মঙ্গলবার

উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন : রাজা সরকার


আপনার  conversation পড়লাম ভালো লাগলো তবে এর অধিকাংশটাই আগে আপনার কোনো না কোনো লেখায় পড়েছি

কিন্তু এই লেখাটি লিখছি অন্য একটি কারণে সেটি হলো শিলিগুড়িতে আমাদের লেখালেখি বা পত্রিকা প্রকাশের বিষয়ে আপনার উল্লেখের মধ্যে কিছু তথ্যগত ভুল থেকে যাচ্ছে যেমন আমি ধৃতরাষ্ট্র এর সম্পাদক বা প্রকাশক ছিলাম না ছিল মনোজ রাউত আমি একই সঙ্গে একটি স্বল্পকালীন পত্রিকা করেছিলাম নাম কুরুক্ষেত্র আর এসব চলছিল সত্তর দশকের শেষ কয়েকটি বছর ও আশির শুরু পর্যন্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প শুরু হয় তারপর আর তা কখনো একা অলোক গোস্বামী করতো না এটা যৌথ ভাবে করা হতো তবে মূল কাজটার বোঝা আমার এবং অলোক সহ আরো কয়েকজনের উপর থাকতো  এই বিষয়ে আমার একটি সংক্ষিপ্ত লেখার অংশ বিশেষ তুলে দিলাম

কনসেনট্রেশন ক্যাম্প।
**রাজা সরকার।


----------তখন ১৯৭৭ ,৭৮। এই সময়ে আমি আর সমীরণ ঘোষ একটি ঠিকঠাক  লিটল ম্যাগাজিনের  সন্ধানে আমরা দুজন খুব উদগ্রীব হয়ে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় মিলিত হই স্থানীয় কোর্ট মোড় সংলগ্ন গ্রন্থাগারগুলোতে। তার একটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ এবং অন্যটি তরাই হরসুন্দর--। এই সময়েই একদিন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রিডিং টেবিলে একটি শীর্ণ পত্রিকার সন্ধান পাই। নাম ধৃতরাষ্ট্রসম্পাদক মনোজ রাউত। ততদিনে অবশ্য পাহাড়তলী আর আসমুদ্র হিমাচল নামে আরো দুটি পত্রিকার নাম আমরা শুনেছি বা দেখে ফেলেছি। অচিরেই ধৃতরাষ্ট্র সম্পাদক মনোজ রাউত সম্পর্কে খোঁজ খবর করে একদিন তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় পর্ব সাঙ্গ হয়ে গেল। যেন আমরা পরস্পরকে খুঁজছিলাম। সেই পর্ব ছিল সেদিন বেশ দীর্ঘ এবং শেষ হয়েছিল একটি গোপন পানশালায়।

শিলিগুড়ি শহর তখনও লিটল ম্যাগাজিনের জন্য শুনশান । ছোট কাগজ বলতে ঐ দু'চারটে যা বের হয় তা অনেকটা নির্বাক যুগের কথা মনে করিয়ে দেয় । হয়তো তাতে কখনো দু'চারটে ভাল লেখার হদিশও আছেকিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের আধার সেখানে তৈরি হয়নি । লেখালেখির বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক গাম্ভীর্য তখনো লিটল ম্যাগাজিনের জন্মের অন্তরায় । ঠিক এই রকম এক আবহে নতুন করে শিলিগুড়িতে একটি লিটল ম্যাগাজিনের শুরু। নাম "ধৃতরাষ্ট্র"। পাত্র মিত্ররা মনোজ রাউত,সমীরণ  ঘোষ,পল্লব কান্তি রাজগুরু, চন্দন দে ও রাজা সরকার। লেখা ও  জীবন খুব কাছাকাছি নিয়ে আসার প্রচেষ্টার সেই শুরু । শুরু লেখার ভাষা ও স্বভাব চরিত্রের  পরিবর্তনেরও । আর তার জন্য ক্রমশঃ যে সামাজিক ঘাত প্রতিঘাতের মুখোমুখি হতে হচ্ছিলো তা বলা বাহুল্য । কিন্তু  দমে যাওয়ার বদলে  'বছরের মধ্যেই  ব্যাপারটি আরো সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ওঠে ।


---------এরকম একটি পরিবেশে একসময় শিলিগুড়ির অন্তত ৬/৭টি লিটল  ম্যাগাজিন মিলে  একযোগে একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করা শুরু হয়ে গেল । যার নাম ছিল  "কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্প" । সময়টা ১৯৮৩। এটিকে শিলিগুড়ির লিটল ম্যাগাজিনের দ্বিতীয় পর্ব বলা চলে। । আমাদের সবারই কমবেশি অভিজ্ঞতা বলছিল ব্যাক্তিগত ভাবে এক দুইজন মিলে একটি কাগজ করার চেয়ে সংঘবদ্ধভাবে একটি লিটল ম্যাগাজিন কে একটা আন্দোলনমুখী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া অনেক জরুরী। যাতে  আমাদের ভাষা ভাবনার আধার হতে পারে পত্রিকাটি। সক্রিয় লেখকসুচি হলো এরকম-- অলোক গোস্বামী, প্রবীর শীল,রতন নন্দীকিশোর সাহা,কুশল বাগচি,সুমন্ত ভট্টাচার্য,মলয় মজুমদার, মনোজ রাউ্‌ সমীরণ  ঘোষ, রাজা সরকার সহ আরও  অনেকে । শিলিগুড়ি শহরের বইপাড়াটাকেই সকাল বিকেল আমাদের পত্রিকার চলমান অফিস হিসেবে ধরা হতো। যেখানে আলাপ আলোচনা লেখালেখির নিয়ে তুমুল তর্ক বিতর্ক চলতো। চলতো পত্রিকা প্রকাশের যাবতীয় পরিশ্রমের কাজ। আশেপাশের মানুষজন এইসব কান্ড দেখে প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও পরে একসময় মেনে নিয়েছিল।

এই  পর্বে আমার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে ষাট দশকের হাংরি জেনারেশনের লেখকদের । তখন এমন নয় যে হাংরি লেখকরা খুব সক্রিয়। তাদের সক্রিয়তা বা আন্দোলন অনেক আগেই ১৯৬৪/৬৫তেই স্তিমিত হয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু এটি একটি সাহিত্য আন্দোলন তার রেশ বা রচনার মৃত্যু ঘটেনি। শিলিগুড়িতে আমাদের মত  নতুন পাঠকের কাছে তা নিঃসন্দেহে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কিন্তু এটা খুবই  আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে প্রায় দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও এই আন্দোলন সম্পর্কে শিলিগুড়ির লেখা জগৎ তখনও অন্ধকারে। খোঁজ খবর বইপত্র কিছুই পাওয়া যায়না।  তার উপর তখনো অতীতের নানা চাপের ফসল হাংরি লেখকদের উপর  দায় হিসেবে রয়ে গেছে । পত্রিকা বের হয় না। নিজেরাও তারা তখন অনেকটা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। তবে এদিক ওদিক থেকে ছিটকে কিছু বই হাতে আসলেও আন্দোলন সম্পর্কে জানার কোন উপায় নেই। আমরা তাদের লেখা পড়ার প্রথম সুযোগ পাই তখনকার ত্রিপুরাবাসী হাংরি কবি প্রদীপ চৌধুরি সঙ্গে যোগাযোগ করার পর। তিনি সেখান থেকে তখন কিছুটা নিয়মিত ফুঃনামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন।তার  সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে  সন্ধান পাই কবি অরুণেশ ঘোষ এর। তিনি কুচবিহারে থাকেন। হাংরি আন্দোলনের শরিক না হলেও উত্তরবঙ্গের তিনিই একমাত্র এই আন্দোলনের খোঁজখবর রাখতেন এবং তাদের শেষদিকের পত্র পত্রিকায় লিখতেন। তবে তখন তিনি খুব নীরব এবং নিঃসঙ্গ। ইতিমধ্যে তার সম্পর্কে অনেক সত্য মিথ্যা খবর রটানো ছিল। তার মধ্যে একটা ছিল যে উনি কারোর সঙ্গে দেখা করেন না। কিন্তু লেখালেখি নিয়ে আমাদের ভাষা ও ভাবনার সন্ধান তখন এতই তীব্র যে খুব দ্রুত আমি একটি সাক্ষাৎকারের জন্য কিছু প্রশ্ন নিয়ে তার প্রত্যন্ত গ্রাম হাওয়ারগাড়িতে এক দুপুরে গিয়ে হাজির হই। সব রটনা মিথ্যা মনে হয়। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে  আমার কথা হয়। একসময় আমার লিখিত প্রশ্নাবলীর উত্তর উনি ডাকযোগে আমাকে পাঠিয়েও দেন। যা আমার সম্পাদিত কাগজ কুরুক্ষেত্রের এর শেষ সংখ্যায় ছাপা হয়। তারপর  থেকে অনেকদিনই আমাদের সঙ্গে তার সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। এবং  পরবর্তী কালে প্রকাশিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এ তার প্রভাবও ছিল।  

দ্বিতীয় পর্বের লিটল ম্যাগাজিন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প তখনকার সময়ে প্রকাশিত কাগজগুলোর মধ্যে ক্রমশঃ উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে।আশি এবং নব্বই এই দুই দশক জুড়ে এই কাগজটি লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র সম্পর্কে অনেক কথাই বলে। লিটল ম্যাগাজিন বাজারি বড় কাগজের ছিট কাগজ হিসেবে থাকবে, না কি  একটি পৃথক লেখা ভাবনার উপর নির্ভর করে শুধু সাহিত্য-শখ পুরণের খেলার সামগ্রী না হয়ে সময়ের দাবী অনুযায়ী একটি ভিন্ন; যাকে তখনকার মত বলা --প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখার আধার হয়ে উঠবে। আজ আর অস্বীকারের উপায় নেই যে ষাট দশকের হাংরি লেখকরা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পএর মাধ্যমেই উত্তরের এই সব অঞ্চলে পরিচিতি পান। কেউ কেউ এটাকে হাংরি রিভাইভাল বলে ভাবতে ভালবাসতেন বা মলয় রায়চৌধুরি যেমন এগুলোকে হাংরি ছিট মহল বলে উল্লেখ  করতেন। কিন্তু আমরা জানতাম দুই দশক পরে নতুন করে হাংরি আন্দোলন হয় না। সময় এবং পরিসরের মাত্রা তখন ভিন্নতর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা টের পেলাম একটা হাংরিয়ালিজম দানা বাঁধছে কিছু হাংরি লেখকের মনে। দুই দশক পরে তখন আন্দোলনের একটা তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। হাংরি মেনিফেস্টোর অসম্পুর্ণতা দূর করার চেষ্টা। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পসেই কাজে কিছুটা ব্যবহৃত হয়েছে। প্রসঙ্গত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পএ সুভাষ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর আমরা নানা ভাবে আক্রান্ত বোধ করতে থাকি। সেই সাক্ষাৎকারে হাংরি কনসেপ্ট নিয়ে সুভাষের কথায় অনেকে অস্বস্থি বোধ করেন। অনেকেই আন্দোলন নিয়ে সুভাষের কথার বিরোধিতা করতে গিয়ে আমাদেরও তার সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। সঙ্ঘ ভাঙা  মানুষেরা বোধ করি কোন সঙ্ঘ আর পছন্দ করে না। কিন্তু ততদিনে পাশাপাশি আমরা জেনে যাচ্ছি যে হাংরিদের অভ্যন্তরীণ মত পার্থক্য, মামলা কেন্দ্রিক কিছু ব্যক্তিগত বিভেদের সালতামামি। এসব অগ্রাহ্য না করতে পারলেও আমরা আমাদের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলাম। ততদিনে কিছুটা বিস্মৃত হয়ে যাওয়া ফাল্গুনি রায় ও অবনী ধর এর লেখা আমরা আমাদের কাগজে পুনঃ প্রকাশ করতে শুরু করি। হাংরি লেখকদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইও ঐসময় কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পের লেখকদের নিজ উদ্যোগে প্রকাশিত হয় । যেমন মনোজ রাউত প্রকাশ  করেন শৈলেশ্বর ঘোষের প্রতিবাদের সাহিত্যএবং অরুণেশ ঘোষের অপরাধ আত্মার নিষিদ্ধ যাত্রাঅরুণেশের এই বইটি যথেষ্ট বিতর্কিত হয় । বিতর্কিত হতে পারে কিন্তু বইটিকে অগ্রাহ্য করার ডাক দেয়া হয়েছিল কলকাতার কাগজের বাঘএর পক্ষ থেকে। কিছুটা পরের দিকে খুব উল্লেখযোগ্য দুটি কাজ করেন অলোক গোস্বামী। একটি সুভাষ ঘোষের গোপালের নয়নতারাও ফাল্গুনী রায়ের একটি রচনা সংকলন প্রকাশ । সাধারণ পাঠকের কাছে ফাল্গুনী রায় তখনও অনেকটা অজ্ঞাত। তার উপর তিনি ছিলেন হাংরি আন্দোলনের বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং কিছুটা ব্রাত্য ।  স্বাভাবিক ভাবেই  বইটি কোন পাঠক সহায়তা পায়নি কলকাতাতেও। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ফাল্গুনী নিয়ে অনেক উচ্ছাস তৈরি হয়তার রচনা সংকলিতও হয়। কিন্তু অলোক  গোস্বামীর এই  সংকলনটির উল্লেখ কোথাও দেখা যায় না। কলোনীর স্বভাব আমাদের  যাবে কোথায়! প্রসঙ্গত একটি উল্লেখ ফাল্গুনী রায় বিষয়ে করা যেতে পারে যে ফাল্গুনীর মৃত্যুর পর তার জন্য একমাত্র শোকসভাটি হয় কুচবিহার শহরের একটি ছোট্ট ঘরেউপস্থিত ছিলেন আহবায়ক হিসেবে অরুণেশ ঘোষ, জীবতোষ দাস,ও অন্য দুএক জন এর সঙ্গে  শিলিগুড়ি থেকে যাই আমি। স্মৃতিচারণে অরুণেশ সেদিন  ফাল্গুনী সম্পর্কে আমাদের কিছুটা অবহিত করেন। ঘটনাটিকনসেনট্রেশন ক্যাম্পপ্রকাশের আগেকার ঘটনা।

দুটি দশক জুড়ে আমাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পএর কর্মকান্ড। আমরা না চাইলেও নিজেদের মুদ্রাদোষে আমরা পরস্পর কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি একটা সময়। সেই বিচ্ছিন্নতার মূলে প্রধানত ছিল  প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন, বিতর্ক। পাশাপাশি ছিল আমাদের পরিচিত হাংরি লেখকদের পারষ্পরিক বিদ্বেষপ্রসূত কার্যকলাপ।  আর এই ঘটনাক্রমে  ৬/৭ টি লিটল ম্যাগাজিনএর সঙ্ঘ ভাঙতে শুরু করলোঅলোক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে সরে গিয়ে বের করলো ক্রমশ ও আরো পরে গল্পবিশ্ব   তারপরও বিচ্ছিন্ন ভাবেকনসেনট্রেশন ক্যাম্পএর আরো কয়েকটি সংখ্যা  আমার আর সুমন্ত ভট্টাচার্য্যের ব্যবস্থাপনায় বের হয়ে বন্ধ হয়ে যায়







সোমবার

মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মণিদীপা সেন ও চয়ন দাশ

“এবং চিলেকোঠার” জন্য মলয় রায়চৌধুরীর
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মণিদীপা সেন ও চয়ন দাশ
প্রশ্ন : মলয় রায়চৌধুরী এবং বাংলায় হাংরি আন্দোলন একটি সর্বাধিক আলোচিত প্রসঙ্গ । একাধিকবার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এই একই প্রসঙ্গে কথা বলতে আপনার ঠিক কেমন লাগে ?

মলয় : বিরক্ত আর অসহায় লাগে । মনে হয় সাক্ষাৎকার যিনি বা যাঁরা নিচ্ছেন তাঁরা আমার প্রায় আশিটা বইয়ের কোনোটাই পড়েননি । কেবল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ পড়েছেন বা বন্ধুদের মুখে শুনেছেন ।

প্রশ্ন : হাংরি আন্দোলনের সময়টুকু বাদ রেখে মলয় রায়চৌধুরীকে যদি জানতে হয় তাহলে তার ছবিটা কেমন ?

মলয় : হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমার লেখালিখির আউটপুট বেশি নয় । আন্দোলনের পরেই আমার বেশির ভাগ বই প্রকাশিত হয়েছে । সিরিয়াস পাঠক আমার এই পরবর্তী ছবিটার সঙ্গেই পরিচিত । আমার বেশ কিছু পাঠক হাংরি-পরবর্তী পর্বের বইপত্রের জেরক্স সংগ্রহ করে পড়েছেন, তাও তাঁরা জানিয়েছেন । 

প্রশ্ন : City Lights Journal 3 নিয়ে কিছু বলুন ।

মলয় : আমার মামলার সময়ে  আমেরিকার এশিয়া সোসাইটির বনি ক্রাউন আর ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড কলকাতায় এসেছিলেন । বনি ক্রাউন তরুণ বাঙালি কবিদের রচনা আমেরিকায় প্রকাশ করতে চাইছিলেন । সংগ্রহ করে তিনি সিটি লাইটস জার্নল-এর সম্পাদক কবি লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির সঙ্গে যোগাযোগ করেন । হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড মকদ্দমার  সংবাদ পড়েছিলেন ; তিনি ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটার অনুবাদ পুস্তিকাকারে প্রকাশ করতে চাইছিলেন, এবং ভূমিকাসহ কয়েকটা সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন । লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি কবিতাটার অনুবাদ ‘স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস’ সিটি লাইটস জার্নালে প্রকাশ করতে চান, ম্যাককর্ডের ভূমিকাসহ । আমি ফেরলিংঘেট্টিকে অনুরোধ করেছিলুম যাতে অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখাও তাতে অন্তর্ভুক্ত হয় । 

প্রশ্ন : Stark Electric Jesus লেখার জন্য ১৯৬৬ সালে ব্যাঙ্কশাল কোর্ট আপনার কারাবাস ঘোষণা করে । কবির চোখে কারাবাসের অভিজ্ঞতা জানতে চাইব ।

মলয় : এই ইংরেজি ভার্শানের জন্য মামলা আর দণ্ডাদেশ হয়নি । হয়েছিল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার জন্য । জজ সাহেব কারাদণ্ড দিলেও আমাকে জেল খাটতে হয়নি । হাইকোর্টে অ্যাপিল করে আমি জিতে গিয়েছিলুম । তবে আমাকে গ্রেপ্তার করার সময়ে আর লকাপ থেকে আদালতে নিয়ে যাবার সময়ে হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । অন্ধকার লকাপে আমার সঙ্গে সাতজন দাগি অপরাধী ছিল, যারা অবাক হয়েছিল শুনে যে আমি লেখালিখির জন্য গ্রেপ্তার হয়েছি ।

প্রশ্ন : আপনার প্রিয় কবি/লেখক যারা আপনাকে ইন্সপায়ার করেছেন ?

মলয় : ইন্সপায়ার শব্দের বদলে আমি কারা আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন তা বলতে পারি । দুজনেই তরুণী, দুজনের গালেই টোল পড়ত, আমার স্ত্রীর গালেও টোল পড়ে । একজন ইমলিতলা পাড়ার কুলসুম আপা, যিনি ফয়েজ আর গালিবের ভক্ত ছিলেন । আরেকজন আমার ব্রাহ্ম স্কুলের পার্টটাইম গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তী, ব্রাহ্ম লেখক আর কবিদের বই বেছে-বেছে পড়তে বলতেন, লিখতে প্ররোচিত করতেন, পরে মার্কসবাদের দিকে টেনে নিয়ে যান। এঁরা দুজন আমার প্রথম প্রেমিকা ।

প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যে আপনি Confessional Poetry-র  প্রবক্তা । এই স্টাইলের সম্পর্কে যদি একটু বলেন।

মলয় : প্রবক্তা বলা উচিত হবে না ; আমিই প্রথম কনফেশানাল কবিতা লেখা আরম্ভ করি । অগ্রজ কবিরা লেখার সময়ে কাব্যিক মুখোশ পরে নিতেন । কনফেশানাল কবিতাকে বলা যায় পোয়েট্রি অফ দি পার্সোনাল, কবির জীবনের চরম গোপন মুহূর্তগুলোকে সরাসরি ফাঁস করে দেওয়া, তাঁর ট্রমা, তাঁর যৌনতা, তাঁর আত্মহত্যার চিন্তা, তাঁর হেনস্হা । কনফেশানাল কবিতা লিখতে বসে কবি আর বিব্রত হন না যে পাঠক আমাকে কী ভাববে, ইত্যাদি । তাছাড়া এই কবিতাগুলোয় দ্রুতি খুবই জরুরি ।

প্রশ্ন : আপনার নিজের কাছে আপনার শ্রেষ্ঠ লেখা ?
মলয় : শ্রেষ্ঠ শব্দটা ব্যবহার করতে চাই না । লিখে আনন্দ পেয়েছি, এরকম কথা বলা যায়, যা এখনও ভালোলাগে । আগে আমি ‘নখদন্ত’ বইটার কথা বলতুম । বইটাতে সব রকম জনারই প্রয়োগ করেছিলুম । এখন আমি বলি ‘নরমাংসখোরদের হালনাগাদ’ নামের নভেলার কথা । এই নভেলাটা টানা একটা বাক্যে লেখা, কোনো দাঁড়ি কমা কোলন সেমিকোলন কিচ্ছু নেই । 

প্রশ্ন : অনেকে বলেন, সারা জীবন এক সরলরেখায় হাঁটা যায় না । মানেন ?

মলয় : তাঁরা ঠিক কথাই বলেন । জীবন ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল ।

প্রশ্ন : একজন সাহিত্যিকের কাছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ? প্রতিষ্ঠা না প্রতিষ্ঠান ?

মলয় : এর উত্তর দিতে পারব না । আমি তো কবি-লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত নই । আর আমি প্রতিষ্ঠানের ধার ধারি না । হাংরি আন্দোলনের পরে আমার সঙ্গে আমার লেখালিখির যে সম্পর্ক তাকে বলা যায় একাকীত্ব এনজয় করা ।

প্রশ্ন : জীবনের কোন স্মৃতি ভুলে যেতে চান ?

মলয় : হ্যাঁ । আশির দশকের প্রথম দিকে যখন মুম্বাইতে থাকতুম, তখন বাবাকে নিজেদের কাছে এনে রাখা উচিত ছিল । আমি, আমার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, কেউই বাড়িতে থাকতুম না বলে বাবাকে মুম্বাইতে আনিনি। উনি পাটনায় খুবই লোনলি ফিল করতেন, দীর্ঘ চিঠি লিখতেন, আর আমাদের বলতেন তার উত্তর দিদির বাড়ির ঠিকানায় পাঠাতে । প্রচণ্ড আফশোষ হয় । বাবা মারা যেতে আমি ন্যাড়া হইনি, দাদা হয়েছিলেন । মারা যাবার বেশ কিছুকাল পরে একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবার জন্য কান্না পেয়ে গেল, সামনে যে সেলুন দেখলুম সেখানে ঢুকে ন্যাড়া হয়ে গিয়েছিলুম ।

প্রশ্ন : নামি অনামি বেনামি নতুন পুরোনো সব ধরণের লিটল ম্যাগাজিনেই আমরা সব সময় আপনার উপস্হিতি পেয়ে থাকি । সাম্প্রতিক এই লিটল ম্যাগাজিনের জগত এবং বাংলা সাহিত্যে তার প্রভাব সম্পর্কে আপনার মতামত ?

মলয় : এরা আছে বলেই তো লেখালিখি করে যেতে পারছি । নয়তো কোথায়ই বা লিখতুম ? সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরিতে গেলে দেখা যায় এমফিল আর পিএইচডি করিয়ে গবেষকরা তথ্য যোগাড় করার জন্য লিটল ম্যাগাজিন ঘেঁটে চলছেন, জেরক্স নিচ্ছেন । এ থেকেই তো বোঝা যায় এই পত্রিকাগুলোর ভূমিকা বাংলা সাহিত্যে কতো গুরুত্বপূর্ণ ।

প্রশ্ন : শূন্য দশকের কবিদের লেখা পড়েন ? নজর কাড়ে ?

মলয় : কারা-কারা শূন্য দশকের তা-ই তো জানি না । জানলে কয়েকজনের নাম বলতে পারতুম । বেশি পড়ার সুযোগ আমার হয় না, কেননা আরথ্রাইটিসের জন্য লিখতে আমার প্রচুর সময় লাগে । তবে যেটুকু পড়ি, যাদের কবিতা সাড়া জাগায়, তাদের নাম আমি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করি, ইররেসপেকটিভ অফ দশক-বিভাজন ।

প্রশ্ন : একজন ফিল্ড হকি প্লেয়ার এবং একজন লেখক-কবির ব্যক্তিগত জীবনের রসায়নটা ঠিক কেমন ?

মলয় : কম বয়সে যখন তরুণীরা আমার কাছে ঘেঁষতো, তখন আমার স্ত্রী সেসব পছন্দ করতো না । তবে সুবিধা এই যে আমার লেখালিখি সম্পর্কে আমার স্ত্রীর আগ্রহ নেই । কী লিখছি না লিখছি, কাকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখছি, তা নিয়ে ওর আগ্রহ নেই । অসাধারণ রান্না করতে পারে, এককালের স্টেট-লেভেল হকি খেলোয়াড় হওয়া সত্বেও ।

প্রশ্ন : এবার খানিকটা র‌্যাপিড ফায়ার প্রশ্ন

ক ) গোটা গ্রন্হাগার না একটা কলম ?

মলয় : কলম, যদিও আমি আর কলম ধরতে পারি না, আরথ্রাইটিসের কারণে । গ্রন্হাগার নিয়ে হবেটাই বা কী ? পড়ার তো সময় হয় না । নাকতলার ফ্ল্যাট ছাড়ার সময়ে অর্ধেক বই দাদার বাড়িতে রেখে এসেছিলুম আর অর্ধেক বিলি করে দিয়েছিলুম ।

খ ) আপনার চোখে প্রেম প্ল্যাটনিক না ফিজিকাল ?

মলয় : ফিজিআল, ফিজিকাল । প্ল্যাটনিক নামে কোনো প্রেম হয় না ।
গ ) সত্যজিৎ রায় না ফেদেরিকো ফেলিনি ?

মলয় : সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালি” আর ফেদেরিকো ফেল্লিনির “ই ভিতেল্লোনি”, দুটো ফিল্মই পাটনার সিনেমাহলে প্রায় একই সময়ে দেখেছিলুম । তবে বিদেশি ফিল্ম দেখে তেমন আনন্দ পাই না, সাব টাইটেলের জন্যে, এক চোখ দিয়ে নিচের সংলাপ পড়া আর অন্য চোখ দিয়ে দৃশ্য দেখা, এটা আমার হয়ে ওঠে না ।

ঘ) ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যদি কারোর নাম বলতে হয়, কার নাম বলবেন ?

মলয় : নিঃসন্দেহে আলিয়া ভাট ।
ঙ ) বিশ্বাসী শত্রু না অবিশ্বাসী বন্ধু ?

মলয় : দুটোর কোনোটই নয় । এদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ ।

প্রশ্ন : সমগ্র আলাপচারিতার পর “এবং চিলেকোঠা” সম্পর্কে কিছু মনে হওয়া ?

মলয় : কেমন যেন মনে হলো, বেশির ভাগ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের মতন “এবং চিলেকোঠা” কর্তৃপক্ষও আমার বইপত্র বিশেষ পড়েননি, তাই বইগুলোর বিষয়, আঙ্গিক, চরিত্রগঠন, নিরীক্ষাপ্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন না ।