মঙ্গলবার

যখন হাংরি আন্দোলনে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পেণ্ডুলাম ছিলেন



প্রথমে পড়ুন দেবশিস মজুমদারকে দেয়া সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের এই সাক্ষাৎকার-চুটকি, তারপর আরও কিছু সন্দীপনীয় মাল-মশলার সঙ্গে পরিচয় করাবো ।

‘কৃত্তিবাস’-এর সূত্রেই শক্তির সঙ্গে আলাপ এবং শক্তির সূত্র ধরেই ‘হাংরি জেনারেশনে’র সঙ্গে যোগাযোগ। হাংরির প্রতি এই আকর্ষণের কারণটা কী ছিল?
প্রথম কথা, আমি হাংরি জেনারেশনের লেখক নই। যদিও বুলেটিনে হয়তো একবার ২/৪ লাইন লিখেছি কিনা মনে নেই। তাতে হাংরি বলে কিছু ছিল না। যেমন, হাংরি জেনারেশন বলে যদি কোনো আন্দোলন হয়ে থাকে তাতে যোগদান করার কোনো ব্যাপার ছিল না। তবে মলয়রা যাদের ‘হাংরি’ লেখক বলে মনে করেছিল তাদের মধ্যে অবশ্যই আমি একজন। জীবনানন্দ দাশও একজন। সমীর আর শক্তির প্রতি আমার বন্ধুত্ব ছিল। সেই সূত্রেই যেটুকু। কিন্তু সব খবর রাখতামও না। একবার একটা আড্ডায় আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তাহলে কিছু মুখোশ কিনে বিভিন্ন লোককে পাঠানো যাক। ওপর থেকে নিচে সমস্ত স্তরের লোককেই। সে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ই হোক আর সাগরময় ঘোষই হোক। ঠিক হল মুখোশে লেখা থাকবে – ‘মুখোশ খুলে ফেলুন।‘ দ্যাট ওয়াজ মাই আইডিয়া। আর আমার আইডিয়া বলে সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে গিয়ে মুখোশগুলো কিনতে হল। এই রকম সব ঘটনা আর কি। তারপর ওরা যখন অ্যারেস্ট হল তখন আমি বিয়ে করেছি, ৬৪ সালের কথা। সত্যিকথা বলতে কি রীণারা খুবই অভিজাত পরিবারের মেয়ে। এই যেমন ধরো ওর দাদা পাঁচটা আংটি পরে। যারা উত্তর কলকাতায় থাকে। চামড়া রক্তাভ। তা যাইহোক, বিয়ে করে দমদমে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে উঠেছি, এমন সময় একদিন লালবাজার থেকে ডেকে পাঠালেন। আমার কিন্তু সাহস বলতে যা বোঝায়, তা হল ভীরুর সাহস। আমাদের দলে সাহসী বললে বলতে হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। এবং বারবার যে ওর দিকে আকর্ষিত হই তা ওই সাহসের কাছে। আর বাকি সব ভীতুর দল। তখন তো সুনীল এখানে নেই – আইওয়াতে। এদিকে এখানে এরা সব আন্দোলন করেই খালাস। লিখতে যে হবে সে ধান্দা তো নেই। লেখক বলতে যা তা ওই আমি, শক্তি আর উৎপল। আর একজনের কথা বলতে হয়, তাকে হাংরি জেনারেশনই বল আর যাই বল, সে হচ্ছে বাসুদেব দাশগুপ্ত।

সত্যিই, আজও ‘রন্ধনশালা’র গল্পগুলো পড়লে অভিভূত হই।
ওই রকম বই ওই সময় ওই একটাই। তা, বাসুদেব তো লিখলো না। আসলে লেখাটাই হচ্ছে প্রকৃত বিপ্লব করা আর সেটাই করে যেতে হয়। যাই হোক, হাংরি জেনারেশনের একটা সংখ্যা বেরিয়ে গেল পাটনা থেকে যাতে খুবই অশ্লীল লেখাটেখা ছিল। সেই পত্রিকার প্রিন্টার অ্যাণ্ড পাবলিশার হিসাবে ছিল আমার নাম।

আপনি জানতেন না?
উইদাউট মাই নলেজ – টোটালি। সেইজন্য লালবাজারে গিয়ে আমি বলেছিলাম যে, এই সংখ্যাটা আমি ছাপিনি বা প্রকাশ করিনি। কিন্তু সাক্ষী দেওয়ার সময় মলয়কে সম্পূর্ণভাবে ডিফেণ্ড করি। বলি, সাহিত্যের ক্ষেত্রে এইরকম এক্সপেরিমেন্ট হয়েই থাকে। আজ যা অশ্লীল, পরে তাই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হয়ে দাঁড়ায়। পরে কোনো একটা লেখায় বোধ হয় এই বিষয়টা স্বীকার করেছে সমীর রায়চৌধুরী। তবে সমীর শক্তির বিষয়ে যেটা বলেছে সে ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। যদি সত্যি সত্যি ঘটনাটা ঘটে থাকে তবে তা দুঃখজনক। শক্তি যদি বলে থাকে বিষয়টা সত্যিই অশ্লীল তা হলে যা দাঁড়াচ্ছে সেটা খুব খারাপ।

পড়লেন তো ? কোনো বুলেটিনেই ওনার নাম পাবলিশার হিসেবে ছিল না, তা সে পাটনা থেকে হোক বা মঙ্গল গ্রহ থেকে । এবার পড়ুন হারাধন ধাড়া অর্থাৎ দেবী রায়কে লেখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের চিঠিখানা :

প্রিয় দেবী,
পর-পর দুসপ্তাহ এলেন না, কোনো চিঠিপত্রও নেই, দোষ একটিমাত্র করেছি । এতোদিনের বন্ধুত্বে একটি, আপনাকে লেখা দিইনি । এজন্যে যদি কিছু মনে করে থাকেন, আমার কিছু করার নেই । উৎপল আপনার ওখানে গিয়েছিল ? প্রিয় উৎপল অনেকদিন দেখা হয়নি । রয়েড স্ট্রিটে উঠে গেছেন ? আমি সুনীলের একটা চিঠি পেয়েছি । আমি খুব ভালো নেই । একদিন যদি চলে আসেন ভাল হয় --- আপনি তো শক্তির মতো ধান্দায় ঘোরেন না । আপনি চলে এলেই পারেন । বীটদের একটা পত্রিকা Now ডাকে পেয়েছি । প্রেরক C.Plymell একজন কবি । 1537 N. TO Peka/Wichita/Kansas/USA. একটা উত্তর দিন । ভাই শক্তি, 'দেশে' কলাম ছাপানো ব্যাপারে তৈরি plan কী successful হল, অন্যান্য planগুলো, শংকর, বরেন, সুভাষ মুখো থেকে শুরু করে নরেশ গুহ স্টিল সুনীল, বুদ্ধদেব, নীরেনবাবু ইত্যাদি মিলিয়ে, ও বিধু, রবীন দত্ত, সামসের সমেত ও অধুনা সংকর কী যেন ( ছাড়পত্র সম্পাদক ) প্লাস শরৎ, ভাস্কর, প্রণব প্রভৃতি নিয়ে যে বিরাট জাল ফেলেছিস, সেটা এবার তোল । আমরা আর কতো সময় দাঁড়িয়ে থাকব ? তারপরেও অপেক্ষা করতে হবে । আমেরিকাগামী প্লেনে দমদমে see off  করতে পারলে তবে আমাদের ছুটি । প্রিয় সুনীল, আপনার চিঠি পেয়েছি । আমার bedroom-এ উঁকি মারছেন কেন ? আমার সমূহ বিপদ --- এই প্রথম আমার মনে হচ্ছে, আমার দ্বারা বুঝে ওঠা সম্ভব হবে না এখন আমার কী করা উচিত, এখন এই প্রথম আমাকে অপরের উপদেশমতো চলতে হবে । প্রিয় দীপেন, তোমার কী হল ? কোথায় থাক ? তুমি যেন আমার সব অপরাধের শাস্তি আমি ভোগ করছি । প্রিয় উৎপল, আপনি ছাড়া কারো সম্পর্কে এখন বন্ধুত্বের বোধ নেই । সুনীলের জন্য আছে, কিন্তু তা বোধহয় সে আমেরিকায় আছে বলে ।
         শ্যামবাজার থেকে টু-বি ধরেছি, দোতলা, মাঝে-মাঝে বাসস্টপগুলির সুযোগ নিয়ে লিখছি । একদিন আসুন ।
                                                                                                                              আপনাদের সন্দীপন ।

এই চিঠিটা সন্দীপন হাংরি বুলেটিন বা হাংরি আন্দোলনের পত্রিকায় প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন । চিঠিটা পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চটে-মটে সন্দীপনকে এই চিঠি দিয়েছিলেন, আয়ওয়া, আমেরিকা থেকে :

15 June 1964
313 South Capital
Iowa City, Iowa, USA
         সন্দীপন, নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসেছি, প্রচণ্ড হাওয়া, সঙ্গে ৫ ডজন বিয়ার ক্যান, পাশে সাঁতারের পোশাক পরা একটা ধলা মেয়ে, মাঝে মাঝে তার পাছায় টোকা মারছি পায়ের আঙুল দিয়ে, এ দৃশ্য কেমন ? অবিকল এই দৃশ্যের মাঝে আমি শুয়ে আছি । চিঠি লিখছি। কিন্তু আমি এ দৃশ্যের মধ্যে নেই । হাতের তালু গোল করে খুব ছোটো করে, চোখের কাছে আনছি -- সব কিছু দূরে চলে যাচ্ছে । মেয়ের মুখও । খিদে নেই । তেষ্টা নেই । তবু বিয়ার খাচ্ছি । কারণ, এখানে বসে খাওয়া বেআইনি বলে, ঘরের মধ্যে খুব গরম, থাকতে পারিনি। ঘাসের ওপর গড়িয়ে এলাম। একটা দূরন্ত খরগোশকে ধরার জন্য পাঁচবার ছুটে গিয়েছিলাম ।
         কী ভালো লেগেছিল আপনার চিঠি পেয়ে । বিশেষত লাল পেনসিলের অক্ষর । যেন দুটো চিঠি পেলুম । গল্পটা আপনার ভালো লাগবে না জানতুম । গদ্য লিখে আপনাকে খুশি করতে পারব এমন দুরাশা আমার নেই । সত্যি নেই । কারণ, আপনি গ্রেট গদ্য লিখেছেন একসময়, এখন আর তেমন না । কিন্তু যা লিখেছেন, তার ধারে কাছে আর কেউ পোঁছতে পারেনি । আমি ওরকম গদ্য লিখতে পারি না । লিখবো না । কিন্তু ওই গদ্যই আমার প্রিয় পাঠ্য । আপনি পড়বেন, এই ভয়ে আমি সহজে গদ্য লিখতে চাই না । তবু কখনও লিখি, হয়তো টাকার জন্য, টাকার জন্য ছাড়া কখনও গদ্য লিখেছি বলে মনে পড়ে না । লিখেছিলুম একটা উপন্যাস, সেতা ছাপার সম্ভাবনা নেই । আমার কবিতার জন্য আপনাকে ভয় করি না, কবিতা লেখার ক্ষমতার ওপর আমার বেশি আস্হা নেই, আপনি যেরকম কবিতা ভালোবাসেন, অথবা যাই হোক --- আমি সেরকম কখনও লিখব না । আমি কবিতা লিখি গদ্যের মতো, ওরকমই লিখে যাবো । ও সম্বন্ধে আমার কোনো দ্বিধা নেই । শক্তি অসাধারণ সুন্দর বহু লাইন লিখেছে । আমার চেয়ে অনেক বড়, আমি ওকে শ্রদ্ধা করি । কিন্তু শক্তির কবিতা মুণ্ডহীন, আমি ওরকম লিখতে পারব না, চাই না, কারণ আমি ওরকম ভাবে বেঁচে নেই । বরং উৎপলের কবিতা আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করছে । কিন্তু এখানে এই শুয়ে থাকা, গাছের ছায়া মুখে পড়ছে --- তখন মনে হয় কোথাও কিছু নেই, না কবিতা, না হৃদয় ।
         প্রিয় সন্দীপন, দু-দিন পর আজ সকালে আবার আপনার চিঠি পেলুম । কি সব লিখেছেন কিছুই বুঝতে পারলুম না । কেউ আমাকে কিছু লেখেনি । শরৎ ও তারাপদ কফিহাউসে কি সব গণ্ডোগোলের কথা ভাসা-ভাসা লিখেছে । সবাই ভেবেছে অন্য কেউ বুঝি আমাকে বিস্তৃত করে লিখেছে । কিন্তু আপনার চিঠি অত্যন্ত অস্বস্তিজনক । তিনবার পড়লুম, অস্বস্তি লাগছে । বিছানা থেকে উঠে কলের কাছে গেলুম, ফিরে এলুম টেবিলে, আবার রান্নাঘরে, ভালো লাগছে না, কেন আমাকে এরকম চিঠ লিখলেন । আমি তো শুয়েছিলুম । আমি তো বিছানায় রোদ ও আলস্য নিয়ে খেলা করছিলুম । কেন আমাকে এমনভাবে তুললেন !
         সন্দীপন, আপনি অনেকদিন কিছু লেখেননি, প্রায় বছরতিনেক । তার বদলে আপনি কুচোকাচা গদ্য ছাপিয়ে চলেছেন এখানে সেখানে । সেই স্বভাবই আপনাকে টেনে নিয়ে যায় হাংরির হাঙ্গামায় । আমি বারণ করেছিলুম । আপনি কখনও আমাকে বিশ্বাস করেননি । ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলেন । আমি শক্তিকে কখনও বারন করিনি, কারণ আর যত গুণই থাক --- শক্তি লোভী । শেষ পর্যন্ত উৎপলও ওই কারণে যায় । কিন্তু আমি জানতুম আপনি লোভী নন । আপনার সঙ্গে বহুদিন এক বিছানায় শুয়েছি, পাশাপাশি রোদ্দুরে হাঁটার সময় একই ছায়ায় দাঁড়িয়েছি । সেই জন্য আমি জানতুম । আমি আমার লোভের কথা জানতুম । সেই জন্যই বুঝেছিলুম আপনার লোভ আমার চেয়ে বেশি নয় । আমার ওতে কখনও লোভ হয়নি, হয়েছিল অস্বস্তি থেকে ঘৃণা । ইংরেজিতে রচনা ছাপিয়ে ইওরোপ আমেরিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমার বিষম বদ রুচি মনে হয়েছিল আগেই, এখানে এসে আরও বদ্ধমূল হয়েছি । হাংরির গ্যাঁড়াকলের প্রতি আরও ক্রুদ্ধ হয়েছি । অপরের কৌতূহল এবং করুণার পাত্র হতে আপনার ইচ্ছে করে ? হাংরি এখানে  যে দু'একজন পেয়েছে, তাদের কাছে তাই । আমি এতদিন দেশে রইলুম --- অনেক সুযোগ এবং আহ্বান পেয়েছিলুম, কোথাও তবু একটি লাইনও ইংরেজি পদ্য ছাপাইনি । ছাপালে কিছু টাকা পেতুম, তবু না । কারণ সবাইকে বলেছি, আমি বাংলা ভাষার কবি, আমি শুধু বাংলাতেই লিখি, যে ভাষাব কথা বলে ৭ কোটি লোক --- ফরাসি ও ইতালির চেয়ে বেশি । এবং ফরাসি ও ইতালির চেয়ে কম উন্নত ভাষা নয় । আমার কাজ কবিতালেখা, নিজের কবিতা অনুবাদ করা নব, ও কাজ অন্যের । তোমাদের দরকার হলে বাংলা শিখে অনুবাদ করে নাও । এই ধরনের সূক্ষ্ম পিঠ চাপড়ানির ভাব লক্ষ্য করেই আমি বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্হের কাজ, যেজন্য আমি এখানে এসেছিলুম, এক লাইনও করিনি ।
         হাংরির এই ইংরেজি মতলোব ছাড়া, বাংলা দিকটা আরও খারাপ । ওর কোনো ক্রিয়েটিভ দিক নেই । শর্টকাটে খ্যাতি বা অখ্যাতি পাবার চেষ্টা --- অপরকে গালাগাল বা খোঁচা দিয়ে । আপনি মলয়কে এত পছন্দ করছেন ---   কিন্তু ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে, আপনি নিশ্চই মনে-মনে বিশ্বাস করেন না । আমি চলে আসার পরও আপনি হাংরির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন --- হিন্দি কাগজের জন্য আপনি কি একটা লিখেছিলেন --- তাতেও হাংরির জয়গান । ভাবতে খুব অবাক লাগে --- আপনার মতো অ্যাব্সট্র্যাক্ট লেখক কী করে ইলাসট্রেটেড উইকলিতে ছবি ছাপাটাও উল্লেখের মনে করে । এগুলোই হাংরির গোঁজামিল । এই জন্যেই এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক থাকাতে বারবার দুঃখ পেয়েছি, দুঃখ থেকে রাগ, রাগ থেকে বিতৃষ্ণা । একটা জিনিশ নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমি কখনও প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করিনি, ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করিনি । পারতুম । করিনি, তার কারণ, ওটা আপনাদের শখের ব্যাপার, এই ভেবে, এবং আপনারা আপনারা ওটাকে দাঁড়  করাবার চেষ্টা করছিলেন কৃত্তিবাস বা সুনীলের প্রতিপক্ষ হিসেবে । সে হিসেবে ওটাকে ভেঙে দেওয়া আংমার পক্ষে নীচতা হতো খুবই । বিশ্বাস করুব, আমার কোনো ক্ষতির কথা ভেবে নয়, আপনার অপকারের কথা ভেবেই আমি আপনার ওতে থাকার বিরোধী ছিলুম । এটা হয়তো খুব সেন্টিমেন্টাল শোনালো, যেন কোনো ট্রিক, কিন্তু ও-ই ছিল আমার সত্যিকারের অভিপ্রায় ।
         এবারে নতুন করে কী ঘটলো বুঝতে পারলুম না । যে ছাপা জিনিসটার কথা লিখেছেন, সেটা দেখলে হয়তো বুঝতে পারতুম । এবং এটা খুবই গোলমেলে --- যে চিঠি আপনি চারজন বন্ধুকে এক সঙ্গে লিখেচেন, যেটা চারজনকে একসঙ্গে পাঠানো যায় না, সেতা হারাধন ধাড়াকে পাঠালেন কী জন্য, বুঝতে পারলুম না । কিংবা আমার বোঝারই বা কী দরকার ? আচ্ছা মুশকিল তো, আমাকে ওসব বোঝার জন্য কে মাথার দিব্যি দিয়েছে এই আষাড় মাসের সন্ধ্যাবেলা ? আমি কলকাতায় ফিরে শান্তভাবে ঘুমোবো, আলতো পায়ে গুরবো --- আমার কোনো সাহিত্য আন্দোলনের দরকার নেই । মলয় আমার চিঠি কেন ছাপিয়েছে ? আমার গোপন কিছু নেই--- বিষ্ণু দেকে আমি অশিক্ষিত বলেছি আগেও, কৃত্তিবাসের পাতায় ব্যক্তিগত রাগে, কারণ উনি ওঁর সংকলনে আমার কবিতা আদ্দেক কেটে বাদ দিয়েছেন বলে । কিন্তু মলয়ের সেটা ছাপানোর কি মতলব ? যে প্রসঙ্গে লিখেচিলুম সেটা ছাপিয়েছে তো ? আমি ওকে লিখেছি সম্প্রতি, 'সামনে-পেছনে বাদ দিয়ে , ডট ডট মেরে চালাকির জন্য আমার চিঠি যদি ছ আপাও, তাহলে এবার ফিরে গিয়ে কান ধরে দুই থাপ্পড় মারব।' আপনার চিঠি সম্বন্ধেও তাই । আপনার চিঠি ওরা ছাপিয়েছে, সেটাই খারাপ --- যা লিখেছেন তা নয় । বেশ করেছেন লিখেছেন --- আমি না পড়েই বলছি । ওটা আপনার শক্তির আর আমার ঘরোয়া ব্যাপার --- আর কার কি তাতে ? আপনার যা খুশি বলার অধিকার আছে ।
         কিন্তু ওসব থাক সন্দীপন । আপনাকে কেউ মারবে না । কার অমন স্পর্ধা আছে ? যদি আপনি জায়গা দেন, আমি সব সময় আপনার পাশে আছি ।  অনেকে আছে । আপনার সঙ্গে কত ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে --- কিন্তু এই দীর্ঘদিন নিরালায় ভেবে দেখলুম, আপনাকে বাদ দিয়ে আমাদের চলে না । এক হিসেবে আপনি আমার অপরাংশ, আপনার চরিত্রের  অসংলগ্নতা, ভুল এবং জোচ্চুরি -- সব কিছু আমার প্রিয় । যেন আমার না পাওয়া জীবন । লেখক হিসেবে, 'প্রতিভাবান' এই শব্দটা যদি ব্যবহার করতে হয় --- তবে আমাদের পুরো জেনারেশনে তন্ময় দত্ত ছাড়া --- শুধু আপনার সম্বন্ধেই আমি ওকথা ভাবি । আপনার ঐ সুখের সূক্ষ্ঞ শরীর কেউ ছোঁবে না --- কলকাতা শহরে এমন কেউ নেই । না নেই । আপনি নরম ভাবে শুয়ে থাকুন রীনার পাশে, আপনি ওঁকে মঙ্গল গ্রহের গল্প বলুন ।
         আমি কলকাতায় পৌঁছোবো --- ১৮ আগস্ট । নানা কারণে এখানে এক মাস দেরি হয়ে গেল । দেরি হয়ে গেল আমারই বোকামিতে খানিকটা । জুনের মাঝামাঝি বা আস্টের প্রথমে প্যারিসে একটা থাকার জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কয়েকদিনের জন্য । আমি জুন মাসটা নষ্ট করেছি --- সুতরাং আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা না করে উপায় নেই । এই ঠিকানায় আছি জুলাই-এর বারো তারিখ পর্যন্ত অন্ততঃ, তারপর নিউইয়র্ক ও ইংল্যান্ড । এখানে থেকে এম. এ. পড়তে পারি আমি --- আপনার মনে এরকম ধারনা এল কি করে ? আমি কি সম্পূর্ণ কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়েছি ? কৃত্তিবাসে আপনার লেখা নিয়ে প্রচুর গণ্ডোগোল করেছি --- তবু, এবার কৃত্তিবাসে আপনার লেখা না দেখে মন খারাপ লাগলো । এখান থেকে কোনো জিনিস নিয়ে যাওয়ার হুকুম আছে আপনার কাছ থেকে ?
         ভালোবাসা ।
                                                                                                                        সুনীল

এবার পড়ুন দেবী রায়কে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের চিঠি । চিঠিতে উনি প্রস্তাব দিচ্ছেন যে হাংরি আন্দোলনের একটা সিমবল তৈরি করা হোক আর বুলেটিনগুলোর পাঁচ পয়সা দাম রাখা হোক।        

        মির্জাপুর, ৫ অক্টোবর ১৯৬৩
        প্রিয় হারাধনবাবু
        হাংগরি জেনারেশনের জন্য লেখা পাঠালাম । প্লট, কনটেন্ট, ক্র্যাফ্ট — এসব বিষয়ে ডেফিনিশন চেয়েছেন, আপাতত অন্য কতকগুলো ডেফিনিশন পাঠালাম, ওগুলো পরে লিখব । প্রকাশযোগ্য কিনা দেখুন ।       ছাপালে সবকটি একসঙ্গে ছাপাতে হবে — নইলে খাপছাড়া লাগবে । ছাপার ভুল যেন বেশি না থাকে, দরকার পড়লে অনুগ্রহপূর্বক একটা ফ্রেশ কপি করে প্রেসে দেবেন ।
        ‘অমৃত’তে আমার বইয়ের যে বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছিল, দেখেছেন ? নইলে পাবলিশারের কাছে গিয়ে তার একটা কাটিং পাঠাবার ব্যস্হা করেন তো খুশী হই । ওই বিজ্ঞাপনটাই দেশে বেরোবার কথা আছে — যদি বেরোয় তার প্রুফটা কাইন্ডলি দেখে দেবেন । আনন্দবাজারে লেখকদের লেখকদের কোনো বিবৃতি বেরিয়েছিল নাকি ? তাহলে তারও একটা কাটিং পাঠাবেন ।
        সামনের মাসে বাড়ি পাল্টাব । আরো একমাস থাকবো বা ততোধিক । সহজে যাব না । শরীর ভালো । ছোটোগল্পে আবার লেখা দিতে পারলাম না, সম্ভব হলে ক্ষমা করবেন ।
        আগামি সপ্তাহে নতুন ঠিকানা পাঠাবো । তার আগে চিঠি দিলে, কুমুদ বাঙলো, রুম নং ৫, টিকোর, চুনার, মির্জাপুর, — এই ঠিকানায় দেবেন । ‘আক্রমন’ বানান কী ? ‘ন’ না ‘ণ’ ?
        লেখাটা প্রকাশ হবার আগে আপনি ছাড়া কেউ যেন না দেখে । অনেক বাদ দিয়ে, খুব নরম করে, সবদিক বাঁচিয়ে লিখেছি, ভয় নেই ।
        হাংগরি জেনারেশনের একটা সিম্বল করতে বলেছিলুম, তার কী হল ? ৫ নয়া পয়সা দাম করতে পারেন।           
কমাগুলো ভেবেচিন্তে দিয়েছি, ওইগুলোই আসল জিনিস যেন থাকে ।
    শেষের তারিখটা যেখানে আছে, ওখানে প্রকাশের তারিখ দেবেন ।
    ‘অভিযান’ পূরবীতে হয়েছিল তো ?
    সুনীলবাবুকে ( হাজরা ) প্রীতি জানাচ্ছি ।
    ইতি
    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

বুঝতে পারছেন তো যে পেণ্ডুলাম দোল খেতে শুরু করেছে । ১৯৬৪ সালে হাংরি মামলা আরম্ভ হতে লালবাজার থেকে যখন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডাক পড়ল, তখন উনি আমার বিরুদ্ধে পুলিসের সাক্ষী হতে রাজি হয়ে গেলেন আর ১৫ই মার্চ ১৯৬৫ তারিখে এই জবানবন্দি দিলেন, মানে পেণ্ডুলাম দোল খেয়ে গ্যালিলেওকে পর্যন্ত ঘাবড়ে দিয়ে থাকবে:
       I am graduate of Calcutta University and employed as an Assistant Inspector, Calcutta Corporation. I am also a writer and used to visit the College Street Coffee House where young writers of Calcutta generally assembled in the evening. Samir Roychoudhury is a personal friend of mine. I came to know the sponsors of Hungry Generation, namely Shakti Chatterjee, Malay Roychoudhury and others. Although I am not directly connected with the Hungry Generation but I was interested in the literary movement. Some of the manifesto of the Hungry Generation contain advertisement of my literary works. In one of the publication my name was cited as the publisher. This was done with a motive to exploit my reputation as a writer but since my prior consent was not taken I took exception. The present publication in question also came to my notice. As a poet myself I do not approve either the theme or the language of the poem of Malay Roychoudhury captioned        I have severed all connections with Hungry Generation. I had correspondence with Malay Roychoudhury who often sought my advise in literary matters.
                                                                             Sandipan Chattopadhyay
                                                                                 15 March 1965
আমি যখন হাইকোর্টে কেস জিতে গেলুম, তখন পেণ্ডুলাম মাঝখানে এসে ঝুলে থাকার কথা বলল, ৩০ জুলাই ১৯৬৭ তারিখের এই পোস্টকার্ডখানায় :
প্রিয় মলয়,
হাইকোর্টের রায় পড়ে তোমাকে মনে-মনে তৎক্ষণাৎ কনগ্র্যাচুলেট করেছি । একটা মামলা হওয়া দরকার ছিল, কাউকে না কাউকে এরকম মামলার আসামী হতেই হত । সীমাবদ্ধ হওয়া সত্বেও এর ফলাফল আধুনিক সত্য সাহিত্যের পক্ষে যথেষ্ট ভালো হবে, মনে হয় ।
কৃতিত্ব সবটাই তোমার একার, তবু লেখক নামের যোগ্য সকলেই একে পুরস্কার বলে মনে করবে ও ভাগ করে নিতে চাইবে । ব্যক্তিগতভাবে আমি পুরস্কৃত হওয়ার আনন্দ পেয়েছি ।
                                                                                      প্রীতিসহ
                                                                                   সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

আবার ১৯৮৬ সালে সুমিতাভ ঘোষালের ‘গদ্যপদ্য সংবাদ’ পত্রিকায় পেণ্ডুলাম আরেক দিকে যেতে চাইলো।

“সে সময়ে আমাদের কেউই পাত্তা দিত না । তা যারা হাংরি আন্দোলন শুরু করে, সেই মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরী আমাকে জানান যে আমার লেখা ওদের ভালো লেগেছে, ওরা যে ধরণের লেখা ছাপাতে চায় তা নাকি আমার লেখায় ওরা দেখতে পেয়েছে, তাই আমার লেখা ওরা ছাপাতে চায় । ওদের কাছে পাত্তা পেয়ে আমি খুবই আহ্লাদিত হয়েছিলুম ।
হাংরি আন্দোলনের ইস্তাহার আমি অনেক পরে দেখেছি । সেসময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা গল্প আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল । বলতে গেলে সেই গল্পটার জন্যই আমি হাংরি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলুম । গল্পটার নাম আমার ঠিক মনে নেই । গল্পটা ছিল অনেকটা এইরকম -- একটা ছেলে, তার ভীষণ খিদে । একদিন ছাত্রীকে পড়াতে পড়াতে ছাত্রীর আঁচলের খুঁটটা খেতে শুরু করে । এইভাবে সে একটু একটু করে পুরো শাড়িটা খেয়ে ফ্যালে । এ ব্যাপারটায় সে বেশ মজা পেয়ে যায় । এর পর থেকে সে অনেক কিছুই খেতে শুরু করে । যেমন জানালা, চেয়ার, ছাপাখানা, নোটবুক ইত্যাদি । একদিন এক হোটেলের সান্ত্রীকে সে খেয়ে ফ্যালে । এই ছেলেটিই একদিন গঙ্গার ধারে তার প্রেমিকাকে নিয়ে বসেছিল । হঠাৎ তার সেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে । তখন সেই ছেলেটি গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জাহাজকে খেতে চায় । কিন্তু সেই ছেলেটি জাহাজটাকে খেতে পারে না । জাহাজটা ছেড়ে দেয় । তখন সেই ছেলেটি একটা চিরকুট গঙ্গায় ভাসিয়ে দ্যায় । সেটা ঠিক কার উদ্দেশে ভাসিয়েছিল তা জানা যায় না । ছেলেটির প্রেমিকার উদ্দেশ্যেও হতে পারে । পৃথিবীর উদ্দেশ্যেও হতে পারে । বা অন্য কিছুও হতে পারে । এখানেই গল্পটা শেষ । এই গল্পটা আমাকে সেসময়ে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং আমার মনে হয়েছে ক্ষুৎকাতর আন্দোলনের এটাই মূল কথা ।
আমি হারি আন্দোলনের সঙ্গে ভীষণভাবেই জড়িত ছিলাম । হাংরি আন্দোলনের আদর্শ -- আমার ভালো লেগেছিল, এবং আমি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম । এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই । কিন্তু পরের দিকে ওরা আমাকে না জানিয়ে আমার নামে পত্রিকা টত্রিকা বার করে । যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল ।
তখন আমি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । কিন্তু এই হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সুনীল আমেরিকায় । এই আন্দোলনকে সুনীলের অসাক্ষাতে একটা ক্যু বলতে পারা যায় ।
প্রতিষ্ঠানের লোভ আমার কোনোদিনই ছিল না । বাংলাদেশে যদি কেউ আগাগোড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভূমিকা পালন করে থাকে তবে তা আমি । আমার 'বিজনের রক্তমাংস' গল্পটি বেরোনোর পর থেকে আমার সে ভূমিকা অব্যাহত ।
আমি মনে করি ওরকমভাবে দল পাকিয়ে সাহিত্য হয় না । একজন লেখক নিজেই অতীত, নিজেই ভবিষ্যত, নিজেই সমাজ, নিজেই সভ্যতা, এবং নিজেই সবকিছু । সাহিত্য সৃষ্টিতে দলের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ।
আমি মুচলেকা দিয়েছিলাম তার দুটো কারণ । এক, আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই, আর দুই, আমার বউ আমাকে জেলে যেতে বারণ করেছিল । বউ বলল, যে একেই তো তোমার মতো মদ্যপকে বিয়ে করার জন্য আমার আত্মীয় পরিজনরা সব আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছে । তার ওপর তুমি যদি জেলে যাও তাহলে সোনায় সোহাগা হবে । সেই জন্যে আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করি ।”

গ্যালিলেও আগেই পেণ্ডুলামের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলে গেছেন, আমার নতুন কিছু বলার নেই ।
                                 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন