হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরী : সোমনাথ ঘোষ
কবি প্রদীপ চৌধুরীর প্রসঙ্গ উঠলেই পাঠকের মনে যে প্রশ্নগুলি আসে তা হল উনি বাঙালি কবি নাকি ফরাসি কবি, প্রাচ্যের কবি নাকি পাশ্চাত্যের কবি, হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলনের কবি নাকি এক ক্ষয়িষ্ণু সমাজের অন্ধকার ভবিষ্যৎহীন উত্তরাধিকারী হয়ে যাপনের তাড়নাকে ক্রমাগত নিজের কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করতে থাকা এক শিল্পী? বস্তুত কবি প্রদীপ এ ধরণের কোন সংজ্ঞাতেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, কোন একটি দুটি শব্দে বুঝতে সুবিধে হবে ভেবে তাঁকে টাইপকাস্ট করা যায় না। কিন্তু এসব কিছুকে ছাপিয়ে তাঁর যে পরিচয়টি সর্বদা অমর থেকে যাবে তা হল তাঁর জীবন ও যাপনের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে এক কবিতা পাগল সত্তা। প্রদীপের কাছে কবিতা অনেকটা অবসেশনের মত। তাই তিনি অবলীলায় লিখে ফেলেন, "সব পেয়েও যাদের প্রকৃতপক্ষে নিজের কিছুই নয়, 'সর্বহারা' মানুষের চূড়ান্ত আশ্রয়স্থল কবিতা, কবিতা আদিম ও আধুনিক মানুষের যাবতীয় জিজ্ঞাসা ও অন্তর্ঘাতের, শিক্ষিত ও ভুলশিক্ষিত মানুষের চেতনা ও অবচেতনার যাবতীয় সংঘাত-লুপ্তির একমাত্র উপায়। কবিতা "আলটিমেট সিন্থেসিস" ।
কবিতাই মানুষের নির্বাণ ও পরমপুরুষার্থ। কবিতাই সবচেয়ে নিজস্ব, কারণ মানুষ নিজেই এর রচয়িতা। পৃথিবীর যে কোন আধুনিক কবির কাছে কবিতাই শেষ ধর্ম। পৃথিবী -সময়-কবিতা-পাঠক এবং রুচি অভিন্ন ও অবিভাজ্য।”
কবি প্রদীপ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালের বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায়। দেশভাগের পর তাঁর বাবা প্রথমে কলকাতায় এবং পরে ত্রিপুরায় কর্মসূত্রে বসবাস শুরু করেন। প্রদীপের স্কুলজীবন ত্রিপুরাতেই কাটে। ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর স্তরে দর্শন পড়ার জন্য প্রদীপ বিশ্বভারতীতে ভর্তি হন। প্রদীপের লেখালেখি শুরু অবশ্য ১৯৬১ সাল থেকেই। ১৮ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবি হিসেবে ছাত্রমহলে পরিচিতি থাকার কারণে বিশ্বভারতীর 'সাহিত্যিকা' পত্রিকার সচিব হন প্রদীপ। এর পাশাপাশি ‘স্বকাল’ নামে নিজস্ব একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন প্রদীপ। এই পত্রিকাটি দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন তিনি, যদিও পরের দিকে এর নাম হয় 'স্বকাল/ফুঃ (Pphoo)' এবং একদম শেষে ‘ফুঃ/Pphoo’। এটি একটি ত্রিভাষিক পত্রিকা ছিল যেখানে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ও ফরাসী ভাষাতেও কবিতা ছাপা হত।
কলেজজীবনের সময় থেকেই প্রদীপ হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রদীপকে হাংরি আন্দোলনের সাথে পরিচয় করান। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৯৬১ সালে পাটনা থেকে প্রথম ম্যানিফেস্টো প্রকাশের মাধ্যমে। আন্দোলনের মূল স্রষ্টা ছিলেন কবি-সাহিত্যিক মলয় রায়চৌধুরী। কবিতা সম্পর্কে হাংরিদের বক্তব্য ছিল, “…it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzling of the hymning five, a sowing of the tempestual hunger.”।
হাংরিরা মনে করতেন পঞ্চাশের দশক অবধি বাংলা কবিতায় যে স্থিতাবস্থা চলে আসছে, কবিতার ভাষাকে সেই স্থিতাবস্থার শেকল ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে। একইসাথে স্বাধীনতা পরবর্তী উত্তর ঔপনিবেশিক ভারতে এবং বিশেষ করে দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতা ও কায়েমি স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষের যে স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে হাংরিদের আন্দোলন সেসবের প্রতিই এক কাউন্টার ডিসকোর্স। তাই প্রদীপ চৌধুরী লিখছেন,"আমি কোন জেনারেশনের নই- আধুনিক পৃথিবী এবং পৃথিবীর যাবতীয় জেনারেশন- প্রকৃতপক্ষে অধঃপতিত নষ্ট সর্বহারা ভীরু উন্মাদ নির্বাক চোর অন্ধ সন্ন্যাসী কমরেড অভিযাত্রী নষ্টদেহ যক্ষাক্রান্ত শুধুই-লাশ, স্থাবর অস্থাবর প্রাণিজগতের সকলের শিরা-উপশিরার চেতন-অচেতন অবসেস্ড আত্মার এক অলৌকিক সামগ্রিকতার আমি এক খুবই ছোট অথবা অতিশয় বিশাল প্রতিবিম্ব মাত্র।"হাংরি সাহিত্যিকদের লেখাতে যে ভাষাপ্রয়োগ আমরা দেখি তা সেই সময়ের নিরিখে ছিল অভিনব। বস্তুত কবিতা- সাহিত্যে অন্ত্যজ মানুষের কথা ও ভাষা প্রয়োগ ষাটের দশকে হাংরিরাই প্রথম করে। এর একটি কারণ যেমন প্রচলিত সিস্টেমের প্রতি বিদ্রোহ এবং একটি কাউন্টার ডিসকোর্স তৈরির চেষ্টা যাকে হাংরিরা বলেন "প্রতিস্পর্ধার আন্দোলন'', আরেকটি কারণ অবশ্যই অধিকাংশ হাংরি সাহিত্যিকদের নিম্নবিত্ত শ্রেণী থেকে উঠে আসা এবং নিজেদের পারিপার্শ্বিকের ভাষা ও অভিজ্ঞতা সাহিত্যে ব্যবহারের প্রচেষ্টা। মলয় রায়চৌধুরী লিখছেন, “….আমি পাটনায় ইমলিতলা নামে এক অন্ত্যজ অধ্যুষিত বস্তি-এলাকায় থাকতুম, অবনী ধর ছিলেন জাহাজের খালাসি আর পরে ক্রেন-ড্রেজার-ডাম্পার অপারেটার, লরি-ট্যাকসি-প্রায়ভেট মোটরগাড়িচালক, রেলওয়ে ক্যাটারিঙের বেয়ারা, কোককয়লাফেরি, ঠোঙা ও প্যাকেট তৈরি, পোস্টার-ফেস্টুন লেখা ইত্যাদি, অসংগঠিত শ্রমিকের জন্য যে-ধরণের কাজ পাওয়া যায় সবই করেছিলেন। সমীরণ ঘোষ ছিলেন ডাকপিওন, প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ এসেছিলেন উদ্বাস্তু পরিবার থেকে, দেবী রায় চায়ের ঠেকে চা বিলি করতেন, শম্ভু রক্ষিত নিজের গ্রামে চাষবাস করতেন, নিজেই প্রেসে গিয়ে কমপোজ করতেন, সুবিমল বসাকের শৈশবে পরিবারকে পথে বসিয়ে তাঁর বাবা দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেন, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় হিন্দি পত্রিকার মলাট এঁকে রোজগার করতেন, ফালগুনী রায় কিছুই করতেন না।”
এই বিকল্প সাহিত্য আন্দোলন নিয়ে সেযুগে বিস্তর বিতর্ক হয়। হাংরিদের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে এবং তাঁরা একাধিক পুলিশ কেসের সম্মুখীন হন। সে কালে কবিতায় নিম্নবর্গের ভাষা ও অবাধ যৌনশব্দের যথেচ্ছ প্রয়োগ ভাবাই যেত না এবং এ বিষয়ে হাংরিরাই পথিকৃৎ ছিলেন। মলয় রায়চৌধুরীর লেখা কবিতা 'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' এখন একটি কাল্ট হাংরি কবিতা মানা হলেও সে যুগে এটি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয় এবং মলয় গ্রেপ্তার হন। প্রদীপ বিশ্বভারতীর সহপাঠিনীর নাম উল্লেখ করে প্রেমের কবিতা (যা বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষের ভাষায় "অর্ধ-অশ্লীল" ছিল) লেখার জন্য বিশ্বভারতী থেকে বহিস্কৃত হন এবং বুদ্ধদেব বসুর তৎপরতায় যাদবপুরে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হন। হাংরি বুলেটিন ছাপানোর কারণে প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয় এবং প্রদীপ ত্রিপুরা চলে গেলে পুলিশ সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। প্রায় মাসখানেক জেল হেফাজতে থাকার পর প্রদীপ ছাড়া পান।
এই উথালপাতাল সময়ে প্রদীপ দুটি কাব্যগ্রন্থ লিখে ফেলেছিলেন, যথাক্রমে 'অন্যান্য তৎপরতা ও আমি' (১৯৬৪) ও 'চর্মরোগ' (১৯৬৫)। প্রদীপ লিখছেন,"ননসেন্স, একি খাপছাড়া স্বভাব হয়ে উঠছে আমার! বোধ হয় এখনও শরীর থেকে কবিতার বদগন্ধ নিঃশেষ হয়ে যায় নি, কেননা তাহলে, মাঝে মাঝে এমন বিষন্নতা আমাকে জোর করে ফেলতো না, অমরতা নয়, এমন কি selfabnigation ছাই হয়ে যেত, হয়ত বড় বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেললাম ভাগ্যকে, তা কি ভাগ্য, না অশরীরী অধঃপতন? সংখ্যাহীন ভাবে এসব হিসেবে ঘটে যায়, আমাকে চালিয়ে যেতে হবে, স্মরণশক্তির পাছায় আত্মগোপন করে যেসব মুখ আমাকে ক্ষীণতম বর্ণমালার দিকে ঠেলছে, যে কোন উপায়ে তাদের মুখ একত্র করতে হবে, খোলা তর্জনী ব্যবহার করে দিব্য-দৃষ্টি নষ্ট করে দিতে হবে, দুর্গন্ধ ও পিচুটির ভয় উপেক্ষা করেই" (অন্যান্য তৎপরতা ও আমি)। এই বইয়েরই আরেকটি অংশ তুলে দিচ্ছি, "কোলকাতা যেন এক বিরাট আতঙ্কের কারখানা, ধর্মে ও যৌনমিলনে সমান আতঙ্ক- আমার চারদিকে উদ্ধারহীন ভীড়, যন্ত্রচালিত যানবাহন, ব্যাধিলিপ্ত মানুষের মুখ- আমার খেয়াল হচ্ছে না, একা এই শহর ক'হাজার কোলকাতা আত্মসাৎ করছে। ধ্বংস বলব একে? একে সৌন্দর্য বলব?? লীনা, লীনা আমি কি তোমাকে কোনদিন সুন্দর বলে তোমার স্কার্ট খাবলে ধরেছিলাম- তোমার যোনিতে আমার ১০০০০০০ দাঁত বসে গাছে, তোমার শেষ নিসংগতা আমার মাড়িতে লেগে আছে- লীনা আমি বুঝতে পারছি না, কোথায় গেল তোমার পুরুষরা- এমন অতিনাটকীয় ভাবে মাঝে মাঝে গঙ্গায় চন্দ্রালোক প্রতিফলিত হয়, ঐ পার থেকে আমাকে এখানে নিয়ে আসারই বা কি মানে হতে পারে? লাইট হাউসের চূড়ায় মেরিলিন মনরোর পাথরের চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আমি জানি কোন দূর বিদেশে গিয়েও তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। তুমি জানোনা মৃত্যু কি! "ছাই অতীত. লীনা, এত রাতে তুমি ওদের দেহ দিচ্ছ কেন???""
প্রসঙ্গত প্রদীপের এই লেখাগুলি প্রধানত তাঁর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন লেখা। সেসময় প্রদীপের কবি সুবো আচার্যর সাথে পরিচয় হয় এবং দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব জন্মায়। দুই বন্ধুর নিয়ম না মানা পাগলাটে জীবনযাপন প্রসঙ্গে প্রদীপ বলেছিলেন, “a symbolic protest against the academic and self-serving middle class”। খালাসিটোলায় মদ খাওয়া, বিভিন্ন বেশ্যালয়ে ঘুরে বেড়ানো, রেলওয়ে স্টেশনে, ফাঁকা ট্রেনে, ফুটপাথে শুয়ে রাত কাটানো, হিপিদের মতো উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপনের অনুষঙ্গ তাঁর প্রথম বই 'অন্যান্য তৎপরতা ও আমি'তে প্রচ্ছন্ন ভাবে এসেছে। জীবনের হতাশা, যন্ত্রণা ও উদ্দেশ্যহীনতাকে প্রদীপ একেবারে সামনে থেকে উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন এবং সেটিই তাঁর লেখাতে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই প্রদীপ নিজের রচনাকে চিরকাল আত্মজৈবনিক বলে এসেছেন। তিনি লিখছেন, "অস্বীকারের ভেতর সভ্যতা স্থির পরিণামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আমি বলছি, পরিণামের, অর্থাৎ ধ্বংসের দিকে। আমি করিডর থেকে করিডরে ছুটেছি উন্মত্ত, ছাদে ও কার্নিশে ঝুলে থাকতে দেখেছি পুরুষানুক্রমিক মাকড়সা, অনবরত হলুদ জাল তৈরী করছে, আমি ওইসব লতার মধ্যে ঝুলে থাকতে চেয়েছি, বছরের পর বছর, আমার সর্ব শরীরে জান্তব অনুশোচনা, ব্যথা।" (অন্যান্য তৎপরতা ও আমি)। হাংরিদের বিরুদ্ধে ওঠা অশ্লীলতার অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রদীপের তীব্র প্রতিবাদ ছিল। কল্লোল ও কৃত্তিবাস পেরিয়ে এসে ষাটের দশকের এই হাংরি সাহিত্য যেন তাদের পূর্বসূরিদের থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন। বীট জেনারেশনের লেখকদের দ্বারা অনেকাংশেই প্রভাবিত হাংরি সাহিত্যিকরা। অ্যালেন গিন্সবার্গ, জ্যাক কেরুয়াক এদের প্রিয় লেখক ছিলেন। বীটদের কাউন্টার কালচার, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, যৌন লিবেরেশনের কনসেপ্ট হাংরিদের আকর্ষিত করে। (প্রসঙ্গত কেরুয়াক প্রদীপের খুবই প্রিয় লেখক ছিলেন, যদিও প্রদীপ ব্যক্তিগতভাবে বীটদের খুব বড় অনুরাগী ছিলেন না)। হাংরিরা মনে করতেন যৌনতা নিজেই একটি ভাষা। কবিতা সাহিত্যে অবাধ যৌন অনুষঙ্গ হাংরিদের কাছে আবেগের সৎ বহিঃপ্রকাশেরই নামান্তর। তাই অশ্লীলতার অভিযোগ সম্পর্কে প্রদীপ লিখছেন, "...বিশেষ শব্দ বা বিশেষ ঘটনাকে প্রাধান্য দেবার পেছনে একধরণের উদ্দেশ্যপ্রবণতা রয়ে গেছে- এই উদ্দেশ্য-প্রবণতা কবিতা ও জীবন উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকারক। এ ধরণের খণ্ডচেতনা থেকেই কবিতায় বিভিন্ন পরিষদ, একাডেমী ও এস্টাব্লিশমেন্ট সৃষ্টি হয়। জীবন এভাবেই দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। মানুষের মধ্যে শ্রেণী সংঘর্ষ শুরু হয়।"
যাদবপুরে পড়াকালীন প্রদীপের ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। এরপর তিনি হায়দরাবাদে ‘Central Institute of English and Foreign Languages’ (বর্তমান নাম: English and Foreign Languages University) এ ফরাসি ভাষা শেখেন। ফরাসি ভাষার প্রতি ওনার এতই তীব্র আকর্ষণ জন্মায় যে পরবর্তীকালে বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি প্রদীপ ফরাসি ভাষাতেও কবিতা লেখা শুরু করেন। কলেজ জীবনেই প্রদীপ আকৃষ্ট হন ফরাসি কবি আর্তুর র্যাঁবোর প্রতি। ফরাসি কবি লোত্রেয়ামোঁর লেখাও প্রদীপকে প্রভাবিত করে। প্রদীপের কথায়, " লোত্রেয়ামোঁর মধ্যে আমি শুনতে পেয়েছি সমুদ্র বিষয়ে তাঁর আবেগমথিত চিৎকার, আমার লেখায় আমি তা ধরে রাখতে চেয়েছি।" লোত্রেয়ামোঁর বিখ্যাত পোয়েটিক নভেল বা গদ্য-কবিতা (prose poem) ‘Les Chants de Maldoror’ প্রদীপের অন্যান্য তৎপরতা ও আমি এবং চর্মরোগের বিষয় ও রচনাশৈলীকে প্রভাবিত করে। বস্তুত এ ধরণের গদ্য কবিতা তখনও মূলধারার বাংলা সাহিত্যে অপ্রচলিত ছিল। এ বিষয়ে প্রদীপের একদা হাংরি সতীর্থ কবি শৈলেশ্বর ঘোষ লিখেছিলেন, "কবিতা বা কবিতা নয় এসব কূটতর্ক আমাদের নয় কারণ কবিতা বলতে আমরা বুঝি আত্মার এক বিশেষ অবস্থার প্রকাশ।"
১৯৬৫-৬৬ সালের পর প্রদীপ আর হাংরি আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকেননি। বস্তুত এত পুলিশি ঝামেলার জন্য হাংরি আন্দোলনের আর সেভাবে কোন অস্তিত্ব থাকে না। হাংরি বুলেটিনও আর বেরোয় না এবং হাংরি সাহিত্যিকদের একে ওপরের সাথে যোগাযোগও কমে যায়। প্রদীপ নিজেও বিভিন্ন কারণের জন্য হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহ হারান, যদিও নিজের জীবনে এই সাহিত্য আন্দোলনের গুরুত্বকে তিনি কোনদিন অস্বীকার করেননি। পরবর্তীকালে তাঁকে হাংরি কবি হিসেবে টাইপকাস্ট করা হোক তিনি তা চাইতেন না। প্রদীপ মনে করতেন কোন আন্দোলন দীর্ঘকাল চললে তা প্রথমে রেজিমেন্টেশন এবং পরে এক নতুন এস্টাব্লিশমেন্টের জন্ম দেয়। ১৯৭০ সালে লেখা 'কবিতাধর্ম' একজন প্রকৃত কবি হিসেবে প্রদীপের আত্মকথনের ফসল। প্রদীপকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে গেলে আগ্রহী পাঠকের এই বইটি অবশ্যই পড়া উচিত। প্রদীপ লিখছেন, "যে কোন প্রকৃত লেখকই স্বয়ংসম্পূর্ণ, আমি বলতে চাই। একজন গোটা লেখকের বাইরে আমি কোন খন্ড আদর্শ বা জেনারেশনে বিশ্বাস করি না। আমি হাংরি জেনারেশনে বিশ্বাস করি না……….. হাংরি জেনারেশন নয়, যে কোন জেনারেশন বা দলীয় অভিধা, যেমন কল্লোলগোষ্ঠী, কৃত্তিবাসগোষ্ঠী- এ সবের দ্বারা কিছু কাগজ ও লেখকের নাম বোঝায় শুধু- লেখালেখির পয়েন্ট বিচার করার সময় সকলকে একসূত্রে বেঁধে দেখা ঠিক নয়, আলাদা আলাদা ভাবে দেখা উচিত।" প্রদীপের ১৯৭১ সালে প্রকাশিত '৬৪ ভূতের খেয়া' কাব্যগ্রন্থে কিন্তু আমরা হাংরি জেনারেশনের প্রভাব স্পষ্টই দেখতে পাই। আগের লেখাগুলিতে জীবনের প্রতি যে অসহায়তা, কাতরতা এবং এক দমবন্ধ পাগলামি পাঠককে অস্থির করে তোলে, তার ছাপ যেন ‘৬৪ ভূতের খেয়াতেও’ রয়ে গিয়েছে। এই বইয়ের দুটি কবিতার কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করছি:
“গোটা যৌন জেনারেশন ছাই বাতাসে ভাসছে
আমার তলপেটে আবার সেই বিষাক্ত ক্ষুধা
শিকড় মেলে ধরছে
আমি লাঠি মারতে গেলে জীবন দুলে ওঠে
শেয়ালদার শৌচাগারের মত আমি সভ্যতা
ব্যবহার করেছি এবং
জীবন আমাকে
বারবার প্রাণহীন শিশুপ্রিথিবীর দিকে ঠেলে দিচ্ছে
পুলিশ ও পেচ্ছাপ
একই সঙ্গে ডেকে ওঠে সভ্যতার বিপদদের বাঁশি
ও নারীর উরু ফাঁক হয়ে যায়. যান্ত্রিক নিয়মে
ব্যবহার......
কে কাকে ব্যবহার করে?
ঈশ্বর? সম্পর্ক? নাকি স্ত্রীযোনির অতিরিক্ত লালা?”
(‘প্রসূতিসদন’)
“পিতার মতো ক্রুর, জন্মের চেয়ে কালো, কালো রাত
আজ প্রেমিকের রাত ফুঁসছে
ডিয়ার ডিয়ার
অন্ধ বারান্দায় আজ ফুলে উঠছে বালিকার পেট
ডিয়ার ডিয়ার
একই হত্যা, শূন্যতা অথবা শ্মশান থেকে
আরেক জনের জন্যে অলৌকিক ভাবে জেগে ওঠা?
ডিয়ার ডিয়ার
আমার এ জন্মের শেষ নাস্তিকতা তুমি
ঈশ্বর পরিষ্কার কর আমার নিঃশ্বাস
ঈশ্বর আমার মুখ থেকে চোয়াল খুলে নাও
বিধবার রাত্রির মতো দীর্ঘ ও শূন্য করে দাও আমার আত্মা
চোখের জলের মতো তরল করো আমার শরীর
আমার শরীর বৃষ্টির মতো
ভিজিয়ে ভিজিয়ে নষ্ট করে দাও
ডিয়ার ডিয়ার”
(‘ডিয়ার ডিয়ার’)
কবিতাগুলি পড়লে মনে হয় যে জীবন যেন প্রদীপের কাছে হতাশা ও যন্ত্রণার উৎস। তাঁর কবিতায় জীবন যেন লোত্রেয়ামোঁর 'ম্যালডরোর' হয়ে প্রদীপের বুক চিরে রক্ত পান করে, আর প্রদীপ যেন এই জীবনযন্ত্রণায় গোঙাতে থাকেন, সেই অস্ফুট স্বর বেরিয়ে আসে তাঁর কবিতার মাধ্যমে। তাঁর কবিতায় এত যন্ত্রণা কেন? কেনই বা জীবনের প্রতি এমন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি? ফরাসি কবি দেনিস এমোরিনকে দেওয়া স্বাক্ষাৎকারে প্রদীপ বলছেন, "অর্থলিপ্সা, খাদ্যলিপ্সা ও ক্ষমতালিপ্সা প্রায়শই গিলে খায় বন্ধুতা....কবিদের জাগ্রত চেতনার কাছে পৃথিবীর এই অদ্ভুত পদ্ধতি, এটা কি সত্যিই এক চূড়ান্ত হতাশা নয়? অধিকাংশ মানুষই যন্ত্রণার সূতিকাগার এই বিশাল হতাশা, সভ্য মানুষের এই অবিশ্বাস্য পাগলামো।" প্রকৃতপক্ষে প্রদীপের কবিতা যেন অন্তঃসারশূন্য এক সভ্যতায় এক মানুষের বেঁচে থাকার কষ্টের গোঙানি। প্রদীপ বলতেন আধুনিক সভ্যতা যেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক বিপ্লব, তাই তাঁর কবিতা সেই সভ্যতার অমরত্বের অন্ধ অহংকারের বিরুদ্ধে যেন এক প্রতিবিপ্লব হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই ‘প্রতিবিপ্লব দীর্ঘজীবী’ হয় না, কারণ সভ্যতা নামক সিস্টেমের কাছে ব্যক্তি মানুষ নিতান্তই অসহায়। এই অসহায়তার মধ্যে বেঁচে থাকার কষ্টের যে গোঙানি, তাই যেন প্রদীপের এই সময়ের কবিতার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। তাঁর কাব্যজীবনের প্রথম পর্বের কবিতাগুলির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে সমস্ত জাগতিক বিষণ্ণতা ও অস্থিরতার কেন্দ্রস্থলে নিজেকে নিয়ে যাওয়া এবং তা থেকে মুক্তি না পাওয়ার হাহাকার। ম্যালডরোরের সাথে লোত্রেয়ামোঁর বিভেদ যেভাবে লেখাতে হঠাৎ হঠাৎ মুছে যায়, মনে হয় নিজের অজ্ঞাতসারে লোত্রেয়ামোঁ যেন নিজেই ম্যালডরোরের মতো বীভৎস ও ভয়ানক হয়ে ওঠেন। লেখক ও তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের সাবেকি সীমানা যেন নিমেষে মিলিয়ে যায়। মনে হয় ম্যালডরোর যেন লোত্রেয়ামোর অল্টার-ইগো, তাঁরই জীবন-যন্ত্রণার প্রতীক। র্যাঁবো লিখছেন, “I called on firing squads in order to bite the butts of their guns while dying. I called for plagues in order to gag myself on blood, on sand. Disaster was my god. I wallowed in the gutter. I dried myself in the criminal breeze. And I played some fine tricks madly, passionately.”।
এই ডিপ্রেশন, এবং তাঁর থেকে উদ্ভুত বিকার প্রথম পর্বের প্রদীপের মধ্যেও নিহিত। জীবন এবং জীবন-যন্ত্রণাকে তিনি যেন আলাদা করতে পারেন না, জীবনের প্রতি তাঁর কোন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই, আছে শুধু বিভ্রান্তের বিহবল আত্মক্লেশ: "আমি আমার সব অসম্পূর্ণতার কথা বুঝতে পারি, গলির ভেতর এই নামহীন কোলাহল, সমস্ত চাপ আমার শরীরে ভর করেছে, প্রত্যেক দেয়ালে নিস্তেজ চুন-সুরকি, আমার চোখের সামনেই এই পতন ঘটে গেল,আমি জানতাম নিসর্গের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কি পাশবিকভাবে আমি পাৎলুন ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছি, আমি আমার ঘিলু বদল করতে চাই, কিংবা উপরে ফেলতে, পশু-পাখী, পাখীর ডিম ও আগুনের হালকার উপর আমার এই নির্বিকার প্রভূত্ব, বেকার বেকার-"।
প্রদীপের পরবর্তী সময়ের বাংলা কাব্যগ্রন্থগুলি 'কালো গর্ত' (১৯৮৩) ও 'রাত্রি' (২০০০)। ষাটের দশকের শেষ থেকে অবশ্য প্রদীপ ইংরেজি ও ফরাসি ভাষাতেও চুটিয়ে কবিতা লিখছেন। ফ্রান্স, কানাডার পত্র-পত্রিকাতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। কবি হিসেবে বিভিন্ন আমন্ত্রণে তিনি প্যারিস একাধিকবার ভ্রমণ করেছেন। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিকদের সাথে তাঁর বন্ধুত্বও হয়। তাঁর সম্পাদিত ত্রিভাষিক পত্রিকা ‘Pphoo’ তে একাধিক বিদেশী কবি-সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশিত হয়, যেমন জর্জ ডাউডেন, ক্লদ পেল্যু, ইউসুকে কেইদা, নাদিয়া সেলা-পপ এবং আরো অনেকে। প্রদীপের বন্ধু ফরাসি লেখক হ্যারি রুডলফ উইলকিন্সের স্ত্রী ব্যালেরিনা প্রদীপের কালো গর্ত কাব্যগ্রন্থের কবিতা 'গ্রহণ' কোরিওগ্রাফ করে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শন করেন।
প্রদীপের কাব্যজীবনের প্রথম পর্বের কবিতাগুলি যদি এক চূড়ান্ত অস্থিরতাকে ব্যক্ত করে, তাঁর দ্বিতীয় পর্বে তিনি কবি হিসেবে অনেক পরিণত। ভাষা ও বিষয়ের বৈচিত্রের যে অভাব তাঁর প্রথম পর্বের কবিতাগুলির ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়, দ্বিতীয় পর্বে তিনি তা অনেকাংশেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। এর প্রধান কারণ সম্ভবত নিজের লেখনীকে হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলনের প্রভাবমুক্ত করতে পারা। তিনি সার্থক লিখেছেন, "আমি এককভাবে বাধার পাহাড়গুলিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে রচনা করেছি আমার কালো গর্ত। সৃষ্টির ঐ কালো গর্তে প্রতিষ্ঠানের কোন স্থান নেই। 'প্রতিষ্ঠান-বিরোধীতা' নামক প্রতিষ্ঠানেরও স্থান নেই।" ‘কালো গর্তের’ কবিতাগুলি যেন তাঁর নিজের জীবনকে ফিরে দেখা। জীবনের বিষাদ তাঁকে অস্থির করলেও তিনি জানেন নির্মম নিয়তিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কবি জানেন যে বিষাদময়তার পারে স্বাভাবিক পৃথিবী মানুষের মননে, স্বপ্নে "শান্ত শুয়ে আছে"। তাই তিনি বলেন, "আমার কবিতায় পুরোপুরি একীভূত হয়ে গেছে জীবন এবং অযুত স্বপ্ন; আবেগ; আমার কবি চরিত্র এবং কালো হাসাহাসি।" তাঁর 'দুই অধ্যায়' কবিতাটি ('কালো গর্ত' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত) যেন তাঁর কবিজীবনের দ্বিতীয় পর্বের রূপক। কবিতাটির কিছু অংশ নিচে উল্লেখ করা হল:
“লোহিত সাগরের বুক চিরে সূর্য ওঠে
এবং কিছু দরকারি উত্তাপ রেখে ডুবে যায়।
কেউ আমার আত্মায় হুমড়ি খেয়ে পরে না,
আমার বুকে একবারও চেপে ধরেনি
প্রসাধনহীন প্রেমিকা তার বুক,
কোথায় পূনর্মিলনের প্রতিশ্রুতি?
হৃদপিন্ডে কমপিউটারের
শ্বাস-প্রশ্বাসে হিমশিম খাই-
কখনো ডাক্তার, কখনো মেয়েছেলের
কাছে ছুটি গাঁড়লের মতো
অনুমোদিত একটি বড়ি, একটি নির্ভুল গুলির শব্দ, ভালবাসা
বর্ণাঢ্য করে তোলে জীবনের
২য় অধ্যায়।”
('দুই অধ্যায়’)
কবিতা লেখা তাঁর কাছে বিধ্বংসী ব্যাপার হলেও তিনি এখন জীবনের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন, যেখানে জীবন মানে শুধুমাত্র বিষণ্ণতা নয়, বরং তিনি "জীবনের অভ্রান্ত সত্যগুলিকে তীব্র আবেগে অনুসরণ করে যান"। প্রদীপ লিখছেন, "আমার চলাফেরা ক্রমে যতই সংকুচিত হয়ে আসছে, আমার রচনায় জীবনকে অতিক্রম করে নতুন জীবনে যাবার আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে উঠছে। এবার আর শুধু শহর ও সমুদ্র নয়, অস্থির আকাশের শৃঙ্গগুলিও আমার আন্দোলনের আওতায় এসে গেছে। কেবল রাত্রি গাঢ় অন্ধকারই আমার অরাজক কল্পনার ঢেউ, তীব্রতা, 'আন্দোলনকে' আড়াল করে রাখতে।" তাই কবি লিখছেন:
“একটি একটি শব্দের পাথর সরিয়ে
তিরিশ বছর ধরে আমি এই
শ্রোতপথ তৈরী করেছি-
আমার কবিতা।
এই গোপন সুড়ঙ্গ পথে রাত্রি ফিরে এসেছে
আমার বুকে।
তার নক্ষত্রখচিত জামাকাপড়গুলি
এখনো আকাশে জ্বলজ্বল করছে।
আকাশের নীচে মানুষ
পুরুষ মানুষের নীচে শুয়ে আছে তৃপ্ত মেয়ে মানুষ।
উত্তেজনার পর সাবলীল রেতঃপাত
এই সত্য। এই আমার কবিতা।”
('রাত্রি' কাব্যগ্রন্থের 'কবিতা' নামক কবিতার কিছু অংশ)
পেলবতা বা নমনীয়তা কোনোদিনই তাঁর কবিতার চরিত্র ছিল না। পাঠক তাঁর কবিতায় সেসব খুঁজতে গেলে ধৈর্য হারাবেন। তাঁর কবিতার ভাষা অনেকাংশেই আগ্রাসী। পেলব ছন্দময়তা তিনি যেন জেনেবুঝে ভাংচুর করেন। তিনি তাঁর লেখায় এমন শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন যা পাঠককে কাব্যের সাবেকি প্রশান্তি প্রদান না করে সজোরে ধাক্কা দেবে। তাই তিনি লেখেন,
"জীবনের দ্বিতীয় ভাগে রহস্যময় স্বপ্ন।/ সাময়িক বিভ্রান্তি। নারীর শরীরে/ কল্পনার একপাটি দাঁত- একি!..../প্রতিটি মানুষী সম্পর্কে এই স্বাভাবিক চক্রান্ত।/ শরীরে মিউকাস বাড়ে।" ('দূর প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আছে জয়িতা': ‘কালো গর্ত’ কাব্যগ্রন্থ)। তাঁর কবিতার নামগুলিও তাই হয় অভিনব, যেমন 'মৃত্যু প্রণালী বিষয়ে আপনি কি বলেন, 'কসমস বনাম আমি', 'আততায়ী ও ডালিয়া', 'আমার নখের নিচে কর্কটের বিষ' অথবা 'রক্তের ভেতর ঢুকে পড়েছে কালো হাত'। পঞ্চাশোর্ধ প্রদীপের লেখা ‘রাত্রি’ কাব্যগ্রন্থে অবশ্য কবি যেন নিজের সত্তাকে পুনরাবিষ্কার করতে চান। "আমি আবার সেই কেন্দ্রবিন্দুর দিকে অবরোধ প্রকৃয়ায় ফিরে যেতে চাই যেখান থেকে এই অলৌকিক জীবন শুরু হয়েছিল।..... স্মৃতি-বিস্মৃতিসহ কবিতাবৃত্তের কেন্দ্রে চলে যেতে আমার বাধা কোথায়।" পৃথিবীর অস্থিরতা তাঁকে আর উদ্ভ্রান্ত করে না কারণ তিনি জানেন, "মানুষকে শান্ত হতে দেবে না - এই প্রক্ষোভ / একদিন আততায়ীর ধারণাকে মুছে দেবে-/ আমাদের জন্ম, মৃত্যু, বিবাহহীন মিলন, কর্কটবমন, মৃত্যু..../ জীবন ও মৃত্যুর পাঁচিল ডিঙিয়ে আমরা আরো/ খরস্রোতা নদীর কাছে আরো চলে যাবো।" ('জোয়ার' কবিতার কয়েক লাইন: 'রাত্রি' কাব্যগ্রন্থ)। তিনি প্রকৃত কবি হিসেবে জন্ম মৃত্যুর ওপারের অতীন্দ্রিয়তাকে স্পর্শ করতে চান। 'রাত্রি' কবিতাটি যেন তাঁর এই অনুভূতিরই চারণভূমি। তাঁর লেখা পর্যায়ক্রমে পড়ার পর সবশেষে ‘রাত্রি’ কবিতাটি পড়লে মনে হয় একজন কবির জীবনের বৃত্ত সম্পূর্ণ হল, যখন তিনি অস্থিরতা ও বিষণ্ণতাকে সরিয়ে রেখে এগিয়ে চলেন এক অতীন্দ্রিয় জগতের খোঁজে।
“হত্যা শেষ, এখন চারদিকে বেজে চলেছে
ভোরের সানাই।
কুমারী রাত্রি সুগন্ধি রুমাল হাতে
আমার মুখের সামনে বসে আছে।
তেজস্ক্রিয় আকাশের অনেক নিচে
মুখোমুখি আমি ও রাত্রি। শূন্য ঘর।
আমি রাত্রির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি।
জন্ম মৃত্যুর পরপারে এই আমার পৃথিবী।
এই সত্য
রাত্রি আমাকে ভালোবাসে।
হঠাৎ ছুরিকাঘাতের পর
ভালোবাসা বিনিময় ছাড়া রাত্রির সঙ্গে
আমার কোন কথা হয়না।
আমি কালো গর্তের শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গিয়ে
পুনরায় রাত্রির কাছে আবার ফিরে এসেছি
আরেকটি অস্থির পৃথিবী আমাদের
মিলনের অপেক্ষা করছে। রাত্রি ও আমার।”
('রাত্রি' কবিতার শেষ অংশ: 'রাত্রি' কাব্যগ্রন্থ)
অল্প বয়সে লেখা শুরু করলেও প্রদীপের বই ও লেখার সংখ্যা খুব বেশি নয়। ওনার সাথে ব্যক্তিগত স্তরে পরিচয় থাকার জন্য জানি যে মাঝেমধ্যে উনি লেখালেখি বন্ধ করে দিতেন, বলতেন যে কিছুদিন শুধু পড়াশুনো নিয়ে থাকতে চান। কলকাতার সাহিত্যমহলে নাম করার তেমন বাসনা কোনোদিনই ওনার ছিল না। কিছু মুষ্টিমেয় কবিতাপ্রেমী পাঠক ওনার কবিতা পড়লেই উনি খুশি হতেন। বরং তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল তাঁর লেখা ফরাসি কবিতাগুলি নিয়ে ফ্রান্স বা কানাডায় কিরকম আলোচনা হচ্ছে তাই নিয়ে। মানুষ হিসেবে বেশ খামখেয়ালি ছিলেন, সম্ভবত সেই কারণেই হয়তো লেখার সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে অনেক কম।
প্রদীপের মৃত্যুর পর মলয় রায়চৌধুরীর একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ বাদে নেটমাধ্যমে ওনার উপর তেমন কোন লেখা চোখে পড়ল না। এর কারণ সম্ভবত বাংলার কবিতামহলের এক প্রান্তিক চরিত্র হিসেবেই চিরকাল থেকে গিয়েছেন তিনি। তাই কষ্ট করে তাঁর লেখা অনেকেই পড়েননি। দ্বিতীয় কারণটি তাঁর নামের সঙ্গে "হাংরি কবি" জুড়ে থাকা। একজন কবির জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তাঁকে নিয়ে সব আলোচনা হয়ে যাবে এমন কোন মানে নেই। আশা করা যায় ভবিষ্যতে তাঁকে নিয়ে আলোচনা হলে কোন আন্দোলনের ঘেরাটোপে আটকে না রেখে একজন স্বতন্ত্র কবি হিসেবেই তিনি আলোচিত হবেন। তাঁর ভাষায় বললে, "একজন বিপ্লবীর প্রধান হাতিয়ার/তার বুকের গভীর জ্বর/ একজন কবির জ্বর প্রবাহিত নদী"।
তথ্যসূত্র:
১) প্রদীপ চৌধুরীর রচনা সংকলন (১ম ও ২য় খন্ড)
২) ফুঃ/Pphoo, বিকল্প সাহিত্যের সংকলন, জানুয়ারী ২০০২ (প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত)
৩) https://hungryalist.wordpress.com/2016/09/21/first-manifesto-of-the- hungryalist-movement-published-in-1-november-1961/
৪) হাংরি, ডাডা ও পরাবাস্তব আন্দোলন: মলয় রায়চৌধুরী (https://malayerprobondha.wordpress.com)
৫) প্রদীপ চৌধুরী, ফরাসি কবি, বাঙালি কবি, হাংরি আন্দোলনের কবি: মলয় রায়চৌধুরী (http://bakharganj.blogspot.com)
৬) TSC Interviews| Pradip Choudhuri (http://sunflowercollective.blogspot.com)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন