ঝুমা চট্টোপাধ্যায়
মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে কোনোদিন আমার মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি। মাঝ দুপুর বা ঝিঁঝিঁ পোকা সন্ধ্যেয় পুরনো খবরের কাগজের কোণায় মুড়ে সেই অতিরিক্ত ঝাল আর গুড় তেল দেওয়া লংকা-আমের আচার টুকু আর টুকলির মা, ব্যস এই অসামান্য জিনিষদুটোর মুখোমুখি হলেই চিরকাল যার পর নাই খুশী হতাম কিন্তু আশি সালের পর যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছিল বরাবর তারা সেল( স্টীল অথারিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেড)এর কোয়ার্টারে উন্নত বসবাস করবে এমনটা আশা করা ভুল, তাই ক’এক বছর পর টুকলি আর তার মা কোথায় চালান হয়ে গেল বলা মুশকিল, আর হ্যাঁ অবশ্যই মলয় রায়চৌধুরী যিনি হাংরী মুভমেন্টের কবি ,দেখেছেন লিখেছেন দিয়ারা , দ্বীপের মত চর, জেগে ওঠে, জল প্রবাহকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে বছরের পর বছর...এবং সেই চরে বসবাসকারী অজস্র মানুষের সুখ শান্তি পাইপ-গান কাট্টা –তামাঞ্চা গাঁড়াসা ভোজালি এক নল্লা দু নল্লা একে সান তাল্লিশ। সেই সব প্রত্যক্ষদর্শীরা যারা চায়নি গঙ্গার বুকে চর জাগুক, পুরনো পলি জমে শক্ত হয়ে ক্রমে শুকনো ডাঙ্গা ও অগণিত মানুষের উদ্বিগ্ন ক্রম বিবর্তন, মলয় রায়চৌধুরী তাদের ক্ষোভ লালসা আঘাত প্রত্যুত্তর টু বি স্পেসিফিক, ‘ঔরস’ উপন্যাস দিয়ে আমাদের বুঝিয়েছেন দেখিয়েছেন ভুলিয়েছেন জাগিয়েছেন হয়ত কোথাও গোপনে কাঁদিয়েওছেন, যে কান্নাটা আমি বহু বছর আগে টুকলির মার জন্য কাঁদতে পারতাম। মলয়ের লেখা তবুও সব সময় পড়িনা, কারণ তা একলা একটা খন্ডে গিয়ে শেষমেষ যাবতীয় সুখ-শান্তির সমাপ্তি বা কোকিল ডাকা ভোরএ ঘুম ভাঙ্গিয়ে তুলবে না বলে।। শুধু যখন আর কিছু পড়া বা শোনা মাথায় অবিশ্রান্ত একঘেয়ে কামান দেগে দেগে ইনফরমেশনের পাহাড় গড়ে তোলে,ঠিক তখুনি ‘ছোটলোকের ছেলেবেলা’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ বা ‘ ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ এক আধবার চোখ বুলিয়ে নিলেই যথেষ্ঠ। ‘ঔরস’ও তাই-ই, তবে একবারে হয়নি, পরপর তিন বার পড়ে ফেলতে হল। এক নিঃশ্বাসে দ্রুত,কারণ উপন্যাসটাও যেন ঐ এক নিঃশ্বাসে দ্রুত কয়ে যাওয়া। যার কথা ও সুর দুটোই মলয় রায়চৌধুরীর।
একজন রেগুলার পাঠক বলতে যা বোঝায় মলয় রায়চৌধুরীর তেমন পাঠক আমি না। কিন্তু ওনার অতীত বর্তমান ও ভবিষৎ পাঠক, তাদের আবেদন নিবেদন এবং সপ্রেম গোপন দীর্ঘশ্বাস, এবং তাঁর রচনাবলীর প্রকাশক সম্পাদক এবং বইএর পুনর্মুদ্রন, প্রাপ্তিস্থান এবং অল্প হলেও দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেওয়া ‘মূল্য’ আমার নজরে থাকে, থেকেই যায়। আরও মন দিয়ে লক্ষ্য করি ওনার বইগুলির প্রচ্ছদের ভেতর দিকের প্রথম পাতা, যেখানে একদম নীচে ছোট ছোট হরফে ‘ এই লেখকের অন্যান্য বই’। ঔরস উপন্যাস পড়ার আগে ওনার পুরনো লেখাগুলো পড়েছিলাম, কোনও কোনও লেখা আবার দুবারও। অসংখ্য চরিত্র, তাদের হিজিবিজি উপস্থিতি,সংলাপ, বাদানুবাদ,আর্জি, দাবী-দাওয়া বকমবকম...
‘মাছ খাও না?’ জানতে চাইল ঢ্যাঙা যুবতী, জিনসের ঘাঘরা। ‘তুমি তো বাঙালী?’
আবোল তাবল মাংস আর শুঁটকি মাছের বোঁটকা ভয় অতনুর। বরং নিরামিষ খেয়ে চালিয়ে দেবে। যুবতীর কন্ঠস্বর কিছুটা ভাঙা ভাঙা, শোনেনি এর আগে। এত কাছাকাছি একজন যুবতীর সঙ্গে, একজন নয় দু-জন, সে কথা বলতে পারছে। ছি ছি মিথ্যে বলা উচিত হয়নি।
‘তুমি ফ্যামিলি আনতে পারতে’। বেঁটে মতন যুবতীর খোঁজ খবর।
‘বিয়ে করিনি এখনও।’ বিছানা থেকে নেমে, টেবিলে রাখা ফ্রায়েড রাইসে এক নজর লোভী চাউনি , বলল অতনু। এদের ইংরেজী সত্যি কত ভালো। নিজেরটায় বাঙালী টান, ভজকট।
‘ভালো কথা’ একসঙ্গে বলে উঠল দুজনে। একজন আর একজনের মাথায় আলতো চাঁটি মেরে, ‘গুড লাক’...... ( ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস)
‘ মা জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা আমায় বলো দিকিন বুড়ো ছেলেটা কার? বটঠাকুরের দু-দুটো মেয়ে থাকতে ও ছেলেটা কেন? ছেলেটা আসলে কার?’
কার মানে? তুমি তো জানোই দাদা বৌদি ওকে পুষ্যি নিয়েছিল।
সেটাই তো জানতে চাইছি। কেন পুষ্যি নিয়েছিলেন? ছেলেটা যে আমার বড় জার নয়, তা আমি জানি। সকলেই জানে।
কার ছেলে কি করে জানব? তোমার সামনেই তো দাদা পাঞ্জাবী বউটার কাছ থেকে দেড়শো টাকায় কিনেছিল বাচ্ছাটা।
আমার এতদিন সন্দেহ হয়নি। আজকে সন্দেহ হল বলেই জানতে চাইছি। বাচ্ছাটা কি তোমার দাদার? উনিই কি বুড়োর আসল বাবা?
তা কেন ? না বোধহয়। দাদার মত অমন দেবতুল্য মানুষ। ...... ’’ ( ছোটলোকের ছোটবেলা)
কবি মলয় রায়চৌধুরী, ঔপন্যাসিক মলয় রায়চৌধুরী, প্রাবন্ধিক মলয় রায়চৌধুরী, নাট্যকার মলয় রায়চৌধুরী, গল্পকার মলয় রায়চৌধুরী, অনুবাদক মলয় রায়চৌধুরী, সমালোচক মলয় রায়চৌধুরী,সাক্ষাৎকারী মলয় রায়চৌধুরী, গ্রামোন্নয়ন-উপদেষ্টা মলয় রায়চৌধুরী,আবৃত্তিকার মলয় রায়চৌধুরী, ভাবুক মলয় রায়চৌধুরী, দার্শনিক মলয় রায়চৌধুরী, রান্নাশিল্পী মলয় রায়চৌধুরী যে ভাষায় যেমত শব্দবন্ধ ব্যবহার করে উপন্যাস লেখেন, ঔরস তার ব্যতিক্রম না। ভাষার মাধুকরী করেছেন, করতে হয়েছে, যে বুঝবে জানবে তিনি ক্রমে বড় হয়ে উঠেছিলেন যে মহল্লায় চারিদিকে তার কুর্মি দোসাদ ডোম চামার কামার মুসলমান এবং যাদব। কবিসৃষ্টি অপেক্ষা কবিকে জানিলে অধিকতর লাভ’’, লাভ আজও এই মুহুর্তে ছত্রিশ কোটি বাঙালির পুরুষানুক্রমে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের খতিয়ান, যে খতিয়ান মলয় দিয়ে গেছেন তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে গল্পে কবিতায় প্রবন্ধে মনে মননে ফেস বুক পোস্টে, দিচ্ছেন, ভাবছেন ভাবাচ্ছেন আমরা কি বাঙালি? কি হলে বাঙালি হয়? কোথায় বাঙালির আইডেনটিটি বা পরিচয়। কার উত্তরসুরী আমরা? কবে বাঙালির বাঙালিত্ব শুরু? শেষ বলে কিছু আছে? নেই? কেন নেই? পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, বিহারের বাঙালি, গুজরাটের বাঙালি,ব্যাঙ্গালোরের বাঙালি,দন্ডকারণ্যের বাঙালি, কর্পোরেটের বাঙালি, যখন তখন যেখান সেখান থেকে তাড়া খাওয়া বাঙালি,ব্যবসাদার মাফিয়া ডন খুনী কেন্দুপাতার ডিলার বাঙালি, পার ভাঙা যেমন নদীর মুদ্রাদোষ, বজ্রগর্ভ মেঘের সঞ্চার সত্ত্বেও বৃষ্টিহীনতা যেমন মৌসুমী বাতাসের ব্যাধি,তেমন মলয়ের এই বাঙালি দেখা আ-দিগন্ত...
সাহিত্য সমস্ত জীবন থেকে আহরিত হয় বলে সাহিত্য সমালোচনা ভাষাতত্ব,বিজ্ঞান,দর্শন ইত্যাদি নানান আন্ত-সম্পর্ক যুক্ত বিষয় থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে পারেনা। এজন্য আমরা শুধুমাত্র মলয়ের ঔরস উপন্যাসের পাঠকৃতির দিকে নজর না দিয়ে তাঁর সমগ্র সাহিত্য দর্শনের দিকে নজর দিলে ভাল করব। যা থেকে তার লেখনীর গুণিতক গুলোকে খুঁজে পাওয়া যাবে। যাকে উত্তর আধুনিক বলেও চিহ্নিত করা যাবে। আধুনিকতা একটা প্যারাডাইম। যাকে ফুকো বলেছেন episteme। আধুনিকতা ‘প্যারাডাইম শিফট্’ থেকে আসে উত্তর আধুনিকতা। যেখানে একটা প্যারাডাইম থেকে আসে অন্য আর একটা প্যারাডাইম। কথা প্রযুক্তি সেই সামগ্রিক প্যারাডাইম শিফট্ বা বাঁকবদলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যে পরিবর্তন অর্গানিক বা জৈবিক। মলয় ঘুরে বেড়ান জীবনের নানান বিষয়ের মধ্যে যাকে আধুনিকতা দিয়ে বোঝা যায় না। ঔরস উপন্যাস শুধু মৃত্যুর গল্প না, আনন্দ ও বেদনা এখানে সমান উচ্চারিত। সুশান্ত ঘোষ সর্বদা এক আনন্দ অনুভব করে। সে বিহারী জোতদার পরিবারের যুবকদের মতন, রাজপুত ভুমিহার কুরমি যারা,কিংবা ব্রাহ্মণ কায়স্থ বিহারী আমলার শহুরে ছেলেদের ধাঁচে, অফিসে প্রতি ঋতুতে হালফ্যাশান এনেছে। দপতরের গৃহবধূ কর্মীদের নজরে সুশান্ত অবিনশ্বর যাদুখোকন, লিচুকুসুম্ মাগ ভাতারের অচলায়তনের ফাটল দিয়ে দেখা মুক্ত দুনিয়ার লালটুশ। কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক সুশান্ত, আরও স্বচ্ছলতার আপ্রাণে, শীতে দাক্ষিণাত্য থেকে আম, কোংকন থেকে এঁচোড় কাঁঠাল, গ্রীষ্মে সিমলা থেকে টম্যাটো কড়াই শুঁটি ফুলকপি..., ঠগিদের বংশধর হবার গোপন গর্ব আছে তার। সুশান্ত ঘোষ একটানা গেঁজিয়ে যেতে পারে, চোখে চোখ রেখে, নন স্টপ, যেন বাজে বকার মধ্যেই পালটে যাচ্ছে হিজড়েতে, সবায়ের অজান্তে।
কি হয় অমন কথা বলাবলির, এক্সচেঞ্জ হলে সুশান্তর পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, ঠোঁট বন্ধ রেখে হাইতোলা চেপে, ভেবেছে অতনু। অতনু চক্রবর্তী। ময়লা বলতে যা বোঝায়, অতনুর গায়ের রং তার চেয়ে এক পোঁচ ফরসা। দু চোখে সব সময় বরফের বুদবুদ, ভেতরে ভেতরে উসখুসে নদীর স্রোত। গত অঘ্রানে তেইশে পড়েছে...... অতনুর হাতে মানসী বর্মনের গচ্ছিত রাখা বাদামি নরম ফোমলেদার ব্যাগ,কয়েক লক্ষ টাকার নোংরা নোট আর অসীম পোদ্দারের গোপন ডায়রী তাতে। .....গত বছর গরমকালে সুশান্ত অতনুকে এক শনিবার মহংগুর দোকানে বিকেল ছ’টা নাগাদ অপেক্ষা করতে বলেছিল। বগেরির মাংস খেয়ে জীবনের অ্যাকশন রিপ্লে দেখাতে নিয়ে যাবে......। এসব ওদের প্রথম যৌবনের গল্প। এর বিবরন আছে ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ এ। ঔরস উপন্যাস হল এরই পরবর্তী- সুশান্ত, ছেলে অপু, বউ বেবি, শ্বশুর তারিনী মন্ডল,পাটনা শহরের পুরনো পারিবারিক কিছু সম্পর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি। গল্পের কেন্দ্রে থাকে মৃত্যু। আর তার চারপাশ জুড়ে থাকে বাঙালি আইডেন্টিটিক্রাইসিস,শারিরীক,জৈবিক,মানসিক ক্ষুধা। জীবন আর মুত্যুকে এক সঙ্গে দেখার যে প্রশ্ন করে সুশান্ত তা শেষ পর্যন্ত হেলে সাপই থেকে যায়।
যে কোনও ধরনের দুঃখ কাব্য-সাহিত্যের উপজীব্য অর্থাৎ বেদনা ব্যথা না থাকলে সে গল্প কবিতা শোনা হয়ে গেলেও পরে আর মনে থাকবে না। মলয় বলছেন , আনন্দের বিপরীত দুঃখ নয়। আনন্দ বলতে বোঝায় প্রীতি হর্ষ সুখ প্রমোদ যেগুলোর স্প্যান ওই ফ্ল্যাশটুকু। বিরল প্রতিস্বের মানুষের কথা যদি ভাবি, যেমন ধরা যাক চৈতন্যদেব ও রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, তাঁদের ক্ষেত্রেও আনন্দের স্প্যান দীর্ঘ হবার কোনও কারণ দেখিনা। বয়সের সঙ্গে এই স্প্যানের হেরফের হয়, এমনও মনে হয় না। কিন্তু দুঃখের ক্ষেত্রে হয়। যে কারণে দুঃখের কোনও দীর্ঘ স্প্যানের মধ্যে এক বা একাধিক আনন্দের ফ্ল্যাশ গড়ে উঠে মিলিয়ে যাবার ঘটনা ঘটতে পারে। বস্তুত এই ফ্ল্যাশের বিমূর্ততার জন্যে ‘অনির্বচনীয়’’ আনন্দ শব্দবন্ধ তৈরী হয়ে থাকবে। কেননা দুঃখও তো বর্ণনাতীত, অবর্ণনীয়,অনির্বাচ্য হতে পারে। আনন্দের তুলনায় বেশি। আনন্দকে যে কাল খন্ডে ব্রহ্মা বলা হয়েছিল, সে সময় থেকেই আনন্দকে মনে হয়, অনির্বচনীয় মনে করা হয়েছে। ব্রহ্মের দুটি রূপের কথা ভাবা হয়েছিল। একটি নির্গুণ ও অমূর্ত, অন্যটি সগুণ ও মূর্ত। সে যুগে দুঃখ নিয়ে সাংখ্য দর্শনে ভাবা হয়েছিল, এবং স্বাভাবিক ভাবেই তাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অ্যাবস্ট্রাকশনে। অন্তত আমাদের সময়ে চিন্তা ভাবনার ফর্মে তা অ্যাবস্ট্রক্ট মনে হবে। সাংখ্যের প্রণেতা কপিল মুনির ব্রহ্ম ভাবকল্পকে আনন্দের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলা হয়েছিল। সাংখ্য দর্শনে দুঃখ নিয়ে ভাবা হল। তার কারণ কপিল মুনি ঈশ্বরকে অসিদ্ধ প্রমান করলেন। বললেন,বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃ্তির বিকার থেকে। সাংখ্য অনুযায়ী দুঃখ ত্রিবিধঃ আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক আর আদিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখ দুই রকমঃ- শরীর খারাপ হবার দুঃখ, এবং ঈর্ষা ভয় রিপুর কারণে মনে দুঃখ। আধিভৌতিক দুঃখও দুরকম। প্রথম যদি ভুতে ধরে, দ্বিতীয় – মানুষ পশু পাখি সাপখোপের দেওয়া দুঃখ। আধিদৈবিক দুঃখ উৎপন্ন হতে পারে দেবতার প্রকোপে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে। এই সমস্ত অ্যাবস্ট্রাকশন গুলোর কারনে আনন্দ ও দুঃখের ভাবকল্পে প্রাচীনকালে ভেবে দেখা হয়নি, বা সম্ভবত চিন্তার ফর্মের জন্যে ভাবা সম্ভব হয়নি,যে সমাজ ও সম্প্রদায়ের ব্যবস্থাটি থেকেই কারোর আনন্দ আর কারোর দুঃখ ঘটতে পারে।( হাওয়া ৪৯,চল্লিশতম সংকলন মাঘ ১৪১৭বইপার্বন২০১১, পৃঃ -১৩)
মলয়কে তিন বছর বয়সে ক্যাথলিক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদিন যেতে হত বাইবেল ক্লাশ করতে। তিনি বলছেন,চার্চের যে স্মৃতি রয়ে গেছে তা দুঃখের। আজও যে কোনও ক্যাথলিক চার্চে ঢুকলে ইন্সটিংটিভলি তাঁর দুঃখ চাগিয়ে ওঠে। মলয়ের জানতে ইচ্ছে করে আনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম ও বেদনাময় খৃস্ট – এভাবনা দুটি রেঁনেশাসকালীন ধর্মান্ত্রিত হিন্দুরা কিভাবে মেলাতেন, কারণ ঐ সব হিন্দুরা বেশিরভাগই ছিলেন উচ্চবর্ণের। খৃস্টধর্মের প্রভাবেই আধুনিকতাবাদী পাশ্চাত্ত্য কবিদের রচনায় এত বেশি দুঃখ ব্যথা, বেদনা, কষ্ট, যন্ত্রনা। লক্ষণীয় যে হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ গ্রন্থে ব্যথা ও বেদনা শব্দদুটি নেই,যদিও ব্যথ ও বেদন আছে। ঔরস উপন্যাস অবশ্যই একটি দুঃখের গল্প যেখানে গল্পের শেষে মলয় আমাদের তেমন কোনও সমতল জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাননি। মূলধারার বৃহত্তর বাঙালি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও বঙ্গীয় সংস্কৃতির খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচে থাকা এক বাঙালি পরিবারেরই গল্প নিয়েই এই উপন্যাস লিখিত। লেখক কি নিয়ে কিভাবে লিখবেন তা সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব অভীপ্সা। শরৎচন্দ্রের সময়ে ছিল বার্মা মুলুক,রবীন্দ্রনাথের নীড় বিশ্ববিধাতার সাথে যুক্ত,জীবনান্দের মিস্টিক অতীত ও কার্তিকের বাংলা। সেই সব স্পেসের সাথে বর্তমান স্পেস আলাদা। এখন লেখা অনেকটাই ই-স্পেসে। মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন দিনের পর দিন মাসের পর মাস ঘটনার অনুক্রমে সত্যের প্রুরালিটি। যার প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ তৈরী করে। যেমন...... ‘হাত পা বাঁধা, গুটকাদেঁতো মুখে লিউকোপ্লাস্ট, বছর তিরিশের ঢাউসভুঁড়ি হুলোচোখ ট্রাক ড্রাইভারটা মার খেয়ে আধজখম হয়ে খড় কাটার যন্ত্রে সবুজ নাইলন দড়ি বাঁধা অবস্থায়, অজ্ঞান হয়ে নেতিয়ে ছিল,প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাশিদের পাড়ায় তোতারাম পাসওয়ানের মহাত্মা গান্ধী রাস্ট্রীয় কর্মযোজনার টাকা মেরে তৈরী খামারে। ট্রাক চালক বৈশাখি যাদবের কাছ থেকেই তারিণীর সাঙ্গপাঙ্গরা আঁচ করতে পেরেছিল খুনের পেছনে কাদের হাত থাকতে পারে। আররে, বৈশাখি হ্যায় কংসায়তি যাদব, অসলি কৃষ্ণায়তি যাদব নেহি হ্যায়, মুহ খোলেগা ক্যায়সে নেহি; ডরপোক কংসায়তি ফাট্টু কাঁহিকা।
তারিণী মন্ডল দিয়ারার চরের জমিদার, সুশান্ত ঘোষের শ্বশুর। তার মেলা সম্পত্তি। এবং সে সবের একমাত্র ওয়ারিশ নাতি অপু,অশ্বমেধ ঘোষ। সুশান্ত ঘোষ – বাবা মার জন্য স্মৃতির জারকে আচ্ছন্ন সুশান্তর মন কেমন করে মাঝেমাঝে, তখন গ্যাঁজানো তরমুজের চোলাই করা সোমরস নিয়ে বসেন, সঙ্গে শুয়োয়ের মাংসের বড়া,আদা-রসুন-পেঁয়াজবাটা আর বেসনমাখা, হামানদিস্তায় থেঁতো করা মাংসের বড়া, সাদা তেলে যা রাঁধতে ওনার বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউএর ভারিভরকম মায়ের জুড়ি নেই। ওনার ছেলে অপু, যদিও বাংলা বলতে পারে কিন্তু মাকে শুনিয়ে হিন্দিতেই বলে, হাঁ পিজিয়ে পিজিয়ে অওর গম গলত কিজিয়ে; আরে অগর আপকা দিল নঁহি লগতা থা তো ভাগ কেঁও নঁহি গয়ে থে? য়ঁহাসে নিকলকে ভাগলপুর স্টেশন, অওর ওঁয়াহাসে সিধে পটনা, স্টেশন ভি ঘর কে নজদিক।পর আপ নহিঁ ভাগে। লগতা হ্যায় আপকো অপনে বিবি সে জ্যাদা প্যার অপনে সসুরসে হ্যায়। বিবি কঁহি ভি মিল জাতি, মগর তারিণী মন্ডলকে তরহ মকখনভরা পহাড় নহিঁ না মিলতা, য়হি হ্যায় না আপকা গম?
সুশান্ত তাই মাঝে মধ্যেই পটনা চলে যায়। পরিবারের বাদবাকি লোকজনদের সঙ্গে খানিক সময় কাটিয়ে আসেন। অবশ্য সুশান্তর বাবা মা আর কেউ বেঁচে নেই, আছেন বড় জ্যাঠাইমা, বড় জ্যাঠা আর ভাইঝি ইতু। এদের সঙ্গে খানিক মন খুলে কথাবার্তা বলেন , বিশেষ করে ভাইঝি ইতু অনেকটাই তাঁকে বোঝে। ইতু নিজেও নিজের মনের কথা কাকা সুশান্তকেই খুলে বলে। পটনার এই আদ্যিকালের বাড়ি আর বস্তপচা মূল্যবোধ ছেড়ে সেও যেদিকে দুচোখ যায় বেরিয়ে যেতে চায়। কারণ এই পরিবারে ইতুও অনাদৃতা, তারও বাবা মা কেউ নেই। এমনকি একমাত্র প্রেমিক অমিত,তাকেও এ বাড়ির সবাই বেজন্মা বদনাম দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। অমিত হল সুশান্তর সেই যৌবন কালের বন্ধু অতনু চক্রবর্তী ও অতনুর বান্ধবী মানসী বর্মনের পালিত পুত্র। অমিত আর ইতুর মধ্যে নিভৃত একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাড়ির লোকজন তা জানতে পেরে অমিতকে বেজন্মা অপবাদ দেয়। ফলত অমিতের রাতারাতি গৃহত্যাগ। সুশান্তর কাছে ইতু মনের আক্ষেপ প্রকাশ করে। বলে অমিতের জন্যই সে এই বাড়িতে এখনও বাস করছে, কারণ অমিত ফিরে আসবে। সুশান্ত তাকে পড়াশোনা কেরিয়ার নিয়ে ভাবতে বলে, কিন্তু ইতুর অত ইচ্ছে নেই। ইতু এখন পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে,সুশান্তর মত। অবশ্য সুশান্ত তো পালিয়ে যাননি, ছোটবেলায় তাঁকে তারিণী মন্ডল কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তিপণের টাকা না পাওয়ায় নিজের মেয়ে বেবির সঙ্গে সুশান্তর বিয়ে দিয়েছিলেন। এদিকে উপন্যাসের শেষে দেখা যায় অমিত ইতুর ফের সাক্ষাৎ, ইতু চলে গেল অমিতের সঙ্গে। জায়গাটা হল দন্ডকারণ্যের গভীর জঙ্গল, যেখানে গোঁড় গারিয়া ইত্যাদি আদিবাসীদের অবস্থান। জীবনের হাজার জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে ইতু জঙ্গলে ছুটল, লেখক লিখেছেন- নমস্তে ইতুদিদি, শুনে,কালো মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে,ইতুর নাকে ছেলেটির যৌবন গ্রন্থির ঝাপটের উগ্র গন্ধ নাকে সে লাগতে প্রায় বমি পেয়ে গেল; উফ, ফেরোমোন। মুখে থলেটা চাপা দিয়ে সামলালো। কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারল যে এক হাতে ছেলেটির পেট ধরে থাকতে হবে, আরেক হাতে মোটর সাইকেলের হ্যান্ডেল, নয়ত সড়কের যা অবস্থা, নির্ঘাৎ ছিটকে পড়বে কোনও পাথরে চাকা পড়লেই। ঘামে ভেজা পেটে হাত রেখে ধরতে, ছেলেটি বলল, হ্যাঁ ঠিক করে বসুন। এ রাস্তা ভালো নয়, এই তো সবে দুটো ব্লক নিয়ে নারায়নপুর জেলা তৈরী হয়েছে। ইতুর মনে পড়ল অমিত এভাবেই ওর স্কুটারে পেট ধরে বসেছিল, আর নাভিতে সুড়সুড়ি দিয়েছিল। যুবকটির পেট, বর্ষায় ভেড়ার লোমের মতন, বেশ ভিজে,উনিশ কুড়ি বছর হবে, গায়ের রং মুখের গড়ন দেখে আদিবাসি বলেই মনে হল। ইতু জিজ্ঞেস করল, দান্ত্যেশ্বরী মন্দির কি পড়বে রাস্তায়? ছেলেটি বলল, না, দিদি। দান্ত্যেশ্বরী হল বস্তারের দেবী। নারায়নপুরে অবুঝমারিয়াদের দেবী হল কাকসার। বৈগারা রাসনাভাকে পুজো করে, আর গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে। উত্তর শুনে যুবকটিকে কোনও পালটা প্রশ্ন করল না ইতু। নিজেকেই প্রশ্ন করল, মেঘনাদ? এ কোন মেঘনাদ? রামায়ন?...।
মলয় রায়চৌধুরী বহু পঠিত, বহুচর্চিত, বহু নিন্দিত ও একই সঙ্গে বহু আলোচিত। বরাবর তিনি টিকে থাকার গল্পই লিখে এসেছেন। এই উপন্যাসের অনেক চরিত্র। মনে হয় শুধুমাত্র জীবনের ভজকট দিক গুলো দেখাবার জন্য এমন ভাবে অহেতুক চরিত্র সংযোজনা। সুশান্ত আর তাঁর ছেলে অপুর মধ্যে তেমন কোনও বাদানুবাদ বা সংলাপ নেই, অথচ ভাইঝি ইতু আর সুশান্ত নিজেদের মধ্যে এমন গল্প করেছে যে তা নাহলেও এই উপন্যাসের অঙ্গহানি হত না। ইতুর মুখ দিয়ে মলয় যে সব কথা বা ডায়ালগ বলেছেন যা শুধু মলয়কেই মানায়( সেই শুভা কে বোবা করে এক তরফা যেমন বলেছিলেন, প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতারেরই এক্সটেন্ডেড পার্ট। এর থেকে মলয় আর বের হতে পারলেন না!) সমাজ ও পরিবার সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরী যা যা ভাবেন, যেভাবে ভাবেন, আজ যে শিশুটি দিয়ারা চরে জন্ম নিল, হতে পারে বড় হয়ে সে দিয়ারা চরকেই মডেল টাউন বানিয়ে ফেলল। অপু তার নানা নানির খুনের বদলা নিয়েছে। অথচ তার মানসিক টানাপোড়েন উপন্যাসে বেশি নেই। সে ক্রুদ্ধ, বদ মেজাজী বা রাজনীতি বিলাসী। দিল্লীবাসী ও সময়ের স্রোতে চলা এক যুবক। কিন্তু এটুকু হলেই তার কথা শেষ হয়না। প্রত্যেক মানুষের দুটি করে চিন্তা স্রোত, বিষয় যাই হোক, সর্বদাই মানুষের মন সেই বিষয়ে প্রথমেইএকটি গড়পরতা চিন্তা ভাবনা করে। আবার সম সাময়িক দ্রুত একটি শুদ্ধ চিন্তাও পাশাপাশি কাজ করে চলে। অপু এই মুহুর্তের জেনারেশান। সুতরাং তার কাছ থেকে পাঠকের অন্য যে কোনও আশা বা চাহিদা থাকতেই পারে। কিন্তু সে যেন তার বাবা মা বা নানার প্রতিবিম্ব বা একই চিন্তা ভাবনার উত্তরসুরী। এই চরিত্রটি দিয়ে লেখক ঔরস উপন্যাসকে ভিন্ন মাত্রা এনে দিতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। অপু একটি গড়পরতা চরিত্র ছাড়া আর কিছু না। মনে রাখার মতন অপু কিচ্ছুই করে উঠতে পারেনি। ইতু অমিত তারিণী মন্ডল জ্যাঠাইমা সৌদামিনী ইত্যাদিরা না থাকলেও উপন্যাস নিজের নিয়মেই এগিয়ে যেত। ইতু অমিতের একত্র সহবাস হয়েছে, কিন্তু গল্পের শেষে দেখা গেল দুজনে দুই দিকে। তারিণী মন্ডল ও তাঁর স্ত্রী মন্থরা দেবী খুন হলেন, সুশান্ত আত্মহত্যা করল,অপু কোথায় পালালো না পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিল ,চরিত্রের পরিনতি মনে দাগ কাটে না। আসলে মলয় স্পেস এর গল্প লিখেছেন, লিখেছেন একটি নিদির্ষ্ট কালখন্ডের চিত্র-চরিত্রায়ন। হতে পারে এইটি হয়ত উত্তর আধুনিকতা। যেন বহমান সময় স্রোত থেকে হঠাৎই এক আঁজলা জল তুলে নেওয়া।
মলয় বলছেন, লেখালেখি সম্পর্কে যখন আমরা ব্যক্তিগত পরিমন্ডল ও মানসিক স্থিতি গড়ে তুলছিলুম, ১৯৫৯-৬০ নাগাদ, তখন কেন লিখব, কেন ভাবছি, কেন কেউ পাঠবস্তুটি পড়বে, এ সমস্ত ধারনা গড়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্থানীয় বুদ্ধিজীবি মহলে সাহিত্যের আলোচনায়, আলোচকরা ছিলেন ডক্তর জনসন প্রভাবিত এবং প্রতিটি রচনা বা তার অংশের ব্যাখা ছিল পূর্বনির্ধারিত, প্রায় অপরিবর্তনীয়। প্রতিটি মাষ্টারমশায় ‘সোনার তরী’ থেকে একই সংকেত পাচ্ছেন দেখে, মুখ বুজে স্তম্ভিত হয়ে যেতুম। শোকের কবিতায় শোক প্রকাশ করতে অস্বীকার করার বোধটি বাংলা কবিতায় বেশ দেরীতে এসেছে, আটের নয়ের দশকে, যখন পোস্টমডার্ন বা উত্তর-ঔপনিবেশিক কবিতা তার নিজস্ব আদল পেল। বিভা বসু রচিত ‘একটি দুরারোগ্য মুক্তি’, সুবীর সরকার রচিত ‘যুদ্ধরত সৈনিকদের অ্যালবাম’, কামাল হোসেন রচিত ‘শবদের কাঁধে করে’ অ্যান্টিএলিজিগুলো মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে। ইংরিজিতে সম্ভবত শোক প্রত্যাখানের প্রথম এলিজি ডিলান টমাসের ‘রি-ফিউজাল টু মোর্ন ডেথ বাই ফায়ার অব আ চাইল্ড ইন লন্ডন’।
একদা এলিজি ছিল নির্জন সমাধি। এখন সেখানে হুল্লোড় আর হইচই। তাত্ত্বিক,দার্শনিক,নান্দনিক,রাজনৈতিক,আর্থিক,সাংস্কৃতিক লাশে ঠাসা। পোস্টমডার্ন বলা হোক বা উত্তর-ঔপনিবেশিক যে নামেই ডাকা হোক বর্তমান কালখন্ডটিকে, সামাজিক ভাবে মৃত্যু পেয়েছে একটি বীভৎস রূপ, যা শোকের সংজ্ঞায় পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যে এলিজি ছিল লিরিক জঁরের অন্তর্গত, তা এখন চীৎকার ও বুক চাপড়ানি, ভয় ও উদাসীনতা,অবিশ্বাস ও বুকনির খোলা ময়দান। সুবিমল বসাকের একটি রচনা আছে। নাম, ‘আত্মার শান্তি দু-মিনিট’। শহুরে দ্রুতির গর্জনে দাঁড়িয়ে ওই বিয়োগব্যথাতুর দু-মিনিট হয়ে ওঠে দুই শতাব্দী। সময় নিজেই আজ আবিষ্ট ও আচ্ছন্ন। সময় এখন বিকার তত্ত্বের অন্তর্গত। গ্রীক এলিজি প্যাসটরাল ছিল। বাংলা ও এউরোপীয়ান এলিজি ছিল স্মৃতি আশ্রয়ী। এখনকার অ্যান্টি এলিজি জানে যে স্বজনের মৃত্যুতে আর্থিক লোকসানে মানুষ অধিক শোকার্ত,ব্যথিত ও আতঙ্কিত। যা অস্বাভাবিক তাকেই স্বাভাবিক করে ফেলেছে আধুনিকতা। শোকের আদিম রূপটি সেহেতু মডার্ন ও পোস্টমডার্ন এলিজিতে পাওয়া যাবে না।
প্রায় আশি বছর বয়সে পৌঁছেছেন মলয়। কথা হল এমন ধরনের উপন্যাস আবার নতুন করে লেখার কি কিছু দরকার ছিল? এতদিন যা যা লিখেছেন, যেভাবে লিখেছেন, মনে হয় ঔরস তারই পুনরাবৃত্তি। বর্ত্তমান কালখন্ড সমাজ পরিবার মানুষ সময় ইত্যাদি সব কিছুকেই অসংখ্য ডাইয়ামেনশনে ঘুরিয়ে মারছে। একটা সময়ে, সে বেশিদিন আগের কথা না, মানুষ একান্নবর্তী পরিবারে জীবন কাটাত। তারপর কালের নিয়মে সে প্রথা ঘুচে গিয়ে এল অণু পরিবার। স্বামী স্ত্রী আর এক বাচ্ছা। এখন সময় আরও বদলেছে। বাচ্ছা ভারতের নামী স্কুলে পড়ে ও সেখানেই থাকে। স্ত্রী মোটামুটি একটি চাকরী করে আর স্বামী আগের চাকরী ছেড়ে বর্তমানে ব্যাবসা করছেন। প্রায়ই তিনি আজ হংকং, কাল আয়ারল্যান্ড, পরশু জাপান ছুটছেন। স্কুলে সামার ভ্যাকেশন হলে বাচ্ছাটি আর বাড়ি আসতে চায় না। স্কুল থেকে সাউথ আফ্রিকা ট্যুর হচ্ছে। মাকে ফোনে জানিয়ে দিচ্ছে , এবার গরমের ছুটিতে সে বন্ধুদের সঙ্গে সেখানেই বেড়াতে যাবে। মা-ও অগত্যা রাজী হয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, কর্মব্যস্ত স্বামী নেক্স্ট ফ্লাইট ধরার আগে গোগ্রাসে কিছু ব্রেড ওমলেট দিয়ে দ্রুত লান্চ সেরে নিচ্ছেন। হতাশা ও একাকীত্বে ভুগতে থাকে স্ত্রী বাড়িতে আজকাল রান্না বান্নার পাট প্রায় তুলেই দিয়েছেন। একমাত্র বাচ্ছা ( এবার সে বড় হয়ে গেছে) একদিন মাকে জানাল,সম্প্রতি বিশেষ একটি অ্যাপস খুব শীঘ্রই চালু হতে চলেছে। থালা ভর্তি খাবার দাবার সাজিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে গেলেই হল। যারা একেবারে একলা, দুপুর বা রাত্রে খাবার সময় সব রকম খাবার দাবার নিয়ে স্ক্রীনের সামনে বসে অন লাইন এমন কাউকে সঙ্গী পাবে বিপরীত দিক থেকে সেই মানুষটিও অমন খাবারের থালা নিয়ে একলা খেতে বসেছে। এক কথায় অন লাইন খাবার টেবিল, একলা খাওয়াও হল না, উলটে প্রাপ্তি হল খেতে বসে নানা রকম গল্প গুজব। এই মুহুর্ত্তের গল্প এটা। এমন বিষয় নিয়ে মলয় আপনি কিছু লিখে দেখাতে পারেন। ঔরস উপন্যাসকে কোথাও কোথাও চর্বিত চর্বন বলে মনে হয়েছে। সেই এক ঘেয়েমি থেকে পাঠক নতুন স্বাদ পেতেও পারেন।
...............................................................................................................।।ঋণ স্বীকার ঃ
ছোটলোকের ছোটবেলা, ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস –মলয় রায়চৌধুরী
মলয় রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ – সম্পাদক- সমীর রায়চৌধুরী, হাওয়া৪৯,মাঘ১৪১৭,বই পার্বণ ২০১১
সমীর রায়চৌধুরীর ছোটগল্প- অশোক তাঁতী( দমদম জংশন, ২য় বার্ষিক সংখ্যা, ২০১৮)
.....................................................................................................................।।
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন