প্রতিবাদের কবিতা — বাংলা সাহিত্যের একটি ‘ঐতিহাসিক ভুল’ : মৌলিনাথ বিশ্বাস
যতদিন মানবসভ্যতা বেঁচে থাকবে ততদিন অত্যাচার-আগ্রাসন-সন্ত্রাস থাকবে । যতদিন অত্যাচার-আগ্রাসন-সন্ত্রাস থাকবে ততদিন তার বিরুদ্ধে থাকবে প্রতিবাদ । এবং যতদিন প্রতিবাদ থাকবে, থাকবে প্রতিবাদী শিল্প-কবিতা-গান । কাস্তে বা হাতুড়ির মতো তুলি-কলম-কন্ঠও হয়ে ওঠে, অবস্হাবিশেষে, অস্ত্র। যেকোনও প্রতিষ্ঠান — রাষ্ট্র থেকে পত্রিকা — এই অস্ত্রটিকে কামানের থেকেও বেশি ভয় পায় ।
বাংলা কবিতার জগতে সম্প্রতি একটি ঘটনা ঘটেছে । ঘটনাটি ছাপার অক্ষরে ইতিমধ্যেই নথিভূক্ত । এই নিবন্ধ সেই নথিভূক্তি আরও একটু বেশি করে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এবং সেই বিষয়ে আমার মত নথিভূক্ত করে রাখতে । তার আগে, বাংলা সাহিত্য পত্রিকার একটি শ্রেণিবিভাগ, যা সবাই জানেন, আর একবার মনে করা:-
বাংলা সাহিত্য পত্রিকা
I
I
I——————————————–I
প্রাতিষ্ঠানিক/ব্যবসায়িক~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~অপ্রাতিষ্ঠানিক
( যেমন দেশ, পরমা, সানন্দা~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~I
সংবাদপত্র যারা সপ্তাহান্তিক~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~I
ক্রোড়পত্রে কবিতা প্রকাশ করে )~~~~~~~~~~~~~~~~~~~I
I________________________________________I
( লিটল ম্যাগাজিন যারা~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~Iলিটল ম্যাগাজিন
যারা প্রতিষ্ঠান
হতে চায়নি, যেমন
কবিতা, এক্ষণ, হাওয়া৪৯
I
I
নিজেরা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~I
যেমন কৃত্তিবাস, কবিতাপাক্ষিক~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~I
ধ্রুবপদ, অনুষ্টুপ ইত্যাদি )~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~I
একটু স্হূলভাবে এই হল বাংলা সাহিত্য/কবিতাপত্রের গোত্রভাগ । উপরোক্ত মূল দুই ভাগ এই ২০১৪ সালে আর জল-অচল নয় । শ্রেণিচরিত্র কোনও পক্ষেই আর তত শুদ্ধ নয় ।
দুই
সম্প্রতি ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার তরফে মলয় রায়চৌধুরীর কাছে একটি কবিতার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল । সেই ‘কৃত্তিবাস’ যে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা এবং নবপর্যায়ে আমৃত্যু সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাংরি আন্দোলনের সময় মলয় রায়চৌধুরীর পক্ষে ইতিবাচক সাক্ষ্যদান বাংলা সাহিত্যের এক ঐতিহাসিক অধ্যায় । ব্যক্তির অপছন্দ কখনও রাষ্ট্রিয় চাপের বিরোধিতা না করার যুক্তি হতে পারে না — সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেইকালে চূড়ান্তভাবে এবং প্রায় আমৃত্যু একই রকমভাবে, এই নীতি মেনে চলেছেন । বাকিটা রাজনীতি যার ব্যাখ্যা এই নিবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক ।
এখন, কোনো কবির কাছে আমন্ত্রণ জানানোর আগে, ধরে নেওয়া যায়, পত্রিকা কর্তৃপক্ষ/সম্পাদক সেই কবি ও তাঁর লেখালিখি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পোষণ করবেন । তা না হলে বুঝতে হবে পত্রিকা সম্পাদকের পেশাদারিত্বের অভাব আছে ।
মলয় রায়চৌধুরী আমন্ত্রণ গ্রহণ করে একটি কবিতা পাঠান । কবিতাটি পুরোটাই নীচে উদ্ধৃত রয়েছে । ‘কৃত্তিবাস’ কবিতাটি প্রকাশ করেনি । মলয় রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, “‘কৃত্তিবাস’ কর্তৃপক্ষ কবিতা চেয়েছিলেন তাঁদের পত্রিকার জন্য । কবিতা পাঠিয়েছিলুম । কবিতা পেয়ে ওনারা জানিয়েছেন যে, কবিতাটির কারণে ওনারা ‘কোল্ড ফিট’ নামের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ; ওনারা চান না যে কবিতাটি ছাপার ফলে এই রোগটি পাঠকদের মাঝে ছড়াক ।”
আমন্ত্রিত কবি আমন্ত্রণ গ্রহণ করে কবিতা পাঠালে সেই পত্রিকা সম্পাদকের উচিত হাজার সমঝোতা করেও, সেই লেখা, অবশ্যই প্রকাশ করা । না করাটা, স্পষ্ট উল্লেখ থাক, অসভ্যতা । যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত এবং দেশীয় সংবিধান কর্তৃক নিষিদ্ধ কারণ আছে, আলোচ্য কবিতাটি তার কোনোটাই লঙ্ঘন করেনি । আমি বিশ্বাস করি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই অসভ্যতাটি করতেন না । তিনি আমন্ত্রণ জানাতেনই না । সে অন্য প্রসঙ্গ । কিন্তু আমন্ত্রিত লেখা তিনি কখনোই ফেরত দিতেন না । শ্রীগঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার যেহেতু কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না, তাই আমি আমার যুক্তি নির্ভর ধারণার কথা জানালাম । বিপরীত তথ্য হাজির হলে, মেনে নেব, আমার ধারণা ভুল ।
আলোচ্য কবিতাটি অবিসংবাদিতভাবে একটি প্রতিবাদী কবিতা । প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ । আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মলয় রায়চৌধুরীর ‘কৃত্তিবাস’ সম্পাদকের আমন্ত্রণ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করা উচিত ছিল । আবারও বলছি, এটা আমার ব্যক্তিগত মত । তিনি তাঁর যুক্তি ও বোধ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । এটা তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত । কিন্তু তাঁর কবিতাটি প্রকাশ করলে, আমি মনে করি, সুনীলোত্তর ‘কৃত্তিবাস’-এর পালকে একটি উজ্জ্বল পালক যুক্ত হতো । এমন ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বাংলা সাহিত্য নিশ্চয়ই মনে রাখবে । আমরা মনে রাখবো কবিতাটির শেষের আগে পংক্তিটির, শেষ পর্যন্ত নির্মম পরিহাসে পরিণত হওয়া ।
আমার ঠাকুমাকে যেন বলবেন না
মলয় রায়চৌধুরী
উনি আমাকে পছন্দ করতে বারণ করেছিলেন
আপনি কেন পছন্দ করছেন, নীরা ?
আমি আজও শুঁয়োপোকা ঠাশা ঈশান মেঘে চিৎ সাঁতার দিই
উনি পঞ্চাশ বছর আমার কাছে কবিতা চাননি
আপনি কেন চাইছেন, নীরা ?
আমি আজও জলের দশ-পা গভীরে শুয়ে বরফের লাঠি চালাই
উনি আমার সাবজুডিস মামলায় সম্পাদকীয় লিখেছিলেন
আপনি সম্পাদক হয়ে কেন লেখা চাইছেন, নীরা ?
আমি আজও স্মোকড পেংগুইনের চর্বির পরোটা খেতে ভালোবাসি
উনি আমার কবিতার বইয়ের প্রকাশক হয়েও স্বীকার করেননি
আপনি কেন স্বীকৃতি দিচ্ছেন, নীরা ?
আমি আজও দুপুর গেরস্তের হাঁমুখে সেঁদিয়ে ফ্যামিলিপ্যাক হাই তুলি
উনি আমার নাম উচ্চারণ করতে চাইতেন না
আপনি কেন তরুণদের কাছে করছেন, নীরা ?
আমি রক্তঘোলা জলে টাইগার শার্কদের সঙ্গে বলিউডি নাচে গান গাই
উনি বলেছিলেন ওর মধ্যে সত্যিকারের লেখকের কোনো ব্যাপার নেই
আপনি কেন মনে করছেন আছে, নীরা ?
আমি ইমলিতলায় জানতুম কাঠকয়লা ছাড়া ইঁদুরপোড়ায় স্বাদ হয় না
উনি বলেছিলেন ওএ কোনো ক্রিয়েটিভ দিক নেই
আপনি কেন মনে করছেন আছে, নীরা ?
আমি অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যাঙ্কনোট পুড়িয়ে মড়ার গন্ধ পেতুম
উনি বলেছিলেন ওর দ্বারা কোনোদিন কবিতা হবে না
আপনি কেন মনে করছেন হয়েছে, নীরা ?
আমি অ্যামস্টারডমের খালপাড়ে হাঁ-করা বুড়োদের লিরিক শুনেছি
উনি সেসময়ে দুঃখ থেকে রাগ আর রাগ থেকে বিতৃষ্ণায় উঠেছেন
আপনি এত উদার কেন, নীরা ?
আমার ঠাকুমাকে যেন প্লিজ বলবেন না
‘শুভম সাময়িকী’ পত্রিকার ডিসেম্বর ২০১৪ সংখ্যায় স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় একটি লেখায় মন্তব্য করেছেন, “আনেক পত্র-পত্রিকায় অকারণেই ওর ( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ) নামে কুৎসা, নিন্দামন্দ ছাপানো হতো । যার উত্তরে সুনীল কোথাও কিছু লিখত না ।” কথাটি, দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে, একশো শতাংস সত্য । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই শিক্ষিত আভিজাত্য পূর্ণমাত্রায় ছিল । ‘আভিজাত্য’ উত্তরাধিকার নয়, জন্মগত ।
রাষ্ট্র থেকে পত্রিকা — প্রতিবাদকে কোনো প্রতিষ্ঠানই কখনই খোলা মনে মেনে নেয় না । তবু, প্রতিবাদী কলম বেঁচে থাকে ।
[ ‘কবিতা এই সময়’ পত্রিকার ২০১৫ বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশিত ]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন