শনিবার

হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরী : তমালশেখর দে

 প্রদীপ চৌধুরীর কাছে কবিতা ছিল এক বিরাট অবসেশন

তমালশেখর দে

“সাহিত্য নয়, আমি একেবারে চাষার মতো তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চাইঃ “ কবিতা কী কাজে লাগে?” প্রখ্যাত ফরাসী সাংবাদিক দেনিস এমোরিনের এই প্রশ্নের উত্তরে প্রদীপ চৌধুরী বলেছিলেন – “ কবিতা হলো পরিমাপ বর্হিভূত ব্যক্তিসত্ত্বার রীতিবিরুদ্ধ চালিকাশক্তি যার জন্ম ও বৃদ্ধি ক্ষমতা-অর্জনের প্রয়োজনীয় ছকের বাইরে। … কবিতার একমাত্র কাজ আমাদের দৃষ্টির সঠিক অবস্থান আরো বেশী শক্তিশালী এবং প্রসারিত করে তোলা, আমাদের জীবন যে কোনো অবস্থাতেই অর্থহীন নয় ।” এই উত্তরের ভিতর দিয়ে আমরা যদি আমাদের ভাবনার দৃষ্টি প্রসারিত করি, তাহলে কবি প্রদীপ চৌধুরীর কাব্যভাবনাকে স্পষ্ট বুঝতে পারবো । প্রদীপ চৌধুরী সহজেই তাঁর “মুক্ত কবিতার খসড়া”-য় লিখছেন – “ কবিতায় বাস্তবতার সীমারেখা এভাবেই বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। আমার চেনাজানা পৃথিবী আমারই হাতে বারবার নিহত হয়েছে ।”

কবি প্রদীপ চৌধুরীকে বুঝতে গেলে ‘কবিতাধর্ম’ –এর লেখক- গদ্যকার প্রদীপ চৌধুরীকে প্রথমে বুঝে নিতে হবে । না-হলে ভুল পাঠের সম্ভাবনা প্রবল থেকে যাবে। এই যেমন ‘কবিতাধর্ম’ প্রদীপ শুরুই করেছিলেন “আমি কোন জেনারেশনের নই–” এই একটি মারাত্মক লাইন দিয়ে । বস্তুত আমরা কোনো- না- কোনো জেনারেশনে অবশ্যই পড়ি । তাহলে কবি এমন কেন বললেন ? এটা কি তবে এক ধরণের দ্বিচারিতা ? প্রশ্ন জাগা এবং ভ্রান্ত একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছার প্রবল সম্ভাবনা থেকে যায়। অথচ চিন্তাবিদ প্রদীপ চৌধুরী দেনিস এমোরিনকে বলছেন – “আমি সব অর্থেই এক সম্পূর্ণ মানুষ । সুতরাং এটা খুব সম্ভব, আমার লেখালেখিতে, আমার কবিতায়, প্রচুর আত্মজৈবনিক উপাদান রয়েছে । কিন্তু কী এই আত্মজীবনী যার একমাত্র কেন্দ্রীয় চরিত্র আমি নিজে; আমি বহু বছর ধরে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছি । ফলশ্রুতি ‘কবিতাধর্ম’ – ‘ আমি’-র একটি অসম্ভব সংজ্ঞা দিয়ে যার শুরুঃ “ আমি কোন জেনারেশনের নই”।

কবি প্রদীপ চৌধুরী এই “খোঁজ” আমৃত্যু চালিয়ে গেছেন তাঁর কবিতায়। জীবন এবং কবিতার অনুভব মিলিয়ে তিনি লিখতে চেয়েছিলেন এক মহাগাঁথা । তাই তো তিনি নিজেই বলে গেছেন- ‘আমার কবিতাকে ভোগ্যপণ্যের জগৎ এবং স্বপ্ন-জগতের এক অসম গ্রন্থিবন্ধন বলা যেতে পারে।’ কবি প্রদীপ চৌধুরী এই অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ বা পর্যালোচনা তার প্রায় প্রতিটি কবিতার ছত্রে, চিত্রকল্পে আমরা দেখতে পাই। জীবন এবং কবিতার অনুভব মিলিয়ে তিনি লিখতে চেয়েছিলেন এক মহাগাঁথা । তিনি নিজেই বলে গেছেন তাঁর গদ্য ভাবনায় – ‘আমার কবিতাকে ভোগ্যপণ্যের জগৎ এবং স্বপ্ন-জগতের এক অসম গ্রন্থিবন্ধন বলা যেতে পারে।’ প্রদীপ বিশ্বাস করতেন, বিশুদ্ধ কবিতার বাইরে মানুষের কোনো আদর্শ কিংবা কোনো ঈশ্বরচেতনা তাকে বাঁচাতে পারে না। হয়ত কবিতাও পারে না । কিন্তু কোথাও না কোথাও কবিতা জীবনকে জাস্টিফাই করে ব্যক্তিকে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্যে নির্দেশ দেয় । জীবনকে দুর্দান্ত করে তোলে।

“পারাপারহীন এক মরুভূমির মতো বিশাল এই শহরের নিঃসঙ্গ

আত্মা এবং আমার জীবন ” ( মধ্যরাত)

কিংবা

“ এই অদৃশ্য শূন্যতার কাছে এসে

রাজনীতি, চুরি-চামারি

বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়

কবিতাভাষার মধ্যে ফুরিয়ে গেছে ।

শূন্যতার ভাষা

শূন্যতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ।” ( অদৃশ্য মাত্রা)

কবি প্রদীপ চৌধুরী ব্যক্তিজীবনে ছিলেন খুবই নিঃসঙ্গ । তাঁর আপাত যাবতীয় উন্মাদনা- উশৃঙ্খল- বেপরোয়া দিনযাপনের অন্তরালে কোথাও ছিল পরম এক শৃঙ্খলাবোধ । বাধা-ধরা গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে গিয়ে তিনি বারবার মূলত জীবনকেই দেখতে চেয়েছেন । তাই তিনি সহজেই বলতে পারেন- “ যাবতীয় বিশৃঙ্খলার মধ্যেও কবিতা তার স্বকীয় আকারে আর্বিভূত হয় এবং এই বিশৃঙ্খলাকে গ্রহণক্ষম করে তুলে তাকে বিশ্বাসযোগ্যতা দান করা ।”

“আরেকটি অতিরিক্ত সিঁড়ি আমার আত্মার মধ্যে তৈরী হচ্ছে, ঘন জলের

নীচে তার ছায়া

অনবরত কাঁপছে, আমার ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের

দাগ লেগে আছে ওর শরীরে

ও আমার গলে যাওয়া শরীর’ ( ও আমার গলে যাওয়া শরীর)

কবি প্রদীপ চৌধুরীর “ অন্যান্য তৎপরতা ও আমি’ ‘চর্মরোগ’ ‘৬৪ ভূতের খেয়া’ ‘মত্ততা ও তারপর’ একের পর এক কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলে অনেকটাই কবির ভাবনা বিশ্বের সাথে পরিচিত হতে পারি । এই কবিকে এক ঝলকেই মননের ভিতরে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাঁকে নিয়ে চর্চা করতে হবেই। কেননা, তাঁর নিজস্ব কিছু দৃষ্টিভঙ্গি আছে । তিনি জীবনকে বারবার তার শর্তে দেখতে চেয়েছেন । আর তাঁর সে জীবন ছিল কবিতাময় । তাই তো তিনি বলতে পারেন – “কবিতাই আদিম ও আধুনিক মানুষের যাবতীয় জিজ্ঞাসা এবং অন্তর্ঘাতের, শিক্ষিত এবং ভুল শিক্ষিত মানুষের চেতনা ও অবচেতনার যাবতীয় সংঘাত-লুপ্তির একমাত্র উপায় । … কবিতাই মানুষের নির্বাণ ও পরমপুরুষার্থ । কবিতাই সবচেয়ে নিজস্ব, কারণ, মানুষ নিজেই এক রচয়িতা । যে কোন আধুনিক কবির কাছে কবিতাই মানুষের শেষ ধর্ম ।”( কবিতাধর্ম)

হাংরি জেনারেশনের প্রতিষ্ঠাদের মধ্যে অন্যতম তিনি একজন ছিলেন। ত্রিপুরার সাথে তাঁর নাড়ীর যোগ । প্রায় ১৭ বছর ত্রিপুরাতে শিক্ষকতার চাকরি করার পর হঠাৎ করেই সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে যান কলকাতায় । সেই যাওয়ার পেছনেও মূল ভূমিকা ছিল কবিতারই । ত্রিপুরাতে তাঁর উদ্দাম জীবন, কবিতাচর্চা নানাভাবে ত্রিপুরার কবিতা মহলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। উত্তর ত্রিপুরাকে তিনি ভালবেসে নাম দিয়েছিলেন- ‘কবিতা উপত্যকা’। এখানকার বহু লিটল পত্রিকার সাথে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন । ‘স্বকাল/ফুঁ’ এর বহু সংখ্যা বেরিয়েছে ত্রিপুরা থেকে। এমন কি তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগেও কবি সাত্ত্বিক নন্দী-কে বলেছিলেন –“ সুস্থ হয়েই সোজা চলে আসছি ত্রিপুরা।” ত্রিপুরা তাঁর মননে চিরকালই দীর্ঘ একটা প্রভাব ফেলেছিল । শহুরে জটিল কৃত্রিমতার বাইরে তিনি বারবারই বেরিয়ে যেতে চাইতেন । তাঁর ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় – “ মেকী সভ্যতা ও কৃত্রিম শিক্ষার দিকে মানুষের ঝোঁক বাহ্যিক । ভেতরের দিক থেকে মানুষ সব সময়ই চাপিয়ে দেয়া শিক্ষার জামা খুলে ফেলে কবিতার স্বাধীন জীবনে ফেরার জন্য উন্মুখ । অনুভূতির জীবনদেবতার কাছে নিজেকে নিজের মতো ফিরে পাওয়ার জন্যে ছটফট্ করছে ।”

প্রদীপ চৌধুরী নিজের জীবন থেকেই তার কবিতার বিষয় ভাবনাকে বেছে নিয়ে ছিলেন । ফরাসী সাহিত্যের প্রতি ছিল তার অগাধ টান । ভালবাসা। ফরাসী দেশেও তাই গিয়েছিলেন বারকয়েক । সরকারি আমন্ত্রণেও গেছেন। বাংলা- ইংরেজি- ফরাসী ভাষায় বের হত তার ত্রৈমাসিক “ স্বকাল/ ফু ” লিটল ম্যাগাজিন পত্রিকা । যা নিঃসন্দেহে অনন্য এক নজির। তিনি একটা যোগসূত্র তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন দেশের বাইরে। বাংলা সাহিত্যে প্রদীপ চৌধুরীর কবিতা টিকে থাকবেন বলেই আমার বিশ্বাস । বর্তমান মহামারী আমাদের জীবন থেকে অনেককেই নির্মমভাবে অসময়ে কেড়ে নিয়েছে । কবি প্রদীপ চৌধুরীকেও ছিনিয়ে নিয়ে গেল। কবির লেখায় কবিই একদিন বলেছিলেন – “শব্দহীন এক বোবা পৃথিবীতে মানুষ জন্মগ্রহণ করে, করতে বাধ্য হয় এবং আরেক শব্দহীন জগতের জন্যে সে সারাজীবন অপেক্ষা করে যায়, করে যেতে হয় তাকে । মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া একজন আধুনিক মানুষের আর কিছুই করার নেই।”(কবিতাধর্ম)

কবি প্রদীপ চৌধুরীর কাছে কবিতাই ছিল প্রথম এবং শেষ বেঁচে থাকার অবলম্বন । হয়ত তাই তিনি বলতেন – –‘কবিতা আমার কাছে এক বিরাট অবসেশন।’ কবির কবিতা দিয়েই কবির কথাটা বলি-

“ মৃত্যুর মতো ঠাণ্ডা রাত গ্রাস করছে আমাকে

মৃত্যুর মতো প্রেম আমাকে গিলে ফেলছে

একা,

ডিয়ার ডিয়ার

… … … …

ঈশ্বর পরিষ্কার কর আমার নিঃশ্বাস

ঈশ্বর আমার মুখ থেকে চোয়াল খুলে নাও

বিধবার রাত্রির মতো দীর্ঘ ও শূন্য করে দাও আমার আত্মা

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন