আপনার conversation পড়লাম। ভালো লাগলো। তবে এর অধিকাংশটাই আগে আপনার কোনো না কোনো লেখায় পড়েছি।
কিন্তু এই লেখাটি লিখছি অন্য একটি কারণে। সেটি হলো শিলিগুড়িতে আমাদের লেখালেখি বা পত্রিকা প্রকাশের বিষয়ে
আপনার উল্লেখের মধ্যে কিছু তথ্যগত ভুল থেকে যাচ্ছে। যেমন আমি ‘ধৃতরাষ্ট্র’ এর সম্পাদক বা প্রকাশক
ছিলাম না। ছিল মনোজ রাউত। আমি একই সঙ্গে একটি স্বল্পকালীন পত্রিকা করেছিলাম। নাম ‘কুরুক্ষেত্র’। আর এসব চলছিল সত্তর দশকের শেষ কয়েকটি বছর ও আশির শুরু পর্যন্ত। ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ শুরু হয় তারপর। আর তা কখনো একা অলোক গোস্বামী করতো না। এটা যৌথ ভাবে করা হতো। তবে মূল কাজটার বোঝা আমার এবং অলোক সহ আরো কয়েকজনের উপর থাকতো। এই বিষয়ে আমার একটি সংক্ষিপ্ত
লেখার অংশ বিশেষ তুলে দিলাম।
কনসেনট্রেশন
ক্যাম্প।
**রাজা সরকার।
----------তখন
১৯৭৭ ,৭৮। এই সময়ে আমি আর সমীরণ ঘোষ একটি ঠিকঠাক লিটল ম্যাগাজিনের সন্ধানে আমরা দুজন খুব উদগ্রীব হয়ে প্রায় প্রতি
সন্ধ্যায় মিলিত হই স্থানীয় কোর্ট মোড় সংলগ্ন গ্রন্থাগারগুলোতে। তার একটি বঙ্গীয়
সাহিত্য পরিষদ এবং অন্যটি তরাই হরসুন্দর--। এই সময়েই একদিন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের
রিডিং টেবিলে একটি শীর্ণ পত্রিকার সন্ধান পাই। নাম ‘ধৃতরাষ্ট্র’। সম্পাদক মনোজ রাউত। ততদিনে অবশ্য ‘পাহাড়তলী’ আর ‘আসমুদ্র হিমাচল’ নামে আরো দুটি পত্রিকার নাম আমরা শুনেছি বা দেখে ফেলেছি।
অচিরেই ‘ধৃতরাষ্ট্র’ সম্পাদক মনোজ রাউত সম্পর্কে খোঁজ খবর করে একদিন তার সঙ্গে
আমাদের পরিচয় পর্ব সাঙ্গ হয়ে গেল। যেন আমরা পরস্পরকে খুঁজছিলাম। সেই পর্ব ছিল
সেদিন বেশ দীর্ঘ এবং শেষ হয়েছিল একটি গোপন পানশালায়।
শিলিগুড়ি শহর তখনও লিটল ম্যাগাজিনের জন্য
শুনশান । ছোট কাগজ বলতে ঐ দু'চারটে যা বের হয়
তা অনেকটা নির্বাক যুগের কথা মনে করিয়ে দেয় । হয়তো তাতে কখনো দু'চারটে ভাল লেখার হদিশও আছে, কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের আধার
সেখানে তৈরি হয়নি । লেখালেখির বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক গাম্ভীর্য তখনো লিটল
ম্যাগাজিনের জন্মের অন্তরায় । ঠিক এই রকম এক আবহে নতুন করে শিলিগুড়িতে একটি লিটল
ম্যাগাজিনের শুরু। নাম "ধৃতরাষ্ট্র"। পাত্র মিত্ররা মনোজ রাউত,সমীরণ ঘোষ,পল্লব কান্তি
রাজগুরু, চন্দন দে ও রাজা সরকার। লেখা ও জীবন খুব কাছাকাছি নিয়ে
আসার প্রচেষ্টার সেই শুরু । শুরু লেখার ভাষা ও স্বভাব চরিত্রের পরিবর্তনেরও । আর তার জন্য ক্রমশঃ যে সামাজিক ঘাত প্রতিঘাতের মুখোমুখি হতে
হচ্ছিলো তা বলা বাহুল্য । কিন্তু দমে যাওয়ার বদলে
ক'বছরের মধ্যেই ব্যাপারটি
আরো সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ওঠে ।
---------এরকম
একটি পরিবেশে একসময় শিলিগুড়ির অন্তত ৬/৭টি লিটল ম্যাগাজিন মিলে একযোগে
একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করা শুরু হয়ে গেল । যার নাম ছিল "কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্প" । সময়টা ১৯৮৩। এটিকে শিলিগুড়ির লিটল
ম্যাগাজিনের দ্বিতীয় পর্ব বলা চলে। । আমাদের সবারই কমবেশি অভিজ্ঞতা বলছিল
ব্যাক্তিগত ভাবে এক দুইজন মিলে একটি কাগজ করার চেয়ে সংঘবদ্ধভাবে একটি লিটল
ম্যাগাজিন কে একটা আন্দোলনমুখী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া অনেক জরুরী। যাতে আমাদের ভাষা ভাবনার আধার হতে পারে পত্রিকাটি।
সক্রিয় লেখকসুচি হলো এরকম-- অলোক গোস্বামী, প্রবীর শীল,রতন নন্দী, কিশোর সাহা,কুশল বাগচি,সুমন্ত ভট্টাচার্য,মলয় মজুমদার, মনোজ রাউ্ সমীরণ ঘোষ, রাজা সরকার সহ আরও অনেকে । শিলিগুড়ি শহরের বইপাড়াটাকেই সকাল বিকেল
আমাদের পত্রিকার চলমান অফিস হিসেবে ধরা হতো। যেখানে আলাপ আলোচনা লেখালেখির নিয়ে
তুমুল তর্ক বিতর্ক চলতো। চলতো পত্রিকা প্রকাশের যাবতীয় পরিশ্রমের কাজ। আশেপাশের
মানুষজন এইসব কান্ড দেখে প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও পরে একসময় মেনে নিয়েছিল।
এই পর্বে আমার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে ষাট দশকের হাংরি
জেনারেশনের লেখকদের । তখন এমন নয় যে হাংরি লেখকরা খুব সক্রিয়। তাদের সক্রিয়তা বা
আন্দোলন অনেক আগেই ১৯৬৪/৬৫তেই স্তিমিত হয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু এটি একটি সাহিত্য
আন্দোলন তার রেশ বা রচনার মৃত্যু ঘটেনি। শিলিগুড়িতে আমাদের মত নতুন
পাঠকের কাছে তা নিঃসন্দেহে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কিন্তু এটা খুবই
আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে প্রায় দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও এই আন্দোলন সম্পর্কে
শিলিগুড়ির লেখা জগৎ তখনও অন্ধকারে। খোঁজ খবর বইপত্র কিছুই পাওয়া যায়না। তার
উপর তখনো অতীতের নানা চাপের ফসল হাংরি লেখকদের উপর দায় হিসেবে রয়ে গেছে ।
পত্রিকা বের হয় না। নিজেরাও তারা তখন অনেকটা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। তবে এদিক ওদিক থেকে
ছিটকে কিছু বই হাতে আসলেও আন্দোলন সম্পর্কে জানার কোন উপায় নেই। আমরা তাদের লেখা
পড়ার প্রথম সুযোগ পাই তখনকার ত্রিপুরাবাসী হাংরি কবি প্রদীপ চৌধুরি সঙ্গে যোগাযোগ
করার পর। তিনি সেখান থেকে তখন কিছুটা নিয়মিত ‘ফুঃ’নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন।তার সঙ্গে
যোগাযোগের মাধ্যমে সন্ধান পাই কবি অরুণেশ ঘোষ এর। তিনি কুচবিহারে থাকেন।
হাংরি আন্দোলনের শরিক না হলেও উত্তরবঙ্গের তিনিই একমাত্র এই আন্দোলনের খোঁজখবর
রাখতেন এবং তাদের শেষদিকের পত্র পত্রিকায় লিখতেন। তবে তখন তিনি খুব নীরব এবং
নিঃসঙ্গ। ইতিমধ্যে তার সম্পর্কে অনেক সত্য মিথ্যা খবর রটানো ছিল। তার মধ্যে একটা
ছিল যে উনি কারোর সঙ্গে দেখা করেন না। কিন্তু লেখালেখি নিয়ে আমাদের ভাষা ও ভাবনার
সন্ধান তখন এতই তীব্র যে খুব দ্রুত আমি একটি সাক্ষাৎকারের জন্য কিছু প্রশ্ন নিয়ে
তার প্রত্যন্ত গ্রাম হাওয়ারগাড়িতে এক দুপুরে গিয়ে হাজির হই। সব রটনা মিথ্যা মনে
হয়। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে আমার কথা
হয়। একসময় আমার লিখিত প্রশ্নাবলীর উত্তর উনি ডাকযোগে আমাকে পাঠিয়েও দেন। যা আমার
সম্পাদিত কাগজ ‘কুরুক্ষেত্রে’র এর শেষ সংখ্যায় ছাপা হয়। তারপর থেকে অনেকদিনই আমাদের সঙ্গে তার সক্রিয় যোগাযোগ
ছিল। এবং পরবর্তী কালে প্রকাশিত ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ এ তার প্রভাবও ছিল।
দ্বিতীয় পর্বের
লিটল ম্যাগাজিন ‘কনসেনট্রেশন
ক্যাম্প’ তখনকার
সময়ে প্রকাশিত কাগজগুলোর মধ্যে ক্রমশঃ উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে।আশি এবং নব্বই এই দুই
দশক জুড়ে এই কাগজটি লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র সম্পর্কে অনেক কথাই বলে। লিটল
ম্যাগাজিন বাজারি বড় কাগজের ছিট কাগজ হিসেবে থাকবে, না কি
একটি পৃথক লেখা ভাবনার উপর নির্ভর করে শুধু সাহিত্য-শখ পুরণের খেলার সামগ্রী
না হয়ে সময়ের দাবী অনুযায়ী একটি ভিন্ন; যাকে তখনকার মত বলা
--প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখার আধার হয়ে উঠবে। আজ আর অস্বীকারের উপায় নেই যে ষাট দশকের
হাংরি লেখকরা ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’এর মাধ্যমেই উত্তরের এই সব অঞ্চলে পরিচিতি পান। কেউ কেউ
এটাকে হাংরি রিভাইভাল বলে ভাবতে ভালবাসতেন বা মলয় রায়চৌধুরি যেমন এগুলোকে হাংরি
ছিট মহল বলে উল্লেখ করতেন। কিন্তু আমরা
জানতাম দুই দশক পরে নতুন করে হাংরি আন্দোলন হয় না। সময় এবং পরিসরের মাত্রা তখন
ভিন্নতর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা টের পেলাম একটা হাংরিয়ালিজম দানা বাঁধছে কিছু
হাংরি লেখকের মনে। দুই দশক পরে তখন আন্দোলনের একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করার
প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। হাংরি মেনিফেস্টোর অসম্পুর্ণতা দূর করার চেষ্টা। ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’সেই কাজে কিছুটা ব্যবহৃত হয়েছে। প্রসঙ্গত ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’এ সুভাষ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর আমরা নানা ভাবে
আক্রান্ত বোধ করতে থাকি। সেই সাক্ষাৎকারে হাংরি কনসেপ্ট নিয়ে সুভাষের কথায় অনেকে
অস্বস্থি বোধ করেন। অনেকেই আন্দোলন নিয়ে সুভাষের কথার বিরোধিতা করতে গিয়ে আমাদেরও
তার সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। সঙ্ঘ ভাঙা মানুষেরা বোধ করি কোন সঙ্ঘ আর পছন্দ করে না।
কিন্তু ততদিনে পাশাপাশি আমরা জেনে যাচ্ছি যে হাংরিদের অভ্যন্তরীণ মত পার্থক্য, মামলা
কেন্দ্রিক কিছু ব্যক্তিগত বিভেদের সালতামামি। এসব অগ্রাহ্য না করতে পারলেও আমরা
আমাদের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলাম। ততদিনে কিছুটা বিস্মৃত হয়ে যাওয়া ফাল্গুনি রায়
ও অবনী ধর এর লেখা আমরা আমাদের কাগজে পুনঃ প্রকাশ করতে শুরু করি। হাংরি লেখকদের
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইও ঐসময় কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পের লেখকদের নিজ উদ্যোগে
প্রকাশিত হয় । যেমন মনোজ রাউত প্রকাশ করেন শৈলেশ্বর
ঘোষের ‘প্রতিবাদের সাহিত্য’এবং অরুণেশ ঘোষের ‘অপরাধ আত্মার নিষিদ্ধ যাত্রা’। অরুণেশের এই বইটি যথেষ্ট বিতর্কিত হয় । বিতর্কিত হতে পারে
কিন্তু বইটিকে অগ্রাহ্য করার ডাক দেয়া হয়েছিল কলকাতার ‘কাগজের বাঘ’এর পক্ষ থেকে। কিছুটা পরের দিকে খুব উল্লেখযোগ্য দুটি কাজ
করেন অলোক গোস্বামী। একটি সুভাষ ঘোষের ‘গোপালের নয়নতারা’ও ফাল্গুনী রায়ের একটি রচনা সংকলন প্রকাশ । সাধারণ পাঠকের
কাছে ফাল্গুনী রায় তখনও অনেকটা অজ্ঞাত। তার উপর তিনি ছিলেন হাংরি আন্দোলনের
বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং কিছুটা ব্রাত্য । স্বাভাবিক ভাবেই বইটি
কোন পাঠক সহায়তা পায়নি কলকাতাতেও। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ফাল্গুনী নিয়ে অনেক উচ্ছাস
তৈরি হয় । তার রচনা সংকলিতও হয়। কিন্তু অলোক গোস্বামীর এই সংকলনটির উল্লেখ
কোথাও দেখা যায় না। কলোনীর স্বভাব আমাদের যাবে কোথায়! প্রসঙ্গত একটি উল্লেখ
ফাল্গুনী রায় বিষয়ে করা যেতে পারে যে ফাল্গুনীর মৃত্যুর পর তার জন্য একমাত্র
শোকসভাটি হয় কুচবিহার শহরের একটি ছোট্ট ঘরে । উপস্থিত ছিলেন
আহবায়ক হিসেবে অরুণেশ ঘোষ, জীবতোষ দাস,ও অন্য দুএক জন এর সঙ্গে
শিলিগুড়ি থেকে যাই আমি। স্মৃতিচারণে অরুণেশ সেদিন ফাল্গুনী সম্পর্কে আমাদের কিছুটা অবহিত করেন।
ঘটনাটি‘কনসেনট্রেশন
ক্যাম্প’প্রকাশের আগেকার
ঘটনা।
দুটি দশক জুড়ে
আমাদের ‘কনসেনট্রেশন
ক্যাম্প’এর কর্মকান্ড। আমরা
না চাইলেও নিজেদের মুদ্রাদোষে আমরা পরস্পর কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি একটা সময়। সেই
বিচ্ছিন্নতার মূলে প্রধানত ছিল প্রতিষ্ঠান
বিরোধিতা সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন, বিতর্ক। পাশাপাশি ছিল আমাদের পরিচিত হাংরি
লেখকদের পারষ্পরিক বিদ্বেষপ্রসূত কার্যকলাপ। আর এই ঘটনাক্রমে ৬/৭ টি লিটল ম্যাগাজিনএর সঙ্ঘ ভাঙতে শুরু করলো। অলোক ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ থেকে সরে গিয়ে বের করলো ‘ক্রমশ’ ও আরো পরে ‘গল্পবিশ্ব’। তারপরও বিচ্ছিন্ন ভাবে‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’এর আরো কয়েকটি সংখ্যা
আমার আর সুমন্ত ভট্টাচার্য্যের ব্যবস্থাপনায় বের হয়ে বন্ধ হয়ে যায়।
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন