শুক্রবার

উত্তরাধুনিক কবিতা কাকে বলে : সমীর রায়চৌধুরী

 ভাষাতাত্বিক প্রবাল দাশগুপ্ত তাই উত্তরাধুনিকতাকে বলেছেন ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’ বা ‘অধুনান্তিক’ ।

প্রবাল দাশগুপ্ত অধুনান্তিককে বলেছেন “সাজানো বাগানের পরের স্টপ” । আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন এই কথাগুলোতে, “কিছু কাল আগে ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’ বলে একটা প্রসঙ্গ ফেঁদেছিলাম। সেই সূত্রে ভেবে বলো তো, তুমি যখন আধুনিক বিজ্ঞানের দূরবীক্ষণ আর অণুবীক্ষণ দিয়ে দূরের মহতো মহীয়ান্ আর কাছের অণোর্ অণীয়ান্ জিনিসপত্রকে যথাক্রমে কাছে টেনে আনো এবং বাড়িয়ে মাঝারি আয়তনে নিয়ে আসো যাতে তোমার নজরে তাকে ধরতে পারো, তখন তুমি আদতে কী করছ? আমি বলে দিই? জিনিসটাকে তুমি তোমার বাগে আনছ, যাতে তোমার পছন্দমতো ম্যাগনিফিকেশনে দেখতে পাও। বাগ, ইয়ানী বগীচা, ওই বাগান আর কী। তোমার সাজানো বাগানে নিয়ে আসতে পারলে তবে তুমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলো, এইবার ধরতে পেরেছি। নীটশে যখন পাগল হয়ে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময় দিয়ে, যতদূর মনে পড়ছে ১৮৮৯ সালে, একজন প্রখ্যাত নীটশেবিদ পণ্ডিতকে চিঠি লিখে বলেন, “আমাকে তুমি ধরতে পেরেছ ভালো করেই জানি। খুব ভালো ধরেছ। এবার আমায় ছাড়তে পারবে কি? ছেড়ে দেখাও তো?” অধুনান্তিক শেখাটা ওই ছাড়তে শেখার দস্তুর। বাগে আনা কথাটার ব্যুৎপত্তি যাঁরা জানেন তাঁরা ভুল ধরিয়ে দেবেন, সেই অপেক্ষায় আছি, পাঠক তুমি তখন ধরতে পারবে আসল উত্তরটা কী হবার কথা, আমি আগাম বলে রাখছি, তার পর ভুলে যেও না উত্তরটা ধরতে পারার পর ছাড়তে পারাও চাই, নইলে তোমার সঙ্গে আকাশের সংযুক্তি ছিঁড়ে যাবে, পড়ে থাকবে খালি আধুনিকবাদের যুক্তি, দেখবে যে মাটির সঙ্গে একেবারেই আকাশের কোনো যোগ নেই তাকে আর মাটি বলে চিনতেই পারছ না, মনে হচ্ছে ছাই। চারিদিকে অসত্য কথন, মিথ্যাচার, ক্ষমতার রহস্যাবৃত কথাস্রোত সচেতন মানুষকে দগ্ধ করে। এক আস্তিক বিপন্নতা দেখা দেয়। লেখার মাধ্যমে সে তার কথন বিশ্বকে ব্যাপ্তি দেয়। পুনর্নির্মাণ করে তার সত্যদ্রষ্টা সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ। ধারণাময় এই ধরিত্রীর মাইক্রোস্তরে যতই প্রবেশ করা যায়, দেখা যায়, বহু সংকেত এমনই যে, বাস্তব জগতে বা প্রাত্যহিক কাজেকর্মে তা তেমন কাজে লাগে না। তবু তা প্রয়োজনীয় নয়, একথাও বলা যাবে না। অস্বীকার করা যাবে না, ব্যক্তি মনের সৃজন জগতের মুক্তির একটি পরিসর নির্মাণে তার ভূমিকার কথা।”

জাঁ ফ্রাঁসোয়া  লিওতার্ ‘দ্যা পােস্ট মর্ডান কন্ডিশন এ রিপাের্ট অন নলেজ’ নামক একটি বই লেখেন। লিওতার্, ইয়ুর্গেন  হাবারমাসের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলেন যে, আলােকময়তা বা এনলাইটেনমেন্ট  কিছু মহাবয়ান বা মহাসন্দর্ভ বা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। এই বয়ানগুলাে প্রচণ্ড শক্তিশালী। এই আন্দোলনে যুক্তিবাদী ধারণাগুলাে যেমন, প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী ইত্যাদি ধারণাগুলাে শক্তিমত্তা অর্জন করে। তিনি বলেন যে, এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভগুলাে দাবি করে যে সমগ্র বিশ্বে যা কিছু ঘটছে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সবকিছুর ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে, মূলত পারে না। লিওতারের বক্তব্য হল, বাস্তব আরাে জটিল আরাে বহুবিধ এবং সত্যও বহুবিধ। তিনি বলেন কোনাে বিশেষ সংঘাতের ক্ষেত্রে নানাবিধ যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে তা সামনে নিয়ে আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লিওতারের কথা হল, বিভিন্ন অবস্থান হতে সত্যাকে বুঝতে হবে, একটি বিষয়ে সত্য পরবর্তীতে সেটি সত্য নাও হতে পারে। লিওতারের দৃষ্টিতে পুঁজিবাদ বিবিধতা মুছে ফেলে, এটি সমরূপতা ও অখণ্ডতা তৈরির চেষ্টা চালায়। লিওতার বারবার মেটা-ন্যারেটিভ বা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহাবয়ানের ওপর গুরুত্বারােপ করেন। তিনি এটির প্রতি সন্দিহান। তিনি বলেছেন, এই মহাবয়ানসমূহ তাদের বিশ্বাসযােগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। উত্তর আধুনিকতাবাদীর দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এই বিশ্বাসহীনতা এবং বিবিধতার ওপর গুরুত্বারােপ। সত্য বহুবিধ এবং সত্য উপলব্ধিতে অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সত্য বহুবিধ হলে কবিতার সত্যও বহুবিধ হবে ।

জাঁ ফ্রাঁসোয়া বদরিয়ার বলেছেন যে,  আধুনিকতাবাদে বাস্তব এবং অবাস্তবের বিভাজন রেখা স্পষ্ট ছিল। এই দুটির মধ্যে পার্থক্য দাঁড় করানাের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অত্যন্ত ক্রিয়াশীল। যেমন, ভূত দেখা, এটি বিজ্ঞান সম্মত নয় বিধায় এটা বাস্তব নয়। বদরিয়ার বক্তব্য হচ্ছে যে, বর্তমানের সমাজ জীবনে সিনেমা, টিভি, বিজ্ঞাপনের ইমেজসমূহের সর্বব্যাপী প্রভাবের কারণে বাস্তব এবং অবাস্তব, সত্যি আর কল্পিত, আসল আর নকল, উপরিতল আর গভীরতা,  এসবের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে গেছে। এর ফলে আমরা একটি হাইপার রিয়েল সংস্কৃতি পাই। যেখানে দুইয়ের ভিন্নতা ক্ষয়ে গেছে। যেমন, আমরা প্লাস্টিক সার্জারির কথা বলতে পারি। প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে আমরা আমাদের জন্মসূত্রে পাওয়া রূপের পরিবর্তন করে সৌম্যকান্তি বা সুন্দরী হয়ে আরেকজন হয়ে যেতে পারি। যেমন নাকটা পছন্দ হচ্ছে না, তা প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে ঠিক করে নিতে পারি। এই প্রেক্ষিতে বদরিয়া বলেন যে বাস্তব এবং পরিবেশন এই দুয়ের মধ্যে যে সুস্পষ্ট বিভাজন ছিল সেটি উত্তর-আধুনিকতার ফলে সংস্কৃতিতে, বিজ্ঞাপন, সিনেমা এসবের প্রভাবে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। অধ্যাপক ইহাব হাসান একটি বিকল্প জ্ঞানভাষ্য এবং সমালােচনার মাধ্যম হিসেবে উত্তরাধুনিকতাকে  মানতে চান। তিনি যে উত্তরাধুনিকতাবাদের কথা বলতে চান তাতে উইলিয়াম ব্লেক, ডি সাদ; একটা সময়ের পাউন্ড, জয়েস, দাদা, স্যুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ, নব্য ফরাসি উপন্যাসের ধারা, জেনে, বিট আন্দোলন, জনপ্রিয় সাহিত্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে চান।

অধুনান্তিক পত্রিকা “হাওয়া৪৯”-এর সম্পাদক সমীর রায়চৌধুরী আধুনিক কবিতা আর অধুনান্তিক কবিতার বৈশিষ্ট্য এইভাবে চিহ্ণিত করেছেন : -

আধুনিক কবিতা : যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মতো যুক্তি ধাপেধাপে এগোয়, কবিতায় আদি-মধ্য-অন্ত এই ভাবগুলো বজায় থাকে, একরৈখিক, ক্রমঅগ্রসর, কেন্দ্রাভিগ, যুক্তির দিকে কবিতার অভিমুখ, আঁটোসাঁটো, স্বয়ংসম্পূর্ণ, বদ্ধসূচনা, বদ্ধ আঙ্গিক, বদ্ধ সমাপ্তি, ডিসটোপিয়া, সুনিশ্চিত মানে, পরিমেয়তা ও মিতকথনের প্রতি গুরুত্ব, কবির ঠিক করে দেয়া মানে, স্হাবর, তলে-তলে মানে, বাইরে মুখোশ, ‘আমি’ পাঠবস্তুর কেন্দ্রে, ‘আমি’র নির্মাণ, একক ‘আমি’, পূর্ব নির্ধারিত মানদন্ড, ক্যানন দাঁড় করানো, সীমা স্পষ্ট, আত্মপ্রসঙ্গই মূল পপসঙ্গ, শুদ্ধতা, ‘আমি’র পেডিগ্রি বা কুলজি, একক মালিকানা, স্পষ্ট মালিকানা, গোপন গভীরে শিকড়, কবিই টাইটেল হোলডার, লিনিয়ার, লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত, একক গলার জোর, একমুখী প্রগতি, ধ্বনি মেলান কবি, কবি একজন বিশেষজ্ঞ, শ্রেষ্ঠত্ব, শ্রেষ্ঠ কবিতা, চার্ট টপার কবি, একজনকে তুলে ধরা, হিরো কবি, গুরু কবি, এক সময়ে একজনই বড়ো, ব্র্যাণ্ড নেম কবি, আইকন, কথার খেলাপ, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, শব্দার্থকে সীমাবদ্ধ রাখা, কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন, বাদ দেবার প্রবণতা, এলিমিনেশন, একটিমাত্র মতাদর্শ, ইজম, হাইকমাণ্ড, পলিটব্যুরো, নিটোলো কবিতা, শক্তিমত্তার পরিচয়, কবিতার নির্দিষ্ট মডেল যেমন সনেট ওড ব্যালাড ইত্যাদি, কবিকে প্রকৃতির বাইরে সংসাস্কৃতিক জীব মনে করা, প্রতীকের প্রাধান্য, প্রতীকের চমৎকারিত্ব, ঘুরিয়ে বলা, স্হিতাবস্হার কদর, নাক উঁচু সংস্কৃতি, প্রান্তিককে অশোভন মনে করা, শ্লীল ও অশ্লীল ভেদাভেদ, ব্যবধান তৈরি করা, ভালো কবিতা-খারাপ কবিতার বাইনারি বৈপরীত্য, উতরে যাওয়া কবিতা, খণ্ডবাদী, রিডাকশানিজম, অবচ্ছিন্নবোধ, কেন্দ্রিকতায় উদ্ভূত, কবিতার শিরোনামের গুরুত্ব, প্রতিভা, মাস্টারপিস, ক্ষমতার মসনদ গঠন, মৌলিকতার হামবড়াই, একটিমাত্র বার্তার বাহক, কবিতার লক্ষ্য অব্যর্থ, কবির ব্যক্তিসত্তার বিবেচন, আধিপত্যের প্রতিষ্ধঠা, বৃক্ষশাখার মতন ইনটারলিংকড।

উত্তরাধুনিক কবিতা : যুক্তিবিপন্ন, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোবার প্রবণতা, আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু হওয়া আর শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না দেওয়া, ছেতরানো, ক্রমান্বয়হীন, আবেগ-যুক্তির দ্বৈরাজ্য, কেন্দ্রাভিগ, এলোমেলো দেখায়, দ্বৈরাজ্যের দিকে কবিতার অভিমুখ, মুক্ত সূচনা, মুক্ত আঙ্গিক, মুক্ত সমাপ্তি, হেটেরোটোপিয়া, মানের নিশ্চয়তা এড়িয়ে যাওয়া, অফুরন্ত মানে, যা ইচ্ছা তা মনে করে নিতে পারেন পাঠক, মানের ধারণার প্রসার, প্রচলিত মত অস্বীকার, যা আছে তা লোনোর দরকার নেই, স্বচ্ছতা, ভিতর-বাহির আলাদা নয়, একক ‘আমি’র অনুপস্হিতি, ‘আমি’র বন্ধুত্ব, ক্যানন থেকে বেরিয়ে যাওয়া, সীমা আবছা, সীমায় ভাঙন, মিশ্রতা, লিমিনালিটি, সংকরায়ন, সংকরত্ব, মালিকানার রুবরিক, মালিকানার বহুত্ব, মালিকানা বিপন্ন, মালিকানা বিসর্জন, পাঠকই টাইটেল হোলডার, শেকড় ছড়িয়ে পড়া, রাইজোম্যাটিক, প্লুরালিজম, বিদিশাগ্রস্ত বহুস্বরের আশ্রয়, দিগ্বিদিকে গতিময়, অ্যাক্টিভিস্ট, জগৎ আয়োজনের মেলবন্ধন উসকে দেন, কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য, বিবেচন-প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা সরিয়ে দেয়া, পাঠকৃতি বিচার্য - কবি নয়, সার্বিক চিন্তা-চেতনা, কথা চালিয়ে যাওয়া, কথার শেষ নেই, শব্দার্থের ঝুঁকি, আত্মমনস্কতা থেকে কবিতার মুক্তি, জোটবাঁধা, যোগসূত্র খোঁজা, শব্দজোট, মর্মার্থজোট, বহুমতাদর্শের পরিসর, বাক্যজোট, প্রতিনিয়ত রদবদল, ক্রমাগত পরিবর্তণ, ভঙ্গুরতার স্বীকৃতি, জীবন থেকে উঠে আসা ধারণা, বহুরঙা, অপরিমেয় নাগাল, নির্দিষ্টতার বাইরে, প্রতীকবর্জন, সরাসরি বলা,পরিবর্তনের তল্লাশি, প্রযুক্তির স্বীকৃতি, সাংস্কৃতিক বিভাজন বিলোপ, অভেদের সন্ধান, একলেকটিক, বাস্তব-অতিবাস্তব-অধিবাস্তবের ব্যবধান বিলোপ, যেমন ইচ্ছা হয়ে ওঠা কবিতা, বহুপ্রকার প্রবণতা গ্রাহ্য, কবি পরোয়াহীন, কমপ্লেকসিটি, জটিলতা, অনবিচ্ছিন্নতার দিকে, প্রান্তিকতায় উদ্ভূত, মাইক্রোন্যারেটিভ, সাময়িক প্রত্যয়, তত্বের বৈভিন্ন্য অনুশীলন, কবিতা ফ্লাক্স থেকে উপজাত, কাইনেটিক, কেন্দ্রিয় বিষয়ের অনুপস্হিতি, কবিতার শিরোনাম গুরুত্বহীন, প্রান্তিক শব্দ, আঞ্চলিক শব্দ, পথচলতি অভিব্যক্তি, একসঙ্গে বহু কন্ঠস্বর, বার্তার বহুলতা ও বার্তা বর্জন, আধিপত্যের বিরোধিতা, ছবি ও লাইন ঘাসের মতন ইনটারলকড, সংজ্ঞার সীমা ছাপিয়ে যাওয়া ।


আমরা পেয়েছি শিবনারায়ণ রায়কে, যিনি বলেছিলেন,   “ভাবতে হবে, চিন্তা করতে হবে, সেইসঙ্গে পড়াশোনাও করতে হবে প্রচুর। তাহলেই সবটা মিলিয়ে নতুন নতুন পথ হাজির হবে আমাদের সামনেতবুও শিক্ষা ও সুযোগের অভাবে বাংলা সাহিত্যে সুররিয়ালিজমের প্রভাব যথাকালে আসেনি। অথচ এ তো ভারতবর্ষেরই। সুররিয়ালিজমের মূল খুঁজতে অনেক চলে গেছেন প্রাচীন গ্রিসে যেখানে ডেফির দেবতা সক্রেটিসকে বলেছিলেন, নিজেকে জানো। কিন্তু তারও বহু আগে আমরা শুনেছিলাম আত্মানং বিদ্ধি। ধ্যানের সাহায্যে অপরলোকে উত্থান, শরীর ছাড়িয়ে গিয়ে দৈববাণী শ্রবণ, বেদ যে কারণে অপৌরুষেয়, অ্যালকেমির সমান্তরাল তান্ত্রিক উপাসনা ইত্যাদি। কিন্তু সাহিত্যে আমরা এগুলো ভুলে গেছি অনেকদিন, সম্ভবত ইংরেজদের প্রভাবে। সারা পৃথিবীর সচেতন লেখকদের মধ্যে এমন বোধহয় একজনও নেই— যিনি সুররিয়ালিজমকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পেরেছেন।   জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পরাবাস্তবতার অসাধারণ প্রয়োগ দেখতে পাই। যাঁরা জীবনানন্দের কবিতা বুঝতে পারতেন না তাঁদের পরাবাস্তব আন্দোলনের কথা জানা ছিল না।

আধুনিক কবিতার পরের কালকন্ডে যে ধরণের কবিতা আর গল্প লেখা আরম্ভ হলো সেগুলোকেই উত্তরাধুনিক বলা যায়। একটি কবিতা উত্তরাধুনিক ফর্মে হতে হলে যেসব মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে হয়—তা নিয়ে হয়তো তর্ক আছে। এক পক্ষ বলেন অঙ্কের হিসাব কষে বা বৈজ্ঞানিক উপাত্ত ধরে নির্ধারিত ছকে একজন কবি কবিতা আর গল্প-উপন্যাস লেখেন না। ঠিক বিপরীত কথা বলছেন কেউ কেউ।  তথাকথিত ছক থেকে কবিতাকে মুক্ত করে সাবলিলভাবে বেড়ে উঠতে দেয়াই উত্তরাধুনিকতা। এতে অন্যের প্রভাব চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা থাকে না। এতে শেকড়ের টান ও নিজস্বতার প্রভাবকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

উত্তরাধুনিকতা হলো একটি আভাঁগার্দ বহুরৈখিক পথ । আভাঁগার্দ মানে ‘অ্যাডভান্স গার্ড’ বা ‘ভ্যানগার্ড’, আক্ষরিক অর্থে ‘ফোর-গার্ড’, ভাবকল্পটি এমন একজন ব্যক্তি বা কাজ যা শিল্প, সংস্কৃতি বা সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় যা পরীক্ষামূলক, নতুন বা অপ্রথাগত। কাজগুলো প্রথমদিকে নান্দনিক উদ্ভাবন এবং প্রাথমিক অগ্রহণযোগ্যতা দ্বারা চিহ্নিত করা হতো । আভাঁগার্দ শব্দটা, মূলত ফরাসি সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত একটি শব্দ ছিল । এই  সামরিক রূপকটি সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ আরম্ভ হলো, বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক, প্রথানুগত লেখালিখি থেকে পার্থক্য চিহ্ণিত করার জন্য । শব্দটি সেনাবাহিনীর সামনের জওয়ানদের নির্দেশ করে, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমে শত্রুদের মুখোমুখি হয় এবং যারা পরে আসে তাদের জন্য পথ প্রশস্ত করে । অর্থাৎ আভাঁগার্দ বলতে বোঝায়, সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে, যাঁরা সমসাময়িক কালখণ্ড থেকে এগিয়ে । বলা বাহুল্য যে তাঁরা আক্রান্ত হবেন এবং তার জন্য তাঁরা নিজেদের সেইমতো প্রস্তুত করেন, এরকম মনে করা হয় । তবে বিবর্তনমূলক অর্থে নয়।  কারণ এটি বুর্জোয়া সমাজে সাহিত্য-শিল্পের মূল নীতি সম্পর্কে আমূল প্রশ্ন তোলে, যে বক্তব্যটি হলো এই যে, ব্যক্তি-একক  বিশেষ সাহিত্য-শিল্পের কাজের স্রষ্টা বা ব্র্যাণ্ড, পুঁজিবাদী কাঠামোয় বিক্রয়যোগ্য । আভাঁগার্দ ভাবকল্পটি সর্বদা প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে যাঁরা বুর্জোয়া এস্টাব্লিশমেন্টের স্থিতাবস্থাকে চুরমার করে যারা এগিয়ে যাবার কথা বলেন । কবি বা শিল্পী কী বলিতেছেন নয়, কবিতা বা শিল্পটি কী করিতেছে, এটাই হলো আভাঁগার্দের নবায়ন ।

আভাঁগার্দ কবিতা তার আগেকার অন্যান্য কবিদের কাব্যাদর্শ  প্রত্যাখ্যান করে এগোয় এবং পরিবর্তে নতুন এবং উত্তেজনাপূর্ণ বাকপথের সন্ধান করে । অর্থাৎ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্পের মনোবিজ্ঞান এবং আদর্শে, ঐতিহাসিকভাবে বিবেচনা করা হয় যে ( হেগেলীয় এবং মার্কসবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি যাকে ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতা বলবেন), ভবিষ্যতবাদী প্রকাশের প্রতিনিধিত্ব করেL তাই বলতে গেলে, একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক এবং ইউটোপিয়ান পর্যায়, আভাঁগার্দের বিচরণক্ষেত্র। ব্যাপারটাকে অনেকে মনে করেন, আভাঁগার্দ নিজেই বিপ্লব না হলেও তা ঘোষণা এবং বিপ্লবের জন্য একটি প্রস্তুতি। একইভাবে ছবি আঁকা আর ভাস্কর্যের নবায়ন করে আভাঁগার্দ । উদ্ভাবন ব্যাপারটা আভাঁগার্দ কাজের কেন্দ্র । ফলত, অনেকসময়ে, আভাঁগার্দ লেখা সম্পূর্ণ নতুন, দুর্বোধ্য, দুরূহ, মজার এবং প্রায়শই সমসাময়িক পাঠকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। কবি বা শিল্পী তার ফলে হতাশ হন না, ঠিক যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটে, পেছিয়ে আসার প্রশ্ন ওঠে না । মরে যাবে জেনেই  আভাঁগার্দ জওয়ানরা শত্রুনিধনে বেরোয় । কখনও কখনও কবি বা শিল্পীরা, যাঁরা আভাঁগার্দ  থিমের সাথে জড়িত, তাঁদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি পেতে কয়েক দশক লেগে যায় কিংবা শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি নাও পেতে পারেন । ক্রমশ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প মূলধারার অংশ হয়ে যায় এবং অবিশ্বাস্যভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায়, একদা যে ডাডাবাদী কাজগুলো আভাঁগার্দ হইচই হিসাবে নিন্দিত হয়েছিল তা প্রয়োগ করছে বিজ্ঞাপনের এজেন্সিগুলো । প্রাথমিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যা আদর্শ বা স্থিতাবস্থা হিসেবে বহুকাল যাবত গ্রাহ্য, তার সীমানা অতিক্রম করে আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প । আভাঁগার্দকে  কেউ কেউ আধুনিকতার শেষ বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন যার হাত ধরে উত্তরাধুনিকতা প্রবেশ করেছে । অনেক শিল্পী  আভাঁগার্দ আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে নিজেদের কাজকে উত্তরাধুনিক হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন । ‘শ্রুতি’ আন্দোলনের কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায় আমেরিকার ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েটদের বহু আগে উত্তরাধুনিক কবিতা লিখেছিলেন ।


প্রাগুক্ত বইতে তপোধীর ভট্টাচার্য বলেছেন, সাহিত্যিকতার সংগঠনে উপস্থাপনার কত বহুমুখী তাৎপর্য হতে পারে এবং পাঠকৃতির নির্মিতিতে অন্তর্বয়ন ও পরাপাঠের গুরুত্ব কত বেশি,এ সম্পর্কে তারা আমাদের সচেতন করে দিয়েছেন । কোনও যথাপ্রাপ্ত বাস্তবতার পুনরুখাপন করাই শিল্প নয়। ভাষার বহুস্বরিক বিন্যাস ও প্রতিন্যাসের মধ্য দিয়ে বাস্তব অহরহ পুননির্মিত হয়। যে-অনুপাতে ভাষা নতুন হয়ে ওঠে, ঠিক সেই অনুপাতে শিল্পকেও মৌলিক বলতে পারি । এইজনো সৃষ্টি ও নির্মাণের দ্বন্ধ। আর, এই ধারণাও এখন অচল যে নব নব উন্মেষশালিনী প্রতিভার অধিকারী শুধু লেখক এবং পাঠক কেবল নিস্ত্রিয় ভোক্তা। রোর্লা বার্ত তার বিখ্যাত 5/7, বইতে বাচনিক নন্দনের নতুন পর্যায়ের সুচনা করেছেন। বালজাকের “সারাসিন' এর আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি পাঠককেন্দ্রিকতা ও লেখককেন্দ্রিকতার নতুন সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। ভাষা থেকে অর্থের উদ্তাসনে যেখানে উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়, সেখানে পাঠক সব্তিয় না হয়ে পারে না। স্বভাবত ভাষার অভিব্যক্তিতেও তার ছাপ পড়তে বাধ্য । কিন্তু যেখানে পাঠকৃতিকে আমরা নিষ্ক্রিয় পাঠক হিসেবে গ্রহণ করি, সেখানে ভাষাতেও অর্থাৎ অর্থবোধে সক্রিয়তার বিদ্যুৎস্পর্শ দেখা দিতে পারে না। যেখানে পাঠকের সক্রিয় সহযোগিতা আবশ্যিক সেখানে লিখন-প্রক্রিয়া কার্যত লেখক থেকে পাঠকের কাছে সরে যায়।”...সংস্কৃতি ও বর্বরতার দ্বান্বিকতা কিংবা অমঙ্গলবোধ সম্পর্কিত চুড়ান্ত চেতনা কীভাবে সাংস্কৃতিক সমালোচনা-ধারাকে প্রভাবিত করে, এসম্পর্কে আডোর্নোর মন্তব্য নিঃসন্দেহে আমাদের ভাবায়। আউস্হিৎস সভ্যতার ইতিহাসে নিঃসন্দেহে বিপুল গুরুত্বসম্পন্ন জলবিভাজন রেখা । এই রেখার ওপারে যারা রয়েছে, কবিতা লেখা তাদের কাছে বর্বরতার অভিজ্ঞান কেন-_ তা তলিয়ে ভাবতে হয়। সৃষ্টির জ্ঞানও ধবস্ত হয়ে যাচ্ছে সার্বিক বিনষ্টির গাঢ়তম ছায়ার অভিঘাতেঃ তাই কবিতার মতো সূক্ষ্ম সংবেদনশীল শিল্পমাধ্যম এখন নিরাশ্রয়। তবে এই কথাগুলিকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করা সমীচীন কি না, এই প্রশ্ন উঠে তাইযন্ত্রণাময় আত্মসমালোচনার সুত্রে বাচনিক আতিশয্য অনিবার্ধ হয়ে পড়েছিল। হয়তো শিক্পকর্মকে কেউ কখনো ইতিহাস-নিরপেক্ষ বলে ভাবতে না পারে ।”...”প্রতিটি পাঠকৃতি মানে সিসিফাসের পুনর্নবীকৃত উদ্যম; বয়ানের ভেতরে প্রচ্ছন্ন থাকে তাৎপর্যের গভীরে পৌছানোর সোপানমালা। অধ্যবসায়ী শিল্পরসিক পাঠক/দর্শক ছাড়া অন্য কেউ তাদের আবিষ্কার করতে পারেনা ।”

আধুনিকতাবাদীদের পরের কবিরা, যাঁদের ষাট-সত্তর-আশি-নব্বই দশকের কবি বলা হয় তাঁদের কবিতায় বক্তব্য আছে, কিন্তু বক্তব্য নিয়ে নিশ্চিত হওয়া চলে না। কবিতাজুড়েই চলে দ্বিরুক্তিবদাভাস, শ্লেষ ও কূটাভাসের খেলা। পরিচিত পরিমণ্ডলের বাইরে থেকেও তাঁরা নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে আহরণ করেন উপমা উৎপ্রেক্ষা ও রূপক, মিথ ও মেটাফর। অনেক কঠিন সমাজ বাস্তবতার কথা বললেও তাঁদের কবিতার ভাষা অধিক সম্ভাবনা তৈরি করে । বস্তুত আধুনিকতাবাদীদের পরবর্তী কবিদের অনেকে নিজের সময়কে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন