রবিবার

অনিল করঞ্জাই - সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অরূপ চৌধুরী -- হাংরি আন্দোলন থেকে যাবে মৃত্যুহীন, পরিসমাপ্তিহীন

                                                       Anil Karanjai
অরূপ : হাংরি জেনারেশন মুভমেন্টে আপনার ভূমিকা ঠিক কি রকম ছিল ?
অনিল : দ্যাখো, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ও সম্পর্কে একটু অন্যরকম । প্রাথমিক স্তরে প্রধানত বাংলা ভাষার হাংরি লেখালিখিকে হিন্দি সাহিত্যে অনুবাদের মধ্যে দিয়ে প্রচারিত করতে গিয়েই হাংরি লেখক-কবিদের সঙ্গে আমার পরিচয় গড়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে আন্দোলনের সঙ্গে আমি নিজস্ব নিয়তিকে জড়িয়ে ফেলি । এছাড়াও ছবি-আঁকিয়ে হিসেবে হাংরি আন্দোলনে আমার কিছু কিছু ভূমিকা ছিলই ।
অরূপ : হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে ঠিক কি ভাবে আপনার যোগাযোগ গড়ে ওঠে, অর্থাৎ সুলুক সন্ধান ঠিক কি ভাবে প্রথম আপনি খুঁজে পান ।
অনিল : আসলে হাংরি আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার অনেক আগে থেকেই দেশ-বিভাগের শিকার হয়ে আমরা চলে এসেছিলাম বেনারসে । তারপর ১৯৬২ সালে পাকাপাকিভাবে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সংগঠনমূলক একটা কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ি । কাজের জায়গা হিসেবে বেনারসকেই খুব স্বাভাবিক কারণে আমি বেছে নিয়েছিলাম । সে সময়ের অন্যান্য আরও কিছু বন্ধুবান্ধবের ভিতরে করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন । আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মদ্রোহিতা ও অন্যান্য কিছু সমাজ সংস্কারকে তীব্রভাবে আঘাত করা । এ ছাড়াও গ্রামেগঞ্জের সাধারণ মানুষজনের ভিতরে সরাসরি ঢুকে পড়ে কাজ করার মানসিকতাও আমরা আমাদের কার্যকলাপের ভিতরে প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলাম । ঠিক এরকম মানসিক অবস্হার ভিতরই সম্ভবত বাষট্টি সালের কোনো এক সময়ে  আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে যায় অ্যালেন গিন্সবার্গের । বারাণসী অবস্হানকালে আমাদের ডেরায় একদিন সশরীরে এসে হাজির হয়েছিলেন গিন্সবার্গ । এরপর মাঝে মাঝেই উনি আমাদের ডেরায় আসতে শুরু করেন, এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা চালাতে চালাতে আমরাও একধরণের সহমর্মীতা টের পেতে থাকি । এর কিছুদিনের মধ্যেই গিন্সবার্গ মারফত পাটনায় মলয়ের সঙ্গে আমাদের সখ্যতা গড়ে ওঠে । ধীরে ধীরে হাংরি আন্দোলনের অংশীদার হয়ে পড়ি ।
অরূপ : হাংরি আন্দোলনকে কি আপনি সার্থক সাহিত্য আন্দোলন বলে মনে করেন ?
অনিল : সার্থক কিনা জানি না, তবে সাহিত্য আন্দোলন তো বটেই, এবং তার উপরে আরও অনেক কিছু । এই আন্দোলন ছিল সমস্ত পৃথিবীজুড়ে এই শতাব্দির একটি সদর্থক, গভীর ও অর্থবহ আন্দোলন । যতোদিন পর্যন্ত এই কবন্ধ সমাজব্যবস্হা থাকবে, প্রতারণা থাকবে, ততদিন পর্যন্ত হাংরি চেতনাও থাকবে, এবং প্রয়োজন দেখা দিলে হাংরির বিরুদ্ধেই আবার হাংরি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে । শুধুমাত্র সাহিত্য আন্দোলনই হাংরি আন্দোলন নয় । সমগ্র আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক হলো হাংরি সাহিত্য আন্দোলন । হাংরি আন্দোলন ছিল একটি সার্বিক ও সর্বাত্মক আন্দোলন । রাজনীতি ও সমাজনীতিকে বাদ দিয়ে কখনও কোনো নিরপেক্ষ সাহিত্য আন্দোলন হয়নি । হতে পারে না । রাইফেলের ডগায় বসে থাকা প্রজাপতিকে নিয়ে সাহিত্য হয়তো নিশ্চয় করা যায়, কিন্তু তার থেকেও জরুরি প্রশ্ন যেটি, সেটি হলো রাইফেলটি যে হাত ধরে আছে, সেটা কার ?
অরূপ : হাংরি আন্দোলনের কোনো প্রভাব সেইসময়ে অথবা পরবর্তীকালীন লেখালিখির উপরে কোনো ছাপ ফেলতে পেরেছে বলে মনে হয় আপনার ?
অনিল : নিশ্চয় । হাংরি আন্দোলনের লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বড়ো রকমের ঝাঁকুনি দিয়েছিল । বেশ বড়ো রকমের একটা বদলের হাওয়া লক্ষ্য করা গিয়েছিল । অনেক ভাববাদী পোশাক-আশাক খসে পড়েছিল । এমনকি বিমল মিত্রের মতো লেখকদের লেখালিখির ধাঁচেও বেশ কিছু পরিবর্তনের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল । হিন্দি সাহিত্যের ভাষা ও রীতিনীতির ব্যাপারেও নতুন এক ধরণের  তরতাজা চিন্তা ভাবনা ক্রমশই চাগাড় দিয়ে উঠছিল । এবং সম্ভবত সেই প্রথম  ও শেষ  Time পত্রিকায় বেশ কিছুটা জায়গা দখল করে নিয়েছিল বাংলা সাহিত্য্। 
অরূপ : খুব হৈ-হল্লা শুরু হলেও এই আন্দোলনের পরমায়ু খুব সংক্ষিপ্ত । কেন ?
অনিল : দ্যাখো, সেভাবে ব্যাপারটাকে নিয়ে ভাবতে গেলে  বড়োজোর বলা যেতে পারে যে পৃথিবীর কোনো শিল্প আন্দোলনই খুব বেশিদিন টিকে থাকেনি । কিন্তু একটা কথা প্রসঙ্গক্রমে আমাদের মেনে নিতেই হবে যে, যে কোনো আন্দোলনেরই  ভাবধারা ও দর্শনেরই একটা দিক থাকে যা সুদূরপ্রসারী। যা পরবর্তী যুগ বা সময়ের ভিতরে  খুব গোপন চোরাটানের মতো মিশে যায় । আসলে সমস্ত আন্দোলনই  শেষ পর্যন্ত আমাদের মনুষ্যত্বের দিকে উঠে যাওয়ার এক একটা ধাপ বা সিঁড়ি। এই শতাব্দির প্রথম দিকে, তোমরা ভাবতে চেষ্টা করো, ডাডাবাদী আন্দোলনের কথা ।সময় হিসেবে এই আন্দোলনের স্হায়িত্ব বা জীবৎকাল  কী খুব দীর্ঘদিনের ?  কিন্তু সুররিয়ালিজম আন্দোলনকে একটা শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড় করিয়ে দেবার যে ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা ডাডা আন্দোলনের ছিল, তা ক আজ আর কোনোরকম ভাবেই আমরা অস্য়িকার করতে পারছি ? নিশ্চয় নয়, এবং সেই নিরিখেই আজ একথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গেই বলা যায় যে যতোদিন এই থুতুচাটা, কবন্ধ সমাজব্যবসস্হা  থাকবে, ততোদিন হাংরি আন্দোলন থেমে গেলেও, হাংরি দর্শন থেকে যাবে মৃত্যুহীন, পরিসমাপ্তিহীন ।
অরূপ : হাংরি দর্শনে আত্মকামীতা এবং আত্মপ্রচারের ভূমিকা কতোদূর ?
অনিল :  কিছুটা  আত্মপ্রচারমূলক তো বটেই । কোনো মতবাদ সাধারণত বিশেষ কোনো একজনের চিন্তাপ্রসূত হয় । সেই মতবা যখন প্রচারিত হতে থাকে, তখন তা তো আত্মপ্রচারমূলক হতে বাধ্য  । সে অর্থে দেখতে গেলে পৃথিবীর যেকোনো দর্শনই আত্মপ্রচারমূলক , এমনকি মার্কসবাদও । 
আসলে হাংরি দর্শন ছিল আমার আমিত্বের উথ্থান । আমরা আমাদের আমিত্বকে ছাল ছাড়িয়ে দেখাতে চেয়েছিলাম, জানতে দিতে চেয়েছিলাম । কম্যুনিকেশন সিস্টেমকে সমস্ত ছক থেকে মুক্ত করে আমরা আমাদের উপলব্ধ জ্ঞান ও বক্তব্যকে মেলে ধরতে, টাঙিয়ে দিতে চেয়েছিলাম ।
অরূপ : নকশাল আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব, এবং হাংরি আন্দোলন, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় সমসময়িক দুটো ঘটনা । এই দুটো ঘটনার ভিতরে  কোনো তাৎপর্যময় সম্পর্ক আছে বলে আপনি মনে করেন ?
অনিল : নিশ্চয় । আসলে সেই সময় ও পরিপ্রেক্ষিতের কথা ভাবলে, দুটো ঘতনার অনিবার্যতাই খুব পরিষ্কার হয়ে যায় । অবশ্যই কোনো ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নয়, তা ছিল ঐতিহাসিক পরম্পরা ও পরিপ্রেক্ষিতের দিক থেকে । তবে সাহিত্যৈ হাংরি আন্দোলন কিছুটা অগ্রবর্তী নিশ্চিত ।  
( সুমিতাভ ঘোষাল সম্পাদিত 'গদ্য-পদ্য সংবাদ' পত্রিকার অক্টোবর ১৯৮৬ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন