সোমবার

মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মণিদীপা সেন ও চয়ন দাশ

“এবং চিলেকোঠার” জন্য মলয় রায়চৌধুরীর
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মণিদীপা সেন ও চয়ন দাশ
প্রশ্ন : মলয় রায়চৌধুরী এবং বাংলায় হাংরি আন্দোলন একটি সর্বাধিক আলোচিত প্রসঙ্গ । একাধিকবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এই একই প্রসঙ্গে কথা বলতে আপনার ঠিক কেমন লাগে ?

মলয় : বিরক্ত আর অসহায় লাগে । মনে হয় সাক্ষাৎকার যিনি বা যাঁরা নিচ্ছেন তাঁরা আমার প্রায় আশিটা বইয়ের কোনোটাই পড়েননি । কেবল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ পড়েছেন বা বন্ধুদের মুখে শুনেছেন ।

প্রশ্ন : হাংরি আন্দোলনের সময়টুকু বাদ রেখে মলয় রায়চৌধুরীকে যদি জানতে হয় তাহলে তার ছবিটা কেমন ?

মলয় : হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমার লেখালিখির আউটপুট বেশি নয় । আন্দোলনের পরেই আমার বেশির ভাগ বই প্রকাশিত হয়েছে । সিরিয়াস পাঠক আমার এই পরবর্তী ছবিটার সঙ্গেই পরিচিত । আমার বেশ কিছু পাঠক হাংরি-পরবর্তী পর্বের বইপত্রের জেরক্স সংগ্রহ করে পড়েছেন, তাও তাঁরা জানিয়েছেন । 

প্রশ্ন : City Lights Journal 3 নিয়ে কিছু বলুন ।

মলয় : আমার মামলার সময়ে  আমেরিকার এশিয়া সোসাইটির বনি ক্রাউন আর ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড কলকাতায় এসেছিলেন । বনি ক্রাউন তরুণ বাঙালি কবিদের রচনা আমেরিকায় প্রকাশ করতে চাইছিলেন । সংগ্রহ করে তিনি সিটি লাইটস জার্নল-এর সম্পাদক কবি লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির সঙ্গে যোগাযোগ করেন । হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড মকদ্দমার  সংবাদ পড়েছিলেন ; তিনি ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটার অনুবাদ পুস্তিকাকারে প্রকাশ করতে চাইছিলেন, এবং ভূমিকাসহ কয়েকটা সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন । লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি কবিতাটার অনুবাদ ‘স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস’ সিটি লাইটস জার্নালে প্রকাশ করতে চান, ম্যাককর্ডের ভূমিকাসহ । আমি ফেরলিংঘেট্টিকে অনুরোধ করেছিলুম যাতে অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখাও তাতে অন্তর্ভুক্ত হয় । 

প্রশ্ন : Stark Electric Jesus লেখার জন্য ১৯৬৬ সালে ব্যাঙ্কশাল কোর্ট আপনার কারাবাস ঘোষণা করে । কবির চোখে কারাবাসের অভিজ্ঞতা জানতে চাইব ।

মলয় : এই ইংরেজি ভার্শানের জন্য মামলা আর দণ্ডাদেশ হয়নি । হয়েছিল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার জন্য । জজ সাহেব কারাদণ্ড দিলেও আমাকে জেল খাটতে হয়নি । হাইকোর্টে অ্যাপিল করে আমি জিতে গিয়েছিলুম । তবে আমাকে গ্রেপ্তার করার সময়ে আর লকাপ থেকে আদালতে নিয়ে যাবার সময়ে হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । অন্ধকার লকাপে আমার সঙ্গে সাতজন দাগি অপরাধী ছিল, যারা অবাক হয়েছিল শুনে যে আমি লেখালিখির জন্য গ্রেপ্তার হয়েছি ।

প্রশ্ন : আপনার প্রিয় কবি/লেখক যারা আপনাকে ইন্সপায়ার করেছেন ?

মলয় : ইন্সপায়ার শব্দের বদলে আমি কারা আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন তা বলতে পারি । দুজনেই তরুণী, দুজনের গালেই টোল পড়ত, আমার স্ত্রীর গালেও টোল পড়ে । একজন ইমলিতলা পাড়ার কুলসুম আপা, যিনি ফয়েজ আর গালিবের ভক্ত ছিলেন । আরেকজন আমার ব্রাহ্ম স্কুলের পার্টটাইম গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তী, ব্রাহ্ম লেখক আর কবিদের বই বেছে-বেছে পড়তে বলতেন, লিখতে প্ররোচিত করতেন, পরে মার্কসবাদের দিকে টেনে নিয়ে যান। এঁরা দুজন আমার প্রথম প্রেমিকা ।

প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যে আপনি Confessional Poetry-র  প্রবক্তা । এই স্টাইলের সম্পর্কে যদি একটু বলেন।

মলয় : প্রবক্তা বলা উচিত হবে না ; আমিই প্রথম কনফেশানাল কবিতা লেখা আরম্ভ করি । অগ্রজ কবিরা লেখার সময়ে কাব্যিক মুখোশ পরে নিতেন । কনফেশানাল কবিতাকে বলা যায় পোয়েট্রি অফ দি পার্সোনাল, কবির জীবনের চরম গোপন মুহূর্তগুলোকে সরাসরি ফাঁস করে দেওয়া, তাঁর ট্রমা, তাঁর যৌনতা, তাঁর আত্মহত্যার চিন্তা, তাঁর হেনস্হা । কনফেশানাল কবিতা লিখতে বসে কবি আর বিব্রত হন না যে পাঠক আমাকে কী ভাববে, ইত্যাদি । তাছাড়া এই কবিতাগুলোয় দ্রুতি খুবই জরুরি ।

প্রশ্ন : আপনার নিজের কাছে আপনার শ্রেষ্ঠ লেখা ?
মলয় : শ্রেষ্ঠ শব্দটা ব্যবহার করতে চাই না । লিখে আনন্দ পেয়েছি, এরকম কথা বলা যায়, যা এখনও ভালোলাগে । আগে আমি ‘নখদন্ত’ বইটার কথা বলতুম । বইটাতে সব রকম জনারই প্রয়োগ করেছিলুম । এখন আমি বলি ‘নরমাংসখোরদের হালনাগাদ’ নামের নভেলার কথা । এই নভেলাটা টানা একটা বাক্যে লেখা, কোনো দাঁড়ি কমা কোলন সেমিকোলন কিচ্ছু নেই । 

প্রশ্ন : অনেকে বলেন, সারা জীবন এক সরলরেখায় হাঁটা যায় না । মানেন ?

মলয় : তাঁরা ঠিক কথাই বলেন । জীবন ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল ।

প্রশ্ন : একজন সাহিত্যিকের কাছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ? প্রতিষ্ঠা না প্রতিষ্ঠান ?

মলয় : এর উত্তর দিতে পারব না । আমি তো কবি-লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত নই । আর আমি প্রতিষ্ঠানের ধার ধারি না । হাংরি আন্দোলনের পরে আমার সঙ্গে আমার লেখালিখির যে সম্পর্ক তাকে বলা যায় একাকীত্ব এনজয় করা ।

প্রশ্ন : জীবনের কোন স্মৃতি ভুলে যেতে চান ?

মলয় : হ্যাঁ । আশির দশকের প্রথম দিকে যখন মুম্বাইতে থাকতুম, তখন বাবাকে নিজেদের কাছে এনে রাখা উচিত ছিল । আমি, আমার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, কেউই বাড়িতে থাকতুম না বলে বাবাকে মুম্বাইতে আনিনি। উনি পাটনায় খুবই লোনলি ফিল করতেন, দীর্ঘ চিঠি লিখতেন, আর আমাদের বলতেন তার উত্তর দিদির বাড়ির ঠিকানায় পাঠাতে । প্রচণ্ড আফশোষ হয় । বাবা মারা যেতে আমি ন্যাড়া হইনি, দাদা হয়েছিলেন । মারা যাবার বেশ কিছুকাল পরে একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবার জন্য কান্না পেয়ে গেল, সামনে যে সেলুন দেখলুম সেখানে ঢুকে ন্যাড়া হয়ে গিয়েছিলুম ।

প্রশ্ন : নামি অনামি বেনামি নতুন পুরোনো সব ধরণের লিটল ম্যাগাজিনেই আমরা সব সময় আপনার উপস্হিতি পেয়ে থাকি । সাম্প্রতিক এই লিটল ম্যাগাজিনের জগত এবং বাংলা সাহিত্যে তার প্রভাব সম্পর্কে আপনার মতামত ?

মলয় : এরা আছে বলেই তো লেখালিখি করে যেতে পারছি । নয়তো কোথায়ই বা লিখতুম ? সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরিতে গেলে দেখা যায় এমফিল আর পিএইচডি করিয়ে গবেষকরা তথ্য যোগাড় করার জন্য লিটল ম্যাগাজিন ঘেঁটে চলছেন, জেরক্স নিচ্ছেন । এ থেকেই তো বোঝা যায় এই পত্রিকাগুলোর ভূমিকা বাংলা সাহিত্যে কতো গুরুত্বপূর্ণ ।

প্রশ্ন : শূন্য দশকের কবিদের লেখা পড়েন ? নজর কাড়ে ?

মলয় : কারা-কারা শূন্য দশকের তা-ই তো জানি না । জানলে কয়েকজনের নাম বলতে পারতুম । বেশি পড়ার সুযোগ আমার হয় না, কেননা আরথ্রাইটিসের জন্য লিখতে আমার প্রচুর সময় লাগে । তবে যেটুকু পড়ি, যাদের কবিতা সাড়া জাগায়, তাদের নাম আমি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করি, ইররেসপেকটিভ অফ দশক-বিভাজন ।

প্রশ্ন : একজন ফিল্ড হকি প্লেয়ার এবং একজন লেখক-কবির ব্যক্তিগত জীবনের রসায়নটা ঠিক কেমন ?

মলয় : কম বয়সে যখন তরুণীরা আমার কাছে ঘেঁষতো, তখন আমার স্ত্রী সেসব পছন্দ করতো না । তবে সুবিধা এই যে আমার লেখালিখি সম্পর্কে আমার স্ত্রীর আগ্রহ নেই । কী লিখছি না লিখছি, কাকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখছি, তা নিয়ে ওর আগ্রহ নেই । অসাধারণ রান্না করতে পারে, এককালের স্টেট-লেভেল হকি খেলোয়াড় হওয়া সত্বেও ।

প্রশ্ন : এবার খানিকটা র‌্যাপিড ফায়ার প্রশ্ন

ক ) গোটা গ্রন্হাগার না একটা কলম ?

মলয় : কলম, যদিও আমি আর কলম ধরতে পারি না, আরথ্রাইটিসের কারণে । গ্রন্হাগার নিয়ে হবেটাই বা কী ? পড়ার তো সময় হয় না । নাকতলার ফ্ল্যাট ছাড়ার সময়ে অর্ধেক বই দাদার বাড়িতে রেখে এসেছিলুম আর অর্ধেক বিলি করে দিয়েছিলুম ।

খ ) আপনার চোখে প্রেম প্ল্যাটনিক না ফিজিকাল ?

মলয় : ফিজিআল, ফিজিকাল । প্ল্যাটনিক নামে কোনো প্রেম হয় না ।
গ ) সত্যজিৎ রায় না ফেদেরিকো ফেলিনি ?

মলয় : সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালি” আর ফেদেরিকো ফেল্লিনির “ই ভিতেল্লোনি”, দুটো ফিল্মই পাটনার সিনেমাহলে প্রায় একই সময়ে দেখেছিলুম । তবে বিদেশি ফিল্ম দেখে তেমন আনন্দ পাই না, সাব টাইটেলের জন্যে, এক চোখ দিয়ে নিচের সংলাপ পড়া আর অন্য চোখ দিয়ে দৃশ্য দেখা, এটা আমার হয়ে ওঠে না ।

ঘ) ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যদি কারোর নাম বলতে হয়, কার নাম বলবেন ?

মলয় : নিঃসন্দেহে আলিয়া ভাট ।
ঙ ) বিশ্বাসী শত্রু না অবিশ্বাসী বন্ধু ?

মলয় : দুটোর কোনোটই নয় । এদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ ।

প্রশ্ন : সমগ্র আলাপচারিতার পর “এবং চিলেকোঠা” সম্পর্কে কিছু মনে হওয়া ?

মলয় : কেমন যেন মনে হলো, বেশির ভাগ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের মতন “এবং চিলেকোঠা” কর্তৃপক্ষও আমার বইপত্র বিশেষ পড়েননি, তাই বইগুলোর বিষয়, আঙ্গিক, চরিত্রগঠন, নিরীক্ষাপ্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন না ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন