বৃহস্পতিবার

যশোধরা রায়চৌধুরী : মলয় রায়চৌধুরী বিষয়ে কিছু কথা


কবি মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ
         ১৯৯৫তে একটা বই পড়েছিলাম হাংরি জেনারেশনের উপর । উত্তম দাশের লেখা । কবি উত্তম দাশ । সেটা থেকেই প্রথম জানতে পারি, হাংরি কবি মলয় রায়চৌধুরী হাজতবাস পর্যন্ত করেছেন অশ্লীলতার দায়ে । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখার জন্য । এইটুকু পড়ে বুঝতে পেরেছিলাম, মলয় রায়চৌধুরীর নাম আমরা যতটুকু শুনি, বা আমি, সদ্যই কবিতা লিখতে বসে, সে সময় অব্দি, যতটুকু শুনেছিলাম, সেটা যথেষ্ট ছিল না, নয় ।

         আমার সে সময়ে, কয়েকটি লিখিত শব্দের জন্য হাজতবাস করেছেন, এমন একজন কবির নাম -না-জানা থাকার জন্য এক ধরনের লজ্জা হয়েছিল । শব্দকে ঈশ্বর মানি । অথচ শব্দের জন্য কারুর জীবনের এই সব ঘটনা -- শিল্পের জন্যও বলা চলে --- এই যে এক্সট্রিম পয়েন্টে চলে যাওয়া, এমন মারাত্মক একটা কিছু করে ফেলা -- এটা খুব চমকে দিয়েছিল, নাড়া দিয়েছিল । ‘ঘিলুর বীভৎস শাঁস থেকে, শাঁসের উত্তরাধিকারহীন নৈরাজ্য থেকে সারি সারি বিস্ময়ক শব্দপূঞ্জের ভেতরে নিক্ষিপ্ত অসংযত অহং অনুসন্ধানই কবিতা’ ( হাংরি ইস্তাহার ) --- একথা বিশআস করতে শুরু করি তখনই । বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভরে বৃষ্টি’ অথবা সমরেশ বসুর ‘বিবর’ ‘প্রজাপতি’ অত্যান্ত আগ্রহে শ্রদ্ধায় পড়েছি । 

         হাংরি আন্দোলনের ভেতর অবশ্যই একটা দেখানেপনা, যুবা/অল্পবয়স্ক সুলভ উন্মাদনার ঘটা, বুদ্ধিদীপ্ত হৈ হল্লা ছিল । তবু হাংরি আন্দোলন, ষাটের দশকের অন্যান্য আন্দোলনগুলো -- প্যারিসের আটষট্টির ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলন/অভ্যূথ্থান, আমেরিকার বিটনিক -- গিনসবার্গ ও অন্যান্যরা -- সবটা পরস্পর সংযুক্ত । ফলত বাংলার বুদ্ধিজীবী যুবকেরা যে একটা ইন্টারন্যাশানাল মাত্রা পেয়েছিলেন -- দেশের গণ্ডিটা মুছে যুবসত্তা যে খুব ইমপরট্যাণ্ট হয়ে উঠেছিল -- এটা পরিষ্কার । ফলত শ্রদ্ধা, ক্যারিসমা, বিস্ময়বোধ থেকেই যায় ।

         আমি সেই সময় হাংরি আন্দোলন নিয়ে খান কয় বই পড়েছিলাম । ১৯৯৫-এর বইমেলায় মলয় রায়চৌধুরীর দুতিনটি বইও কিনি । তার মধ্যে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ও ছিল । আর একটা কবিতা ভীষণ ভালো লেগেছিল, সেটা হচ্ছে ‘ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ’ ।

         পরে এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবেখন । ‘ধন’ শব্দটার আমাদের সমাজে দু’তিনরকম মানে । মূলত সেই অ্যামবিগুইটির জায়গা থেকেই গড়ে উঠেছে, শরীর লাভ করেছে কবিতাটি । এটা পোস্টমডার্ন বলে আমার মনে হয়েছে । কবিতার সঙ্গে কবিতার নামের যোগাযোগ অবিচ্ছেদ্য । যেটা আর একটা পোস্টমডার্ন লক্ষণ । তাছাড়া কবিতার নামটা একটা ব্যঙ্গ বা প্যাসতিশ । মানে, কোনও লোক যেন পড়ার বইয়ের একটা চ্যাপ্টারের হেডিংকে কাঁচি দিয়ে কেটে তারপর সেটাকে এই কবিতার ওপর আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছে । অর্থাৎ একটা প্যাচওয়র্ক । এটা পোস্টমডার্ন লক্ষণ । এইসব মিলিয়ে সোজা কথায় কবিতাটা আমাকে মজা দিয়েছিল । আমার শিল্পবোধে সুড়সুড়ি দিয়েছিল । এই যে তির্যক একটা রস, এটা অনেক কবির কবিতাতে পাই । মলয় রায়চৌধুরীর কবিতায় বেশ ভালোরকম পাওয়া যাবে । তখন এসব লক্ষণ-টক্ষণ নিয়ে মাথা ঘামাইনি । তবে এই রসটা চেখে-চেখে মিয়েছিলাম । বলা যায়, এভাবেই, নব্বইয়ের মাঝামাঝি, বেশ বেশিসংখ্যক কবিই কবিতা লিখতে সুরু করে --- আমিও করি । এটা প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ কোনও প্রভাব বলতে হবে, মলয় রায়চৌধুরীর শিল্পধারার ।

         তখন এসব বেশ পড়ছিলাম টড়ছিলাম । হাংরির ব্যাপারটা নিয়ে মজে ছিলাম । কয়েকটা গদ্যও লিখেছিলাম এটা নিয়ে । কবি মলয় রায়চৌধুরীকে তখনও ব্যক্তিতে চিনি না ।


কবি মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার দ্বিতীয় যোগাযোগ
         ‘কবিতা পাক্ষিক’ একটা অনুষ্ঠান করে আলিপুরে, কানাইলাল জানার বাড়িতে, রবিবার করে যেমন হতো অনুষ্ঠানগুলো । আমি খুব আগ্রহ নিয়ে গেছিলাম । কালীকৃষ্ণ গুহ আর মলয় রায়চৌধুরীর পাঠ ছিল । যেহেতু আমার সদ্য সদ্য স্মৃতিতে ছিল হাংরি ও মলয়ের কবিতা -- স্বচক্ষে লোকটিকে দেখার ইচ্ছে ছিল । 

         মলয়দা ও সমীরদার সঙ্গে আমার ওখানেই আলাপ হয় । তখনও আমার প্রথম বই ‘পণ্যসংহিতা’ বেরোয়নি । পাক্ষিকে সদ্য সদ্য লিখছি । অর্থাৎ ১৯৯৫ সাল হবে । ঐ সময়টা খুব ইমপট্যান্ট আমার কাছে । বাংলা কবিতাও ওই সময়ে বেশ পুনরুজ্জীবন পেলো । বড় কারণ প্রভাতদারা পোস্টমডার্ন কবিতার যে ‘আন্দোলন’ করলেন -- সেটা -- সেটার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত মলয়দা ও সমীরদা । ‘হাওয়া৪৯’ এবং ‘কবিতা পাক্ষিক’ -- দুটো কাগজই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এই বাংলা কবিতার পোস্টমডার্ন আত্মচেতনার জায়গাটাতে । আর মলয় রায়চৌধুরী একজন ইডিওলগ -- এই ‘আন্দোলনের’ একজন নেতা ।

         উপরে আন্দোলন শব্দটাকে ইনভার্টেড কমায় রাখার কারণ এটা তথাকথিত আন্দোলন । সত্যিকারের আন্দোলন বলে কেউ কেই নাও মানতে পারেন । সেজন্যই --- ।


মলয় রায়চৌধুরী এবং ভাষার ভাঙচুর
         ‘আপনি কি এখন দয়া করে আড্ডা দেবেন ?’

         এই বাক্যটির level/register of language বা ব্যবহৃত ভাষান্তর কী ? ভাষান্তরে সাম্যতা বজায় আছে কি ? ‘আপনি’ ও ‘দয়া করে’-র সাথে ‘আড্ডা দেবেন’, যাকে বাংলায় বলে, ঠিক যায় না । কেন যায় না ? কারণ ‘আপনি এখন দয়া করে’-র ভাষান্তর formal/শিষ্ট/ভদ্রতাবচক, আর ‘আড্ডা দেওয়া’-র ভাষান্তর informal, ঘরোয়া, বন্ধুদের মধ্যে ব্যবহৃত ( অবশ্যই অশিষ্ট অভদ্র নয় )। এখন কেউ যদি ইচ্ছা করে দু’তিনটি ভাষান্তরকে মিলিয়ে দিতে চান ? ইচ্ছে করে ভাষান্তর ভেঙেচুরে, বা বিভিন্ন স্তরের মধ্যে ওলটপালট ঘটিয়ে কোনও নতুন রস বা মজার উদ্ভব ঘটান ? সেটাই একটা শিল্প হয়ে ওঠে তখন । নতুন করে ।

         যেমন, ‘ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ’ কবিতাটির কথা বলছিলাম । সেখানে গুরুগম্ভীর মার্কসীয় পরিভাষায় লিখিত প্রবন্ধের শিরোনামের যে ভাষান্তর, তাকে ব্যবহার করা হয়েছে রতিক্রিয়া ও বিছানার আপাতঅশ্লীল এবং ‘অশিষ্ট’ ভাষান্তরের একটি কবিতার শীর্ষক হিসেবে । আর এটাই জন্ম দিচ্ছে এক অভূতপূর্ব মজার 
         এই শৈলীকে কেন পোস্টমডার্ন বলছি ? সেটা বলার আগে একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন । তা হল পোস্টমডার্নিজম কিন্তু কোনও সাহিত্যশৈলীর নাম নয় । আমি যতটুকু বুঝি, তাতে সাহিত্যের/শিল্পের কিছু কিছু লক্ষণকে পোস্টমডার্ন বলা যায় । মূলত এটা একটা প্রবণতার নাম, যে প্রবণতায় স্হির/নিশ্চিত কোনও কিছুকে তুলে ধরা হয় না । একটি ‘মতবাদ’-কে তুলে ধরার বদলে ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যাবার নামই পোস্টমডার্ন প্রবণতা । অতএব পোস্টমডার্নিজম আর একটি নতুন মতবাদ নয় । 

         আর্কিটেকচারে, অর্থাৎ স্হাপত্যশৈলীতে পোস্টমডার্ন প্রবণতার সাম্প্রতিক যে-প্রমাণ আমরা দেখেছি, সেটার সঙ্গে ভাষাশৈলীকে তুলনা করলেই ভাষান্তর নিয়ে যে কথাগুলো বলছিলাম, সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে । স্হাপত্যশৈলী যখন পালটাতে থাকছিল, ক্রমশ ‘আধুনিক’ হয়ে উঠছিল, সেটা মডার্নিজম । অর্থাৎ সেটা সরলরৈখিক প্রগতি । বারোক অলঙ্কারময় স্হাপত্যের স্হান নিল গম্ভীর ভিকটোরিয়ান রীতি । ভিকটোরিয় স্হাপত্যের বদলে ছিমছাম, কাটাকাটা, সায়েন্স ফিকশান-সুলভ স্হাপত্য এলো -- যেটা নাকি ‘আধুনিক’ রীতি । এবার দেখা গেল ‘আধুনিক রীতি’ও পুরোনো হয় ! ( যেমন আধুনিক গান হয়ে ওঠে পুরোনো বাংলা গান ! অর্থাৎ ১৯৬০-৭০-এর ‘আধুনিক গান’ -- ওই শব্দটা যে-সময়ের সৃষ্ট বা যে-কালপর্বের coinage সেটা আধুনিক কালপর্ব ) এবং ১৯৯০-এর স্হাপত্যে আবার পপাচীন অলঙ্কারময়তা বা ভিকটোরিয় ডিজাইনগুলোকে নতুন মোড়কে এক্সপেরিমেন্টধর্মী শৈলীতে ব্যবহার করা চালু হল । প্রাচীন যা কিছুর পুনর্ব্যবহার, তাদের নতুন কনটেক্সটে ফেলে দেখা --- সেটাই পোস্টমডার্ন প্রবণতা । অর্থাৎ সরলরৈখিক প্রগতি নয়, বক্র, ঘুরে-আসা, বৃত্তীয় ঢঙ । বারবার একই বিন্দুকে ছুঁয়ে যাওয়া । ( যেমন ‘আধুনিক’ বাংলা গানের উত্তর-আধুনিক ফর্ম : remix ! remake ! )

         অর্থাৎ পোস্টমডার্ন প্রবণতায় নকল বা অনুকরণ, বা প্যারডি-র একটা বিরাট ভূমিকা আছে । এই সময়ের কবি যখন অনুকরণ করেন কৃত্তিবাসী রামায়ণের শৈলী, অথবা রাবীন্দ্রিক ঢঙেই লেখেন কোনও তির্যক কবিতা -- সেটা হয়ে ওঠে পোস্টমডার্ন ।

         মলয় রায়চৌধুরী এই ভাষান্তর ভেঙে দেওয়ার কাজটা তুমুল রাগ ও অনুরাগের সঙ্গে করেন, করেছেন -- অবচেতন থেকেই করেছেন বলে আমার ধারণা, কোনও ‘ইজম’-এর অনুশাসন মেনে নয় । মূলত কবিরা লেখেন আগে, ‘ইজম’-এর তকমাটা তার ওপর লাগানো হয় পরে --- হয়তো কবিরা নিজেরা্‌ই নিজেদের মধ্যে আবিষ্কার করেন এমন কোনও প্রবণতা যা থেকে তিনি নিজেকে এক বিশেষ শৈলীর কবি হিসেবে পুনঃচিহ্ণিত করেন । করে, স্মিত এক হাসি ফুটে ওঠে তাঁর মুখে ।


মলয় রায়চৌধুরী ও সমাজবীক্ষণ
         একটু আগেই লিখছিলাম মলয় রায়চৌধুরীর রাগ ও অনুরাগের কথা । যে কোনও রাগি কবিরই রাগ বস্তুত সামাজিক সিস্টেমের ওপর রাগ, প্রচলিত কনভেনশনের ওপর রাগ । মা-বাবাকৃত অত্যাচার, যা শিশু হিসাবে তাঁর বরাতে জুটেছে, সেই অত্যাচারের প্রতিবাদ । পিতৃতান্ত্রিক সিস্টেমের উপর রাগ, বস্তুত বাবার উপর রাগ । আর সেই আবার উদ্দেশে পাঠানো প্রতিবাদ ও পপতিক্রিয়াই ঘুরে যায় রাষ্ট্র, পরিবার, বিবাহ, প্রেম এবং ধর্মের দিকে, ঘুরে যায় বিচারক, পুরোহিত, শিক্ষক, পুলিশের দিকে -- এক কথায় এসট্যাবলিশমেন্টের দিকে । ইস্কুল, জেলখানা, মন্দির এবং পাগলাগারদ সমার্থক হয়ে ওঠে ।  ভ্যালু-সিস্টেমের সদাশয়তা, তথাকথিত সুকুমার পপবৃত্তি, এগুলোই একমাত্র ভ্যালু নয়, এই ভ্যালু সিস্টেমই ফলত আক্রান্ত হয় । আর তার পরিবর্তে, সমীর রায়চৌধুরী যেমন বলেছিলেন, “শিল্পের কাজ নানা গোপনীয়তাকে ফাঁস করে দোয়া” -- ঠিক সেই রকম সাবভার্সিভ হয়ে ওঠেন কবি । তাঁর শিল্পকর্মের মধ্যে তিনি ফাঁস করে দেন মায়ের লুকানো ক্ষতচি্‌হ্ণ ও গোলাপি সেমিজের ইতিবৃত্ত -- সমাজের তথাকথিত মূল্যবোধের পালক পিতা-প্রভূদের ছেনালিপনা ও ডাবল স্ট্যাণ্ডার্ড -- মিথ্যাচারিতার ইতিবৃত্ত । যেভাবে পাঁচ বছরের ছেলেটিকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে খাওয়াতে হত, সে সাত বছরের দিকে যেতে যেতেই জেনে ফেলে যে কোনও কালো গাড়িই পুলিশের গাড়ি নয় । বাবা-মা ‘ওই পুলিশ আসছে’ বলা মানেই পুলিশ আসছে না । অর্থাৎ তার কাছে ফাঁস হয়ে যায়, বাবা-মা মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা বলাটাই দস্তুর ; ঠিক সেভাবেই ।

         সুতরাং সমাজের গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত যে-মিথ্যা ছড়ানো, সে গলিঘুঁচিগুলো একে-একে নখাগ্রে আসতেই প্রতিবাদী, রাগী কবিরা সে-গোপনীয়তাগুলোকে ফাঁস করে দিতে চেষ্টা করেন । তাঁদের বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার সঙ্গেই এই প্রক্রিয়াটা অঙ্গাঙ্গীভাবঢ জড়িত । ধনতন্ত্রের যে ক্রমবিকাশের কথা মলয় তাঁর কবিতায় বলেছিলেন, সেই বিকাশ তাহলে এটাই ? লৈঙ্গিক/phallic সত্তার বিকাশের সাথে-সাথে, পিতৃতন্ত্রের কঠোর অনুশাসনেরও বিকাশ । ফলত আগ্রাসন ও হিংস্রতার বিকাশ --- কামসম্পর্কিত বিকৃতি ও কামহিংসার বিকাশ। 

         অর্থাৎ এই একটি কবিতায় বিধৃত আছে মানুষের মনস্ততাত্বিক বিকাশ এবং সামাজিক সত্তার বিকাশের ক্রিটিক ( critique ).


ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ
শেষরাতে পাশ থেকে কখন উঠেছো
চুপচাপ আলমারি ভেঙে কি অ্যাসিড
ঢকঢক করে গিলে মরছ এখন
আলজিভ খসে গেছে দুগালে কোটর
মাড়িদাঁত দেখা যায় কষেতে বইছে
গাঢ় ফেনা হাঁটুতে ধরেছে খিঁচ ব্যথা
চুল আলুথালু বেনারসী শাড়ি শায়া
রক্তে জবজবে মুঠোতে কাজললতা
শোলার মুকুট রক্তমাখা একপাশে
কী করে করেছো সহ্য জানতে পারিনি
শুনতে পাইনি কোনো চাপা চিৎকার
তবে কেন সায় দিয়েছিলে ঘাড় নেড়ে
আমি চাই যে করেই হোক বেঁচে ওঠে
সমগ্র জীবন থাকো কথাহীন হয়ে

         এই কবিতাটিতে যতখানি রাগ রিরংসা ও ভায়োলেন্স আছে, তা কোনও এ-মার্কা হিন্দি ছবিতেও পাওয়া যাবে না বলে আমার বিশ্বাস । বস্তুত তথাকথিত এ-মার্কা ক্রাইম থ্রিলাররা অনেক বেশি নিরীহ ও ছাপোষা বলে আমার ধারণা । কেননা সেসব ছবির রক্তগুলি যে রঙ, আর মাংসগুলি যে রবার তা এতই স্পষ্ট যে তা আমাদের কাছে ভয়ংকর নয়, বীভৎস নয়, স্পর্শও করে না । অন্যদিকে কবিতাটির রক্ত ও মৃত্যু এতটাই সত্যি ও স্পর্শনযোগ্য যে তা আমাদের ভিতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয় । শুধু শব্দ, শুধু শব্দই সম্ভব করে এই দ্বিতীয়, বাস্তবানুগ, পুনর্জীবন । যা গায়ে কাঁটা দেওয়া এবং বীভৎস । যার জন্য, হ্যাঁ, যার জন্য মানুষের হাজতবাসও হতে পারে।

         এই বীভৎস কবিতাটি একটি বিবাহরাত্রির বর্ণনা । এর ব্যাকগ্রাউণ্ডে কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে একটি ঘটনা ; একটি মেয়ে, যার বিয়ে হয়ে গেছে, তার অন্য কোনও প্রেম ছিল, অথচ সেসব চাপা দিয়ে তার বিয়ে হয়ে গেছে এই পুরুষটির সঙ্গে । বিবাহরাত্রে/ফুলশয্যার রাত্রে সে অ্যাসিড খায় । আত্মহত্যা করে । এটা অবশ্যই সামাজিক, আরোপিত বিবাহের অন্তরালে নষ্ট-ধ্বস্ত একটি সত্য । ফাঁস হয়ে যাওয়া বলা যেতে পারে ।

         কিন্তু খটকা একটা থেকেই যায় । ঘাড় নেড়ে সন্মতি দেওয়ার সত্যটা । এই গোপন ওয়াদা/প্রতিশ্রুতির কথাটা কেমন যেন ইঙ্গিত করে -- এই আত্মহত্যা, এবং বিবাহে --- আরও একজনের অংশগ্রহণ আছে -- সে হল এই পুরুষ যার জবানবন্দিতে লিখিত কবিতাটি ।

         যেন তারই প্ররোচনায় রমণীর এই অ্যাসিডপান ।

         কিন্তু কাহিনির এই ধোঁয়াশাগুলির বাইরেও কবিতাটির অনেকখানি ছড়িয়ে থাকে । আজ্ঞে হ্যাঁ, ছড়িয়েই থাকে । বলা ভালো, ছেতরে থাকে । যতিচিহ্ণহীন কবিতাটিতে যুক্তিশৃঙ্খলা থাকলেও তা স্বাভাবিক যুক্তি নয় । তার এলোমেলো একটা চলন আছে । অ্যাসিড গিলে ফেলা মেয়েটি জিভ খসে গিয়ে সমগ্র জীবন নির্বাক হয়ে থাকবে ; কবি এখানে একটা wish বা ইচ্ছা/বাসনাকে মুক্তি দিচ্ছেন । যেন ‘কথা বোলো না, পাশে থাকো’ সেই পুরোনো রোমান্টিক বক্তব্যকেই আবার বলা হল, নতুন আঙ্গিকে । “For God’s sake hold your tongue and let me love !” এর প্রভূত প্রেমোন্মাদনা, গদগদভাবে, তারই একটা তির্যক reference হল যেন --- ‘সমগ্র জীবন থাকো কথাহীন হয়ে।’
         আসলে ছ্যাতরানো, ভাঙচুর বাস্তবতার কবি, হাংরি তথা পোস্টমডার্নের ভেতরে ভেতরে সেই আকাঙ্খাটা হল আদর্শ, স্বপ্নিল, ‘প্রেম’ নামক চূড়ান্ত বস্তুটির জন্য regressive আকাঙ্খা -- বাকচাতুরিহীন, তুমুল আরাম । কিন্তু ভাঙচুর বাস্তবতায় সে-আরামকে কখনও সরাসরি পাওয়া সম্ভব নয়, ফলত তির্যক অভিমান, frustration, alienation । সে আরামকে সোজাসুজি চাওয়া --- আরামের বদলে আত্মহত্যা চাওয়া -- স্বস্তির বদলে ধ্বংস । “পৃথিবীর শীতল বিশ্বাসঘাতকতা থেকে যেহেতু পুনরায় গর্ভের গোলাপি উষ্ণতায় ফিরে যেতে চায় ব্যক্তিমানুষ, কবিতা, আমাদের কালের কবিতা, ওই অসহিষ্ণু ফিরে যাবার আপ্রাণ ব্যর্থ চেষ্টার অসহ্য অদম্য গোঙানি…”

        হাংরি কবিদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা যেন একটা obsession অথবা  passion-এর মতো হয়ে উঠেছিল, বাস্তবেও আমরা দেখেছি । এই কবিতাতেও, আত্মহত্যার বর্ণনা এতটাই রঙিন ও আগ্রহোদ্দীপক, এতটাই টানটান উত্তেজনাময় ও বর্ণময়, যে বোঝা যায়, কবিতাটি প্রেমের কবিতা হয়ে উঠতে-উঠতে আত্মহত্যার কবিতা, alienation-এর কবিতা হয়ে উঠেছে । Sadism-এর কবিতা হয়ে উঠেছে । এবং সেই sadism আসছে একটা masochism থেকে । মূলত আত্মপীড়নকেই প্রেমিকা বা বধুর উপর আরোপ করা হচ্ছে, নিজেকে মরতে দেখার ‘সুখ’ আরও রগরগে হয়ে উঠেছে একটি নববধুকে মরতে দেখার মধ্যে দিয়ে ।

         পুরো কবিতাটা পড়ে আমার মনে হয়েছে এটা একটা celebration বা উদযাপন -- হাংরি বিবাহরাত্রি । কারণ দাম্পত্যরতির প্রথম রক্তপাতের প্রসঙ্গটা যেন আসছে কবিতায় -- ‘ধন’তন্ত্রের অগ্রসরণ একটা invasion অথবা আগ্রাসনের মতো ব্যবহৃত । তারপরেই সেটা ঘুরে যাচ্ছে আত্মহত্যার দিকে । যে আত্মহত্যাটাও রতির মতোই উত্তেজক । যেখানে কাজ করছে একটা প্রদর্শনীমূলকভাব, অথবা exhibitionism.

         হাংরি রাজনীতি, যা তৃতীয় বিশ্বের post-colonial রাজনীতি, তা সরাসরি ধনতন্ত্র/ পণ্যায়ন/ ভোগবাদের প্রসারের প্রতি আপাত মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ারও এক রাজনীতি । কিন্তু বস্তুত নিজের উপর ধনতন্ত্রের আগ্রাসনকে দেখার / অনুভব করার তীব্র প্রতিক্রিয়া । ভোগবাদের যাবতীয় উপকরণ, বেনারসি শাড়ি শায়া সেমিজ ও শোলার মুকুট কাজললতা সমস্ত কিছু রক্তে ভেসে যায় । ভোগবাদের তেজি আক্রমণাত্মক সর্বগ্রাসী ভঙ্গী, killer instinct, ঘুরে হাত্মহননের দিকে চলে যায় । ভোগবাদের প্রসার, ঐতিহাসিক কারণেই, ১৯৬০-এর দশকের ইউরোপ-আমেরিকার প্রেক্ষিতে, যখন বৃদ্ধি পেয়েছিল, সে সময়ের যুবাদের বদহজম বা acidityই হাংরির আন্দোলন, ১৯৬৮-এর প্যারির অভ্যূথ্থান, বিটনিক আন্দোলন ।

         আমার কাছে ‘ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ’ কবিতাটি এই কারণেই ‘সময় সমাজের দলিল’ বলতে গোদা বিশ্লেষকরা যা বোঝেন, বলতে গেলে তাইই ।


( এপ্রিল ২০০১ )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন