বুধবার

অঙ্কন কাজী : রক্তাক্ত জখম - হাংরি আন্দোলনের বিতর্কিত উত্তরাধিকার




         এই বছর ( ২০১৮ ) কলকাতার এক্সপেরিমেন্টার গ্যালারিতেশিল্পী সঞ্চয়ন ঘোষ ‘শ্রমের আপোষ’ নামে কার্মিক শ্রমের বিভিন্ন উপাদানকে একটি বৌদ্ধিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উপস্‌আপন করে সম্ভাব্য ইউটোপিয়ার দৃষ্টিকল্পনা করেছিলেন । 

         প্রদর্শনীর কেন্দ্রস্হলে ছিল চুন-বালি-জল দিয়ে গড়া একটি বিশাল চাতাল, ঠিক যেমন বীরভূমের ছাদ পেটাইকারীরা তৈরি করেন । তার চারিপাশে ছিল ছাদ পিটিয়েদের ছবি, একটি বাংলা সাহিত্য পত্রিকার প্রথম সংখ্যা এবং শ্রম আইন জার্নালের দুটি সংস্করণ । দেয়াল থেকে যে হেডফোনগুলো ঝুলে ছিল, সেগুলো কানে লাগিয়ে সেই দলিত রমণীদের গান শোনার ব্যবস্হা করা হয়েছিল । যাঁরা এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন তাঁদের শ্রম -- যা মোটামুটি আশির দশকে শেষ হয়ে গেছে -- সেই গানগুলো পুরুষ কবিদের কবিতার ঐতিহ্যে প্রবেশ করেছে । চুন-বালির চাতালের ওপরে রাখা ছিল একটি ঝলমলে বোর্ড, যেন ‘২০০১: একটি মহাশূন্যের যাত্রা’, যার ওপর আলো দিয়ে লেখা ছিল মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার এই লাইনগুলো :

চাঁদোয়ায় আগুন লাগিয়ে
তার নীচে শুয়ে আকাশের উড়ন্ত নীল দেখছি এখন
দুঃখ কষ্টের শুনানী মুলতুবি রেখে
আমি আমার সমস্ত সন্দেহকে জেরা করে নিচ্ছি

         এই নগ্ন দৃষ্টিকল্পনা, এমনই এক সম্ভাব্য ভবিষ্যতের, যা অবিরাম পিছু হটে চলেছে, এবং একটি অবরোধী আধুনিক বিষয়বস্তুর সৃষ্টিশীল বিনির্মাণের ওপর নির্ভর করে আছে, যা হাংরি আন্দোলনের ক্রুদ্ধ আকাঙ্খাপূর্তিকে বুঝতে পারার জন্য অঙ্গাঙ্গীভাবে জরুরি । হাংরি আন্দোলন ছিল  সাহিত্যের আন্দোলন, যা ষাটের দশকের পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক কল্পনায় ছেয়ে গিয়েছিল । 

         সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়ের সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরী ছিলেন  “হাংরি আন্দোলনের” প্রতিষ্ঠাতা, যাঁরা হামেশাই পশ্চিমবাংলার সাহিত্যিক এবং আইনি প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্হানকে স্পষ্ট করে তুলেছিল, এবং সেই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা শেষাবধি জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং অভিযুক্ত করেছে, ফলে শেষ পর্যন্ত দলটিকে ভেঙে ফেলতে সফল হয়েছে । তা সত্বেও এদের প্রভাব বাংলা সাহিত্যে, এমনকি হিন্দি সাহিত্যেও ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল । হাংরি সাহিত্য আন্দোলনকে প্রায়ই আণ্ডারগ্রাউণ্ড সাহিত্যিক সংস্কৃতির উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হয় -- মূলত ‘লিটল ম্যাগাজিনের’ সমর্পিত বিকল্প পাঠকদের কাছে -- দেশজ ভাষায় একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সাহিত্য-ভাণ্ডাররূপে ।

          হাংরি আন্দোলনকারীরা তাঁদের রচনাবলীকে একাধিক ইশতাহার ও সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌছে দিতেন । আত্মসন্দেহ এবং আশা একযোগে উপস্হিত আছে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনায়, যখন কিনা তাঁরা কোনোরকম সমঝোতা সহ্য করতেন না । আধুনিকতাবাদী জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর সাফাইকরা প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতার পরিবর্তে, তাঁরা এনেছিলেন সমাজের সীমালঙ্ঘন -- অস্বাভাবিক যৌনতাচর্চা, অতিরিক্ত মদ্যপান, এবং মাদকসেবন, মেলাবার প্রয়াস করেছিলেন হিন্দু ধর্মের আচার-আচরণের সঙ্গে  যৌনতার নিষিদ্ধতাকে --- যা প্রায়শই সাহিত্যিক অভিব্যক্তি হিসাবে তুলে ধরতেন তাঁরা। ক্রোধের যাথার্থকে বাগ্মীতার মাধ্যমে প্রকাশ করে তাঁরা বিশ্বাসযোগ্যতা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন ।

       , ‘কবিতা হল মানুষের নার্সিসিস্টিক চালিকাশক্তির কর্মক্রিয়া’, নভেম্বর ১৯৬১ সালে প্রকাশিত প্রথম ইশতাহারে বলেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীরা । ‘স্বাভাবিকভাবে, আমরা আধুনিকতার  ফাঁকাফোকর হিসাবে কবিতাকে, যা কিনা কমার্শিয়াল পত্রিকার ডারলিঙ, যেখানে কবিতা অরগ্যাজমের স্বতঃস্ফূর্তিতে পুনর্জাগরিত হয় না, এবং প্রকৃতপক্ষে যা হয় তা হল নকল কাদাঘুর্ণিতে পাক-খাওয়া, অর্ধশিক্ষিত বুড়ো-খোকাদের ছন্দের গদ্য, তাতে কেউই সেই আর্তচিৎকার খুঁজে পাবে না, যেমনভাবে একটি অপ্রাণ থেকে প্রাণের সৃষ্টি হয়, মানুষ প্রয়াস করে কর্মতেজ হয়ে ওঠার।’
          যে পাঁচ বছর হাংরিদের সাহিত্য আন্দোলন সক্রিয় ছিল, তাঁরা শতাধিক বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। 

 চল্লিশজনের বেশি কবি-লেখক ও শিল্পীদের সদস্য হিসাবে পেয়েছিল হাংরি আন্দোলন, যাঁরা নতুন নতুন পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করতেন । কিন্তু ১৯৬৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এগারোজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রুজু করে । বহু পুরোনো সদস্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ, হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধতা করার জন্য এগিয়ে যান, এবং মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার মামলায় সাক্ষ্য দিলেন । ফলে আন্দোলন ক্রমশ প্রাণশক্তি হারিয়ে ফ্যালে ।

         পরবর্তীকালে হাংরি আন্দোলনকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার বহু প্রয়াস করা হয়েছে । সেই সমস্ত আয়োজন মূলত মলয় রায়চৌধুরী এবং শিল্পী অনিল করঞ্জাই-এর অবদানকে ঘিরে বিভিন্ন সভাসমিতিতে এবং বিদ্যায়তনিক চর্চায় সীমাবদ্ধ থেকেছে । অনিল করঞ্জাইয়ের স্বপ্নের মতন যৌনতার ল্যাণ্ডস্কেপ ছিল হাংরি আন্দোলনের ঐতিহ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ।

         বাংলা পপুলার সংস্কৃতিতে, হাংরি-চরিত্র হিসাবে সৃজিৎ মুখার্জির ২০১১ সালের ‘বাইশে শ্রাবণ’ ফিল্মে সিনেমার আর্টহাউস পরিচালক গৌতম ঘোষকে অভিনয় করতে দেখা গেছে, কলকাতার প্রান্তবাসী একজন অসন্তুষ্ট, সীমালঙ্ঘনকারী হাংরি কবি হিসাবে ।  ২০১৫ সালে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হাংরি সাহিত্য আন্দোলন : তত্ব, তথ্য, ইতিহাস’ -- আন্দোলনকারী ও তাঁদের সমালোচকদের বক্তব্য একত্রিত করে -- গ্রন্হটির দ্বারা হাংরি আন্দোলনকে বিদ্যায়তনিক স্তরে প্রাণশক্তি দেবার প্রয়াস করা হয়েছে । বইটি হাংরি সাহিত্যের মূল্যবোধের মানদণ্ড ও ইতিহাসের প্রেক্ষিতে আন্দোলনের অবস্হান নির্ণয় করার চেষ্টা করেছে ।

         সঞ্চয়ন ঘোষের শিল্পকর্মের মতনই, উপরোক্ত দুটি কর্ম-পরিকল্পনাই হাংরি আন্দোলনের প্রতি সহৃদয়, কিন্তু তাঁদের পুনরায় জাগিয়ে তোলার  কর্ম-পরিকল্পনায় হাংরি আন্দোলনের অন্তর্গত বহুবিধ টেনশনের সহজ-সমাধা হয়নি। এই কর্ম-পরিকল্পনাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে আমরা আন্দোলনটিকে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশে তাঁদের রাজনীতিকে বুঝতে পারব ।

         বীরভূমের দলিত নারীদের সঙ্গীতকে সঞ্চয়ন ঘোষ যেভাবে প্রয়োগ করেছেন, তা তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে সমস্যা ও সমাধান দুইই তুলে ধরেছে : টেক্সট ও আইডিয়ার গভীর লিঙ্গবাদী দৃষ্টিভঙ্গী, যা হাংরি আন্দোলনের মুক্তিপ্রসঙ্গের কেন্দ্রবিন্দু ছিল অথচ  যা প্রায়ই বাধাবন্ধনহীন নারীদ্বেষেকে প্রকট করে তুলতো । হাংরি আন্দোলনকারীদের দৃষ্টিতে পৌরুষ ছিল যেন একটি বিপন্ন বৌদ্ধিক ও বস্তুগত আহরণসূত্র । ‘বাইশে শ্রাবণ’ ফিল্মে খলনায়কের পৌরুষ দ্বিধা-খণ্ডিত -- সে একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার, যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি --- এবং নিবারণ নামে উচ্চাকাঙ্খী হাংরি আন্দোলনকারী কবির ভূমিকায় পুলিশ-অফিসারটির গড়ে তোলা ছায়ামানুষ হিসাবে গৌতম ঘোষ, যে কিনা সিরিয়াল কিলারও হতে পারে । এই দুই চরিত্রের মাঝে ফেঁসে গেছে একজন যুবক, যাকে সমীহ করা যায়, পরমব্রত চ্যাটার্জি, পাকড়াশী নামে একজন পুলিশ অফিসারের ভূমিকায়, যে নৃশংস খুনগুলোর সমাধান করতে অসফল, সেই সব খুনের শিকার হল ভিখারি আর যৌনকর্মীদের মতন সমাজের প্রান্তবাসীরা ।

         পাকড়াশীকে একদল পুলিশ অফিসারের হুমকির সামনে পড়তে হয়, যারা বিশ্বাস করতে পারেনি যে তার মতন সাদাসিধা একজন যুবক পুলিশ অফিসারের কাজ করতে পারবে । সে ক্রুদ্ধ হয়ে  অ্যাকশান-হিরো ধাঁচের পুলিশ অফিসারের ধরাবাঁধা চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করে, আর মনে মনে ভাবে যে তাহলে কি মাংসের দোকানের কসাইয়ের মতন হলে লোকে তাকে সিরিয়াসলি নিতো ! পাকড়াশীর মতন এক সুবোধ ভদ্রলোকের বিপরীতে পুলিশ বিভাগে প্রবীরের  উপস্হিতি অনেকটা ভতুড়ে । থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করার আধিক্যের কারণে প্রবীরকে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছিল, পরে তাকে ফিরিয়ে আনা হয় যাতে পাকড়াশীর বইপড়া বিদ্যার সহায়ক হবার জন্য সে তার নিয়মনীতি বর্জিত, অনেক সময়ে বেআইনি, ট্যাকটিকস প্রয়োগ করতে পারে ।

         একজন বয়স্ক এবং আরেকজন উদীয়মান যুবকের দুরকম আঙ্গিকের অস্বচ্ছন্দ পৌরুষের যৌথতার বিরুদ্ধে নিবারণ নামের কবিকে উপস্হাপন করা হয়েছে, যাঁর রচনা প্রকাশিত হয়নি, যিনি বিকৃতকাম চিত্রকল্পে মেতে ওঠেন এবং প্রায়ই হাংরি আন্দোনকারীদের মামলার উল্লেখ করেন । প্রবীর থাকে একটি পুরোনো ভাঙাচোরা প্রাসাদে, যখন কিনা নিবারণ অত্যন্ত গরিব এবং অর্ধোন্মাদ, কেননা তাকে রবীন্দ্রনাথ নামের একজন ছায়াবৎ লোক কবি হিসাবে স্বীকৃতি ও খ্যাতির নিষ্ঠুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে । রহস্যকাহিনি যেমন যেমন তার বিষণ্ণ বাঁকবদল দিয়ে এগোয়, পৌরুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব অধিকতর গুরুত্ব পেতে থাকে । প্রবীরের যুক্তিহীন সহিংস পৌরুষকে উপস্হাপন করা হয়েছে বাঙালি পুরুষমানুষের উথাল-পাথাল মনঃস্হিতিকে বোঝার জন্য । প্রথম বাঁকবদলে দেখানো হয় প্রবীরের ক্ষমতার দেখনদারি । সমাজের শরীরে সীমাভঙ্গকারী কবিতার বিপদ সম্পর্কিত বাঁধাধরা ধারণাকে সে স্রেফ নিজের কাজে ব্যবহার করে । ফিল্মের শেষ দিকে তার মৃত্যুকে ট্র্যাজিক ঘটনা হিসাবে দেখানো হয়েছে -- যা পলিটিকালি ইনকারেক্ট, বলতে চেয়েছে ফিল্মটি, সে বেঁচে থাকুক আর নিজেকে বিজয়ী মনে করুক, কেননা বেঁচে থাকলে মনে হতো যে সে জিতে গেছে, কিন্তু তার সন্দেহজনক আত্মবলিদান আসলে স্ট্যাটাস কুয়োকে জিইয়ে রাখার জন্য শোক করার ব্যাপার নয় ।

         ইত্যবসরে হাংরি আন্দোলনকে নিজের ব্যবস্হা নিজে করে নিতে বলা হয়েছে, তার উত্তরাধিকারকে এমনই এক ইনোসেন্ট প্রজন্মের ভুল ব্যাখ্যার জন্য মাঝপথে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যারা তাদের সামাজিক সীমালঙ্ঘনের রাজনৈতিক দৃষ্টিপ্রতিভা দ্বারা বদল আনতে অপারগ, অথবা দায় নেবার দায় তাদের নেই।

সৃজিৎ মুখার্জির ফিল্মের তুলনায় প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সংকলনগ্রন্হটি হাংরি আন্দোলনের ইতিহাসকে আরও জটিল করে তোলে । হাংরি আন্দোলনকারীদের স্বয়ম্ভু বিপ্লবী হিসাবে তুলে ধরার পরিবর্তে, বইটির ঐতিহাসিক প্রবন্ধগুলো হাংরিদের অবস্হানকে তুলনা করতে চেয়েছে পুরোনো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাহিত্যিক প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে । সমীর রায়চৌধুরী -- মলয়ের দাদা-- তাঁর প্রবন্ধ আরম্ভ করেছেন জওহরলাল নেহেরুর দুই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মাধ্যমে । দ্বিতীয় পরিকল্পনা, যেটি শিল্পোদ্যোগকে গুরুত্ব দিয়েছিল, তার ফলে মফসসলের আঞ্চলিক প্রান্তে গড়ে উঠেছিল ইস্পাতের কারখানাগুলো । তা ছিল সংস্কৃতি ও সামাজিক দিক থেকে জনগণের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা শ্রমিকরা বেশ বড়ো আকারে স্হানান্তরিত হয়েছিল ।

          পাটনা, যে শহরে রায়চৌধুরী ভাইরা বড়ো হয়েছিলেন এবং হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন সেই ধরনের জায়গাগুলোর প্রধান গুরুত্ব --- মুঙ্গের, ডালটনগঞ্জ, ধানবাদ, পুর্নিয়া, চাইবাসা, এমনকি বহু দূরের বেনারস ও ত্রিপুরাকে আলোয় আনা হয়েছে । হাংরি আন্দোলনকারীরা অনায়াসে স্হানীয় বুলি, সাহিত্যিক প্রতিনিধিত্ব, স্হানীয় কৌম এবং সেই পরিসরগুলোর রাজনৈতিক ইতিহাসকে এনেছেন তাঁদের টেক্সটে, আর পাশাপাশি এই ঘিঞ্জি অঞ্চলগুলোর কাঙালি বাঙালি জীবনের একক অভিজ্ঞতাকে লেখায় নিয়ে আসার প্রয়াস করেছেন । সমীর বলেছেন শ্রমিকশ্রেণির পাড়ায় শৈশবের কথা, শ্রেণিভেদের শিকার হবার কথা, প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের দ্বারা এবং বিদ্যায়তনিক সংস্হাগুলোর দ্বারা পরিত্যক্ত হবার কথা ।

         ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক, যে, তিনি ওই অবদমনকে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়োজন অনুভব করছেন এবং দাবি করছেন যে ওই নাকউঁচু বর্গের চেয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও রামচরিতমানস সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখেন । তাঁর দাবিটা  মনে হবে হাস্যকর যদি সতীনাথ ভাদুড়ীর বিখ্যাত উপন্যাস ঢোঁড়াই চরিত মানস-এর সঙ্গে তুলনা করে হয়, যে উপন্যাসটি তুলসীদাসের মহাকাব্যটির অন্তর্ঘাতী পুনর্লিখন, যার পৃষ্ঠভূমি ছিল বিহারের অবদমিত তাঁতি জাতের মানুষেরা । একই ধরণের স্হানিক প্রভাব পাওয়া যাবে হিন্দি লেখক ফণীশ্বরনাথ রেণু এবং রামধারী সিহ দিনকর-এ । হাংরি আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রে, যাঁরা প্রায় সকলেই এসেছিলেন প্রভাবশালী বর্ণ থেকে, নিম্নবর্গকে নিয়ে নিরীক্ষা অথবা পুনর্গঠন গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সমাধানহীন রয়ে গেছে ।

         সমীর যখন বিদ্যায়তনিক স্তরে স্বীকৃতির কথা বলেন, তখন একটি নামই উল্লেখ করতে পারেন, এবং তা হল দীপ্তি ত্রিপাঠীর, যিনি হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখায় যুক্তিকাঠামোর অভাব এবং শব্দবাহুল্যের প্রতি ঝোঁকের কথা বলেছিলেন । সমীর এই সমালোচনাকে, যদিও বেশ আশ্চর্যের, তাঁর লেখায় যৌনতার প্রতি ঔচিত্যবাদী প্রতিক্রিয়া হিসাবে মনে করেছিলেন । সমীর আনন্দের সঙ্গে স্বীকার করেছিলেন যে ন্যারেটিভের একরৈখিকতাকে পরোয়া করেন না এবং প্লটের মারপ্যাঁচকে মনে করেন কৃত্রিম ।

          হাংরি আন্দোলনের আদর্শগত উদ্দেশ্যের সংক্ষিপ্ত সজ্ঞা নিরুপণে সমীর রায়চৌধুরী এবং প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় উভয়েই তাঁদের বক্তব্যে অস্পষ্ট রয়ে গেছেন । তার মানে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনাবলীকে  তাঁদের আধুনিকতাবাদী আচরণ থেকে পৃথক করতে তাঁরা অসমর্থ, যেমন জুতোর বাক্স রিভিউ করার জন্য পাঠানো, কাগজের মুখোশ পাঠিয়ে মুখোশ খুলে ফেলতে বলা ইত্যাদি । তাঁরা প্রতিষ্ঠানবিরোধী কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রবাহকেও গুরুত্ব দিয়েছেন । কৃত্তিবাস ছিল মহানগরীয় এবং আধুনিকতাবাদী নান্দনিকতার সাহিত্য পত্রিকা । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত কৃত্তিবাস পত্রিকাটি ষাটের দশকে নড়বড়ে হয়ে গেলেও পরবর্তীকালে বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে তা হয়ে ওঠে সমীহ করার মতো একটি সাংস্কৃতিক বস্তু ।

         র‌্যাডিকাল আধুনিকতার হস্তক্ষেপের বিপ্রতীপে সাহিত্যিক অবস্হানের বিপদহীন আশ্রয়ে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সংকলন আলো ফেলেছে প্রান্তিক এলাকার গুরুত্বে, যা আমরা দেখতে পাই স্হানিক ক্ষমতা সংঘর্ষের দ্বারা সজ্ঞায়িত একরূপতার দাবিতে --- বাঙালিদের জন্য পশ্চিমবাংলা, ওড়িয়াদের জন্য ওড়িষা, বিহারিদের জন্য হিন্দি বা মৈথিলি --- যখন কিনা বিশাল একটা শ্রমিক জনসমূদায়কে উপেক্ষা করা হয়েছে যারা রাজ্যের সীমা অতিক্রম করে জীবনযাপনের জন্য  অন্যত্র চলে গেছে । হাংরি আন্দোলনকারীরা পাঠকদের পাঠাভ্যাস পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ জানালেন তাঁদের নিজস্ব ভাষার মাধ্যমে ।

         ব্যাপারটা সঞ্চয়ন ঘোষের ইনস্টলেশনে স্বরলিপির মিশ্রণ ঘটিয়ে যে গান শোনানো হচ্ছে তার ক্ষেত্রেও সত্য । বাউড়ি গায়িকারা যে বুলিতে গান গাইতেন তা শুদ্ধ সাহিত্যিক বাংলা ভাষা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল । এমন এক ঐতিহ্য যেখানে প্রভাবশালী জাতের পুরুষদের রুচি প্রতিষ্ঠিত ভাষা এবং গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠানবিরোধী ডিসকোর্স নির্ণয় করে, তাতে যদি না খাপ খায় তাহলে আচরণ-অভ্যাসগুলো লোপাট হয়ে যায় । সঞ্চয়ন ঘোষের ইন্সটলেশান লিঙ্গবাদী রাজনীতির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চেয়েছে, বুঝতে চেষ্টা করেছে যে বাঙালির সংস্কৃতিতে শ্রমসাহিত্য গভীরভাবে কেন লিঙ্গবাদী । 

         এই ধরনের মিশ্রণ, সাহিত্যিক সংঘর্ষ থেকে অশুদ্ধতা গড়ে তোলা, মলয় রায়চৌধুরীর বিখ্যাত কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর  তুচ্ছ যৌনচিত্রময় লাইনগুলোর চেয়ে বেশি সামাজিক ও সাহিত্যিক আঘাত করতে পারে :

তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
আমাকে তোমাত গর্ভে আমারি শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
আমার বাবা-মা অন্য হলেই কি আমি এরকম হতুম ?

ঋণস্বীকার : দি ক্যারাভান পত্রিকা, ১ অক্টোবর, ২০১৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন