মঙ্গলবার

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর ডিটেকটিভ উপন্যাস


         স্মৃতিকাতরতা পাঠকের একচেটিয়া অধিকার নয় । 
লেখকও স্মৃতিকাতর হতে পারেন । কারণ লেখকও বস্তুত পাঠক । 
এই সহজ সত্যটিকে অনুধাবন করতে পারলে যা ঘটে তাকে বাংলা সাহিত্য 
খুব বেশি প্রত্যক্ষ করেছে বলে মনে হয় না । বিশেষ করে লেখক যখন তাঁর 
সামগ্রিক পাঠকৃতি এবং পাঠের বাইরের স্মৃতিকে ব্যবহার করছেন লিখনে, 
অথচ সে লিখন আত্মজৈবনিক নয়, বিশুদ্ধ রহস্যোপন্যাস, 
তার পাঠ অভিজ্ঞতা যে অভিনব হবেই, বলার অপেক্ষা রাখে না । 
মলয় রায়চৌধুরীর সাম্প্রতিকতম গ্রন্হ “অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার 
রহস্যোপন্যাস” পড়তে বসে এইসব আনকথা মনে এলোই । 
মলয়, যাঁর প্রাথমিক পরিচিতি হাংরি আন্দোলনের কবি হিসেবে, 
সে আন্দোলনের উদ্গাতা হিসেবে, যখনই গদ্যে নিজেকে এনে ফেলেছেন, 
পাঠকের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির দিকে ধেয়ে গিয়েছে, 
সে কথাও নতুন করে বলার নয় । ‘নখদন্ত’, ‘জলাঞ্জলি’ অথবা 
সাম্প্রতিক সময়ের ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’-জাতীয় উপন্যাসগুলিতে 
মলয় উপন্যাসের প্রথাগত আখ্যান কাঠামোকে ভেঙেছেন, 
কখনও একেবারে প্রতিস্পর্ধী কিছু খাড়া করেছেন । কিন্তু তাই বলে তিনি যে 
নিজেকে সোজাসুজি রহস্যোপন্যাসে এনে ফেলবেন, সে কথা অনুমান করতে 
পারেননি তাঁর অনুগত পাঠককুল ।

         রহস্যপন্যাস মানে সত্যি-সত্যই ডিটেকটিভ নভেল । যাতে পষ্টাপষ্টি খুন আছে, রগরগে না হলেও, যৌনতা আছে, চক্রান্ত আছে, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের আড়াআড়ি আছে । এ সবই এক বিশেষ সময়ের বিশেষ সাহিত্যের কথা বলে । বাংলায় পাল্প ডিটেকটিভ ফিকশনের ঐতিহ্যটি তেমন অভিজাত নয় । খুব একটা পুষ্টও নয় । তবু এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলা ভাষায় এ ধরণের গোয়েন্দা কাহিনির অস্তিত্ব একটা সময়ে ছিল । স্বপনকুমার সাহিত্য তার একটা বিশিষ্ট উদাহরণ ( এ প্রসঙ্গে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় নামক আরেকজন লেখকের কথাও বলা যায়, যাঁর গোয়েন্দার পদবি ছিল বাজপেয়ী ) । সেসব সাহিত্যিককে মনে রেখেই কি মলয় তাঁর এই উপন্যাসের অবতারণা করেছেন ? স্মৃতিকাতরতাই কি এই রচনার মুখ্য প্রণোদন ? উত্তর খুঁজতে গেলে পাঠ করতে হয় বাংলা চটি সিরিজের ব্যানারে প্রকাশিত এই বই । যেখানে ধরতাই এক অতিবাস্তব পরিস্হিতির মধ্যে, আর ক্রমে নিয়ে যায় বাস্তবতা নামক শর্তটির কিনার বরাবর । উপন্যাসের গোড়াতেই জনৈকা মায়া পাল জনৈক নিরঞ্জনের কব্জি পাকড়ে বলছে--- ‘চলুন পালাই’ । এবং সত্যি-সত্যই ঘটছে সেই পলায়ন । কলকাতা ছেড়ে, পশ্চিমবাংলা ছেড়ে, এমনকী নিজেদের আত্মপরিচয়কে ছেড়েও পলায়ন । অন্ধ্রের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আক্ষরিক অর্থেই প্রান্তবাসী মানুষের মধ্যে গিয়ে পড়ছে দুই নাগরিক মানুষ-মানুষী। শুরু হচ্ছে নাগরিক নির্মোক ত্যাগের ব্যায়াম । মায়া ও নিরঞ্জন এক বিকল্প জীবনের মধ্যে প্রবেশ করে, যাকে আধুনিকতার প্রতিস্পর্ধা বলা যায় । কিন্তু এই বিকল্প দীর্ঘস্হায়ী নয় । মায়ার রহস্যময় মৃত্যু পুনরায় নিরঞ্জনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে নগরবৃত্তে। তার পর ? এক বাংলাবাড়িতে এক কঙ্কালের উপস্হিতি আবিষ্কার, এক কুকুরের দেহাবশেষের খোঁজ পাওয়া এবং পুলিশের এক বিতর্কিত ইন্সপেক্টর রিমা খানের সত্যানুসন্ধান ; এর পরের অংশ বলা যাবে না । গোয়েন্দাকাহিনির  উপসংহার বলে পাঠকের চক্ষুশূল হতে চাই না ।

         কাইনির মজা তার কথনে । মলয় সেটা জানেন মোক্ষমভাবেই । তাই রহস্যের পরত যেমন জটিল, তেমনই ল্যাবিরিন্হ এই আখ্যানের বিন্যাসেও । স্মৃতি যেমন এ-রহস্যের একটা বড় উপাদান, তেমনিই গুরুত্বপূর্ণ এই ‘স্মৃতি’ হিসেবে পরিচিত বিষয়টির সংগঠন । ইন্সপেক্টর রিমা খান কঙ্কালের আইডেনটিটি জানতে হাতড়ে বেড়ায় তার রেখে যাওয়া সিডির এক বিশাল বাঞ্চ । পর্নগ্রাফি, রকসংগীত ইত্যাদির সঙ্গে মিশে আছে কঙ্কালের আত্মজৈবনিক বিবৃতির এলোমেলো অংশ । কখনও তা যৌন অ্যাডভেঞ্চারের, কখনও তা নির্বেদ ভাবনার । আসক্তি ও অনাসক্তির লড়াইয়ে বিপর্যস্ত এক মানুষ, যে জীবনে একবারই সন্ধান পেয়েছিল পরিবর্তের । সেখান থেকে চ্যুতি যেমন তার নিজের কাছে ট্রমা, তেমনই ট্রমা তার জীবনেতিহাসের সন্মুখীন হওয়া যে কারোর । রিমার অনুসন্ধান টিপিকালি পুলিশি । এর মধ্যে কোনওভাবেই রোমাঞ্চকাহিনির ছমছমকে খুঁজে পাওয়া যাবে না । অথচ রিমার জগতে রয়েছেন ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলু মিত্তির, পরেশ বর্মার মতো সুপার স্লথরা । এমনকী তিমির ওপরে যেমন তিমিঙ্গিল, এই সব সুপার স্লথদের উপরে রয়েছেন সুপার-সুপার স্লথ -- এরকুল পোয়ারো এবং শার্লক হোমস । হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই এঁরা এই কাহিনির কুশীলব । এঁদের উপস্হিতি এ আখ্যানকে নিয়ে যায় স্পুফ এর পর্যায়ে । স্পুফ অথচ ছ্যাবলামি নয় । ‘ডার্টি ফেয়ারি’ রিমা খান, তার নিজস্ব ট্রমা, তার ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জসহ কখন পাঠকের ঘাড়ে এসে নিঃশ্বাস ফ্যালে, টের পাওয়া যায় না । এক বিভ্রম তৈরি হয় । ডিতেকটিভ কাহিনিই পড়ছি তো ! সর্বতোভাবে বিচ্ছিন্ন মানুষের সংকট, যৌনতার ধূসর-ধূসরতর তরঙ্গভঙ্গ এবং এক সাবলাইম প্রতিশোধের মাথা চাড়া দেওয়া -- এ কি কোনও মামুলি থ্রিলার ? পরক্ষণেই মনে হয় এ বিভ্রমমাত্র, আসল অভিপ্রায় তো রহস্যের উন্মোচন । ডিটেকটিভ কাহিনির পোড়-খাওয়া পাঠক জানেন, রহস্যের সমাধান হবেই । সেই অনিবার্য সমাধানবিন্দুতে যাওয়ার আগে যে রোমাঞ্চকুণ্ডলিতে পাক খাওয়া, তা-ই এই ধরণের কাহিনির মূল মজা । সে পাক মলয় যুৎসই ভাবেই খাইয়েছেন । কিন্তু সেই গোলকধাঁধা নির্জস খুন আর ডিটেকশনের নয় । তাতে মিশে আছে অস্তিত্ব নামক একটা অতি প্রাচীন বিষয়ের একান্ত সমস্যাও, যা তাঁর পূর্ববর্তী লিখন ‘জলাঞ্জলি’ এবং ‘নখদন্ত’তেও ছিল, প্রকাটভাবে ছিল ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’য় । এদিক থেকে দেখলে মলয় সরে আসেননি তাঁর অভ্যাসগত লিখন থেকে । মলয়ের সঙ্গে সহবাসরত পাঠকের তাই কোনও ভয় নেই এই ‘নতুন’ উপন্যাসে । বরং প্রাপ্তিযোগ অনেক।

         একটা কথা শেষমেশ বলতেই হয় । এই বই লিখে মলয় একটি ঘোরঘট্ট কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন নিঃশব্দে। বাংলা রহস্যকাহিনির বাজার যখন তলানিতে এসে ঠেকেছে, তখন এমন এক মেধাবী লিখন সত্যিই আশার সঞ্চার করে । উদ্বেগ জাগে পরবর্তী রিমা খান অ্যাডভেঞ্চারের জন্য । আরও কি লিখবেন মলয় ? এই সময়ের রহস্যকাহিনি লেখার জন্য যে পাঞ্জার তাকতের প্রয়োজন, তা যে তাঁর রয়েছে, তা প্রমাণিত । একন দেখার, সিরিজ কনটিনিউ করার মানসিকতাটি তিনি লালন করছেন কিনা তা দেখার । পাঠকের শুভেচ্ছা রইল মলয়ের জন্য । আরও শুভেচ্ছা রইল ‘ডার্টি ফেয়ারি’ রিমা খানের জন্য । বাংলা সাহিত্যে এমন এক নারীকে আগে দেখেছি কি ? মনে তো পড়েনা ।
         

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন