কবিতা পড়া, কবিতা শোনা, কবিতা এড়িয়ে যাওয়া : মলয় রায়চৌধুরী
এক
.
ভারতবর্ষের ভাষাগুলোতে বাল্মীকির ক্রৌঞ্চমিথুন-বিয়োগ-জনিত এই শ্লোক প্রথম কবিতা বলে প্রচারিত।
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ।
যৎক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।। ”
স্কুলে সংস্কৃত শিখেছিলুম । কম নম্বর পেতুম । সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ পড়িনি । মহাভারতও নয়।
.
কৃত্তিবাসের রামায়ণও পড়িনি, যদিও ইমলিতলার বাড়ির পুজোর ঘরে কৃত্তিবাসের রামায়ণ লাল শালুতে মোড়া রাখা থাকতো। রামায়ণ পড়েছি রাজশেখর বসুর অনুবাদে । মহাভারত পড়েছি অনুবাদে।কাশীরাম দাসের নয় ; কালীপ্রসন্ন সিংহের । ইমলিতলার বাড়িতে মহাভারত রাখা হতো না, বাড়িতে মহাভারত রাখলে ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়া-মারামারি হয়, তাই । এই দুই মহাকাব্যের পরও বাংলায় মহাকাব্য লেখা হয়েছে : মাইকেল মধুসূদন দত্তের পর মহাকাব্য-রচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বৃত্রসংহার) এবং নবীনচন্দ্র সেনের 'ত্রয়ী' যথাক্রমে রৈবতক (১৮৮৭),কুরুক্ষেত্র (১৮৯৩),প্রভাস(১৮৯৬) । এই শতকের শেষে গীতিকাব্যের বন্যাবেগ না এলে, মহাকাব্যের ধারাকে বিশ শতকের আরম্ভ পর্যন্ত টেনে আনা চলতো। বিশ শতকেও আমরা অনেক মহাকাব্য পেয়েছি। কিন্তু সমসাময়িক গীতিকাব্যের আন্তরিকতা, সত্যবোধ এবং দীপ্তির কাছে তা অত্যন্ত নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়ায় আজ আর তার খোঁজ কেউ নেন না। বিশ শতকের মহাকাব্যের কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন - আনন্দচন্দ্র মিত্র (হেলেনা কাব্য), কায়কোবাদ (মহাশ্মশান), হামিদ আলী (সোহ্রাববধ কাব্য), সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (অনলপ্রবাহ) এবং যোগীন্দ্রনাথ বসু (পৃথ্বীরাজ)। এগুলোর মধ্যে মাইকেল মধুসূদনের মহাকাব্য ছাড়া কোনোটাই পড়িনি । অশ্ব ঘোষ-এর লেখা 'বুদ্ধকার্তিকা' আর 'সৌন্দরানান্দকাব্য' পড়িনি । কালিদাস-এর 'ঋতুসংহার' 'মেঘদূত', 'রঘুবংশ', 'কুমারসম্ভব' , 'মালবিকাগ্নিমিত্র' ,'বিক্রমোর্বশীয়' আর 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম', সবই পড়েছি অনুবাদে। ‘গিলগামেশ’ মূল রচনা পড়িনি, স্কুলে থাকতে গল্পের বইতে পড়েছি । গীতা, বেদগুলো পড়েছি চাকরিতে ঢোকার বছর দশেক পর, বাংলা অনুবাদে । কোরান পড়েছি অনুবাদে – বুঝতে পারিনি ।
.
অর্থাৎ বই পড়ার শিক্ষার সঙ্গে স্কুল-কলেজের শিক্ষার কোনো যোগ নেই । পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কবিতা লেখেন এবং সেগুলোকে ডেসিফার করা সহজ নয়। কবিতা লেখা শেখানো যায় না। কবির জন্ম হয়। এ কথা যেকোনো শিল্পীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তা না হলে ফরাসি কবি আর্তুর র্যাবো কিভাবে ২০ বছর বয়সের মধ্যে লিখে ফেললেন তার ভয়ংকর সুন্দর সব কবিতা, হুইটম্যান কেন ভবঘুরে জীবন যাপন করেও হয়ে ওঠেন মার্কিন কবিতার জনক, লেটোর দলের অন্যদের মতো হারিয়ে না গিয়ে নজরুল কিভাবে নাড়িয়ে দেন বাংলা কবিতার ভুবন। আর অসম্ভব প্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথ যেখানে হতে পারতেন ভাইয়ের মতো আইসিএস অফিসার, তা না হয়ে, হয়ে উঠলেন বিশ্বকবি। কবির জন্ম না হলে এসব অসম্ভব, অকল্পনীয় ঘটনা ঘটত না। এঁরা কেউ পাঠশালায় কবিতা শেখেননি ।
.
কবিতার উৎপত্তি নির্ণয় করা কঠিন, কারণ লিখিত কবিতার প্রাচীনতম উদাহরণ সম্ভবত সময়ের কাছে হারিয়ে গেছে। নাসার একটা রিপোর্ট আছে মহাভারতের যুদ্ধের সময়কালের ওপর। মহাভারতে যে তেরো দিনের ব্যবধানে পুর্ণ চন্দ্রগ্রহণ আর পূর্ণ সূর্যগ্রহণের ব্যাখ্যা আছে সেই সূত্র ধরে নাসার পক্ষ থেকে এস বালাকৃষ্ণান কয়েকটা বছরকে চিহ্নিত করেছেন, যে সময়ে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। যেমন, ৩১২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, ২৫৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, ১৮৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, ১৩৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ইত্যাদি । তবে গবেষকদের মতে বাল্মীকি রামায়ণের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রমাণ (যেমন মহাভারতে সতীদাহ প্রথার উল্লেখ থাকলেও রামায়ণের মূল পাঠে তা নেই) থেকে অনুমিত হয় এই গ্রন্থ মহাভারতের আগে লেখা হয়েছিল। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, হিন্দু কালপঞ্জিতে উল্লিখিত যুগপর্যায়ের দ্বিতীয় যুগ, ত্রেতায় এই মহাকাব্য লেখা হয়। গল্প অনুযায়ী, ত্রেতা যুগেই ইক্ষ্বাকু বংশীয় রাজা দশরথের ছেলে রামের জন্ম হয়। এগুলো মহাকাব্য বা সেই সময়ের কবিতা । মহাভারত আর রামায়ণ মহাকাব্যের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এ-দেশের মানুষের ধর্মাচরণ, নিষ্ঠা, বিশ্বাস। এবার মাটি খুঁড়ে রামায়ণ-মহাভারতের সময়কার জীবনশৈলী খুঁজতে দিল্লিতে খোঁড়াখুড়ি চলছে। দেশজুড়ে দুই মহাকাব্যের শিকড়ের খোঁজে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগকে খননকার্যের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। ফেব্রুয়ারি মাসে, রাজধানী দিল্লি থেকে মাত্র সাড়ে চার কিলোমিটার দূরত্বে শুরু হয়েছে খোঁড়াখুড়ির কাজ।
.
একটা লেখাকে ঠিক কী ব্যাপার কবিতায় পরিণত করে সেটা এমন এক বিষয় যার উত্তর সাহিত্য সমালোচনার সমগ্র ইতিহাস এখনও দিতে পারেনি।কবিতার উদ্দেশ্য কী তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন। কেন মানবসমাজে কবিতার সৃষ্টি হয়েছে ? প্রথমত, মানব সংস্কৃতি হাজার হাজার বছর ধরে শৈল্পিক সৃষ্টিতে নিযুক্ত । মানব আচরণের প্রাচীনতম প্রমাণের বেশিরভাগই, যা আজও টিকে আছে, তা শিল্পের সাথে সম্পর্কিত, যেমন গুহাচিত্র, হরপ্পার ছোট ভাস্কর্য, পিরামিডের ভেতরে নানা ধরনের ছবি, মায়া আর অ্যাজটেকদের কাজ। সম্ভবত কবিতার অস্তিত্বের কারণ তা লেখা বা গাওয়া, যা মানুষের পক্ষে অপ্রতিরোধ্য। আলাদা করে ভাবলে, প্রতিটি কবিতার অস্তিত্বের নিজস্ব কারণ থাকতে পারে। কিছু কবি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক ঘটনা বর্ণনা করতে লেখেন, যেমন সাহিত্যের প্রাচীনতম রচনাগুলো, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি। অন্যগুলো জগতসংসার সম্পর্কে স্বতন্ত্র সত্য প্রকাশ করতে, দার্শনিক ধারণা প্রকাশ করতে, কোনো ঘটনার প্রাণবন্ত ছবি আঁকতে, নিজের জ্বলন্ত মগজের, ব্যর্থ প্রেমের, পচনরত কালখণ্ডের কথা বলতে, লেখা হয়েছে । যেমন ভারভারা রাও এই দেশের পচনরত কালখণ্ড সম্পর্কে লেখার জন্য জেলে রয়েছেন বহুদিন। সরোজ দত্ত আর দ্রৌণাচার্য ঘোষকে খুন করা হয়েছিল । শম্ভু রক্ষিতকে জেলে পোরা হয়েছিল।
.
রাষ্ট্রের পক্ষে কবিদের অপ্রয়োজনীয় মনে করে আদর্শ রাষ্ট্র থেকে আগেভাগেই কবিদের দূরে রাখতে চেয়েছিলেন অ্যারিস্টটলের গুরু প্লেটো। কিন্তু কবিতা তো শুরু হয়েছিল ব্যক্তি-এককের আত্ম-প্রকাশের একটা রূপ হিসেবে। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির উদ্ভবের সঙ্গে পালটেছে কবিতা।তাদের কাব্যিক অনুষঙ্গ নির্বিশেষে, স্বৈরশাসকরা কবিতার বিপদ অনুভব করে, এই কারণেই তাদের শাসনামলে কবিদের নিয়মিতভাবে কারারুদ্ধ, নির্যাতন, হত্যা বা নির্বাসনে পাঠানো হয়। এমনও হয়েছে যে শাসকেরা কবির লেখা সহ্য করতে না পেরে হয় সরকারিভাবে তাকে খুন করেছে বা চুপচাপ গুমখুন করেছে বা লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় পিনোশের সরকার কবি পাবলো নেরুদাকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করে। স্পেনে দক্ষিণপন্থী দলের উত্থানের সময়ে সরকারের রোষদৃষ্টিতে পড়েন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার পক্ষপাতী লোরকা। গ্রানাডার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা এতটাই অস্থির ছিল যে কেউই সেখানকার মেয়রের দায়িত্ব নিতে চাইছিলেন না। লোরকার আত্মীয় মন্তেসিনো এই পদে বসার সাতদিনের মধ্যেই খুন করা হয় তাঁকে। আর এই হত্যার পরের দিনই ১৯৩৬ এর ১৮ আগস্ট গ্রেপ্তার হন লোরকা। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯ আগস্ট।কবি ওসিপ ম্যাণ্ডেলস্টামকে গুম খুন করে লোপাট করে দিয়েছিলেন স্ট্যালিন। ১৯৫২ সালে তেরোজন ইহুদি কবি-লেখককে মস্কোর লুবিয়াঙ্কা কারাগারে খুন করা হয়েছিল । কবিতা মানুষকে হত্যা করে না। একনায়করা করে। কিন্তু কবিতা আমাদের মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়, আমাদের সাক্ষ্য দিতে বলে, সময়ের ব্যাখ্যা চায়। "কবি শব্দই বিদ্রোহবাচক,কারণ জীবনের ষড়যন্ত্রময় বস্তুসমূহের মারাত্মক অবস্থান যে মেনে নিতে অস্বীকার করে ও বেঁকে বসে সে-ই কবি," একথা বলেছিলেন শৈলেশ্বর ঘোষ।
.
কোনো কোনো কবি মৃত্যুর ওপার থেকেও আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। ১৯৪৪ সালে হাঙ্গেরির জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবার আগে মিক্লোস রাদনোতি তাঁর শেষ কবিতা লিখেছিলেন। তাকে মাথায় গুলি করে খুন করা হয়েছিল আর তাঁর লাশ পরে গণকবরে পাওয়া যায়, সেই সঙ্গে তাঁর কবিতা লেখার ছোট নোটবুক, যার একটা পাতায় ছিল “আমি লিখি, আমি আর কি করতে পারি? একটা কবিতা বিপজ্জনক, / আর তুমি যদি কেবল জানতে যে কীভাবে একটা বাতিক, সূক্ষ্ম লাইন, / এমনকি এর জন্যও সাহস লাগে ..."। নাজিম হিকমেত তাঁর জীবনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জেল ও নির্বাসনে কাটিয়েছেন। ওলে সোয়িঙকা বায়াফ্রার বিদ্রোহীদের সাথে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন আর পড়া-লেখার উপকরণ ছাড়াই দুই বছরের জন্য নির্জন কারাগারে বন্দী ছিলেন। বন্দী কবিদের সাম্প্রতিক তালিকাটি দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময় - ডারেন তাতুর, ট্রান ডুক থাচ, স্টেলা নায়ানজি, আহনাফ জাজিম, ইলহান কোমাক, আশরাফ ফায়াদ। মিয়ানমারের সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানে ৩০ জনের বেশি কবিকে বন্দী করা হয়েছে এবং চারজনকে হত্যা করা হয়েছে। উইঘুর কবিদের চীনা বন্দিশিবিরে বন্দি রাখা অব্যাহত । রাশিয়ার গোয়েন্দারা একজন কবিকে বিষ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল আর ইরানে, কবিদের "অপপ্রচার করা" এবং "পবিত্রতার অবমাননা" করার জন্য রাস্তার মোড়ে বেত দিয়ে পেটানো হয়েছে। এই সমস্ত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস একটা একক ঘটনায় তুলে ধরা যায়: বেলারুশিয়ার কবি স্টেপান লাটিপভ মিনস্কে বিচার চলাকালীন একটা কলমের নিব দিয়ে নিজের ঘাড়ের রক্তশিরায় ছুরি চালিয়েছিলেন । আমেরিকার সান কোয়ান্টিন কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের অনেকের শেষ আশ্রয় কবিতা লেখা, যদিও তাদের ভয়ঙ্কর তকমা দিয়ে আলাদা-আলাদা খোপে রাখা হয়, আর লেখাগুলো জেলের বাইরে এনে কর্মী বা শিল্পীদের সহায়তায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়।
.
বহু কবি শাসকের তুষ্টির জন্য তার পদসেবা বেছে নিয়েছে । এই কবিদের কবিতা বুঝতে হলে পাঠককে সমাজ-শাসক-ইতিহাস-দেশ ইত্যাদির পঠন-পাঠন করতে হবে। কিছু লোক কিছু নির্দিষ্ট ধরণের কবিতা বোঝা কঠিন বলে মনে করতে পারে, আবার অন্যরা তা সহজে বুঝতে পারে । কিছু কবি ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের বার্তা জানাতে জটিল ভাষা বা চিত্রকল্প ব্যবহার করতে পারে, অন্যরা আরও সরল ভাষা ব্যবহার করতে পারে। শেষ পর্যন্ত, কবিতা বোঝা কঠিন হবে কি না তা ব্যক্তিগত রুচি, শিক্ষা, আগ্রহ আর ব্যাখ্যার বিষয় ।
.
দুই
.
কবিতা সম্ভবত গুহাচিত্রের পরের ধাপ । আম্বাদেবী রক আশ্রয়কেন্দ্রে ভারতের প্রাচীনতম গুহাচিত্র রয়েছে অম্বাদেবী গুহার দেয়ালে যা ২৫০০০ বছর আগের। ভীমবেটকার গুহাচিত্র প্রায় ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। গুহাচিত্রকে মানব প্রাণীর সৌন্দর্যের উপলব্ধির প্রথম অভিব্যক্তি আর জীবনের এক রহস্যময় বা পবিত্র দিকের প্রতিনিধিত্ব হিসাবে বিবেচনা করা যায়। প্রাগৈতিহাসিক বিষয়ের আর্ট গ্যালারিতে পাথরের ওপর প্রাণবন্ত রঙের প্রাণীদের অজস্র ছবি আর কাজের আকর্ষণীয় ভঙ্গি দেখা যায়। গুহা চিত্রগুলো হল একটা ক্যানভাস হিসাবে গুহার দেয়াল ব্যবহার করে তৈরি করা পেইনটিঙ। প্রস্তর যুগে তৈরি, শিল্পের এই কাজগুলি প্রায়শই কাঠকয়লার মতো প্রাকৃতিক জিনিস দিয়ে আঁকা হতো। রঙ সাধারণ সরঞ্জাম হাত দিয়ে বোলানো হতো। কবিতাও ওইভাবে বেরিয়ে আসে, মগজের গুহার দেয়াল থেকে। ২৫০০০ বছর দেয়ালের গায়ে আঁকা ছবিগুলো টিকে আছে ; এথেকেই তো প্রমাণ হয় যে মানুষ প্রথম থেকেই জানতে চেয়েছে তার আস্তিত্বের মানে, বলতে চেয়েছে যে পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলতে হলে শিকার করা আর খাওয়ার চেয়ে বেশি কিছু আছে । বিশ্বের প্রাচীনতম গুহার দেয়ালে যাঁরা ছবি তৈরি করেছেন তাদের সম্পর্কে কিছুই কি জানি আমরা ?
.
পাথরে বা গুহার দেয়ালে আঁকা বা খোদাই করা ছবি—যা বিশ্বজুড়ে পাওয়া গেছে—মানুষের যোগাযোগের প্রাচীনতম রূপগুলির মধ্যে একটিকে প্রতিফলিত করে, যার সাথে ভাষার বিকাশের সম্ভাব্য সংযোগ রয়েছে– তাই একে কবিতার আর গানের প্রথম ধাপ বলা যায়। প্রাচীনতম ছবিগুলো প্রায়শই বিমূর্ত দেখায় যা প্রতীকী হতে পারে। যখন পরবর্তীতে প্রাণী, মানুষ এবং মিশ্রচিত্রণ করা হয়েছে তা হয়তো একধরনের আধ্যাত্মিক কাজ ছিল। আরও স্পষ্টভাবে, গুহা শিল্পের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আমাদের প্রতীকী, বহুমুখী ভাষার ক্ষমতা কীভাবে বিকশিত হয়েছিল সে সম্পর্কে সূত্র সরবরাহ করে । এই ধারণার একটি চাবিকাঠি হল যে গুহা শিল্প প্রায়শই শাব্দিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত, যেখানে শব্দ দৃঢ়ভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। এই আঁকাগুলো গুহার বেশ গভীরে, যেখানে ঢোকা কঠিন, সেই অংশগুলোতে অবস্থিত, যা থেকে আঁচ করা যায় যে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি গুহাগুলোর মধ্যে আঁকার একটা প্রধান কারণ ছিল। ছবিগুলো সম্ভবত শব্দগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করতো যা সেই দাগগুলোতে প্রাথমিক মানুষেরা বলতে চেয়েছিল।
.
শব্দ আর অঙ্কনের এই যোগাযোগকে বলা যায় শ্রুতির তথ্য এবং চোখে-দেখা একটা মিশেল যা প্রাথমিক মানুষদের প্রতীকী চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রক্রিয়া ছিল।শব্দ এবং চিত্রের সংমিশ্রণ এমন একটি জিনিস যা আজ কবিতাকে চিহ্নিত করে, অসীম নতুন বাক্য তৈরি করার ক্ষমতা দেয় কবি আর পাঠককে। গুহাচিত্রগুলোতে মানসিক চিত্রকল্পের পাশাপাশি উপলব্ধি, বা কাব্যিক কল্পনা, সেইসাথে পুঙ্খানুপুঙ্খ কাজ ব্যবহার করা হয়েছে । কখনও কখনও একটা দেয়ালে সমস্তই যেন কবিতা, কখনও কখনও সমস্তই যেন গদ্য--অন্য সময়ে পরিবর্তনশীল সংমিশ্রণ, যেখানে কবিতা গদ্যে পরিণত হয়, গদ্য কবিতায় পরিণত হয়।
.
এই প্রসঙ্গে শ্রুতি আন্দোলনের কবি পরেশ মণ্ডলের ভিজুয়াল কবিতা উল্লেখ করতে হয় । ভিজ্যুয়াল কবিতা একটি কবিতার অর্থের উপর জোর দেওয়ার জন্য কবিতায় চিত্র, রঙ, বিন্যাস, আকার, টাইপোগ্রাফি এবং প্যাটার্নের মতো গ্রাফিক বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করে। ভিজ্যুয়াল কবিতার প্রয়াস হলো পাঠককে সংবেদনশীল স্তরে সম্পৃক্ত করার, কবিতার চাক্ষুষ চেহারা ব্যবহার করে শব্দের সাথে অর্থের আরেকটি স্তর যুক্ত করা। সৃষ্টি এবং জাগতিক বস্তুর প্রতিনিধিত্বকারীর মধ্যে সম্পর্ক গড়ার উপরোক্ত আকাঙ্ক্ষা আমাদের জিনের মধ্যে পোঁতা আছে আর আমাদের বিবর্তনের সাথে তা জড়িত । গুহা শিল্পের মতো, কবিতা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পাঠানো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সাংস্কৃতিক স্মৃতি হয়ে ওঠে । দুপুর মিত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে, শ্রুতি আন্দোলনের কবি মৃণাল বসুচৌধুরী বলেছেন, “এটুকু হয়ত বলাই যায়, বাংলা কবিতার অবয়বে যে দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন এসেছে, কবিতার পংক্তির ১৪, ১৮ কিংবা ২২ অক্ষরের ঠাসবুনোন থেকে মুক্তি পেয়ে অক্ষরবৃত্তও যে দৃষ্টিনন্দন হয়ে খেলা করছে কবিতায়। কবিতার বহিরঙ্গে যে পরিবর্তন এসেছে, তার জন্য শ্রুতির কবিদের প্রচেষ্টাকে না মানাটা অন্যায় হবে। তার্কিকরা ১৯৬৫ সালের আগে কবিতার চেহারা কেমন ছিল এবং পরবর্তী দু’এক বছরে তা কিভাবে হঠাৎ বদলে গেল ভেবে দেখবেন।”
.
মানুষের বিবর্তন যত এগিয়েছে, শৈল্পিক আচরণ আরও জটিল এবং বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে।সময়ের সঙ্গে তাই ছবি আঁকায় আর কবিতা লেখায় অবিরাম রদবদল ঘটে চলেছে । নিয়ান্ডারথালরা, যদিও অন্যায়ভাবে তাদের হিংস্র জানোয়ার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তাদের শৈল্পিক আচরণের আধিক্যে অবাক করার মতো। তারা পেইন্টিংয়ের প্রাচীনতম উদাহরণগুলির মধ্যে কয়েকটি তৈরি করেছিল, প্রাকৃতিক রঞ্জক ব্যবহার করে বিমূর্ত ছবি এঁকেছিল আর গুহার দেয়ালে স্টেনসিল-ছাপ তৈরি করেছিল । জানি না কোনো নিয়ানডারথাল সমালোচক সেগুলোর মানে জানতে চেয়েছিল কিনা । গুহা চিত্রের মতো, কবিতা আমাদের আরও সৃজনশীলভাবে চিন্তা করতে উৎসাহ যোগায় , সমসাময়িক সমাজে মানুষের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে আর আমরা সাংস্কৃতিকভাবে যা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি সে সম্পর্কে তথ্য সম্প্রচার করে ।
.
তিন
.
‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ বইতে আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেছেন, “কাব্যের ইতিহাসে প্রগতির লক্ষণ স্পষ্ট দেখা যায় কিনা এ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। যাঁরা বলেন খগ্বেদ-সংহিতা, কঠোপনিষদ্, কিংবা সং অব. সলোমনের তুল্য কবিতা পরবর্তীকালে আর রচিত হয় নি, তাঁদের কাব্যরসাস্বাদনে ভক্তিরসের আমেজ লেগেছে এমন সন্দেহের অবকাশ যদি-বা থাকে, বিশুদ্ধ কাব্যরসবিচারের উপর নির্ভর ক'রেই বহু দায়িত্জ্ঞানসম্পন্ন সমালোচক এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে ব্যাস, বাল্সীকি, হোমর, সফোক্লিস প্রভৃতি আড়াই-তিন হাজার বছর পূর্বে কবিকর্মকে সার্থকতার যে-স্তরে তুলে দিয়ে গেছেন, তার চেয়ে উচ্চতর শিখর-আরোহণ পরবর্তী কোনো কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি আজও। কিন্তু কাব্যের প্রগতি তর্কাধীন হলেও তার গতি অনস্বীকার্য । নদীর মতো কবিতাও চলে এবং সিধে চলে না, কখনো হঠাৎ কখনো ধীরে-ধীরে বাঁক নেয়, কখনো-বা এমন মৌলিক পরিবর্তন ঘটায় আপন আধারে, আধেয়তে, বা উভয়ত, যাকে ইতিহাসে যুগাস্তব বলেই অভিহিত করতে হয়।”
.
বাংলা কবিতায় তেমনই এসেছে নানা আন্দোলনের বাঁকবদল, এসেছে আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, পুনরাধুনিকতা ইত্যাদি। বাঙালির আধুনিকতার রুদ্ধ ধারাটি মুক্ত করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝিতেই। আর রবীন্দ্রনাথ এসে তাকে দিয়েছিলেন তীব্র স্রোত। তবে মাইকেল কিংবা রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় সেই আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছিলেন ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের ক্ষুদ্র বলয় থেকে বেরিয়ে বাঙলা কবিতা তখনও আধুনিকতাকে পুরোপুরি গ্রহণ করেনি। আর তাই মাইকেল থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কবিতা ছিল পরবর্তী তিরিশের দশক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শব্দগঠন, ভাষার শৈলী-বৈচিত্র্য, চিত্রকল্পের অনুভূতি প্রকাশের বিষয়ও ছিল আলাদা। বলতে গেলে মাইকেল থেকে রবীন্দ্র (রবীন্দ্রনাথের পুরো কাল নয়; ১৮৬১-১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ) সময় পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্যের জন্য ছিল আধুনিকতার প্রস্তুতিকাল। এই সময়েই আধুনিকতা প্রস্তুত হচ্ছিল তিরিশের জন্য।
.
তিরিশের দশকের কবিদের হাতেই বাঙলা কবিতা ইউরোপীয় আধুনিকতাকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে। এর আগের কবিরা আধুনিকতাকে ধারণ করেছিলেন বিচ্ছিন্নভাবে। বিচিত্র প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমও ছিল প্রায় সম্পর্কশূন্য। ত্রিশের দশকের কবিরাই প্রথম আধুনিকতাকে ব্যক্তির উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। কবিতায় গ্রহণ করেছিলেন সমগ্রতাকে। কোনো এক নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তাদের ভাব-উপলব্ধি আবদ্ধ থাকেনি। সবকিছুকে ধারণ করেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিন্তু প্রকাশ করেছিলেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। আর প্রত্যহ-জীবনের নানান উপলব্ধিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করারই ছিল বিংশ শতকের আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে প্রকাশ-রীতির মধ্যেই যে আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছিল পরিপূর্ণরূপে তা নয়, বরং এর অন্তনিহিত ভাবও ছিল কবির একান্ত নিজস্ব বিষয়।
.
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার কথা বললেই উপরোক্ত দুজনের নাম ভেসে ওঠে । প্রথম আধুনিকতা বাংলা সাহিত্যে এসেছে উনিশ শতকে নবজাগরণের হাত ধরে। মধুসূদন দত্ত শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক কবি। যে বছরে মধুসূদন দত্তের আধুনিকতার প্রকাশ, সেই বছরই আবির্ভাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১)। উনিশ শতকের এই আধুনিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানবতাবাদ আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। আর মধুসূদন পড়া আরম্ভ করে পাঠক বুঝতে পারেন যে যথেষ্ট শিক্ষিত না হলে আধুনিক কবিতার আবেদন কিংবা অনুধাবন কম হয় । বিশ শতকের তিরিশের কবিদের কথা তো পরে উঠবে । তার আগে নজরুল, মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ, এই তিনজনের মধ্যে অন্যরকম প্রয়াস দেখা গিয়েছিল, কিন্তু আসলে রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতার আরম্ভ তিরিশের দশকে। 'পল্লীকবি' উপাধিতে ভূষিত, জসীমউদ্দীন বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত কবি ভিন্নঘরানার কবি যাঁর সঙ্গে তিরিশের কবিদের কবিতাভাবনার মিল নেই। তিনি ১০,০০০ এরও বেশি লোক সংগীত সংগ্রহ করেছেন, যার কিছু অংশ তার সংগীত সংকলন জারি গান এবং মুর্শিদা গান এ স্থান পেয়েছে। একই কথা বলতে হয় নজরুল সম্পর্কে, যাঁকে তিরিশের কবিদের থেকে ভিন্নভাবে পাঠ করা হয়। এই দুজন কবি কিন্তু তিরিশের কবিদের তুলনায় জনপ্রিয় । মোহিতলাল আর যতীন্দ্রনাথ আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, পুনরাধুনিকতার ভিড়ের চাপে সিলেবাসের বাইরে বেরোলেন না ।
.
রবীন্দ্রনাথের পর যে আধুনিকতাবাদীরা আমাদের সামনে উদয় হলেন, তাঁরা, কী বলব, বুদ্ধদেব বসু-সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ, উন্নাসিক শব্দটা ব্যবহার যুৎসই হবে । সম্ভবত ইংরেজি শিক্ষার গোমর । রবীন্দ্রনাথকে যেকোনো কবি অ্যাপ্রোচ করতে পারতেন, তিনি খোলাখুলি মতামত দিতেন । কিন্তু তাঁর পরে যাঁরা এলেন, তাঁরা ব্লকেড খাড়া করার সাহিত্যিক উন্নাসিকতা নিয়ে এলেন, যেন ওনারাই নান্দনিক সংস্কৃতির মালিক । এই জিনিস চালু করে গিয়েছিল ইংরেজরা, যে-কারণে আমাদের দেশের প্রান্তিক সমাজের সাহিত্য একেবারে মুছে গেছে, এমনকি সেসব বইপত্র-পুঁথি-পাঁচালি আর পাওয়া যায় না । প্রান্তিকদের কবিতাকেও আমল দিতেন না তিরিশ থেকে পঞ্চাশ দশকের কবিরা । আধুনিক শব্দ এসেছে ‘অধুনা’ থেকে, যার মানে সম্প্রতি বা আজকাল, অথচ সমসময়ের নিম্নবর্গের কবিদের তাঁরা পাত্তা দেননি।’আধুনিক’ অভিধার কালগত তাৎপর্য্য নেই, তা আসলে চিন্তাজগতে দার্শনিক রদবদল। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন,’পাঁজি মিলিয়ে মডার্নের সীমানা নির্ণয় করবে কে?এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের কথা।’(‘আধুনিক কাব্য’, সাহিত্যের পথে )। রবীন্দ্রনাথ চাননি যে তাঁকে আধুনিকতাবাদের বাইরে রাখা হোক। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের পর থেকে এবং ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব ফুরিয়ে যেতে থাকলে কবিতা পড়া, কবিতা শোনা কমে যাওয়া আরম্ভ হয় । আধুনিক সংস্কৃতির আবির্ভাবের কারণে পাঠক আর কবিতার মাঝে যে ফাটল দেখা দেয় তা সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে ।
.
চার
.
কবিতায় আধুনিকতার পুরোধা-প্রতিকৃৎ কবি হলেন শার্ল বোদলেয়ার। এই পথ আরও প্রশস্ত করেছেন জাঁ আর্তুর র্যাঁবো, স্তেফান মালার্মে, পল ভ্যালেরি, পল ভের্লেন, গটফ্রিড বেন, আঁদ্রে ব্রেঁত, স্যামুয়েল বেকেট, জাঁ জেনে, এজরা পাউন্ড, টি এস এলিয়ট, ইয়েটস প্রমুখ। এঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবের ফলে বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার চর্চা শুরু হয়েছিল তার রেশ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পাওয়া যায় না। বাংলা কবিতায় ইউরোপের আধুনিকতা এনেছেন বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অজিত দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে প্রমুখ । কবিতায় ইউরোপীয় আধুনিকতার পত্তন করা যে কঠিন তা বুদ্ধদেব বসু টের পেয়েছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালে ‘ রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক ’ প্রবন্ধ লিখেছিলন: ‘ আমাদের পরম সৌভাগ্যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেয়েছি, কিন্তু এই মহাকবিকে পাবার জন্য কিছু মূল্যও দিতে হয়েছে আমাদের– দিতে হচ্ছে। সে-মূল্য এই যে বাংলা ভাষায় লেখার কাজটি তিনি অনেক বেশি কঠিন ক’রে দিয়েছেন। একজনের বেশি রবীন্দ্রনাথ সম্ভব নয়; তাঁর পরে কবিতা লিখতে হ’লে এমন কাজ বেছে নিতে হবে যে-কাজ তিনি করেননি; তুলনায় তা ক্ষুদ্র হ’লে– ক্ষুদ্র হবারই সম্ভাবনা– তা-ই নিয়েই তৃপ্ত থাকা চাই।’ বোদলেয়ার বলেছেন আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি আলাদা আলাদা কিন্তু এর কেন্দ্রিয় জায়গাটা এক অর্থাৎ মন। ত্বকের যে অনুভূতি, কান দিয়ে যা শুনছি; তা যাচ্ছে মগজে, সেখান থেকে নির্দেশ আসছে। সামনে কারা আছে বা কাদের দেখছি তাও নির্দেশ দিচ্ছে মগজ। বোদলেয়ার বলছেন আমাদের প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের যে ইন্দ্রিয়বেদ্যতা তার উৎস এক।
.
আধুনিক কবিতার প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য আবু সায়ীদ আইয়ুব তাঁর ‘ আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ ’ বইতে উল্লেখ করেছিলেন। প্রথমত: ‘ কাব্যদেহের প্রতি একাগ্র মনোনিবেশ, যার পরিণাম কাব্যরচনায় ও সমালোচনায় দেহাত্মবাদ, ভাষাকে আধার বা প্রতীক জ্ঞান না ক’রে আপনারই দুর্ভেদ্য মহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত স্বয়ংসত্তা জ্ঞান করা। ’ দ্বিতীয়ত: ‘ জাগতিক অমঙ্গল বিষয়ে চেতনার অত্যাধিক্য।’ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছেন : “কোনোখানেই তিনি দুর্গম নন- অন্তত বাইরে থেকে দেখলে তা-ই মনে হয়; একবারও তিনি অভিধান পড়াতে ছোটান না আমাদের, চিন্তার চাপে ক্লান্ত করেন না, অর্থ খুঁজতে খাটিয়ে নেন না কখনো। আর তার বিষয়বস্তু- তাও বিরল নয়, দুষ্প্রাপ্য নয়, কোনো বিস্ময়কর বহুলতাও নেই তাতে; এই বাংলা দেশের প্রকৃতির মধ্যে চোখ মেলে, দু’চোখ ভ’রে যা তিনি দেখেছেন তা-ই তিনি লিখেছেন, আবহমান-ইতিহাস লুঠ করেননি, পারাপার করেননি বৈতরণী অলকানন্দা। এইজন্য তাঁর যেমন দুঃসাধ্য, তার প্রলোভনও তেমনি দুর্দমনীয়।”
.
তিরিশের আধুনিক কবিদের মধ্যে দুর্বোধ্যতার অভিযােগে সর্বাপেক্ষা বেশী অভিযুক্ত বিষ্ণু দে, (১৯০৯-১৯৮১)।টি এস এলিয়ট যেমন বিশ্বাস করতেন- "Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion",- বিষ্ণু দে-ও তেমনি কবিতায় কল্পনাবিলাস বা ভাববিলাসকে প্রশ্রয় দেন নি কখনও, মনন ও পাণ্ডিত্যের শিল্পিত প্রকাশ হিসাবেই তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতাকে। তাই সেই পাণ্ডিত্য ও মননের ভার তাঁর কবিতাকে করেছে সাধারণ পাঠকের কাছে দুরূহ এবং কবি হিসাবে বিষ্ণু দে হয়ে উঠেছেন আধুনিক কবিদের মধ্যে দুর্বোধ্যতম কবি। আর সত্যই, যথেষ্ট শিক্ষিত না হলে বিষ্ণু দে’র কবিতা অনুধাবন কঠিন ; কেবল কলেজে পড়াশুনা করলেই বিষ্ণু দে’র কবিতা স্পষ্ট হবে না । তাঁর কবিতা পড়ার সময় পাঠককে জানতে হবে ট্রয়লাস, ক্রেসিডা, ওফেলিয়া, হেলেন, কাসান্দ্রা, এলসিনাে ইত্যাদি এঁরা কে আর কেনই বা বিষ্ণু দের কবিতায় এলেন।
.
‘আধুনিকতাবাদ’ কেবল ওই সংকীর্ণ সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ নয় । আধুনিকতাবাদের সূচনাকাল হিসাবে বিভিন্ন বিষয়ের ইতিহাসকার আর লেখকরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কথা বলেন। যেমন, ইতিহাসবিদ উইলিয়াম এভারডেলের মতে আধুনিকতা ১৮৭০ এর দশকে শুরু হয়েছিল, যখন গণিতবিদ রিচার্ড ডেডেকিন্ডের (১৮৩১-১৯১৬) ‘ডেডেকিন্ড বিভাজন’ এবং লুডভিগ বোল্টজম্যানের (১৮৪৪-১৯০৬) ‘পরিসংখ্যানগত তাপগতিবিদ্যা রূপক (বা দার্শনিক) অবিচ্ছিন্নতা’ ভেঙে যেতে শুরু করে। ইভারডেল মনে করেন যে ১৮৮৫-৮৬ সালে সিউরাতের "লা গ্রান্ডে জট দ্বীপে একটি রবিবারের বিকেল" নামের ছবি আঁকায় "বিন্দু" ব্যবহারের সাথে সাথে চিত্রকলার আধুনিকতা শুরু হয়েছিল।আধুনিকতাবাদের আরেকজন অগ্রদূত হলেন ফ্রেডরিখ নিৎশে (১৮৪৪-১৯০০)। বলা যায় যে যারা কবিতা পড়তে চায় তারা এসব জেনে কীই বা করবে!
.
ফ্রান্সে স্থানীয়ভাবে সাহিত্যে বোদলেয়ার, চিত্রকলায় মনে আর কথাসাহিত্যে ফ্লবেয়ারের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকবাদ প্রবর্তিত হয়েছে বলা হয় । সঙ্গীত এবং স্থাপত্যে আধুনিকবাদের শুরু কিছুটা পরে হয়েছে । বাংলায় যাঁরা আধুনিক কবিতা লেখা আরম্ভ করলেন, তাঁদের কাছে আধুনিকতা ইউরোপ থেকে আনা একটি দার্শনিক আন্দোলন ছিল যা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা সমাজে সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক রূপান্তরের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রবণতায় নবায়ন এনেছিল। যেসব ব্যাপার আধুনিকতাবাদকে রূপ দিয়েছিল তার মধ্যে শিল্পভিত্তিক সমাজ গঠন, নগরের দ্রুত বিকাশ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। আধুনিকতাবাদ এনলাইটেনমেন্টের চিন্তাধারার অভ্রান্ততাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং অনেক আধুনিকবাদী চিন্তক ধর্মীয় বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করেছেন। রবীন্দ্রনাথের পরের কবিরা অনেকেই ঈশ্বর-বিশ্বাস থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিয়েছিলেন ; জীবনানন্দ দাশ থেকে বিনয় মজুমদার হয়ে হাল আমলের কাজল সেন পর্যন্ত বহু আধুনিক-উত্তরাধুনিক কবি-চিন্তক নিরীশ্বরবাদী । আধুনিকতাবাদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল আত্মসচেতনতা এবং সামাজিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্য নিয়ে বিদ্রুপ, যা আমরা সমর সেনের কবিতায় পাই।
.
সমর সেনের ‘উড়ো খই’ আর ‘বাবু বৃত্তান্ত’ আমি পড়েছিলুম। জানতুম উনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি রোমান্টিক কবি নই; আমি মার্কসিস্ট’। বাঙালি মার্কসবাদীরা জন্মরোমান্টিক; তাঁরা কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার-অভিনেতা, দারিদ্র্যের মাহাত্ম্যপূজক, বুদ্ধিজীবী হিসাবে অহংকারী, মানবতাবাদী, দুর্ভোগের জন্যে সবসময়ে তৈরি, আত্মবলিদানকে মনে করেন সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। ফলে সমর সেনের প্রজন্মের পর এক অদ্ভুত মার্কসবাদী বাঙালি প্রজন্মের তত্ত্ব পাওয়া গেল, যা এরকম : গরিব হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো, জবরদখল করা ভালো, একঘেয়ে করে দেয়া ভালো, গ্রামছাড়া করে দেয়া ভালো, খেতখামার পুড়িয়ে দেয়া ভালো, কমপিউটার না শেখা ভালো, ইত্যাদি ইত্যাদি।সমর সেন রবীন্দ্রনাথের লিরিকাল রোমান্টিসিজম থেকে বাঙলা কবিতাকে বের করে এনেছিলেন, সেই হিসাবে তিনি রোমান্টিক কবি নন, তবে তা বাঙলা কবিতায় আধুনিকতাবাদী রোমান্টিসিজমের একটি প্যারাডাইম শিফ্ট হলেও মার্কসবাদী হিসাবে রোমান্টিক মধ্যবিত্তের “বাবুকবিতা”। মার্কসবাদের জন্য কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেন, তখন তাঁর বয়স পঁচিশ। কম বয়সে কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়াকে বাঙালি আলোচকরা কিংবদন্তির অন্তর্গত করেছেন, যেমন র্যাঁবো । জায়গায় পড়েছি যে সমর সেন ছিলেন টি এস এলিয়টের আধুনিকতাবাদের পথচারী এবং অমন আধুনিকতার সঙ্গে মার্কসবাদের সংশ্লেষ বাংলা বিপ্লবী কবিতায় আনতে চেয়েছিলেন।
.
সমর সেনের কবিতা সম্পর্কে সরোজকুমার দত্ত লিখেছিলেন, “তাঁর কবিতা ‘ইনটেলেকচুয়াকল ক্লিকের’ জন্য লেখা, আমার-আপনার জন্য নহে। পাঠক সম্প্রদায়ের প্রতি এই সানুনাসিক অবহেলা আপনার কাব্যকে সর্বসাধারণের উপভোগ হইতে বাঁচাইয়া দুর্বোধ্য করিবার এই গলদঘর্ম প্রয়াসে ইহা আর যাহাই হউক, বিপ্লবী মনোভাবের পরিচায়ক নহে। মসীকৌলিন্যের অভিমানে শ্রীযুত সেন আজ আর্টের প্রচাররূপ ও কমিউনিকেটিভনেসকে পরোক্ষভাবে অস্বীকার করিতেছেন। রচনার আবেদনের পরিধি সংকীর্ণ হইতে সংকীর্ণতর হইয়া ক্রমে আত্মতৃপ্তিতে পরিণত হইতে বসিয়াছে। এই শম্বুকবৃত্তিকে কি বিপ্লবী প্রচেষ্টা বলিব? ইহা বিপ্লবের নামে ইণ্ডিভিজুয়াল অ্যানার্কির চরম অবস্হা মাত্র।”
.
পাঠক আর কবির মাঝের ফাটল বাড়তে লাগল ।পরের প্রজন্মের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর “ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো” কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন “আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠকের হাতে”। বেচারা পাঠক।’আধুনিক বাংলা কবিতায় দুর্বোধ্যতা’ প্রবন্ধে সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “ সুধীন্দ্রনাথের ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনার’ কাছাকাছি পৌঁছোতে হলে পাঠককে তৎসম শব্দ ভেদ করার মানসিক পরিশ্রম করতে হবে। বোধগম্যতার নিরিখে এগুলিকে কবির স্বার্থপরতা বলা ঠিক নয় বরং বলা উচিত আধুনিক পাঠকের মেধা ও মননের কাছে দাবি।” এরকম কবিতা পড়ার জন্য পাঠকের পড়াশুনা জরুরি আর সেই কারণেই পাঠক কবিতাকে এড়িয়ে যান । তাঁর কাছে তো প্রতি বছর শারদ সংখ্যা ভরে-ভরে কবিতা ছাড়াও পৌঁছোয় গল্প, উপন্যাস, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ।
.
পাঁচ
.
আবদুল হালীম খাঁ তাঁর ‘কবিতা ও আধুনিক কবিতা’ প্রবন্ধে বলেছেন, “দুঃখের বিষয় মানুষের যেমন শত্রু রয়েছে, বাংলা ভাষার কবিতারও কিছু শত্রু রয়েছে। তাঁরা বাংলা ভাষার কবিতার অগ্রগতি, উন্নতি ও মর্যাদাকে বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। কবিতাকে তাঁরা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, কবিতা যেন আর পাঠকরা না পাঠ করেন। তারা কবিতা নামে কষ্ট করে কষ্টা গদ্য লাইন ছোট বড় করে লিখছেন। আবার কেউ যা লিখছেন তা সম্পূর্ণ অবোধ ছন্দ সুরের বালাই নেই। বাংলা কবিতায় এমন সব আবর্জনা যারা জমিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের কেউ কেউ প্রশংসা করছেন।” আবদুল হালীম খাঁ’র মতন পাঠকদের আবির্ভাব আঁচ করে ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ‘কবিতার দুর্বোধ্যতা’ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু সমালোচকদের অভিযোগের উত্তরে লিখেছিলেন, ‘পাঠকের বোধগম্যের উপর কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে এমন কথা বোধহয় শোনা যায়নি। ... কবিতা সম্পর্কে ‘বোঝা’ কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনে, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের কিছু বোঝায় না, স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে, তা বোঝা যাবে না, বোঝান যাবে না।’
.
আধুনিক কবিতার শুরুতেই যখন দুর্বোধ্যতার অভিযোগ উঠেছিল, তখনকার পাঠক কি যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন না? বরং এখনকার তুলনায় তাঁরা শিক্ষিত ছিলেন। এখন শিক্ষকরা ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকছে ; আদালতে তারা নিজেদের আকাট বলে প্রমাণ করছে । তারা কবিতা পড়ে না, বাংলা ভাষাটাই জানে না । অথচ কবিতা-লেখকদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে । কেউ পড়ুক বা না পড়ুক, কবিরা নিজেদের সৃষ্টিতে মোহিত, সেই গুহাচিত্রের মানুষদের মতন । গুহাচিত্রের কালখণ্ড থেকে আমরা বহুদূরে চলে এসেছি । কবিতার আদল-আদরায় রদবদলের পাশাপাশি চিন্তার জগতেও বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে । অল্পসংখ্যক পাঠক ওই পরিবর্তনের সঙ্গে পরিচিত । কবিতা পাঠক যদি চিন্তার জগতের রদবদলের সঙ্গে পরিচিত না হন তাহলে এখনকার কবিতার সঙ্গে তার ‘সংযোগ’ ঘটবে না।
.
আধুনিকতাবাদের প্রাথমিক পর্যায়ে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্ব বেশ প্রভাবশালী ছিল। ফ্রয়েডের চিন্তাভাবনার মূল "মানসিক জীবনে অবচেতন সত্ত্বার প্রাধান্যের" ধারণা, যাতে সমস্ত ব্যক্তিক বাস্তবতা মৌলিক তাড়না এবং প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, যার মাধ্যমে মানুষ বাইরের বিশ্বকে অনুভব করে। ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ফরাসি পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।গোপাল হালদার তাঁর ‘আধুনিক সাহিত্য’ প্রবন্ধে বলেছেন, “কবি মাত্রেই যে বিষয়কে অবলম্বন করেন তার একটি হল বিষয়বস্তুর দিক, অপরটি প্রকাশ ও রূপায়ণের দিক। এই বিষয়বস্তু ও তার প্রকাশধর্মীতা এই দুয়ে মিলে সাহিত্যে একটি অখণ্ডতার প্রকাশ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ কবি কৰ্ম বা কবি নিমির্তির এক বিশেষ কৌশল এই দুয়ের সমন্বয় করতে পারে, কিন্তু বিশেষ বস্তু হিসেবে যা ঘটে থাকে তাকে অনুসরণ করাই সাহিত্যেকের ধর্ম নয়, অর্থাৎ বিষয় নির্বাচনে কবিকে তাঁর একটি সামগ্রিকতার দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়।” তিনি আরও বলেছেন, “প্রাচীন মধ্য যুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগের বিষয়গত, ভাবগত, এমনকি তার রূপায়ণগত পরিবর্তন হয়েছে আমূল। আধুনিক যুগ জীবনের নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে তার বিচিত্র প্রকাশ। তাই আজকের আধুনিক কাব্যের নানান বিভাগও সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ আধুনিক সাহিত্যের সহস্রমুখী জীবনকে প্রকাশ করার জন্য কত বিচিত্র পথের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। যেমন—বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ পর্যন্ত শুধু কাব্যেরই প্রকাশ, যেখানে দেব দেবীই ছিল মুখ্য অবলম্বন সেখানে মানুষ নিজের প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি। তারপর জীবনের ধারা পালটেছে, সাহিত্যের আঙ্গিক প্রকরণও বদলে গেছে। বিষয়বস্তু তো বটেই, পদ্যের স্থানে আসছে গদ্য এবং কাব্যের ক্ষেত্রে কত বিভাগ সৃষ্টি হয়েছে, কত নতুন ছন্দ, নতুন রীতি, কত সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অভিব্যক্তি আধুনিক সাহিত্যের প্রবন্ধে, সমালোচনায়, কাব্যে তা প্রকাশিত হয়েছে। যুগে যুগে সমালোচনার রূপ ও রীতির কতই না পরিবর্তন হয়েছে।”
.
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ২০শ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন আধুনিকতাবাদী আন্দোলন যা ২০শ শতাব্দীর শিল্প, সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের যে বৈশিষ্ট্য এটিকে বিশিষ্টতা দান করেছে সেটি হল রােমন্টিকতাবাদের বিরােধিতা করা। রােমান্টিকতাবাদের উৎপত্তি হয় নতুন আধুনিক শিল্পভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠার সাথে সাথে। এই দৃষ্টিমতে শিল্প ভিত্তিক সমাজের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে দূরত্ব রচিত হয়েছে এবং ঐতিহ্যের পতন ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে অবিশ্বাস, আনুগত্যহীনতা, প্রেম-ভালােবাসা, মায়া-মমতাহীনতার নতুন মূল্যবােধ জন্ম লাভ করছে। অপরপক্ষে পুরাতন ও ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন সেটিই হল রােমান্টিকতাবাদ। ১৯শ শতকের আন্দোলন হল রােমন্টিকতাবাদ এবং ২০শ শতাব্দীতে আধুনিকতাবাদ রােমান্টিকতাকে বর্জন করে এক নতুন আন্দোলন হিসেবে শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
.
ছয়
.
আধুনিকতাবাদের সমর্থনে ইয়ুর্গেন হাবেরমাস একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেটিতে তিনি ফরাসি চিন্তকদের বিরুদ্ধে অভিযােগ করেছিলেন। তার মধ্যে অবশ্যই বদরিয়া, জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার, মিশেল ফুকো এবং জ্যাক দেরিদা উল্লেখ্য। হাবারমাসের বক্তব্য হল আধুনিক কাল বিশেষ করে আলােকময়তার যে অবদান ঐতিহ্য, অন্ধবিশ্বাস এগুলাে পরিত্যাগ করতে পেরেছিল এবং ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা, সংকীর্ণ স্বার্থ হতে মুক্ত মানুষ যুক্তিবিদ্যা, যুক্তিশীলতা প্রয়ােগের মাধ্যমে সমাজের সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারবে এবং সমস্যা মুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে পারবে মনে করা হয়েছিল । তিনি বলেন যে আলােকময়তা বা এনলাইটেনমেন্টের কারণে আমরা নানাভাবে উপকৃত হয়েছি। নানা ধরনের যুদ্ধ, গণহত্যা ঘটে থাকলেও প্রগতির যাত্রা শেষ হয়ে যায়নি। হতে পারে আলােকময়তার যাত্রা অসম্পূর্ণ, তবে এটা নিশ্চিত যে আমরা উপকৃত হয়েছি। তিনি বলেন, মানুষ মাত্রই যুক্তিবাদী। সে নিপীড়িত হলে অবশ্যই নিপীড়ন মুক্ত হতে চায়। বিজ্ঞানের সাহায্যে, উচ্চতর চিন্তা-ভাবনার সাহায্যে মানুষ নিপীড়ন মুক্ত হতে চায়।
.
বাংলা ভাষায় তিরিশের দশক থেকে কবিতার যে আধুনিকতাবাদী বাঁকবদল ঘটে, সেই বাঁকবদলের পর থেকে, ফিকশান পাঠক আর সংবাদপত্র পাঠকরা মনে করেন, তাঁরা সমসাময়িক কবিতা বুঝতে পারেন না, তাই এড়িয়ে যাওয়াই ভালো । বুদ্ধদেব বসু এই ‘বুঝতে পারা’ ব্যাপারটাকেই হেয় প্রতিপন্ন করেছিলেন । এই অবস্হা দেখে, বাংলায় যাঁরা তারকা কবি, যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, জয় গোস্বামী, শ্রীজাত প্রমুখ, তাঁরা পাঠকদের জন্য ফিলগুড কবিতা লিখেছেন ; কলকাতার বিজলি-থামে সর্ষের তেল বিক্রির পোস্টারে হাসিমুখে দেখা গেছে সুনীলকে, যেমন এককালে রবীন্দ্রনাথ গোদরেজ সাবানের বিজ্ঞাপনে ছিলেন । বস্তুত কবিতার পাঠক এখন কেবল কবিরাই, যাঁরা মনে করেন যথেস্ট শিক্ষিত না হলে আধুনিক কবিতার আবেদন কিংবা অনুধাবন কম হয় । ‘কবিতা লেখা’, ‘কবিতা পড়া' গ্রন্থে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, “যে মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চায় তারই সঙ্গে থাকে তার বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা, তীব্রতা, বিক্ষোভ আর বিদ্রোহ। এই সামগ্রিকতার ছবি থেকে আমরা মনে রাখতে পারি যে, সমস্ত রকম খাঁচা ভেঙে কবি যখন তাঁর নিজস্ব সত্য অস্তিত্বের প্রকাশ করে যান তাঁর নিজেরই ভাষায়, যার মধ্যে ধরা পড়ে গোটা জগৎজীবন, তখন সেটা তৈরি করে তোলে আরেকটা, আরও একটা নতুন কোনো আদল।” এই নতুন আদলের কবিতাকে ফিকশান-পাঠক আর সংবাদপত্র-পাঠকরা এড়িয়ে চলেন । বাংলাদেশের আলোচক টোকন ঠাকুর তাঁর প্রবন্ধ ‘কবিতার পাঠক কি কমে যাচ্ছে’তে বলেছেন, “কবিতা কবির লিখে যাওয়া কয়েকটি বাক্যের বেশি কিছু, সে কথা অবশ্য খুব বেশি লোক জানেন বলে মনে হয় না। তাই কবিতাপাঠ থেকে রস নিতে পারার ক্ষমতা পাঠকের থাকতেই হবে। যাঁর নেই, তিনি আর যা–ই হোন, কবিতা-পাঠক হবেন না।” যে-ভাষা খবরের কাগজে নিত্যদিন ব্যবহৃত হয়, সাহিতা-বিশ্লেষণেও অনেকে সেই একই ভাষা প্রত্যাশা করেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যদিও মোক্ষম কথা লিখে গেছেন -“যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্যে কবিকে দোষারোপ করা অন্যায় - তবু কোনো ইতরবিশেষ হয়নি।”
.
‘কবির সঙ্গে বসবাস’-এ জয় গোস্বামী লিখেছেন, “যাঁরা ছন্দ না জেনেই কবিতা লিখে চলেছেন, তাঁদের কবিতা হয়তো ভালো হচ্ছে, মুদ্রণযোগ্যতাও পাচ্ছে বিভিন্ন কবিতা-পত্রিকায়– কিন্তু বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাসে চার ভাগের তিনভাগ কবিতাই যে কোনও না কোনও ছন্দকে আশ্রয় করে লেখা! তাহলে, যাঁরা ছন্দকে কবিতায় ব্যবহারযোগ্য মনে করছেন না, কিন্তু কবিতাকে মুদ্রণযোগ্য অবস্থায় উন্নীত করে কবিতা ও কাব্যগ্রন্থ ছাপিয়ে চলেছেন, তাঁদেরও ব্যক্তিগত কবি পরিচিতি ভালোভাবেই ঘটছে সমাজে। তবে ছন্দ-বিজ্ঞান না-জানার কারণে, তাঁরা নিজেরা যে বঞ্চিত হচ্ছেন কত কত অসামান্য ছন্দ-সৌন্দর্যের উপভোগ থেকে, সেকথা কি একবার তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন না? আমি লিখব, লেখা ছাপাব, কিন্তু পাঠক হিসেবে নিজেকে সুশিক্ষিত করে তুলব না? কী জানি, যে যুগের যা যুগলক্ষণ, তাকে তো আমাদের মতো বৃদ্ধদের মুখ বুজে স্বীকার করে নিতেই হবে!” একথাটা ঠিক যে কবিতায় ছন্দ থাকলে সেই কবিতা না ‘বুঝলেও’ চলে,কেননা পুজোয় যেমন ধুনুচি নাচ সবায়ের মগজে একরকম আহ্লাদ যোগায়, তেমনই কবিতার ছন্দ।
.
সাত
.
বাঙলা সাহিত্যের আধুনিকতা একটা পথ ধরে এগোচ্ছিল কিন্তু তার ওপর বাজ পড়লো দেশভাগের। ছিতরে গেল আধুনিকতা । ইউরোপের মতন আমরা কোনও দার্শনিক পেলুম না । শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত প্রমুখকে দার্শনিকের মান্যতা দিয়েও কথাটা বলতে হলো । কবিতার এলাকাকে বজ্রবিদ্যুত এমন ফালাফালা করে দিয়ে গেল যে চল্লিশের দশকে বেশির ভাগ কবি মার্কসবাদে আকৃষ্ট হয়ে সরাসরি মনের কথা লাইনে লাইনে সাজাতে লাগলেন । চল্লিশের দশকের সূচনাবিন্দু থেকেই বাংলা কবিতায় সমাজসচেতন রাজনৈতিক মনোভঙ্গিই হয়ে ওঠে কাব্যভাবনার নিউক্লিয়াস। সুকান্ত ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, দিনেশ দাস, , বিমল ঘোষ, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ । বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন। যদিও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন তাঁর অবস্থান- ‘আমার কবিতা কোনোদিনই চল্লিশের প্রগতিশীল কবিতা বা কবিদের কাছ থেকে অন্ন বা জল আহরণ করেনি। বরং আমি নিজের কবিতাকে যতটা বুঝি, আমার কবিতার শিকড় অন্যখানে। সেখানে আজও যাঁরা জলসিঞ্চন করছেন তাঁরা সবাই দলছুট একক কবি – যেমন জীবনানন্দ, তারপর নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ।’ (নান্দীমুখ : ১৯৮০)। তিনি আরোও বলেছেন ‘চল্লিশের ‘প্রগতি সাহিত্য’ প্রথম থেকেই আমার কাছে খণ্ডিত এবং যান্ত্রিক বলে মনে হয়েছে। বাংলা কবিতায় শ্রেণীসচেতনতার কথা প্রবহমান চিরসত্য। আবহমান কাল ধরেই সমাজ ও রাজনীতি জড়িয়ে আছে কবিতার শরীরে। গোবিন্দচন্দ্র দাস, মুকুন্দ দাস, সত্যেন্দ্রনাথ, নজরুল, বিজয়লাল সেই কবে থেকে আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে বিপ্লবের বীজ।’ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথ্যরীতিতে রচিত কবিতা সহজবোধ্যতার কারণে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর আনুকূল্য লাভ করেছিল। মানবিক বোধ আর রাজনৈতিক বার্তা ছিল তাঁর কবিতার প্রধান অভিমুখ। তাঁর কবিতা পড়ার জন্য পাঠকের শিক্ষিত হবার দরকার হয়নি । পরবর্তী কালখণ্ডের কবিরা কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চান না । ব্যাপারটা অদ্ভুত কেননা যাঁর কবিতা সহজবোধ্য তিনি প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্যের পরও পাঠকদের থেকে দুরে চলে গেছেন।
.
পাঠক কবিতা পড়েন এবং কবিরা লেখেন কারণ আমরা মানব জাতির সদস্য। আর মানব জাতি আবেগে ভরা। এবং চিকিৎসা, আইন, ব্যবসা, প্রকৌশল, এগুলি মহৎ সাধনা এবং জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু কবিতা, সৌন্দর্য, রোমান্স, প্রেম, এগুলোর জন্যই আমরা বেঁচে থাকি। দুর্ভাগ্যবশত, "মূলধারার" সবকিছুই কালক্রমে বিরক্তি উদ্রেককারী আর ওভাররেটেড ; কবিতার বাণিজ্যিক পাতা প্রবণতা হয়ে ওঠে আর জায়গা পাবার জন্য নকলনবিশী আরম্ভ হয় ।
.
আধুনিকতাবাদ একটা তত্ব ।তপোধীর ভট্টাচার্য তাঁর ‘সময়ের প্রত্নতত্ব’ বইতে বলেছেন, “মূল প্রশ্নটা হলো : তত্ব কী এবং তত্তের কেন প্রয়োজন ? এই প্রসঙ্গ ইতিমধো বেশ কয়েকবার আলোচিত হয়েছে। তবু আরো একবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। “তত্ব - এর আভিধানিক অর্থ হলো স্বরূপ বা যাথার্থ্য। অন্যভাবে বলা যায়, বস্তম্বরূপই তত্ব। কোনো ঘটনা-বিন্যাস বা ভাব-বিন্যাসের সারাৎসার যখন অনুসন্ধান করি এবং সেই অনুসন্ধানের বার্তা বা প্রতিবেদন তৈরি করি, তখনই তত্বকথা জন্ম নেয়। তার মানে, তত্ব হলো বিশেষ দৃষ্টি এবং দার্শনিকেরই অন্য নাম তাত্তিক।….প্রতীচ্যের আধুনিকতা বিষয়ক আকল্প ওঁপনিবেশিক ভারতবর্ষে, বিশেষ ভাবে বাঙালির ভাববিশ্বে অনেকখানি পুনর্বিনাস্ত হয়েছিল। বিলম্বিত পুঁজিবাদের পর্যায়ে আধুনিকোত্তরবাদের সূচনা হলো যখন, বাঙালির চেতনায় তার অভিঘাত বহুধা বিচ্ছুরিত হলো।নয়া পনিবেশিক পরিস্থিতির মধ্যেও এত দ্রুত পটপরিবর্তন হয়ে চলেছে যে গত দুই দশকে উত্তরাধুনিকতা ও আধুনিকোত্তরবাদী চিন্তার সহাবস্থান আমরা লক্ষ করেছি। এই বিতর্ক এখনও অমীমাংসিত । প্রবল অনিশ্চয়তা ও কেন্দ্র-বিচ্যুতির আবহে এমন ধরনের আশ্চর্য নতুন সাহিত্যিক পাঠকৃতি রচিত হয়ে চলেছে যে এদের বিশ্লেষণ করতে গেলে পুরোনো পাঠাভ্যাস সংহিতায় আর কুলোচ্ছে না। প্রাসঙ্গিক তত্তের উপযুক্ত সমর্থন ছাড়া এখন কোনো ধরনের প্রতীতি অসম্ভব।”
.
আট
.
বহু পাঠক কবিতায় উত্তরাধুনিকতার প্রভাবকে জটিলতার আর পাঠকের সঙ্গে দূরত্ব গড়ে ওঠার কারণ বলে মনে করেন । যদিও আধুনিকতাবাদের সাথে উত্তর-আধুনিকতাবাদ পদটি সম্পর্কিত। এরা দুটো ক্রমান্বয়িক পর্ব হলেও শব্দ দুটির মধ্যে বিপরীতধর্মিতার চেয়ে ধারাবাহিকতা অনেক বেশি। ষাট আর সত্তর দশকের কবিদের রচনায় উত্তরাধুনিক বৈশিষ্ট্য প্রথম দেখা দেয় । আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর আধুনিকতাবাদ পদ দুটিই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে বােঝায়। দুটি পদই ২০শ শতকে শিল্প, সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে খণ্ডিতকরণকে দেখে, কিন্তু এই দেখার মেজাজ ভিন্ন। আধুনিকতাবাদী আন্দোলনে উঁচু-নিচু সংস্কৃতির বিভাজন স্পষ্ট ছিল । বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় নিম্নবর্ণের কবিদের রচনা প্রায় নেই। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকাতেও প্রথম পর্বে নিম্নবর্ণের কবিদের রচনা পাওয়া যায় না ।কিন্তু উত্তরাধুনিকতাবাদী আন্দোলনে উঁঁচু-নিচু সংস্কৃতির বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করে, এটি রকমারি মিশ্রণ, যুক্তিভাঙন ইত্যাদিকে সমর্থন করে।ভাষাতাত্বিক প্রবাল দাশগুপ্ত তাই উত্তরাধুনিকতাকে বলেছেন ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’ বা ‘অধুনান্তিক’ ।
.
প্রবাল দাশগুপ্ত অধুনান্তিককে বলেছেন “সাজানো বাগানের পরের স্টপ” । আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন এই কথাগুলোতে, “কিছু কাল আগে ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’ বলে একটা প্রসঙ্গ ফেঁদেছিলাম। সেই সূত্রে ভেবে বলো তো, তুমি যখন আধুনিক বিজ্ঞানের দূরবীক্ষণ আর অণুবীক্ষণ দিয়ে দূরের মহতো মহীয়ান্ আর কাছের অণোর্ অণীয়ান্ জিনিসপত্রকে যথাক্রমে কাছে টেনে আনো এবং বাড়িয়ে মাঝারি আয়তনে নিয়ে আসো যাতে তোমার নজরে তাকে ধরতে পারো, তখন তুমি আদতে কী করছ? আমি বলে দিই? জিনিসটাকে তুমি তোমার বাগে আনছ, যাতে তোমার পছন্দমতো ম্যাগনিফিকেশনে দেখতে পাও। বাগ, ইয়ানী বগীচা, ওই বাগান আর কী। তোমার সাজানো বাগানে নিয়ে আসতে পারলে তবে তুমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলো, এইবার ধরতে পেরেছি। নীটশে যখন পাগল হয়ে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময় দিয়ে, যতদূর মনে পড়ছে ১৮৮৯ সালে, একজন প্রখ্যাত নীটশেবিদ পণ্ডিতকে চিঠি লিখে বলেন, “আমাকে তুমি ধরতে পেরেছ ভালো করেই জানি। খুব ভালো ধরেছ। এবার আমায় ছাড়তে পারবে কি? ছেড়ে দেখাও তো?” অধুনান্তিক শেখাটা ওই ছাড়তে শেখার দস্তুর। বাগে আনা কথাটার ব্যুৎপত্তি যাঁরা জানেন তাঁরা ভুল ধরিয়ে দেবেন, সেই অপেক্ষায় আছি, পাঠক তুমি তখন ধরতে পারবে আসল উত্তরটা কী হবার কথা, আমি আগাম বলে রাখছি, তার পর ভুলে যেও না উত্তরটা ধরতে পারার পর ছাড়তে পারাও চাই, নইলে তোমার সঙ্গে আকাশের সংযুক্তি ছিঁড়ে যাবে, পড়ে থাকবে খালি আধুনিকবাদের যুক্তি, দেখবে যে মাটির সঙ্গে একেবারেই আকাশের কোনো যোগ নেই তাকে আর মাটি বলে চিনতেই পারছ না, মনে হচ্ছে ছাই। চারিদিকে অসত্য কথন, মিথ্যাচার, ক্ষমতার রহস্যাবৃত কথাস্রোত সচেতন মানুষকে দগ্ধ করে। এক আস্তিক বিপন্নতা দেখা দেয়। লেখার মাধ্যমে সে তার কথন বিশ্বকে ব্যাপ্তি দেয়। পুনর্নির্মাণ করে তার সত্যদ্রষ্টা সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ। ধারণাময় এই ধরিত্রীর মাইক্রোস্তরে যতই প্রবেশ করা যায়, দেখা যায়, বহু সংকেত এমনই যে, বাস্তব জগতে বা প্রাত্যহিক কাজেকর্মে তা তেমন কাজে লাগে না। তবু তা প্রয়োজনীয় নয়, একথাও বলা যাবে না। অস্বীকার করা যাবে না, ব্যক্তি মনের সৃজন জগতের মুক্তির একটি পরিসর নির্মাণে তার ভূমিকার কথা।”
.
জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার্ ‘দ্যা পােস্ট মর্ডান কন্ডিশন এ রিপাের্ট অন নলেজ’ নামক একটি বই লেখেন। লিওতার্, ইয়ুর্গেন হাবারমাসের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলেন যে, আলােকময়তা বা এনলাইটেনমেন্ট কিছু মহাবয়ান বা মহাসন্দর্ভ বা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। এই বয়ানগুলাে প্রচণ্ড শক্তিশালী। এই আন্দোলনে যুক্তিবাদী ধারণাগুলাে যেমন, প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী ইত্যাদি ধারণাগুলাে শক্তিমত্তা অর্জন করে। তিনি বলেন যে, এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভগুলাে দাবি করে যে সমগ্র বিশ্বে যা কিছু ঘটছে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সবকিছুর ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে, মূলত পারে না। লিওতারের বক্তব্য হল, বাস্তব আরাে জটিল আরাে বহুবিধ এবং সত্যও বহুবিধ। তিনি বলেন কোনাে বিশেষ সংঘাতের ক্ষেত্রে নানাবিধ যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে তা সামনে নিয়ে আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লিওতারের কথা হল, বিভিন্ন অবস্থান হতে সত্যাকে বুঝতে হবে, একটি বিষয়ে সত্য পরবর্তীতে সেটি সত্য নাও হতে পারে। লিওতারের দৃষ্টিতে পুঁজিবাদ বিবিধতা মুছে ফেলে, এটি সমরূপতা ও অখণ্ডতা তৈরির চেষ্টা চালায়। লিওতার বারবার মেটা-ন্যারেটিভ বা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহাবয়ানের ওপর গুরুত্বারােপ করেন। তিনি এটির প্রতি সন্দিহান। তিনি বলেছেন, এই মহাবয়ানসমূহ তাদের বিশ্বাসযােগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। উত্তর আধুনিকতাবাদীর দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এই বিশ্বাসহীনতা এবং বিবিধতার ওপর গুরুত্বারােপ। সত্য বহুবিধ এবং সত্য উপলব্ধিতে অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সত্য বহুবিধ হলে কবিতার সত্যও বহুবিধ হবে ।
.
জাঁ ফ্রাঁসোয়া বদরিয়ার বলেছেন যে, আধুনিকতাবাদে বাস্তব এবং অবাস্তবের বিভাজন রেখা স্পষ্ট ছিল। এই দুটির মধ্যে পার্থক্য দাঁড় করানাের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অত্যন্ত ক্রিয়াশীল। যেমন, ভূত দেখা, এটি বিজ্ঞান সম্মত নয় বিধায় এটা বাস্তব নয়। বদরিয়ার বক্তব্য হচ্ছে যে, বর্তমানের সমাজ জীবনে সিনেমা, টিভি, বিজ্ঞাপনের ইমেজসমূহের সর্বব্যাপী প্রভাবের কারণে বাস্তব এবং অবাস্তব, সত্যি আর কল্পিত, আসল আর নকল, উপরিতল আর গভীরতা, এসবের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে গেছে। এর ফলে আমরা একটি হাইপার রিয়েল সংস্কৃতি পাই। যেখানে দুইয়ের ভিন্নতা ক্ষয়ে গেছে। যেমন, আমরা প্লাস্টিক সার্জারির কথা বলতে পারি। প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে আমরা আমাদের জন্মসূত্রে পাওয়া রূপের পরিবর্তন করে সৌম্যকান্তি বা সুন্দরী হয়ে আরেকজন হয়ে যেতে পারি। যেমন নাকটা পছন্দ হচ্ছে না, তা প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে ঠিক করে নিতে পারি। এই প্রেক্ষিতে বদরিয়া বলেন যে বাস্তব এবং পরিবেশন এই দুয়ের মধ্যে যে সুস্পষ্ট বিভাজন ছিল সেটি উত্তর-আধুনিকতার ফলে সংস্কৃতিতে, বিজ্ঞাপন, সিনেমা এসবের প্রভাবে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। অধ্যাপক ইহাব হাসান একটি বিকল্প জ্ঞানভাষ্য এবং সমালােচনার মাধ্যম হিসেবে উত্তরাধুনিকতাকে মানতে চান। তিনি যে উত্তরাধুনিকতাবাদের কথা বলতে চান তাতে উইলিয়াম ব্লেক, ডি সাদ; একটা সময়ের পাউন্ড, জয়েস, দাদা, স্যুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ, নব্য ফরাসি উপন্যাসের ধারা, জেনে, বিট আন্দোলন, জনপ্রিয় সাহিত্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে চান।
.
অধুনান্তিক পত্রিকা “হাওয়া৪৯”-এর সম্পাদক সমীর রায়চৌধুরী আধুনিক কবিতা আর অধুনান্তিক কবিতার বৈশিষ্ট্য এইভাবে চিহ্ণিত করেছেন : -
.
আধুনিক কবিতা : যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মতো যুক্তি ধাপেধাপে এগোয়, কবিতায় আদি-মধ্য-অন্ত এই ভাবগুলো বজায় থাকে, একরৈখিক, ক্রমঅগ্রসর, কেন্দ্রাভিগ, যুক্তির দিকে কবিতার অভিমুখ, আঁটোসাঁটো, স্বয়ংসম্পূর্ণ, বদ্ধসূচনা, বদ্ধ আঙ্গিক, বদ্ধ সমাপ্তি, ডিসটোপিয়া, সুনিশ্চিত মানে, পরিমেয়তা ও মিতকথনের প্রতি গুরুত্ব, কবির ঠিক করে দেয়া মানে, স্হাবর, তলে-তলে মানে, বাইরে মুখোশ, ‘আমি’ পাঠবস্তুর কেন্দ্রে, ‘আমি’র নির্মাণ, একক ‘আমি’, পূর্ব নির্ধারিত মানদন্ড, ক্যানন দাঁড় করানো, সীমা স্পষ্ট, আত্মপ্রসঙ্গই মূল পপসঙ্গ, শুদ্ধতা, ‘আমি’র পেডিগ্রি বা কুলজি, একক মালিকানা, স্পষ্ট মালিকানা, গোপন গভীরে শিকড়, কবিই টাইটেল হোলডার, লিনিয়ার, লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত, একক গলার জোর, একমুখী প্রগতি, ধ্বনি মেলান কবি, কবি একজন বিশেষজ্ঞ, শ্রেষ্ঠত্ব, শ্রেষ্ঠ কবিতা, চার্ট টপার কবি, একজনকে তুলে ধরা, হিরো কবি, গুরু কবি, এক সময়ে একজনই বড়ো, ব্র্যাণ্ড নেম কবি, আইকন, কথার খেলাপ, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, শব্দার্থকে সীমাবদ্ধ রাখা, কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন, বাদ দেবার প্রবণতা, এলিমিনেশন, একটিমাত্র মতাদর্শ, ইজম, হাইকমাণ্ড, পলিটব্যুরো, নিটোলো কবিতা, শক্তিমত্তার পরিচয়, কবিতার নির্দিষ্ট মডেল যেমন সনেট ওড ব্যালাড ইত্যাদি, কবিকে প্রকৃতির বাইরে সংসাস্কৃতিক জীব মনে করা, প্রতীকের প্রাধান্য, প্রতীকের চমৎকারিত্ব, ঘুরিয়ে বলা, স্হিতাবস্হার কদর, নাক উঁচু সংস্কৃতি, প্রান্তিককে অশোভন মনে করা, শ্লীল ও অশ্লীল ভেদাভেদ, ব্যবধান তৈরি করা, ভালো কবিতা-খারাপ কবিতার বাইনারি বৈপরীত্য, উতরে যাওয়া কবিতা, খণ্ডবাদী, রিডাকশানিজম, অবচ্ছিন্নবোধ, কেন্দ্রিকতায় উদ্ভূত, কবিতার শিরোনামের গুরুত্ব, প্রতিভা, মাস্টারপিস, ক্ষমতার মসনদ গঠন, মৌলিকতার হামবড়াই, একটিমাত্র বার্তার বাহক, কবিতার লক্ষ্য অব্যর্থ, কবির ব্যক্তিসত্তার বিবেচন, আধিপত্যের প্রতিষ্ধঠা, বৃক্ষশাখার মতন ইনটারলিংকড।
.
উত্তরাধুনিক কবিতা : যুক্তিবিপন্ন, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোবার প্রবণতা, আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু হওয়া আর শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না দেওয়া, ছেতরানো, ক্রমান্বয়হীন, আবেগ-যুক্তির দ্বৈরাজ্য, কেন্দ্রাভিগ, এলোমেলো দেখায়, দ্বৈরাজ্যের দিকে কবিতার অভিমুখ, মুক্ত সূচনা, মুক্ত আঙ্গিক, মুক্ত সমাপ্তি, হেটেরোটোপিয়া, মানের নিশ্চয়তা এড়িয়ে যাওয়া, অফুরন্ত মানে, যা ইচ্ছা তা মনে করে নিতে পারেন পাঠক, মানের ধারণার প্রসার, প্রচলিত মত অস্বীকার, যা আছে তা লোনোর দরকার নেই, স্বচ্ছতা, ভিতর-বাহির আলাদা নয়, একক ‘আমি’র অনুপস্হিতি, ‘আমি’র বন্ধুত্ব, ক্যানন থেকে বেরিয়ে যাওয়া, সীমা আবছা, সীমায় ভাঙন, মিশ্রতা, লিমিনালিটি, সংকরায়ন, সংকরত্ব, মালিকানার রুবরিক, মালিকানার বহুত্ব, মালিকানা বিপন্ন, মালিকানা বিসর্জন, পাঠকই টাইটেল হোলডার, শেকড় ছড়িয়ে পড়া, রাইজোম্যাটিক, প্লুরালিজম, বিদিশাগ্রস্ত বহুস্বরের আশ্রয়, দিগ্বিদিকে গতিময়, অ্যাক্টিভিস্ট, জগৎ আয়োজনের মেলবন্ধন উসকে দেন, কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য, বিবেচন-প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা সরিয়ে দেয়া, পাঠকৃতি বিচার্য - কবি নয়, সার্বিক চিন্তা-চেতনা, কথা চালিয়ে যাওয়া, কথার শেষ নেই, শব্দার্থের ঝুঁকি, আত্মমনস্কতা থেকে কবিতার মুক্তি, জোটবাঁধা, যোগসূত্র খোঁজা, শব্দজোট, মর্মার্থজোট, বহুমতাদর্শের পরিসর, বাক্যজোট, প্রতিনিয়ত রদবদল, ক্রমাগত পরিবর্তণ, ভঙ্গুরতার স্বীকৃতি, জীবন থেকে উঠে আসা ধারণা, বহুরঙা, অপরিমেয় নাগাল, নির্দিষ্টতার বাইরে, প্রতীকবর্জন, সরাসরি বলা,পরিবর্তনের তল্লাশি, প্রযুক্তির স্বীকৃতি, সাংস্কৃতিক বিভাজন বিলোপ, অভেদের সন্ধান, একলেকটিক, বাস্তব-অতিবাস্তব-অধিবাস্তবের ব্যবধান বিলোপ, যেমন ইচ্ছা হয়ে ওঠা কবিতা, বহুপ্রকার প্রবণতা গ্রাহ্য, কবি পরোয়াহীন, কমপ্লেকসিটি, জটিলতা, অনবিচ্ছিন্নতার দিকে, প্রান্তিকতায় উদ্ভূত, মাইক্রোন্যারেটিভ, সাময়িক প্রত্যয়, তত্বের বৈভিন্ন্য অনুশীলন, কবিতা ফ্লাক্স থেকে উপজাত, কাইনেটিক, কেন্দ্রিয় বিষয়ের অনুপস্হিতি, কবিতার শিরোনাম গুরুত্বহীন, প্রান্তিক শব্দ, আঞ্চলিক শব্দ, পথচলতি অভিব্যক্তি, একসঙ্গে বহু কন্ঠস্বর, বার্তার বহুলতা ও বার্তা বর্জন, আধিপত্যের বিরোধিতা, ছবি ও লাইন ঘাসের মতন ইনটারলকড, সংজ্ঞার সীমা ছাপিয়ে যাওয়া ।
.
নয়
.
আমরা পেয়েছি শিবনারায়ণ রায়কে, যিনি বলেছিলেন, “ভাবতে হবে, চিন্তা করতে হবে, সেইসঙ্গে পড়াশোনাও করতে হবে প্রচুর। তাহলেই সবটা মিলিয়ে নতুন নতুন পথ হাজির হবে আমাদের সামনে”। তবুও শিক্ষা ও সুযোগের অভাবে বাংলা সাহিত্যে সুররিয়ালিজমের প্রভাব যথাকালে আসেনি। অথচ এ তো ভারতবর্ষেরই। সুররিয়ালিজমের মূল খুঁজতে অনেক চলে গেছেন প্রাচীন গ্রিসে যেখানে ডেফির দেবতা সক্রেটিসকে বলেছিলেন, নিজেকে জানো। কিন্তু তারও বহু আগে আমরা শুনেছিলাম আত্মানং বিদ্ধি। ধ্যানের সাহায্যে অপরলোকে উত্থান, শরীর ছাড়িয়ে গিয়ে দৈববাণী শ্রবণ, বেদ যে কারণে অপৌরুষেয়, অ্যালকেমির সমান্তরাল তান্ত্রিক উপাসনা ইত্যাদি। কিন্তু সাহিত্যে আমরা এগুলো ভুলে গেছি অনেকদিন, সম্ভবত ইংরেজদের প্রভাবে। সারা পৃথিবীর সচেতন লেখকদের মধ্যে এমন বোধহয় একজনও নেই— যিনি সুররিয়ালিজমকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পেরেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পরাবাস্তবতার অসাধারণ প্রয়োগ দেখতে পাই। যাঁরা জীবনানন্দের কবিতা বুঝতে পারতেন না তাঁদের পরাবাস্তব আন্দোলনের কথা জানা ছিল না।
.
আধুনিক কবিতার পরের কালকন্ডে যে ধরণের কবিতা আর গল্প লেখা আরম্ভ হলো সেগুলোকেই উত্তরাধুনিক বলা যায়। একটি কবিতা উত্তরাধুনিক ফর্মে হতে হলে যেসব মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে হয়—তা নিয়ে হয়তো তর্ক আছে। এক পক্ষ বলেন অঙ্কের হিসাব কষে বা বৈজ্ঞানিক উপাত্ত ধরে নির্ধারিত ছকে একজন কবি কবিতা আর গল্প-উপন্যাস লেখেন না। ঠিক বিপরীত কথা বলছেন কেউ কেউ। তথাকথিত ছক থেকে কবিতাকে মুক্ত করে সাবলিলভাবে বেড়ে উঠতে দেয়াই উত্তরাধুনিকতা। এতে অন্যের প্রভাব চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা থাকে না। এতে শেকড়ের টান ও নিজস্বতার প্রভাবকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
.
উত্তরাধুনিকতা হলো একটি আভাঁগার্দ বহুরৈখিক পথ । আভাঁগার্দ মানে ‘অ্যাডভান্স গার্ড’ বা ‘ভ্যানগার্ড’, আক্ষরিক অর্থে ‘ফোর-গার্ড’, ভাবকল্পটি এমন একজন ব্যক্তি বা কাজ যা শিল্প, সংস্কৃতি বা সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় যা পরীক্ষামূলক, নতুন বা অপ্রথাগত। কাজগুলো প্রথমদিকে নান্দনিক উদ্ভাবন এবং প্রাথমিক অগ্রহণযোগ্যতা দ্বারা চিহ্নিত করা হতো । আভাঁগার্দ শব্দটা, মূলত ফরাসি সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত একটি শব্দ ছিল । এই সামরিক রূপকটি সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ আরম্ভ হলো, বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক, প্রথানুগত লেখালিখি থেকে পার্থক্য চিহ্ণিত করার জন্য । শব্দটি সেনাবাহিনীর সামনের জওয়ানদের নির্দেশ করে, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রথমে শত্রুদের মুখোমুখি হয় এবং যারা পরে আসে তাদের জন্য পথ প্রশস্ত করে । অর্থাৎ আভাঁগার্দ বলতে বোঝায়, সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে, যাঁরা সমসাময়িক কালখণ্ড থেকে এগিয়ে । বলা বাহুল্য যে তাঁরা আক্রান্ত হবেন এবং তার জন্য তাঁরা নিজেদের সেইমতো প্রস্তুত করেন, এরকম মনে করা হয় । তবে বিবর্তনমূলক অর্থে নয়। কারণ এটি বুর্জোয়া সমাজে সাহিত্য-শিল্পের মূল নীতি সম্পর্কে আমূল প্রশ্ন তোলে, যে বক্তব্যটি হলো এই যে, ব্যক্তি-একক বিশেষ সাহিত্য-শিল্পের কাজের স্রষ্টা বা ব্র্যাণ্ড, পুঁজিবাদী কাঠামোয় বিক্রয়যোগ্য । আভাঁগার্দ ভাবকল্পটি সর্বদা প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে যাঁরা বুর্জোয়া এস্টাব্লিশমেন্টের স্থিতাবস্থাকে চুরমার করে যারা এগিয়ে যাবার কথা বলেন । কবি বা শিল্পী কী বলিতেছেন নয়, কবিতা বা শিল্পটি কী করিতেছে, এটাই হলো আভাঁগার্দের নবায়ন ।
.
আভাঁগার্দ কবিতা তার আগেকার অন্যান্য কবিদের কাব্যাদর্শ প্রত্যাখ্যান করে এগোয় এবং পরিবর্তে নতুন এবং উত্তেজনাপূর্ণ বাকপথের সন্ধান করে । অর্থাৎ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্পের মনোবিজ্ঞান এবং আদর্শে, ঐতিহাসিকভাবে বিবেচনা করা হয় যে ( হেগেলীয় এবং মার্কসবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি যাকে ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতা বলবেন), ভবিষ্যতবাদী প্রকাশের প্রতিনিধিত্ব করেL তাই বলতে গেলে, একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক এবং ইউটোপিয়ান পর্যায়, আভাঁগার্দের বিচরণক্ষেত্র। ব্যাপারটাকে অনেকে মনে করেন, আভাঁগার্দ নিজেই বিপ্লব না হলেও তা ঘোষণা এবং বিপ্লবের জন্য একটি প্রস্তুতি। একইভাবে ছবি আঁকা আর ভাস্কর্যের নবায়ন করে আভাঁগার্দ । উদ্ভাবন ব্যাপারটা আভাঁগার্দ কাজের কেন্দ্র । ফলত, অনেকসময়ে, আভাঁগার্দ লেখা সম্পূর্ণ নতুন, দুর্বোধ্য, দুরূহ, মজার এবং প্রায়শই সমসাময়িক পাঠকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। কবি বা শিল্পী তার ফলে হতাশ হন না, ঠিক যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটে, পেছিয়ে আসার প্রশ্ন ওঠে না । মরে যাবে জেনেই আভাঁগার্দ জওয়ানরা শত্রুনিধনে বেরোয় । কখনও কখনও কবি বা শিল্পীরা, যাঁরা আভাঁগার্দ থিমের সাথে জড়িত, তাঁদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি পেতে কয়েক দশক লেগে যায় কিংবা শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি নাও পেতে পারেন । ক্রমশ আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প মূলধারার অংশ হয়ে যায় এবং অবিশ্বাস্যভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাই দেখা যায়, একদা যে ডাডাবাদী কাজগুলো আভাঁগার্দ হইচই হিসাবে নিন্দিত হয়েছিল তা প্রয়োগ করছে বিজ্ঞাপনের এজেন্সিগুলো । প্রাথমিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যা আদর্শ বা স্থিতাবস্থা হিসেবে বহুকাল যাবত গ্রাহ্য, তার সীমানা অতিক্রম করে আভাঁগার্দ সাহিত্য-শিল্প । আভাঁগার্দকে কেউ কেউ আধুনিকতার শেষ বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন যার হাত ধরে উত্তরাধুনিকতা প্রবেশ করেছে । অনেক শিল্পী আভাঁগার্দ আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে নিজেদের কাজকে উত্তরাধুনিক হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন । ‘শ্রুতি’ আন্দোলনের কবি সজল বন্দ্যোপাধ্যায় আমেরিকার ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েটদের বহু আগে উত্তরাধুনিক কবিতা লিখেছিলেন ।
.
প্রাগুক্ত বইতে তপোধীর ভট্টাচার্য বলেছেন, “সাহিত্যিকতার সংগঠনে উপস্থাপনার কত বহুমুখী তাৎপর্য হতে পারে এবং পাঠকৃতির নির্মিতিতে অন্তর্বয়ন ও পরাপাঠের গুরুত্ব কত বেশি,এ সম্পর্কে তারা আমাদের সচেতন করে দিয়েছেন । কোনও যথাপ্রাপ্ত বাস্তবতার পুনরুখাপন করাই শিল্প নয়। ভাষার বহুস্বরিক বিন্যাস ও প্রতিন্যাসের মধ্য দিয়ে বাস্তব অহরহ পুননির্মিত হয়। যে-অনুপাতে ভাষা নতুন হয়ে ওঠে, ঠিক সেই অনুপাতে শিল্পকেও মৌলিক বলতে পারি । এইজনো সৃষ্টি ও নির্মাণের দ্বন্ধ। আর, এই ধারণাও এখন অচল যে নব নব উন্মেষশালিনী প্রতিভার অধিকারী শুধু লেখক এবং পাঠক কেবল নিস্ত্রিয় ভোক্তা। রোর্লা বার্ত তার বিখ্যাত 5/7, বইতে বাচনিক নন্দনের নতুন পর্যায়ের সুচনা করেছেন। বালজাকের “সারাসিন' এর আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি পাঠককেন্দ্রিকতা ও লেখককেন্দ্রিকতার নতুন সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। ভাষা থেকে অর্থের উদ্তাসনে যেখানে উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়, সেখানে পাঠক সব্তিয় না হয়ে পারে না। স্বভাবত ভাষার অভিব্যক্তিতেও তার ছাপ পড়তে বাধ্য । কিন্তু যেখানে পাঠকৃতিকে আমরা নিষ্ক্রিয় পাঠক হিসেবে গ্রহণ করি, সেখানে ভাষাতেও অর্থাৎ অর্থবোধে সক্রিয়তার বিদ্যুৎস্পর্শ দেখা দিতে পারে না। যেখানে পাঠকের সক্রিয় সহযোগিতা আবশ্যিক সেখানে লিখন-প্রক্রিয়া কার্যত লেখক থেকে পাঠকের কাছে সরে যায়।”...”সংস্কৃতি ও বর্বরতার দ্বান্বিকতা কিংবা অমঙ্গলবোধ সম্পর্কিত চুড়ান্ত চেতনা কীভাবে সাংস্কৃতিক সমালোচনা-ধারাকে প্রভাবিত করে, এসম্পর্কে আডোর্নোর মন্তব্য নিঃসন্দেহে আমাদের ভাবায়। আউস্হিৎস সভ্যতার ইতিহাসে নিঃসন্দেহে বিপুল গুরুত্বসম্পন্ন জলবিভাজন রেখা । এই রেখার ওপারে যারা রয়েছে, কবিতা লেখা তাদের কাছে বর্বরতার অভিজ্ঞান কেন-_ তা তলিয়ে ভাবতে হয়। সৃষ্টির জ্ঞানও ধবস্ত হয়ে যাচ্ছে সার্বিক বিনষ্টির গাঢ়তম ছায়ার অভিঘাতেঃ তাই কবিতার মতো সূক্ষ্ম সংবেদনশীল শিল্পমাধ্যম এখন নিরাশ্রয়। তবে এই কথাগুলিকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করা সমীচীন কি না, এই প্রশ্ন উঠে তাইযন্ত্রণাময় আত্মসমালোচনার সুত্রে বাচনিক আতিশয্য অনিবার্ধ হয়ে পড়েছিল। হয়তো শিক্পকর্মকে কেউ কখনো ইতিহাস-নিরপেক্ষ বলে ভাবতে না পারে ।”...”প্রতিটি পাঠকৃতি মানে সিসিফাসের পুনর্নবীকৃত উদ্যম; বয়ানের ভেতরে প্রচ্ছন্ন থাকে তাৎপর্যের গভীরে পৌছানোর সোপানমালা। অধ্যবসায়ী শিল্পরসিক পাঠক/দর্শক ছাড়া অন্য কেউ তাদের আবিষ্কার করতে পারেনা ।”
.
দশ
.
আধুনিকতাবাদীদের পরের কবিরা, যাঁদের ষাট-সত্তর-আশি-নব্বই দশকের কবি বলা হয় তাঁদের কবিতায় বক্তব্য আছে, কিন্তু বক্তব্য নিয়ে নিশ্চিত হওয়া চলে না। কবিতাজুড়েই চলে দ্বিরুক্তিবদাভাস, শ্লেষ ও কূটাভাসের খেলা। পরিচিত পরিমণ্ডলের বাইরে থেকেও তাঁরা নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে আহরণ করেন উপমা উৎপ্রেক্ষা ও রূপক, মিথ ও মেটাফর। অনেক কঠিন সমাজ বাস্তবতার কথা বললেও তাঁদের কবিতার ভাষা অধিক সম্ভাবনা তৈরি করে । কবিতার পাঠ অবশ্য রুচির ওপরও নির্ভর করে, তবে যে কবিতাগুলো পাঠককেকে চিন্তা করার আর পুনর্বিবেচনা করার উৎসাহ যোগায় সেগুলোই টিকে থাকে । কবিতার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটা ব্যাখ্যা সঠিক হবে মনে করা উচিত নয় কেননা পাঠকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে আর সেটাও তো বৈধ। সাংস্কৃতিক জীবনে আমাদের কবিতা দরকার। সত্যিই তাই। কবিতা ভিন্ন পথের প্রচার করে, গোষ্ঠী কিংবা আন্দোলন গড়ে তোলে এবং মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে। যারা কবিতা লিখতে শুরু করে তাদের জীবনের ছবি আঁকার অনুমতি দিতে পারে ; রূপক, চিত্রকল্প এবং প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাগুলো সামলাবার উপায় বাতলাতে পারে বা নিজেদের কিছু অংশ যা তারা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করতে প্রস্তুত নয় তা কবিতার দেহে লুকিয়ে রাখতে পারে। কবিতা পাঠকদের ভাষা ব্যবহার করার আর ভাঙার অনুমতি দেয় - তা এক গভীর অভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে, প্রচলিত নিয়ম ভাঙতে পারে (ব্যাকরণ, ছেদ, যতি, যতিহীনতা, ভাঙাবাক্য ইত্যাদি, যেমন অনন্য রায়, শম্ভু রক্ষিত করেছেন )।
.
যেহেতু কবিতা নিয়মকে অমান্য করে, কবিতা সকলের জন্য অবাধ। কিশোররা তাদের শব্দভাণ্ডারে সীমাবদ্ধ থাকার সময় তাদের কণ্ঠস্বর লেখায় প্রকাশের উপায় খুঁজে পেতে পারে। তাছাড়া কবিতা সর্বজনীন।উচ্চস্বরে পড়লে, কবিতা হল ছন্দ এবং সঙ্গীত ; আর ছন্দ মানে প্রচলিত ছন্দ নয়। গর্ভবতী মায়েরা আজকাল পেটের বাচ্চাদের গান গেয়ে শোনান, কবিতা পড়ে শোনান । পেটের বাচ্চারা শব্দ বা অর্থ বুঝতে পারে না ঠিকই, কিন্তু তারা মায়ের ভাষার ছন্দ অনুভব করবে, শব্দের অর্থ কী তা নিয়ে বড়ো হয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠবে এবং সম্ভবত তাদের নিজস্ব ভাষাজগত তৈরি করতে চাইবে। জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীতে, ছন্দের মাধ্যমে সদ্য গোঁফ-ওঠা ছেলেরা আর বুক-ওঠা মেয়েরা প্রেমের কবিতায় প্রবেশ করে। কবিতা সাহিত্যের সমস্ত জনারের মধ্যে সবচেয়ে গতিশীল। ওই কিশোর-কিশোরীদের জন্য কবিতা শারীরিক এবং পূর্ণাঙ্গ যা তাদের হৃদয় এমনকি অস্তিত্বকে সক্রিয় করে তোলে আর কখনও কখনও তাদের মনের ফাঁদগুলোকে কাটিয়ে বেরোতে পারে।
.
যখন লোকেরা বলে যে কবিতা নিছক বিলাসিতা, বা ফালতু বিকল্প, বা কবিতা ব্যাপারটা শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের জন্য, বা স্কুলে কবিতা পড়ানো উচিত নয় কারণ এটা অপ্রাসঙ্গিক।কিংবা কবিতা সম্পর্কে এমন সব কথা বলা হয় যা অদ্ভুত আর বোকাবোকা, তাহলে বুঝতে হবে যারা অমন কথা বলছে তাদের জীবন বেশ সহজ ছিল। কঠিন জীবনের জন্য কঠিন ভাষা প্রয়োজন - আর তা থেকেই অঙ্কুরিত হয় কবিতা। সাহিত্যকে শক্তিশালী করার জন্য এমন একটি ভাষা জরুরি যা শক্তিশালী । কবিতা লুকানোর জায়গা নয়। কবিতা হলো খোঁজার জায়গা।কিন্তু মনে রাখলে ভালো হয় যে, যখন কেউ কবিতাকে আঁকড়ে তার সমস্যার সমাধান করার উপায় বের করার চেষ্টা করে বা নিজের দুঃখকষ্ট প্রশমিত করার জন্য পড়ে বা লেখে, তখন হতাশ হবার সম্ভাবনা থাকে । হয়তো কবিতা একটা মামুলি নিরাময় হতে পারে। কিন্তু একটা কবিতা তার নিজের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত, তাই কবিতা কখনই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন হতে পারে না।
.
আসলে "কবিতা" বলতে বহু পাঠকের কাছে জোর-জুলুমের চাহিদা বোঝায়। এটি একটি অন্তর্নিহিত কারণ অবজ্ঞার সাথে দেখা হয় এবং কেন কবিতাকে সময় নষ্ট তকমা দিয়ে খারিজ করা হয়। ফিকশান ও সংবাদপত্র পাডকের মধ্যে বেশিরভাগই কবিতা এবং মানব সম্ভাবনার মধ্যে কোনো পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে পান না । কবিতা লিখতে শুরু করে বহু কিশোর বিব্রত বোধ করে আর লুকিয়ে লেখে । বাণিজ্যিক পত্রিকায় লুকিয়ে কবিতা পাঠায় । ছাপা হলে কলার তুলে আত্মপ্রকাশ করে । বাণিজ্যিক পত্রিকা সম্পর্কে সমালোচকদের বক্তব্য হল যে কবিতা অস্পষ্ট বা কঠিন হলে, তারা তা প্রকাশ করে না। তাদের প্রকাশিত বেশিরভাগ কবিই ফিকশান পাঠকদের জন্য লেখা ; তারা আর সত্যই যুগান্তকারী কিছু প্রকাশ করতে চায় না। পরীক্ষামূলক কবিতার চেতনা যা প্রারম্ভিক দিনগুলিতে কবিতার লিটল ম্যাগাজিনগুলোকে আসরে এনে তুমুল কাণ্ড ঘটিয়েছিল তা অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কৃত্তিবাস পত্রিকা সুনীলের সঙ্গেই বুড়িয়ে গিয়েছিল। দেখা যাক বীজেশ সাহার কবিতার পত্রিকা নতুন করে ঢেউ তুলতে পারে কিনা।
.
এগারো
.
গুস্তাভ ইউং তাঁর থিয়োরি অফ শ্যাডো বা ছায়াতত্বতে বলেছিলেন, একজন মানুষের বিকাশ যে বৃত্তি বা মূল ধারায় হয়েছে তার বাইরেও কিছু সম্ভাবনা ছিল যা সে হতে পারতো । কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি । তাহলে এই সম্ভাবনাগুলো যায় কোথায় ? আসলে সেইসব সম্ভাবনা অবচেতনে ছায়া হয়ে তার সঙ্গেই ঘোরে ফেরে । কবিতার পাঠক হতে পারতো এমন মানুষ শেষ পর্যন্ত পাঠকের ছায়া নিয়ে ঘোরে । পাঠক হওয়া এড়িয়ে যেতে হয় । সে বরং শ্রোতা হতে চাইবে । কিন্তু তেমন অনুষ্ঠান বাংলায় সাধারণ পাবলিকের জন্য হয় না বললেই চলে, যেমনটা হিন্দি বা উর্দুতে হয় ।
.
আলোক সরকার বা অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বা সিদ্ধেশ্বর সেন বা এমনকি আল মাহমুদের কবিতা বোঝার প্রধান বাধা হলো যোগাযোগের ক্ষেত্রে খুব আক্ষরিক হওয়ার আমাদের অন্তর্নিহিত প্রবণতা। আমরা প্রায়ই অত্যন্ত আক্ষরিক পরিভাষায় কথা বলি এবং লিখি, কারণ আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে আমদের বোঝা যাচ্ছে। সুতরাং যখন যোগাযোগ অন্য কেউ করতে চায় , আমরা তাকে একইভাবে দেখি এবং তার কথার আক্ষরিক অর্থ বের করার চেষ্টা করি। এটা কবিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । যে কবিতা পাঠকের মন মাতায় তা আক্ষরিক নয়, সংজ্ঞা অনুসারে। কবিতা হিসাবে, পাঠবস্তুটা আমাদের এক উচ্চতর সত্যের সামনে দাঁড় করায় যা অ-আক্ষরিক, অরৈখিক উপায়ে প্রকাশ করা হয়, এমন একটি উপায়, যা যিনি রচনা করেছেন তাঁর কাছে সম্পূর্ণ নবায়িত। তাই পাঠককে প্রথমেই যা করতে হবে তা হল কবিতার মুখোমুখি হলে আক্ষরিক নিশ্চয়তার জন্য নিজের আকাঙ্ক্ষাকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা । শুধু চুপচাপ পড়া, তারপর জোরে জোরে পড়া, শব্দগুলোকে কিছুক্ষণের জন্য নিজের মগজে ঘুরতে দেয়া। পাঠক তা থেকে অর্থ বের করতে না পারলেও কবিতাটাকে একটা শৈল্পিক অভিজ্ঞতা হিসাবে উপভোগ করতে চেষ্টা করুন, যেমন পিকাসো, মাতিস, দালি, তায়েব মেহতা, এস এইচ রজা, রাম কুমার প্রমুখের পেইনটিঙ দেখার সময়ে করেন।
.
আমরা যদি কবিতার ভাষা বুঝতে না পারি, তবে বুঝতে হবে যে মানুষের যোগাযোগ একটি মৌলিক উপায়ে অবরুদ্ধ । এই ব্যর্থতার অনুভূতিই ব্যাখ্যা করে কেন বহু ফিকশান বা সংবাদপত্র পাঠক উদাসীন হওয়ার পরিবর্তে কবিতাকে ঘৃণা করার প্রবণতা দেখায়। কবিতা পড়া নিজেই একটা দক্ষতা, যেমন কেউ তা লিখতে শেখে, তেমন করেই কবিতা কীভাবে বুঝতে হয় তা শিখতে পাঠকের কিছুটা সময় নেওয়া উচিত। অবশ্য, পাঠককে ধারাবাহিক হতে হবে কারণ সে যত বেশি পড়বে, তত সহজে সমস্যাটা কাটিয়ে উঠবে। উপন্যাসের জন্য পাঠক যেমন সময় নেয়, তেমনই কবিতার জন্য সময় দেয়া দরকার । বাঙালি যুবক-যুবতীরা কম বয়স থেকেই কবিতা লেখার চেষ্টা করে, ফলে কবিতা সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়ে যায় ; কিন্তু অনেকে কবিতা লেখা ছাড়ার সঙ্গে কবিতা পড়াও ছেড়ে দেন । হিন্দি আর উর্দুর মতন বাংলায় যদি কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান হয় তাহলে তাঁরা আবার কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হবেন বলে মনে হয় । ফেসবুকে অজস্র কবিতা প্রতিদিন লেখা হয়, তা সে যেমন লেখাই হোক, আমি তাদের তারিফ করি ।
.
কবিতা মানব সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই রয়েছে । কবিতা দেবতাদের ভাষা হিসাবে পরিচিত ছিল আর সমস্ত পৌরাণিক এবং ধর্মীয় গ্রন্থগুলো পদ্যে লেখা হয়েছে । সবাই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদকেই স্বীকার করেন। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্যাপদ থেকে শুরু। চর্যাপদ যদি আমাদের কবিতার প্রথম বই হয় তাহলে মনে রাখতে হবে চর্যার ভাষার আলোচনায় সবচেয়ে আকর্ষণের বিষয় সন্ধ্যা বা সান্ধ্য ভাষা। চর্যাগীতি গুলো রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিলো বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ধর্মতত্ত্ব আর গুহ্য সাধনপদ্ধতি সম্পর্কিত নানা তথ্য নির্দেশ লিপিবদ্ধ করা এবং সেই তথ্যগুলো যাতে সাধারন মানুষের বোধগম্য না হয় সেই কারনে পদগুলির প্রকাশভঙ্গিতে প্রহেলিকাময় রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষ্যা ইত্যাদির আড়াল ব্যাবহার করেছিলেন পদকর্তারা। বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে সন্ধ্যা শব্দ অভীষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এটা বোঝাতে যে পদগুলোর প্রকৃত অর্থ শুধুই মর্মজ্ঞের কাছে বা দীক্ষিত ব্যাক্তির কাছে প্রকাশ্য, অন্য কারো কাছে নয়। অন্য কোনো সাধারণ ব্যাক্তির এই অর্থ বোঝা বা বোঝার চেষ্টা করাও অনুচিত এটাই মনে করতেন পদকর্তারা; আর তাই তাঁরা পদ রচনার ক্ষেত্রে বেছে নিয়েছিলেন এই প্রহেলিকাময় সন্ধ্যা ভাষা। তাই যদি হবে তাহলে তরুণতম কবিরা যেভাবে লেখার চেষ্টা করছেন সেই কবিতাগুলোকে কেন বলা হবে না মর্মজ্ঞ আর দীক্ষিতদের জন্য লিখেছেন কবি । যেমন বারীণ ঘোষালের কবিতা, যেমন অলোক বিশ্বাসের কবিতা, যেমন ধীমান চক্রবর্তীর কবিতা ।
.
বারো
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও বাংলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাসগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই সময়কার বাংলা সাহিত্য। ইসলামি ধর্মসাহিত্য,পীরসাহিত্য,বাউল পদাবলি,পবিত্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ,মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্তপদাবলি, বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, নাথসাহিত্য ইত্যাদি ছিল এই সাহিত্যের মূল বিষয়। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয় খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। গদ্য যে মাত্র ৩০০ বছরের পুরানো তা জেনে ফিকশান ও সংবাদপত্র পাঠকরা হতবাক হতে পারেন। চিঠিপত্র লেখা এবং দলিল-দস্তাবেজ লেখার প্রয়োজনে বাংলা গদ্যের সূত্রপাত। দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদি সংস্কৃতি ও পার্সি - এই দুই ভাষার প্রভাবে পরিকীর্ণ। পর্তুগীজ ধর্মপ্রচারক মানোএল দা আস্সুম্পসাঁউ-এর রচনা রীতি বাংলা গদ্যের অন্যতম আদি নিদর্শন। তবে প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা আলালের ঘরে দুলাল বাঙালা ভাষায় রচিত আদি গদ্যসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এটি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আগেও অনেক লেখক বাংলায় গদ্য রচনা করেছেন। তাদের লেখায় নানান অসঙ্গতি ছিলো, যথাযথভাবে ব্যাকরণ অনুসরণ করা হতো না এবং বিরামচিহ্ন ব্যবহার করা হতো না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই সর্বপ্রথম প্রমিত ভাষা ব্যবহার করে গদ্যরচনা শুরু করেন এবং যথাযথভাবে বিরাম চিহ্নের ব্যবহার করেন। বাংলা সাধু গদ্যরীতিকে পূর্ণাঙ্গ রুপ দান করেছেন তিনি। বাংলা গদ্য ভাষার বিকাশেও তার অবদান অনেক। তিনি সাধু ভাষায় বাংলা গদ্যরীতিকে পূর্ণাঙ্গতা দান করেন।
.
যথেষ্ট পড়াশোনা দ্বিজেন্দ্রলালেরও ছিল কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ডিকোড করতে পারতেন না । তাঁর মতে, ‘রবীন্দ্রসাহিত্য অস্পষ্ট’। দ্বিজেন্দ্রলাল বলেছিলেন, ‘যদি স্পষ্ট করিয়া না লিখিতে পারেন সে আপনার অক্ষমতা। … অস্পষ্টতা একটা দোষ, গুণ নহে’ (কাব্যের অভিব্যক্তি প্রবাসী ১৩১২ কার্তিক)। দ্বিজেন্দ্রলালের মত ছিল, রবি খালি ‘প্রেম’ নিয়ে লিখতে বসেন। নাটক নভেলও তাই। ‘কেন পৃথিবীতে মাতা নাই, ভ্রাতা নাই, বন্ধু নাই – সব নায়ক আর নায়িকা? তাও যদি কবিরা দাম্পত্য প্রেম লইয়া কাব্য লেখেন, তাহাও সহ্য হয়। ইহাদের চাই হয় বিলাতি কোর্টশিপ নয়ত টপ্পার প্রেম। নহিলে প্রেম হয় না। অবিবাহিত পুরুষ ও নারী চাই-ই। ফল দাঁড়ায় এই যে এরূপ প্রেম হয় ইংরাজি (অতএব আমাদের দেশে অস্বাভাবিক) না হয় দুর্নীতি মূলক’ (কাব্যে নীতি সাহিত্য ১৩১৬ জৈষ্ঠ সংখ্যা)।’
.
শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিজের কবিতার মানদণ্ডে এতোই বিভোর থাকতেন যে পঞ্চাশের কবিতা সিংহ-এর কাব্যে নারীশক্তির যে-স্বর জোরালোভাবে বিচ্ছুরিত হয়েছিল তা টের পাননি। আটের দশকে মল্লিকা সেনগুপ্তের কাব্যরচনা সেই নারীবাদী স্বরকে নেতৃত্ব দিতে শুরু করল তা টের পাননি। মল্লিকার আত্মপ্রকাশের সমসময়েই এলেন সুতপা সেনগুপ্ত, আনিতা অগ্নিহোত্রী ও চৈতালী চট্টোপাধ্যায়। সমাজকে দেখার জন্য মেয়েদের যে নিজস্ব দৃষ্টিকোণ তা এঁদের রচনার মধ্যে ফুটে উঠল। আটের দশকের সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংকেতবাহী কবিতার নিজস্বতা টের পাননি শক্তি চট্টোপাধ্যায় । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যিনি যথেস্ট শিক্ষিত ছিলেন না, অথচ অসাধারণ কবিতা লিখে গেছেন, একটা পত্রিকায় ‘এত কবি কেন?’ নামে বিক্রয়যোগ্য তর্কে বলেছিলেন, 'গদ্যের ঘাড় মটকে পদ্য আদায় করার রেওয়াজ শুরু হয়েছে।.এখন যারা কবিতা লেখে তাদের বেশিরভাগই লেখে এক ধরনের ভাঙচুরময় গদ্যে।কেন লেখে? লেখা সহজ বলে।... কবিতা লেখার প্রথম শর্ত ছন্দ।' 'আমার কাছে যদি কোনও তরুণ কবি আসে, লেখা দেখায়, আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে শেকসপিয়ারের সনেট অনুবাদ করতে বলি।...সে কবি আর দ্বিতীয়বার আমার কাছে আসে না।সে তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে চলে যায়।সহনশীলতা ও সম্পাদকীয়তা ওর রক্তে।ও ঘষে-মেজে সেই তরুণের একটি কবিতা 'দেশ'-এ ছাপিয়ে দেয়।...সেই তরুণ কিন্তু হয়ে উঠল জবরদস্ত কবি।তাকে এখন ঠেকায় কে? সুনীল কবিতার যত বড়ো পৃষ্ঠপোষক তত বড়ো শত্রু।' 'বাংলাদেশের যে সব পত্রিকাগুলো পাই তার মধ্যে পাঠযোগ্য কোনও লেখা খুঁজে পাই না।ভুল ছন্দে কী সব বিচিত্র লেখা।আমাদের এখানকার তরুণ রচনা থেকে অনেক কাহিল।' 'স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার' বইটি শামসুর রাহমানের শেষতম কবিতার বই।আমায় উৎসর্গ করা।বইটি হাতে পেয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম কদিন ধরে।পড়ে উঠতে পারলাম।কিন্তু এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।শামসুরের কবিতায় সে-ধার গেল কোথায়?' 'ও ,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যে কীভাবে মহাকবি তৈরি করে চলেছে প্রতি হপ্তায় এবং মহিলা কবি।এত মেয়ে পদ্য লেখে।...আমার তো মেয়েদের কবিত্বে খুব সামান্য আস্থা আছে।এতখানি বয়সেও কবিতা সিংহ ভুল ছন্দে কীভাবে কবিতা লিখে চলেছে।'
.
আবার একদা মন্ত্রী অশোক মিত্র, যিনি বড়ো বেশি শিক্ষিত ছিলেন, তিনি লিখেছেন, 'মাল্যবান থেকে শুরু করে তাঁর প্রতিটি প্রকাশিত প্রতিটি গল্প-উপন্যাস আমি অপ্রকাশিত দেখতে পেলে খুশি হতাম...যাঁরা এ-সমস্ত নিভৃত স্বগত রচনাদি টেনে হিঁচড়ে মুক্ত আকাশের নীচে অনাবৃত করছেন তাঁরা জীবনানন্দের স্মৃতিকে সম্মান জানাচ্ছেন কিনা তা নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ। অবশ্য অশোক মিত্র জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে মত পাল্টে বলেছিলেন, '”অনুভবের গভীরতার দিক থেকে বিচার করলে বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দের কাব্যের তুলনা নেই। প্রায় ২০ বছর ধরে জীবনানন্দের কবি প্রতিভার প্রতি যে নির্দয় অসম্মান প্রদর্শন করা হয়েছিল, তা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে কলঙ্কের এক চরম চিহ্ন হয়ে থাকবে।”
.
সুধীন্দ্রনাথ দত্তও বড়ো বেশি শিক্ষিত ছিলেন । সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এক লাইনও লেখেননি জীবনানন্দকে নিয়ে। মুখে বলেছিলেন জীবনানন্দ 'নেভার এ স্পন্টেনিয়াস পোয়েট'। 'পরিচয়' পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে জীবনানন্দর কবিতা ছাপিয়েছিলেন নেহাতই বিষ্ণু দে অনুরোধ করেছিলেন তাই।তফাত ছিল কাব্য বোধ ও জীবন দর্শনে। তিরিশের দশকের বেশ কয়েকজন কবি-আলোচক জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে আমল দিতে চাননি । তাঁরাও বেশ শিক্ষিত আর বিখ্যাত ; স্কুল-কলেজের সিলেবাসে আছেন । সাগরময় ঘোষ প্রকাশ করতে চাননি, ফেলে রেখেছিলেন । ঠিক কী কারণে জীবনানন্দের কবিতা তাঁদের মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য ছিল না ? ব্যাপারটা কি 'আসন্ন সময়কে উপলব্ধির অভাব' ? কেন জীবনানন্দের কবিতাকে তাঁরা গুরুত্ব দিতে চাননি ? এটা নিয়ে কেউ কি লিখেছেন ? ১৯১৫ সালে জীবনানন্দ কবিগুরুর কাছে কিছু কবিতা পাঠান। তখন তার বয়স ষোলো। কবিগুরু জবাব দেন, “'তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নাই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মাঝে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো।'
.
ননী ভৌমিকও বেশ শিক্ষিত, শুনেছি শিক্ষা আর দীক্ষার জোরে বহুকাল সোভিয়েত রাষ্ট্রে ছিলেন । তিনি 'বাঙলা সাহিত্যে বাস্তববাদের সমস্যা' প্রবন্ধে লেখেন- “সাম্প্রতিক কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ অস্বীকৃতিরই একটি আধুনিক মুখোশ মাত্র। আপন অবচেতনার রঙে স্বাধীন বাস্তব জগতকে, মানুষ এবং তাঁর ভূত-ভবিষ্যতকে এমন করে রাঙিয়ে দেওয়ার দুর্লক্ষণ আতঙ্কের কথা; অথচ বিস্ময়ের কথা এই যে এমন সমালোচক আছেন যারা এই ছিন্নবিচ্ছিন্ন, চিন্তাহীন, উদ্ভট অনুভূতিস্রোতকে আখ্যা দেন 'ঐতিহাসিক বোধ' বলে।' ['পরিচয়', অগ্রহায়ণ ১৩৫৯] গিরিজাপতি ভট্টাচার্য 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'র আলোচনায় লিখলেন,”'এই গ্রন্থে স্থানে স্থানে কাঁচা হাতের ছাপ চোখে পড়ে, সুন্দর ও সার্থক পঙক্তির প্রাচুর্য থাকলেও সমগ্র কবিতা মাঝে মাঝে নিষ্প্রভ ও অস্পষ্ট মনে হয়। কতকগুলি ভাব, উপমা ও বাক্যের পুনঃ পুনঃ সমাবেশ কবিতাগুলোর দৌর্বল্য প্রকাশ করে, তথাপি এই বইয়ে এমন সৌন্দর্যস্বাতন্ত্র্য ও কবিত্ব-বিকাশ আছে যা কবির অনন্যসাধারণ দক্ষতার পরিচায়ক। অন্ততঃ বইটির কতগুলো কবিতা জীবনানন্দের জন্য আধুনিক কবিদের প্রথম শ্রেণীতে স্থান নির্দেশ করবে।' জীবনানন্দ শুরুতেই যেসব প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের সমর্থন পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব তাদের মাঝে অন্যতম। কিন্তু জীবনানন্দকে নিয়ে মধ্য-চল্লিশের দশকে বিতর্ক শুরু হলে এহেন বুদ্ধদেবও আস্থা হারিয়ে ফেলে তার সমালোচনা করেন। তিনি লিখলেন, বুদ্ধদেব বসু : 'জীবনানন্দ দাশ আমাদের নির্জনতম স্বভাবের কবি। এই নির্জনতার বিশিষ্টতাই তাঁর প্রাক্তন রচনাকে দীপ্যমান করেছিল। মনে মনে এখনো তিনি নির্জনের নির্ঝর, তাঁর চিরতন্ত্রী এখনো স্বপ্নের অনুকম্পায়ী। কিন্তু পাছে কেউ বলে তিনি এস্কেপিস্ট, কুখ্যাত আইভরি টাওআরের নির্লজ্জ অধিবাসী, সেই জন্য ইতিহাসের চেতনাকে তাঁর সাম্প্রতিক রচনার বিষয়ীভূত ক'রে তিনি এইটেই প্রমাণ করবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন যে তিনি 'পেছিয়ে' পড়েন নি। করুণ দৃশ্য, এবং শোচনীয়। এর ফলে তাঁর প্রতিশ্রুত ভক্তের চক্ষেও তাঁর কবিতার সম্মুখীন হওয়া সহজ আর নেই। দুর্বোধ বলে আপত্তি নয়; নিঃসুর বলে আপত্তি, নিঃস্বাদ বলে।' বুদ্ধদেব বসু। তিনি পরবর্তীতে জীবনানন্দের একজন বন্ধুপ্রতিম ও ভক্ত পাঠক হয়ে উঠেছিলেন। 'প্রগতি' পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষসংখ্যায় তিনি লেখেন, 'জীবনানন্দবাবু বাঙলা কাব্যসাহিত্যে একটি অজ্ঞাতপূর্ব ধারা আবিষ্কার করেছেন বলে আমার মনে হয়। তিনি এ পর্যন্ত মোটেই popularity অর্জন করতে পারেননি, বরঞ্চ তার রচনার প্রতি অনেকেই বোধ হয় বিমুখ; -অচিন্ত্যবাবুর মতো তাঁর এরই মাঝে অসংখ্য imitator জোটেনি। তার কারণ বোধ হয় এই যে জীবনানন্দবাবুর কাব্যরসের যথার্থ উপলব্ধি একটু সময়সাপেক্ষ;...তার কবিতা একটু ধীরেসুস্থে পড়তে হয়, আস্তে আস্তে বুঝতে হয়।' ['প্রগতি', আশ্বিন ১৩৩৫] । প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো গুণী লেখক জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্ক্তি নিয়ে, যেমন 'সুরঞ্জনা তোমার হৃদয় আজ ঘাস'-এর কথা বলে রসিকতা করতেন। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে শান্তিনিকেতনের সাহিত্য মেলায় পাঁচ বছরের কবিতা অর্থাৎ ১৩৫৫-১৩৫৯ বঙ্গাব্দের একটি প্রবন্ধে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এক বিশ্নেষণে লিখেছিলেন, 'সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকেও যিনি কোন কিছুর মধ্যে নন, সেই ভাবান্তরহীন কবি হলেন জীবনানন্দ দাশ। প্রকৃতি ও জীবনের সমস্ত কিছুই তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। তারপর একের পর এক সমস্ত কিছুই তিনি ধূসর কুয়াশায় আপাদমস্তক মুড়িয়ে দেন।'
.
তেরো
.
যথেস্ট শিক্ষিত না হলে আধুনিক কবিতার আবেদন কিংবা অনুধাবন কম হয় বলার মধ্যে সত্যতা আছে । অনেকের কাছে কবিতা কঠিন কারণ একটা রচনা খুব কম শব্দে তথ্যের গুরুতর সংকোচন নিয়ে গঠিত। কাজের সম্পূর্ণ প্রশংসা করার জন্য একজনকে অবশ্যই কাঠামো, আঙ্গিক এবং সাহিত্যিক শৈলীগুলো জানতে হবে। বাংলা পদ্যের ইতিহাস শুরু হয়েছে চর্যাপদ থেকে; কিন্তু গদ্যের ইতিহাস ততটা প্রাচীন নয়। গদ্যের চারিত্র্য নির্ভর করে শব্দের ব্যবহার এবং বাক্যে পদ স্থাপনার ক্রমের ওপর। আধুনিক যুগে গদ্যের প্রধান দুটি ব্যবহার হলো কথাসাহিত্য এবং প্রবন্ধ। আঠারো শতকে বাঙ্গালা গদ্যের বিকাশ সূচীত হয়েছিল। কবিতা পড়ার ও বোঝার জন্য পাঠককে খুব মনোযোগী হতে হয়। অন্যদিকে, গদ্য খুব প্রত্যক্ষ এবং সাধারণত যে যুগে যে ভাষায় কথা বলা হয় সেই ভাষায় লেখা হয়। গদ্য সাধারণত বলে যে লেখাটার অর্থ কী, কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে কোনও একক ব্যাখ্যা সম্ভব নয় আর তা আমরা স্কুলে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতা পরীক্ষার খাতায় ব্যাখ্যা করার সময়ে হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছি ।
.
কবিতাকে সবচেয়ে সম্মানজনক সাহিত্য-ধারা বলে মনে করা হয়। ফেসবুকে তাই অজস্র কবিতা প্রতিদিন পোস্ট হয় । গ্রীক ভাষায়, একটা কবিতাকে মানুষের অসাধারণ সৃষ্টি বলা হতো, আর প্লেটো বলেছিলেন কবিতা হলো বাস্তবতার অনুকরণ । ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতা চিন্তা ও অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত ওপচানো বলেছেন। ওয়র্ডসওয়র্থের বিরোধিতা করে টি, এস, এলিয়ট বলেছিলেন, “কবিতা আবেগের উপচে ওঠা নয়, তা আবেগ থেকে মুক্তি; কবিতা ব্যক্তিত্বের প্রকাশ নয়, ব্যক্তিত্ব থেকে অব্যাহতি। তবে, অবশ্যই, শুধুমাত্র যাদের ব্যক্তিত্ব এবং আবেগ আছে তারাই জানেন যে এই জিনিসগুলি থেকে পালাতে চাওয়ার অর্থ কী।" কিটস, রোমান্টিক কবি , মনে করতেন যে কবিতা যদি গাছের পাতার মতো অবাধে বেরিয়ে না আসে, তবে তা না আসাই ভাল। যদি এসব কথা সঠিক হয়, তবে কেন ফিকশান ও সংবাদপত্র পাঠকের কাছে কবিতা বোঝা কঠিন মনে হয় ? কবিতা খুব আকর্ষক এবং মনোমুগ্ধকর হতে পারে কারণ বোদ্ধা পাঠক তাকে ডিকোড করতে সক্ষম হলে পান৷ যেহেতু তা সহজ নয়, তাই একজন পাঠককে অবশ্যই বিভিন্ন ধরণের কবিতার সাথে সাথে গদ্য কাঠামোর বিভিন্ন সাহিত্যিক রচনাশৈলীর সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। কবিতা সবার বোঝার কথা নয়। কবিতা একটা নির্দিষ্ট কারণে একটা নির্দিষ্ট দর্শকের উদ্দেশ্যে লেখা । তারা ব্যক্তিগত ব্যাপার ; কোনো গেটসভা বা মাঠসমাবেশ বা মোড়মিটিঙের পাবলিকের জন্য নয় ।
.
কবিতা গণিতের মতো নয়, যেখানে পাঠক ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করতে আর উত্তর মূল্যায়ন করতে নিয়ম এবং ফরমুলা ব্যবহার করতে পারে। কবিতা পাঠে ভয় আর ঝুঁকি জড়িত । পাঠক মনে করতে পারে যে তার অজ্ঞতা ধরা পড়ে যাবে । মানুষ তো মর্মার্থ সৃষ্টিকারী প্রজাতি। যখন থেকে আমরা ভাষা উদ্ভাবন করেছি, তখন থেকে আমরা দুর্দান্ত কিছু আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছি , তা গুহার দেয়ালে, শিলালিপিতে বা কাগজে, যেখানেই হোন। পাঠক অমুক কবিতা বা তার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে পারছে না? কবিতায় সে ঢুকতে পারছে না । এই চিন্তাভাবনা, বিষাক্ত। যদিও এটি একটি সর্বজনীন অনুভূতি, পাঠক নিজের অজ্ঞতার লজ্জা সম্পর্কে কথা বলতে চায় না । তাই টের পাওয়া যায় কেন অনেক লোক কবিতাকে ঘৃণা করে; কবিতা আক্ষরিক অর্থে পাঠকের অজ্ঞতার লজ্জার অনুভূতি প্রকাশ করে । সেরকম পাঠক কবিতাকে আর কবিদের অপমান করা শুরু করে ।
.
যদিও কবিতা সময়ের সঙ্গে বদলাতে থাকে আর অনেক রূপ, অভিব্যক্তি এবং শৈলী রয়েছে, তবে একটা ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ , তা হল কবিতাকে অনুভূতির মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয় । ফিকশান আর সংবাদপত্র পাঠের জন্য তার দরকার হয় না, তবে কবিতা অবশ্যই তা দাবি করে, তাই পাঠককে কবিতার শক্তির সাথে একটা তাৎক্ষণিক সংযোগ তৈরি করতে হয়। যদি তা না ঘটে তাহলে কবিতা সম্ভবত অমন পাঠকের জন্য নয়! বেশিরভাগ স্কুল আমাদর জীবনের বহু চমৎকার ব্যাপার নষ্ট করে দেয়, যার ফলে বড়ো হয়ে পাঠক ভেবে আপশোষ করে যে সেগুলো কতো আনন্দের হতে পারতো । এর প্রধান কারণ হল শিক্ষকরা ছাত্রদের ওপর চাপ দেয়, তাই ছাত্ররা প্রতিদিন ক্লাসে যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে বড়ো হয়ে তাও পছন্দ করে না। ব্যাপারটা সত্যি যে বাজারে গদ্যের আবির্ভাবের দরুণ কবিতার মুকুট ছিনিয়ে নিয়েছে গদ্য ।বাজারের নিয়মে ভোগ্যবস্তু হিসেবে পাঠকদের কাছে উপন্যাস পরম প্রিয়। বিখ্যাত মহাকাব্য এখন পাঠক গদ্যে পড়তে চায় । গল্প বলার ক্ষমতার ফলে গদ্য জিতে গেছে । কৃত্তিবাসের রামায়ণের বদলে পাঠক গদ্যে রামায়ণ পড়তে চায় বা ফিল্ম-টিভিতে দেখে সন্তুষ্ট থাকে ।
.
কবিতা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর মধ্যে একটা হলো ভাষা। ‘লস্ট ইন ট্রানস্লেশান; বা "অনুবাদে হারিয়ে যাওয়া" সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এমনকি যখন অনুবাদ হুবহু হয়, ছন্দের সমস্যা, বা একট পদের পরিমাপের গোলমাল ঘটে যায়। একটা কবিতা মূল ভাষা থেকে অন্য ভাষায় নিয়ে গেলেই তার মেজাজ হারিয়ে যায়।বোদলেয়ারের একই কবিতা অজস্রবার অনুবাদ হয়েছে আর সেগুলোয় আসল বোদলেয়ারকে খুঁজে পাওয়া যায় না । শেক্সপিয়ার বা গালিবের কবিতার অনুবাদে আমরা শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে পাই ; মূল কবিদের পাই না । অতএব, একটি কবিতা তার মূল ভাষায় পড়া সবচেয়ে ভাল, তাই পাঠক সম্ভবত নিজের মাতৃভাষার কবিতা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করবে। কবিতা এতই সূক্ষ্ম যে এটা কেবল তার আসল রূপের সাথে খাপ খায়। পাঠক যখন খুঁতখুঁত করে যে একটা বিদেশী কবিতা "ভালো হয়নি:, তখন ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে শব্দ নিয়ে কারিকুরি এতো সহজে কাজ করে না !
.
চোদ্দ
.
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সুনিপুণ অভিনেতা এবং অভিনয়ের সুদক্ষ শিক্ষক । কবিতার আবৃত্তিতে এবং প্রবন্ধ গল্প নাটক ও উপন্যাসের পঠনেও তিনি সুদক্ষ ছিলেন । তাঁর সাধারণ কথাবার্তাও ছিল সাহিত্যধর্মী ও সুরেলা । এসব কথা বিবেচনা করলে রবীন্দ্রনাথের নিজকণ্ঠের যে মুষ্টিমেয় রেকর্ডিং হয়েছে তা নিতান্তই অকিঞ্চিতকর ।
.
গেয় কবিতা এখনও লেখা হয় । যিনি লেখেন তিনি সেগুলো গেয়ে শোনান। চণ্ডীমণ্ডপের বদলে এখন মঞ্চে কবিতা গেয়ে শোনান গায়ক কবি অর্থাৎ প্রযুক্তির সঙ্গে ফরম্যাট পালটে গেছে। । যেমন, কবির সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত, রূপম ইসলাম, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য। রেডিওতে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান হয় । কবিতা সিংহ যখন আকাশবাণী কলকাতায় ছিলেন তখন বহু তরুণকে কবিতা পাঠের সুযোগ দিয়েছিলেন। দূরদর্শনে পঙ্কজ সাহা প্রতিষ্ঠিত কবিদের অনুষ্ঠান করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমার কৈফিয়ৎ’ বা বুদ্ধদেব বসুর ‘জোনাকি’-র মতো কবিতায় প্রদীপ ঘোষের কন্ঠ সকলের কাছে সমাদৃত । প্রদীপ ঘোষের স্ত্রী গৌরী ঘোষও প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতা পাঠ করতেন।বাচিক শিল্পী জগন্নাথ বসু ও ঊর্মিমালা বসু মঞ্চে পাঠ করেছেন প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতা। শুভ দাশগুপ্তের ‘শ্রীচরণেষু নেতৃবৃন্দ’ নামক স্বকণ্ঠে স্বরচিত কবিতা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ইউটিউবে বহু কবির কবিতা পাঠ আছে । এপার-ওপার দুই বাংলার, প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত কবিদের । ফালগুনী রায়ের কবিতা অনেকে পাঠ করেছেন । আমার কবিতাও দুই বাংলার বাচিক শিল্পীরা পাঠ করেছেন। কবিদের দেখেছি বাচিক শিল্পীদের টাকা দিয়ে নিজের কবিতার সিডি তৈরি করিয়েছেন ।
.
কবির লেখা কবিতা গায়ক বা গায়িকারা গেয়ে শোনান বা রেকর্ড করেন। যেমন জয় গোস্বামীর মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয় গেয়েছেন লোপামুদ্রা মিত্র, আবৃত্তি করেছেন মুনমুন মুখার্জি । নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তন ছাত্রসাহেব শর্মা ২০১২ সাল থেকে ‘রেডিও বঙ্গনেট ’ নামের একটি ইন্টারনেট নির্ভর রেডিও স্টেশন চালিয়ে আসছেন৷ তাঁদের এখনও পর্যন্ত ৪ -টি চ্যানেল চালু হয়েছে৷ একটিতে শোনা যায় ধ্রুপদী সঙ্গীত , একটিতে লোকগীতি , একটিতে আধুনিক বাংলা গান , একটিতে রক সঙ্গীত৷২৪ ঘণ্টা চালু থাকে এই ৪টি চ্যানেল৷ সাহেব জানালেন , ‘রক সঙ্গীতের চ্যানেলটার সম্পূর্ণ দায়িত্ব রূপম ইসলামের৷ তখন থেকেই একটা বাংলা কবিতার চ্যানেল নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল৷ব্রততীদি এগিয়ে আসায় এই চ্যানেলটি করতে আর আমার অসুবিধে হবে না৷ ’ব্রততী বলেছেন , ‘কেবলমাত্র কবিতার জন্য ডেডিকেটেড এই রকম চ্যানেল আমাদের দেশে নেই৷ বিদেশে কিছু কিছু জায়গায় রয়েছে৷ আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল এই রকম একটা কিছু করার৷ বেলঘরিয়ার ‘শঙ্খমালা ’ সংস্থা আর আমার পাঠশালার ছাত্র -ছাত্রী তাতার -ঊর্মি-সোমেশ -সৌম্য -সোহম --- এঁদের সহযোগিতায় ইতিমধ্যেই আমি প্রায় ২০০ ঘণ্টা কবিতার রেকর্ডিং সংগ্রহ করে ফেলেছি৷ আমার নিজের সংগ্রহেও অনেক কিছু ছিল৷ এই চ্যানেলটা শুরু করার ব্যাপারে আর কোনও সন্দেহ নেই৷ আমিই ঠিক করব কী ধরনের প্রোগ্রামিং চলবে দিনভর৷’ ব্রততী বলেছেন , ‘আমার টার্গেট শ্রোতা হল এই প্রজন্মের নেট -স্যাভি এবং স্মার্টফোন ব্যবহার করা মানুষরাই৷ এই প্রজন্মের কাছে বাচিক শিল্পকে জনপ্রিয় করাই আমার উদ্দেশ্য৷ কোনও সন্দেহ নেই বাংলা কবিতা শোনার আগ্রহী মানুষ এখনও অনেক রয়েছেন৷ তার প্রমাণ , রবীন্দ্রসদনে আমাদের অনুষ্ঠানের সমস্ত টিকিট ইতিমধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে৷ ’কীভাবে ডাউনলোড করা যাবে এই অ্যাপ ? সাহেব শর্মা জানালেন , ‘গুগল প্লে স্টোর কিংবা অ্যাপল অ্যাপস্টোর -এ গিয়ে radio bongonet টাইপ করলেই পাওয়া যাবে এই অ্যাপ৷ এছাড়া www.bongonet.net এই ওয়েবসাইটে গেলেই পাওয়া যাবে সমস্ত নিয়ম কানুন এবং রোজকার প্লে -লিস্ট৷ ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এই চ্যানেলে ঠিক সেই -সেই কবিতাই রাখছেন যা সবাই শুনতে চান৷ কেবল , প্লে -লিস্ট দেখে জেনে নিতে হবে কখন আপনার পছন্দের কবিতাটি শোনা যাবে৷
.
কবিতা ক্রমশ রকব্যাণ্ডের অংশ হয়ে উঠেছে, যেমন মহীনের ঘোড়াগুলি ১৯৭৬ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম বাংলা স্বাধীন রক ব্যান্ড। এটি ভারতের প্রথম রক ব্যান্ড যা ১৯৭০-এর দশকের মাঝ পর্বে কলকাতায় যাত্রা শুরু করে। গৌতম চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, এব্রাহাম মজুমদার, তাপস দাস ও তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, এই সাত জন সঙ্গীতশিল্পী সহকারে নব্বই দশকের পর তারা ব্যাপকভাবে ভারতীয় রক যুগের কিংবদন্তি, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং সর্বাধিক প্রভাবশালী আভা-গার্দ সঙ্গীতদল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক (১৯৭৭), অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব (১৯৭৮) এবং দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি (১৯৭৯) এই তিন অ্যালবাম ভারতীয় রক মিউজিকের মাইলস্টোন। পরে এসেছে ফসিলস, ক্যাকটাস, ভূমি, চন্দ্রবিন্দু ইত্যাদি । ২০০০-এর দশকে মেটাল জনপ্রিয় হয়ে উঠলে, ইনসমনিয়া এবং আন্ডারগ্রাউন্ড অথরিটির মতো অনেক ব্যান্ড হেভি মেটাল এবং বিকল্প সঙ্গীত বাজানো শুরু করে । আমার ‘ডেথ মেটাল’ কবিতাটা একটা রকব্যাণ্ড ইউটিউবে দিয়েছে।
.
বাঙালি গেয় কবিদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ্য কবির সুমন । কবির সুমন একজন তারকা কবি, নিজের গান নিজে লেখেন, অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ২২০০ টাকায়্ এবং তা হাউসফুল যায় । হিন্দি ভাষায় বহু তারকা কবির নাম শোনা যায় যাঁরা অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের জন্য লাখ টাকা নেন, যেমন গুলজার, জাভেদ আখতার, প্রসূন যোশী, কুমার বিশ্বাস, আশুতোষ রাণা প্রমুখ। হিন্দি ভাষার কবি কুমার বিশ্বাস কবিতা সম্মেলন ও মুশায়রার ক্ষেত্রেও একজন নেতৃস্থানীয় কবি। এ পর্যন্ত তিনি কবিতা আবৃত্তি করেছেন এবং হাজার হাজার কবিতা সম্মেলন ও মুশায়রা পরিচালনা করেছেন। দেশের শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর একক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে আইআইটি খড়গপুর, আইআইটি বিএইচইউ, আইএসএম ধানবাদ, আইআইটি রুরকি, আইআইটি ভুবনেশ্বর, আইআইএম লখনউ, এনআইটি জলন্ধর, এনআইটি ত্রিচি ইত্যাদির মতো অনেক প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত ।
.
বিটনিক কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ভারত থেকে একটা হারমোনিয়াম কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন । তাঁকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কবিতা পাঠ করতে ডাকলে তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে কবিতা শোনাতেন। নিউ ইয়র্কে সেন্ট মার্কস চার্চে তরুণ কবিরা নিয়মিত কবিতা পাঠ করেন কোনো-না-কোনো যন্ত্রানুষঙ্গ হাতে নিয়ে। আজকালকার গেয় কবিতা, বিভিন্ন দেশে, প্রায়ই জনপ্রিয় সঙ্গীতের বিপরীত ।
.
লিথুয়ানিয়ায় গেয় কবিতার পথপ্রদর্শক ভিটাউটাস কার্নাগিস একবার বলেছিলেন, ‘ পপ গানের সস্তা, জীর্ণ শব্দের বদলে গেয় কবিতা সত্যিই একটা পাল্টা সংস্কৃতি।’ এখনকার গেয় কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল শ্রোতাকে কবিতা আর সঙ্গীতের শক্তিতে মোহিত করা । যাঁরা কবিতাকে গানের মতো পাঠ করেন তাঁদের বলা হয় বার্ড’ বা চারণকবি। তাঁদের গানগুলো সাধারণত বিখ্যাত লিথুয়ানিয়ান কবিদের রচনা বা বার্ডদের নিজের লেখা কবিতার উপর ভিত্তি করে তৈরি। বাদ্যযন্ত্র (প্রায়শই একটি গিটার, কম প্রায়ই একটি বেহালা বা একটি পিয়ানো) ব্যবহার করা হয় আর শ্রোতাদের মধ্যে সঠিক মেজাজ তৈরি করে, যাতে শ্রোতা শব্দগুলোকে অনুধাবন করতে পারে। বার্ডরা তাদের পরিবেশনায় গান আর আবৃত্তিকে মিশিয়ে উপস্হাপন করে। উল্লেখযোগ্য লিথুয়ানিয়ান এবং পোলিশ কবি যাঁরা তাঁদের কবিতা গেয়ে পাঠ করেন তাঁরা হলেন কোসটাস স্মোরিজিনাস, লেভা নারকুটে, ভিতাউতাস কেরেনাজিস, আলিনা ওরোয়োভা প্রমুখ। কেউ কেউ অন্যের প্রকাশিত কবিতা ব্যবহার করে বা সমসাময়িক কবিদের সাথে সহযোগিতা করে। কবিতা-গায়ক শিল্পীরা শুধুমাত্র মঞ্চ অভিনেতাই নন, বিভিন্ন পেশার লোকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয় যাদের সাধারণত খুব কম বা কোনও বিশেষ সঙ্গীত শিক্ষা নেই।
.
গেয় কবিতা, বাঙালির মধ্যযুগে জনপ্রিয় ছিল অথচ আমরা সেই পরম্পরা কেন হারিয়ে ফেলেছি তা গবেষণার বিষয় হলেও, বিশ্বের অনেক অংশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের যাযাবর জনগণের মধ্যে শৈল্পিক অভিব্যক্তির একটি জনপ্রিয় রূপ হিসেবে আজও বজায় আছে। ফারসি, আরবি আর তুর্কি সাহিত্যের বেশিরভাগ কবিতা মৌখিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাদের কারণে টিকে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের গেয় কবিতা একটা জীবন্ত ঐতিহ্য হিসাবে রয়ে গেছে কারণ গায়ক-কবিরা কেবল প্রাচীন পাঠ্য এবং সুরে রদবদল করেই কবিতাকে নানা জায়গায় নিয়ে যান না বরং বর্তমান সংবেদনশীলতাকে প্রতিফলিত করার জন্য নতুন রচনাও তৈরি করেন। গায়ক-কবিদের কবিতাগুলোর চিত্রকল্পে একটি দ্বৈত অর্থ রয়েছে। তাঁরা মনে করেন যা বস্তুগত এবং পার্থিব আনন্দের তুচ্ছ প্রতীক বলে মনে হয় তাও রহস্যময় পরমানন্দ এবং ঐশ্বরিক প্রেমের প্রতিনিধিত্ব করে।
.
মার্কিন সম্পাদক এবং কবি অ্যালিসন অ্যাডেল হেজ কোক আদিবাসী আমেরিকান কবিতার বহুভাষিক সংকলনে গেয় কবিতা একত্র করেছেন, যেগুলো বিগত কালখণ্ডের সাক্ষী এবং পুনরুদ্ধার করা গেয় লবিতায় পুরানো এবং নতুন কণ্ঠ যোগ করেছেন। সমগ্র আমেরিকা থেকে আশিরও বেশি কবিকে জড়ো করেছেন, আলাস্কা থেকে চিলি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে, এবং আন্তর্জাতিক কবিদের পাশাপাশি শেরউইন বিটসুই, লুইস এরড্রিচ, জয় হারজো, লি ম্যারাকল এবং সাইমন অর্টিজের মতো পরিচিত নামগুলোও রয়েছে। আদিবাসি কবি-গায়করা লিখেছে ভিন্ন অঞ্চল এবং সমান্তরাল অভিজ্ঞতা থেকে, পাকা মাটির ঢিবিকে গুঁড়িয়ে রাজপথ তৈরি থেকে, তাদের হাপিশ-হওয়া গ্রাম পালটে গিয়ে মহাদেশের প্রথম বিশাল শহরগুলো থেকে, বরফঢাকা এলাকা থেকে, আগ্নেয়গিরির দোআঁশ জমি থেকে, মুছে ফেলা ইতিহাসের অঞ্চলগুলো থেকে। এবং অবিরাম সশস্ত্র সংঘাতের এলাকা যেখানে "উত্তর ঔপনিবেশিকতা" আর “উত্তরাধুনিকতা” স্রেফ ব ইদ্যায়তনিক ধারণা নয় বরং জীবন্ত বাস্তবতা।
.
অপেক্ষায় আছি কবে বাঙালি যুবক-যুবতী কবিরা ফিরিয়ে আনবেন গেয় কবিতার পরম্পরা।