বৃহস্পতিবার
হাংরি আন্দোলনের কবি ও ঔপন্যাসিক রাজা সরকার-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অঞ্জন আচার্য
হাংরি আন্দোলনের কবি ও ঔপন্যাসিক রাজা সরকার-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছে ঢাকা টাইমস- এর অঞ্জন আচার্য
রাজা সরকার। পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রথাবিরোধী লেখক। লিখেন কবিতা, প্রবন্ধ, গদ্য। দুঃসহ সংগ্রামী জীবন তাঁর। জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জের শ্রীমন্তপুর গ্রামে। ছেলেবেলায় দাদুর হাত ধরে তাঁর দেশান্তর ঘটে। শিলিগুড়িতে থাকতে তিনি ছিলেন হাংরি জেনারেশনের একজন। সেখান থেকে করতেন হাংরি মুভম্যান্ট। কলেজ-জীবনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে। তারপর জীবনবাস্তবতায় জীবিকার সন্ধান করতে হয়। চাকরি মেলে ফুড করপোরেশনে। সেখানেও দুর্বিসহ কাজ করতে হয় তাঁকে। এখন পুরোদস্তুর অবসর জীবন। পড়াশুনা আর লেখালেখি নিয়েই কাটে পুরোটা সময়। মননশীল, রুচিবান, আধুনিক চিন্তাশীল ও স্পষ্টভাষী এই মানুষটির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় লেখকের যাদবপুরের গাঙ্গুলী বাগানের বাড়িতে। কথা হয় নানা বিষয় নিয়ে। অকৃত্রিম আন্তরিক এই মানুষটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাঁর অনেক অজানা কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অঞ্জন আচার্য
অঞ্জন আচার্য : দাদা, নমস্কার। কেমন আছেন?
রাজা সরকার : ভালোই।
অঞ্জন : আপনার একটি সাক্ষাৎকার নিতে চাই। তেমন কিছু না, অগ্রজের কাছে অনুজের কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাস্য; কিছু কৌতূহল মেটানোর প্রয়াস মাত্র। যদি অনুমতি মেলে...
রাজা : নিশ্চয়ই।
অঞ্জন : আপনার জন্ম তো বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার মোহনগঞ্জ গ্রামে। সেখানে আপনার বেড়ে ওঠা এবং খুব ছোটবেলায় আপনার দেশান্তরিত হওয়ার গল্পটা শুনতে চাই।
রাজা : জন্ম-গ্রামটার নাম শ্রীমন্তপুর। মোহনগঞ্জ তখন ছিল আমাদের থানা শহর। শ্রীমন্তপুর থেকে ৪/৫ মাইল উত্তরে। দেশান্তরিত হয়েছিলাম আমার ঠাকুমার হাত ধরে। আমার ‘আঁতুড় ঘর’নামক গ্রন্থটিতে দেশান্তরের যাত্রার বিশদ বিবরণ রয়েছে।
অঞ্জন : এরপর আপনার পরিবারের সংগ্রামী জীবন। শিলিগুড়িতে বেড়ে ওঠা। নতুন করে নতুন জায়গায় আবাস গড়া ইত্যাদি বিষয় যদি একটু শেয়ার করেন।
রাজা : ১৯৬৪ সালে দেশ ছাড়ি। প্রথমে আসামের গোয়ালপাড়া জেলার দুধনৈ নামক স্থানে কিছুদিন ক্যাম্প-জীবন। পরে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বড়দার আশ্রয়ে শিলিগুড়িতে গিয়ে থাকা। একজন উদ্বাস্তু মানুষের জন্য সমাজের বরাদ্দ সব লাঞ্ছনাই আমাদেরও প্রাপ্য হয়েছিল।তার মধ্যেই চলছিল বেঁচে থাকা।
অঞ্জন : আপনার লেখালেখির শুরুটা কীভাবে হলো, একটু বলবেন?
রাজা : লেখালেখি করবো এটা কোনোদিন ভাবিনি।গ্রন্থাগারে সময় কাটানো এবং সেখান থেকে বই নিয়ে পড়ার অভ্যাস ছিল।২৬/২৭ বছর বয়সে প্রথম শুরু।তখন ডাকযোগে শিলিগুড়ির একজনের কাছে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা আসতো। কোনোভাবে কিছুদিন সেই পত্রিকা পড়ার সুযোগ হয়েছিলো। লেখার চিন্তাটা মাথায় আসে তখনই। সেটা সত্তর দশকের শেষ দিক।
অঞ্জন : বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহটাই-বা কোথা থেকে পেলেন?
রাজা : সাহিত্যের প্রতি আগ্রহটা এসেছিল সত্তর দশকের ধ্বংসস্তূপের পাশে একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে। বাংলা যেহেতু নিজেরই ভাষা, সংযোগটাও তাই প্রথম বাংলা সাহিত্যের সঙ্গেই।
অঞ্জন : আপনার লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন কোন কোন লেখক, কিংবা এখনো করে যাচ্ছেন বলে আপনি মনে করেন?
রাজা : না, কেউ না।
অঞ্জন : ছাপার অক্ষরে প্রথম কবে আপনার লেখা প্রকাশিত হলো? শুরুটা জানতে চাই, কেমন ছিল সেই অনুভূতি?
রাজা : প্রথম শিলিগুড়ি থেকে প্রকাশিত ‘ধৃতরাষ্ট্র’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিনে। গড় বাঙালি লেখকদের তুলনায় যেহেতু একটু বেশি বয়সে লিখতে আসি, ফলে মনে রাখার মতো অনুভূতি তেমন কিছু ছিল না।
অঞ্জন : আপনি তো হাংরি জেনারেশনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। শিলিগুড়ি থেকে হাংরি মুভমেন্ট করেছেন, ‘কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ নামে একটি পত্রিকাও বের করতেন আপনারা। আপনার রচিত ‘কিছু কালো ফুল ও তার ক্ষত’ হাংরি-ইতিহাসে এখনো লেখা আছে। ওই সময়টা সম্পর্কে বলুন।
রাজা : ‘সক্রিয় কর্মী’ বলতে যা বোঝায় তেমন কেউ ১৯৬১ সনে হাংরি আন্দোলন শুরুর সময়েও ছিল বলে মনে হয় না। সাহিত্য আন্দোলনের কোনো মেম্বরশিপও হয় বলে জানা নেই। ব্যাপারটা একান্তই লেখা নির্ভর। এ ক্ষেত্রে লেখা বিষয়টা যেহেতু জীবনযাপনের ঘাত-প্রতিঘাতের এক জৈবনিক গ্রাফ হয়ে উঠে, ফলে গ্রিনরুম থাকে না এখানে। সবটাই প্রকাশ্য এবং প্রত্যক্ষতাজনিত এক ভাষা-যুদ্ধ, যা আঘাত করে বসে প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের চলমান ভাষা-বোধকে। শিলিগুড়ি থেকে আমরা যেটা করেছি সেটাকে অনেকেই হাংরি রিভাইভাল বলতে চেয়েছেন। কিন্তু আমি তা মনে করি না।১৯৮০ দশকে এসে আমরা ততদিনে স্তিমিত এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হাংরি আন্দোলনের বিভিন্ন রচনা ও তাদের লেখাপত্রের সঙ্গে পরিচিত হই এবং সেটা হাংরি আন্দোলনের দুই দশক পরে। শিলিগুড়ি শহরে তখন ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ নামক একটি পত্রিকার মাধ্যমে আমরা লেখালেখি প্রকাশ করতে শুরু করি। আমরা স্বীকারও করি আমাদের চিন্তা-ভাবনার ভেতর ক্ষুধার্ত প্রজন্মের একটা প্রভাব তৈরি হয়। কারণ মধ্যস্বত্বভোগের বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ক্ষুধার্ত প্রজন্মের রচনাই প্রথম বাংলা লেখালেখির চিন্তাবিশ্বে সম্মিলিতভাবে একটি সার্বিক বিদ্রোহের বীজ বপন করে, যা আমাদের আকৃষ্টও করে। ফলে একসময় আমাদের ‘পোস্ট হাংরি’ও বলা হতে থাকে। শিলিগুড়ি শহরকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গে এর প্রভাব কিছুটা ছড়িয়েও পড়ে।
অঞ্জন : যত দূর জানি, একসময় আপনি নকশাল আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ওই আন্দোলনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? আপনার কি মনে হয় না এটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি ভ্রান্তনীতি ছিল?
রাজা : যে কোনো সামজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা প্রেক্ষাপট থাকে। তীব্র মন্দায় আক্রান্ত ষাটের দশক ছিল ঐ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট। তখন, অর্থাৎ ১৯৭০ সালে আমি কলেজে ভর্তি হই। ঐ পেক্ষাপট বা কথিত নকশাল আন্দোলনের মর্মাথ বুঝে ওঠার মতো অবকাশ বা পরিসর কোনোটাই তখন ছিল না। নকশাল আন্দোলন যে আদতে একটা কৃষক আন্দোলন, যাকে বর্ধিত করে বলা হতো বিপ্লব তথা সশস্ত্র বিপ্লব, তার তাত্ত্বিক দিক নিয়ে কোনো কথা শোনার উপায় ছিল না। বরং ততদিনে শ্রেণীশত্রু নিধনের নামে শহরাঞ্চলে এই আন্দোলনটি মূলত রোমান্টিক হানাহানি্তেই পর্যবসিত হয়ে পড়েছিল। আর তা করতে গিয়ে একসময় নিদারুণ প্রাণহানির মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। অসাধারণ এক নৈরাজ্য কায়েম হয়েছিল পুলিশ-নকশাল-কংগ্রেস-সিপিএম-গুন্ডা বদমাশ—সর্বোপরি লুম্পেন প্রলেতারিয়েতদের সমন্বয়ে। সেই নৈরাজ্যে সন্দেহ করা হতো সব যুবকই নকশাল। শেষ পর্যন্ত পুলিশের খাতাই বলতে পারতো কে নকশাল আর কে নকশাল নয়।
কৃষক আন্দোলনের একটা দীর্ঘ ধারাবাহিকতা আমাদের এই উপমহাদেশের কিছু কিছু অংশে সক্রিয়ভাবেই বহমান ছিল। বিশেষ এক শ্রেণী চরিত্রের কারণে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা তার প্রতি সবসময় দমনমূলকই ছিল। একসময় সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন সমস্ত সহিষ্ণুতা বর্জন করে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণ করে বসে। ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। কথাটা তাই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আর ভ্রান্তনীতি নয়; ভ্রান্তপদ্ধতি বলা যেতে পারে।
অঞ্জন : আবার লেখালেখির প্রসঙ্গে আসা যাক। কর্মজীবনে আপনি ছিলেন ফুড করপোরেশনের একজন ব্যস্ততম কর্মকর্তা। চাকরির পাশাপাশি কীভাবে লেখার জন্য সময় বের করতেন?
রাজা : ব্যস্ততম কর্মকর্তা নয়রে ভাই, নিষ্পেষিত কর্মচারী বলা যায়। কমবেশি চল্লিশ বছরের চাকরি জীবন ছিল মূলত শূন্য-মূলধনের এক উদ্বাস্তুর দু-বেলা আহার আর মাথার উপর আচ্ছাদনের লড়াই। লেখার থেকে তো বেশি পড়তে হয়। দুটোর জন্যই সময় এবং অনুকূল পরিবেশ খুব কমই পেয়েছি।
অঞ্জন : দীর্ঘদিন ধরে আপনি লিখছেন। আপনার লেখাগুলোর রসদ আপনি কোথা থেকে পেয়েছেন? স্মৃতিকথামূলক লেখা ছাড়া অন্যান্য লেখায়, বিশেষ করে কবিতায় ব্যক্তি আপনি কতখানি উপস্থিত আছেন?
রাজা : দীর্ঘদিন ধরে লিখছি না। বলা যায়, দীর্ঘদিন ধরে লেখার মধ্যে আছি। টের পাই নিজের ভেতরে একটি বোকা মানুষের বসবাস আছে। লেখার উৎস বা রসদ সেইই।
অঞ্জন : বাংলাদেশের সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘সিলেট টুডে’ পত্রিকা আপনার একটি দীর্ঘ স্মৃতিকথা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ওটা লেখার পেছনের তাড়না কী ছিল, তা যদি পাঠকদের সঙ্গে একটু শেয়ার করতেন। কেমন সাড়া পেলেন লেখাটির?
রাজা : লেখাটির নাম ছিল ‘ফিরে দেখা এক জন্ম কথা’। শৈশবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনেকের মতো বিতাড়িত হলেও সেই দেশ এবং পরবর্তী বাংলাদেশ আমার ভেতরে থেকেই যায়। সেই তাড়নায় বাংলাদেশ হওয়ার পর সেখানে আমার যাওয়া-আসাও হয়। আমাদের পরিবারের একটা অংশ ওখানে থেকে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে তারা সেখানে আটকে পড়ে। ধর্মে হিন্দু একটি পরিবারের তখন প্রাণে বাঁচতে হলে দেশ ছাড়া দরকার, অথচ দেশ ছাড়া হওয়া যাচ্ছে না—এরকম এক পরিস্থিতিতে ভাঙাচোরা মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে এক মা ও তাঁর গর্ভবতী কন্যাসন্তানের মধ্যে এক মানসিক সংঘাতের গল্প।
আমার পাঠক সীমিত। যারা পড়েছেন তারা এই নতুন প্রেক্ষাপটের কথাতে আবিষ্ট হয়েছেন বলেই জেনেছি। প্রতিবেশী দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিশদ বৃত্তান্ত পশ্চিমবঙ্গের পাঠকের কাছে এখনো নতুন বলেই মনে হয়।
অঞ্জন : বর্তমান সময়ে পশ্চিমবঙ্গে নতুনদের মধ্যে কাদের লেখা আপনার পছন্দ? কেন পছন্দ?
রাজা : সব নতুনদের লেখা পড়ার সুযোগ নেই আমার। তবে পছন্দের লেখার সন্ধানে আছি বলা যায়।
অঞ্জন : বাংলাদেশের কবিতা গল্প-উপন্যাস আপনার পড়ার সুযোগ হয়? এ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? কার কার লেখা ভালো লাগে বা লেগেছে?
রাজা : ইন্টারনেটের সুবাদে বেশ সুযোগ হয়। অনেক ভালো-লাগা লেখাই পড়ি বা পড়েছি। ভাষা ব্যবহারের সজীবতাটাই বেশি আকর্ষণ করে থাকে। নাম করতে হলে বলবো গত বছর দুই ধরে মাথায় থেকে যাচ্ছে শহীদুল জহির। অসামান্য!
অঞ্জন : বাস্তবতার নিরীক্ষে একটা প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গের যে পরিমাণ বই বাংলাদেশে পাওয়া যায় সে তুলনায় বাংলাদেশের বই পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যায় না। এতে করে বাংলাদেশের অনেক শক্তিশালী লেখকের লেখাও পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের কাছে পৌঁছয় না। অনেক পাঠক বাংলাদেশি অনেক বড় লেখকের নাম পর্যন্ত শোনেনি। এই ব্যর্থতার হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় কী হতে পারে বলে আপনার অভিমত।
রাজা : পশ্চিমবঙ্গের বই বাংলাদেশে কী পরিমাণ পাওয়া যায় আমার জানা নেই। তবে ২০১৪ সালে ঢাকা বইমেলায় গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কোনো প্রকাশকের স্টল দেখিনি। দেখিনি পশ্চিমবঙ্গের কোনো লিটল ম্যাগাজিনের স্টলও। খোঁজ নিয়ে জেনেছি পশ্চিমবঙ্গের বই বিপণন সেখানে নিষিদ্ধ। পাশাপাশি কলকাতা বইমেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোতে যত বইমেলা হয় সর্বত্র বাংলাদেশের বই পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রকাশকদের স্টল থাকে। বইমেলা ছাড়াও শুধু মাত্র বাংলাদেশের বইয়ের জন্য কলকাতার নন্দন চত্বরে বছরে একটি পৃথক মেলা হয়। সুতরাং তুলনায় কমবেশির পরিমাণ নিয়ে বলতে পারবো না। অনেক পাঠক যারা বাংলাদেশি বড় লেখকদের নাম শোনেননি তারা নিশ্চই ধীরে ধীরে জেনে যাবেন। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নির্মলেন্দু গুণ শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ তসলিমা নাসরীনসহ আরো অনেক লেখক এখানে যথেষ্ট পরিচিত এবং পঠিত বলেই জানি।
অঞ্জন : অভিযোগ আছে বাংলাদেশের অনেক নবীন-প্রবীণ লেখকের ভালো লেখা পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা তো দূরে থাক, সাধারণ সাহিত্য পাতায় প্রকাশের জন্যও মনোনীত হয় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় তো বটেই, ঈদ উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের সবিশেষ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এ বৈষম্য কেন বলে মনে হয়? এটা কি বাণিজ্যিক নাকি রাজনৈতিক? পুঁজিবাদী আদিপত্যবাদের দৃষ্টিতে এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রাজা : আমি লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। সেই লিটল ম্যাগাজিনের, যে লিটল ম্যাগাজিন নিজেদের বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাগজের দরোজায় পৌঁছনোর সিঁড়ি হিসেবে নিজেদের মনে করে না। ফলে দুই বাংলার লেখকরা কম বেশি কে কোথায় লিখছেন আমার জানা থাকার কথা নয়। সাহিত্যের শারদীয়া বা ঈদ সংখ্যা জাতীয় লেখা-সংস্কৃতি থেকে আমার অনেক দূরত্ব ভাই। তবে বৈষম্যের ব্যাপারে নিরপেক্ষভাবে বলতে পারি যে চাহিদা ও জোগানের তারতম্যের জন্য এটা হতে পারে। চাহিদা ঐতিহাসিক ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত। সাহিত্যের চাহিদা শিক্ষা-সংস্কৃতির হাত ধরে তৈরি হয়। জোগানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলেও চাহিদা থেকেই যায়। নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কিন্তু জোগান সমসাময়িক নীতি ও নিয়ন্ত্রণাধীন। পশ্চিম বঙ্গের সাধারণ পাঠকের কাছে বাংলাদেশে রচিত সাহিত্যের চাহিদা তৈরি হওয়া উচিত। কারণ বাংলাদেশের বই বিপণনে এখানে কোনো নিষেধ নেই।
অঞ্জন: দুই বাংলার সাহিত্যের সম্মিলন কীভাবে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? এক্ষেত্রে লিটলম্যাগাজিন অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। আপনি নিজেও লিটলম্যাগে লেখেন, এবং ‘ঢপের কাগজ’ নামে একটি ভিন্নমাত্রার ছোটকাগজের সঙ্গে জড়িত। এরপরও…
রাজা : সাহিত্যের সম্মিলন চুক্তি করে হয় না। তার আগে মানুষের সম্মিলন হওয়া প্রয়োজন। একই ভাষার মানুষ একদেশ থেকে এখন দু দেশে বিভক্ত। পাকিস্তান আমলে মানুষের সম্মিলনে নানা বিধিনিষেধ ছিল। ইদানীং সেটি নেই। লেখালেখির মানুষদের যাতায়াতও বেড়েছে। শুধু লেখালেখির মানুষ নয়, যাতায়াত হওয়া দরকার শিক্ষার্থী, পর্যটকসহ সাধারণ মানুষের। পশ্চিমবঙ্গের দিক থেকে বলতে পারি, এখনও এখানকার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে বাংলাদেশ খুব পরিচিত তা কিন্তু নয়। সংশ্লিষ্ট মানুষেরাই শুধু বাংলাদেশ বিষয়ে জানে। এই জানার বিষয়টা আসলে দেশভাগপূর্ব অবিভক্ত বাংলার ইতিহাস থেকে আজকের বাংলাদেশ—যা জানাটা দুই দিকের বাঙালিদেরই জন্যই জরুরি ছিল। যা হয়নি। আমারই আত্মীয় বর্তমান প্রজন্মের একজন কলেজ ছাত্রী আমাকে বাংলাদেশে জিজ্ঞেস করেছিল যে ‘তোমার জন্ম বলছ এখানে—অথচ তুমি কলকাতায় থাক— কেন?’
অঞ্জন : প্রকৃত বাংলা সাহিত্য প্রসারে ব্লগ, অনলাইন পত্রিকা ও ওয়েব ম্যাগাজিনগুলো কতখানি ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন? এর ফলে কি ছাপা বইয়ের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে? ই-বুক ও কাগুজে বইয়ের এই দ্বান্দ্বিক অবস্থার মূল্যায়ন আপনি কীভাবে করেন?
রাজা : পড়া-লেখা-ছাপার যে প্যাটার্নটা ইন্টারনেট-পূর্ব কালে ছিল তা ইন্টারনেট পরবর্তীকালে বলাবাহুল্য ভেঙে যাচ্ছে। হয়তো আরো ভাঙবে। সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক হাউজগুলোর মনোপলি ভাঙছে। লেখার ফর্ম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ বাড়ছে। এককথায় লেখকের আরাধ্য স্বাধীনতা বাড়ছে। লিখে বাড়ি-গাড়ি হবে কিনা বলা শক্ত। আমাদের দেশে ই-বুক থেকে কাগুজে বই এখনও এগিয়ে আছে। আগামী দিনেও থাকবে এমন গ্যারান্টি দেখছি না।
অঞ্জন : চাকরি থেকে অবসরের এই জীবন কীভাবে কাটান আপনি? একই সঙ্গে পারিবারিক-জীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ রইল। মানে স্ত্রী-মেয়ে-মেয়ে জামাই।
রাজা : আমার চাকরি যখন বুঝতে পারলাম জীবন থেকে অনেক সময় নিয়ে নিয়েছে তখন খুব অসহ্য মনে হতো। ফলে অবসর আমার কাছে মুক্তবাতাস। যতটুকু বাকি আছে জীবন, ততটুকু ইচ্ছেমতো লেখাপড়ার মধ্যেই থাকতে চাই। ছোট্ট পারিবারিক জীবন আমার। আপাতত আমরা দুই সিনিয়র সিটিজেন কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে কংক্রিট নির্মিত এক পাখির বাসায় থাকি। আমাদের একটাই কন্যা। বিবাহিতা। আপাতত সে ও আমার জামাতা দেশেই আছে। এবং আমাদের কাছাকাছিই থাকে।
অঞ্জন : এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ দাদা। ভালো থাকুন সবসময়।
রাজা : তোমাকেও ধন্যবাদ।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন