মঙ্গলবার

হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়

 হাংরি আন্দোলন : শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ধীমান চক্রবর্তী এবং মুর্শিদ এ এম

প্র: আপনার কাছে কোনো চিঠি আছে মলয়ের বা সমীরের ?

উ: না, না, আমি তো লিখিনি। যখন এসেছে, দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু চিঠি লিখিনি । তবে হাংরি জেনারেশন করে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । আইওয়া থেকে ফিরে এসে সুনীল হাংরি জেনারেশনের সপক্ষে সাক্ষী দেয়। সেই সাক্ষীর জোরে, বুদ্ধদেব বসুর জোরেই ওরা মুক্তি পায় । পি.কে.সেন পুলিশ কমিশনার, আমাদের যিনি চেয়ারম্যান ছিলেন। উৎপলকুমার বসুকে ডেকে পাঠান । বলেন, তোমরা এ সমস্ত অন্যায় কাজ করছ । এ সমস্ত কাজ করতে দেয়া হবে না । ওকে বলে যে, তুমি লেখো, আমি আর এ সমস্ত কাজ করব না । যদ্দুর মনে হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর উৎপল দুজনেই লিখে দিয়েছিল আমরা এসব করব না । 

প্র: শক্তি তো বিপক্ষে সাক্ষ্যও দিয়েছিলেন—

উ: হ্যাঁ–

প্র: আরও একটা ব্যাপার আছে। সুনীলবাবু যে আইওয়া থেকে চিঠি লিখেছিলেন মলয়কে যে —তোমরা এই আন্দোলন-টান্দোলন করো, কাছে থাকলে একটা থাপ্পড় দিতাম । আবার সেই সুনীলই মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছেন — এটা কীরকম ব্যাপার ?

উ: সুনীলের এটা দ্বিচারিতা….

প্র: হাংরি আন্দোলন ১৯৬৫ সালে শেষ হয়ে যাবার পর সমীরদা পোস্টমডার্ন, অধুনান্তিকতা ইত্যাদি নিয়ে কাজকর্ম শুরু করেছেন । সেই নিয়ে আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।

উ: মানে সিরিয়াস সাহিত্যের কাজ, হাংরি আন্দোলন ছেড়ে দিয়ে…? সেই সময় সমীর আর শান্তি লাহিড়ী মেঘমল্লারে এসে, মদ্যপ অবস্হায়, ট্যাকজসি করে এসে এক কপি হাওয়া৪৯ দিয়ে বললেন, এটাতে আপনি লিখুন। আমি লেখা দিয়েছিলাম কিনা মনে নেই । সম্ভবত কখনো দিইনি। একদিনই এসেছিল, তারপর যোগাযোগ করেনি । তখনই জানতে পারলাম যে সমীর সিরিয়াস সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে । হাংরি আন্দোলন তখন শেষ, বন্ধ হয়ে গেছে । তারপরই তো নকশাল এসে গেল, ব্যাপারটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল । সমীর যখন সিরিয়াস কাজকর্মে যুক্ত হল, তখন ওর সঙ্গে আমার সাহিত্য সভা-টভায় দেখা হতো । ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল একটা ব্যাপারে, সেটা হচ্ছে — সুনীলের যখন আইওয়া যাবার কথা হচ্ছে, তখন একটা বই বেরিয়েছিল Blue Hand, ডেবোরা বেকার বলে এক মহিলার লেখা, তিনি হলেন অমিতাভ ঘোষের মেম স্ত্রী – বইটি অ্যালেন গিন্সবার্গের জীবনী। বইটি লেখার জন্য লেখিকা আমার কাছে এসেছিলেন তথ্য যোগাড় জরতে। আমি সাহায্য করেছিলাম বলে বইটি যেদিন বের হয় সেদিন আমাকে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল—টাউন হলে অনুষ্ঠান হয়েছিল । বইটার এক কপি দিয়েছিল। সেই লেখায় আমি পড়লাম যে হাংরি জেনারেশনের ব্যাপারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লাভবান হয়েছে, আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উৎপল । কারণ উৎপলের চাকরিটা চলে যায় । 

প্র: সমীরদারও তো চাকরি চলে যায় । মানে সাসপেণ্ডেড হন ।

উ: হ্যাঁ, তারপর ফিরে পায় । কিন্তু উৎপল এইসব করাতে চাকরি চলে যায় । ওই Blue Hand বইতে লেখা আছে যে, উৎপল আমেরিকাতে অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে যোগাযোগ করে — যে আমার এখন চাকরি নেই, আমি খুব খারাপ অবস্হার মধ্যে আছি, আমায় কিছু একটা ব্যবস্হা করে দাও। তখন গিন্সবার্গ তাকে বলে, তুমি লণ্ডন চলে যাও, ওখানে স্কুলে পড়াবে, আমি ব্যবস্হা করে দিচ্ছি । এবং Blue Hand বইতে লেখা আছে with the help of Allen Ginsberg, Utpalkumar Basu has got a job in London. আমি সেই ঘটনার উল্লেখ করে, শক্তির জন্মদিনে একটা উৎসব হয়েছিল, সেখানে, ওই যে অনুষ্ঠান-টান করে, কী যেন নাম, সে আমাকে নেমন্তন্ন করল যে, আমাকে একটা লেখা দিন —। সেখানে শক্তি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে একটা কথা লিখেছিলাম যে, আইওয়া যাবার প্রস্তাব নিয়ে আসে কলকাতায় প্রথম পল অ্যাঙ্গেল, এবং উদ্দেশ্য ছিল যে, বোহেমিয়ান একজন কবিকে আমন্ত্রণ করবেন, যেমন উনি নানা দেশ থেকে নিয়ে যান —এবং তার জন্য টাকাও এনেছিলেন। ওঁর লক্ষ্য ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায় । শক্তি চট্টোপাধ্যায়কেই উনি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন । কিন্তু বুদ্ধদেব বসু ও সম্প্রদায় বলেছিল, এবং তাতে সুনীলেরও সায় ছিল নিশ্চয়ই, যে, শক্তি যেমন মদ খায় আর মাতলামি করে – সুতরাং ওকে না পাঠিয়ে অন্য কাউকে পাঠানো হোক । সুনীল খুব ভদ্র সুতরাং পত্রপাঠ আইওয়া চলে যায় এবং পরের বছর শঙ্খ ঘোষকে পাঠানো হয় । পরপর দুবছর ওরা যায় এবং শক্তি বাদ পড়ে যায় । সেটা আমি লিখেছিলাম শক্তির জন্মদিনে, ওই লেখাটার মধ্যে । সেটা পড়ে সুনীল আমায় চিঠি লেখে যে, আপনি ওই বইটা পড়ে লিখেছেন যে, There was a rumour, that Shakti Chattopadhyay was the nominated person, but Sunil Gangopadhyay availed the chance. এটা পড়েছেন বোধহয়। সেটা ভালো করে পড়িনি — আসলে রিউমার ছিল বোধহয়–। তারপর লেখে, এ প্রসঙ্গে জানাই এ বছরের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার আপনি পাচ্ছেন — আমাকে পুরস্কারটা পাইয়ে দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করে। সেই চিঠিটাই আমি কয়েক দিন আগে ‘নতুন কৃত্তিবাস-এ দিয়ে দিই, বীজেশ সাহা সেটা ছেপে দিয়েছে । সুনীলের চিঠিটা। ঘটনা হচ্ছে ওরা চেয়েছিল একজন বোহেমিয়ান, এবং সেই অর্থে শক্তি যথেষ্ট বোহেমিয়ান ছিল। কিন্তু সুনীল ছিল ভদ্র, কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর টান ছিল ওর প্রতি, তাতে করে সুনীল নমিনেটেড হয়ে যায়। সুনীল তার অর্ধেক জীবন  বইতে লেখে– ‘অ্যালেন কলকাতা থেকে চলে যাবার পরে সুনীলকে চিঠি লেখে যে, আমাকে নমিনেট করেছে, আমাকে আইওয়া যেতে হবে। আমি প্রস্তুত হলাম এবং চাকরি বাকরি ছেড়ে চলে গেলাম।’ একবছর পর যখন ফিরে আসে তখন চাকরি নেই কিন্তু চাকরি পেয়ে গেল । আনন্দবাজারে আর সবাই যেমন লেখালিখি করে, ওকে একটা পৃষ্ঠা দেওয়া হল, পঞ্চাশ টাকা করে দিত, এক পৃষ্ঠা লেখা— আনন্দবাজারের চাকরি !

প্র: সুনীলের সঙ্গে সমীরের যেমন বন্ধুত্ব ছিল, তেমনি শেষের দিকে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি বা বিরোধও ঘটেছিল। এ সম্পর্কে কিছু শুনেছেন ?

উ: না। একদম জানি না । কী ধরনের বিরোধ ?

প্র: বিরোধ বলতে দীর্ঘ দিন তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল না ।

উ: বোধ হয় দূরত্বের জন্য ।

প্র: না । উনি ব্রহ্মপুর আর ইনি এই গড়িয়াহাট । স্হানিক দূরত্ব তো বেশি নয়, লেখালিখি নিয়ে বা আলাপচারিতায় বা একে অপরের খোঁজ নিতেন না—

উ: সমীরের যে ধরনের সাহিত্যচর্চা, তার সঙ্গে সুনীলের সাহিত্যচর্চায় কোনো মিল নেই। সুনীলের হচ্ছে সামাজিকতা এবং জনপ্রিয় সাহিত্যের দিকে নজর। সমীরের ছিল সিরিয়াস সাহিত্য নিয়ে কথাবার্তা — এবং সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে গবেষণার দিক বিকশিত করা। ওদের মধ্যে মিল থাকার কথা নয়। সমীরের সঙ্গে বহু মানুষের বন্ধুত্ব ছিল, সমীরের সঙ্গে কেন ছিল জানি না। এটা খুব দুঃখের কথা। সুনীলের সঙ্গে শঙ্খবাবুর বন্ধুত্ব হয়েছিল, সমীরের সঙ্গে হয়নি ! যারা যারা নিরপেক্ষ ছিল তাদের সঙ্গে হয়নি ।

প্র: হাওয়া৪৯-এর কোনো লেখা পড়েছেন ? ইদানিং যা যা লেখালিখি তা কি আপনার গোচরে এসেছে ?

উ: বিশেষ কিছু পড়িনি । কয়েকটা সংখ্যা হাওয়া৪৯ পড়েছি, তারপর আমার সঙ্গে কারও যোগাযোগ হয়নি, এবং আমারও তেমন উৎকন্ঠা হয়নি এসব বিষয়ে । আমি আমার নিজের লেখা নিয়ে থাকতাম ।

প্র: একদিন যে সাহিত্যসভায় দেখা হল বললেন ? সেখানে কী কী কথাবার্তা হল ?

উ: ওখানে হাংরি আন্দোলন নিয়ে কথাবার্তা হল । মলয়কে ও নাকি সংযত হবার পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু মলয় সেটা শোনেনি । এরকম বলল, সেটা সত্যি কিনা জানি না, হয়তো হয়ে থাকতে পারে। আসলে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের হিরো হচ্ছে মলয় রায়চৌধুরী। যদি কারও আমেরিকা যাবার কথা হয়ে থাকে তো যাওয়া উচিত ছিল মলয়ের । হাংরি জেনারেশন নিয়ে আমেরিকায় যদি উৎসাহ হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য মলয় যেহেতু নেতৃত্ব দিয়েছিল – মলয়েরই যাওয়া উচিত ছিল। মলয় বড়ো ব্যাঙ্কে চাকরি করত বলে, চাকরি ছেড়ে যেতে চায়নি কিনা জানি না । ওর যাওয়ার কথা উঠেছিল কিনা তাও জানি না । ওরই যাওয়ার কথা, ও-ই ছিল লিডার অব হাংরি জেনারেশন । প্রথম থেকেই। সমীর রায়চৌধুরী নেতৃত্ব দিয়েছিল কিনা জানি না, বড়ো দাদা হিসেবে সঙ্গে থাকা, টাকা-পয়সা দেওয়া — এসব করেছিল। কিন্তু আসল নেতৃত্ব দিয়েছিল মলয়, এ আমি এখনও বলব ।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন