মঙ্গলবার

মলয় রায়চৌধুরীর 'নখদন্ত' - ডকুমেন্ট অব আ ট্র্যাজেডি টু বি কন্টিনিউড : শর্মিষ্ঠা ঘোষ




টাইপ এ : লেখক কাহিনী বুনবেন মনগড়া কিংবা তাও ঠিক নয় , কতগুলো জেনারেল হ্যাপেনিংস বা প্রোবাবিলিটির ওপর । চারপাশের বস্তু ও প্রাণীজগৎ কে ঘিরে ।

টাইপ বি : লেখক ডিটো ভাষ্য দেবেন সাংবাদিকের নির্লিপ্ততায় যা ঘটেছে ও ঘটছে চেনাজানা চৌহদ্দিতে ।

টাইপ সি : লেখক সত্যতথ্য ভিত্তিক ও গবেষণালব্ধ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংসকে বীভৎস বা করুণ রসে জারিত করে নাটকীয় ভাবে পরিবেশন করবেন ।

টাইপ ডি : এইসব উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের সম্মেলনে লেখক কথাকারের ভণিতা সহ পেশ করবেন । কতগুলি তথ্যের আগে পিছের কার্যকারণ তুলে ধরবেন । সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং নিজস্ব ধ্যান ধারণা বিশ্বাস পছন্দ অপছন্দের আলোতে বিশ্লেষিত একটি বিশ্বাসযোগ্য উপস্হাপনা সেটি ।

মলয় রায়চৌধুরীর সম্পর্কে কিছুই না জেনে পড়তে বসেও মামুলি পাঠক চতুর্থ শ্রেণীভুক্ত করবেন তাঁকে ।
"নখদন্ত" শুরু ও শেষ হয় ডায়েরির মেজাজে , তার সাথে জুড়ে যায় কথকের নিজস্ব লেখন জগৎ , পর্যালোচনা , কাহিনী প্রসঙ্গে উঠে আসে রাজ্য রাজনীতি , অর্থনীতি , সমস্যা , অন্যায় , বঞ্চনা , শ্রমিক শ্রেণী বিশেষত পাট শিল্পের সমস্যা জনিত ঘটনাবলী । সত্য ঘটনা নির্ভর এক নিটোল গল্প যা একইসাথে একজন গবেষকের কাছেও যথেষ্ট আদরণীয় হতে পারে দ্বিবিধ কারণে । প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার সাবটেক্সট , পোস্টমডার্নিজম ইত্যাদি নিয়ে আগ্রহীরা আবার পাশাপাশি একটি উচ্চমানের গবেষণালব্ধ তথ্যাবলী সমৃদ্ধ লেখা হিসেবে ।

সাধারণ ফিকশান ক্যাটেগরিতে ফেলতে গিয়ে এ লেখা এ কারণেই বাঁধে । আবার পাঠক 'মামুলি' এই কথা পলিটিক্যালি কারেক্টনেসের উর্দ্ধে উঠে বলা , কারণ জ্ঞানত এক শ্রেণীর পাঠক বিদ্যমান যারা বিস্তর তত্ত্বকথা ঠোঁটস্হ করে একটি টেক্সটের কলকব্জা ঢিলে করে অমুকবাদ তমুকবাদ কপচান । লেখক যখন ছকভাঙা কিছু দিয়ে জোর ধাক্কা মারতে চাইছেন তিনি এমন জ্ঞানপাপী পাঠককেই অধিক সমাদর করে থাকেন , তাতে মামুলি পাঠকের পাঠ প্রতিক্রিয়ার বিস্ময়বোধে বা ইস্থেটিক প্লেজারে কোন ঘাটতি পড়ে না । আর্টস ফর আর্টস সেক কথাটি তারা সিংহাসনে বসান বেশ নমো করেই । নৈকট্য না থাকুক , স্বীকৃতির অভাব তাদের শত্তুরেও খুঁজে পাবে না ।

তো , আমি এহেন গোলা পাঠক মলয় রায়চৌধুরী পাঠ করেছি আমার মত করেই , ডিকনস্ট্রাকশন করেছি আমার সাধ্য অনুযায়ী , ইউনিটি অব টাইম প্লেস অ্যাকশান মান্য করল কি করল না ভাবা বাদ দিয়ে বা ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভের একটি বিপজ্জনক প্রবণতা , নিজ মতবাদের প্রতিফলন কাহিনী থ্রেডকে প্রভাবিত করতে পারে এই আশঙ্কা সাময়িক ভাবে সরিয়ে রেখে । রোমান এ ক্লেফ না বিলডানসরোমান তর্কাতর্কির পরেও যে সংবেদনশীলতা ভিখারি পাসওয়ান কেসের আগে পরে একটি তৃতীয় নয়নের উপস্হিতি মহাকালের দৃষ্টি না এড়ানো নেমেসিস হয়ে আসে তা অস্বীকার করা যায় না ।

পাট শিল্পাঞ্চলের এ টু জেড গুলে খেয়ে কঠোর পরিশ্রমের তথ্যকে শিল্পসম্মত উপস্হাপনের তোয়াক্কা না করেই জিরো নম্বর হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য নরম একটা দুঃখবোধ মধ্যবিত্ত বাবুপাঠকের গালে বেশ ঠাস ঠাস করেই লাগে । জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের পাশাপাশি সুখি সুখি খাঁচার তোতার জীবন থেকে একেবারে আছড়ে পড়ে শব্দবানে । কোন রেয়াত নেই বিদগ্ধ জননেতাদের । কোন ছাড় নেই ডান বাম মধ্যবর্তী মতবাদের ধ্বজাধারীদের । কারণ পাটশিল্পের অবনমনের জন্য পাটকল ও উৎপাদক অঞ্চলের অবস্হানগত বিপ্রতীপ যতখানি দায়ী কোন অংশে কম দায়ী নয় রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্যালাসনেস ও তাদের ডানহাত বাঁহাত মুষ্টিমেয় চালিকাশক্তি বনিক সম্প্রদায় । ক্রমাগত হাতবদল হওয়া মালিকানা , লিজ , পি এফ , গ্রাচুইটি মেরে পালিয়ে যাওয়া মালিক , কাঁচামালের নয়ছয় , কমিশন লোভী মধ্যস্বত্বভোগী , পচাগলা ট্রেড ইউনিয়ন লিডারশিপ , ঘুষের চক্করে ইমান বেচার দল , শুধু পাট কেন চোখ বুলালে চা শিল্পেও একইপ্রকারে বর্তমান ।

দু একটি ফেনোমেনা বাদ দলে উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের কাছে এ ছবি চেনাই লাগবে । সময়টা আগে পিছে যেদিকেই গড়াক , শাসনে নীল লাল যে অবতারই থাকুক না কেন , বনাঞ্চলের অধিকার নিয়ে লড়াই করা লীলা গুরুং , ন্যায্য মজুরীর দাবীতে উত্তরকন্যা অভিযানে যাওয়া চা শ্রমিক , রেশন , পি এফ , গ্রাচুইটি হজম করে ফেলা বাবুলোগ , শাসকের ভয়ে টেবিলের নীচে লুকোন পুলিশ কোন জাপানী তেলে শ্রমিকদের শান্তিপুর্ণ আন্দোলনে ক্ষ্যাপা কুত্তা হয়ে ওঠে আজ ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনে বা সময়ের ব্যবধানে মলয় রায়চৌধুরী এবং একটি গোলা পাবলিকের অনুভবকে একই বিন্দুতে দাঁড় করায় ।

কিন্তু দিন শেষে তিনি মলয় রায়চৌধুরী । তাঁর প্রকাশ, তাঁর চলন, তাঁর ধার-ভার-নীরীক্ষা আলোচনাযোগ্য হয়ে ওঠে যথাযোগ্য কারণেই । ঘটনাচক্রে কাহিনীর সময় থেকে আজ পর্যন্ত অনেক জল গড়িয়ে গেছে , পাঠক দেখে ফেলেছে একের পর এক লোকোমোটিভ কারখানা , কার ফ্যাক্টরিস, ছোট বড় কাপড়ের কল , কাগজ কল , ইস্পাতের যন্ত্রাংশ , রং , নানাবিধ ফুড প্রোডাক্ট তৈরীর কারখানা লালবাতি জ্বেলেছে , গনেশ উল্টেছে এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ক্ষেত মজুর , জনমুনিষ , কুলি , ভিখিরি , চোর , ডাকাত , দেহোপজীবী , ফেরিওয়ালায় পরিণত হয়েছে , নিজ রাজ্য ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে দিল্লি , মুম্বাই , কেরল , অন্ধ্রপ্রদেশ এমনকি একটি দীর্ঘকালীন রাজত্ব করার কারণে ঘুণ ধরে যাওয়া শাসনব্যবস্হার শেষে নব্যজমানা শুরু হয়ে প্রায় এক দশক হতে চলেছে তখনও বিহার থেকে আগত , ঝাড়খন্ড থেকে আগত একসময়ের কাজহারানো পাটকল শ্রমিকদের কিস্যা অনেকটাই গা সওয়া লাগে । থার্ড ফোর্থ ফিফত ডিগ্রী পুলিশি টর্চারের সামনে আজ যখন আন্দোলনরত শিক্ষিত বেকারও অহরহ পড়ে সেই বিস্ময় সেই নৃশংসতা জনিত শিহরণ অনেকটাই প্রশমিত হয়ে যায় ।

তবু টাইম ডকুমেন্টেড এ লেখা তার নিজস্ব গুরুত্ব বজায় রাখবে ঐতিহাসিক কারণেও বটে । "ইতি শ্রী শ্রী পশ্চিমবঙ্গের সাতকাহন শেষ হইল " , না , আসলে শেষ হয় নি , কারণ একটা পিরিয়ড মাত্র শেষ হল , তাও আংশিক কারণ গোটাটাই অন্ধকারের চলাফেরা হতাশা আর ক্রোধজনিত মনোলগ , যা হারানো ডায়েরির পাতায় ফিরে আসে । শেষ হয় না , কারণ লেখক বর্তমান , শেষ হয় নি তাঁর দেখা শোনা । শেষ হয় নি পশ্চিমবঙ্গীয় কিস্যা ।

পালা বদল হয়েছে মাত্র , বদলায় নি কিছুই । যে ভাষ্যের কোন চরিত্র বলে , " খ্যাংরা কাঠির ওপর আলুর দম মার্কা এক নেতার জন্যেই পশ্চিমবঙ্গে তিরিশ বছর কম্পিউটার ঢুকতে পারেনি । তাই আজ মাথায় করে টাইপরাইটার বয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতে হচ্ছে , " সে আসলে থেমে গেছে সেই নেতার জমানা শেষ হবার বহু আগেই । নোট আছে ডায়েরির পাতায় পাতায় যেমন থাকে । যেন মুখবন্ধ । কী কেন তার কৈফিয়ত । " 1.ইনভেন্ট আইডিওলজি টু সাপোর্ট অ্যাকশান । 2. ব্লেমিং আদার্স অর ইভেন্টস নট রিলেটেড টু ইউ ফর ইয়োর মিজারি ইজ এ ফয়েল অব ইয়োর উইথড্রল ফ্রম দি ওয়ার্লড । ... 4. কালচার ডাজ নট সিম্পলি রেসপন্ড টু পাওয়ার , ইট শেপস দি মরাল ওয়ার্লড ইন হুইচ পাওয়ার ইজ এক্সারসাইজড অ্যান্ড এনকাইনটার্ড । 5. সিডাকটিভ ডিগ্রেডেশান অব নলেজ । রিভাইভ ইয়োর প্রিডিলেকশানস । 6. অল পলিট্কাল অ্যাকশান গেটস সেল্ফ কনট্যামিনেটেড ।" যেন কোন বর্ণনার প্রেক্ষিত ও বর্ণনাকারীর নিউট্রালিটিটা ঘোষণা করা বেশ জরুরী । "

1. দি পাস্ট শুড বি অলটার্ড বাই দি প্রেজেন্ট অ্যাজ মাচ অ্যাজ দি প্রেজেন্ট ইজ ডায়রেক্টেড বাই দি পাস্ট । 2. মেমরি অবস্কিয়র্স ট্রুথ ।" যেখানে তিনি লিখছেন দেয়াল লিখনের কথা , ভুল হাতে পড়ে একটা স্বপ্নের অপমৃত্যুর পর নির্মম রসিকতা ," কমরেড তুমি আর গাঁড় মারবে না ? এখনও অনেক ...ইয়ে ...রয়েছে বাকি ।" হয়তো তখন ভাবা যায় নি দুহাজার আঠেরোর পশ্চিমবঙ্গে আরো অনেক নতুন নতুন শিল্পে লালবাতি জ্বলবে , কম্পিউটার আর ই জমানার মানুষও সমানভাবে খিস্তি করবে নতুন কোন লিডারকে , সমান প্রযোজ্য হবে , "

মিলের শপফ্লোরে জঙ্গল , দেয়ালে দেয়ালে কত সে অশথ গাছ । রাত্তিরে তোলাবাজ আর মস্তানদের অঙ্গনওয়াড়ি । আলোর বালাই নেই । লাখ লাখ ট্যাকার বিদ্যুৎ বিল বাকি । লাইন কাইট্টা দিসে । বাইরে দেয়ালে আর স্লোগান নাই । ঘুঁটের পর ঘুঁটের পর ঘুঁটে , তারপর ঘুঁটে , আবার ঘুঁটে । আমাগো ন্যাতা সাইনবোর্ড লয়্যা অননো মিলে গ্যাসেন গিয়া ... কবে যে মিলের জমিডা বিক্রয় হইব ।" কোথাও কি বদলেছে বিরোধী বা প্রতিবাদীদের ওপর শাসকদলের উস্কানিতে পুলিশি নির্যাতনের ইতিবৃত্ত ? এখনো কি হরহামেশা এসবের পর কর্তাদের নেতাদের বলতে শোনেন না " ওই ঘটনার কতা আমার জানা নেই । তবে খোঁজ নিচ্ছি " ? নির্বাচন চলাকালীন পোলিং অফিসার কে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করে রেল লাইনে ফেলে দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালাতে দেখেন নি সম্প্রতি ? সেন্ট পলস এর ফেস্টে হাজার হাজার টাকা তোলা তুলছে না ইউনিয়ন ? অধ্যাপক , শিক্ষকদের গান পয়েন্টে হেনস্হা ঘটছে না প্রায় রোজ ? ঘটছে । কারণ রাজ্যটার নাম যাই হোক না কেন , কোন জায়গাতেই ফর দ্য পিপল , অব দ্য পিপল , বাই দ্য পিপল কোন ব্যাপার নেই , সংবিধানে সে যাই দাবী করা হোক না কেন ।

তাই মলয় রায়চৌধুরীর রাগ ক্ষোভ ব্যঙ্গ যতই পার্টিকুলার আইডিয়ালস বা লাইন অব পলিটিক্সকে আক্রমণ করুক না কেন , কোন আইডিয়াল রিপাবলিক বা ইউটোপিয়া খুব রিজনেবল চাওয়াও নয় । তাই পিরিয়ড পিস হিসেবেই বা শুধু বলি কেন এই টেক্সটকে , মাৎস্যন্যায়ের সর্বলক্ষণ বুকে করে চলা এক মায়া সভ্যতা সে নিজেকে টেনে নিয়েই চলে , ক্ষইতে ক্ষইতে , না ফুরোতে ফুরোতে , কাংগাল চামার বা সত্য আচার্যরা আজও নাম বদলে ধাম বদলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে চলেছেন । আঠেরোটা ইউনিয়ান সেদিন যে সর্বনাশ করেছে আজ একটিমাত্রই কাফি । চাকরির পরীক্ষা দিতে জড়ো হওয়া টাইপরাইটার মাথার বেকারদের মহামিছিল শুধু বদলে গেছে কম্পিউটার জানা বেকারদের আত্মহত্যায় , ঘুষ দিতে না পারার আর লিডার ধরতে না পারার ব্যর্থতায় । হাসপাতালের ঘোষণা করা মরা বাচ্চা আজও দাফন করতে গেলে নড়ে ওঠে , মানুষের হাসপাতালে কুত্তার ডায়ালিসিস হয় , কোটি কোটি টাকার ওষুধ নয়ছয় হয় , পোড়াতে হাসপাতালের পর হাসপাতালে আগুন ধরানো হয়,  আজও জঙ্গমহল হাসছে বিজ্ঞাপনের পেছনে, না খেতে পেয়ে শবররা মরে যায় , নতুন নতুন কলকারখানা বন্ধ হয় রোজ আর সেসব সারানোর গুণিনরা বিষধর । " তারা যত বিষ ঝাড়েন তত বিষ বাড়ে । কত - কত বক্তৃতা আর ভাষণ ঝাড়েন সেসব গুণিনরা , গম্ভীর মুখে , নাক ফুলিয়ে , যন্তরের মতন বকরের পর বকরের পর বকর ।"

কই কিছুই তো একচুল বদলায় নি , সাদা ধুতি গিয়ে সাদা শাড়ি এসেছে , সর্বহারার নেতার বদলে হাওয়াই চটির নেত্রী এসেছে , পশ্চিমবঙ্গের 'বাংলা' নাম না রেখে "রসাতল" রাখার দাবীটি মোটেও বদলায়নি । সব 'নখদন্ত' নিয়ে বিদ্যমান । মলয় রায়চৌধুরী যদি প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার ঐতিহ্য এখনো বর্তমান রেখে থাকেন আমরা নিশ্চয়ই এর একটি সিকুয়েল আশা করতে পারি !

সোমবার

উদয়ন ঘোষ : মলয় পোস্টকলোনিয়াল, মলয় পোস্টমডার্ন


        যত দিন যাচ্ছে, মলয়ের লেখা যত পড়ছি, ততই মনে হচ্ছে, তাঁকে নিয়ে মহাভারত লেখা যায় । মহাভারত অবশ্য কথার কথা, আসলে মলয় সম্পর্কে বহুবিধ কথা লেখা যায় । সেজন্য নিজের সুবিধার্থে এবং টাইম অ্যাণ্ড স্পেস ভেবে, আমি স্হির করেছি, মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে মাত্র ওই কথা লিখি, অর্থাৎ মলয়ের পোস্টকলোনিয়ালিজম এবং তাঁর পোস্টমডার্নিজম ।

         আর যে যাই ভাবুক, আমি ভাবি, এদেশে পোস্টকলোনিয়াল না হলে পোস্টমডার্ন হওয়া যায় না ।

         আদিতেই বলে রাখা ভালো, ওই পোস্টকলোনিয়ালিজম ও পোস্টমডার্নিজম সম্পর্কে আমার ধারণাকে, আমি, কিছুকাল হল, নিজের কাছে অন্তত, স্বচ্ছ করে রাখতে পেরেছি । কেননা দুটোই ঐতিহাসিক ভাববস্তুগত নির্দিষ্ট এক অবজেকটিভ কোরিলেশানে আছে । এবং দুটোই এককভাবে কোনও দর্শন, অথবা আচরণ কিংবা ঢঙ অথবা প্রবণতা নয়, তদুপরি এককভাবে এই দুই কোনও সাংস্কৃতিক অথবা পরিকাঠামোগত স্ফূরণও নয় । এবং এই দুই ওই সবকিছুর যোগফলও নয় । অথভ ওই পোস্টকলোনিয়ালিজম ও পোস্টমডার্নিজমে ওই সব তথাকথিত কোনও নির্দিষ্ট দর্শন, আচরণ, ঢঙ, প্রবণতা, সাংস্কৃতিক/পারকাঠামোগত স্ফূরণ ইত্যাদি ইতস্তত থাকলেও থাকতে পারে । কিছু গবেষক, ক্রিটিক, উৎসাহী পাঠক, অথবা ওই দুই ইজমের ধ্বজাধারী সেবক, লেখক, কিংবা সদাসর্বদা যাঁরা যে-কোনও ইজমের হঠাৎ দার্শনিক বনে যান, অথবা তদনুরূপ সমাজবিজ্ঞানী ওই দুই ইজমে, ওপরে, যা যা লক্ষণের কথা আছে -- তার সবগুলি, অথবা একাধিক, কিংবা যে-কোনও একটি লক্ষণকে ওই দুই ইজমের ধ্রুবতারা মনে করতে পারেন ।

         আমি বরাবরই ওই সব ইজম, এবং তৎসংক্রান্ত নানাবিধ টাইটেল-সাবটাইটেল, লেবেলসর্বস্বতা ইত্যাদি থেকে তফাতে থাকার চেষ্টা করি । জীবিকায় শিক্ষক হবার জন্যে, এবং ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে আমাকে কিন্তু ওই সব পড়তে হয়েছে, এবং ক্লাসে ওই সব বলতেও হয়েছে, বিশেষত তথাকথিত নন্দনতত্বের ক্লাসে । আমাকে ক্ষমা করুন, পাঠক, ক্লাসে, প্রকাশ্যে ওই সব আমি মানিও বলতে হয়েছে, বা এই ঠিক যে রস নয় প্রকার, ছত্রিশ তার অনুষঙ্গ, যেভাবে ওই সব লেখা পোয়েটিইকস সম্পর্কিত গ্রন্হাদিতে, সেভাবেই বলতে হয়েছে । নিজের কথা বলার তো স্কোপ নেই, তাই ছাত্রদের কোনও দিনই বলা হয়নি যে, ওই সব জেনেও, সাহিত্যের চুলও ছোঁয়া যায় না ।

        এমতাবস্হায় আমাকে লিখতে হচ্ছে, ওই কথা অর্থাৎ মলয় রায়চৌধুরীর পোস্টকলোনিয়ালিজম এবং তাঁর পোস্টমডার্নিজম । পাঠক অবশ্যই ভাবতে পারেন, কী দরকার ছিল এইসব ঘটা করার । স্রেফ মলয় রায়চৌধুরী কী ও কে সহজ সরল ভাষায় সরলার্থ করলেই হত !

         হত না ।

         কেননা পাঠক হিসেবে পাঠকমনকে যতটা জানি, সাহিত্যের আলোচনায় যদি ওই সব ইজম, টাইটেল, লেবেল না-থাকে, তাহলে অ্যাকাডেমিক সাহিত্য বুঝতে বড় অসুবিধে হয় । যেই লেখা হল, মলয় হাংরি জেনারেশন অন্যতম ইশ্যু, অমনি পাঠকের যা বোঝার সহজে বোঝা হয়ে গেল । কেননা পাঠকের, যে-কোনো ভাবেই হোক, ওই সব টাইটেল চোখে পড়বেই এবং মূর্ত থেকে বিমূর্ত ধারণা থেকেই যাবে, বলা উচিত জন্মও নেয় ওই সব ইজম, টাইটেল একবার মগজে ঢোকাতে পারলে । এখন, কী করি, আপনিই বলুন পাঠক, যখন পাঠক হিসেবে আমাদের মাথায় ইতিমধ্যেই ঢুকে বসে আছে ওই সব, তখন ওই সব দিয়েই কাজ করে যেতে হবে । না-হয় বযোজোর আমি ইজম টাইটেলের ফ্রেম ভেঙে গড়ে দিলাম । এবং এভাবে পাঠকমন ও আমার ভেঙে দেয়ার মধ্যে সত্যবস্তুকে রক্ষা, দুই-ই সামলালাম । হ্যাঁ, পাঠক, দু-নৌকোয় পা দিয়েই কাজটা করতে হবে । মানুষের সে-অভ্যাস ভালোই আছে -- কেননা পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র তথাকথিত অনাবিল জানোয়ার হয়ে পরক্ষণেই আবার তথাকথিত আবিল মানবিক হতে পারে । এ-কাজকেই আবার মানুষই বলর দু-নৌকোয় পা দেয়া ।

দুই

         যাই হোক, প্রথমে পোস্টকলোনিয়ালিজমের কথা হয়ে যাক । অর্থাৎ মলয় কোথায় পোস্টকলোনিয়াল । এ-ব্যাখ্যায় আমি মলয়ের নিজস্ব ‘ভূমিকা’ তথা ‘আত্মপক্ষ’ থেকে ওঁরই কথাগুলো হুবহু লিখে যাচ্ছি : “২৯ অক্টোবর ১৯৩৭ থেকে ২ নভেম্বর ১৯৩৯ এর মধ্যে কোনো ১১ই কার্তিক, পাটনার প্রিন্স অব ওয়েল্স মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে, পৃথিবীর দিকে পা করে জন্মাবার’’’”ইত্যাদি । অথচ ক্ষণেক পরেই ওই মলয় জানাচ্ছেন, “হাসপাতালের রেকর্ড খুঁজে দেখেছিলুম ২৯ অক্টোবর -- ২ নভেম্বর ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯ বৃহস্পতিবার শুক্রবার শনিবার কারুর, ছেলে হয়নি, হলেও মরা অবস্হায়।”--- ময় রায়চৌধুরীর ‘ভেন্নগল্প’-এর দ্বিতীয় ভূমিকার ‘প্রতিবন্ধী অস্তিত্ব’ থেকে হুবহু নেয়া ( পৃ ্ঞ-ট, মার্চ ১৯৮৪ ) ।

         এখন ব্যাখ্যা সরল যে, মলয় পোস্টকলোনিয়াল, কেননা মলয় কলোনিয়াল নন, কেননা মলয় কলোনিতে জন্মাননি, কেননা পৃথিবীর দিকে পা করে জন্মাবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কেননা পরবর্তীতে ওই হাসপাতালের রেকর্ডে, যেখানে তিনি জন্মেছেন বলে লোকশ্রুতি, সেখানে কোনও পুত্রসন্তান ( ছেলে ) জন্মাবার তথ্য নেই । অর্থাৎ মলয় পোস্টকলোনিয়াল ইন দা ট্রুয়েস্ট সেন্স অব দা টার্ম । পোস্টকলোনিয়াল না হলে নিজের প্রতিবন্ধী কলোনিয়াল অস্তিত্বকে, এবং তার পরিকাঠামোর ফ্রেম এভাবে ভাঙতে পারতেন না । মলয় এখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক, এবং উত্তরঔপনিবেশিক । ঠিক, তদুপরি বলি, মলয়ই একমাত্র, যিনি ঘোষণা করেন, “মলয় রায়চৌধুরীর কোনো গ্রন্হের কারুর কোনো কপিরাইট নেই’...কোনোরকম স্বত্ব কারুর জন্য সংরক্ষিত নয় । তা পাঠকের।” মলয় এখানে তৃণমূল গণতান্ত্রিক, অতএব উত্তরঔপনিবেশিক । বলা বেশি হোক, তবু বলি, পাঠক, এখানেই তাঁর পোস্টকলোনিয়ালিজম বুঝুন । এই পোস্টকলোনিয়াল হবার জন্যই মলয় বড় সহজে পোস্টমডার্ন হতে পেরেছেন । অবশ্য মলয় স্বয়ং মনে করেন, সাম্রাজ্যবাদে পতনের সঙ্গে উপনিবেশেরও পতন হয় । তবুও মলয়ের জন্মকালে, বাল্যকালে, কৈশোরেও কিন্তি ওই সাম্রাজ্যবাদের ঐতিহাসিক পতন ঘটেনি ।

তিন

         এবার পোস্টমডার্নিজম পপসঙ্গে যাই, কেবল এই কথা বলে নিয়ে, মলয় যে-উত্তরঔপনিবেশিক তথা অধুনান্তিক, এ তাঁর জন্মবৃত্তান্তেই আভাসিত, কেননা সেখানে সে যৌগিক সংস্কৃতির । জন্মলাভও করেন, আবার রেকর্ড রাখেন না । 

          পশ্চিমী সভ্যতার এক শূন্যতায় পোস্টমডার্নিজম যে কেবল নঞর্থক প্রতিক্রিয়া, তা নয়, একটা প্রতিবাদের জায়গাও বটে । ১৯৭০ ও ৮০র দশকের সিনিসিজম ও হতাশার সঙ্গে সামঞ্জস্য বলেই এর চিন্তাভাবনা ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করেছে । সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস ও পরাজিত মনোভাবের ভূমিটি, পোস্টমডার্ন তত্ব, কবিতা, শিল্প অধিকার করার, সক্ষমতাতেই মনোযোগ আকর্ষণ করে । পোস্টমডানড চিনতায়, তার অন্যতম প্রধান প্রবক্তা জাক দেরিদার ভাবনায়, পাওয়ার বা ক্ষমতা সম্পর্কেই সন্দেহ ঘনীভূত, ক্ষমতার দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার দিকে অঙ্গুলিসংকেত । দেরিদা বলেন, ক্ষমতা সবকিছুকে জোর করে এক করতে চায়, পার্থক্য অস্বীকার করে, সময় ও সময় ছাড়িয়ে জীবনশিল্পের নানামাত্রিক ব্যাখ্যাকে চেপে ধরে এক করতে চায়, প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্হাতেও এর ব্যত্যয় হয় না । পাওয়ারকে তাই অবিশ্বাস করো । মানুষের তুচ্ছতা ও ক্ষমতাহীনতাকে পোস্টমডার্ন সামনে নিয়ে আসে । অত্যাচারিত যে অত্যাচারিত, তার কারণ সমগ্র ব্যবস্হাই অনিবার্যভাবে অত্যাচার পুনরুৎপাদিত করে । পোস্টমডার্নে এ সত্যই ধ্বনিত হয়, ক্ষমতাবান অত্যাচারিতের ভালো তো মোটেও নয়, বরং খারাপ । শুধু তাই নয়, দেরিদা ও পোস্টমডার্নেরা মনে করেন, সক্রিয়তার কোনও নির্বাচন নেই, যে কোনও সক্রিয়তাই ক্ষমতার সামগ্রিকতায় আক্রান্ত হয়, কার্যকর সক্রিয়তা তাই অনৈতিক । স্বাধীনতা যদি পেতেই হয়, তাহলে প্রয়োজন ‘ডিকন্সট্রাকশান’-এর বা বিনির্মাণের । এখানেই মানুষ পোস্টমডার্নকে সঙ্গী হিসাবে পায় : কারণ জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় সে দেখে স্বাধীনতার অনুপস্হিতি, দেখে যে-কোনও রাজনৈতিক ব্যবস্হাই হোক, ফলাফল একই : হতাশা ও স্বাধীনতাহীনতা । আমাদের “বাস্তবেও অন্য প্রক্রিয়ায় প্রায় এরকমই অভিজ্ঞতা পাওয়া যায় । পোস্টমডার্নের এই সাধারণ মানুষের অসহায়তা বোধের উপর গুরুত্ব দেওয়া, এখানেও তাই প্রাসঙ্গিক মানুষের তুচ্ছ হয়ে যাওয়া, মানুষের হতাশা এ-বাস্তবেও অন্যভাবে ক্রমশ মানব অস্তিত্বকে খাচ্ছে ।”

         উদ্ধৃতিটি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের । তাঁর পোস্টমডার্নিজম তত্বের ব্যাখ্যায় ওইভাবে অগ্রসর হয়ে তিনিও জানাচ্ছেন, পোস্টকলোনিয়াল না হলে পোস্টমডার্নিজমে প্রবেশ করা যায় না  অবশ্য তিনি এ কথাও বলতে ছাড়েন না, কলোনিয়াল তৃতীয় বিশ্বের যে-হতাশা প্রথম বিশ্বের দ্রুত গ্লোবালাইজেশান দেখে জন্মায়, সেখানে পরোক্ষে পোস্টমডার্ন হওয়া যায়, যদিও তা খানিক পুঁথিপড়া হবে, স্পন্টেনিয়াস হবে না । এবং এখানকার মানুষদের তুচ্ছ হয়ে যাওয়া প্রথম বিশ্বের মানুষদের দেখে, দ্রুত উল্লম্ফনের দ্বারা সব তুচ্ছতাকে কাটাবার মানসিকতায় বৈদেশিক ঋণ নিয়েও -- গ্রাম্য কলকাতায় মেট্রোরেল করা, যার শুরুতেও অদূরে গ্রাম্য আচরণ, তার শেষেও ওই আচরণ, শুরুর তুল্যই, নিকটবর্তী । অথবা হায়দ্রাবাদে প্রথম বিশ্বকেও চমকে দেবার জন্য প্রস্তুত ইন্টারনেটের মহিমা, যারও অদূরে তেলেঙ্গানার কাছাকাছি ব্রাহ্মণ্য দাপট সর্বকালের গ্রাম্যতাকে ছাড়িয়ে যায়, এখনও । অর্থাৎ আধুনিকতা এখানে আধিপত্যবাদী নয়, ভঙ্গুর । তাই পোস্টমডার্ন হওয়া যায় । কেননা গ্রাম্যতার আয়রনিকাল অস্তিত্বেই বস্তুত পোস্টমডার্নিজমের আবির্ভাব ।

         আমিও এসব মানি । বলা উচিত পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ওই ভাবনাকে অভিব্যক্ত করার জন্য আমি আমারই বাক্যসমূহকে কাজে লাগাই । এবং আজ একথা স্বীকার করা আমারই দায় যে এসবই আমি, বড় সম্প্রতি, মলয় রায়চৌধুরী থেকে সম্প্রসারিত হয়েছি ।

চার

       সমীর রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘পোস্টমডার্নিজম : অধুনান্তিকতা’ গ্রন্হের প্রবন্ধ ‘পোস্টমডার্নিজম তত্ব : মলয় রায়চৌধুরী’ আমি একাধিকবার পড়লাম । সম্প্রতি খুব মন দিয়ে এমন নিবিড় পাঠ আর করিনি । কার্যত আমি প্রকৃতই বিস্মিত হচ্ছিলাম, এমন অনাবিল প্রক্রিয়ায় এদেশে বসবাস করে কীভাবে ওই প্রবন্ধ লেখা যায় । মাইল মাইল অসহনীয় জ্ঞান তো পযেই আছে কতকাল ধরে । কবেই আমি জানিবার জানিবার গাঢ় বেদনার ভার ঘাড় থেকে নামিয়ে, বেশ বহাল তবিয়তে আছি, ওই জ্ঞান আহরণের অসহনীয় বিদীর্ণ বিস্ময় থেকে মুক্ত হয়ে । স্হির করে নিয়েছিলাম, আর ওপথে যাব না । বড় জোর প্রিয় লেখকদের গদ্য-পদ্য পড়ে যাব, তাতে হবতো বা প্রাবন্ধিকতা থেকে যেতে পারে, অথবা ওই, জ্ঞান, যা আমার সুখের চুল অব্দি ছুঁতে পারে না । তবু ওই পর্যন্তই। আমি এখন শেকসপীয়ারের সবকিছু, বিশেষত সনেট, রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস-গান-ছবি, জীবনানন্দের ও বিনয় মজুমদারের সবকিছু পড়ে যাই । ভেবেছিলাম, এভাবেই কাটিয়ে দেব আরও কিছুকাল । তারপর কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘মহাভারত’ । দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর এপিসোডে বেদব্যাসের ম্যাজিক রিয়ালিটি । তারপর মৃত্যু অথবা মস্তিষ্কের স্তব্ধতা আসা স্বাভাবিক ।

পাঁচ

        কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, আমি স্হির করে ফেলেছি, সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরী পড়ে যাব । এবার হুবহু মলয়ের সেই কথাগুলো লিখে যাই :-

“আধুনিকতার কালখণ্ডটির ছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ । সাম্রাজ্যবাদের উথ্থান ও পতনের সঙ্গে ঘটেছে আর্ট ফর্ম রূপে উপন্যাসের উথ্থান ও পতন । সাম্রাজ্যবাদের পতনের সঙ্গে ফুরিয়েছে আধুনিকতা ও আধুনিকতার অবসানের সঙ্গে সম্পূর্ণ ছিতরে গেছে উপন্যাসের ফর্ম । উপন্যাসের আদি কাঠামো ভেঙে পড়ার সঙ্গে কাহিনিকেন্দ্র থেকে অপসারণ ঘটেছে নায়কের । যারা যারা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সাম্রাজ্যবাদ, আধুনিকতা, উপন্যাস বা নায়ক, সবাই আক্রান্ত হয়েছে অধুনান্তিক কালখণ্ডে । কেন্দ্র থাকলে থাকবে পরিধি বা প্রান্ত বা প্রত্যন্ত । সাম্রাজ্যবাদের প্রান্তিক যেমন উপনিবেশ । আগেকার উপন্যাসে অন্ত্যজ ছিল প্রান্তিক । শহর যদি ক্ষমতার কেন্দ্র হয়, গ্রাম তাহলে প্রান্তিক । আমি কেন্দ্রে থাকলে তুমি হবে প্রান্তিক । পুরুষ যদি কেন্দ্র হয়, নারী হবে প্রান্তিক । অধুনান্তিকতা চাগিয়ে ওঠে কেন্দ্রের বিনির্মাণ থেকে । আধিপত্যকে তা খর্ব কর সাহিত্যে, সংগীতে, শিল্পে, নৈতিকতায়, রাজনীতিতে, সমাজে, ভাবদর্শে । বাংলা সাহিত্যে গোরার জায়গায় এসেছে চোট্টি মুণ্ডা ।”

“সাম্রাজ্যবাদ শেষ হবার পর উত্তরঔপনিবেশিকতা গড়ে তুলেছে নিজস্ব আগ্রহের এলাকাটি, যেটি অধুনান্তিকতার উদ্বেগজনক আগ্রহের এলাকাও বটে : প্রান্তিকতা, প্রত্যন্তবাসী, অন্ত্যজ, মফসসল, অনিশ্চয়তা, বহুচারিতা, লোকসংস্কৃতি, দোআঁশলাপনা, লালিকা, রঙের ছটা, এলোমেলো চিন্তা, যৌগিক সংস্কৃতি, অনির্ণেয়তা, আকস্মিকতা, বিশৃঙ্খলা, গৃহহীনতা, ভুতুড়ে পুঁজি, প্যাসটিশ, পণ্য, বহুত্ববাদ, ঠিকেদারি শ্রমিক চুক্তি, একযোগে অনেক কাজ, অপ্রাতিষ্ঠানিকতা, রূপের বৈচিত্র্য ও অজস্রতা, তৃণমূল গণতন্ত্র, পাড়ার নান্দনিকতা ইত্যাদি। উত্তরঔপনিবেশিকতা ও অধুনান্তিকতা মনে করে ইতিহাস একরৈখিক নয়, ইতিহাস অজস্র ও স্হানিক । সাম্রাজ্যবাদ, আধুনিকতার নামে যে ইশারা ও দ্যোতকগুলো নেটিভদের ওপর চাপিয়েছিল, সেগুলোকে অধুনান্তিকতার মাধ্যমে উপড়ে ফেলে দিতে চায় উত্তরঔপনিবেশিকতা । নেলো রিচার্ডস বলেছেন যে, ইউরোপ আমেরিকায় পোস্টমডার্নিজম সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা শুরু হবার আগেই অধুনান্তিকতার আসল প্রবণতাগুলো প্রাক্তন উপনিবেশগুলোয় চোখে পড়ে । কোনো উপনিবেশের ভাষাকে অপ্রভাবিত রাখেনি ইউরোপ । আধুনিকতার নামে চাপানো সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম বিষয়ে ধারণা সবই ইউরোপের । সাম্রাজ্যবাদের শিকারটির সমস্যা, অতএব, অধুনান্তিক । তার ভাষার ভিত্তি নষ্ট হয়ে গেছে । বিচার, বিবেচনার মাধ্যম নষ্ট হয়ে গেছে । অভিব্যক্তির কাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে । অথচ সাহিত্য ও রাজনীতিতে, উত্তরঔপনিবেশিকতা আবর্তিত হয় ভাষাকে কেন্দ্র করে, কেননা, আত্মপরিচয় অন্য কোথাও পাওয়া যায় না । দেখা যাবে যে, শিল্পে ও সাহিত্যে একই ধরণের কাজ হচ্ছে উপনিবেশগুলোয় এবং পোস্ট-ইনডাসট্রিয়াল আমেরিকায় । এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকায় অধুনান্তিকতার প্রাসঙ্গিকতা এ থেকেই টের পাওয়া যায় । সাম্রাজ্যবাদের দরুণ  উপনিবেশের নেটিভদের স্মৃতিবিপর্যয় ঘটে গেছে । পোস্টমডার্ন লেখালিখি ও ছবি আঁকায় যে প্রবণতাগুলো প্রখর তা তুলনীয় স্মৃতিবিপর্যয়ের সঙ্গে ।”

“আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি পোস্টমডার্নিস্ট প্রবণতা দেখা যাচ্ছে । কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক তা নিয়ে চলছে বিরামহীন খেয়োখেয়ি । সত্য, জ্ঞান, বৈধতার নানান রকমফের । যেমন উলফা, জেকেএলএফ, খালিস্তান, শিবসেনা, আমরা বাঙালি, ঝাড়খণ্ড, গোর্খাল্যাণ্ড, বোড়ো্যাণ্ড, উত্তরাখণ্ড, ইত্যাদির মতন ছোট ছোট ছাতার স্হানিক কেন্দ্রিকতা-বিরোধী চেতনা । যেমন ভূমিসেনা, লাচিত সেনা, কুঁয়র সেনা । যেমন অজস্র নাটকের দল । যেমন আঞ্চলিক ভাষার কবিতা । যেমন টুকরো টুকরো মহাআখ্যানবাদী মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট দল । যেমন রাজনীতিতে ক্রিমিনালদের দৌরাত্ম্য । যেমন সুমন-নচিকেতা-মৌসুমীর সংগীতের ক্ষমতাকেন্দ্র-বিরোধী গান । যেমন হাজার হাজার লিটল ম্যাগাজিন । এবং ঘরে ঘরে ‘আদর্শের শেষ’ । যেমন টিনশেড কোচিং ক্লাস শিক্ষা কাঠামো । যেমন প্রতিটি বাঙালির আঙুলে এনলাইটেনমেন্ট-বিরোধী গ্রহরত্ন । যেমন লোকনাথ বাবা, সত্য সাইবাবা, অনুকুল ঠাকুর, বালক ব্রহ্মচারী, আনন্দময়ী, দাদাজী, রজনীশ, মহেশ যোগী ইত্যাদি ধর্মের ছোট ছোট ছাতা যযা হিন্দু শুদ্রকেও প্রতিষ্ঠা দেয় । কম্যুনিটির ভাঙন এবং অ্যসোসিয়েশান সমূহের জন্ম, যে উত্তরাধুনিক বৈশিষ্ট্যের কথা কিথ টেস্টার বলেছেন, এখানে তা ঘটেছে দেশভাগের দরুণ এবং মহাআখ্যানবাদী পার্টি রাজনীতির কারণে । কৌমসমাজ ভেঙে যাবার কারণেই পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র আজ ছুতোর গয়লা নাপিত ধোপা ধুনুরি মুচি, এরা অবাঙালি।”

“গ্রামকেন্দ্রিক নৈরাজ্য গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যেই । আধুনিকতার অসুখ সারানো যাবে কিনা বলা মুশকিল । এই যে দাদা একটু সরুন, দাদু ভাড়াটা দিন, মাসি বেগুন কত করে, বলার সময়ে আমরা যে শুধু দাদা-দাদু-মাসির সম্পর্কচ্যুতি জানতে পারি তা নয়, আমরা টের পাই কৌমসমাজ ভেঙে যাবার খবর, আমরা টের পাই কীভাবে এই শব্দগুলোর ভেতর থেকে তাদের মানে বের করে ফেলে দিয়েছে সমাজ । পোস্টমডার্নিজমকে বাঙালির দোরগোড়ায় এনেছে বঙ্গসংস্কৃতির অধুনান্তিক পার্টি রাজনীতি এবং উত্তরঔপনিবেশিক আর্থিক দুর্গতি।”

ছয়

         এবার মলয়ের কথাগুলি নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবা যায় । প্রথমেই বলা ভালো, আমি যে লিখেছিলাম, পোস্টকলোনিয়াল না হলে কেউ পোস্টমডার্ন হতে পারে না, সেখানে মলয়ের বক্তব্য ওই পোস্টকলোনিয়ালিজম এবং পোস্টমডার্নিজম আসলে একই বস্তুকেন্দ্রের দুটি অভিব্যক্তি, পরস্পর নির্ভর অথবা পারস্পরিক কিংবা যমঝ । অবশ্য মলয় আরও লজিকালি কথাটার বিস্তার ঘটিয়েছেন । তাঁর ধারণা, সাম্রাজ্যবাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মডার্ন যুগের অবসান ঘটেছে, আধুনিকতার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে উপনিবেশেরও অবসানের লক্ষণাদি মূর্ত হয়েছে। 

         মলয়, বোধহয়, ধ্রুপদী সাম্রাজ্যবাদের অবসানের মধ্যেই সাম্রাজ্যবাদের চারিত্রিক অবসান দেখেছেন । আমি অবশ্য বরাবরই নিয়ো-ইমপিরিয়ালিজম টের পাই, এখনও পাই । নিয়ো-ইমপিরিয়ালিজমের অস্তিত্ব মেনে নিলেও, মলয়ের একটি কথা তবু সত্য হয়ে ওঠে । ধ্রপদী সাম্রাজ্যবাদের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুপদী উপনিবেশেরও অবসান ঘটেছে । এটা ঠিক । এবং মলয়কে সেলাম জানাই, আমার মধ্যকার এক নিগূঢ় জিজ্ঞাসা, যার উত্তর নানা সময়ে পেয়েও আবার জিজ্ঞাসায় আক্রান্ত হয়েছে আমার মন, অর্থাৎ আমার মস্তিষ্ক, সেখানে মলয়, সম্প্রতি, তাঁর রচনাদি পাঠকালে আমার শিক্ষক হয়েছেন । অর্থাৎ যথার্থ উত্তর দিয়েছেন, যার পর আর নাই ।

         একদা আমি তিন কমিউনিস্ট পার্টির কখনও সদস্য, ককনও দরদি মেম্বার হয়ে বার বার নানা মিটিং, কংগ্রেস, পার্টি ক্লাস করে যে-প্রশ্নে মন তথা মস্তিষ্ককে জেরবার করেছি, তা হল, আমাদের দেশের রাষ্ট্রচরিত্র বিশ্লেষণে ও বৈপ্লবিক স্তর নির্ণয়ে ওই নিয়ো-ইমপিরিয়ালিজম ও নিয়ো-কলোনিয়ালিজমের ভূমিকা খুঁজতে । বার বার ভুল হয়ে গেছে । সি পি আই ও সি পি এম বাহিত হয়ে যখন নয়া-সংশোধনবাদ-বিরোধী শিবিরে গিয়েছি, তখন যেন সঠিক বৈপ্লবিক পথের দিশা পেয়ে উৎসাহিত তথা আহ্লাদে আটখানা হয়ে প্রকৃতই গৃহে বাস করেও রণাঙ্গনের মাঠে যাবার উদ্যোগ নিচ্ছিলাম । সে-সময় সংশোধনবাদী সি পি আই ও নয়া-সংশোধনবাদী সি পি এম-এর মধ্যপন্হাকে ঘৃনায় বর্জন করে যখন প্রায় গৃহত্যাগে মনস্হির করচি, এমন সময়ে আমার লেখকসত্তা, যার ভিতরে কল্পনা ও যে-কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা চরাচরের নানা সম্পর্কে আসছিল, যে-সত্তা ইহলোক স্বপ্নলোকের বর্ডার মানেনি, সে সহসা দেখল, প্রকৃত রণাঙ্গন নেই । অর্পিত তথা অ-লৌকিক রণাঙ্গন আছে কেবল । তখন ওই ধারাবাহিক সত্তা, যা একান্ত আমার, আমার চিন্তা জ্ঞানলব্ধ, পুনর্বার নয়া-উপনিবেশ ও নয়া-ফিউডাল তত্বে মনোনিবেশ করল ।   

         এই সময়ে তথাকথিত তৃতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অফিশিয়াল অথবা কংগ্রেসসিদ্ধ অস্তিত্ব আসেনি । তখন নানা গ্রুপ, নানা কর্মচিন্তা মাথা তুলছিল, তার মধ্যে মতাদর্শগত বিতর্কে এক ধরণের গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাও মাথাচাড়া দিচ্ছিল । সেই উত্তপ্ত দাবানলী সময়ে আমার সঙ্গে একটি গ্রুপের যোগাযোগ ঘটে, ইতিহাসে তাদের নাম নয়া-সংশোধনবাদবিরোধী সোশ্যালিস্ট রিভলিউশানারি, সংক্ষেপে এস আর গ্রুপ । তাদের সঙ্গে দিনের পর দিন তর্কে যে জায়গায় পৌঁছেছিলাম, তার সঙ্গে মলয়ের বিশ্লেষণের গুণগত সাদৃশ্য আছে । সেই জায়গাটি হল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ক্ল্যাসিকাল ইমপিরিয়ালিজম তথা মনোপলি ক্যাপিটালিজমেরও অন্তিম সময় উপস্হিত । অতএব উপনিবেশেরও অবসান । স্তালিন তো এই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইমপিরিয়ালিজমের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক দেশগুলির উৎসাহিত মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখেছিলেন । এশিয়ায় সেই মিক্তিযুদ্ধ দুই বিশাল দেশ ভারতবর্ষ ও চিনে ততদিনের মধ্যে সূচিত হয়ে গেছে । এই বাংলার তথাকথিত এস আর গ্রুপ বলতে শুরু করেছে তখন, পঞ্চাশের দশকের শেষে, তথাকথিত স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় বুর্জোয়ার উথ্থানে, এদেশে এক উল্লম্ফনে জাতীয় বুর্জোয়ারা নয়া-সাম্রাজ্যবাদী হয়ে গেছে, অন্তত তাদের সম্প্রসারণ তথা আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে ওই তথাকথিত স্বাধীনতা সংগ্রামে । সংগ্রামান্তে, জাতীয় বুর্জোয়ার অন্যতম নেতা, তথাকথিত গণতান্ত্রক জওহরলাল নেহেরু তাঁর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়ার’ পাতায় পাতায় অনুশীলন করছেন এক বৃহৎ ভারতবর্ষ, এক উপমহাদেশের । 

         ক্ল্যসিকাল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের দ্বারা অধিকৃত কাশ্মীর, অসম ইত্যাদি ভারতীয় মেইনস্ট্রিমের অন্তর্গত না হয়েও তথাকথিত স্বাধীন ভারতবর্ষের ম্যাপে একান্ত ভারতীয় হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন ওই ডিসকভারার । জাতীয় বুর্জোয়ার ভ্রূণেই সম্্রসারণবাদী নয়া-সাম্রাজ্যবাদীর ম্যাচিওর হওয়া । অতএব ওই এস আর গ্রুপের মতে, ভারতবর্ষের রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতা এখন সম্পপসারণবাদী বুর্জোয়াদের হাতে । অর্থাৎ এই দেশের ঔপনিবেশিক মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার ভ্রূণে শৈল্পিক বুর্জোয়া তথা নয়া-পুঁজিবাদের ম্যাচুরিটি ঘটে গেছে । সুতরাং এখন এদেশের মূল দ্বন্দ্ব পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্হার সঙ্গে সর্বহারা শ্রমিকমনস্ক জনগণের দ্বন্দ্ব । অর্থাৎ বৈপ্লবিক স্তর হল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব । ওই সব তথাকথিত পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রিভোলিউশান ফালতু কথা -- রণাঙ্গনে এখন পুঁজিবাদ বনাম সর্বহারা ।

         মলয়কে সেলাম, প্রকৃতই সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটে গেছে । আধুনিক যুগ তার অন্তিম কালে শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে মডার্ন থাকার । কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পোস্ট-ইনডাসট্রিয়াল যুগের সূচনা মূর্ত হতে চলেছে । এবং পোস্টইনডাসট্রিয়ালিজম আসলে ইনডাসট্রিয়াল তথা মডার্ন এজের অন্তিমে উপস্হিত হয় । এবং এটি একটি গ্লোবাল উদ্যোগ ।

         সুতরাং পোস্টমডার্নিজম তার নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে নানা ঢঙে সব দেশেরই দোরগোড়ায় কমবেশি উপস্হিত । সেলাম মলয় । আপনি ঠিকই দেখেছেন ।

সাত

         সবকিছু ছেড়ে আমি কেবল মলয়ের ‘ভেন্নগল্প’ গ্রন্হটি দেখি, কেননা পোস্টকলোনিয়াল তথা পোস্টমডার্ন চরিত্র ওই ‘ভেন্নগল্পে’ বড় স্পষ্ট, ক্লিয়ার, সমুজ্জ্বল । ভূমিকায় মলয়ও বলেছেন : ‘দেখা যাবে, এই গ্রন্হটির পাঠবস্তুগুলো কেন্দ্রহীন ; বাস্তবতাকে বিনির্মাণ করে পাওয়া স্হিতিগুলো সমন্বয়হীন ; বিষয় অথবা আঙ্গিকে ঐক্য এবং সমাপ্তি নেই এবং কাঁচামালগুলো থেকে নির্মিত হচ্ছে না কোনোকিছু ; আমি কোনো অভিপ্রায় ছাপিয়ে দিচ্ছি না । বা গড়ে দিচ্ছি না শব্দব্যূহ ।...শরীর ও মন দুটো আলাদা আলাদা ব্যাপার, এরকম সরলীকরণের মধ্যে আমি কোনো রচনাকে টানিনি । লেখাগুলো বরং ভঙ্গুরতার স্বীকৃতি হিসেবে বর্ণনাকারীর, উত্তরঔপনিবেশিক মতদ্বন্দ্বের, জটিলতার, একরকম আলাপচারিতা ।’

         এখানে আমি ওই ভূমিকায় যুক্ত করতে চাই ওই ‘উত্তরঔপনিবেশিক’-এর সঙ্গে ‘উত্তরআধুনিক’ শব্দ, যে দুই শব্দ, পূর্বেই লিখেছি, যমজ । 

         ‘ভেন্নগল্প’-গ্রন্হের প্রথম প্রকাশ কলকাতা বইমেলা ১৯৯৬ । রচনাকাল ১৯৮৩ - ১৯৯৫ । আমি ওই রচনাকালের মাঝামাঝি রচিত, ১৯৯২ সালের ‘অলৌকিক দাম্পত্য’ গল্পটিকেই কেবল ধরে মলয়ের পোস্টকলোনিয়াল, মলয়ের পোস্টমডার্ন চরিত্র বোঝার চেষ্টা করব ।

         কেননা গল্পটি প্রতিনিধিস্হানীয় । আমার কাছে অসাধারণ । গল্পটির শুরু ও শেষ অনাদি ও অন্তহীন ।এবং আসলে গল্পটির মধ্যে কোনো স্টোরি এলিমেন্ট নেই । বলা উচিত এটি গল্প নয়, গদ্য ছাড়া আর কোনও অভিধা আমার জানা নেই । মলয়ের মতে Post-colonial episodes/Texts ; সবকিছুই বিনির্মাণের পর অভিব্যক্ত । শব্দগঠন বিনির্মিত । বাক্যবিন্যাস অব্দি বিনির্মিত । এই গদ্যের কোনো কেন্দ্র নেই, অতএব কোনো গ্রহ বা উপগ্রহ নেই ।

আট

      তবে অন্যান্য গদ্য রচনাও আলোচনার মধ্যে আনলে ভালো হতো । সময় ও সুযোগের অভাব । পরন্তু আমার স্বভাবও এই যে, আমি নানা কিছুর মধ্যে আলোচনাকে বিন্যস্ত রাখতে পারি না । আমার পক্ষে সহজ একটি দুটির মধ্যেকার কথানুসন্ধান । যেমন ধরুন, কবিতা নাটক পুরো তফাতে রাখছি আপাতত । এমনকি বলা যায় উপন্যাসও, যদিও ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসটি মাথায় থেকেই যাচ্ছে, জানি না কেন ! শুধু এটুকু জানি, মলয়ের পোস্টকলোনিয়াল তথা পোস্টমডার্ন সিনট্যাক্স নিয়ে যে ভাবনা গড়ে উঠল এই কদিনে, তাতে ওই ‘নামগন্ধ’ উপন্যসের কিছু ভূমিকা আছে । মলয়ের মালমশলা ছড়িয়ে রেখেছি চতুর্দিকে, এবার কেবল বেছে নেবার পালা । তাতে ওই ঘটল, ওই ‘অলৌকিক দাম্পত্য’ ।এই ‘অলৌকিক দাম্পত্য’-এর অন্তর্গত নয়, অথচ সঠিক বাইরেও নয়, এমনকিছু আপাত অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু যথার্থই পপাসঙ্গিক কথা হয়ে থাক ।

         মডার্ন যুগের মার্কসীয় রাজনীতির এক চমৎকার পোস্টমডার্ন অভীপ্সা আছে । গদ্যটির নাম ‘ভেন্ন’, সেখানে সীতেশের তারিখবর্জিত ডায়েরির লেখাটা :-

“আজকাল আমাদের দেশে শ্রেণিচেতনা বলতে সাধারণত পুঁজিপতি জোতদার ধনী ব্যক্তি প্রভৃতির বিরুদ্ধে জঙ্গী মনোভাবকে বোঝানো হয়ে থাকে । এটা শ্রেণী চাতনার একটা স্হুল দিক মাত্র । আসলে শ্রেণীচেতনা হল সমাজের বস্তুবাদী বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সমাজ বিকাশের পথ অনুধাবন করে ওই মুহূর্তের প্রগতিশীল কর্তব্য নিরুপণ করার ক্ষমতা । এক্ষেত্রে মার্কসবাদের চিরায়ত তত্ব ও সংক্ষিপ্ত মূল সূত্রগুলি খুব বেশি সহায়ক হবে না । বরং মার্কসবাদী পদ্ধতির সৃষ্টিশীল প্রয়োগের মাধ্যমেই যে কোনও দেশের পরিস্হিতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সম্ভব । এবং মার্কসবাদী সমাজ বিশ্লেষণের মূল কথা হল, ঐতিহাসিক বিকাশের পটভূমিতেই যেকোনো সমাজের বিশ্লেষণ করতে হবে ।”

         ‘ভেন্ন’ গল্পটি কিন্তু ১৯৮৩ সালে লেখা । অর্থাৎ ওই আশির দশকের গোড়ার থেকেই মলয়ের পোস্টমডার্নজম কাজ করছে ।

         এখানে ‘The Name Of The Rose’, যা একটি পোস্টমডার্ন উদ্যোগ, তার লেখক উমবের্তো একোর কিছু কথায় আসি…”it ( postmodernism ) demands, in order to be understood, not the negation of the already said, but its ironic rethinking.” মলয় লিখিত ওই ডায়েরি, পাঠক বুঝুন, not the negation of the already said, but its ironic rethinking.

নয়

         এবার সত্য সত্যই ‘অলৌকিক দাম্পত্য’র চাবিকাঠি পেয়ে গেলাম । কেননা এই গদ্য, বস্তুত, দুর্ঘটনা, যা আকছার ঘটছে, তারই ironic rethinking । দুর্ঘটনা, এখানে বাস দুর্ঘটনা, মলয়ের সৃষ্টিশীল প্রয়োগে যে-দুর্ঘটনা অলৌকিক, তাই বলে অ-লৌকিক নয় । দাম্পত্যের যে কথা এখানে আছে, তাও ironic rethinking ।এখানে বলে রাখা ভালো, মডার্ন যুগেই দাম্পত্যের শেষ দেখা গেছে । লিভ টুগেদার মডার্ন সমাজ মেনে নিয়েছে । পোস্টমডার্ন সমাজ তারই ironic rethinking দেয় বলে ধারণা করি । এক্ষণে সরাসরি মলয়ের বাক্যে আসি :-

“কুড়ি বছর আগে শহরের উদাসীন রেল স্টেশনের সামনে চকচকে দুপুরের রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলুম ফরসা যুবতীর কাটা তর্জনী, রক্তহীন, কাচের রঙের নীলচে নখপালিশ, সোনার অলস আঙটিতে গরম পদ্মরাগমণি ঠায় জেগে…”

এবার, এই মলয়, কে বা কী, যিনি ওই অলৌকিক তর্জনী কুড়িয়ে পেলেন ? মলয় স্বয়ং বলেছেন, ওই পদ্মরাগমণি তো আসলে চুনি, এবং---
  
“যে চুনিতে আজও গ্রীষ্মকালীন কেনিয়ার বহুচারী যুবক সিংহের থাবার থমথমে গন্ধ আমাকে দু’তিনশো বছর আগে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন আরা বালিয়া বা ছাপরা থেকে আমার কেঁদো পূর্বপুরুষরা পাকানো চামড়ার চাবুক খেতে আর অর্ধাহারে থাকার জন্যে কালোদের দ্বীপে জাহাজবন্দী কেনা গোলাম হয়ে চলে গিয়েছিলেন।”

এখানে মলয় প্রকৃতই বিশ্ববাসী তথা আবহমানকালীন । এখানে সময় ও কালের বিনির্মাণ হচ্ছে । এটি একটি পোস্টমডার্ন উদ্যোগ । আবার দেখুন, দুর্ঘটনাগ্রস্ত মলয় ও তাঁর সহযাত্রীদের, ইতস্তত মৃত, অথবা জ্ঞানরহিত স্টেজের বিনির্মাণ । যেমন :-

“যে-দুটো রূপসী শীতল হাত আমাকে পেছন থেকে নির্লজ্জ জড়িয়ে রয়েছে, নারীর আতর মাখা বাহু, সোনার কয়েকগাছা অমৃতসরী চুড়িসহ, আজকে, কুড়ি বছর পর, এই শীতের আধো অন্ধকার সকালে, সে-হাতের দক্ষিণ তর্জনীতে সেই হুবহু আঙটি পদ্মরাগমণি । চল্লিশোর্ধ অকৃতদারকে এভাবে আকুল আঁকড়ে থাকা রহস্যময়ী বাহু, এতো শক্ত করে ধরে থাকা, আমি পেছন ফিরে দেখার চেষ্টায় ঠাহর করতে পারলুম না ।”

এবার পাঠক দেখুন, কুড়ি বছর আগে পাওয়া তর্জনী, এখন এই দুর্ঘটনার বিনির্মাণে রূপসীর অঙ্গীভূত । এবং তর্জনীতে । রহস্যময়ী বাহু ধীরে ধীরে অলৌকিক দাম্পত্যে নিয়ে যাচ্ছে । সে এক অসাধারণ বর্ণনা । এবং সে-বর্ণনাও মডার্ন ন্যারেটিভকে বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে পোস্টন্যারেটিভ ডিসকোর্সে নিয়ে যাচ্ছে । যেমন:-

“---ভাগ্যিস আপনি মারা গেলেন, তাই আপনার সঙ্গে এই নিবিড় পরিচয়ের সুযোগ পেলুম।” আমি বললুম ওঁকে, শীতের নিরাপদ ফিকে সকালকে শুনিয়ে, যখন আশেপাশে সবাই মরে গেছে মনে হয়, শুধু আমি বেঁচে, আমদের অমোঘ খবর কেউ জানতে পারেনি।”
“আপনার হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেছে । আপনি আমার কথা ভাবছেন না । কিন্তু তবু কেন ভালোবাসছেন আমায় ?”
“........”, আমি ওঁর আলতো করে বলা কথাগুলো শুনতে পাই । নিঃশব্দ কল্লোল হয়তো এই, অভিব্যক্তিহীন কাকলি, স্খলিত কেকা ।
“........”, উনি অজস্র কথা বলে যেতে থাকেন ।
“.........”, চোখ বন্ধ করে শুনি ওঁর কথাগুলি । মাথা পেছনে করে ওঁর ঠাণ্ডা ঠোঁটে আমার গাল ঠেকাই ! আমার উত্তাপ ওঁকে মুগ্ধ করে ।
আমিও বলে যেতে থাকি ।
-----বেঁচে থাকতে আমাকে চেয়েও দেখতেন না হয়তো আপনি ।
-----কতোদিন ভেবেছি আপনার কাটা আঙুল আর আঙটি আপনাকে খুঁজে ফেরত দিয়ে আসব ।
-----এখন তো আপনি আমার ভাষাও বুঝতে পারছেন না । না ?
-----বাসে, প্রতিটি মেয়েমেনুষকে বারবার দেখেছিলুম, কিন্তু কই, দেখিনিতো আপনাকে ।
-----আমার সৌভাগ্য, এতো লোক থাকতে আমাকেই আপনি বেছে নিলেন, এক বিচারাধীন মধ্যবয়সীকে ।”

         পাঠক, দেখুন, এখানে, মডার্ন ডায়ালগের বিনির্মাণ, যা কিনা পোস্টমডার্নিজমের অন্যতম কোয়ালিটি । এ গদ্যে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমিও আছে ।

         পোস্টমডার্নিজম তো অতীতকে, অতীতের রূপকথাকেও আহরণ করে, কিন্তু আয়রনিকালো ওই কার্য সম্পন্ন হয় । দেখুন :-

“ব্যঙ্গমি : ওকে ফিরে যেতে হবে ।
ব্যঙ্গমা : কোথায় ?
ব্যঙ্গমি : লাৎখোরদের পৃথিবীতে । বিপ্লবে । সংঘর্ষে । পরাজয়ে । সেখানে হাতিশালে হাতির গু থাকে, ঘোড়াশালে পড়ে থাকে লোহার নাল । ছাদের ওপর নৌকো, সিংহাসনে গাধা, নহবতখানায় কাক, মন্ত্রণাঘরে মাকড়সা, কোষাগারে গোবর, কামারশালে নেহাইয়ের ওপর ছাইভস্ম, পালঙ্কে আরশোলা, বাঁশের সাঁকো দিয়ে তৈরি রামধনু, গেরস্ত বাড়িতে ঘরে ঘরে ধেনো-টানা মাতালচি, খোরপোষের টাকায় প্রতিপালিত রাজনীতিক, মৃতদেহের বদলে মুখাগ্নি করার তোষক ।”

         পাঠক, লক্ষ করুন, আধুনিকতাকে লাথি মেরে অধুনান্তিকতার অন্যতম লাৎখোর মলয়কে কোথায় ফিরে যেতে বলা হচ্ছে । ওই সব বিনির্মিত শব্দসমূহে আপনি অর্থ খুঁজতে পারেন, কিন্তু তাতে যেন বিনির্মিত অর্থ হয় । কেননা পোস্টমডার্নরা, স্বাভাবিক কারণেই, মডার্ন ভাষাতত্বকে অতিক্রম করে যান ।

দশ

         পাঠক, এই ‘অলৌকিক দাম্পত্য’ গদ্যে  যে-যৌনতা আছে, তাও মডার্ন যৌনতারই বিনির্মিত যৌনতা, যা পোস্টমডার্ন । এ-বিষয়ে পোস্টমডার্ন  William Simon যা বলেছেন, তা শুনুন, “For many people, the sexual part of their lives will take on new and somewhat disruptive salience -- disruptive in the sense that the metaphoric richness of the sexual may have to risk real life testa, tests that involve the effort to bring one’s fantasies into one’s reality. Such efforts have commonly led either to crises or to an impoverishment of both fantasy and reality.”

         ‘অলৌকিক দাম্পত্য’ এখানেই সত্য । এ-গদ্যে ফ্যান্টাসি-রিয়্যালিটি একবার বিন্যস্ত, তন্মুহূর্তেই ডিকনসট্রাকটেড । একবার ব্যথিত, তন্মুহূর্তেই নির্বেদ ।
         আর এখানেই পোস্টকলোনিয়াল-মলয় এবং পোস্টমডার্ন-মলয়, এই বাংলায়, অদ্যাপি, সার্থক ও তুলনারহিত । সেলাম মলয় ।

[ এপ্রিল, ২০০১ ]
         






বৃহস্পতিবার

যশোধরা রায়চৌধুরী : মলয় রায়চৌধুরী বিষয়ে কিছু কথা


কবি মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ
         ১৯৯৫তে একটা বই পড়েছিলাম হাংরি জেনারেশনের উপর । উত্তম দাশের লেখা । কবি উত্তম দাশ । সেটা থেকেই প্রথম জানতে পারি, হাংরি কবি মলয় রায়চৌধুরী হাজতবাস পর্যন্ত করেছেন অশ্লীলতার দায়ে । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখার জন্য । এইটুকু পড়ে বুঝতে পেরেছিলাম, মলয় রায়চৌধুরীর নাম আমরা যতটুকু শুনি, বা আমি, সদ্যই কবিতা লিখতে বসে, সে সময় অব্দি, যতটুকু শুনেছিলাম, সেটা যথেষ্ট ছিল না, নয় ।

         আমার সে সময়ে, কয়েকটি লিখিত শব্দের জন্য হাজতবাস করেছেন, এমন একজন কবির নাম -না-জানা থাকার জন্য এক ধরনের লজ্জা হয়েছিল । শব্দকে ঈশ্বর মানি । অথচ শব্দের জন্য কারুর জীবনের এই সব ঘটনা -- শিল্পের জন্যও বলা চলে --- এই যে এক্সট্রিম পয়েন্টে চলে যাওয়া, এমন মারাত্মক একটা কিছু করে ফেলা -- এটা খুব চমকে দিয়েছিল, নাড়া দিয়েছিল । ‘ঘিলুর বীভৎস শাঁস থেকে, শাঁসের উত্তরাধিকারহীন নৈরাজ্য থেকে সারি সারি বিস্ময়ক শব্দপূঞ্জের ভেতরে নিক্ষিপ্ত অসংযত অহং অনুসন্ধানই কবিতা’ ( হাংরি ইস্তাহার ) --- একথা বিশআস করতে শুরু করি তখনই । বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভরে বৃষ্টি’ অথবা সমরেশ বসুর ‘বিবর’ ‘প্রজাপতি’ অত্যান্ত আগ্রহে শ্রদ্ধায় পড়েছি । 

         হাংরি আন্দোলনের ভেতর অবশ্যই একটা দেখানেপনা, যুবা/অল্পবয়স্ক সুলভ উন্মাদনার ঘটা, বুদ্ধিদীপ্ত হৈ হল্লা ছিল । তবু হাংরি আন্দোলন, ষাটের দশকের অন্যান্য আন্দোলনগুলো -- প্যারিসের আটষট্টির ছাত্র-শ্রমিক আন্দোলন/অভ্যূথ্থান, আমেরিকার বিটনিক -- গিনসবার্গ ও অন্যান্যরা -- সবটা পরস্পর সংযুক্ত । ফলত বাংলার বুদ্ধিজীবী যুবকেরা যে একটা ইন্টারন্যাশানাল মাত্রা পেয়েছিলেন -- দেশের গণ্ডিটা মুছে যুবসত্তা যে খুব ইমপরট্যাণ্ট হয়ে উঠেছিল -- এটা পরিষ্কার । ফলত শ্রদ্ধা, ক্যারিসমা, বিস্ময়বোধ থেকেই যায় ।

         আমি সেই সময় হাংরি আন্দোলন নিয়ে খান কয় বই পড়েছিলাম । ১৯৯৫-এর বইমেলায় মলয় রায়চৌধুরীর দুতিনটি বইও কিনি । তার মধ্যে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ও ছিল । আর একটা কবিতা ভীষণ ভালো লেগেছিল, সেটা হচ্ছে ‘ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ’ ।

         পরে এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবেখন । ‘ধন’ শব্দটার আমাদের সমাজে দু’তিনরকম মানে । মূলত সেই অ্যামবিগুইটির জায়গা থেকেই গড়ে উঠেছে, শরীর লাভ করেছে কবিতাটি । এটা পোস্টমডার্ন বলে আমার মনে হয়েছে । কবিতার সঙ্গে কবিতার নামের যোগাযোগ অবিচ্ছেদ্য । যেটা আর একটা পোস্টমডার্ন লক্ষণ । তাছাড়া কবিতার নামটা একটা ব্যঙ্গ বা প্যাসতিশ । মানে, কোনও লোক যেন পড়ার বইয়ের একটা চ্যাপ্টারের হেডিংকে কাঁচি দিয়ে কেটে তারপর সেটাকে এই কবিতার ওপর আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছে । অর্থাৎ একটা প্যাচওয়র্ক । এটা পোস্টমডার্ন লক্ষণ । এইসব মিলিয়ে সোজা কথায় কবিতাটা আমাকে মজা দিয়েছিল । আমার শিল্পবোধে সুড়সুড়ি দিয়েছিল । এই যে তির্যক একটা রস, এটা অনেক কবির কবিতাতে পাই । মলয় রায়চৌধুরীর কবিতায় বেশ ভালোরকম পাওয়া যাবে । তখন এসব লক্ষণ-টক্ষণ নিয়ে মাথা ঘামাইনি । তবে এই রসটা চেখে-চেখে মিয়েছিলাম । বলা যায়, এভাবেই, নব্বইয়ের মাঝামাঝি, বেশ বেশিসংখ্যক কবিই কবিতা লিখতে সুরু করে --- আমিও করি । এটা প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ কোনও প্রভাব বলতে হবে, মলয় রায়চৌধুরীর শিল্পধারার ।

         তখন এসব বেশ পড়ছিলাম টড়ছিলাম । হাংরির ব্যাপারটা নিয়ে মজে ছিলাম । কয়েকটা গদ্যও লিখেছিলাম এটা নিয়ে । কবি মলয় রায়চৌধুরীকে তখনও ব্যক্তিতে চিনি না ।


কবি মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার দ্বিতীয় যোগাযোগ
         ‘কবিতা পাক্ষিক’ একটা অনুষ্ঠান করে আলিপুরে, কানাইলাল জানার বাড়িতে, রবিবার করে যেমন হতো অনুষ্ঠানগুলো । আমি খুব আগ্রহ নিয়ে গেছিলাম । কালীকৃষ্ণ গুহ আর মলয় রায়চৌধুরীর পাঠ ছিল । যেহেতু আমার সদ্য সদ্য স্মৃতিতে ছিল হাংরি ও মলয়ের কবিতা -- স্বচক্ষে লোকটিকে দেখার ইচ্ছে ছিল । 

         মলয়দা ও সমীরদার সঙ্গে আমার ওখানেই আলাপ হয় । তখনও আমার প্রথম বই ‘পণ্যসংহিতা’ বেরোয়নি । পাক্ষিকে সদ্য সদ্য লিখছি । অর্থাৎ ১৯৯৫ সাল হবে । ঐ সময়টা খুব ইমপট্যান্ট আমার কাছে । বাংলা কবিতাও ওই সময়ে বেশ পুনরুজ্জীবন পেলো । বড় কারণ প্রভাতদারা পোস্টমডার্ন কবিতার যে ‘আন্দোলন’ করলেন -- সেটা -- সেটার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত মলয়দা ও সমীরদা । ‘হাওয়া৪৯’ এবং ‘কবিতা পাক্ষিক’ -- দুটো কাগজই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এই বাংলা কবিতার পোস্টমডার্ন আত্মচেতনার জায়গাটাতে । আর মলয় রায়চৌধুরী একজন ইডিওলগ -- এই ‘আন্দোলনের’ একজন নেতা ।

         উপরে আন্দোলন শব্দটাকে ইনভার্টেড কমায় রাখার কারণ এটা তথাকথিত আন্দোলন । সত্যিকারের আন্দোলন বলে কেউ কেই নাও মানতে পারেন । সেজন্যই --- ।


মলয় রায়চৌধুরী এবং ভাষার ভাঙচুর
         ‘আপনি কি এখন দয়া করে আড্ডা দেবেন ?’

         এই বাক্যটির level/register of language বা ব্যবহৃত ভাষান্তর কী ? ভাষান্তরে সাম্যতা বজায় আছে কি ? ‘আপনি’ ও ‘দয়া করে’-র সাথে ‘আড্ডা দেবেন’, যাকে বাংলায় বলে, ঠিক যায় না । কেন যায় না ? কারণ ‘আপনি এখন দয়া করে’-র ভাষান্তর formal/শিষ্ট/ভদ্রতাবচক, আর ‘আড্ডা দেওয়া’-র ভাষান্তর informal, ঘরোয়া, বন্ধুদের মধ্যে ব্যবহৃত ( অবশ্যই অশিষ্ট অভদ্র নয় )। এখন কেউ যদি ইচ্ছা করে দু’তিনটি ভাষান্তরকে মিলিয়ে দিতে চান ? ইচ্ছে করে ভাষান্তর ভেঙেচুরে, বা বিভিন্ন স্তরের মধ্যে ওলটপালট ঘটিয়ে কোনও নতুন রস বা মজার উদ্ভব ঘটান ? সেটাই একটা শিল্প হয়ে ওঠে তখন । নতুন করে ।

         যেমন, ‘ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ’ কবিতাটির কথা বলছিলাম । সেখানে গুরুগম্ভীর মার্কসীয় পরিভাষায় লিখিত প্রবন্ধের শিরোনামের যে ভাষান্তর, তাকে ব্যবহার করা হয়েছে রতিক্রিয়া ও বিছানার আপাতঅশ্লীল এবং ‘অশিষ্ট’ ভাষান্তরের একটি কবিতার শীর্ষক হিসেবে । আর এটাই জন্ম দিচ্ছে এক অভূতপূর্ব মজার 
         এই শৈলীকে কেন পোস্টমডার্ন বলছি ? সেটা বলার আগে একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন । তা হল পোস্টমডার্নিজম কিন্তু কোনও সাহিত্যশৈলীর নাম নয় । আমি যতটুকু বুঝি, তাতে সাহিত্যের/শিল্পের কিছু কিছু লক্ষণকে পোস্টমডার্ন বলা যায় । মূলত এটা একটা প্রবণতার নাম, যে প্রবণতায় স্হির/নিশ্চিত কোনও কিছুকে তুলে ধরা হয় না । একটি ‘মতবাদ’-কে তুলে ধরার বদলে ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যাবার নামই পোস্টমডার্ন প্রবণতা । অতএব পোস্টমডার্নিজম আর একটি নতুন মতবাদ নয় । 

         আর্কিটেকচারে, অর্থাৎ স্হাপত্যশৈলীতে পোস্টমডার্ন প্রবণতার সাম্প্রতিক যে-প্রমাণ আমরা দেখেছি, সেটার সঙ্গে ভাষাশৈলীকে তুলনা করলেই ভাষান্তর নিয়ে যে কথাগুলো বলছিলাম, সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে । স্হাপত্যশৈলী যখন পালটাতে থাকছিল, ক্রমশ ‘আধুনিক’ হয়ে উঠছিল, সেটা মডার্নিজম । অর্থাৎ সেটা সরলরৈখিক প্রগতি । বারোক অলঙ্কারময় স্হাপত্যের স্হান নিল গম্ভীর ভিকটোরিয়ান রীতি । ভিকটোরিয় স্হাপত্যের বদলে ছিমছাম, কাটাকাটা, সায়েন্স ফিকশান-সুলভ স্হাপত্য এলো -- যেটা নাকি ‘আধুনিক’ রীতি । এবার দেখা গেল ‘আধুনিক রীতি’ও পুরোনো হয় ! ( যেমন আধুনিক গান হয়ে ওঠে পুরোনো বাংলা গান ! অর্থাৎ ১৯৬০-৭০-এর ‘আধুনিক গান’ -- ওই শব্দটা যে-সময়ের সৃষ্ট বা যে-কালপর্বের coinage সেটা আধুনিক কালপর্ব ) এবং ১৯৯০-এর স্হাপত্যে আবার পপাচীন অলঙ্কারময়তা বা ভিকটোরিয় ডিজাইনগুলোকে নতুন মোড়কে এক্সপেরিমেন্টধর্মী শৈলীতে ব্যবহার করা চালু হল । প্রাচীন যা কিছুর পুনর্ব্যবহার, তাদের নতুন কনটেক্সটে ফেলে দেখা --- সেটাই পোস্টমডার্ন প্রবণতা । অর্থাৎ সরলরৈখিক প্রগতি নয়, বক্র, ঘুরে-আসা, বৃত্তীয় ঢঙ । বারবার একই বিন্দুকে ছুঁয়ে যাওয়া । ( যেমন ‘আধুনিক’ বাংলা গানের উত্তর-আধুনিক ফর্ম : remix ! remake ! )

         অর্থাৎ পোস্টমডার্ন প্রবণতায় নকল বা অনুকরণ, বা প্যারডি-র একটা বিরাট ভূমিকা আছে । এই সময়ের কবি যখন অনুকরণ করেন কৃত্তিবাসী রামায়ণের শৈলী, অথবা রাবীন্দ্রিক ঢঙেই লেখেন কোনও তির্যক কবিতা -- সেটা হয়ে ওঠে পোস্টমডার্ন ।

         মলয় রায়চৌধুরী এই ভাষান্তর ভেঙে দেওয়ার কাজটা তুমুল রাগ ও অনুরাগের সঙ্গে করেন, করেছেন -- অবচেতন থেকেই করেছেন বলে আমার ধারণা, কোনও ‘ইজম’-এর অনুশাসন মেনে নয় । মূলত কবিরা লেখেন আগে, ‘ইজম’-এর তকমাটা তার ওপর লাগানো হয় পরে --- হয়তো কবিরা নিজেরা্‌ই নিজেদের মধ্যে আবিষ্কার করেন এমন কোনও প্রবণতা যা থেকে তিনি নিজেকে এক বিশেষ শৈলীর কবি হিসেবে পুনঃচিহ্ণিত করেন । করে, স্মিত এক হাসি ফুটে ওঠে তাঁর মুখে ।


মলয় রায়চৌধুরী ও সমাজবীক্ষণ
         একটু আগেই লিখছিলাম মলয় রায়চৌধুরীর রাগ ও অনুরাগের কথা । যে কোনও রাগি কবিরই রাগ বস্তুত সামাজিক সিস্টেমের ওপর রাগ, প্রচলিত কনভেনশনের ওপর রাগ । মা-বাবাকৃত অত্যাচার, যা শিশু হিসাবে তাঁর বরাতে জুটেছে, সেই অত্যাচারের প্রতিবাদ । পিতৃতান্ত্রিক সিস্টেমের উপর রাগ, বস্তুত বাবার উপর রাগ । আর সেই আবার উদ্দেশে পাঠানো প্রতিবাদ ও পপতিক্রিয়াই ঘুরে যায় রাষ্ট্র, পরিবার, বিবাহ, প্রেম এবং ধর্মের দিকে, ঘুরে যায় বিচারক, পুরোহিত, শিক্ষক, পুলিশের দিকে -- এক কথায় এসট্যাবলিশমেন্টের দিকে । ইস্কুল, জেলখানা, মন্দির এবং পাগলাগারদ সমার্থক হয়ে ওঠে ।  ভ্যালু-সিস্টেমের সদাশয়তা, তথাকথিত সুকুমার পপবৃত্তি, এগুলোই একমাত্র ভ্যালু নয়, এই ভ্যালু সিস্টেমই ফলত আক্রান্ত হয় । আর তার পরিবর্তে, সমীর রায়চৌধুরী যেমন বলেছিলেন, “শিল্পের কাজ নানা গোপনীয়তাকে ফাঁস করে দোয়া” -- ঠিক সেই রকম সাবভার্সিভ হয়ে ওঠেন কবি । তাঁর শিল্পকর্মের মধ্যে তিনি ফাঁস করে দেন মায়ের লুকানো ক্ষতচি্‌হ্ণ ও গোলাপি সেমিজের ইতিবৃত্ত -- সমাজের তথাকথিত মূল্যবোধের পালক পিতা-প্রভূদের ছেনালিপনা ও ডাবল স্ট্যাণ্ডার্ড -- মিথ্যাচারিতার ইতিবৃত্ত । যেভাবে পাঁচ বছরের ছেলেটিকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে খাওয়াতে হত, সে সাত বছরের দিকে যেতে যেতেই জেনে ফেলে যে কোনও কালো গাড়িই পুলিশের গাড়ি নয় । বাবা-মা ‘ওই পুলিশ আসছে’ বলা মানেই পুলিশ আসছে না । অর্থাৎ তার কাছে ফাঁস হয়ে যায়, বাবা-মা মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা বলাটাই দস্তুর ; ঠিক সেভাবেই ।

         সুতরাং সমাজের গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত যে-মিথ্যা ছড়ানো, সে গলিঘুঁচিগুলো একে-একে নখাগ্রে আসতেই প্রতিবাদী, রাগী কবিরা সে-গোপনীয়তাগুলোকে ফাঁস করে দিতে চেষ্টা করেন । তাঁদের বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার সঙ্গেই এই প্রক্রিয়াটা অঙ্গাঙ্গীভাবঢ জড়িত । ধনতন্ত্রের যে ক্রমবিকাশের কথা মলয় তাঁর কবিতায় বলেছিলেন, সেই বিকাশ তাহলে এটাই ? লৈঙ্গিক/phallic সত্তার বিকাশের সাথে-সাথে, পিতৃতন্ত্রের কঠোর অনুশাসনেরও বিকাশ । ফলত আগ্রাসন ও হিংস্রতার বিকাশ --- কামসম্পর্কিত বিকৃতি ও কামহিংসার বিকাশ। 

         অর্থাৎ এই একটি কবিতায় বিধৃত আছে মানুষের মনস্ততাত্বিক বিকাশ এবং সামাজিক সত্তার বিকাশের ক্রিটিক ( critique ).


ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ
শেষরাতে পাশ থেকে কখন উঠেছো
চুপচাপ আলমারি ভেঙে কি অ্যাসিড
ঢকঢক করে গিলে মরছ এখন
আলজিভ খসে গেছে দুগালে কোটর
মাড়িদাঁত দেখা যায় কষেতে বইছে
গাঢ় ফেনা হাঁটুতে ধরেছে খিঁচ ব্যথা
চুল আলুথালু বেনারসী শাড়ি শায়া
রক্তে জবজবে মুঠোতে কাজললতা
শোলার মুকুট রক্তমাখা একপাশে
কী করে করেছো সহ্য জানতে পারিনি
শুনতে পাইনি কোনো চাপা চিৎকার
তবে কেন সায় দিয়েছিলে ঘাড় নেড়ে
আমি চাই যে করেই হোক বেঁচে ওঠে
সমগ্র জীবন থাকো কথাহীন হয়ে

         এই কবিতাটিতে যতখানি রাগ রিরংসা ও ভায়োলেন্স আছে, তা কোনও এ-মার্কা হিন্দি ছবিতেও পাওয়া যাবে না বলে আমার বিশ্বাস । বস্তুত তথাকথিত এ-মার্কা ক্রাইম থ্রিলাররা অনেক বেশি নিরীহ ও ছাপোষা বলে আমার ধারণা । কেননা সেসব ছবির রক্তগুলি যে রঙ, আর মাংসগুলি যে রবার তা এতই স্পষ্ট যে তা আমাদের কাছে ভয়ংকর নয়, বীভৎস নয়, স্পর্শও করে না । অন্যদিকে কবিতাটির রক্ত ও মৃত্যু এতটাই সত্যি ও স্পর্শনযোগ্য যে তা আমাদের ভিতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয় । শুধু শব্দ, শুধু শব্দই সম্ভব করে এই দ্বিতীয়, বাস্তবানুগ, পুনর্জীবন । যা গায়ে কাঁটা দেওয়া এবং বীভৎস । যার জন্য, হ্যাঁ, যার জন্য মানুষের হাজতবাসও হতে পারে।

         এই বীভৎস কবিতাটি একটি বিবাহরাত্রির বর্ণনা । এর ব্যাকগ্রাউণ্ডে কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে একটি ঘটনা ; একটি মেয়ে, যার বিয়ে হয়ে গেছে, তার অন্য কোনও প্রেম ছিল, অথচ সেসব চাপা দিয়ে তার বিয়ে হয়ে গেছে এই পুরুষটির সঙ্গে । বিবাহরাত্রে/ফুলশয্যার রাত্রে সে অ্যাসিড খায় । আত্মহত্যা করে । এটা অবশ্যই সামাজিক, আরোপিত বিবাহের অন্তরালে নষ্ট-ধ্বস্ত একটি সত্য । ফাঁস হয়ে যাওয়া বলা যেতে পারে ।

         কিন্তু খটকা একটা থেকেই যায় । ঘাড় নেড়ে সন্মতি দেওয়ার সত্যটা । এই গোপন ওয়াদা/প্রতিশ্রুতির কথাটা কেমন যেন ইঙ্গিত করে -- এই আত্মহত্যা, এবং বিবাহে --- আরও একজনের অংশগ্রহণ আছে -- সে হল এই পুরুষ যার জবানবন্দিতে লিখিত কবিতাটি ।

         যেন তারই প্ররোচনায় রমণীর এই অ্যাসিডপান ।

         কিন্তু কাহিনির এই ধোঁয়াশাগুলির বাইরেও কবিতাটির অনেকখানি ছড়িয়ে থাকে । আজ্ঞে হ্যাঁ, ছড়িয়েই থাকে । বলা ভালো, ছেতরে থাকে । যতিচিহ্ণহীন কবিতাটিতে যুক্তিশৃঙ্খলা থাকলেও তা স্বাভাবিক যুক্তি নয় । তার এলোমেলো একটা চলন আছে । অ্যাসিড গিলে ফেলা মেয়েটি জিভ খসে গিয়ে সমগ্র জীবন নির্বাক হয়ে থাকবে ; কবি এখানে একটা wish বা ইচ্ছা/বাসনাকে মুক্তি দিচ্ছেন । যেন ‘কথা বোলো না, পাশে থাকো’ সেই পুরোনো রোমান্টিক বক্তব্যকেই আবার বলা হল, নতুন আঙ্গিকে । “For God’s sake hold your tongue and let me love !” এর প্রভূত প্রেমোন্মাদনা, গদগদভাবে, তারই একটা তির্যক reference হল যেন --- ‘সমগ্র জীবন থাকো কথাহীন হয়ে।’
         আসলে ছ্যাতরানো, ভাঙচুর বাস্তবতার কবি, হাংরি তথা পোস্টমডার্নের ভেতরে ভেতরে সেই আকাঙ্খাটা হল আদর্শ, স্বপ্নিল, ‘প্রেম’ নামক চূড়ান্ত বস্তুটির জন্য regressive আকাঙ্খা -- বাকচাতুরিহীন, তুমুল আরাম । কিন্তু ভাঙচুর বাস্তবতায় সে-আরামকে কখনও সরাসরি পাওয়া সম্ভব নয়, ফলত তির্যক অভিমান, frustration, alienation । সে আরামকে সোজাসুজি চাওয়া --- আরামের বদলে আত্মহত্যা চাওয়া -- স্বস্তির বদলে ধ্বংস । “পৃথিবীর শীতল বিশ্বাসঘাতকতা থেকে যেহেতু পুনরায় গর্ভের গোলাপি উষ্ণতায় ফিরে যেতে চায় ব্যক্তিমানুষ, কবিতা, আমাদের কালের কবিতা, ওই অসহিষ্ণু ফিরে যাবার আপ্রাণ ব্যর্থ চেষ্টার অসহ্য অদম্য গোঙানি…”

        হাংরি কবিদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা যেন একটা obsession অথবা  passion-এর মতো হয়ে উঠেছিল, বাস্তবেও আমরা দেখেছি । এই কবিতাতেও, আত্মহত্যার বর্ণনা এতটাই রঙিন ও আগ্রহোদ্দীপক, এতটাই টানটান উত্তেজনাময় ও বর্ণময়, যে বোঝা যায়, কবিতাটি প্রেমের কবিতা হয়ে উঠতে-উঠতে আত্মহত্যার কবিতা, alienation-এর কবিতা হয়ে উঠেছে । Sadism-এর কবিতা হয়ে উঠেছে । এবং সেই sadism আসছে একটা masochism থেকে । মূলত আত্মপীড়নকেই প্রেমিকা বা বধুর উপর আরোপ করা হচ্ছে, নিজেকে মরতে দেখার ‘সুখ’ আরও রগরগে হয়ে উঠেছে একটি নববধুকে মরতে দেখার মধ্যে দিয়ে ।

         পুরো কবিতাটা পড়ে আমার মনে হয়েছে এটা একটা celebration বা উদযাপন -- হাংরি বিবাহরাত্রি । কারণ দাম্পত্যরতির প্রথম রক্তপাতের প্রসঙ্গটা যেন আসছে কবিতায় -- ‘ধন’তন্ত্রের অগ্রসরণ একটা invasion অথবা আগ্রাসনের মতো ব্যবহৃত । তারপরেই সেটা ঘুরে যাচ্ছে আত্মহত্যার দিকে । যে আত্মহত্যাটাও রতির মতোই উত্তেজক । যেখানে কাজ করছে একটা প্রদর্শনীমূলকভাব, অথবা exhibitionism.

         হাংরি রাজনীতি, যা তৃতীয় বিশ্বের post-colonial রাজনীতি, তা সরাসরি ধনতন্ত্র/ পণ্যায়ন/ ভোগবাদের প্রসারের প্রতি আপাত মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ারও এক রাজনীতি । কিন্তু বস্তুত নিজের উপর ধনতন্ত্রের আগ্রাসনকে দেখার / অনুভব করার তীব্র প্রতিক্রিয়া । ভোগবাদের যাবতীয় উপকরণ, বেনারসি শাড়ি শায়া সেমিজ ও শোলার মুকুট কাজললতা সমস্ত কিছু রক্তে ভেসে যায় । ভোগবাদের তেজি আক্রমণাত্মক সর্বগ্রাসী ভঙ্গী, killer instinct, ঘুরে হাত্মহননের দিকে চলে যায় । ভোগবাদের প্রসার, ঐতিহাসিক কারণেই, ১৯৬০-এর দশকের ইউরোপ-আমেরিকার প্রেক্ষিতে, যখন বৃদ্ধি পেয়েছিল, সে সময়ের যুবাদের বদহজম বা acidityই হাংরির আন্দোলন, ১৯৬৮-এর প্যারির অভ্যূথ্থান, বিটনিক আন্দোলন ।

         আমার কাছে ‘ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ’ কবিতাটি এই কারণেই ‘সময় সমাজের দলিল’ বলতে গোদা বিশ্লেষকরা যা বোঝেন, বলতে গেলে তাইই ।


( এপ্রিল ২০০১ )