশ্ন : রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে হাংরিদের নানা মত । আপনার মতামত জানতে চাইবো ।
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ইজ গ্রেট । তাঁর গ্রেটনেস আমার মতামতের উপর নির্ভর করে না । রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস ও গান আজও আমার কাছে আকর্ষণীয় । আমি এখনও নিয়মিত রবীন্দ্রচর্চা করি ।
প্রশ্ন : ত্রিপুরায় আপনার দ্বারা উৎসাহিত হয়ে অনেক তরুণ কবি নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী রূপে ঘোষণা করেছিলেন বলে জানা যায় । আপনি গুটিয়ে নেবার কারণেই কি তাদের উৎসাহে ভাঁটা পড়ে ? এনাদের কোনও লেখা কলকাতার লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় এখন ? এনাদের বিষয়ে কিছু বলুন।
উত্তর: আমার "গুটিয়ে নেওয়া" ( ধরা যাক ) ত্রিপুরার সাহিত্য চর্চায় কোনও প্রভাব ফেলেনি। সেখানকার কবি-লেখকরা এখনও সমানভাবেই অ্যাগ্রেসিভ লেখা লিখে চলেছে । ওদের সাহিত্যনিষ্ঠা কোলকাতার কবি-লেখকদের আদর্শ হতে পারে । কোলকাতার লিটল ম্যাগাজিনে হত্যে দেবার কোনও কারণ নেই । ওনাদের পত্রপত্রিকা অনেক, এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ । কবিতা উপত্যকা থেকে প্রকাশিত "অনার্য" একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবিতাপত্র । আমি এর অধিকাংশ সংখ্যাতেই লিখি । কোলকাতার কাগজপত্রগুলি ওরা অনেকটা বর্জ্য বলেই মনে করে । আমি ত্রিপুরা চেড়েছি চল্লিশ বছর আগে কিন্তু এখনও বছরে অন্তত একবার ওখানে যেতে চাই --- ত্রিপুরার কবি বন্ধুদের ভালোবাসার টানে ।

[ প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত "হাংরি সাহি্য আন্দোলন : তত্ত্ব, তথ্য, ইতিহাস" গ্রন্হে প্রকাশিত । প্রকাশক প্রতিভাস, ১৮এ গোবিন্দ মণ্ডল রোড, কলকাতা ৭০০ ০০২, দাম ৫০০ টাকা ]