মলয় রায়চৌধুরী।বাংলা কবিতার নুনছাল উঠে-যাওয়া চেহারাটা যেন চোখের সামনে জেগে ওঠে যখন এই নামটি উচ্চারিত হয়। ১৯৬১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত তিনি বাংলা কবিতা লিখেছেন। সেই চর্চা বাঙালি পাঠককে স্বস্তিতে রাখেনি। ষাটের দশকের বিখ্যাত, অনেকের মতে কুখ্যাত, হাংরি আন্দোলনের মলয়ই ছিলেন প্রাণপুরুষ। এই আন্দোলন তাঁকে কারাদণ্ডের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। স্বাধীন ভারতধের প্রথম বাঙালি কবি, তাঁর কোমরে পড়েছিল পুলিশের দড়ি, হাঁটানো হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে। অভিযোগ ছিল কবিতায় অশ্লীলতা। শুরু হয়েছিল বিখ্যাত হাংরি মামলা, যা আজও কিম্বদন্তি হয়ে আছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় রাজসাক্ষী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত, সত্রাজিৎ দত্ত নিম্ন আদালতে সাক্ষী ছিলেন মলয়ের হয়ে। সেই কবিতা 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'। বাংলা কবিতার অন্যতম স্বল্পপঠিত বিখ্যাত কবিতা।আজ সেই মলয় রায়চৌধুরী মুম্বাই-প্রবাসী। কলকাতাকে পাকাপাকিভাবে ছেড়ে গিয়েছেন সেখানে।কিন্তু তাঁকে ধরা গেল। ধরা দিলেন আন্তর্জালে। রাজি হলেন এই সাক্ষাৎকার দিতে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছে ই-মেলের মাধ্যমে। উঠে এসেছে অনেক বিতর্কিত, অস্বস্তিকর, বিস্ফোরক প্রসঙ্গ। হয়তো প্রথমবার মলয় রায়চৌধুরী নিজের বলয়ের বাইরে প্রশ্নগুলির মুখোমুখি হলেন।
মলয় রায়চৌধুরীর ( জন্ম ২৯ অক্টোবর, ১৯৩৯ম ) অনেক পরিচয় আছে। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক।কিন্তু এখনও তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচয় তিনি ষাটের দশকের সেই বিখ্যাত হাংরি আন্দোলনের পুরোধা-পুরুষ। তখন, এবং এখন, সাহিত্যের কোনো অনুশাসন তিনি কখনও মানতে চাননি। সে ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলন হোক বা শতক-শেষের অধুনান্তিক চিন্তা।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উত্তরপাড়া শাখার সন্তান মলয়। বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী ছিলেন চিত্রশিল্পী-ফোটোগ্রাফার। মা অমিতা ছিলেন রোনাল্ড রসের সহায়ক কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা। বড়দা সমীর রায়চৌধুরীও একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক। শৈশব কেটেছে পাটনায়। সেখানে সেন্ট জোসেফ কনভেন্টে প্রাথমিক শিক্ষা হয়।পরে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। গ্রামীণ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রশিক্ষণের পর প্রথমে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, পরে এ. আর.ডি.সি., এবং নাবার্ডে উচ্চপদে ভারতের বিভিন্ন শহরে কর্মরত ছিলেন। সারাজীবন ভারতের চাষি, তাঁতি, জেলে, হস্তশিল্পীদের মধ্যে কাটিয়ে যে অভিজ্ঞতা, তা তাঁর কবিতায় বেশ গভীর ছাপ রেখেছে। অবসর নেন ১৯৯৭ সালে।
১৯৬১ সালে দাদা সমীর রায়চৌধুরী, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়-এর সঙ্গে হাংরি আন্দোলন শুরু করে আবির্ভাবেই সাড়া ফেলে দেন। পরে প্রায় চল্লিশজন কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী এই আন্দোলনে যোগ দেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, রবীন্দ্র গুহ প্রমুখ। আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে এক পাতার বুলেটিন প্রকাশ করা হত। একশো আটটি বুলেটিন বেরিয়েছিল। তার মধ্যে কয়েকটি 'লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি' এবং ঢাকা বাংলা অ্যাকাডেমিতে সংরক্ষণ করা গেছে। ১৯৬৫ পর্যন্ত পুরোদমে চললেও, বিখ্যাত হাংরি মকদ্দমার পর ভেঙে যায় আন্দোলনটি।
১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটির জন্য মলয় অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। ৩৫ মাস ধরে কোর্ট কেস চলে। কলকাতার নিম্ন আদালতে সাজা ঘোষণা হলেও, ১৯৬৭ সালে উচ্চ আদালতে অভিযোগমুক্ত হন। মলয়ের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত ও সত্রাজিৎ দত্ত। রাজসাক্ষী ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, পবিত্র বল্লভ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু। এই মামলাই মলয়কে বিখ্যাত করে তোলে। ইউরোপ-আমেরিকায় তাঁর নাম পৌঁছে যায়। বিখ্যাত Time পত্রিকা হাংরি আন্দোলন নিয়ে লেখা প্রকাশ করে। বিভিন্ন ভাষায় মলয়ের কবিতা অনুবাদ করা হয়। সাম্প্রতিককালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত Modern and Post Modern Poetry of the Millenium সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে অন্তর্ভুক্ত এটিই একমাত্র কবিতা বলে জানিয়েছেন সম্পাদক জেরোম রোদেনবার্গ।
প্রথম কাব্যগ্রন্হ শয়তানের মুখ ( কৃত্তিবাস প্রকাশনী, ১৯৬৩ ) থেকেই মলয় রায়চৌধুরী আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতার এক জলবিভাজক ব্যক্তিত্ব। কবিতায় যে-কোনো নিয়মানুবর্তিতা ও আনুগত্যকে মলয় চিরকাল নাকচ করেছেন। তুমুলভাবে ব্যবহার করেছেন যৌনতা। আবার সমাজচিন্তা ছাড়া তাঁর কবিতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ভাষা-ছন্দ-অলংকার-চিত্রকল্পে বিপুল ভাঙচুরের মধ্যেই তাঁর কবিতার সুর একজন অসহায় ব্যক্তিমানুষের আর্তি ও যাতনা। তা ফুটে ওঠে ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাসে, যৌন-অনুষঙ্গে। বাঙালি পাঠক এই সুর সর্বান্তঃকরণে আজও গ্রহণ করতে পারেনি। পারার কথাও হয়তো ছিল না। কবিতা এবং গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি অনুবাদক হিসেবে মলয় সার্থক। ২০০৩ সালে অনুবাদকর্মের জন্য তাঁকে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার দিতে চাওয়া হলে সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দেন, কারণ তার আগে বহু লিটল ম্যাগাজিনের পুরস্কার তিনি নেননি।
বর্তমানে মলয় রায়চৌধুরী অসুস্হ। লিখতে গেলে বেশ হাত কাঁপে। কবিতা প্রায় দশ বছর লেখেননি। সময় কাটান ইনটারনেটে। কলকাতাকে পাকাপাকি ভাবে ছেড়ে গেছেন মুম্বাই শহরে। সেখানে সস্ত্রীক কাটাবেন শেষ জীবনটা।
অনুপম: মলয়দা, কবিতা লেখা এখন তো ছেড়েই দিয়েছেন আপনি। গদ্য-সাহিত্যেই কি মনোনিবেশ করতে চাইছেন পুরোপুরি ? অনেকদিন আপনার কোনো নতুন কবিতা পড়িনি। এই সিদ্ধান্তের কারণ কী ? কবিতা লিখতে ভালো লাগছেনা আর ?
মলয় রায়চৌধুরী: ২০০৪-এর পরে আর কবিতা লিখিনি; লিখতে পারিনি। মাথায় যা-কিছু আসে, মনে হয় একঘেয়েমি হয়ে যাবে। আমি তো সেনটেন্সের ভার্সিফায়ার বা স্বভাবকবি নই। ইদানিং কবিতা-লেখা ব্যাপারটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল আমার আর পাঠকের প্রয়োজন নেই। পাঠকদের চিঠি বা ই-মেল এলে আশ্চর্য অনুভূতিতে আক্রান্ত হই। সমস্যা আমার আঙুলেরও। বুড়ো আঙুলে আথ্রাইটিসের কারণে কলম ধরার পর ইরিটেশন হতে থাকে, যা চিন্তাকে ডিসটার্ব করে। ইনটারনেটে এক আঙুলে কাজ চালাই, কিন্তু কবিতা লিখতে বসে এক আঙুল কমপিউটারে আর সেই সঙ্গে মগজের রসায়নকে সেই আঙুলের ডগায় নিয়ে যাওয়া বেশ অ্যাবসার্ড। নতুন গদ্য লিখিনি; যা-কিছু প্রকাশিত হয় সবই পুণর্মুদ্রণ। এক আঙুলে গদ্য লেখা আরও কঠিন। ফিকশানাল গদ্যগুলো জীবনের টুকরো-টাকরা মিশিয়ে বানানো। এমন অনেক-কিছু লিখেছি যা বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের ছেলেমেয়েদের পছন্দ হয়নি, ফিকশানালাইজেশান সত্বেও। প্রবন্ধ লিখতে আর ভালো লাগে না। এক আঙুলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এবং ব্লগ যেটুকু যা হয়। আজকাল একটা অদ্ভুত সাইটে ঢুকে পড়েছি; ওটা দেখেছ কি? Chatroulette.com । খুললেই স্ট্রেট তোমার সামনে অচেনা কেউ দেখা দেবে, তার ভালো লাগলে দুমিনিট নিজের ভাষায় কথা বলবে, তারপর অন্য কেউ; মুখোশ পরে ল্যাংটো পোঁদে কেউ-কেউ কোন ভাষায় যা কী বলছে টের পাই না। এটাকে কী বলব? ওয়েবক্যাম থাকলে দেখো। কবিতা কি এই নেক্সটিং পর্যায়ে নিয়ে যাবে ? তোমার ও পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা নিয়ে যাবেন আশা করি। কমপিউটারে উত্তর লিখছি বলে ইংরেজি শব্দ চলে আসছে: মুম্বাই শহরটাও তো ইংরেজির দিকে দৌড়োচ্ছে !
অনুপম: মলয় রায়চৌধুরীকে আমরা জানি বাংলা কবিতার নেটিজেন হিসেবেও। আপনার কি মনে হয় ভবিষ্যতে প্রিন্ট মিডিয়া জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ? সেই দিকেই কি এগোচ্ছি আমরা ?
মলয় রায়চৌধুরী: জাহিরুল হাসান ওঁর ত্রৈমাসিক বার্তায় লিখেছিলেন, "মলয় রায়চৌধুরীও নেটিজেন হলেন"। তার মানে আমার আগে কয়েকজন নেটিজেন ছিলেন। ওঁরা কারা তা জানিনা। আমাদের ভাষায় প্রথম নেটিজেন কবি, আমার মনে হয়, রোহন কুদ্দুস। বস্তুত আমি তো ভেবেছিলুম, রোহন একজন বাংলাদেশি কবি; লজ্জার কথা নিঃসন্দেহে, পরের প্রজন্মের কবিদের লেখাপত্রের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত নই। রোহনকে পথিকৃৎ বলা যায়। আমি যেভাবে লিটেরারি নেটওয়ার্কিং করি, লেখালিখি করি, ইনটারভিউ ইত্যাদি দিয়ে থাকি, সেভাবে অনেকেই এই এলাকায় প্রবেশ করেননি, তাই চোখে পড়েন না ওঁরা। ভারতবর্ষে বাংলা সাহিত্যে ইনটারনেট প্রিন্ট মিডিয়ার জায়গা মোটেই নিতে পারবে না ; অন্তত পঞ্চাশ বছর লাগবে সমান্তরাল মাধ্যম হয়ে উঠতে। বাংলাদেশে কমপিউটার তো বহু বছর আগে ইনট্রোডিউস হয়েছে, কিন্তু এখনও ইনটারনেট প্রিন্ট মিডিয়ার সমান্তরাল নয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের লাইব্রেরিগুলোর যা অবস্হা, ছাপা বইয়ের স্হায়িত্ব সমস্যাজনক। স্হায়িত্বের জন্য ইলেকট্রনিক মাধ্যম জরুরি হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সাইবার কাফেগুলোয় বাংলা ফন্ট নেই, ভাবতে পারো ? এদিকে বাংলা ভাষা বাঁচাও নিয়ে কত চিৎকার শুনতে পাই। কমপিউটার ঢুকছে কুড়ি বছর পর, তার ওপর ইংরেজি শিক্ষা তুলে দেয়া হয়েছিল। নেট স্যাভি একটা কবি-প্রজন্মের উন্মেষ ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে, ফলে ইনটারনেটে বাংলা কবিতার জায়গাটা প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু তুমি যদি সুধীন দত্ত, আলোক সরকার, অরুণেষ ঘোষ খোঁজো তো পাবে না। গুগল করলে তিরিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের কয়েকজন কবির অনুবাদ ( আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের দৌলতে ) বা তথ্য পাওয়া যাবে। পশ্চিমবঙ্গের জন্যও তাকিয়ে থাকতে হয় বাংলাদেশি নেটিজেনদের দিকে।
অনুপম: মলয়দা, হাংরি আন্দোলন নিয়ে গত প্রায় পাঁচ দশকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে-দিতে আপনি হয়তো খুব ক্লান্ত।তবু একটি চর্বিতচর্বণ। এই দু'হাজার দশ সালের মুম্বাই শহরে বসে ষাটের দশকের আন্দোলনটির দিকে
তাকালে কীরকম লাগে ? কী করতে চেয়েছিলেন কবিতায়?
মলয় রায়চৌধুরী: নাহ। হাংরি আন্দোলন নিয়ে আর কিছু বলার নেই। হাংরি আন্দোলনের সময়ে কবিতার অ্যাডিক্ট ছিলুম; কবিতা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রাগ।'সাহিত্য' শব্দ দিয়ে ওই ড্রাগ অ্যাডিকশান ব্যাখ্যা করা যাবে না। যারা এর অ্যাডিক্ট তারা নিজেরা বুঝে নিতে পারবে; কবিতা ছাপানো, সমালোচনা, আলোচনা এই সবই এই অ্যাডিকশানের প্রেক্ষিতে অবান্তর।
অনুপম: ঠিকই মলয়দা। কিন্তু খারাপ লাগে না, যখন মলয় রায়চৌধুরী এই নামটি পরিচিত হয়ে যায়, কিন্তু যা নন তাই দিয়েই সকলে তাঁকে ব্যাখ্যা করতে চায় ? অসহায় লাগে না ? আপনার নামটা জানে, কিন্তু ভুল ভাবে জানে, তাই না ? অনেকের কাছে আপনার বয়স ষাটের দশকের পর আর বাড়েনি । তারা একটা কবিতাতেই আটকে আছে -- 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'।
মলয় রায়চৌধুরী: আমার তা মনে হয় না। বেশির ভাগ পাঠক, যাঁরা নেট-এ যোগাযোগ করেন, তাঁরা আমাকে গদ্য লেখক বলে মনে করেন, 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এর লেখক, বিশেষ করে বাংলাদেশে। ওঁরা আমার উপন্যাসের তালিকা ও প্রাপ্তিস্হান জানতে চান। আমার নিজের কাছে যদিও 'নখদন্ত' লেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি নন-অ্যাকাডেমিক কলকাতাকেন্দ্রিক কফিহাউস আলোচকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। Milansagar.com -এ 'জখম' সবচেয়ে বেশি হিট পেয়েছে । এই পাঠকরা কলকাতার বাইরে বলে অনুমান করা যায় , যাঁদের কাছে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতা সম্পর্কিত কিংবদন্তি পৌঁছোয়নি। তোমার যতটা মনে হচ্ছে আমি ততটা পরিচিত নই। কেননা 'নামগন্ধ' উপন্যাসটা আমি একশো জন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদককে, যাঁরা কুড়ি বছরের বেশি পত্রিকা বের করছেন, ডাকযোগে পাঠিয়ে ( বইটা তাই দু'টাকার স্ট্যাম্পযোগ্য করে ছাপানো হয়েছিল ), পরে টেলিফোনে ফিডব্যাক নিতে গিয়ে জানতে পারি যে অধিকাংশ সম্পাদক আমার নাম শোনেননি। এমনকি হাংরি আন্দোলনের নাম শোনেননি। অসহায় লাগে নি ।
অনুপম: ঠিক আছে মলয়দা । কিন্তু 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি আমেরিকায় জনপ্রিয়। হাংরি মামলা চলার সময়ে ওটার অনুবাদ Stark Electric Jesus-এর দৌলতে আপনার কিছু অর্থাগম হয়েছিল, যা আপনার কিছু সুরাহা করেছিল। সেটা আমেরিকা থেকেই পাওয়া। এখনও আমেরিকা-প্রবাসী আর্যনীলের মুখে শুনতে পাই আপনি নাকি ওদেশে জনপ্রিয় বাঙালি কবি। মার্গারেট রেনডাল, ক্যারল বার্জ, জেরোম রোদেনবার্গ আপনার লেখা সংকলবদ্ধ করেছেন, বই ছেপেছেন --- এসব নিয়ে আপনি কী ভাবেন ? আমেরিকা কবিতার পীঠস্হান নয়, বাংলা কবিতার তো একেবারেই নয় । তবু -- অন্য একটা দেশ --
মলয় রায়চৌধুরী: আগের প্রশ্নটার উত্তরে আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি। শুভঙ্কর দাশ দিনকতক আগে Outsiderwriters.org-এর জন্যে যে সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তাতে বাঙালিদের কমেন্টগুলো এসেছে আমার ফিকশান নিয়ে, আর অবাঙালিদের কমেন্টগুলো ভারতীয় সাহিত্যের প্রেক্ষিতে আমার লেখার সামগ্রিক মূল্যায়ন। ডঃ কবিতা বাচকনভি লিখেছেন যে ভারতবর্ষে ষাটের আন্দোলনের দশকের পর উদয় হয়েছেন বিকাউ বা বেচনদার লেখকরা। আমার কবিতা বিদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বুয়েনস আয়ারস থেকে স্প্যানিশ ভাষায় El Corno পত্রিকায় । প্রথম বই 'শয়তানের মুখ'-এর প্রচ্ছদ ওঁরাই আঁকিয়ে দিয়েছিলেন মেক্সিকান চিত্রকর কার্লোস কোহেন-কে দিয়ে ( স্প্যানিশ ভাষার ইউকিপেডিয়ায় হাংরি আন্দোলনের পৃষ্ঠা আছে )। সেই সূত্রে জার্মান সম্পাদক কার্ল ওয়েইসনার ওঁর পত্রিকায় ( Kalactoveedsedsteen ) প্রকাশ করেন। ইউনাইটেড স্টেটস-এর অধ্যাপক হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড ( Washington State University ) সুবিমল বসাক, দেবী রায় আর আমার সঙ্গে দেখা করার পর আমাদের লেখা আমেরিকায় প্রবেশপথ পেয়ে যায় । ইউনাইটেড স্টেটসে বেশি করে নজরে পড়ার কারণ সম্ভবত ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালার কারণে; আমাদের পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র, ফোটোগ্রাফ, ম্যাগাজিন ইত্যাদি সংরক্ষিত হয়েছে এবং তা গুগলে স্হান পেয়েছে। ফরাসি ভাষায় গুগল সার্চ করলে প্রদীপ চৌধুরীকে বহু পৃষ্ঠায় পাবে। তখন যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁদের অনেকে পরে বেশ প্রতিষ্ঠিত, এবং আমার লেখা অন্তর্ভূক্ত করেছেন। বাণিজ্যিক বাঙালি কবিদের প্রচার আমেরিকায় ভালোই। ডেবোরা কার অ্যালেন গিন্সবার্গকে নিয়ে যে বইটা লিখেছেন তা পড়লে টের পাবে। আমার মামলার জন্যে নিউ ইয়র্কের সেন্ট মার্কস চার্চে আমার ও অন্যদের কবিতা পাঠ করে টাকা তোলার আয়োজন করেছিলেন ক্যারল বার্জ; হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড-ও বই প্রকাশ করে হাই কোর্টের খরচ তুলে দিয়েছিলেন। হাইকোর্টে আমার কেস লড়েছিলেন চারজন অ্যাডভোকেট, তখনকার বিখ্যাত ক্রিমিনাল ল-ইয়ার মৃগেন সেনের নেতৃত্বে। মৃগেন সেনের ফিজ আমার তখনকার মাইনের প্রায় একশোগুণ ছিল।'ছোটোলোকের ছোটোবেলা'-র ইংরেজি অনুবাদের প্রস্তাব পেয়েছি। দেখা যাক।
অনুপম: মলয়দা, "বিকাউ বা বেচনদার লেখক" ব্যাপারটা একটু বলুন। ধরুন গার্সিয়া মার্কেস বা সলমান রুশদি... এঁরাও তো বিক্রির ব্যাপারে উদাসীন নন । রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমও কি বিমুখ ছিলেন ? কে চায় না তার বই বিক্রি হোক, লোকে পড়ুক ? পাঠকের কাছে একটু স্পষ্ট করুন ব্যাপারটা।
মলয় রায়চৌধুরী: আমার মনে হয় আয়ারাম-গয়ারাপ অভিব্যক্তি দিয়ে বিকাউ প্রক্রিয়াটা বোঝানো যায়। রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্কিমের সময়ে বাজার ছিল না । ওঁরা বিনামূল্যে বই বিলি করতেন, ডাকযোগে পাঠকদের পাঠাতেন; তার জন্যে ওঁদের সেক্রেটারিরা ছিলেন। মার্কেস, বর্হেস, রুশদি প্রমুখ লেখকদের আয়ারাম-গয়ারাম বলা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বিশেষ করে (বাংলাদেশে নয়), এবং সাধারণভাবে হিন্দি, তামিল, তেলুগু ইত্যাদি ভাষা-সাহিত্যের জায়গাতে বিগ বিজনেস ও রাজনৈতিক-সরকারি খেলার ফলে আয়ারাম-গয়ারাম বাজারের উৎপত্তি হয়েছে। প্রকাশনা য়ভবসাটা আমাদের এখানে (কলকাতায়) তিরিশের দশকের পরে সেভাবে কাজ করে না যেভাবে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ভাষায়। এখানে প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করার কারিকুরির কারণে আউটস্ট্যান্ডিং লেখালিখিটা আয়ারাম-গয়ারামদের ঢাক-ঢোল দিয়ে চাপা পড়ে যায়। আয়ারাম-গয়ারাম লেখকদের রচনা তো ইংরেজিতে অনুবাদ হয়, কিন্তু কই, এখনও কেউই এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকায় সাড়া ফেলতে পারেননি, যেমনটা ফেলেছেন অরুন্ধতী রায় বা অরুণ কোলাতকার। আয়ারাম-গয়ারাম স্টক এক্সচেঞ্জ না থাকলে মহাশ্বেতা দেবীও বিশ্বব্যাপী ওপনিং পেতেন।
অনুপম: এই প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করার খেলা কি আপনার সঙ্গেও হয়েছে মনে করেন ? আপনার প্রথম বই 'শয়তানের মুখ' তো বেরোল 'কৃত্তিবাস প্রকাশনী' থেকে ১৯৬৩ সালে। আপনার প্রথম বইয়ের প্রকাশক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। উনি আপনার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর বন্ধু। আর সুনীলের সাক্ষই তো আপনাকে হাংরি মামলায় কারাবাস থেকে বাঁচিয়েছিল, তাই না ?
মলয় রায়চৌধুরী: আমার প্রথম বই 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার', তার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিৎ দত্ত ( কবি অজিত দত্তের ছেলে ) লোয়ার কোর্টে আমার হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। লোয়ার কোর্টে (ব্যাংকশাল কোর্ট) আমার ম্যাক্সিমাম নির্ধারিত জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের জেলের আদেশ হয়েছিল। সাক্ষ্যগুলো আমাকে বাঁচাতে পারেনি। আমার দণ্ডাদেশ খারিজ হয় হাইকোর্টে আপিল করার ফলে, তখনকার নামকরা ক্রিমিনাল ল-ইয়ারের যুক্তিতর্কের কারণে। তবে আমি ওঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে তরুণ সান্যালের প্রতি, যিনি কম্যুনিস্ট পার্টির নিষেধাজ্ঞা সত্বেও আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। সুনীল তখন এই সুনীল ছিলেন না; 'অরণ্যের দিনরাত্রি'-র সুনীল ছিলেন। ওটা চাইবাসাভিত্তিক কাহিনী, দাদা তখন চাইবাসায় পোস্টেড ছিলেন। সুনীল সাক্ষ্য দিয়েছিলেন দাদার অনুরোধে, বন্ধুত্বের খাতিরে, যা উনি লিখেওছেন। তবে ওঁর 'অর্ধেক জীবন' পড়লে জানা যায় যে প্রায় শতাধিকবার দাদার বিভিন্ন চাকরিস্হলে আতিথ্য নেওয়া সত্বেও, দাদার সঙ্গে পরিচয়টা উনি লুকোতে পছন্দ করেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তবু উনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন; কোনো একটি পত্রিকায় একবার আমার মৃত্যু-সংবাদ প্রকাশিত হলে উনি সঙ্গে-সঙ্গে আমার খোঁজ নিতে এসেছিলেন। না, আমাকে কোনো রুদ্ধ দরজার সামনে ধাক্কা খেতে হয়নি; আমি চেষ্টা করিনি। ওমুখো হইনি কখনো। সম্ভবত লেখালিখি মাঝে ছেড়ে দিয়েছিলুম বলেই।
অনুপম: কেন এই ছেড়ে দেওয়া, আর কেন তারপরও ফিরে আসা ?
মলয় রায়চৌধুরী: মনীশ ঘটককে জিগ্যেস করেছিলুম, "কেন লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছেন?" উনি বলেছিলেন, "মাথায় আসে, কিন্তু হাত অবধি আসে না।" একই প্রশ্ন সমর সেনকে জিগ্যেস করেছিলুম। উনি শুধু মোনালিসা হাসি দিয়ে যা বলার বলেছিলেন। আমার ক্ষেত্রে লেখার ব্যাপারটা আমায় দুম করে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, যাকে বলে writer's block । ফিরে এসেছিল আমার মা মারা যাওয়ার পরদিন থেকে, লক্ষ্ণৌতে, যেখানে আমার চেয়ে উনিশ বছরের ছোটো এক অবাঙালি তরুণী আমার প্রতি আকৃষ্ট হন। ওই সময় ঢাকায় প্রকাশের আহ্বান পেয়ে যাই একের পর এক লিটল ম্যাগাজিন থেকে। 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর'-এর অধিকাংশ কবিতা ঢাকায় প্রথম প্রকাশিত। গদ্য লেখার জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন, ইনস্টিগেট করতে থাকেন, 'কৌরব' পত্রিকার সম্পাদক কমল চক্রবর্তী।
অনুপম: মলয়দা, বলা কি যায় যে লেখালিখির অক্সিজেন আপনি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেই বেশি পেয়েছেন? আমেরিকা...বাংলাদেশ...জামশেদপুর...আপনাকে কি বাঙালি কবি সেই অর্থে বলা যায় ?
মলয় রায়চৌধুরী: প্ল্যাটফর্মগুলো বাইরের তো বটেই। তুমি আমার বাল্যের ফিরে-দেখা গদ্যগুলো পড়েছ কিনা জানি না...সেখানে উত্তরপাড়া (আদিনিবাস), পানিহাটি (মামারবাড়ি), কোন্নোগর (বড়ো-ঠাকুমার বাড়ি), আহিরিটোলা (পিসিমার বাড়ি, বিখ্যাত সেন্টুদার আস্তানা) বড়িশা-বেহালা (সাবর্ণ জেঠু-কাকুর বাড়ি ) ইত্যাদি আত্মীয়স্বজনদের গভীর প্রভাব নিয়ে কথাবার্তা আছে। এই রচনাগুলো পাঠকদের কাছে পৌঁছোয় না, কেননা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশকরা সীমিত সংখ্যায় ছাপেন। ওইসব রচনাগুলো আমার কবিতার জন্য পড়ে রাখলে ভালো হয়। আমি তো পূর্ববঙ্গ থেকে এসে বলছি না যে আমি পশ্চিমবঙ্গের। পূর্ববঙ্গ থেকে ধর্ম বাঁচাবার ব্যে পালিয়ে এসে যদি পশ্চিমবঙ্গের কবি হওয়া যায়, তাহলে উত্তরপাড়ার লোক হয়ে হওয়া যাবে নাই বা কেন !
অনুপম: আচ্ছা আপনার আত্মজীবনীমূলক বইয়ের নাম 'ছোটোলোকের ছোটোবেলা'। শুভঙ্কর দাশ যে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেখানে আপনি ঘোষিত হয়েছেন cultural bastard বা সাংস্কৃতিক জারজ। অথচ আপনি সম্মানিত পিতার সন্তান। সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বংশধর। আপনার মাতামহ কিশোরীমোহনের নামে পানিহাটিতে রাস্তা আছে। পাটনার কনভেন্টে পড়াশোনা করেছেন।পরে উচ্চপদে চাকরি করেছেন। সবদিক থেকেই আপনি সামাজিক, সুরক্ষিত এবং মর্যাদাবান। তাহলে সাহিত্যের আঙিনায় নিজেকে 'ছোটোলোক', 'জারজ', 'বহিরাগত', বিহারি বাঙালি' --- এসব বলার কারণ কী ?
মলয় রায়চৌধুরী: সাহিত্যের আঙিনায় নয়; জীবনের আঙিনায়। লেখালিখিটা জীবনের একটা মাত্রা মাত্র। জীবন আরও ব্যাপক, রহস্যময়, ব্যাখ্যাহীন, এলোমেলো, খাপছাড়া, বহুত্বময়, সর্বগ্রাসী। জীবনের সবকিছু লেখা হয়ে ওঠে না, ওঠেনি, উঠবে কিনা জানি না।
অনুপম: তাহলে আরেকটা প্রশ্ন। যিনি স্বভাবকবি নন, হাংরি পর্বে তিনিই কবিতার অ্যাডিক্ট কী করে হলেন, কবিতাকে মাদক জ্ঞান কেন করে বসলেন ? আর এখন নেটিজেন সেই কবি মগজের রসায়নকে কমপিউটারের কি-বোর্ডে নামাতে পারছেন না কেন ?
মলয় রায়চৌধুরী: তুমি কি অ্যাডিকশান সম্পর্কে জানো ? সাইকোট্রপিক ড্রাগস নিয়েছ কি ? স্বভাবকবিত্ব ড্রাগ অ্যাডিকশানের বিপরীত জগতের প্রতিক্রয়া, যা মূলত মানসিক। অ্যাডিকশানটা শারীরিক, মানসিক, এমনকি সামাজিক। আমি জেনে-বুঝে অ্যাডিকশান শব্দটা প্রয়োগ করলুম, কেননা 'নেশা' শব্দ দিয়ে সাইকোট্রপিক ড্রাগ অ্যাডিকশান য়্যাখ্যা করা অসম্ভব। আর 'মাদক' শব্দটা দিয়ে ড্রাগ য়্যাখ্যা করা যায় না। ষাটের দশকে সাইকোট্রপিক ড্রাগ বেআইনি ছিল না। তা নিষিদ্ধ হয় আশির দশকে। তবে এখন আমার মদ খাওয়ার রুটিন আছে প্রতি সন্ধ্যায়। অনেকের সঙ্গে বসে আমি মদ খেতে পারি না, আমার একাকীত্ব নষ্ট হয়।
অনুপম: মলয়দা, বলুন তো 'বিস্ময়' শব্দটা আপনার কাছে কী ? চিরকাল, এবং এখন ।
মলয় রায়চৌধুরী: বিস্ময় শব্দের প্রতিশব্দ surprise নয়। surprise বলতে আশ্চর্য হওয়া বুঝবো। অনেক-কিছু আশ্চর্য লাগে বা সারপ্রাইজড হই, কিন্তু তা বিস্ময়ের নয়। আশ্চর্য হওয়াটা তাৎক্ষণিক। বিস্ময় শব্দটার ইংরেজি নেই বোধহয়। অন্তত এখনই মনে পড়ছে না। Dictionary of Philosophy দেখে বলতে পারব। বিস্ময় ব্যাপারটা লেখালিখির জ্ঞানজটিল, জীবনব্যাপী, একাকীত্বের প্রশ্নউন্মীলক। চুপচাপ বসে এই জিনিসটার মধ্যে ডুবে থাকা যায়। প্রক্রিয়াটা অত্যান্ত জরুরি। জীবনকে সতত প্রশ্নমুখি করে রাখার জন্য জরুরি।
অনুপম: 'মলয় রায়চৌধুরী' কি খুব একা একটা লোকের নাম, মলয়দা । এই মুহূর্তে ?
মলয় রায়চৌধুরী: হ্যাঁ।
অনুপম: এই একাকীত্ব কি আপনার অর্জন, না একাকিত্বই বেছে নিয়েছে আপনাকে ?
মলয় রায়চৌধুরী: হয়তো বয়সের জন্য। ঠিক উত্তর দেওয়া কঠিন। যদি গ্রামাঞ্চলে থাকতুম তাহলে এটা নাও হতে পারত। এই একাকীত্ব কোনো কবিত্বের ব্যাপার নয়; এটা আমি রেলিশ করি। বদেলেয়ারের এনুই-এর সঙ্গে বা সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী একাকীত্বের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলা ভুল হবে।
অনুপম: এখন কি পিছন ফিরে তাকালে ষাটের দশকের হাংরি মলয়কে চিনতে পারেন ? যে মলয় সমাজের গণ্যমান্য লোকদের চিঠি লিখে মুখোশ খুলে ফেলতে বলতেন...জুরোর বাক্স পাঠাতেন...পুলিশের ভয়ে গঙ্গাবক্ষে নৌকোয় লুকিয়ে থেকেছেন...এখন ওই আচরণগুলো সমর্থন করেন ?
মলয় রায়চৌধুরী: পুলিশের ভয়ে গঙ্গায় কেউই লুকোয়নি। হিপিদের সঙ্গে গঙ্গার তীরে কেউ-কেউ অবারিত যৌনজীবন কাটিয়েছেন। 'অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা' পড়েছ কী ? বেনারস ছিল সাইকোট্রপিক ড্রাগস এবং হিপিদের জমায়েত । পুলিশ এড়াতে কেবল সুবো আচার্য বিষ্ণুপুরে এবং প্রদীপ চৌধুরী ত্রিপুরায় চলে গিয়েছিলেন, যা ওঁদের বাপের বাড়ি। পুলিশ তবু ত্রিপুরায় গিয়ে প্রদীপকে গ্রেপতার করেছিল। পেছন ফিরলে কেবল সেই ষাটের মলয় নয়, বহু মলয়কে মেলানো দুষ্কর হয়ে ওঠে, বিশেষ করে ছাত্রজীবন, যা তুমি তিন কিস্তিতে প্রকাশিত 'অভিমুখের উপজীব্য' লেখায় পাবে। পরে লক্ষ্ণৌতে আমার অধঃস্তন তরুণ-তরুণী আধিকারিকদের সঙ্গে ( বোধ হয় প্রথম জেন এক্স ) লাগামহীন বাঁধনছেঁড়া হুল্লোড়ের জীবন; তারপর আটের দশকে সারা ভারত ত্যুর করতে থাকাকালে নতুন ও অপরিচিত জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হওয়ার জীবন। এই সত্তর বছর বয়সে সবই অচেনা ঠেকে, মেলানো কঠিন মনে হয়। যদি রোজনামচা লেখার অভ্যাস থাকত তাহলে তবু মেলাতে পারতুম, কিন্তু জ্বালিয়ে নষ্ট করে ফেলি।
অনুপম: আর যৌনতা ? যৌনতা আপনার কাছে কী? নাকি কামপ্রবৃত্তি বলব?
মলয় রায়চৌধুরী: যৌনতা শব্দটার ইংরেজি তো সেক্সুয়ালিটি। তুমি জানতে চাইছ সেক্স আমার জীবনে এবং দৃষ্টিতে কী ? কারেক্ট ? সেক্স আমার জীবনে সবাইয়ের মতন বয়ঃসন্ধিতে ঔৎসুক্য দিয়ে শুরু, কিন্তু নিম্ন বর্গের বিহারি সমাজে থাকার কারণে, ইমলিতলা পাড়ায়, তা খুল্লমখুল্লা বিপর্যস্ত করেছিল। দোলখেলার এক দিনের নিষেধহীনতা, ওই সময়ে বয়ঃসন্ধিকালে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ইমলিতলার মেয়েরা, বাঙালিরা যে-সমস্ত শব্দকে অস্লীল মনে করে, সেই শব্দাবলি সহযোগে, যাচ্ছেতাই করত। তখন থেকেই সেক্স আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এই হিসাবে যে তা অভিমুখ নির্ণয় করে। পশুপাখিদের হিট-পিরিয়ড হয়; মানুষের হলে বাকি সময়টা সে তার যৌবন নিয়ে কী করত? যৌনতা আমার কাছে, আমাদের সংরক্ষণশীল পরিবারে, সীমালঙ্ঘনের, বন্ধন কেটে বেরোবার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। আমি ক্যাসানোভা ছিলুম না, কিন্তু প্রেম-সম্পর্কের বাইরে, সমান্তরালভাবে, যৌন-সম্পর্ক গড়ে ফেলতে আমার ভালোই লেগেছে। তবে একটা ব্যাপার দেখেছি যে, বয়ঃসন্ধিতে সেক্স ছিল মগজ আর শরীরের মিশেল দেওয়া একমাত্রিক তপ্ততা। যত বয়স বেড়েছে, ততই তা ক্রমশ মগজের ব্যাপার হয়ে উঠেছে। যৌবনে মুখহীন নারী-শরীর ভাবতে পারতুম। যত বয়স বেড়েছে, নারীশরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পৃথক-পৃথক ডাক দিয়েছে । একটা কথা, বিহারে হোমোসেক্সুয়ালিটি ছাত্রদের মধ্যে চালু ছিল। হোমোসেক্সুয়ালিটি, কেন কে জানে আমার স্ট্রেঞ্জ এবং বিসদৃশ মনে হয়। হল্যাণ্ডে, অ্যামস্টারডামে, গে আর লেসবিয়েনদের বিরাট জমায়েত হয় প্রতি সন্ধ্যায়। জমায়েতের যুবতিগুলোকে দেখে আকৃষ্ট হতুম, তারা জোড়ায়-জোড়ায় চুমু খাওয়াখাওয়ি করতে থাকলেও। বেশ্যা পাড়ায় কনডাক্টেড ট্যুর করায়; সব যৌনকর্মী ছ'ফুটের বেশি লম্বা।
অনুপম: বৌদি এসব জানেন ? হাংরি মলয় কি কখনও নিজের চোখে নিজেকে দেখতে চেয়েছেন ?
মলয় রায়চৌধুরী: 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' এবং আমার কবিতার বিশেষ ধারা, লেখালিখি নিয়ে কোর্টকাছারি, জেল-জরিমানা, হাংরি আন্দোলন, এসব জানে; যৌবনের ঘটনা কিছু-কিছু জানে। তবে সাহিত্যকে অনর্থক সময় নষ্ট মনে করে। সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ নেই, যদিও আমার সঙ্গে বিদেশি বা এখানকার লেখক-কবিরা দেখা করতে এলে ওর ভালো লাগে; পত্র-পত্রিকায় এবং ইনটারনেটে ফোটো বেরোলে আনন্দিত হয়। আমার মেয়ে অক্সফোর্ড ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ছাত্রী হওয়ার পর যৎসামান্য আগ্রহ হয়েছিল। দাদা ছাড়া আমাদের পরিবারের আর কেউ সাহিত্যে আগ্রহান্বিত নয়। ব্যাংকশাল কোর্টে মামলা চলার সময়ে আমার বাবা, জ্যাঠা, কাকা, পিসেমশাই কেউ না কেউ ডেট পড়লে আসতেন। অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের পরিবার থেকে কেউ আসতেন না। তা সাহিত্যের জন্য নয়। আমাদের বাড়িতে প্রতি প্রজন্মে এক-দুজন পুলিশের মামলায় পড়েছে, তাই এই ঘটনাটা আমার প্রজন্মের প্রাপ্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' পড়ে ওঁরা বলেছিলেন, "এ ধরনের কঠিন-কঠিন পদ্যর কোনো মানে হয় না।" Stark Electric Jesus কবিতাটি ইনটারনেটে আমার ছেলে পোস্ট করেছিল। আমি তখনও কমপিউটারে টাইপ করতে জানতুম না।
অনুপম: মলয়দা, তাহলে কি খুব দোষ দেওয়া যায়, যখন সাধারণ বাঙালি ভেবে বসেন যে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি একজন অসুস্হমনা যুবকের যৌনবিকৃতির ফসল ? তা-ও সেই ষাটের দশকে ? যৌনতার নতুন রূপকথা তৈরি করতে চেয়েছিলেন কি ?
মলয় রায়চৌধুরী; আমার জ্যাঠা, বাবা, কাকা, মা এমনকি ঠাকুমারও মনে হয়নি যে কবিতাটি নীতিভ্রষ্ট মগজের ফলাফল; ওঁরা কেবল সহজ করে লেখার উপদেশ দিতেন। 'জখম' ওই সহজ করে লেখার প্রয়াস। কোনো সাধারণ পাঠক এমন অভিযোগ তো কখনও করেননি, এমনকি অধ্যাপক তরুণ মুখোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী এবং শীতল চৌধুরীও করেননি। আনন্দ বাগচী 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি ওঁর সম্পাদিত 'প্রথম সাড়া জাগানো কবিতা' সংকলনে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন। অভিযোগটা করেছেন অ-সাধারণ পাঠকরা, যাঁরা নিজেরাও কবিযশোপ্রার্থী, এবং যাঁরা কলকাত্তিয়া সাহিত্যের মালিকানা দাবি করতেন। এখন একুশ শতকে পৌঁছে ওই অভিযোগকারীরা, যাঁরা বেঁচে আছেন, নিজেরাই টের পাচ্ছেন যে তাঁরা সময় থেকে কত পিছিয়ে ছিলেন। আমি কোনো পাঠককেই দোষ দেব না, কেননা আমি তো জোর-জবরদস্তি পড়তে বাধ্য করছি না। যাঁর যেমন ইচ্ছা তিনি তেমন ভাববেন। কবিতা লিখতে বসে সেক্সকে এইভাবে ব্যবহার করব, ওইভাবে প্রয়োগ করব, এমনটা কখনও ভাবিনি; সেসব ভেবেছি গল্প-উপন্যাস লেখার সময়। কবিতায় সেক্স এসেছে ইমলিতলা পাড়ায় থাকার কারণে। ইমলিতলায় সেক্স জীবনযাপনের একটা স্বাভাবিক ও নিত্যনৈমিত্তিক উপাদান ছিল। 'ছোটোলোকের ছোটোবেলা' বইয়ে পড়ে থাকবে যে আমাদের বৈঠকখানা ঘরে যে কুয়ো ছিল সেখানে পাড়ার বউরা বিয়ের অতি-অশ্লীল গান গাইবার জন্য দল বেঁধে জড়ো হতেন। সেক্স-এর নতুন রূপকথা তৈরি হয়ে থাকলে তা ওই দলিত মহিলাদের সাংস্কৃতিক অবদান। ভোজপুরি-মঘাই-পাটনাইয়া বুলিতে বহু সিডি আছে এইসব গানের।
অনুপম: তাহলে কি আপনার কবিতায় সেক্স এসেছে, প্রকৃত কাম-তাড়না থেকেই এসেছে ? হাংরি মলয় তাহলে ঠিক কতটা সেক্সুয়ালি হাংরি, আর কতটা সামাজিকভাবে ক্রুদ্ধ ? দুটিকে আলাদা করা কি খুব সহজ ?
মলয় রায়চৌধুরী: এই প্রশ্নের উত্তর বুড়ো বয়সে দেওয়া কঠিন, কেননা এখন যৌনতার বোধ মস্তিষ্ক-নির্ভর হয়ে রয়েছে। হাংরি আন্দোলনের সময় ছিলুম টাটকা যুবক। আত্মমৈথুন কাকে বলে সেটাই শরীরের পক্ষে স্মরণ করা কঠিন। তোমার প্রশ্নের উত্তরটা আমি পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিতে চাইব। এখন তো আর সেক্স সম্পর্কে সেরকম ভাবনা নেই; সামাজিকভাবে ক্রোধ অনেক বেশি এখন; এখন সমাজকর্তাদের ( রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক ) বিশ্বাসঘাতক, অপদার্থ, চোর, নেপোটিস্ট, পশ্চিমবঙ্গবিরোধী মনে করি।
অনুপম: আরেকটা হাংরি আন্দোলন হচ্ছে না কেন ? কোনোকিছুই তো সেই অর্থে আজও বদলায়নি। নাকি আপনাদের তুলনায় আমাদের প্রজন্মটাই অনেক বদলে গেছে মনে হয় ?
মলয় রায়চৌধুরী: হাংরির মতন আন্দোলন কেবল নয়, আর কোনো আন্দোলনই সম্ভব নয়। আমি শুধু বঙ্গসমাজের কথা বলছি না, সারা ভারতবর্ষের কথা বলছি। আমার 'পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন' প্রবন্ধটা পড়েছ কি না জানি না, কিংবা 'উত্তরদার্শনিকতা' প্রবন্ধটা পড়েছ কি ? আমরা উত্তরদার্শনিক কালখণ্ডতে পৌঁছেচি, মূলত প্রযুক্তির দ্রুতগামী রদবদলের জন্য। বিজ্ঞান আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত হস্তক্ষেপ করে চলেছে। এক দশকে যে রদবদল ঘটছে তা আগে এক শতক সময় নিয়ে ঘটত। ফলে রিডিফাইন হয়ে চলেছে ভাবনা-চিন্তার পরিসর। 'আই পিল' খেয়ে কি কোনো তরুণী প্রেমের কবিতা লিখতে পারতেন । 'আই পিল' বস্তুত প্রেমিক-মুক্ত করে দিয়েছে একজন তরুণীকে। রেভ পার্টিতে কেবল এস.এম.এস. পেয়ে হাজির হওয়া যায়, যেখানে অচেনার সঙ্গে সংসর্গই প্রধান লক্ষ্য...লেখকরা embeded হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে লেখার রসদ যোগাড় করে। দুমদাম বোমা ফেলে collateral damage হাজার-হাজার অসামরিক লোকদের নিকেশ করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে-স্কুলে রুটলেস কমরেড টিচার পাঠিয়ে উন্নতির নামে গ্রামসমাজকে নষ্ট করা যায়। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা কমরেড নেতারা মন্ত্রী হয়ে আদিবাসী-উপজাতিদের দিব্যি ভুলে থাকতে পারেন দশকের পর দশক অথচ নিজেদের গুষ্টিদের ধোপদুরস্ত জীবনে তুলে ফেলেন। কত আর বলব? আমাদের প্রজন্মের তুলনায় সমস্ত-কিছু বদলে গেছে। আধুনিকতার তত্বগুলো অনুমান করতে পারেনি যে আসল-চালক তোব্যক্তি-মানুষ; মার্কসবাদ বা গাঁধিবাদ বা অন্য কোনো বাদ তো রাষ্ট্রকে চালায় না, চালায় মানুষ। কৌমসমাজ তো ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত; সেই ব্যক্তিটাই এখন ভিন্ন, সে চলে গেছে দার্শনিকতার ওই পারে, সেখানে আর কোনো আন্দোলন সম্ভব নয়।
অনুপম: তাহলে আপনি নিজেকে অধিক সার্থক কোন পরিসরে মনে করেন --- হাংরি না অধুনান্তিক ?
মলয় রায়চৌধুরী: 'সার্থক' শব্দটা উনিশ শতকের ভাবুকদের অবদান। সেই সময়ের চিন্তাবিদরা ব্যক্তি-মানুষকে পৃথিবীর কেন্দ্রে বসিয়ে নানারকম স্বপ্ন দেখেছিলেন। এখন জানা গেল ব্যক্তি-মানুষকে নিয়ে এমন সরলীকরণ করা যায় না; সে অনেক জটিল, কেননা তার আত্মপরিচয় বহুমাত্রিক ও এলোমেলো এবং সে সতত, সারাজীবন নানা ফ্লাক্সের মধ্যে কাটায়। এখন আর উনিশ শতকের মতো ভাবুকও সম্ভব নয় । আমাদের চারিদিকে তাকালে নানা ক্ষেত্রের বহু ব্যক্তিকে দেখতে পাব, যাদের নিয়ে মিডিয়ার জায়গাতে হইচই হয়, কিন্তু তা কেবল বহুমাত্রিকতার একটা মাত্রা মাত্র। স্বাভাবিক যে আমিও নিজেকে কোনো পরিসরে সার্থক মনে করি না।
অনুপম: অনুবাদক হিসেবে কোনো টেক্সটের প্রতি কখন আগ্রহ জন্মায় আপনার ? অনুবাদক হিসেবেই অকাদেমি পুরস্কার পেয়েও প্রত্যাখ্যান করলেন কেন ? হাংরিদের কি ওটা নিতে নেই ?
মলয় রায়চৌধুরী: উইলিয়াম ব্লেকের Marriage of Heaven and Hell কবিতাটি এমন ফর্মহীন লেখা যে অবাক করার মতো; তখনকার কোনো সাহিত্যিক ও ধার্মিক প্রতিনিষেধ স্বীকার করেননি উনি। তাছাড়া বিষয়বস্তুকে যেমনভাবে ইচ্ছে ব্যাখ্যা করা যায়। স্নাতক স্তরে ব্লেক পাঠ্য ছিলেন, কিন্তু ইংরেজির বাঙালি অধ্যাপক এই কবিতাটির উল্লেখ করতেন না, অথচ ব্লেক সম্পর্কে যাবতীয় কাহিনী আমাদের শোনাতেন। আমি ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলুম বলে ( বিদেশিনী নানরা পড়াতেন, সংলগ্ন চার্চে প্রতি বৃহস্পতিবার বাইবেল ক্লাস হত ) কবিতাটি চার্চ-ক্লাসের রহস্যে নিয়ে যেত। আমি কোনো সাহিত্যিক পুরস্কার নিই না। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরাও পুরস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন, এমনকি বাড়িতে এসে অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছেন, সে সমস্ত পুরস্কার ও সম্মানও তো নিইনি, তাহলে সরকারি পুরস্কার নিতে যাব কেন ?
অনুপম: স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আসা ছিন্নমূল মানুষগুলোর উপর আপনার এতটা রাগ কেন, মলয়দা ? এই সাক্ষাৎকারেও সেটা ধরা পড়েছে। ওঁদের সাবঅলটার্ন ভাবতে পারেন না ?
মলয় রায়চৌধুরী: আমার অভিযোগ সেই লোকগুলোর বিরুদ্ধে যাঁরা পূর্ববঙ্গে থাকতে পাকিস্তান চেয়েছিলেন, অথচ যেই দেশভাগ হল, তাঁরাই সবচেয়ে আগে পালিয়ে এলেন (অশোক মিত্র স্বীকার করেছেন )। তাঁদের অনেকেই সত্তর দশক থেকে এখানে মন্ত্রী-সান্ত্রি হয়ে বসলেন, এবং পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক উন্নতির বদলে নিজেদের কাজ গোছাবার ধান্দাবাজি শুরু করলেন। গত তিরিশ বছরে তাঁরাই পশ্চিমবঙ্গকে ডুবুয়েছেন। তুমি বলছ এঁদের সাবঅলটার্ন ভাবতে ! আদিবাসী-উপজাতিরা আজ ক্রুদ্ধ কেন ? ওঁদের ওই আত্মসেবাজনিত অবহেলার জন্যে। এখানে পালিয়ে এলেন কেন ? ধর্ম বাঁচাবার জন্যে। এখানে এসে তাঁরা কেউ নিরীশ্বরবাদী, কেউ ধর্মহীন, কারও কাছে ধর্ম মানে আফিম, কেউ আবার সেকুলার। এই তর্কগুলোর উত্তর একটাই। তাহলে ইসলাম ধর্ম নিয়ে চোদ্দপুরুষের ভিটেমাটিতে থেকে গেলেন না কেন ? ওঁদের কাছে তার মানে মু। ছিল ধর্ম, ভিটেমাটি নয়। আমি কোনো-কিছু লুকোই না, খোলাখুলি বলি; অনেকে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় তা সীমিত রাখেন। আর আমি খোলাখুলি বলি বলে পশ্চিমবঙ্গীয় কবি-লেখকরা আমার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলতে ইতস্তত করেন না।
অনুপম: এখন এই অধুনান্তিক পর্বে আপনি বলছেন হাংরি আন্দোলন ছিল একটি প্রতিসন্দর্ভ। হাংরি তো ছিল আচরণ ও জীবনচর্চাভিত্তিক একটি আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন। ষাটের দশক কি কোনোভাবে বুঝতে পেরেছেল যে, হাংরি ছিল প্রতিসন্দর্ভ ?
মলয় রায়চৌধুরী: সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের মালিকদের সন্দর্ভের করা হয়েছিল মানেই তো প্রতিসন্দর্ভ। তোমার হয়তো প্রতিসন্দর্ভ শব্দটা বিদ্যায়তনিক লাগছে। প্রতিসন্দর্ভ মানেই তো আর অধুনান্তিক নয়। ফরাসি বিপ্লব তো ছিল প্রতিসন্দর্ভ। ডাডা আন্দলন ছিল প্রতিসন্দর্ভ, ইয়াং বেঙ্গল ছিল প্রতিসন্দর্ভ। ওই বিপ্লবী-বিরোধী-সীমালঙ্ঘনকারীরা জানতেন কীসের এবং কাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হচ্ছে, আচরণ ও আস্ফালন করা হচ্ছে। ঠিক তেমনি হাংরি আন্দোলনকারীরাও জানতেন। শাস্ত্রবিরোধীরা জানতেন, নিম সাহিত্যিকরা জানতেন।
অনুপম: 'কবিতা পাক্ষিক' পত্রিকা সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত আপনার ধারণা কী ? আপনার কি মনে হয় অধুনান্তিক চিন্তা-চেতনাকে বাংলা কবিতায় ব্যবহার করা গেছে ?
মলয় রায়চৌধুরী: 'কবিতা পাক্ষিক' ফাস্ট বোলারের হাতের বলের মতন। ১৫০ kmph হয়ে হাত থেকে বেরিয়েছিল; পিচে পড়ে তা অন্য চেহারা নিল, পিচটার জন্য। পাক্ষিক কবিতা পত্রিকার জন্যে প্রতিনিয়ত রসদ জোগাড় করা এবং তাকে নির্দিষ্ট স্তরে টিকিয়ে রাখা কঠিন। কমার্শিয়াল পত্রিকা নিজেদের মালিকানা অনুযায়ী কবিতা ছাপে; জয় গোস্বামী চলে গেলে তাঁর ক্লোনদের কবিতা বেরোয়। লিটল ম্যাগাজিন, তাও বেশ কিছুকাল যাবৎ প্রকাশ হয়ে চলেছে, কবিযশোপ্রার্থীদের নিজস্ব প্রয়াসকে অস্বীকার করতে পারে না। সম্পাদক নিজে কবি হলে ব্যাপারটা আরও জটিল। বাংলা কবিতার আর কোনো সীমা নেই। এটাই তো অধুনান্তিকতার লক্ষণ।
অনুপম: একজন অ্যালেন গিনসবার্গের সঙ্গে একজন মলয় রায়চৌধুরী কতটা মেলাতে পারেন নিজেকে ?
মলয় রায়চৌধুরী: একেবারেই পারি না। অ্যালেন গিনসবার্গ বিট আন্দোলনের সময়েও প্রচুর টাকার মালিক ছিলেন, পৃথিবীতে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারতেন, যে বই ইচ্ছে কিনতে পারতেন। আমার তো প্রতিদিন উত্তরপাড়া থেকে কলকাতা যাওয়া, পাইস হোটেলে খাওয়া, নিজের জামা-কাপড় নিজে কাচা এইসব ব্যাপারেই যথেস্ট রেস্ত দরকার হত। পাটনা থেকে কলকাতা পৌঁছোতে হত জনতা এক্সপ্রেসের ভিড় ঠেলে। অ্যালেন তো দিব্যি ঝোলা খুলে ডলার বের করতেন। ওঁর বাবা এবং সৎ মা-ও ধনী ছিলেন। আমি যেখানে পাটনাইয়া উনি সেখানে নিউ ইয়র্কার। আমি কুড়ি জনের একান্নবর্তী পরিবার থেকে, আর উনি বাবা, মা আর ভাই। উনি প্রথম বিশ্বের, আমি তৃতীয় বিশ্বের। কলকাতার ষাটের লেখক-কবিদের সঙ্গেও কি মেলাতে পেরেছি নিজেকে ? পারিনি। The Other বা 'অপর' থেকে গেছি।
অনুপম: ষাটের দশকের ক্ষুধার্ত বন্ধুদের সঙ্গে এখন যোগাযোগ আছে ?
মলয় রায়চৌধুরী: না।
অনুপম: এখন কী ধরণের বইপত্র পড়ছেন ? ২০০০ পরবর্তী বাংলা কবিতা পড়েন ?
মলয় রায়চৌধুরী: এক্ষুনি হাতে কোনো বই নেই, তাই কিছুই পড়ছি না। কলকাতায় থাকতে ডিসেম্বর ২০০৯-এ শেষ পড়েছি William Darilymple-এর লেখা বাহাদুর শাহ জাফরের জীবনী। ২০০০ পরবর্তী কবিতার বই কেউ পাঠিয়েছেন বলে মনে পড়ছে না। লিটল ম্যাগাজিনও বিশেষ পাই না। বাংলা ওয়েবসাইটগুলো দেখি; তুমি আর আর্যনীল ( আমি জানতুম না ওর আসল নাম নীলাঞ্জন ) নতুন পোস্টিং হলেই লিংক পাঠাও। কেউ কেউ তাঁদের কবিতা ই-মেল করেন। বাংলাদেশি কবিরা ফেসবুকে ওঁদের লিংক পোস্ট করেন। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে পড়ার সুযোগ নেই। ২০০০ পরবর্তী কবিতা যে বাঁকবদল ঘটাতে চাইছে তা টের পাই, কিন্তু সম্পূর্ণ ছবিটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
অনুপম: প্রাক-আধুনিক পরিসর থেকে আজ অবধি দশজন কবির নাম যদি বলতে বলি ?
মলয় রায়চৌধুরী: বলতে পারব না। প্রাগাধুনিক বললেই স্কুলপাঠ্য কবিদের নামগুলি বেশি করে মনে পড়ে। আধুনিক বললেই তিরিশ দশক মাথায় চলে আসে। মাঝের পর্বটা কী, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ?
অনুপম: বলা কঠিন মলয়দা। আমার তো মনে হয় রবীন্দ্রনাথ একদিকে, আর বাংলা কবিতার বাকি সবকিছু আরেক দিকে, তাহলেও ওঁর দিকেই পাল্লা ভারি থাকবে। ওঁর শক্ত-দুর্বলতা, সফলতা-বিফলতা সব মিলিয়ে উনি একাই 'বাংলা কবিতা'। কারও সঙ্গে কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা হয় না। রবীন্দ্রনাথ আপনার চোখে কী ?
মলয় রায়চৌধুরী: রবীন্দ্রনাথ বাঙালি মধ্যবিত্তের অনস্বীকার্য সাংস্কৃতিক আইকন।
অনুপম: মলয় রায়চৌধুরী কি কবিতা আর লিখবেন না ?
মলয় রায়চৌধুরী: জানি না লিখব কি না । কবিতার লাইন মাথায় আসে, কেমন যেন লিরিকাল; ফলে কলম নিয়ে বসতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া আঙুলের সমস্যার জন্য কলম ধরতে হয় তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে, যা বেশ বিরক্তিকর ।
মলয় রায়চৌধুরীর ( জন্ম ২৯ অক্টোবর, ১৯৩৯ম ) অনেক পরিচয় আছে। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক।কিন্তু এখনও তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচয় তিনি ষাটের দশকের সেই বিখ্যাত হাংরি আন্দোলনের পুরোধা-পুরুষ। তখন, এবং এখন, সাহিত্যের কোনো অনুশাসন তিনি কখনও মানতে চাননি। সে ষাটের দশকের হাংরি আন্দোলন হোক বা শতক-শেষের অধুনান্তিক চিন্তা।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উত্তরপাড়া শাখার সন্তান মলয়। বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী ছিলেন চিত্রশিল্পী-ফোটোগ্রাফার। মা অমিতা ছিলেন রোনাল্ড রসের সহায়ক কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা। বড়দা সমীর রায়চৌধুরীও একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক। শৈশব কেটেছে পাটনায়। সেখানে সেন্ট জোসেফ কনভেন্টে প্রাথমিক শিক্ষা হয়।পরে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। গ্রামীণ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রশিক্ষণের পর প্রথমে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, পরে এ. আর.ডি.সি., এবং নাবার্ডে উচ্চপদে ভারতের বিভিন্ন শহরে কর্মরত ছিলেন। সারাজীবন ভারতের চাষি, তাঁতি, জেলে, হস্তশিল্পীদের মধ্যে কাটিয়ে যে অভিজ্ঞতা, তা তাঁর কবিতায় বেশ গভীর ছাপ রেখেছে। অবসর নেন ১৯৯৭ সালে।
১৯৬১ সালে দাদা সমীর রায়চৌধুরী, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়-এর সঙ্গে হাংরি আন্দোলন শুরু করে আবির্ভাবেই সাড়া ফেলে দেন। পরে প্রায় চল্লিশজন কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী এই আন্দোলনে যোগ দেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, রবীন্দ্র গুহ প্রমুখ। আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে এক পাতার বুলেটিন প্রকাশ করা হত। একশো আটটি বুলেটিন বেরিয়েছিল। তার মধ্যে কয়েকটি 'লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি' এবং ঢাকা বাংলা অ্যাকাডেমিতে সংরক্ষণ করা গেছে। ১৯৬৫ পর্যন্ত পুরোদমে চললেও, বিখ্যাত হাংরি মকদ্দমার পর ভেঙে যায় আন্দোলনটি।
১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটির জন্য মলয় অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। ৩৫ মাস ধরে কোর্ট কেস চলে। কলকাতার নিম্ন আদালতে সাজা ঘোষণা হলেও, ১৯৬৭ সালে উচ্চ আদালতে অভিযোগমুক্ত হন। মলয়ের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত ও সত্রাজিৎ দত্ত। রাজসাক্ষী ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, পবিত্র বল্লভ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু। এই মামলাই মলয়কে বিখ্যাত করে তোলে। ইউরোপ-আমেরিকায় তাঁর নাম পৌঁছে যায়। বিখ্যাত Time পত্রিকা হাংরি আন্দোলন নিয়ে লেখা প্রকাশ করে। বিভিন্ন ভাষায় মলয়ের কবিতা অনুবাদ করা হয়। সাম্প্রতিককালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত Modern and Post Modern Poetry of the Millenium সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে অন্তর্ভুক্ত এটিই একমাত্র কবিতা বলে জানিয়েছেন সম্পাদক জেরোম রোদেনবার্গ।
প্রথম কাব্যগ্রন্হ শয়তানের মুখ ( কৃত্তিবাস প্রকাশনী, ১৯৬৩ ) থেকেই মলয় রায়চৌধুরী আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতার এক জলবিভাজক ব্যক্তিত্ব। কবিতায় যে-কোনো নিয়মানুবর্তিতা ও আনুগত্যকে মলয় চিরকাল নাকচ করেছেন। তুমুলভাবে ব্যবহার করেছেন যৌনতা। আবার সমাজচিন্তা ছাড়া তাঁর কবিতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ভাষা-ছন্দ-অলংকার-চিত্রকল্পে বিপুল ভাঙচুরের মধ্যেই তাঁর কবিতার সুর একজন অসহায় ব্যক্তিমানুষের আর্তি ও যাতনা। তা ফুটে ওঠে ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাসে, যৌন-অনুষঙ্গে। বাঙালি পাঠক এই সুর সর্বান্তঃকরণে আজও গ্রহণ করতে পারেনি। পারার কথাও হয়তো ছিল না। কবিতা এবং গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি অনুবাদক হিসেবে মলয় সার্থক। ২০০৩ সালে অনুবাদকর্মের জন্য তাঁকে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার দিতে চাওয়া হলে সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দেন, কারণ তার আগে বহু লিটল ম্যাগাজিনের পুরস্কার তিনি নেননি।
বর্তমানে মলয় রায়চৌধুরী অসুস্হ। লিখতে গেলে বেশ হাত কাঁপে। কবিতা প্রায় দশ বছর লেখেননি। সময় কাটান ইনটারনেটে। কলকাতাকে পাকাপাকি ভাবে ছেড়ে গেছেন মুম্বাই শহরে। সেখানে সস্ত্রীক কাটাবেন শেষ জীবনটা।
অনুপম: মলয়দা, কবিতা লেখা এখন তো ছেড়েই দিয়েছেন আপনি। গদ্য-সাহিত্যেই কি মনোনিবেশ করতে চাইছেন পুরোপুরি ? অনেকদিন আপনার কোনো নতুন কবিতা পড়িনি। এই সিদ্ধান্তের কারণ কী ? কবিতা লিখতে ভালো লাগছেনা আর ?
মলয় রায়চৌধুরী: ২০০৪-এর পরে আর কবিতা লিখিনি; লিখতে পারিনি। মাথায় যা-কিছু আসে, মনে হয় একঘেয়েমি হয়ে যাবে। আমি তো সেনটেন্সের ভার্সিফায়ার বা স্বভাবকবি নই। ইদানিং কবিতা-লেখা ব্যাপারটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল আমার আর পাঠকের প্রয়োজন নেই। পাঠকদের চিঠি বা ই-মেল এলে আশ্চর্য অনুভূতিতে আক্রান্ত হই। সমস্যা আমার আঙুলেরও। বুড়ো আঙুলে আথ্রাইটিসের কারণে কলম ধরার পর ইরিটেশন হতে থাকে, যা চিন্তাকে ডিসটার্ব করে। ইনটারনেটে এক আঙুলে কাজ চালাই, কিন্তু কবিতা লিখতে বসে এক আঙুল কমপিউটারে আর সেই সঙ্গে মগজের রসায়নকে সেই আঙুলের ডগায় নিয়ে যাওয়া বেশ অ্যাবসার্ড। নতুন গদ্য লিখিনি; যা-কিছু প্রকাশিত হয় সবই পুণর্মুদ্রণ। এক আঙুলে গদ্য লেখা আরও কঠিন। ফিকশানাল গদ্যগুলো জীবনের টুকরো-টাকরা মিশিয়ে বানানো। এমন অনেক-কিছু লিখেছি যা বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের ছেলেমেয়েদের পছন্দ হয়নি, ফিকশানালাইজেশান সত্বেও। প্রবন্ধ লিখতে আর ভালো লাগে না। এক আঙুলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এবং ব্লগ যেটুকু যা হয়। আজকাল একটা অদ্ভুত সাইটে ঢুকে পড়েছি; ওটা দেখেছ কি? Chatroulette.com । খুললেই স্ট্রেট তোমার সামনে অচেনা কেউ দেখা দেবে, তার ভালো লাগলে দুমিনিট নিজের ভাষায় কথা বলবে, তারপর অন্য কেউ; মুখোশ পরে ল্যাংটো পোঁদে কেউ-কেউ কোন ভাষায় যা কী বলছে টের পাই না। এটাকে কী বলব? ওয়েবক্যাম থাকলে দেখো। কবিতা কি এই নেক্সটিং পর্যায়ে নিয়ে যাবে ? তোমার ও পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা নিয়ে যাবেন আশা করি। কমপিউটারে উত্তর লিখছি বলে ইংরেজি শব্দ চলে আসছে: মুম্বাই শহরটাও তো ইংরেজির দিকে দৌড়োচ্ছে !
অনুপম: মলয় রায়চৌধুরীকে আমরা জানি বাংলা কবিতার নেটিজেন হিসেবেও। আপনার কি মনে হয় ভবিষ্যতে প্রিন্ট মিডিয়া জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ? সেই দিকেই কি এগোচ্ছি আমরা ?
মলয় রায়চৌধুরী: জাহিরুল হাসান ওঁর ত্রৈমাসিক বার্তায় লিখেছিলেন, "মলয় রায়চৌধুরীও নেটিজেন হলেন"। তার মানে আমার আগে কয়েকজন নেটিজেন ছিলেন। ওঁরা কারা তা জানিনা। আমাদের ভাষায় প্রথম নেটিজেন কবি, আমার মনে হয়, রোহন কুদ্দুস। বস্তুত আমি তো ভেবেছিলুম, রোহন একজন বাংলাদেশি কবি; লজ্জার কথা নিঃসন্দেহে, পরের প্রজন্মের কবিদের লেখাপত্রের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত নই। রোহনকে পথিকৃৎ বলা যায়। আমি যেভাবে লিটেরারি নেটওয়ার্কিং করি, লেখালিখি করি, ইনটারভিউ ইত্যাদি দিয়ে থাকি, সেভাবে অনেকেই এই এলাকায় প্রবেশ করেননি, তাই চোখে পড়েন না ওঁরা। ভারতবর্ষে বাংলা সাহিত্যে ইনটারনেট প্রিন্ট মিডিয়ার জায়গা মোটেই নিতে পারবে না ; অন্তত পঞ্চাশ বছর লাগবে সমান্তরাল মাধ্যম হয়ে উঠতে। বাংলাদেশে কমপিউটার তো বহু বছর আগে ইনট্রোডিউস হয়েছে, কিন্তু এখনও ইনটারনেট প্রিন্ট মিডিয়ার সমান্তরাল নয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের লাইব্রেরিগুলোর যা অবস্হা, ছাপা বইয়ের স্হায়িত্ব সমস্যাজনক। স্হায়িত্বের জন্য ইলেকট্রনিক মাধ্যম জরুরি হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সাইবার কাফেগুলোয় বাংলা ফন্ট নেই, ভাবতে পারো ? এদিকে বাংলা ভাষা বাঁচাও নিয়ে কত চিৎকার শুনতে পাই। কমপিউটার ঢুকছে কুড়ি বছর পর, তার ওপর ইংরেজি শিক্ষা তুলে দেয়া হয়েছিল। নেট স্যাভি একটা কবি-প্রজন্মের উন্মেষ ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে, ফলে ইনটারনেটে বাংলা কবিতার জায়গাটা প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু তুমি যদি সুধীন দত্ত, আলোক সরকার, অরুণেষ ঘোষ খোঁজো তো পাবে না। গুগল করলে তিরিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের কয়েকজন কবির অনুবাদ ( আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের দৌলতে ) বা তথ্য পাওয়া যাবে। পশ্চিমবঙ্গের জন্যও তাকিয়ে থাকতে হয় বাংলাদেশি নেটিজেনদের দিকে।
অনুপম: মলয়দা, হাংরি আন্দোলন নিয়ে গত প্রায় পাঁচ দশকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে-দিতে আপনি হয়তো খুব ক্লান্ত।তবু একটি চর্বিতচর্বণ। এই দু'হাজার দশ সালের মুম্বাই শহরে বসে ষাটের দশকের আন্দোলনটির দিকে
তাকালে কীরকম লাগে ? কী করতে চেয়েছিলেন কবিতায়?
মলয় রায়চৌধুরী: নাহ। হাংরি আন্দোলন নিয়ে আর কিছু বলার নেই। হাংরি আন্দোলনের সময়ে কবিতার অ্যাডিক্ট ছিলুম; কবিতা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রাগ।'সাহিত্য' শব্দ দিয়ে ওই ড্রাগ অ্যাডিকশান ব্যাখ্যা করা যাবে না। যারা এর অ্যাডিক্ট তারা নিজেরা বুঝে নিতে পারবে; কবিতা ছাপানো, সমালোচনা, আলোচনা এই সবই এই অ্যাডিকশানের প্রেক্ষিতে অবান্তর।
অনুপম: ঠিকই মলয়দা। কিন্তু খারাপ লাগে না, যখন মলয় রায়চৌধুরী এই নামটি পরিচিত হয়ে যায়, কিন্তু যা নন তাই দিয়েই সকলে তাঁকে ব্যাখ্যা করতে চায় ? অসহায় লাগে না ? আপনার নামটা জানে, কিন্তু ভুল ভাবে জানে, তাই না ? অনেকের কাছে আপনার বয়স ষাটের দশকের পর আর বাড়েনি । তারা একটা কবিতাতেই আটকে আছে -- 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'।
মলয় রায়চৌধুরী: আমার তা মনে হয় না। বেশির ভাগ পাঠক, যাঁরা নেট-এ যোগাযোগ করেন, তাঁরা আমাকে গদ্য লেখক বলে মনে করেন, 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এর লেখক, বিশেষ করে বাংলাদেশে। ওঁরা আমার উপন্যাসের তালিকা ও প্রাপ্তিস্হান জানতে চান। আমার নিজের কাছে যদিও 'নখদন্ত' লেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি নন-অ্যাকাডেমিক কলকাতাকেন্দ্রিক কফিহাউস আলোচকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। Milansagar.com -এ 'জখম' সবচেয়ে বেশি হিট পেয়েছে । এই পাঠকরা কলকাতার বাইরে বলে অনুমান করা যায় , যাঁদের কাছে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতা সম্পর্কিত কিংবদন্তি পৌঁছোয়নি। তোমার যতটা মনে হচ্ছে আমি ততটা পরিচিত নই। কেননা 'নামগন্ধ' উপন্যাসটা আমি একশো জন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদককে, যাঁরা কুড়ি বছরের বেশি পত্রিকা বের করছেন, ডাকযোগে পাঠিয়ে ( বইটা তাই দু'টাকার স্ট্যাম্পযোগ্য করে ছাপানো হয়েছিল ), পরে টেলিফোনে ফিডব্যাক নিতে গিয়ে জানতে পারি যে অধিকাংশ সম্পাদক আমার নাম শোনেননি। এমনকি হাংরি আন্দোলনের নাম শোনেননি। অসহায় লাগে নি ।
অনুপম: ঠিক আছে মলয়দা । কিন্তু 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি আমেরিকায় জনপ্রিয়। হাংরি মামলা চলার সময়ে ওটার অনুবাদ Stark Electric Jesus-এর দৌলতে আপনার কিছু অর্থাগম হয়েছিল, যা আপনার কিছু সুরাহা করেছিল। সেটা আমেরিকা থেকেই পাওয়া। এখনও আমেরিকা-প্রবাসী আর্যনীলের মুখে শুনতে পাই আপনি নাকি ওদেশে জনপ্রিয় বাঙালি কবি। মার্গারেট রেনডাল, ক্যারল বার্জ, জেরোম রোদেনবার্গ আপনার লেখা সংকলবদ্ধ করেছেন, বই ছেপেছেন --- এসব নিয়ে আপনি কী ভাবেন ? আমেরিকা কবিতার পীঠস্হান নয়, বাংলা কবিতার তো একেবারেই নয় । তবু -- অন্য একটা দেশ --
মলয় রায়চৌধুরী: আগের প্রশ্নটার উত্তরে আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি। শুভঙ্কর দাশ দিনকতক আগে Outsiderwriters.org-এর জন্যে যে সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তাতে বাঙালিদের কমেন্টগুলো এসেছে আমার ফিকশান নিয়ে, আর অবাঙালিদের কমেন্টগুলো ভারতীয় সাহিত্যের প্রেক্ষিতে আমার লেখার সামগ্রিক মূল্যায়ন। ডঃ কবিতা বাচকনভি লিখেছেন যে ভারতবর্ষে ষাটের আন্দোলনের দশকের পর উদয় হয়েছেন বিকাউ বা বেচনদার লেখকরা। আমার কবিতা বিদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বুয়েনস আয়ারস থেকে স্প্যানিশ ভাষায় El Corno পত্রিকায় । প্রথম বই 'শয়তানের মুখ'-এর প্রচ্ছদ ওঁরাই আঁকিয়ে দিয়েছিলেন মেক্সিকান চিত্রকর কার্লোস কোহেন-কে দিয়ে ( স্প্যানিশ ভাষার ইউকিপেডিয়ায় হাংরি আন্দোলনের পৃষ্ঠা আছে )। সেই সূত্রে জার্মান সম্পাদক কার্ল ওয়েইসনার ওঁর পত্রিকায় ( Kalactoveedsedsteen ) প্রকাশ করেন। ইউনাইটেড স্টেটস-এর অধ্যাপক হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড ( Washington State University ) সুবিমল বসাক, দেবী রায় আর আমার সঙ্গে দেখা করার পর আমাদের লেখা আমেরিকায় প্রবেশপথ পেয়ে যায় । ইউনাইটেড স্টেটসে বেশি করে নজরে পড়ার কারণ সম্ভবত ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালার কারণে; আমাদের পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র, ফোটোগ্রাফ, ম্যাগাজিন ইত্যাদি সংরক্ষিত হয়েছে এবং তা গুগলে স্হান পেয়েছে। ফরাসি ভাষায় গুগল সার্চ করলে প্রদীপ চৌধুরীকে বহু পৃষ্ঠায় পাবে। তখন যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁদের অনেকে পরে বেশ প্রতিষ্ঠিত, এবং আমার লেখা অন্তর্ভূক্ত করেছেন। বাণিজ্যিক বাঙালি কবিদের প্রচার আমেরিকায় ভালোই। ডেবোরা কার অ্যালেন গিন্সবার্গকে নিয়ে যে বইটা লিখেছেন তা পড়লে টের পাবে। আমার মামলার জন্যে নিউ ইয়র্কের সেন্ট মার্কস চার্চে আমার ও অন্যদের কবিতা পাঠ করে টাকা তোলার আয়োজন করেছিলেন ক্যারল বার্জ; হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড-ও বই প্রকাশ করে হাই কোর্টের খরচ তুলে দিয়েছিলেন। হাইকোর্টে আমার কেস লড়েছিলেন চারজন অ্যাডভোকেট, তখনকার বিখ্যাত ক্রিমিনাল ল-ইয়ার মৃগেন সেনের নেতৃত্বে। মৃগেন সেনের ফিজ আমার তখনকার মাইনের প্রায় একশোগুণ ছিল।'ছোটোলোকের ছোটোবেলা'-র ইংরেজি অনুবাদের প্রস্তাব পেয়েছি। দেখা যাক।
অনুপম: মলয়দা, "বিকাউ বা বেচনদার লেখক" ব্যাপারটা একটু বলুন। ধরুন গার্সিয়া মার্কেস বা সলমান রুশদি... এঁরাও তো বিক্রির ব্যাপারে উদাসীন নন । রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমও কি বিমুখ ছিলেন ? কে চায় না তার বই বিক্রি হোক, লোকে পড়ুক ? পাঠকের কাছে একটু স্পষ্ট করুন ব্যাপারটা।
মলয় রায়চৌধুরী: আমার মনে হয় আয়ারাম-গয়ারাপ অভিব্যক্তি দিয়ে বিকাউ প্রক্রিয়াটা বোঝানো যায়। রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্কিমের সময়ে বাজার ছিল না । ওঁরা বিনামূল্যে বই বিলি করতেন, ডাকযোগে পাঠকদের পাঠাতেন; তার জন্যে ওঁদের সেক্রেটারিরা ছিলেন। মার্কেস, বর্হেস, রুশদি প্রমুখ লেখকদের আয়ারাম-গয়ারাম বলা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বিশেষ করে (বাংলাদেশে নয়), এবং সাধারণভাবে হিন্দি, তামিল, তেলুগু ইত্যাদি ভাষা-সাহিত্যের জায়গাতে বিগ বিজনেস ও রাজনৈতিক-সরকারি খেলার ফলে আয়ারাম-গয়ারাম বাজারের উৎপত্তি হয়েছে। প্রকাশনা য়ভবসাটা আমাদের এখানে (কলকাতায়) তিরিশের দশকের পরে সেভাবে কাজ করে না যেভাবে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ভাষায়। এখানে প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করার কারিকুরির কারণে আউটস্ট্যান্ডিং লেখালিখিটা আয়ারাম-গয়ারামদের ঢাক-ঢোল দিয়ে চাপা পড়ে যায়। আয়ারাম-গয়ারাম লেখকদের রচনা তো ইংরেজিতে অনুবাদ হয়, কিন্তু কই, এখনও কেউই এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকায় সাড়া ফেলতে পারেননি, যেমনটা ফেলেছেন অরুন্ধতী রায় বা অরুণ কোলাতকার। আয়ারাম-গয়ারাম স্টক এক্সচেঞ্জ না থাকলে মহাশ্বেতা দেবীও বিশ্বব্যাপী ওপনিং পেতেন।
অনুপম: এই প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করার খেলা কি আপনার সঙ্গেও হয়েছে মনে করেন ? আপনার প্রথম বই 'শয়তানের মুখ' তো বেরোল 'কৃত্তিবাস প্রকাশনী' থেকে ১৯৬৩ সালে। আপনার প্রথম বইয়ের প্রকাশক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। উনি আপনার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর বন্ধু। আর সুনীলের সাক্ষই তো আপনাকে হাংরি মামলায় কারাবাস থেকে বাঁচিয়েছিল, তাই না ?
মলয় রায়চৌধুরী: আমার প্রথম বই 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার', তার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিৎ দত্ত ( কবি অজিত দত্তের ছেলে ) লোয়ার কোর্টে আমার হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। লোয়ার কোর্টে (ব্যাংকশাল কোর্ট) আমার ম্যাক্সিমাম নির্ধারিত জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের জেলের আদেশ হয়েছিল। সাক্ষ্যগুলো আমাকে বাঁচাতে পারেনি। আমার দণ্ডাদেশ খারিজ হয় হাইকোর্টে আপিল করার ফলে, তখনকার নামকরা ক্রিমিনাল ল-ইয়ারের যুক্তিতর্কের কারণে। তবে আমি ওঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে তরুণ সান্যালের প্রতি, যিনি কম্যুনিস্ট পার্টির নিষেধাজ্ঞা সত্বেও আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। সুনীল তখন এই সুনীল ছিলেন না; 'অরণ্যের দিনরাত্রি'-র সুনীল ছিলেন। ওটা চাইবাসাভিত্তিক কাহিনী, দাদা তখন চাইবাসায় পোস্টেড ছিলেন। সুনীল সাক্ষ্য দিয়েছিলেন দাদার অনুরোধে, বন্ধুত্বের খাতিরে, যা উনি লিখেওছেন। তবে ওঁর 'অর্ধেক জীবন' পড়লে জানা যায় যে প্রায় শতাধিকবার দাদার বিভিন্ন চাকরিস্হলে আতিথ্য নেওয়া সত্বেও, দাদার সঙ্গে পরিচয়টা উনি লুকোতে পছন্দ করেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তবু উনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন; কোনো একটি পত্রিকায় একবার আমার মৃত্যু-সংবাদ প্রকাশিত হলে উনি সঙ্গে-সঙ্গে আমার খোঁজ নিতে এসেছিলেন। না, আমাকে কোনো রুদ্ধ দরজার সামনে ধাক্কা খেতে হয়নি; আমি চেষ্টা করিনি। ওমুখো হইনি কখনো। সম্ভবত লেখালিখি মাঝে ছেড়ে দিয়েছিলুম বলেই।
অনুপম: কেন এই ছেড়ে দেওয়া, আর কেন তারপরও ফিরে আসা ?
মলয় রায়চৌধুরী: মনীশ ঘটককে জিগ্যেস করেছিলুম, "কেন লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছেন?" উনি বলেছিলেন, "মাথায় আসে, কিন্তু হাত অবধি আসে না।" একই প্রশ্ন সমর সেনকে জিগ্যেস করেছিলুম। উনি শুধু মোনালিসা হাসি দিয়ে যা বলার বলেছিলেন। আমার ক্ষেত্রে লেখার ব্যাপারটা আমায় দুম করে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, যাকে বলে writer's block । ফিরে এসেছিল আমার মা মারা যাওয়ার পরদিন থেকে, লক্ষ্ণৌতে, যেখানে আমার চেয়ে উনিশ বছরের ছোটো এক অবাঙালি তরুণী আমার প্রতি আকৃষ্ট হন। ওই সময় ঢাকায় প্রকাশের আহ্বান পেয়ে যাই একের পর এক লিটল ম্যাগাজিন থেকে। 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর'-এর অধিকাংশ কবিতা ঢাকায় প্রথম প্রকাশিত। গদ্য লেখার জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন, ইনস্টিগেট করতে থাকেন, 'কৌরব' পত্রিকার সম্পাদক কমল চক্রবর্তী।
অনুপম: মলয়দা, বলা কি যায় যে লেখালিখির অক্সিজেন আপনি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেই বেশি পেয়েছেন? আমেরিকা...বাংলাদেশ...জামশেদপুর...আপনাকে কি বাঙালি কবি সেই অর্থে বলা যায় ?
মলয় রায়চৌধুরী: প্ল্যাটফর্মগুলো বাইরের তো বটেই। তুমি আমার বাল্যের ফিরে-দেখা গদ্যগুলো পড়েছ কিনা জানি না...সেখানে উত্তরপাড়া (আদিনিবাস), পানিহাটি (মামারবাড়ি), কোন্নোগর (বড়ো-ঠাকুমার বাড়ি), আহিরিটোলা (পিসিমার বাড়ি, বিখ্যাত সেন্টুদার আস্তানা) বড়িশা-বেহালা (সাবর্ণ জেঠু-কাকুর বাড়ি ) ইত্যাদি আত্মীয়স্বজনদের গভীর প্রভাব নিয়ে কথাবার্তা আছে। এই রচনাগুলো পাঠকদের কাছে পৌঁছোয় না, কেননা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশকরা সীমিত সংখ্যায় ছাপেন। ওইসব রচনাগুলো আমার কবিতার জন্য পড়ে রাখলে ভালো হয়। আমি তো পূর্ববঙ্গ থেকে এসে বলছি না যে আমি পশ্চিমবঙ্গের। পূর্ববঙ্গ থেকে ধর্ম বাঁচাবার ব্যে পালিয়ে এসে যদি পশ্চিমবঙ্গের কবি হওয়া যায়, তাহলে উত্তরপাড়ার লোক হয়ে হওয়া যাবে নাই বা কেন !
অনুপম: আচ্ছা আপনার আত্মজীবনীমূলক বইয়ের নাম 'ছোটোলোকের ছোটোবেলা'। শুভঙ্কর দাশ যে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেখানে আপনি ঘোষিত হয়েছেন cultural bastard বা সাংস্কৃতিক জারজ। অথচ আপনি সম্মানিত পিতার সন্তান। সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বংশধর। আপনার মাতামহ কিশোরীমোহনের নামে পানিহাটিতে রাস্তা আছে। পাটনার কনভেন্টে পড়াশোনা করেছেন।পরে উচ্চপদে চাকরি করেছেন। সবদিক থেকেই আপনি সামাজিক, সুরক্ষিত এবং মর্যাদাবান। তাহলে সাহিত্যের আঙিনায় নিজেকে 'ছোটোলোক', 'জারজ', 'বহিরাগত', বিহারি বাঙালি' --- এসব বলার কারণ কী ?
মলয় রায়চৌধুরী: সাহিত্যের আঙিনায় নয়; জীবনের আঙিনায়। লেখালিখিটা জীবনের একটা মাত্রা মাত্র। জীবন আরও ব্যাপক, রহস্যময়, ব্যাখ্যাহীন, এলোমেলো, খাপছাড়া, বহুত্বময়, সর্বগ্রাসী। জীবনের সবকিছু লেখা হয়ে ওঠে না, ওঠেনি, উঠবে কিনা জানি না।
অনুপম: তাহলে আরেকটা প্রশ্ন। যিনি স্বভাবকবি নন, হাংরি পর্বে তিনিই কবিতার অ্যাডিক্ট কী করে হলেন, কবিতাকে মাদক জ্ঞান কেন করে বসলেন ? আর এখন নেটিজেন সেই কবি মগজের রসায়নকে কমপিউটারের কি-বোর্ডে নামাতে পারছেন না কেন ?
মলয় রায়চৌধুরী: তুমি কি অ্যাডিকশান সম্পর্কে জানো ? সাইকোট্রপিক ড্রাগস নিয়েছ কি ? স্বভাবকবিত্ব ড্রাগ অ্যাডিকশানের বিপরীত জগতের প্রতিক্রয়া, যা মূলত মানসিক। অ্যাডিকশানটা শারীরিক, মানসিক, এমনকি সামাজিক। আমি জেনে-বুঝে অ্যাডিকশান শব্দটা প্রয়োগ করলুম, কেননা 'নেশা' শব্দ দিয়ে সাইকোট্রপিক ড্রাগ অ্যাডিকশান য়্যাখ্যা করা অসম্ভব। আর 'মাদক' শব্দটা দিয়ে ড্রাগ য়্যাখ্যা করা যায় না। ষাটের দশকে সাইকোট্রপিক ড্রাগ বেআইনি ছিল না। তা নিষিদ্ধ হয় আশির দশকে। তবে এখন আমার মদ খাওয়ার রুটিন আছে প্রতি সন্ধ্যায়। অনেকের সঙ্গে বসে আমি মদ খেতে পারি না, আমার একাকীত্ব নষ্ট হয়।
অনুপম: মলয়দা, বলুন তো 'বিস্ময়' শব্দটা আপনার কাছে কী ? চিরকাল, এবং এখন ।
মলয় রায়চৌধুরী: বিস্ময় শব্দের প্রতিশব্দ surprise নয়। surprise বলতে আশ্চর্য হওয়া বুঝবো। অনেক-কিছু আশ্চর্য লাগে বা সারপ্রাইজড হই, কিন্তু তা বিস্ময়ের নয়। আশ্চর্য হওয়াটা তাৎক্ষণিক। বিস্ময় শব্দটার ইংরেজি নেই বোধহয়। অন্তত এখনই মনে পড়ছে না। Dictionary of Philosophy দেখে বলতে পারব। বিস্ময় ব্যাপারটা লেখালিখির জ্ঞানজটিল, জীবনব্যাপী, একাকীত্বের প্রশ্নউন্মীলক। চুপচাপ বসে এই জিনিসটার মধ্যে ডুবে থাকা যায়। প্রক্রিয়াটা অত্যান্ত জরুরি। জীবনকে সতত প্রশ্নমুখি করে রাখার জন্য জরুরি।
অনুপম: 'মলয় রায়চৌধুরী' কি খুব একা একটা লোকের নাম, মলয়দা । এই মুহূর্তে ?
মলয় রায়চৌধুরী: হ্যাঁ।
অনুপম: এই একাকীত্ব কি আপনার অর্জন, না একাকিত্বই বেছে নিয়েছে আপনাকে ?
মলয় রায়চৌধুরী: হয়তো বয়সের জন্য। ঠিক উত্তর দেওয়া কঠিন। যদি গ্রামাঞ্চলে থাকতুম তাহলে এটা নাও হতে পারত। এই একাকীত্ব কোনো কবিত্বের ব্যাপার নয়; এটা আমি রেলিশ করি। বদেলেয়ারের এনুই-এর সঙ্গে বা সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী একাকীত্বের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলা ভুল হবে।
অনুপম: এখন কি পিছন ফিরে তাকালে ষাটের দশকের হাংরি মলয়কে চিনতে পারেন ? যে মলয় সমাজের গণ্যমান্য লোকদের চিঠি লিখে মুখোশ খুলে ফেলতে বলতেন...জুরোর বাক্স পাঠাতেন...পুলিশের ভয়ে গঙ্গাবক্ষে নৌকোয় লুকিয়ে থেকেছেন...এখন ওই আচরণগুলো সমর্থন করেন ?
মলয় রায়চৌধুরী: পুলিশের ভয়ে গঙ্গায় কেউই লুকোয়নি। হিপিদের সঙ্গে গঙ্গার তীরে কেউ-কেউ অবারিত যৌনজীবন কাটিয়েছেন। 'অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা' পড়েছ কী ? বেনারস ছিল সাইকোট্রপিক ড্রাগস এবং হিপিদের জমায়েত । পুলিশ এড়াতে কেবল সুবো আচার্য বিষ্ণুপুরে এবং প্রদীপ চৌধুরী ত্রিপুরায় চলে গিয়েছিলেন, যা ওঁদের বাপের বাড়ি। পুলিশ তবু ত্রিপুরায় গিয়ে প্রদীপকে গ্রেপতার করেছিল। পেছন ফিরলে কেবল সেই ষাটের মলয় নয়, বহু মলয়কে মেলানো দুষ্কর হয়ে ওঠে, বিশেষ করে ছাত্রজীবন, যা তুমি তিন কিস্তিতে প্রকাশিত 'অভিমুখের উপজীব্য' লেখায় পাবে। পরে লক্ষ্ণৌতে আমার অধঃস্তন তরুণ-তরুণী আধিকারিকদের সঙ্গে ( বোধ হয় প্রথম জেন এক্স ) লাগামহীন বাঁধনছেঁড়া হুল্লোড়ের জীবন; তারপর আটের দশকে সারা ভারত ত্যুর করতে থাকাকালে নতুন ও অপরিচিত জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হওয়ার জীবন। এই সত্তর বছর বয়সে সবই অচেনা ঠেকে, মেলানো কঠিন মনে হয়। যদি রোজনামচা লেখার অভ্যাস থাকত তাহলে তবু মেলাতে পারতুম, কিন্তু জ্বালিয়ে নষ্ট করে ফেলি।
অনুপম: আর যৌনতা ? যৌনতা আপনার কাছে কী? নাকি কামপ্রবৃত্তি বলব?
মলয় রায়চৌধুরী: যৌনতা শব্দটার ইংরেজি তো সেক্সুয়ালিটি। তুমি জানতে চাইছ সেক্স আমার জীবনে এবং দৃষ্টিতে কী ? কারেক্ট ? সেক্স আমার জীবনে সবাইয়ের মতন বয়ঃসন্ধিতে ঔৎসুক্য দিয়ে শুরু, কিন্তু নিম্ন বর্গের বিহারি সমাজে থাকার কারণে, ইমলিতলা পাড়ায়, তা খুল্লমখুল্লা বিপর্যস্ত করেছিল। দোলখেলার এক দিনের নিষেধহীনতা, ওই সময়ে বয়ঃসন্ধিকালে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ইমলিতলার মেয়েরা, বাঙালিরা যে-সমস্ত শব্দকে অস্লীল মনে করে, সেই শব্দাবলি সহযোগে, যাচ্ছেতাই করত। তখন থেকেই সেক্স আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এই হিসাবে যে তা অভিমুখ নির্ণয় করে। পশুপাখিদের হিট-পিরিয়ড হয়; মানুষের হলে বাকি সময়টা সে তার যৌবন নিয়ে কী করত? যৌনতা আমার কাছে, আমাদের সংরক্ষণশীল পরিবারে, সীমালঙ্ঘনের, বন্ধন কেটে বেরোবার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। আমি ক্যাসানোভা ছিলুম না, কিন্তু প্রেম-সম্পর্কের বাইরে, সমান্তরালভাবে, যৌন-সম্পর্ক গড়ে ফেলতে আমার ভালোই লেগেছে। তবে একটা ব্যাপার দেখেছি যে, বয়ঃসন্ধিতে সেক্স ছিল মগজ আর শরীরের মিশেল দেওয়া একমাত্রিক তপ্ততা। যত বয়স বেড়েছে, ততই তা ক্রমশ মগজের ব্যাপার হয়ে উঠেছে। যৌবনে মুখহীন নারী-শরীর ভাবতে পারতুম। যত বয়স বেড়েছে, নারীশরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পৃথক-পৃথক ডাক দিয়েছে । একটা কথা, বিহারে হোমোসেক্সুয়ালিটি ছাত্রদের মধ্যে চালু ছিল। হোমোসেক্সুয়ালিটি, কেন কে জানে আমার স্ট্রেঞ্জ এবং বিসদৃশ মনে হয়। হল্যাণ্ডে, অ্যামস্টারডামে, গে আর লেসবিয়েনদের বিরাট জমায়েত হয় প্রতি সন্ধ্যায়। জমায়েতের যুবতিগুলোকে দেখে আকৃষ্ট হতুম, তারা জোড়ায়-জোড়ায় চুমু খাওয়াখাওয়ি করতে থাকলেও। বেশ্যা পাড়ায় কনডাক্টেড ট্যুর করায়; সব যৌনকর্মী ছ'ফুটের বেশি লম্বা।
অনুপম: বৌদি এসব জানেন ? হাংরি মলয় কি কখনও নিজের চোখে নিজেকে দেখতে চেয়েছেন ?
মলয় রায়চৌধুরী: 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' এবং আমার কবিতার বিশেষ ধারা, লেখালিখি নিয়ে কোর্টকাছারি, জেল-জরিমানা, হাংরি আন্দোলন, এসব জানে; যৌবনের ঘটনা কিছু-কিছু জানে। তবে সাহিত্যকে অনর্থক সময় নষ্ট মনে করে। সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ নেই, যদিও আমার সঙ্গে বিদেশি বা এখানকার লেখক-কবিরা দেখা করতে এলে ওর ভালো লাগে; পত্র-পত্রিকায় এবং ইনটারনেটে ফোটো বেরোলে আনন্দিত হয়। আমার মেয়ে অক্সফোর্ড ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ছাত্রী হওয়ার পর যৎসামান্য আগ্রহ হয়েছিল। দাদা ছাড়া আমাদের পরিবারের আর কেউ সাহিত্যে আগ্রহান্বিত নয়। ব্যাংকশাল কোর্টে মামলা চলার সময়ে আমার বাবা, জ্যাঠা, কাকা, পিসেমশাই কেউ না কেউ ডেট পড়লে আসতেন। অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের পরিবার থেকে কেউ আসতেন না। তা সাহিত্যের জন্য নয়। আমাদের বাড়িতে প্রতি প্রজন্মে এক-দুজন পুলিশের মামলায় পড়েছে, তাই এই ঘটনাটা আমার প্রজন্মের প্রাপ্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' পড়ে ওঁরা বলেছিলেন, "এ ধরনের কঠিন-কঠিন পদ্যর কোনো মানে হয় না।" Stark Electric Jesus কবিতাটি ইনটারনেটে আমার ছেলে পোস্ট করেছিল। আমি তখনও কমপিউটারে টাইপ করতে জানতুম না।
অনুপম: মলয়দা, তাহলে কি খুব দোষ দেওয়া যায়, যখন সাধারণ বাঙালি ভেবে বসেন যে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি একজন অসুস্হমনা যুবকের যৌনবিকৃতির ফসল ? তা-ও সেই ষাটের দশকে ? যৌনতার নতুন রূপকথা তৈরি করতে চেয়েছিলেন কি ?
মলয় রায়চৌধুরী; আমার জ্যাঠা, বাবা, কাকা, মা এমনকি ঠাকুমারও মনে হয়নি যে কবিতাটি নীতিভ্রষ্ট মগজের ফলাফল; ওঁরা কেবল সহজ করে লেখার উপদেশ দিতেন। 'জখম' ওই সহজ করে লেখার প্রয়াস। কোনো সাধারণ পাঠক এমন অভিযোগ তো কখনও করেননি, এমনকি অধ্যাপক তরুণ মুখোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী এবং শীতল চৌধুরীও করেননি। আনন্দ বাগচী 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি ওঁর সম্পাদিত 'প্রথম সাড়া জাগানো কবিতা' সংকলনে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন। অভিযোগটা করেছেন অ-সাধারণ পাঠকরা, যাঁরা নিজেরাও কবিযশোপ্রার্থী, এবং যাঁরা কলকাত্তিয়া সাহিত্যের মালিকানা দাবি করতেন। এখন একুশ শতকে পৌঁছে ওই অভিযোগকারীরা, যাঁরা বেঁচে আছেন, নিজেরাই টের পাচ্ছেন যে তাঁরা সময় থেকে কত পিছিয়ে ছিলেন। আমি কোনো পাঠককেই দোষ দেব না, কেননা আমি তো জোর-জবরদস্তি পড়তে বাধ্য করছি না। যাঁর যেমন ইচ্ছা তিনি তেমন ভাববেন। কবিতা লিখতে বসে সেক্সকে এইভাবে ব্যবহার করব, ওইভাবে প্রয়োগ করব, এমনটা কখনও ভাবিনি; সেসব ভেবেছি গল্প-উপন্যাস লেখার সময়। কবিতায় সেক্স এসেছে ইমলিতলা পাড়ায় থাকার কারণে। ইমলিতলায় সেক্স জীবনযাপনের একটা স্বাভাবিক ও নিত্যনৈমিত্তিক উপাদান ছিল। 'ছোটোলোকের ছোটোবেলা' বইয়ে পড়ে থাকবে যে আমাদের বৈঠকখানা ঘরে যে কুয়ো ছিল সেখানে পাড়ার বউরা বিয়ের অতি-অশ্লীল গান গাইবার জন্য দল বেঁধে জড়ো হতেন। সেক্স-এর নতুন রূপকথা তৈরি হয়ে থাকলে তা ওই দলিত মহিলাদের সাংস্কৃতিক অবদান। ভোজপুরি-মঘাই-পাটনাইয়া বুলিতে বহু সিডি আছে এইসব গানের।
অনুপম: তাহলে কি আপনার কবিতায় সেক্স এসেছে, প্রকৃত কাম-তাড়না থেকেই এসেছে ? হাংরি মলয় তাহলে ঠিক কতটা সেক্সুয়ালি হাংরি, আর কতটা সামাজিকভাবে ক্রুদ্ধ ? দুটিকে আলাদা করা কি খুব সহজ ?
মলয় রায়চৌধুরী: এই প্রশ্নের উত্তর বুড়ো বয়সে দেওয়া কঠিন, কেননা এখন যৌনতার বোধ মস্তিষ্ক-নির্ভর হয়ে রয়েছে। হাংরি আন্দোলনের সময় ছিলুম টাটকা যুবক। আত্মমৈথুন কাকে বলে সেটাই শরীরের পক্ষে স্মরণ করা কঠিন। তোমার প্রশ্নের উত্তরটা আমি পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিতে চাইব। এখন তো আর সেক্স সম্পর্কে সেরকম ভাবনা নেই; সামাজিকভাবে ক্রোধ অনেক বেশি এখন; এখন সমাজকর্তাদের ( রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক ) বিশ্বাসঘাতক, অপদার্থ, চোর, নেপোটিস্ট, পশ্চিমবঙ্গবিরোধী মনে করি।
অনুপম: আরেকটা হাংরি আন্দোলন হচ্ছে না কেন ? কোনোকিছুই তো সেই অর্থে আজও বদলায়নি। নাকি আপনাদের তুলনায় আমাদের প্রজন্মটাই অনেক বদলে গেছে মনে হয় ?
মলয় রায়চৌধুরী: হাংরির মতন আন্দোলন কেবল নয়, আর কোনো আন্দোলনই সম্ভব নয়। আমি শুধু বঙ্গসমাজের কথা বলছি না, সারা ভারতবর্ষের কথা বলছি। আমার 'পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন' প্রবন্ধটা পড়েছ কি না জানি না, কিংবা 'উত্তরদার্শনিকতা' প্রবন্ধটা পড়েছ কি ? আমরা উত্তরদার্শনিক কালখণ্ডতে পৌঁছেচি, মূলত প্রযুক্তির দ্রুতগামী রদবদলের জন্য। বিজ্ঞান আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত হস্তক্ষেপ করে চলেছে। এক দশকে যে রদবদল ঘটছে তা আগে এক শতক সময় নিয়ে ঘটত। ফলে রিডিফাইন হয়ে চলেছে ভাবনা-চিন্তার পরিসর। 'আই পিল' খেয়ে কি কোনো তরুণী প্রেমের কবিতা লিখতে পারতেন । 'আই পিল' বস্তুত প্রেমিক-মুক্ত করে দিয়েছে একজন তরুণীকে। রেভ পার্টিতে কেবল এস.এম.এস. পেয়ে হাজির হওয়া যায়, যেখানে অচেনার সঙ্গে সংসর্গই প্রধান লক্ষ্য...লেখকরা embeded হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে লেখার রসদ যোগাড় করে। দুমদাম বোমা ফেলে collateral damage হাজার-হাজার অসামরিক লোকদের নিকেশ করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে-স্কুলে রুটলেস কমরেড টিচার পাঠিয়ে উন্নতির নামে গ্রামসমাজকে নষ্ট করা যায়। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা কমরেড নেতারা মন্ত্রী হয়ে আদিবাসী-উপজাতিদের দিব্যি ভুলে থাকতে পারেন দশকের পর দশক অথচ নিজেদের গুষ্টিদের ধোপদুরস্ত জীবনে তুলে ফেলেন। কত আর বলব? আমাদের প্রজন্মের তুলনায় সমস্ত-কিছু বদলে গেছে। আধুনিকতার তত্বগুলো অনুমান করতে পারেনি যে আসল-চালক তোব্যক্তি-মানুষ; মার্কসবাদ বা গাঁধিবাদ বা অন্য কোনো বাদ তো রাষ্ট্রকে চালায় না, চালায় মানুষ। কৌমসমাজ তো ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত; সেই ব্যক্তিটাই এখন ভিন্ন, সে চলে গেছে দার্শনিকতার ওই পারে, সেখানে আর কোনো আন্দোলন সম্ভব নয়।
অনুপম: তাহলে আপনি নিজেকে অধিক সার্থক কোন পরিসরে মনে করেন --- হাংরি না অধুনান্তিক ?
মলয় রায়চৌধুরী: 'সার্থক' শব্দটা উনিশ শতকের ভাবুকদের অবদান। সেই সময়ের চিন্তাবিদরা ব্যক্তি-মানুষকে পৃথিবীর কেন্দ্রে বসিয়ে নানারকম স্বপ্ন দেখেছিলেন। এখন জানা গেল ব্যক্তি-মানুষকে নিয়ে এমন সরলীকরণ করা যায় না; সে অনেক জটিল, কেননা তার আত্মপরিচয় বহুমাত্রিক ও এলোমেলো এবং সে সতত, সারাজীবন নানা ফ্লাক্সের মধ্যে কাটায়। এখন আর উনিশ শতকের মতো ভাবুকও সম্ভব নয় । আমাদের চারিদিকে তাকালে নানা ক্ষেত্রের বহু ব্যক্তিকে দেখতে পাব, যাদের নিয়ে মিডিয়ার জায়গাতে হইচই হয়, কিন্তু তা কেবল বহুমাত্রিকতার একটা মাত্রা মাত্র। স্বাভাবিক যে আমিও নিজেকে কোনো পরিসরে সার্থক মনে করি না।
অনুপম: অনুবাদক হিসেবে কোনো টেক্সটের প্রতি কখন আগ্রহ জন্মায় আপনার ? অনুবাদক হিসেবেই অকাদেমি পুরস্কার পেয়েও প্রত্যাখ্যান করলেন কেন ? হাংরিদের কি ওটা নিতে নেই ?
মলয় রায়চৌধুরী: উইলিয়াম ব্লেকের Marriage of Heaven and Hell কবিতাটি এমন ফর্মহীন লেখা যে অবাক করার মতো; তখনকার কোনো সাহিত্যিক ও ধার্মিক প্রতিনিষেধ স্বীকার করেননি উনি। তাছাড়া বিষয়বস্তুকে যেমনভাবে ইচ্ছে ব্যাখ্যা করা যায়। স্নাতক স্তরে ব্লেক পাঠ্য ছিলেন, কিন্তু ইংরেজির বাঙালি অধ্যাপক এই কবিতাটির উল্লেখ করতেন না, অথচ ব্লেক সম্পর্কে যাবতীয় কাহিনী আমাদের শোনাতেন। আমি ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলুম বলে ( বিদেশিনী নানরা পড়াতেন, সংলগ্ন চার্চে প্রতি বৃহস্পতিবার বাইবেল ক্লাস হত ) কবিতাটি চার্চ-ক্লাসের রহস্যে নিয়ে যেত। আমি কোনো সাহিত্যিক পুরস্কার নিই না। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরাও পুরস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন, এমনকি বাড়িতে এসে অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছেন, সে সমস্ত পুরস্কার ও সম্মানও তো নিইনি, তাহলে সরকারি পুরস্কার নিতে যাব কেন ?
অনুপম: স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আসা ছিন্নমূল মানুষগুলোর উপর আপনার এতটা রাগ কেন, মলয়দা ? এই সাক্ষাৎকারেও সেটা ধরা পড়েছে। ওঁদের সাবঅলটার্ন ভাবতে পারেন না ?
মলয় রায়চৌধুরী: আমার অভিযোগ সেই লোকগুলোর বিরুদ্ধে যাঁরা পূর্ববঙ্গে থাকতে পাকিস্তান চেয়েছিলেন, অথচ যেই দেশভাগ হল, তাঁরাই সবচেয়ে আগে পালিয়ে এলেন (অশোক মিত্র স্বীকার করেছেন )। তাঁদের অনেকেই সত্তর দশক থেকে এখানে মন্ত্রী-সান্ত্রি হয়ে বসলেন, এবং পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক উন্নতির বদলে নিজেদের কাজ গোছাবার ধান্দাবাজি শুরু করলেন। গত তিরিশ বছরে তাঁরাই পশ্চিমবঙ্গকে ডুবুয়েছেন। তুমি বলছ এঁদের সাবঅলটার্ন ভাবতে ! আদিবাসী-উপজাতিরা আজ ক্রুদ্ধ কেন ? ওঁদের ওই আত্মসেবাজনিত অবহেলার জন্যে। এখানে পালিয়ে এলেন কেন ? ধর্ম বাঁচাবার জন্যে। এখানে এসে তাঁরা কেউ নিরীশ্বরবাদী, কেউ ধর্মহীন, কারও কাছে ধর্ম মানে আফিম, কেউ আবার সেকুলার। এই তর্কগুলোর উত্তর একটাই। তাহলে ইসলাম ধর্ম নিয়ে চোদ্দপুরুষের ভিটেমাটিতে থেকে গেলেন না কেন ? ওঁদের কাছে তার মানে মু। ছিল ধর্ম, ভিটেমাটি নয়। আমি কোনো-কিছু লুকোই না, খোলাখুলি বলি; অনেকে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় তা সীমিত রাখেন। আর আমি খোলাখুলি বলি বলে পশ্চিমবঙ্গীয় কবি-লেখকরা আমার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলতে ইতস্তত করেন না।
অনুপম: এখন এই অধুনান্তিক পর্বে আপনি বলছেন হাংরি আন্দোলন ছিল একটি প্রতিসন্দর্ভ। হাংরি তো ছিল আচরণ ও জীবনচর্চাভিত্তিক একটি আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন। ষাটের দশক কি কোনোভাবে বুঝতে পেরেছেল যে, হাংরি ছিল প্রতিসন্দর্ভ ?
মলয় রায়চৌধুরী: সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের মালিকদের সন্দর্ভের করা হয়েছিল মানেই তো প্রতিসন্দর্ভ। তোমার হয়তো প্রতিসন্দর্ভ শব্দটা বিদ্যায়তনিক লাগছে। প্রতিসন্দর্ভ মানেই তো আর অধুনান্তিক নয়। ফরাসি বিপ্লব তো ছিল প্রতিসন্দর্ভ। ডাডা আন্দলন ছিল প্রতিসন্দর্ভ, ইয়াং বেঙ্গল ছিল প্রতিসন্দর্ভ। ওই বিপ্লবী-বিরোধী-সীমালঙ্ঘনকারীরা জানতেন কীসের এবং কাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হচ্ছে, আচরণ ও আস্ফালন করা হচ্ছে। ঠিক তেমনি হাংরি আন্দোলনকারীরাও জানতেন। শাস্ত্রবিরোধীরা জানতেন, নিম সাহিত্যিকরা জানতেন।
অনুপম: 'কবিতা পাক্ষিক' পত্রিকা সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত আপনার ধারণা কী ? আপনার কি মনে হয় অধুনান্তিক চিন্তা-চেতনাকে বাংলা কবিতায় ব্যবহার করা গেছে ?
মলয় রায়চৌধুরী: 'কবিতা পাক্ষিক' ফাস্ট বোলারের হাতের বলের মতন। ১৫০ kmph হয়ে হাত থেকে বেরিয়েছিল; পিচে পড়ে তা অন্য চেহারা নিল, পিচটার জন্য। পাক্ষিক কবিতা পত্রিকার জন্যে প্রতিনিয়ত রসদ জোগাড় করা এবং তাকে নির্দিষ্ট স্তরে টিকিয়ে রাখা কঠিন। কমার্শিয়াল পত্রিকা নিজেদের মালিকানা অনুযায়ী কবিতা ছাপে; জয় গোস্বামী চলে গেলে তাঁর ক্লোনদের কবিতা বেরোয়। লিটল ম্যাগাজিন, তাও বেশ কিছুকাল যাবৎ প্রকাশ হয়ে চলেছে, কবিযশোপ্রার্থীদের নিজস্ব প্রয়াসকে অস্বীকার করতে পারে না। সম্পাদক নিজে কবি হলে ব্যাপারটা আরও জটিল। বাংলা কবিতার আর কোনো সীমা নেই। এটাই তো অধুনান্তিকতার লক্ষণ।
অনুপম: একজন অ্যালেন গিনসবার্গের সঙ্গে একজন মলয় রায়চৌধুরী কতটা মেলাতে পারেন নিজেকে ?
মলয় রায়চৌধুরী: একেবারেই পারি না। অ্যালেন গিনসবার্গ বিট আন্দোলনের সময়েও প্রচুর টাকার মালিক ছিলেন, পৃথিবীতে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারতেন, যে বই ইচ্ছে কিনতে পারতেন। আমার তো প্রতিদিন উত্তরপাড়া থেকে কলকাতা যাওয়া, পাইস হোটেলে খাওয়া, নিজের জামা-কাপড় নিজে কাচা এইসব ব্যাপারেই যথেস্ট রেস্ত দরকার হত। পাটনা থেকে কলকাতা পৌঁছোতে হত জনতা এক্সপ্রেসের ভিড় ঠেলে। অ্যালেন তো দিব্যি ঝোলা খুলে ডলার বের করতেন। ওঁর বাবা এবং সৎ মা-ও ধনী ছিলেন। আমি যেখানে পাটনাইয়া উনি সেখানে নিউ ইয়র্কার। আমি কুড়ি জনের একান্নবর্তী পরিবার থেকে, আর উনি বাবা, মা আর ভাই। উনি প্রথম বিশ্বের, আমি তৃতীয় বিশ্বের। কলকাতার ষাটের লেখক-কবিদের সঙ্গেও কি মেলাতে পেরেছি নিজেকে ? পারিনি। The Other বা 'অপর' থেকে গেছি।
অনুপম: ষাটের দশকের ক্ষুধার্ত বন্ধুদের সঙ্গে এখন যোগাযোগ আছে ?
মলয় রায়চৌধুরী: না।
অনুপম: এখন কী ধরণের বইপত্র পড়ছেন ? ২০০০ পরবর্তী বাংলা কবিতা পড়েন ?
মলয় রায়চৌধুরী: এক্ষুনি হাতে কোনো বই নেই, তাই কিছুই পড়ছি না। কলকাতায় থাকতে ডিসেম্বর ২০০৯-এ শেষ পড়েছি William Darilymple-এর লেখা বাহাদুর শাহ জাফরের জীবনী। ২০০০ পরবর্তী কবিতার বই কেউ পাঠিয়েছেন বলে মনে পড়ছে না। লিটল ম্যাগাজিনও বিশেষ পাই না। বাংলা ওয়েবসাইটগুলো দেখি; তুমি আর আর্যনীল ( আমি জানতুম না ওর আসল নাম নীলাঞ্জন ) নতুন পোস্টিং হলেই লিংক পাঠাও। কেউ কেউ তাঁদের কবিতা ই-মেল করেন। বাংলাদেশি কবিরা ফেসবুকে ওঁদের লিংক পোস্ট করেন। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে পড়ার সুযোগ নেই। ২০০০ পরবর্তী কবিতা যে বাঁকবদল ঘটাতে চাইছে তা টের পাই, কিন্তু সম্পূর্ণ ছবিটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
অনুপম: প্রাক-আধুনিক পরিসর থেকে আজ অবধি দশজন কবির নাম যদি বলতে বলি ?
মলয় রায়চৌধুরী: বলতে পারব না। প্রাগাধুনিক বললেই স্কুলপাঠ্য কবিদের নামগুলি বেশি করে মনে পড়ে। আধুনিক বললেই তিরিশ দশক মাথায় চলে আসে। মাঝের পর্বটা কী, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ?
অনুপম: বলা কঠিন মলয়দা। আমার তো মনে হয় রবীন্দ্রনাথ একদিকে, আর বাংলা কবিতার বাকি সবকিছু আরেক দিকে, তাহলেও ওঁর দিকেই পাল্লা ভারি থাকবে। ওঁর শক্ত-দুর্বলতা, সফলতা-বিফলতা সব মিলিয়ে উনি একাই 'বাংলা কবিতা'। কারও সঙ্গে কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা হয় না। রবীন্দ্রনাথ আপনার চোখে কী ?
মলয় রায়চৌধুরী: রবীন্দ্রনাথ বাঙালি মধ্যবিত্তের অনস্বীকার্য সাংস্কৃতিক আইকন।
অনুপম: মলয় রায়চৌধুরী কি কবিতা আর লিখবেন না ?
মলয় রায়চৌধুরী: জানি না লিখব কি না । কবিতার লাইন মাথায় আসে, কেমন যেন লিরিকাল; ফলে কলম নিয়ে বসতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া আঙুলের সমস্যার জন্য কলম ধরতে হয় তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে, যা বেশ বিরক্তিকর ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন