শনিবার

অরুণেশ ঘোষ-এর সাক্ষাৎকার - নিয়েছেন সুমিতাভ ঘোষাল - হাংরি আন্দোলন শেষ হতে পারে কিন্তু তার প্রবাহ শেষ হয়নি

সুমিতাভ : ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপনার কি ভূমিকা ছিল ?
অরুণেশ : ষাটের দশকের লেখকদের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি । কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে আমার অবস্হান । এদের কিছু লেখা পরে আমি পড়তে শুরু করি, অবশ্য তার আগে থেকেই আমি লিখতাম, আমার মতন লেখা । কৃত্তিবাসে আমি লেখা পাঠাই, খুব সম্ভব সেটা ১৯৬৯-৭০ । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গেই আমার প্রথম যোগাযোগ ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলনকে আদৌ একটা সাহিত্য আন্দোলন বলে আপনি মনে করেন ? বাংলা সাহিত্যের মূল ধারায় এর কি কোনো প্রতিচ্ছাপ পড়েছে ?
অরুণেশ : হাংরি লেখা নিশ্চয়ই সাহিত্য । কিন্তু প্রথাগত বাংলা লেখালিখি, এমনকি জীবনানন্দের থেকেও সম্পূর্ণ ভিন্নরকম বলে এখনও এই সাহিত্য মূলস্রোতের সাথে পুরোপুরি মিশে যেতে পারেনি । তবে এর একটা ছাপ পড়েছে এই সময়ের লেখালিখিতে । প্রবল ভাবেই পড়েছে । 
সুমিতাভ : ক্ষমতাবান বেশ কয়েকজন লেখক  এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও এই আন্দোলনের জীবৎকাল খুব অল্প । এর কি কি কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন ?
অরুণেশ : ( উত্তর দিতে অস্বীকার করেন )
সুমিতাভ : হাংরি লেখায় আত্মকামিতা এবং আত্মপ্রচারের ভূমিকা কতোদূর ?
অরুণেশ : আধুনিক সাহিত্যের বড়ো একটা দিক হল, নিজেকে নিয়ে লেখা । আত্মকামিতা নয়, আত্মউন্মোচন । পাঠক এ ধরণের লেখায় অভ্যস্ত নয় বলে খানিকটা ভুল বুঝতে পারেন । যাঁরা লিখতে এসেছেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ আত্মউন্মোচনের চেয়ে নিজেকে নিয়ে আস্ফালন করে ফেলেন বেশি । সেটাই একটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায় ।
সুমিতাভ : নকশাল আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব এবং হাংরি আন্দোলন মোটামুটি সমসাময়িক । এর কোনো তাৎপর্য আছে বলে আপনার মনে হয় ।
অরুণেশ : নকশাল আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক । হাংরি আন্দোলন সাহিত্যিক। মূলত কবিতার ক্ষেত্রে । তবে দুটোর সঙ্গে মিল যেখানে, সেটা হল পূর্ববর্তিদের প্রতি বিতৃষ্ণা, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও পরিবর্তন ঘটাবার সক্রিয়তা । যেমন রাজনীতিতে, তেমনি সাহিত্যেও কিছ ভণ্ড, অক্ষম ও লোলুপ ব্যক্তিরা জাঁকিয়ে বসেছিল । তরুণরা এদের বর্জন করেছে ঘৃণায় । হাংরি আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনের আগেই শুরু হয় । কেউ কেউ মনে করেন, হাংরি আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে নকশাল আন্দোলনে । কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়, আংশিক সত্য । নকশালরা চেয়েছে মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, হাংরিদের কাম্য ছিল সার্বিক স্বাধীনতা ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার কমবেশি পঁচিশ বছর পর আবার একটা ক্ষুৎকাতর আবহাওয়া চোখে পড়ছে । এর কারণ কী ?
অরুণেশ : হাংরি আন্দোলন শেষ হতে পারে কিন্তু তার প্রবাহ শেষ হয়নি, তার স্পিরিট বহমান । এর পাশাপাশি আর কোনো শক্তিশালী আন্দোলন নেই । আছে একদিকে প্যানপ্যানানি সাহিত্য, অন্যদিকে পণ্য-সাহিত্য । বোঝাই যায়, এই অবস্হায় তরুণরা হাংরি পথকেই তুলনামূলকভাবে সৎ ও সঠিক মনে করবে । তবে একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আগের চিৎকার এখন আর নেই ।  এখন সৃষ্টির মধ্য দিয়েই প্রথা আর প্রতিষ্ঠানবিরোধী হতে হবে, সৃষ্টির বাইরে গিয়ে নয়  -- এই বোধটা যেন এসেছে । এটা ভাল লক্ষণ। আবার হাংরিদের অনুকরণ করতে গিয়ে যে কিছু বাজে লেখা হচ্ছে, সেটাও সত্য । অবশ্য এসব ঝরে যাবে ।
( সুমিতাভ ঘোষাল  সম্পাদিত 'গদ্যপদ্য সংবাদ' অক্টোবর ১৯৮৬ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত ।
                                 
                                        Arunesh Ghosh

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন