সোমবার
Hungryalist bulletin No 65 published in 1963
Letter written by Binoy Majumdar to Chief Minister, West Bengal.
রবিবার
হাংরি আন্দোলনের পত্রিকা "ওয়েস্ট পেপার" ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত । Hungryalist magazine WASTE PAPER edited by Tridib Mitra
Hungryalist poet Tridib Mitra's poem PROLAP DUHKHO. হাংরি আন্দোলনের কবি ত্রিদিব মিত্রের কাব্যগ্রণ্হ "প্রলাপ দুঃখ"
A collection of poems titled GHULGHULI by Hungryalist poet Tridib Mitra. হাংরি আন্দোলনের কবি ত্রিদিব মিত্র লিখিত "ঘুলঘুলি"
হাংরি আন্দোলনের কবি ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত "উন্মার্গ" UNMARGA magazine edited by Tridib Mitra and his girlfriend Alo Mitra
"UNMARGA" edited by Hungryalist poet Tridib Mitra. হাংরি আন্দোলনের কবি ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত 'উন্মার্গ'
শনিবার
বিতর্কিত হাংরি বুলেটিন ও দণ্ডাদেশ - Controversial Hungry Generation bulletin and sentence against Malay Roychoudhury.
হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের এই বুলেটিনটির জন্য হাংরি মামলা হয়েছিল । এগারোজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোয় । পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে । শেষপর্যন্ত কেবল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যাংকশাল কোর্টে মামলা হয় এবং তিনি দণ্ডিত হন, একমাসের কারাদণ্ড । মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ । পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হন উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায় । মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিৎ দত্ত । হাইকোর্টে মলয়ের দণ্ডাদেশ নাকচ করে দেয় ।
বৃহস্পতিবার
হাংরি আন্দোলনের তথ্যসমৃদ্ধ বই -- প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত
বিল মরগ্যান এই গ্রন্হে হাংরি আন্দোলন কোর্ট কেসের আলোচনা করেছেন
রবিবার
অনিল করঞ্জাই - সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অরূপ চৌধুরী -- হাংরি আন্দোলন থেকে যাবে মৃত্যুহীন, পরিসমাপ্তিহীন
Anil Karanjai
অরূপ : হাংরি জেনারেশন মুভমেন্টে আপনার ভূমিকা ঠিক কি রকম ছিল ?
অনিল : দ্যাখো, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ও সম্পর্কে একটু অন্যরকম । প্রাথমিক স্তরে প্রধানত বাংলা ভাষার হাংরি লেখালিখিকে হিন্দি সাহিত্যে অনুবাদের মধ্যে দিয়ে প্রচারিত করতে গিয়েই হাংরি লেখক-কবিদের সঙ্গে আমার পরিচয় গড়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে আন্দোলনের সঙ্গে আমি নিজস্ব নিয়তিকে জড়িয়ে ফেলি । এছাড়াও ছবি-আঁকিয়ে হিসেবে হাংরি আন্দোলনে আমার কিছু কিছু ভূমিকা ছিলই ।
অরূপ : হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে ঠিক কি ভাবে আপনার যোগাযোগ গড়ে ওঠে, অর্থাৎ সুলুক সন্ধান ঠিক কি ভাবে প্রথম আপনি খুঁজে পান ।
অনিল : আসলে হাংরি আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার অনেক আগে থেকেই দেশ-বিভাগের শিকার হয়ে আমরা চলে এসেছিলাম বেনারসে । তারপর ১৯৬২ সালে পাকাপাকিভাবে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সংগঠনমূলক একটা কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ি । কাজের জায়গা হিসেবে বেনারসকেই খুব স্বাভাবিক কারণে আমি বেছে নিয়েছিলাম । সে সময়ের অন্যান্য আরও কিছু বন্ধুবান্ধবের ভিতরে করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন । আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মদ্রোহিতা ও অন্যান্য কিছু সমাজ সংস্কারকে তীব্রভাবে আঘাত করা । এ ছাড়াও গ্রামেগঞ্জের সাধারণ মানুষজনের ভিতরে সরাসরি ঢুকে পড়ে কাজ করার মানসিকতাও আমরা আমাদের কার্যকলাপের ভিতরে প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলাম । ঠিক এরকম মানসিক অবস্হার ভিতরই সম্ভবত বাষট্টি সালের কোনো এক সময়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে যায় অ্যালেন গিন্সবার্গের । বারাণসী অবস্হানকালে আমাদের ডেরায় একদিন সশরীরে এসে হাজির হয়েছিলেন গিন্সবার্গ । এরপর মাঝে মাঝেই উনি আমাদের ডেরায় আসতে শুরু করেন, এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা চালাতে চালাতে আমরাও একধরণের সহমর্মীতা টের পেতে থাকি । এর কিছুদিনের মধ্যেই গিন্সবার্গ মারফত পাটনায় মলয়ের সঙ্গে আমাদের সখ্যতা গড়ে ওঠে । ধীরে ধীরে হাংরি আন্দোলনের অংশীদার হয়ে পড়ি ।
অরূপ : হাংরি আন্দোলনকে কি আপনি সার্থক সাহিত্য আন্দোলন বলে মনে করেন ?
অনিল : সার্থক কিনা জানি না, তবে সাহিত্য আন্দোলন তো বটেই, এবং তার উপরে আরও অনেক কিছু । এই আন্দোলন ছিল সমস্ত পৃথিবীজুড়ে এই শতাব্দির একটি সদর্থক, গভীর ও অর্থবহ আন্দোলন । যতোদিন পর্যন্ত এই কবন্ধ সমাজব্যবস্হা থাকবে, প্রতারণা থাকবে, ততদিন পর্যন্ত হাংরি চেতনাও থাকবে, এবং প্রয়োজন দেখা দিলে হাংরির বিরুদ্ধেই আবার হাংরি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে । শুধুমাত্র সাহিত্য আন্দোলনই হাংরি আন্দোলন নয় । সমগ্র আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক হলো হাংরি সাহিত্য আন্দোলন । হাংরি আন্দোলন ছিল একটি সার্বিক ও সর্বাত্মক আন্দোলন । রাজনীতি ও সমাজনীতিকে বাদ দিয়ে কখনও কোনো নিরপেক্ষ সাহিত্য আন্দোলন হয়নি । হতে পারে না । রাইফেলের ডগায় বসে থাকা প্রজাপতিকে নিয়ে সাহিত্য হয়তো নিশ্চয় করা যায়, কিন্তু তার থেকেও জরুরি প্রশ্ন যেটি, সেটি হলো রাইফেলটি যে হাত ধরে আছে, সেটা কার ?
অরূপ : হাংরি আন্দোলনের কোনো প্রভাব সেইসময়ে অথবা পরবর্তীকালীন লেখালিখির উপরে কোনো ছাপ ফেলতে পেরেছে বলে মনে হয় আপনার ?
অনিল : নিশ্চয় । হাংরি আন্দোলনের লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বড়ো রকমের ঝাঁকুনি দিয়েছিল । বেশ বড়ো রকমের একটা বদলের হাওয়া লক্ষ্য করা গিয়েছিল । অনেক ভাববাদী পোশাক-আশাক খসে পড়েছিল । এমনকি বিমল মিত্রের মতো লেখকদের লেখালিখির ধাঁচেও বেশ কিছু পরিবর্তনের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল । হিন্দি সাহিত্যের ভাষা ও রীতিনীতির ব্যাপারেও নতুন এক ধরণের তরতাজা চিন্তা ভাবনা ক্রমশই চাগাড় দিয়ে উঠছিল । এবং সম্ভবত সেই প্রথম ও শেষ Time পত্রিকায় বেশ কিছুটা জায়গা দখল করে নিয়েছিল বাংলা সাহিত্য্।
অরূপ : খুব হৈ-হল্লা শুরু হলেও এই আন্দোলনের পরমায়ু খুব সংক্ষিপ্ত । কেন ?
অনিল : দ্যাখো, সেভাবে ব্যাপারটাকে নিয়ে ভাবতে গেলে বড়োজোর বলা যেতে পারে যে পৃথিবীর কোনো শিল্প আন্দোলনই খুব বেশিদিন টিকে থাকেনি । কিন্তু একটা কথা প্রসঙ্গক্রমে আমাদের মেনে নিতেই হবে যে, যে কোনো আন্দোলনেরই ভাবধারা ও দর্শনেরই একটা দিক থাকে যা সুদূরপ্রসারী। যা পরবর্তী যুগ বা সময়ের ভিতরে খুব গোপন চোরাটানের মতো মিশে যায় । আসলে সমস্ত আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত আমাদের মনুষ্যত্বের দিকে উঠে যাওয়ার এক একটা ধাপ বা সিঁড়ি। এই শতাব্দির প্রথম দিকে, তোমরা ভাবতে চেষ্টা করো, ডাডাবাদী আন্দোলনের কথা ।সময় হিসেবে এই আন্দোলনের স্হায়িত্ব বা জীবৎকাল কী খুব দীর্ঘদিনের ? কিন্তু সুররিয়ালিজম আন্দোলনকে একটা শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড় করিয়ে দেবার যে ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা ডাডা আন্দোলনের ছিল, তা ক আজ আর কোনোরকম ভাবেই আমরা অস্য়িকার করতে পারছি ? নিশ্চয় নয়, এবং সেই নিরিখেই আজ একথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গেই বলা যায় যে যতোদিন এই থুতুচাটা, কবন্ধ সমাজব্যবসস্হা থাকবে, ততোদিন হাংরি আন্দোলন থেমে গেলেও, হাংরি দর্শন থেকে যাবে মৃত্যুহীন, পরিসমাপ্তিহীন ।
অরূপ : হাংরি দর্শনে আত্মকামীতা এবং আত্মপ্রচারের ভূমিকা কতোদূর ?
অনিল : কিছুটা আত্মপ্রচারমূলক তো বটেই । কোনো মতবাদ সাধারণত বিশেষ কোনো একজনের চিন্তাপ্রসূত হয় । সেই মতবা যখন প্রচারিত হতে থাকে, তখন তা তো আত্মপ্রচারমূলক হতে বাধ্য । সে অর্থে দেখতে গেলে পৃথিবীর যেকোনো দর্শনই আত্মপ্রচারমূলক , এমনকি মার্কসবাদও ।
আসলে হাংরি দর্শন ছিল আমার আমিত্বের উথ্থান । আমরা আমাদের আমিত্বকে ছাল ছাড়িয়ে দেখাতে চেয়েছিলাম, জানতে দিতে চেয়েছিলাম । কম্যুনিকেশন সিস্টেমকে সমস্ত ছক থেকে মুক্ত করে আমরা আমাদের উপলব্ধ জ্ঞান ও বক্তব্যকে মেলে ধরতে, টাঙিয়ে দিতে চেয়েছিলাম ।
অরূপ : নকশাল আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব, এবং হাংরি আন্দোলন, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় সমসময়িক দুটো ঘটনা । এই দুটো ঘটনার ভিতরে কোনো তাৎপর্যময় সম্পর্ক আছে বলে আপনি মনে করেন ?
অনিল : নিশ্চয় । আসলে সেই সময় ও পরিপ্রেক্ষিতের কথা ভাবলে, দুটো ঘতনার অনিবার্যতাই খুব পরিষ্কার হয়ে যায় । অবশ্যই কোনো ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নয়, তা ছিল ঐতিহাসিক পরম্পরা ও পরিপ্রেক্ষিতের দিক থেকে । তবে সাহিত্যৈ হাংরি আন্দোলন কিছুটা অগ্রবর্তী নিশ্চিত ।
( সুমিতাভ ঘোষাল সম্পাদিত 'গদ্য-পদ্য সংবাদ' পত্রিকার অক্টোবর ১৯৮৬ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত )
অরূপ : হাংরি জেনারেশন মুভমেন্টে আপনার ভূমিকা ঠিক কি রকম ছিল ?
অনিল : দ্যাখো, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ও সম্পর্কে একটু অন্যরকম । প্রাথমিক স্তরে প্রধানত বাংলা ভাষার হাংরি লেখালিখিকে হিন্দি সাহিত্যে অনুবাদের মধ্যে দিয়ে প্রচারিত করতে গিয়েই হাংরি লেখক-কবিদের সঙ্গে আমার পরিচয় গড়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে আন্দোলনের সঙ্গে আমি নিজস্ব নিয়তিকে জড়িয়ে ফেলি । এছাড়াও ছবি-আঁকিয়ে হিসেবে হাংরি আন্দোলনে আমার কিছু কিছু ভূমিকা ছিলই ।
অরূপ : হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে ঠিক কি ভাবে আপনার যোগাযোগ গড়ে ওঠে, অর্থাৎ সুলুক সন্ধান ঠিক কি ভাবে প্রথম আপনি খুঁজে পান ।
অনিল : আসলে হাংরি আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার অনেক আগে থেকেই দেশ-বিভাগের শিকার হয়ে আমরা চলে এসেছিলাম বেনারসে । তারপর ১৯৬২ সালে পাকাপাকিভাবে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সংগঠনমূলক একটা কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ি । কাজের জায়গা হিসেবে বেনারসকেই খুব স্বাভাবিক কারণে আমি বেছে নিয়েছিলাম । সে সময়ের অন্যান্য আরও কিছু বন্ধুবান্ধবের ভিতরে করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন । আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মদ্রোহিতা ও অন্যান্য কিছু সমাজ সংস্কারকে তীব্রভাবে আঘাত করা । এ ছাড়াও গ্রামেগঞ্জের সাধারণ মানুষজনের ভিতরে সরাসরি ঢুকে পড়ে কাজ করার মানসিকতাও আমরা আমাদের কার্যকলাপের ভিতরে প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলাম । ঠিক এরকম মানসিক অবস্হার ভিতরই সম্ভবত বাষট্টি সালের কোনো এক সময়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে যায় অ্যালেন গিন্সবার্গের । বারাণসী অবস্হানকালে আমাদের ডেরায় একদিন সশরীরে এসে হাজির হয়েছিলেন গিন্সবার্গ । এরপর মাঝে মাঝেই উনি আমাদের ডেরায় আসতে শুরু করেন, এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা চালাতে চালাতে আমরাও একধরণের সহমর্মীতা টের পেতে থাকি । এর কিছুদিনের মধ্যেই গিন্সবার্গ মারফত পাটনায় মলয়ের সঙ্গে আমাদের সখ্যতা গড়ে ওঠে । ধীরে ধীরে হাংরি আন্দোলনের অংশীদার হয়ে পড়ি ।
অরূপ : হাংরি আন্দোলনকে কি আপনি সার্থক সাহিত্য আন্দোলন বলে মনে করেন ?
অনিল : সার্থক কিনা জানি না, তবে সাহিত্য আন্দোলন তো বটেই, এবং তার উপরে আরও অনেক কিছু । এই আন্দোলন ছিল সমস্ত পৃথিবীজুড়ে এই শতাব্দির একটি সদর্থক, গভীর ও অর্থবহ আন্দোলন । যতোদিন পর্যন্ত এই কবন্ধ সমাজব্যবস্হা থাকবে, প্রতারণা থাকবে, ততদিন পর্যন্ত হাংরি চেতনাও থাকবে, এবং প্রয়োজন দেখা দিলে হাংরির বিরুদ্ধেই আবার হাংরি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে । শুধুমাত্র সাহিত্য আন্দোলনই হাংরি আন্দোলন নয় । সমগ্র আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক হলো হাংরি সাহিত্য আন্দোলন । হাংরি আন্দোলন ছিল একটি সার্বিক ও সর্বাত্মক আন্দোলন । রাজনীতি ও সমাজনীতিকে বাদ দিয়ে কখনও কোনো নিরপেক্ষ সাহিত্য আন্দোলন হয়নি । হতে পারে না । রাইফেলের ডগায় বসে থাকা প্রজাপতিকে নিয়ে সাহিত্য হয়তো নিশ্চয় করা যায়, কিন্তু তার থেকেও জরুরি প্রশ্ন যেটি, সেটি হলো রাইফেলটি যে হাত ধরে আছে, সেটা কার ?
অরূপ : হাংরি আন্দোলনের কোনো প্রভাব সেইসময়ে অথবা পরবর্তীকালীন লেখালিখির উপরে কোনো ছাপ ফেলতে পেরেছে বলে মনে হয় আপনার ?
অনিল : নিশ্চয় । হাংরি আন্দোলনের লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বড়ো রকমের ঝাঁকুনি দিয়েছিল । বেশ বড়ো রকমের একটা বদলের হাওয়া লক্ষ্য করা গিয়েছিল । অনেক ভাববাদী পোশাক-আশাক খসে পড়েছিল । এমনকি বিমল মিত্রের মতো লেখকদের লেখালিখির ধাঁচেও বেশ কিছু পরিবর্তনের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল । হিন্দি সাহিত্যের ভাষা ও রীতিনীতির ব্যাপারেও নতুন এক ধরণের তরতাজা চিন্তা ভাবনা ক্রমশই চাগাড় দিয়ে উঠছিল । এবং সম্ভবত সেই প্রথম ও শেষ Time পত্রিকায় বেশ কিছুটা জায়গা দখল করে নিয়েছিল বাংলা সাহিত্য্।
অরূপ : খুব হৈ-হল্লা শুরু হলেও এই আন্দোলনের পরমায়ু খুব সংক্ষিপ্ত । কেন ?
অনিল : দ্যাখো, সেভাবে ব্যাপারটাকে নিয়ে ভাবতে গেলে বড়োজোর বলা যেতে পারে যে পৃথিবীর কোনো শিল্প আন্দোলনই খুব বেশিদিন টিকে থাকেনি । কিন্তু একটা কথা প্রসঙ্গক্রমে আমাদের মেনে নিতেই হবে যে, যে কোনো আন্দোলনেরই ভাবধারা ও দর্শনেরই একটা দিক থাকে যা সুদূরপ্রসারী। যা পরবর্তী যুগ বা সময়ের ভিতরে খুব গোপন চোরাটানের মতো মিশে যায় । আসলে সমস্ত আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত আমাদের মনুষ্যত্বের দিকে উঠে যাওয়ার এক একটা ধাপ বা সিঁড়ি। এই শতাব্দির প্রথম দিকে, তোমরা ভাবতে চেষ্টা করো, ডাডাবাদী আন্দোলনের কথা ।সময় হিসেবে এই আন্দোলনের স্হায়িত্ব বা জীবৎকাল কী খুব দীর্ঘদিনের ? কিন্তু সুররিয়ালিজম আন্দোলনকে একটা শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড় করিয়ে দেবার যে ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা ডাডা আন্দোলনের ছিল, তা ক আজ আর কোনোরকম ভাবেই আমরা অস্য়িকার করতে পারছি ? নিশ্চয় নয়, এবং সেই নিরিখেই আজ একথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গেই বলা যায় যে যতোদিন এই থুতুচাটা, কবন্ধ সমাজব্যবসস্হা থাকবে, ততোদিন হাংরি আন্দোলন থেমে গেলেও, হাংরি দর্শন থেকে যাবে মৃত্যুহীন, পরিসমাপ্তিহীন ।
অরূপ : হাংরি দর্শনে আত্মকামীতা এবং আত্মপ্রচারের ভূমিকা কতোদূর ?
অনিল : কিছুটা আত্মপ্রচারমূলক তো বটেই । কোনো মতবাদ সাধারণত বিশেষ কোনো একজনের চিন্তাপ্রসূত হয় । সেই মতবা যখন প্রচারিত হতে থাকে, তখন তা তো আত্মপ্রচারমূলক হতে বাধ্য । সে অর্থে দেখতে গেলে পৃথিবীর যেকোনো দর্শনই আত্মপ্রচারমূলক , এমনকি মার্কসবাদও ।
আসলে হাংরি দর্শন ছিল আমার আমিত্বের উথ্থান । আমরা আমাদের আমিত্বকে ছাল ছাড়িয়ে দেখাতে চেয়েছিলাম, জানতে দিতে চেয়েছিলাম । কম্যুনিকেশন সিস্টেমকে সমস্ত ছক থেকে মুক্ত করে আমরা আমাদের উপলব্ধ জ্ঞান ও বক্তব্যকে মেলে ধরতে, টাঙিয়ে দিতে চেয়েছিলাম ।
অরূপ : নকশাল আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব, এবং হাংরি আন্দোলন, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় সমসময়িক দুটো ঘটনা । এই দুটো ঘটনার ভিতরে কোনো তাৎপর্যময় সম্পর্ক আছে বলে আপনি মনে করেন ?
অনিল : নিশ্চয় । আসলে সেই সময় ও পরিপ্রেক্ষিতের কথা ভাবলে, দুটো ঘতনার অনিবার্যতাই খুব পরিষ্কার হয়ে যায় । অবশ্যই কোনো ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নয়, তা ছিল ঐতিহাসিক পরম্পরা ও পরিপ্রেক্ষিতের দিক থেকে । তবে সাহিত্যৈ হাংরি আন্দোলন কিছুটা অগ্রবর্তী নিশ্চিত ।
( সুমিতাভ ঘোষাল সম্পাদিত 'গদ্য-পদ্য সংবাদ' পত্রিকার অক্টোবর ১৯৮৬ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত )
শনিবার
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুমিতাভ ঘোষাল - হাংরি আন্দোলন - সাহিত্যের জন্য কাউকে আদালতে শাস্তি দেওয়া হবে তা আমি সমর্থনযোগ্য মনে করি না
সুমিতাভ : ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আপনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ কতোটা ?
সুনীল : হাংরি আন্দোলনে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না । আমি তখন কৃত্তিবাস নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা করতুম । কৃত্তিবাসের থেকে কয়েকজন এই আন্দোলন শুরু করে । এদের মধ্যে প্রধান ভূমিকা প্রথমে নিয়েছি মলয় রায়চৌধুরী, সে ছিল আমার বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর ছোটো ভাই । সমীর রায়চৌধুরী কৃত্তিবাসের একজন লেখক এবং ওই গোষ্ঠীরই একজন । মলয়েরও কিছু কিছু লেখা কৃত্তিবাসে বেরিয়েছিল ।
সুমিতাভ : আচ্ছা শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো... ( কথায় বাধা দিয়ে )
সুনীল : হ্যাঁ, তারপরে মলয় প্রথমে শুরু করার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাতে যোগ দেয় এবং পরে উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকে আসেন ( ? ) । এইভাবে হাংরি আন্দোলন শুরু হয় । কিন্তু এই আন্দোলনের কোনো ইস্তাহার বা কোনো ব্যাপারে আমার কোনো নাম ছিল না বা আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলনকে কি আপনি একটা আদৌ সাহিত্য আন্দোলন বলে মনে করেন ?
সুনীল : হাংরি আন্দোলন তো সাহিত্যের আন্দোলন হিসেবেই শুরু হয়েছিল । কতোটা সাহিত্য তারা সৃষ্টি করতে পেরেছিল, সে বিষয়ে আমি কোনো মতামত দেব না । সেটা এখনকার যারা পাঠক তারাই বিচার করবে । তবে নতুন কোনো একটা সাহিত্য তারা সৃষ্টি করতে পেরেছিল এটা ঠিক ।
সুমিতাভ : তখনকার সাহিত্যে এই আন্দোলনের কোনো প্রতিচ্ছবি পড়েছিল কি?
সুনীল : দুটো ব্যাপার হয়েছিল । একটা হয়েছিল কী হাংরি আন্দোলনের যারা প্রধান তারা কিছু কিছু পত্র পত্রিকায় লিফলেট ইত্যাদি ছাপাতে শুরু করে । এই সাহিত্যকে বদলাতে হবে ; অন্যরকম সাহিত্য সৃষ্টি করে পুরোনো মূল্যবোধকে নষ্ট করে দিতে হবে ইত্যাদি ।
সুমিতাভ : না, সাহিত্যে এর কোনো প্রতিচ্ছাপ পড়েছে কি ?
সুনীল : না । আমি বলব সাহিত্যে এর কোনো ছাপ পড়েছে বলে আমি মনে করি না । তবে এটা একটা গোষ্ঠী, অন্যরকম সাহিত্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল । তবে অ্যাবরাপ্টলি এই আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায় । তবে এতোদিন বাদে আবার সেসব নিয়ে আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি । মাঝখানে দশ বছর হাংরিদের সম্পর্কে কথাবার্তা শুনিনি । ( এই দশ বছর মলয় রায়চৌধুরী কলকাতার সাহিত্য জগতের বাইরে ছিলেন, বুলেটিন প্রকাশ করার জন্য টাকা তিনিই দিতেন )।
সুমিতাভ : ট্রাডিশানাল বাংলা সাহিত্যকে কোনোভাবেই এরা একটুও বদলাতে পেরেছিল কি ?
সুনীল : সেটা তো আমি বলতে ওপারব না । হাংরিদের যারা প্রথান, যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, এরা হাংরি আন্দোলনের মাঝামাঝি অবস্হায় এর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান । যখন এই নিয়ে কোর্টে কেস হয়, তখন এরা বিবৃতি দেয় যে, আমাদের সঙ্গে হাংরির কোনো সম্পর্ক নেই । ওদের লেখা আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্যের মূল ধারার সঙ্গেই যুক্ত । আলাদাভাবে হাংরি আন্দোলনের কোনো প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি না ।
সুমিতাভ : ক্ষমতাবান বেশ কছু লেখক থাকা সত্ত্বেও, হাংরি আন্দোলনের জীবৎকাল খুব অল্প । এর কারণ কি ?
সুনীল : ক্ষমতাবান লেখকরা প্রথমে তাড়াতাড়ি সরে গেলেন । দ্বিতীয় কথা, এরা সিরিয়াসলি সাহিত্য রচনা করার বদলে এমন কিছু কাজ করতে লাগলেন, যেগুলো অনেকেরই বিরক্তি উদ্রেক করলো । যেমন ধরো এরা কাউকে জুতোর মালা পাঠিয়ে দিল । কাউকে একটা মুখোশ পাঠিয়ে দিল । বা কাউকে টেলিফোন করে বলল, আপনার ছেলে মারা গেছে, বাড়ি চলে যান । এইভাবে কিছু কিছু অল্প বয়সের চ্যাংড়ামি --- এটা অনেকেই করে, অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু এটাই যেন প্রধান হয়ে দাঁড়াল । লেখার মধ্যে তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করার করার জন্য অযথা এবং অকারণ অশ্লীলতা আনার চেষ্টা করল । আমি অবশ্য কোনো শব্দকেই অশ্লীল বলে মনে করি না । তথাকথিত অশ্লীলতা, তথাকথিত অশ্লীল শব্দ । বা আরেকটা ছিল, অন্যকে গালাগালি দেওয়া । এই সমস্ত দিকেই যেন তাদের মন বেশি গেল । অবশ্য অন্য লোকের অন্য মত থাকতে পারে ।
সুমিতাভ : হাংরি লেখাগুলোতে আত্মকামিতা জিনিসটার কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে করেন ?
সুনীল : তা, আত্মকামীতা মানে ধরো, আমরা কৃত্তিবাসে যেটা বলতাম, যে নতুন আধুনিক সাহিত্য বলতে আমরা কী বুঝতাম ?তখন আমরা বলতাম যে কৃত্তিবাসের মূল সুর হচ্ছে কনফেশন । স্বীকারোক্তিমূলক লেখা । আমরা যেভাবে জীবন যাপন করছি সাহিত্যে সেটাকে ঠিক সেভাবেই স্বীকার করে নেওয়া দরকার । হাংরিরা হয়তো তার থেকেও আরো এক্সট্রিম-এ চলে গিয়েছিল । তারা, যাকে বলে আত্মকণ্ডূয়ন, সেটার দিকে চলে গিয়েছিল । তবে আমার মনে হয় হাংরি আন্দোলনের মূল সুর কৃত্তিবাস ধারারই একটা অঙ্গ ।
সুমিতাভ : নকশাল আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব, আর হাংরি আন্দোলন, মোটামুটি সমসাময়িক । এর কোনো বিশেষ তাৎপর্য আছে বলে আপনি মনে করেন ?
সুনীল : হাংরি আন্দোলনের মধ্যে রাজনীতি কিছু ছিল না । তবে ক্ষুধার ব্যাপারটা ছিল । তবে সেটা খাদ্য অভাবের যে ক্ষুধা, তা নয় বোধহয় । এটা বোধহয় অন্য কোনো ক্ষুধার কথা ওরা বলতে চেয়েছিল । নকশাল আন্দোলন অনেক ব্যাপক, অনেক মহৎ আত্মত্যাগ আছে । হাংরি আন্দোলন সেরকম কিছু একটা নয় ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার কম-বেশি পঁচিশ বছর পর, আবার একটা ক্ষুৎকাতর আবহাওয়া, বিশেষত ছোটো পত্র-পত্রিকাগুলোয় চোখে পড়ছে । এরকমটা কেন হচ্ছে বলতে পারেন ?
সুনীল : সেরকম কোনো আবহাওয়া আমার চোখে পড়ছে না । যা চোখে পড়ছে তা হলো হাংরিদের নিয়ে আবার লেখালিখি শুরু হয়েছে । কোনো কোনো পত্রিকায় এদের কেস টেস ছাপা হচ্ছে, হিস্ট্রিটাও ছাপা হয়েছে। মলয় রায়চৌধুরীকে বহুদিন নীরবতার পর আবার লেখালিখি করতে দেখছি
সুমিতাভ : সেটা এতদিন পরে হঠাৎ কি কারণে ?
সুনীল : আলাদা কোনো কারণ নেই । এটা নেহাতই কলকাতার ব্যাপার ।
সুমিতাভ : ধন্যবাদ । আমরা তাহলে উঠি...
সুনীল : তবে এটা বলছি, আমার সঙ্গে হাংরিদের সম্পর্ক এই যে আমি তাদের কোনো পত্র-পত্রিকায় লিখিনি । তাদের সঙ্গে আমার কোনো মানসিক মিলও ছিল না । আন্দোলনেও অংশ নিইনি । তবে যখন মামলা হয়, তখন আমার কাছে মলয় রায়চৌধুরী এসেছিল, যেন আমি তার হয়ে সাক্ষ্য দিই । আমি তার পক্ষেই সাক্ষ্য দিয়েছি । আদালতে দাঁড়িয়ে আমি বলেছিলুম, মলয় রায়চৌধুরীর কোনো কবিতায় আমি কোনো অশ্লীলতা খুঁজে পাইনি । আদালতে এটাই আমার সাক্ষ্য ছিল ।
সুমিতাভ : সেটা আপনি স্নেহের বশে করেছিলেন, না নিজের বিশ্বাসে ?
সুনীল : আমি পরে মলয়কে বাড়িতে বলেছিলাম, দেখ তোমার কোনো কবিতাকে যদিও আমি সার্থক কবিতা বলে মনে করি না, কিন্তু কেউ একটা কবিতার মধ্যে কিছি অশ্লীল শব্দ লিখেছে বলে তাকে আদালতে ডেকে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে, সেটাও আমি সমর্থনযোগ্য মনে করি না । সাহিত্যের জন্য শাস্তিদানের কোনো ঘটনা যদি ঘটে, তবে আমি সবসময় অভিযুক্তের পক্ষেই থাকব ।
( সুমিতাভ ঘোষাল সম্পাদিত 'গদ্য-পদ্য সংবাদ' পত্রিকার অক্টোবর ১৯৮৬ সংখ্যায় প্রকাশিত )
সুনীল : হাংরি আন্দোলনে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না । আমি তখন কৃত্তিবাস নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা করতুম । কৃত্তিবাসের থেকে কয়েকজন এই আন্দোলন শুরু করে । এদের মধ্যে প্রধান ভূমিকা প্রথমে নিয়েছি মলয় রায়চৌধুরী, সে ছিল আমার বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর ছোটো ভাই । সমীর রায়চৌধুরী কৃত্তিবাসের একজন লেখক এবং ওই গোষ্ঠীরই একজন । মলয়েরও কিছু কিছু লেখা কৃত্তিবাসে বেরিয়েছিল ।
সুমিতাভ : আচ্ছা শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো... ( কথায় বাধা দিয়ে )
সুনীল : হ্যাঁ, তারপরে মলয় প্রথমে শুরু করার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাতে যোগ দেয় এবং পরে উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকে আসেন ( ? ) । এইভাবে হাংরি আন্দোলন শুরু হয় । কিন্তু এই আন্দোলনের কোনো ইস্তাহার বা কোনো ব্যাপারে আমার কোনো নাম ছিল না বা আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলনকে কি আপনি একটা আদৌ সাহিত্য আন্দোলন বলে মনে করেন ?
সুনীল : হাংরি আন্দোলন তো সাহিত্যের আন্দোলন হিসেবেই শুরু হয়েছিল । কতোটা সাহিত্য তারা সৃষ্টি করতে পেরেছিল, সে বিষয়ে আমি কোনো মতামত দেব না । সেটা এখনকার যারা পাঠক তারাই বিচার করবে । তবে নতুন কোনো একটা সাহিত্য তারা সৃষ্টি করতে পেরেছিল এটা ঠিক ।
সুমিতাভ : তখনকার সাহিত্যে এই আন্দোলনের কোনো প্রতিচ্ছবি পড়েছিল কি?
সুনীল : দুটো ব্যাপার হয়েছিল । একটা হয়েছিল কী হাংরি আন্দোলনের যারা প্রধান তারা কিছু কিছু পত্র পত্রিকায় লিফলেট ইত্যাদি ছাপাতে শুরু করে । এই সাহিত্যকে বদলাতে হবে ; অন্যরকম সাহিত্য সৃষ্টি করে পুরোনো মূল্যবোধকে নষ্ট করে দিতে হবে ইত্যাদি ।
সুমিতাভ : না, সাহিত্যে এর কোনো প্রতিচ্ছাপ পড়েছে কি ?
সুনীল : না । আমি বলব সাহিত্যে এর কোনো ছাপ পড়েছে বলে আমি মনে করি না । তবে এটা একটা গোষ্ঠী, অন্যরকম সাহিত্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল । তবে অ্যাবরাপ্টলি এই আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায় । তবে এতোদিন বাদে আবার সেসব নিয়ে আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি । মাঝখানে দশ বছর হাংরিদের সম্পর্কে কথাবার্তা শুনিনি । ( এই দশ বছর মলয় রায়চৌধুরী কলকাতার সাহিত্য জগতের বাইরে ছিলেন, বুলেটিন প্রকাশ করার জন্য টাকা তিনিই দিতেন )।
সুমিতাভ : ট্রাডিশানাল বাংলা সাহিত্যকে কোনোভাবেই এরা একটুও বদলাতে পেরেছিল কি ?
সুনীল : সেটা তো আমি বলতে ওপারব না । হাংরিদের যারা প্রথান, যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, এরা হাংরি আন্দোলনের মাঝামাঝি অবস্হায় এর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান । যখন এই নিয়ে কোর্টে কেস হয়, তখন এরা বিবৃতি দেয় যে, আমাদের সঙ্গে হাংরির কোনো সম্পর্ক নেই । ওদের লেখা আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্যের মূল ধারার সঙ্গেই যুক্ত । আলাদাভাবে হাংরি আন্দোলনের কোনো প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি না ।
সুমিতাভ : ক্ষমতাবান বেশ কছু লেখক থাকা সত্ত্বেও, হাংরি আন্দোলনের জীবৎকাল খুব অল্প । এর কারণ কি ?
সুনীল : ক্ষমতাবান লেখকরা প্রথমে তাড়াতাড়ি সরে গেলেন । দ্বিতীয় কথা, এরা সিরিয়াসলি সাহিত্য রচনা করার বদলে এমন কিছু কাজ করতে লাগলেন, যেগুলো অনেকেরই বিরক্তি উদ্রেক করলো । যেমন ধরো এরা কাউকে জুতোর মালা পাঠিয়ে দিল । কাউকে একটা মুখোশ পাঠিয়ে দিল । বা কাউকে টেলিফোন করে বলল, আপনার ছেলে মারা গেছে, বাড়ি চলে যান । এইভাবে কিছু কিছু অল্প বয়সের চ্যাংড়ামি --- এটা অনেকেই করে, অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু এটাই যেন প্রধান হয়ে দাঁড়াল । লেখার মধ্যে তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করার করার জন্য অযথা এবং অকারণ অশ্লীলতা আনার চেষ্টা করল । আমি অবশ্য কোনো শব্দকেই অশ্লীল বলে মনে করি না । তথাকথিত অশ্লীলতা, তথাকথিত অশ্লীল শব্দ । বা আরেকটা ছিল, অন্যকে গালাগালি দেওয়া । এই সমস্ত দিকেই যেন তাদের মন বেশি গেল । অবশ্য অন্য লোকের অন্য মত থাকতে পারে ।
সুমিতাভ : হাংরি লেখাগুলোতে আত্মকামিতা জিনিসটার কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে করেন ?
সুনীল : তা, আত্মকামীতা মানে ধরো, আমরা কৃত্তিবাসে যেটা বলতাম, যে নতুন আধুনিক সাহিত্য বলতে আমরা কী বুঝতাম ?তখন আমরা বলতাম যে কৃত্তিবাসের মূল সুর হচ্ছে কনফেশন । স্বীকারোক্তিমূলক লেখা । আমরা যেভাবে জীবন যাপন করছি সাহিত্যে সেটাকে ঠিক সেভাবেই স্বীকার করে নেওয়া দরকার । হাংরিরা হয়তো তার থেকেও আরো এক্সট্রিম-এ চলে গিয়েছিল । তারা, যাকে বলে আত্মকণ্ডূয়ন, সেটার দিকে চলে গিয়েছিল । তবে আমার মনে হয় হাংরি আন্দোলনের মূল সুর কৃত্তিবাস ধারারই একটা অঙ্গ ।
সুমিতাভ : নকশাল আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব, আর হাংরি আন্দোলন, মোটামুটি সমসাময়িক । এর কোনো বিশেষ তাৎপর্য আছে বলে আপনি মনে করেন ?
সুনীল : হাংরি আন্দোলনের মধ্যে রাজনীতি কিছু ছিল না । তবে ক্ষুধার ব্যাপারটা ছিল । তবে সেটা খাদ্য অভাবের যে ক্ষুধা, তা নয় বোধহয় । এটা বোধহয় অন্য কোনো ক্ষুধার কথা ওরা বলতে চেয়েছিল । নকশাল আন্দোলন অনেক ব্যাপক, অনেক মহৎ আত্মত্যাগ আছে । হাংরি আন্দোলন সেরকম কিছু একটা নয় ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার কম-বেশি পঁচিশ বছর পর, আবার একটা ক্ষুৎকাতর আবহাওয়া, বিশেষত ছোটো পত্র-পত্রিকাগুলোয় চোখে পড়ছে । এরকমটা কেন হচ্ছে বলতে পারেন ?
সুনীল : সেরকম কোনো আবহাওয়া আমার চোখে পড়ছে না । যা চোখে পড়ছে তা হলো হাংরিদের নিয়ে আবার লেখালিখি শুরু হয়েছে । কোনো কোনো পত্রিকায় এদের কেস টেস ছাপা হচ্ছে, হিস্ট্রিটাও ছাপা হয়েছে। মলয় রায়চৌধুরীকে বহুদিন নীরবতার পর আবার লেখালিখি করতে দেখছি
সুমিতাভ : সেটা এতদিন পরে হঠাৎ কি কারণে ?
সুনীল : আলাদা কোনো কারণ নেই । এটা নেহাতই কলকাতার ব্যাপার ।
সুমিতাভ : ধন্যবাদ । আমরা তাহলে উঠি...
সুনীল : তবে এটা বলছি, আমার সঙ্গে হাংরিদের সম্পর্ক এই যে আমি তাদের কোনো পত্র-পত্রিকায় লিখিনি । তাদের সঙ্গে আমার কোনো মানসিক মিলও ছিল না । আন্দোলনেও অংশ নিইনি । তবে যখন মামলা হয়, তখন আমার কাছে মলয় রায়চৌধুরী এসেছিল, যেন আমি তার হয়ে সাক্ষ্য দিই । আমি তার পক্ষেই সাক্ষ্য দিয়েছি । আদালতে দাঁড়িয়ে আমি বলেছিলুম, মলয় রায়চৌধুরীর কোনো কবিতায় আমি কোনো অশ্লীলতা খুঁজে পাইনি । আদালতে এটাই আমার সাক্ষ্য ছিল ।
সুমিতাভ : সেটা আপনি স্নেহের বশে করেছিলেন, না নিজের বিশ্বাসে ?
সুনীল : আমি পরে মলয়কে বাড়িতে বলেছিলাম, দেখ তোমার কোনো কবিতাকে যদিও আমি সার্থক কবিতা বলে মনে করি না, কিন্তু কেউ একটা কবিতার মধ্যে কিছি অশ্লীল শব্দ লিখেছে বলে তাকে আদালতে ডেকে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে, সেটাও আমি সমর্থনযোগ্য মনে করি না । সাহিত্যের জন্য শাস্তিদানের কোনো ঘটনা যদি ঘটে, তবে আমি সবসময় অভিযুক্তের পক্ষেই থাকব ।
( সুমিতাভ ঘোষাল সম্পাদিত 'গদ্য-পদ্য সংবাদ' পত্রিকার অক্টোবর ১৯৮৬ সংখ্যায় প্রকাশিত )
অরুণেশ ঘোষ-এর সাক্ষাৎকার - নিয়েছেন সুমিতাভ ঘোষাল - হাংরি আন্দোলন শেষ হতে পারে কিন্তু তার প্রবাহ শেষ হয়নি
সুমিতাভ : ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপনার কি ভূমিকা ছিল ?
অরুণেশ : ষাটের দশকের লেখকদের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি । কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে আমার অবস্হান । এদের কিছু লেখা পরে আমি পড়তে শুরু করি, অবশ্য তার আগে থেকেই আমি লিখতাম, আমার মতন লেখা । কৃত্তিবাসে আমি লেখা পাঠাই, খুব সম্ভব সেটা ১৯৬৯-৭০ । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গেই আমার প্রথম যোগাযোগ ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলনকে আদৌ একটা সাহিত্য আন্দোলন বলে আপনি মনে করেন ? বাংলা সাহিত্যের মূল ধারায় এর কি কোনো প্রতিচ্ছাপ পড়েছে ?
অরুণেশ : হাংরি লেখা নিশ্চয়ই সাহিত্য । কিন্তু প্রথাগত বাংলা লেখালিখি, এমনকি জীবনানন্দের থেকেও সম্পূর্ণ ভিন্নরকম বলে এখনও এই সাহিত্য মূলস্রোতের সাথে পুরোপুরি মিশে যেতে পারেনি । তবে এর একটা ছাপ পড়েছে এই সময়ের লেখালিখিতে । প্রবল ভাবেই পড়েছে ।
সুমিতাভ : ক্ষমতাবান বেশ কয়েকজন লেখক এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও এই আন্দোলনের জীবৎকাল খুব অল্প । এর কি কি কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন ?
অরুণেশ : ( উত্তর দিতে অস্বীকার করেন )
সুমিতাভ : হাংরি লেখায় আত্মকামিতা এবং আত্মপ্রচারের ভূমিকা কতোদূর ?
অরুণেশ : আধুনিক সাহিত্যের বড়ো একটা দিক হল, নিজেকে নিয়ে লেখা । আত্মকামিতা নয়, আত্মউন্মোচন । পাঠক এ ধরণের লেখায় অভ্যস্ত নয় বলে খানিকটা ভুল বুঝতে পারেন । যাঁরা লিখতে এসেছেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ আত্মউন্মোচনের চেয়ে নিজেকে নিয়ে আস্ফালন করে ফেলেন বেশি । সেটাই একটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায় ।
সুমিতাভ : নকশাল আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব এবং হাংরি আন্দোলন মোটামুটি সমসাময়িক । এর কোনো তাৎপর্য আছে বলে আপনার মনে হয় ।
অরুণেশ : নকশাল আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক । হাংরি আন্দোলন সাহিত্যিক। মূলত কবিতার ক্ষেত্রে । তবে দুটোর সঙ্গে মিল যেখানে, সেটা হল পূর্ববর্তিদের প্রতি বিতৃষ্ণা, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও পরিবর্তন ঘটাবার সক্রিয়তা । যেমন রাজনীতিতে, তেমনি সাহিত্যেও কিছ ভণ্ড, অক্ষম ও লোলুপ ব্যক্তিরা জাঁকিয়ে বসেছিল । তরুণরা এদের বর্জন করেছে ঘৃণায় । হাংরি আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনের আগেই শুরু হয় । কেউ কেউ মনে করেন, হাংরি আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে নকশাল আন্দোলনে । কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়, আংশিক সত্য । নকশালরা চেয়েছে মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, হাংরিদের কাম্য ছিল সার্বিক স্বাধীনতা ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার কমবেশি পঁচিশ বছর পর আবার একটা ক্ষুৎকাতর আবহাওয়া চোখে পড়ছে । এর কারণ কী ?
অরুণেশ : হাংরি আন্দোলন শেষ হতে পারে কিন্তু তার প্রবাহ শেষ হয়নি, তার স্পিরিট বহমান । এর পাশাপাশি আর কোনো শক্তিশালী আন্দোলন নেই । আছে একদিকে প্যানপ্যানানি সাহিত্য, অন্যদিকে পণ্য-সাহিত্য । বোঝাই যায়, এই অবস্হায় তরুণরা হাংরি পথকেই তুলনামূলকভাবে সৎ ও সঠিক মনে করবে । তবে একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আগের চিৎকার এখন আর নেই । এখন সৃষ্টির মধ্য দিয়েই প্রথা আর প্রতিষ্ঠানবিরোধী হতে হবে, সৃষ্টির বাইরে গিয়ে নয় -- এই বোধটা যেন এসেছে । এটা ভাল লক্ষণ। আবার হাংরিদের অনুকরণ করতে গিয়ে যে কিছু বাজে লেখা হচ্ছে, সেটাও সত্য । অবশ্য এসব ঝরে যাবে ।
( সুমিতাভ ঘোষাল সম্পাদিত 'গদ্যপদ্য সংবাদ' অক্টোবর ১৯৮৬ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত ।
Arunesh Ghosh
অরুণেশ : ষাটের দশকের লেখকদের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি । কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে আমার অবস্হান । এদের কিছু লেখা পরে আমি পড়তে শুরু করি, অবশ্য তার আগে থেকেই আমি লিখতাম, আমার মতন লেখা । কৃত্তিবাসে আমি লেখা পাঠাই, খুব সম্ভব সেটা ১৯৬৯-৭০ । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গেই আমার প্রথম যোগাযোগ ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলনকে আদৌ একটা সাহিত্য আন্দোলন বলে আপনি মনে করেন ? বাংলা সাহিত্যের মূল ধারায় এর কি কোনো প্রতিচ্ছাপ পড়েছে ?
অরুণেশ : হাংরি লেখা নিশ্চয়ই সাহিত্য । কিন্তু প্রথাগত বাংলা লেখালিখি, এমনকি জীবনানন্দের থেকেও সম্পূর্ণ ভিন্নরকম বলে এখনও এই সাহিত্য মূলস্রোতের সাথে পুরোপুরি মিশে যেতে পারেনি । তবে এর একটা ছাপ পড়েছে এই সময়ের লেখালিখিতে । প্রবল ভাবেই পড়েছে ।
সুমিতাভ : ক্ষমতাবান বেশ কয়েকজন লেখক এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও এই আন্দোলনের জীবৎকাল খুব অল্প । এর কি কি কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন ?
অরুণেশ : ( উত্তর দিতে অস্বীকার করেন )
সুমিতাভ : হাংরি লেখায় আত্মকামিতা এবং আত্মপ্রচারের ভূমিকা কতোদূর ?
অরুণেশ : আধুনিক সাহিত্যের বড়ো একটা দিক হল, নিজেকে নিয়ে লেখা । আত্মকামিতা নয়, আত্মউন্মোচন । পাঠক এ ধরণের লেখায় অভ্যস্ত নয় বলে খানিকটা ভুল বুঝতে পারেন । যাঁরা লিখতে এসেছেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ আত্মউন্মোচনের চেয়ে নিজেকে নিয়ে আস্ফালন করে ফেলেন বেশি । সেটাই একটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায় ।
সুমিতাভ : নকশাল আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব এবং হাংরি আন্দোলন মোটামুটি সমসাময়িক । এর কোনো তাৎপর্য আছে বলে আপনার মনে হয় ।
অরুণেশ : নকশাল আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক । হাংরি আন্দোলন সাহিত্যিক। মূলত কবিতার ক্ষেত্রে । তবে দুটোর সঙ্গে মিল যেখানে, সেটা হল পূর্ববর্তিদের প্রতি বিতৃষ্ণা, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও পরিবর্তন ঘটাবার সক্রিয়তা । যেমন রাজনীতিতে, তেমনি সাহিত্যেও কিছ ভণ্ড, অক্ষম ও লোলুপ ব্যক্তিরা জাঁকিয়ে বসেছিল । তরুণরা এদের বর্জন করেছে ঘৃণায় । হাংরি আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনের আগেই শুরু হয় । কেউ কেউ মনে করেন, হাংরি আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে নকশাল আন্দোলনে । কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়, আংশিক সত্য । নকশালরা চেয়েছে মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, হাংরিদের কাম্য ছিল সার্বিক স্বাধীনতা ।
সুমিতাভ : হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার কমবেশি পঁচিশ বছর পর আবার একটা ক্ষুৎকাতর আবহাওয়া চোখে পড়ছে । এর কারণ কী ?
অরুণেশ : হাংরি আন্দোলন শেষ হতে পারে কিন্তু তার প্রবাহ শেষ হয়নি, তার স্পিরিট বহমান । এর পাশাপাশি আর কোনো শক্তিশালী আন্দোলন নেই । আছে একদিকে প্যানপ্যানানি সাহিত্য, অন্যদিকে পণ্য-সাহিত্য । বোঝাই যায়, এই অবস্হায় তরুণরা হাংরি পথকেই তুলনামূলকভাবে সৎ ও সঠিক মনে করবে । তবে একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আগের চিৎকার এখন আর নেই । এখন সৃষ্টির মধ্য দিয়েই প্রথা আর প্রতিষ্ঠানবিরোধী হতে হবে, সৃষ্টির বাইরে গিয়ে নয় -- এই বোধটা যেন এসেছে । এটা ভাল লক্ষণ। আবার হাংরিদের অনুকরণ করতে গিয়ে যে কিছু বাজে লেখা হচ্ছে, সেটাও সত্য । অবশ্য এসব ঝরে যাবে ।
( সুমিতাভ ঘোষাল সম্পাদিত 'গদ্যপদ্য সংবাদ' অক্টোবর ১৯৮৬ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত ।
Arunesh Ghosh
শুক্রবার
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও হাংরি জেনারেশন আন্দোলন - আমার বউ আমাকে জেলে যেতে বারণ করেছিল
সে সময়ে আমাদের কেউই পাত্তা দিত না । তা যারা হাংরি আন্দোলন শুরু করে, সেই মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরী আমাকে জানান যে আমার লেখা ওদের ভালো লেগেছে, ওরা যে ধরণের লেখা ছাপাতে চায় তা নাকি আমার লেখায় ওরা দেখতে পেয়েছে, তাই আমার লেখা ওরা ছাপাতে চায় । ওদের কাছে পাত্তা পেয়ে আমি খুবই আহ্লাদিত হয়েছিলুম ।
হাংরি আন্দোলনের ইস্তাহার আমি অনেক পরে দেখেছি । সেসময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা গল্প আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল । বলতে গেলে সেই গল্পটার জন্যই আমি হাংরি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলুম । গল্পটার নাম আমার ঠিক মনে নেই । গল্পটা ছিল অনেকটা এইরকম -- একটা ছেলে, তার ভীষণ খিদে । একদিন ছাত্রীকে পড়াতে পড়াতে ছাত্রীর আঁচলের খুঁটটা খেতে শুরু করে । এইভাবে সে একটু একটু করে পুরো শাড়িটা খেয়ে ফ্যালে । এ ব্যাপারটায় সে বেশ মজা পেয়ে যায় । এর পর থেকে সে অনেক কিছুই খেতে শুরু করে । যেমন জানালা, চেয়ার, ছাপাখানা, নোটবুক ইত্যাদি । একদিন এক হোটেলের সান্ত্রীকে সে খেয়ে ফ্যালে । এই ছেলেটিই একদিন গঙ্গার ধারে তার প্রেমিকাকে নিয়ে বসেছিল । হঠাৎ তার সেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে । তখন সেই ছেলেটি গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জাহাজকে খেতে চায় । কিন্তু সেই ছেলেটি জাহাজটাকে খেতে পারে না । জাহাজটা ছেড়ে দেয় । তখন সেই ছেলেটি একটা চিরকুট গঙ্গায় ভাসিয়ে দ্যায় । সেটা ঠিক কার উদ্দেশে ভাসিয়েছিল তা জানা যায় না । ছেলেটির প্রেমিকার উদ্দেশ্যেও হতে পারে । পৃথিবীর উদ্দেশ্যেও হতে পারে । বা অন্য কিছুও হতে পারে । এখানেই গল্পটা শেষ । এই গল্পটা আমাকে সেসময়ে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং আমার মনে হয়েছে ক্ষুৎকাতর আন্দোলনের এটাই মূল কথা ।
আমি হারি আন্দোলনের সঙ্গে ভীষণভাবেই জড়িত ছিলাম । হাংরি আন্দোলনের আদর্শ -- আমার ভালো লেগেছিল, এবং আমি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম । এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই । কিন্তু পরের দিকে ওরা আমাকে না জানিয়ে আমার নামে পত্রিকা টত্রিকা বার করে । যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল ।
তখন আমি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । কিন্তু এই হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সুনীল আমেরিকায় । এই আন্দোলনকে সুনীলের অসাক্ষাতে একটা ক্যু বলতে পারা যায় ।
প্রতিষ্ঠানের লোভ আমার কোনোদিনই ছিল না । বাংলাদেশে যদি কেউ আগাগোড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভূমিকা পালন করে থাকে তবে তা আমি । আমার 'বিজনের রক্তমাংস' গল্পটি বেরোনোর পর থেকে আমার সে ভূমিকা অব্যাহত ।
আমি মনে করি ওরকমভাবে দল পাকিয়ে সাহিত্য হয় না । একজন লেখক নিজেই অতীত, নিজেই ভবিষ্যত, নিজেই সমাজ, নিজেই সভ্যতা, এবং নিজেই সবকিছু । সাহিত্য সৃষ্টিতে দলের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ।
আমি মুচলেকা দিয়েছিলাম তার দুটো কারণ । এক, আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই, আর দুই, আমার বউ আমাকে জেলে যেতে বারণ করেছিল । বউ বলল, যে একেই তো তোমার মতো মদ্যপকে বিয়ে করার জন্য আমার আত্মীয় পরিজনরা সব আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছে । তার ওপর তুমি যদি জেলে যাও তাহলে সোনায় সোহাগা হবে । সেই জন্যে আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করি ।
( সুমিতাভ ঘোষাল সম্পাদিত 'গদ্য পদ্য সংবাদ' পত্রিকার অক্টোবর ১৯৮৬ সংখ্যায় প্রকাশিত ।
Sandipan Chattopadhyay
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
হাংরি আন্দোলনের ইস্তাহার আমি অনেক পরে দেখেছি । সেসময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা গল্প আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল । বলতে গেলে সেই গল্পটার জন্যই আমি হাংরি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলুম । গল্পটার নাম আমার ঠিক মনে নেই । গল্পটা ছিল অনেকটা এইরকম -- একটা ছেলে, তার ভীষণ খিদে । একদিন ছাত্রীকে পড়াতে পড়াতে ছাত্রীর আঁচলের খুঁটটা খেতে শুরু করে । এইভাবে সে একটু একটু করে পুরো শাড়িটা খেয়ে ফ্যালে । এ ব্যাপারটায় সে বেশ মজা পেয়ে যায় । এর পর থেকে সে অনেক কিছুই খেতে শুরু করে । যেমন জানালা, চেয়ার, ছাপাখানা, নোটবুক ইত্যাদি । একদিন এক হোটেলের সান্ত্রীকে সে খেয়ে ফ্যালে । এই ছেলেটিই একদিন গঙ্গার ধারে তার প্রেমিকাকে নিয়ে বসেছিল । হঠাৎ তার সেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে । তখন সেই ছেলেটি গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জাহাজকে খেতে চায় । কিন্তু সেই ছেলেটি জাহাজটাকে খেতে পারে না । জাহাজটা ছেড়ে দেয় । তখন সেই ছেলেটি একটা চিরকুট গঙ্গায় ভাসিয়ে দ্যায় । সেটা ঠিক কার উদ্দেশে ভাসিয়েছিল তা জানা যায় না । ছেলেটির প্রেমিকার উদ্দেশ্যেও হতে পারে । পৃথিবীর উদ্দেশ্যেও হতে পারে । বা অন্য কিছুও হতে পারে । এখানেই গল্পটা শেষ । এই গল্পটা আমাকে সেসময়ে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং আমার মনে হয়েছে ক্ষুৎকাতর আন্দোলনের এটাই মূল কথা ।
আমি হারি আন্দোলনের সঙ্গে ভীষণভাবেই জড়িত ছিলাম । হাংরি আন্দোলনের আদর্শ -- আমার ভালো লেগেছিল, এবং আমি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম । এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই । কিন্তু পরের দিকে ওরা আমাকে না জানিয়ে আমার নামে পত্রিকা টত্রিকা বার করে । যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল ।
তখন আমি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । কিন্তু এই হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সুনীল আমেরিকায় । এই আন্দোলনকে সুনীলের অসাক্ষাতে একটা ক্যু বলতে পারা যায় ।
প্রতিষ্ঠানের লোভ আমার কোনোদিনই ছিল না । বাংলাদেশে যদি কেউ আগাগোড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভূমিকা পালন করে থাকে তবে তা আমি । আমার 'বিজনের রক্তমাংস' গল্পটি বেরোনোর পর থেকে আমার সে ভূমিকা অব্যাহত ।
আমি মনে করি ওরকমভাবে দল পাকিয়ে সাহিত্য হয় না । একজন লেখক নিজেই অতীত, নিজেই ভবিষ্যত, নিজেই সমাজ, নিজেই সভ্যতা, এবং নিজেই সবকিছু । সাহিত্য সৃষ্টিতে দলের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ।
আমি মুচলেকা দিয়েছিলাম তার দুটো কারণ । এক, আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই, আর দুই, আমার বউ আমাকে জেলে যেতে বারণ করেছিল । বউ বলল, যে একেই তো তোমার মতো মদ্যপকে বিয়ে করার জন্য আমার আত্মীয় পরিজনরা সব আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছে । তার ওপর তুমি যদি জেলে যাও তাহলে সোনায় সোহাগা হবে । সেই জন্যে আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করি ।
( সুমিতাভ ঘোষাল সম্পাদিত 'গদ্য পদ্য সংবাদ' পত্রিকার অক্টোবর ১৯৮৬ সংখ্যায় প্রকাশিত ।
Sandipan Chattopadhyay
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)