রবিবার

আমাকে বলে কি না ক্ষতিকারক

 


আমি তো বলেছিলাম, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ । আমি জানতাম,  যাঁরা কবি নন তাঁরা সত্যকে সহ্য করতে পারেন না । তাই আমার কবিতা পড়ে তাঁরা আমাকে দেগে দিলেন ‘ক্ষতিকারক’ কবি হিসাবে । ভেবে দেখুন, আমাকে বলা হচ্ছে ‘ক্ষতিকারক’ । কারা বলছেন ? যাঁরা পৃথিবীকে ভয় পান, আমার কবিতায় বলা সত্যকে ভয় পান, ডাক্তারের ছুরিকে ভয় পান । অশোক মিত্র আমাকে ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসাবে দেগে দিয়েছিলেন । তারপর ওনার স্যাঙাতের তিন দশকের শাসনে পশ্চিমবাংলাকে তছনছ করে দেয়া হল, অথচ সুযোগ পেয়েছিলেন একটি সুন্দর সমৃদ্ধ পশ্চিমবাংলা গড়ে তোলার । পৃথক হয়ে যাওয়া বাংলাদেশেও অনেকে মগজে তালিবান পুষে রেখেছেন ; তাঁরা দেশটাকে রসাতলে নিয়ে যাবার প্রয়াস করে চলেছেন । শেষ পর্যন্ত কী হয় তা দেখবো । বুদ্ধদেব বসু আমাকে ‘নির্জনতম কবি’ হিসাবে দেগে দিয়েছিলেন, কেননা আমি ওনার মতন তরুণদের নিয়ে আড্ডা জমাতে পারতাম না । এখন দেখুন, ওনার ভাঙাচোরা ‘কবিতা ভবন’ কিনে নিয়েছে মারোয়াড়ি বিল্ডার । এমনকী রাশবিহারী অ্যাভেনিউয়ের সমস্ত দোকান মারোয়াড়িদের, ‘আদি ঢাকা বস্ত্রালয়ও’ ।অন্নদাশংকর রায় আমাকে দেগে দিলেন, ‘শুদ্ধতম কবি’ হিসাবে, কেননা উনি বাচ্চাদের ছড়া লিখতে ভালোবাসতেন। আমি গরিব ছিলাম বলে রবীন্দ্রনাথের মতন সারা পৃথিবী ঘুরে, বিখ্যাত লোকেদের সঙ্গে মিশে, নেটওয়ার্কিং করতে পারিনি । রবীন্দ্রনাথের মতন জমিদার-ব্যাংকার-নীলচাষি দাদু ছিল না আমার । অথচ ভীতু কবিরা আমাকে বলছে ‘ক্ষতিকর’ -- তারা তো নিজেরাই সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কতো নেটওয়র্কিঙ করলেন, কোনও ফল হল না, কারণ কবিতার সত্য উনি অনুধাবন করতে পারেননি, যদিও ওকাম্পোর মতন এক বান্ধবী ছিল ওনার, মার্গারেট নামে । শংকর-এর ‘চৌরঙ্গী’ আর  ‘কত অজানারে’  চল্লিশের বেশি সংস্করণ হয়েছে, ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে ; সমস্যা হলো শংকর বিদেশে নেটওয়র্কিঙ করে উঠতে পারেননি, অতো টাকাকড়ি রোজগারের পরও । আমি জানি, কোনো শান্তিনিকেতন গড়ে যেতে না পারলেও আমি শান্তির কবি। আমার খ্যাতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে জগতজুড়ে । বিভিন্ন দেশের কবিরা আমার কবিতা অনুবাদ করছেন । আমি চাই যে আমার উপন্যাসগুলো বিদেশি ভাষায় অনুবাদ হোক । তাহলে ইউরোপ-আমেরিকার পাঠক জানতে পারবেন বাংলাভাষা কতো উন্নত, আমাদের দেশের উপন্যাস ইউরোপীয় ভাষাগুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে ।







                                                                                                           

                   

শনিবার

কিন্নর রায় : সেলিম মোরশেদের দিগগজগিরি

 

সুবিমল মিশ্র সম্বন্ধে সেলিম মোরশেদের উচ্চারণ আছে ব্যক্তিগত ইশতেহার যা সামষ্টিক ও হতে পারে’তে। তিনি বলছেন, ‘সাতশ বছরে বাংলা ভাষার ইতিহাসে সুবিমল মিশ্রের মতো এত ব্যাপক বেপরোয়া এবং গঠনমূলক ভাঙাচোরা আর কেউ করেননি।’

ফাল্গুনী রায়ের ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিশন’ বা সুবিমল বসাকের ‘ইমলিওলা’— নামটা ঠিক লিখলাম তো, কজনে পড়েছি আমরা। পুরো পড়ে, আত্মস্থ না করেই ভান করেছি অতীন্দ্রিয় পাঠিক বা অমল চন্দর গদ্য শৈলী, বিষয় নিয়ে চেষ্টা করেছি কথা কাকলি ফোটাতে?

হাংরি সাহিত্য আন্দোলন অনেকটা যেন সত্তরের প্রায় শেষ লগ্নে শতধ বিভক্ত হয়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া নকশালবাড়ি— রাজনৈতিক আন্দোলন। সবাই তখন ‘হম কিসিসে কম নেহি’। প্রত্যেকেই প্রায় সেন্ট্রাল কমিটি অথবা পলিটব্যুরো। আর কে কতখানি ঘনিষ্ঠ ছিলেন সি এম— চারু মজুমদারের তার বাখানিতে ব্যস্ত। অথবা একদা চারুবাবুর অতি ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখন কতটা চারুবাবু বিরোধী, তা প্রমাণে ব্যস্ত। আসলে বিজয়ীকে কেউ প্রশ্ন করে না। কিন্তু পরাজিত বা আপাত পরাজিতের দিকে ছুটে আসতে থাকে অজস্র প্রশ্ন। একের পর এক।

তখন চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল, অসীম চট্টোপাধ্যায়, সত্যনারায়ণ সিং, চন্দ্রপোল্লা রেড্ডিদের মধ্যে যে আপাত অন্তর্বিরোধ তা আর ফুটে উঠত না সেভাবে। কারণ আগেই লিখেছি, বিজয়ীকে কেউ প্রশ্ন করে না সাধারণ ভাবে, বরং তার স্তুতি করে।

শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর ‘ক্ষুধার্ত সংকলন’-এর ভূমিকাতে লেখেন—

এই ধরণের কথা উঠে আসে উত্তর-নকশালবাড়ি পর্বে। ১৯৭৫-এর ২৬ জুন সংসদ এড়িয়ে ভারতবর্ষের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা ইমার্জেন্সি বা জরুরী অবস্থার আগে পরে, ইমার্জেন্সি পর্বেও টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া সি পি আই (এম-এল)-এর নেতারা এভাবেই কথা বলতে থাকেন প্রায়। ফলে নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে ঘটনা ও মূল্যায়নের সময় জঙ্গল সাঁওতাল ও সৌরীন বসুর লেখার মধ্যে থেকে যায় অনেক অনেক ফারাক।

শৈলেশ্বর ও মলয়ের হাংরি তুলনা প্রতিতুলনা ও তথ্যের মধ্যে থাকে বহু ফারাক ও তীক্ষ্ণতা। ব্যক্তি ঈর্ষা, ব্যক্তিগত বিরোধ, পছন্দ-অপছন্দ অনেক সময় কাজ করে গভীরভাবে।

‘উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা, যে উদ্বাস্তু হয়নি তার পক্ষে বোঝা কোনোদিনই সম্ভব নয়। জীবনের এই ধ্বংসযজ্ঞ মধ্যে থেকেই এসেছিল সেদিন ঐ বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, সুবো আচার্য, প্রদপ চৌধুরী এবং শৈলেশ্বর ঘোষ। বাল্যকালেই তারা যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা নিয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা থাকে তাদের রচনায়। বাংলার সুদূর গ্রামগঞ্জ থেকে এসে কলকাতায় আকস্মিকভাবে মিলিত হয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে তারাই হাংরি জেনারেশনকে আন্দোলনে পরিণত করবে। তাদেরই সৃষ্টি দিয়ে। এবং করেছেও তাই।’

শৈলেশ্বর ঘোষের এই ভূমিকাংশ পড়তে পড়তে মলয় রায়চৌধুরীর আখ্যান ‘নামগন্ধ’, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, কবিতা গ্রন্থ ‘মেঘার বাতানুকূল ঘুঙুর’-এর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল সমর রায়চৌধুরীর ‘সিগারেটের তিরোভাব ও অন্যান্য’, ‘খুল যা সিম সিম’-এর কথা। আসলে সমীর না থাকলে মলয় হন না। সে সব অন্য প্রসঙ্গ, এখন থাক।

‘আনডারগ্রাউন্ড সিনেমা’ ও ‘আনডারগ্রাউন্ড লিটারেচার’ তৃতীয় বিশ্বের নানান দেশে খুবই বেগবান, শক্তিশালী।

আসলে সেলিম মোরশেদের বিষয় ও গদ্য চলনে আমাদের কারও কারও পড়ার টেবিলে গোপনে ভুলেদের কুণ্ডলী পাকান শঙ্খচূড় অথবা গোখরো, যা যে কোনো সময়ে মেলে ধরতে পারে ফণা— তার কুলোপানা চক্কর। এই আকস্মিকতায় দীক্ষিত পাঠক চমকিত— সচকিত হন না। বরং আক্রমণাত্মক ভাষা ও অ্যাগ্রেসিভ বিষয়ের মধ্যে দিয়ে তিনি আক্রমণ করতে থাকেন সব কিছুকে। এমন কি অস্তিত্বকেও।

‘যারা নিয়মিত বাণিজ্যিক কাগজগুলোয় লেখে (অবশ্যই তাদের লেখা একটা মান স্পর্শ করে) প্রতিষ্ঠান হাতের পাঁচ হিসাবে তাঁদের লেখা নিয়ে বলে, ভালো লেখাটাই বড় কথা। আর লেখকরা বলেন, আমাদের লেখার দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন যদি হুবহু ছাপে তবে আপত্তি কেন? আমারা আমাদের ব্যাপক রিডারদেরকে বঞ্চিত করব কেন? জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকতে গিয়ে কী পরিমাণ লেখক নিজেই লাঞ্ছিত হন, তা বলাই বাহুল্য। এই লেখকরা সাহিত্য সম্পাদকদের মুখের দিকে তাকিয়ে লেখেন। আহসান হাবিব ছাড়া এ যাবত কোনো উপযুক্ত এবং সৎ (যদি এই টোটাল প্রক্রিয়ার কোনো সৎ ও উপযুক্ত সাহিত্য সম্পাদক হবার কথা নয়) কোনো সাহিত্য সম্পাদক নেই। যারাই সাহিত্য সম্পাদক কোনো-না-কোনোভাবে লেখালেখির জগতে তারা ব্যর্থ।

‘এদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করলে আপনার লেখা তখন নিন্দনীয় হয়ে উঠবে; সমসাময়িক একজন দুর্বল লেখককে দুর্দান্ত বিশ্লেষণে শিল্পী বানিয়ে এর বিভ্রান্ত রুচির জন্ম দিয়ে আপনাকে ছোট করে রাখবে। আমরা  জানি, বিগত বিশ বছরে মধ্যবিত্ত জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-দর্শনে বুৎপত্তি লাভ করেছে। তার জীবন প্রক্রিয়ার ভেতর, বাস্তবতার ভেতর অনেক সপ্রতিভ অভিব্ব্যক্তি রপ্ত করেছে— এইসব করলেও শিল্প-সাহিত্যের টেস্টের ক্ষেত্রে ওই পুতু-পুতু— ধরা, বন্দি হওয়া, ঘোরে-পড়া, এমন ধরণের শিল্প কর্ম যারা পছন্দ করে, তাদের তরল রুচি বলব আমরা। কমিউনিকেটিং লেখা পাঠকরা চায়— পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ও মালিকরা এই কথা বলে আশি মিনিটে শেষ ওয়া একটি দৈনিকের সাময়িকীতে বিশ মিনিটের জন্য কমিউনিকেটিং গদ্য, কবিতা ছাপে। অনেক সময় বিনিয়োগ হিসেবে আধা-সিরিয়াস লেখা দুই-একটা ছেপে অজস্র বস্তাপচা লেখা ছাপার যৌক্তিকতা জায়েজ করে। এটা মোদ্দা কথা যে আমাদের দেশের বুর্জোয়ারা কোটি কোটি টাকা দিয়ে খবরের কাগজ বের করে কেন? এক : তাদের ব্যবসা এবং কালো টাকার ঢাল হিসাবে কাগজটি ভূমিকা রাখে— দুই : এখান থেকে প্রচলিত মূল্যবোধের ওপরই সে ব্যবসা করে। সেই ক্ষোভ আপনি লেখক হিসাবে কীভাবে প্রকাশ করবেন দৈনিকের পাতায়? প্রবীণ লেখকরা বলেন, ক্ষোভ খুব ছোট জায়গায় থাকে। বাণিজ্যিক মিডিয়ার লেখকরা বলেন, শিল্পিত করে ক্ষোভ প্রকাশ করলে বিরোধ কোথায়? কতোটা সুবিধাবাদী দেখুন তারা, ক্ষোভ নিয়ে সব সময় লিখতে হবে এমন কথা বলছি না। তবে ক্ষোভ শিল্পিত করে লিখতে হবে। এমন ধারা মাথায় নিয়ে তারা লিখতে বসেন। দেখুন, কারা সচেতন ভাবে অচেতন এবং স্বতঃস্ফূর্ত লেখার ভাব করে— এঁরা।’

এই মেয়া পরিচালকদের মধ্যে আছেন জ্যোতির্ময় দত্ত, অসিত পাল প্রমুখ। এই মেলাকে সমর্থন করছেন শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্তদের মতো পুরনো মানবেন্দ্রনাথ রায়-পন্থী র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্টরা, সাফল্য কামনা করছেন ‘মুক্তমেলা’-র। শক্তি, সুনীল, আসছেন এখানে। এই সময়টাতেই শিল্পী অসিত পাল হাসপাতালের গায়ে, ফাঁকা দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকছেন সাপ আর পদ্মফুল— প্রস্ফুটিত পদ্ম। দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ের কাছাকাছি চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের নীল দেওয়ালের গায়ে কালোতে সাপ আর কমল একই সঙ্গে আঁকছেন অসিত। তখন তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেন।

‘মুক্তমেলা’ কে ‘সি আই এ’-র চক্রান্ত বলে ঘোষণা করেন নকশালপন্থী যুব ছাত্ররা ধু-উ-ড়ু-ম, ধু-উ-ড়ু-ম শব্দে বোমা মারলেন সেখানে। ধোঁয়া, আগুন, বিস্ফোরণ। কলকাতার আকাশে তখন চক্কর দেওয়া যায় ‘এয়ার ইন্ডিয়া’-র বিমানে উঠলে। শুধুই কলকাতার আকাশটুকু। এই প্লেনে ওঠার জন্য কাটতে হয় টিকেট।

কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের আবস্থাও একই প্রায়, অর্থাৎ ছবিটা এক।

সেলিম মোরশেদ মনে করেন— ‘বহুলোক মনে করেন অপেক্ষাকৃত সৎভাবে স্বদ্দল থাকাটাও বোধহয় প্রাতিষ্ঠানিক জীবন-যাপন। তাঁরা মনে করেন, না খেয়ে থাকা উস্কোখুস্কো চুল, আর অপরিষ্কার প্যান্ট-শার্ট পরে সারাদিন উঞ্ছবৃত্তি আর গাঁজা-মদ-হেরোইনে আশক্ত থেকে, কোনো যূথবদ্ধ শ্রমের সাথে যুক্ত না থেকে জীবন পারাপারই বোধহয় প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। আমাদের কাছে এগুলোকে অনেক সময় প্রতিবাদের মতো মনে হলেও এগুলো আসলে ক্রেজ। ঠিক কোথায় আঘাত করতে হবে আমরা সেই লক্ষ্যমুখকে সনাক্ত করব ক্রিয়েটিভ এক্সপ্রেশন দিয়ে। ফলে একজন প্রতিষ্ঠান বিরোধী যথেষ্ট সচেতন। শুনে রাখুন, সচেতনতাকে প্রতিষ্ঠান পছন্দ করে না। আপনাকে কম বুদ্ধির লোক করতে পারাই তার লক্ষ্য। অবোধ-আজগুবি-উদ্ভট কথিত কল্পনাকে প্রতিষ্ঠান তারিফ করে তার ওপর লেবাস লাগায়। একজন প্রাতিষ্ঠানিক লেখক একবার আমাদের বলেছিলেন, একজন পাগল তোমাদের চেয়েও বেশি প্রতিষ্ঠান বিরোধী। কেন না সে এই সমাজের সব কিছুতে উদাসীন। বোঝা যায় পাগলের উদাসীনতা লেখকটির পছন্দ। অথচ এই উদাসীনতা কোনো সচেতন লোকের কাম্য নয়। সে সমাজে বাস করলেও সামাজিক ভালো-মন্দের দায়-দায়িত্ব সে নেয় না। ফলে পাগল সামাজিকভাবে শিকার। তার কোনো বিরোধিতা নেই।’

তিনি আমাদের জানান, ‘অধিকাংশ সাহিত্যসম্পাদক মদ্যপ, নারীসঙ্গ লিপ্সু এবং দুর্নীতিবাজ হয়ে থাকে। তারা চিত্রকরের কাছ থেকে পেইনটিং উপহার নেয়— বিনিময়ে তাদের ফলাও করে লেখা ছাপে। এই পেইনটিং নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য চাকরি থেকে রিটায়ারের পর গ্যালারি করে পেইনটিংগুলো বিক্রি করবে। ভাবুন কত নির্লজ্জ তারা। আর এই ধরণের লোকের বাড়িতে লেখকদের বাজার পর্যন্ত করে দিতে হয়। তারপরও সাহিত্য সম্পাদকদের আওতাহীন হয়ে অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েও লেখকরা লেখেন। এরাই প্রতিষ্ঠানের পোষ মানা লেখক।’

প্রতিষ্ঠান নামের চিহ্নিত যাম ও তোরণদের অনায়াসে অস্বীকার করেন এই লেখক। তাঁর ‘সাপলুডো খেলা’ নামের উপন্যাসিকায় দেখি— সেই সঙ্গে পড়িও—

‘কাল কত তারিখ?’ কথা বলার তেমন ইচ্ছে ছিল না সলোমানের, নেহায়েত প্রয়োজনেওই সহকারীকে সে প্রশ্ন করল; তার কণ্ঠস্বর ছিল শীতলতায় পূর্ণ।

‘ছাব্বিশ।’

‘পাওয়ার হাউস থেকে বরাদ্দকৃত মইটি পেতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে আবে। ‘নয়’ উগ্র হয়ে ওঠে অন্ধকারে। কাল সন্ধ্যার পর তারা পিলারে দুর্ঘটনায় পড়বে।

‘…রিলিজিয়ন উদারতার নামে রাষ্ট্রকে সেক্যুলার রাষ্ট্র বলে চালানো হচ্ছে। স্টেট যেখানে রিলিজিয়নের পৃষ্ঠপোষক সেখানে সেক্যুলারিজিমের অর্থ বিকৃত করা হচ্ছে। রিলিজিয়ন বিষয়টি অন্তর্গত। স্টেটকে ভূমিকা শূন্য হতে হবে।’

‘আশি সালে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার এক নাতিশীতোষ্ণ বিকেলে পশ্চিম আকাশ জুড়ে দেখা দেওয়া বেগুনি রঙ আর ডোরাকাটা বাঘের মতো তরতাজা মেঘগুলো একে একে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল উত্তরদিকে। ইতোমধ্যে সে স্কোয়াড্রন লিভার (পাইলট কোর)-এর প্রাপ্য সম্মানের স্বত্বাধিকারী; রাশি রাশি সুখস্বপ্নে গতিশীল আর ‘কৃতকর্মই মানুষকে নির্ধারিত করে দেয় তার আপন গন্তব্য’— এই ধারণায় সতত গতির মুখোমুখি দাঁড়াত ছুরির ফলার মতো ছাব্বিশের জুবায়ের আহমেদ, কালো ঘন ভ্রু জোড়া ভ্রুর অনমনীয় চিত্তের যুবকটি তার বিশ্বাসের ক্ষেত্রসমূহ নিয়ত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উন্মুল করে দিত। কথিত সংস্কারের তাবৎ রক্ত পুঁজমুখ; তার বিশাস আর তার যুক্তির প্রবল্য এতই দৃঢ়তর ছিল যে তার বন্ধুদের কেউ কেউ তাকে রীতিমতো লৌহমানব বলে চিন্তা করতে শুরু করেছিল। এমন কি সে তাই কজেনেছিল আর পর্যায়ক্রমে নিজেকে তৈরি করেছিল এক জন নাস্তিক হিসেবে।

দিনটি তার মৃত্যু অবধি স্মরণীয় কেননা ওই দিনেই তার প্রথম অভিজ্ঞতা হয় যুদ্ধ-বিমান চালনার; সেই বৃহস্পতিবারে পিটি-সিক্স আর মিগ টুয়েন্ট ওয়ানের দুর্দান্ত প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ছয় ফুটের দীর্ঘাকৃতির ইব্নে আজিজ, আফ্রিকান, পরবর্তী কালে যার বসবাস হয় ইরাকের নিভৃত অঞ্চলে। প্রশিক্ষক হিসাবে সারা দুনিয়ায়ই তিনি ছিলেন তুলনাবিহীন একজন মানুষ এবং যার বিশ্বাস ছিল : আহম্মদিয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানী (১৮০৫-১৯০৮) ইমাম মেহেদী ও মসীহ মাউদ হবার যে দাবি করেন তা যথার্থ। আর অবশ্যই ফিরিশতারা তাকে সেই সময় পরিবেষ্টন করে রাখত।’

ফলে ইরাক ও তুরস্ক-সহ অন্যান্য ইসলামিক রাষ্ট্রে কুর্দ ও ইয়াজেদি উপজাতির ওপর হামলা হয়। মূল হামলাকারী কখনও রাষ্ট্রশক্তি, কখনও ‘আই এস আই এস’। মৌলবাদী ‘বোকো হারাম’ নির্যাতন চালায় নারী ও শিশুদের ওপর। তাদের পণবন্দি— জব্দ করে।

মোহাজির মুসলমানরা নির্যাতিত হন পাকিস্তানে। ইনডিয়া থেকে পার্টিশানের আগে পরে যাঁরা পাকিস্তানে চলে গেছেন, মজহবের আনুকূল্য পাবেন বলে, আজও তাঁদের সন্দেহের চোখে চোখে দেখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রশক্তি।

ভারতে অন্ধ শক্তি ভেঙে দেয় বাবরি মসজিদ, ১৯৯২–এর ৬ ডিসেম্বর। তথাকথিত রাম মন্দির নির্মাণের ধুয়ো তুলে মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠ, আবার খাবারের, খাদ্যের ন্যায্য দাবিকে নস্যাৎ করা হয়। কৃষকদের বঞ্চিত করা হয়।

পাকিস্তানের ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াঁদাদ আর একদা পাকিস্থানি প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ সাহেব কী মোহাজির হিসাবে থাকেন সন্দেহ তালিকায়, স্ক্যানারে?

সেলিম মোরশেদের লেখা পড়তে পড়তে হা-অন্ন তৃতীয় বিশ্বের একজন মানুষ হিসাবে, অতি সাধারণ আখ্যানকার হিসাবে মনে এল এইসব কথা। জিজ্ঞাসা। আর তাঁর কথাযাত্রা, আখ্যানসমূহ পড়তে পড়তে অনুভব করি এইসব তথ্যমালা, যা আমার কাছে বড়সড় এক জিজ্ঞাসা চিহ্ন এবং একই সঙ্গে হারিকিরি— কাচ ফলা হয়ে দাঁড়ায়।

       

           

               

সোমবার

বুড়ো বয়সে ঢুকে পড়লেন ক্ষমতাসেবীর দলে

 

” একজন যিনি কবি হযে় উঠতে চান, তার আত্মবিমোচন পদ্ধতি শুরু হতেই যদি বুঝে যান যে তিনি ক্ষমতার বিপক্ষের লোক নন, তিনি ক্ষমতার পক্ষের লোক; তিনি যে ভাষা পেতে চান সেটি ক্ষমতাকে বিরূপ করে তুলবে — তখন শুরু হয় তার ত্রাসের কাল | ভাষা বিমোচন তো দূরের কথা, এই সংঘর্ষের ক্ষেত্রটি থেকে পলায়নই তার বাঁচার পথ হয় | এমন রচনাকার আমরা দেখেছি যিনি ক্ষমতার ভাষাকে আঘাত করার আপাত একটা মানসিকতা দেখাচ্ছেন কিন্তু অনতিকালেই তিনি ওই পথ ত্যাগ করতে বাধ্য হন | তিনি ঢুকে পডে়ন ক্ষমতাসেবীর দলে |”

শৈলেশ্বর ঘোষ (ভাষা বিমোচন)


শুক্রবার

Kausik Sarkar


 

Kausik Sarkar


 

Kausik Sarkar


 

Kausik Sarkar


 

শনিবার

মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস সম্পর্কে সুরজিৎ সেন-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গৌতম সেনগুপ্ত

মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস সম্পর্কে সুরজিৎ সেন-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গৌতম সেনগুপ্ত গৌতম সেনগুপ্ত: মলয় কী এমন লেখক যে ওঁর লেখা পড়তে হবে ? মানে কেন পড়ব ? সুরজিৎ সেন: কী পড়ব, কেন পড়ব বা পড়ব না --- এটা পাঠকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর অমুক জিনিস পড়তেই হবে, না পড়লে চলবে না --- এটা মডার্নিজমের সমস্যা। ইচ্ছে হলে পড়বেন, না হলে পড়বেন না।আর তাছাড়া আমি তো বাংলা সাহিত্যের জেলা-কমিটির মেম্বার নই যে গাইডলাইন অনুযায়ী ভালো-খারাপ বলতে না পারলে, আমায় কন্ট্রোল কমিশানের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তার চেয়ে একটা গল্প বলি শুনুন, দীপকদা, মানে দীপক মজুমদার, সমাজের প্রান্তবাসী অর্থাৎ মার্জিনালদের কথা বলতে গিয়ে আমায় গল্পটা বলেন। গল্পটা উনি শুনেছিলেন প্যারিসের এক ভবঘুরের কাছ থেকে। গল্পটা এরকম। দেবদূত কাথকাদ একদিন আকাশের গলিঘুঁজি পেরিয়ে, টাল খেয়ে, টপকে একটা আকাশছোঁয়া বাড়ির চুড়োয় গিয়ে দাঁড়াল। তারপর লাফ দিল নিচের অস্পষ্ট পৃথিবীর দিকে। নিচের পৃথিবী থেকে ভেসে এল অসংখ্য হাততালি, সেই সব দর্শকদের যারা ভেবেছিল এটা আত্মহত্যা। কাথকাদ ওই হাততালিকে অভিনন্দন বলে ভুল ভেবেছিল। এর পর সে আকাশচুড়ো থেকে লাফ দেয়াটাকে রীতিমত অভ্যাসে পরিণত করে ফেলল। ব্যাপারটা বুঝে শহরের মেয়র আঁতকে উঠলেন। এ-ধরণের জিনিস যদি শিশুরা নকল করতে শুরু করে ? কাথকাদকে গ্রেপ্তার করা হল। একটা দমবন্ধ-করা ঘরে রিসেপশানিস্টরা তাকে সেই চেয়ার এগিয়ে দিল, যেটা তার ডানা দুটো রাখার পক্ষে উপযুক্ত নকশায় তৈরি নয়। ইতিমধ্যে মেয়র ও শহরের অন্যান্য কর্তাবাবারা বিচার করে রায় দিল যে, কাথকাদ এক মহা চালিয়াত, তার ডানা দুটো আসলে তার পঙ্গুতারই নিদর্শন। সেই আত্মধিক্কার থেকেই লোকের নজর কাড়ার জন্যে সে এইসব কসরৎ দেখায়। সদ্ধান্ত হল: কাথকাদের গন্ডগোল আছে। ছয়ের দশকের শুরুতে মলয় কাথকাদের মতই লাফ মারেন বাংলা সাহিত্যের পৃথিবীর দিকে। ওই দশকের মাঝামাঝি বাংলা সাহিত্যের মেয়র ও অন্যান্য কর্তাবাবাদের কলকাঙিতে 'অশ্লীল' কবিতা লেখার দায়ে গ্রেপ্তার হন। এবং সিদ্ধান্ত হয় মলয়ের গন্ডগোল আছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যে. ছয়ের দশকের মাঝামাঝি, বাংলা সাহিত্য তখন যথেষ্ট সমৃদ্ধ [ অবশ্য জীবনানন্দের উপন্যাসের কথা তখনও জানি না, কমলবাবুর উপন্যাস বা আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস তখনও লেখা হয়নি], বামপন্হী আন্দোলন তখন আন্তর্জাতিক তত্ত্বের কচকচিতে ভর্তি, শিল্প-সাহিত্য তখন ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের নিত্যনতুন থিয়রির চর্বিতচর্বণ। সব মিলিয়ে ভাবখানা এরকম, যে, পশ্চিমবাংলা মননের দিক দিয়ে ভারতের সবচেয়ে আধুনিক রাজ্য, ওদিকে সত্যজিৎবাবুরও রমরমা। কিন্তু মলয়ের গ্রেপ্তারের মধ্যে দিয়ে বোঝা গেল সমস্ত ব্যাপারটা কী সাংঘাতিক ভিকটোরিয়ান ছিল। আধুনিকতা-ফতা সব ফালতু। অনেকদিন আগে মলয়ের একটা কথা পড়েছিলাম যে, "আধুনিকতা এক ধ্রুপদী জোচ্চোর"। এর মানে আজ বুঝতে পারি। এ হল ইউরোপিয় এনলাইটেনমেন্ট প্রসূত আধুনিকতা--- যা দিয়ে শাসকপ্রভূদের কলোনিমনন তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। যাতে প্রভূদের শিখিয়ে দেয়া গাইডলাইনের বাইরে কেউ কিছু না ভাবে। মলয় বাংলা ভাষায় লেখালিখির মধ্য দিয়ে ব্যাপারটায় একটা টোকা দেন। তাতেই হৈ হৈ ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত নকশালরা এই ব্যাপারটিকে ধাক্কা দেয়। পরে অবশ্য তারা আরেক ধরণের ভিকটোরিয়ানিজমের জন্ম দেয়। যা হোক, মলয় যে তখন থেকেই মেইনস্ট্রিমের বাইরেই রয়ে গেছেন --- মানে বুঝতেই পারছেন ছয়ের দশকের মেইনস্ট্রিম আর নয়ের দশকের মেইনস্ট্রিম --- এক নয়। এই জন্যেই মলয়ের লেখা পড়া দরকার। গৌতম সেনগুপ্ত: এত মেটাফরে কথা বললে তো খুব মুশকিল। মলয়ের গল্প-উপন্যাসের বৈশিষ্টটা কী ? যেখান থেকে ওই লাফ-টাফ বা কাথকাদের কথা আসছে। সুরজিৎ সেন: মেটাফরেই তো কথা বলতে হবে। জানেন না কোথায় বাস করছি ? যাকগে, যা বলছিলুম, শাসকপ্রভূরা আমাদের জন্য তৈরি করে দিয়ে গেছেন ভাষা-কাঙামো, পদ্ধতি, বিন্যাস। এই দিয়েই যাবতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি। মলয় গল্প-উপন্যাসে শুরু থেকেই ওই মাস্টারদের তৈরি ল্যাঙ্গোয়েজ-জেল ব্রেক করে বেরোবার চেষ্টা করেছেন। কারণ লেখালিখির শুরুতেই যে ভাবেই হোক না কেন, বুঝতে পেরেছিলেন মলয়, যে, নেহেরুভিয়ান সরকারি খরচে যে বিশাল কেরানি-আমলা সমাজটির বাড়বাড়ন্ত, তাদের জন্যে উপনিবেশের ডিমটি ফেটে বেরিয়ে পড়েছেন কমার্শিয়াল কথাসাহিত্যিকরা, আধুনিকতার দুরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে।এই মানচিত্রের বাইরে মলয় চলে যেতে পেরেছেন। অবশ্য তার মানে এই নয় যে মলয় কোনও নবদিগন্ত উন্মোচন করেছেন। কিন্তু কতকগুলো ব্যাপার আছে। লেখার ব্যাপারে মলয় কাউকে পরোয়া করেন না, এমনকি নিজেকেও নয়। লেখার মধ্যে দিয়ে তত্ত্ব বিক্রি করেন না, আর প্রগতিশীল বামপন্হী হবার লোভ কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। মলয় বোধহয় বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক যাঁর বইয়ের কোনো কপিরাইট থাকে না। এটা উনি করতে পেরেছেন তার কারণ গল্প-কবিতা-উপন্যাস লিখে কোনওদিন কোনও লেখক-প্রতিষ্ঠা চাননি--- মানে লেখক নিজেই একটি ব্র্যান্ড নেম, তাঁর লেখার প্যাকেজিং, রিভিউ ডিজাইন, সেলেবিলিটি, মিডিয়া হাইপ--- মলয় এসব চাননি। সোজা কথায়, লিখে বাড়ি গাড়ি বউ রাঁঢ় ট্রাকটর এসব করতে চাননি। এরপর প্রশ্ন উঠবে, চাইলেই কি পেতেন ? জানি না। খুব বড় সরকারি চাকরি করতেন --- এসব নিয়ে যাতে ভাবতে না হয়। সেই মেধা, যোগ্যতা ওঁর ছিল। আর এই দুহাজার সালেও তো বাংলা গল্প-উপন্যাসের পাঠক হিসেবে ৬০ পেরিয়ে-যাওয়া মলয়ের উপরউ ভরসা করে আছি। অথচ আমি চাই আমার বয়সের (৩৮/৩৯) কোনও লেখকের উপর ভরসা করতে। পারছি কই ? কেউ তো নজরে পড়ছে না। গৌতম সেনগুপ্ত: এ তো গেল মলয়ের গদ্য ইন জেনারাল, কিন্তু 'নামগন্ধ'টা নিয়ে আলাদা করে… সুরজিৎ সেন: মলয়ের প্রথম উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস', দ্বিতীয় উপন্যাস 'জলাঞ্জলি', তৃতীয় 'নামগন্ধ'--- একটা জার্নি 'ডুবজলে' শুরু হয়ে ভায়া 'জলাঞ্জলি' শেষ হচ্ছে 'নামগন্ধ'-এ। কিসের জার্নি ? না, অরিন্দম বলে একটি ছেলে খুব বড় সরকারি চাকরি করে পাটনায়, পাটনা থেকে বদলি হয়ে আসছে কলকাতায়। অবশ্য এর মানে এই নয় যে উপন্যাসগুলো আলাদা করে পড়া যাবে না। পড়া তো যাবেই; কারণ প্রতিটি উপন্যাসই স্বয়ংসম্পূর্ণ। অরিন্দম কলকাতায় আসার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের কথকতা শুরু হয়ে যায়। বালির ভোটবাগানে বজরং মার্কেটের (এশিয়ার বৃহত্তম স্ক্র্যাপ আয়রনের বাজার ) দখলদারির জন্যে একটা খুন দিয়ে উপন্যাসের শুরু। আর যা দলটি খুন করছে তাদের একজনের সবুজ টিশার্টে সাদা হরফে লাখা 'ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে'। মলয় কিন্তু আমাদের চারপাশের ভায়োলেন্সটাকে সব সময় লিখছেন। আর এই উপন্যাসে রিয়েলিটি আর প্রতীকের একটা নকশা তৈরি করেছেন। রিয়েলিটি হল, আদিত্য বারিক, যে, পুলিশের এ এস আই-এর চাকরি পেয়েছে, 'ওর আদর্শ হল রুণু গুহনিয়োগী নামে একজন প্রাক্তন অফিসার, যদিও তার সঙ্গে আদিত্যর পরিচয় নেই, কিংবদন্তি শুনেছে, কাগজে পড়েছে, আদালতে গিয়ে দেখেছে সহকর্মীদের সঙ্গে, জয়ধ্বনি করেছে, যখন অযথা বিচার চলছিল লোকটার। জ্যোতি বসুর মতন কর্মজীবী মুখ্যমন্ত্রী ওব্দি রুণু স্যারের কদর করে পদোন্নতির ধাপ একের পর এক এগিয়ে দিয়েছিলেন ওনার দিকে'। ( নামগন্ধ পৃ ৫ )। আপনি তো জানেন রুণু গুহনিয়োগী কে ? কী ব্যাপার ? আর প্রতীকটা হল ওই 'ভ্রূপল্লবে...', আশা করি বুঝেছেন। এখনকার পশ্চিমবঙ্গের সার সত্যটি মলয় জানিয়েছেন এই ভাবে, 'এ এস আই-এর চাকরি পেয়ে নিজেকে সুসজ্জিত করে তোলার অভ্যাসে কিছুটা রদবদল করেছে ও, আদিত্য। এখন ও জনসনের বেবি পাউডার, বাচ্চাদের সাবান, শ্যাম্পু, শিশুদের ক্রিম আর অলিভ অয়েল ব্যবহার করে। আগেকার এক আই জি, এখন দুটো কারখানার মালিক, শিখিয়ে ছিলেন জীবনদর্শনটা। নিষ্পাপ থাকার নিজস্ব গন্ধ আছে, বুঝলে হে, পুলিশ অফিসারের উচিত সেই গন্ধটাকে সবচেয়ে আগে দখল করা। ফি বছর পুজোয় অধস্তন অফিসারদের জন্য শিশুদের ব্যবহার্য সাবান-পাউডার-ক্রিম-শ্যাম্পুর সারা বছরের কোটা উপহার পাবার ব্যবস্হা করে দিতেন উনি...। আদিত্যর এখনকার চাকরিটা মাঙনায় হয়নি। দেড় লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছিল। বাড়ি বয়ে একজন প্যাংলা ডাকমাস্টার জানিয়ে গিয়েছিল কার সঙ্গে কখন দেখা করলে চাকরিটা হবে। ডাকমাস্টারহীন বাঙালিসমাজ ভাবা যায় না। এরা থানার জন্য টাকা তোলার অঞ্চলভিত্তিক ঠিকেদারি নেয়।পুলিশে ঢোকার আগে আদিত্য জানতোই না যা তথ্য আর সংস্কৃতির এরা বাঙালিজীবনে চাবিকাঠি' (নামগন্ধ পৃ ৭)। উপন্যাসের অন্যতম মহিলা চরিত্র খুশি, ভারতের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে যার বয়স পঞ্চাশ। খুশি তার নিজের দাদার বাড়ি চাকরানী হয়ে বন্দি। দাদা ভবেশ এখন গ্রামের রাজনীতির দন্ডমুন্ডের কর্তা। খুশির আজও বিয়ে হয়নি। প্রথম বিয়ের সম্বন্ধ হয় ১৯৭১ সালে, হবু বরের মুণ্ডহীন ধড় পাওয়া যায়--- সে নাকি নকশাল ছিল। দ্বিতীয় হবু বর সফল আড়তদার হঠাৎ পুড়ে মারা যায়। শেষ অবধি পূর্ব পরিচিত যিশু বিশ্বাস খুশির প্রেমে পড়ে তাকে দাদার হাত থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে ডাকাত সন্দেহে গণপ্রহারে মারা যায় গ্রামবাসীদের হাতে। খুশি যেন আমাদের ভারতবর্ষ। যারাই তাকে উদ্ধার করতে যায় তাদের কপালে বোধহয় অপঘাতে মৃত্যুই লেখা আছে। অরিন্দম বর্ণহিন্দু, আদিত্য নমশূদ্র, যিশু খ্রিস্টান । উপন্যাসের শুরুর খুনের পরেই আমরা দেখি ১৮/১৯ বছরের একটা ছেলেকে একদল লোক পিটিয়ে মেরে ফেলছে এবং তারপর 'ছেলেটা মরে গেছে নিশ্চয়। তবু ওকে পিটিয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। মৃতদেহ পিটিয়ে তার জীবন্ত অতীতের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা খুঁজছে লোকগুলো। অরিন্দম পড়ে গেছে সেই ভাষাসন্ত্রাসের খপ্পরে'।(নামগন্ধ পৃ ৭)।আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসীরাও কিন্তু এই ভাষাসন্ত্রাসের খপ্পরে পড়ে গেছি। ইংরেজরা লুটে-পুটে খেয়ে, ভাষার কিছু প্রণালিবদ্ধ কাঠামো অন্যান্য উচ্ছিষ্টের সঙ্গে আমাদের জন্য রেখে যায়।যেমন ইংরেজি Bitter Experience শব্দটির বাংলা হল 'তিক্ত অভিঞ্জতা' । মানে খুব খারাপ কিছু প্রত্যক্ষ বা অনুভব করা। অথচ আমাদের বাঙালি জিভে উচ্ছে নিম করলা সুক্তো--- এই সব তিক্ত স্বাদ বা অভিঞ্জতা খুবই উপাদেয়। যেহেতু সাহেবরা Bitter Experience বলতে খারাপ কিছু বোঝায়, তাই আমাদের ভাষাবিদরাও খারাপ কিছু বলতে 'তিক্ত অভিঞ্জতা'ই বুঝেছেন। ছোটগল্প-উপন্যাস বলতে কী বোঝায়, অক্সব্রিজসরবনের সাহেবরা যেমন-যেমন বলে গেছেন, আমাদের শিক্ষকরা বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছেন। আজ সেই মৃত ভাষাটিকে হাজার পিটিয়েও তার জীবন্ত অতীতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে না। মলয় তাঁর লেখালিখির শুরু থেকেই এটা ধরতে পেরে সেটাকে ফাঁসিয়ে দেবার চেষ্টা করে গেছেন বরাবর। 'নামগন্ধ'ও তার ব্যতিক্রম নয়। আর রসবোধ--- যেটা বাংলা লেখালিখিতে ক্রমশ বিরল হয়ে এসেছে, সেটার একটা চমৎকার সূক্ষ্ম ব্যবহার মলয় করেছেন তাঁর উপন্যাসগুলোয়। এমনিতে মলয়ের লেখার কোনো মডেল নেই। চরিত্ররা নিজেরা নিজেদের গুরুত্বহীনতায় ভোগে, ভঙ্গুর, টাল-খাওয়া, পোস্টকলোনোয়াল মতদ্বন্দ্বের, জটিলতার, আলাপচারিতা--- এই হল মলয়ের লেখা। এই ভঙ্গীটা আমাদের ভাষায় নেই বললেই হয়। আর এই জায়গা থেকেই জমে যায় মলয়ের উপন্যাস। 'হিমঘরের পিওনটাও চড়া দামে বন্ড কেটেছে ইউনিট ম্যানেজারের চোখের সামনে। পিওনটা গ্রুপ থিয়েটার করে। ওদের নাটক দলটার নাম প্রতিবাদী সভা। একাডেমিতে নীলদর্পণে ভালো অভিনয় করেছিল'--- ( নামগন্ধ পৃ ৯৫ ) ক্লাস।এই হিমঘর---আলু চাষির দুর্দশা---আলু পচে যাওয়া---বামপন্হীদের বদমাইসি--- এই সব পাবেন 'নামগন্ধ' উপন্যাসে। সত্যিই একটা নিষিদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের ছবি। আম কেমন খেতে সেটা শোনার চেয়ে খেয়ে দেখা ভালো--- সোজা কথা, উপন্যাসটা পড়ে ফেলুন।

পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্য

মলয় রায়চৌধুরীর প্রধান দৃষ্টিকোণ ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার । আর সেই সঙ্গে মলয় ‘সাহিত্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । মলয় রায়চৌধুরী মনে করেন, ‘প্রতিষ্ঠান একটা প্রক্রিয়া । প্রতিষ্ঠান কোনো অরগানাইজেশান নয় । তা চাগিয়ে ওঠে শাসনের মূল্যবোধ থেকে । মলয় আরও বলেছেন, এই ইনট্রিনজিক ফ্যাসিজমই এসট্যাবলিশমেন্ট ।’ সব মিলিয়ে এটাই দাঁড়ায়, , মলয়ের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতা । আর প্রতিষ্ঠান মানে শাসকের, শাসনের মূল্যবোধ । মলয় প্রতিষ্ঠান বলতে কোনও দল, আমলাতন্ত্র, চার্চ-মসজিদ, হিন্দুধর্মকেন্দ্র, শিক্ষাব্যবস্হা ইত্যাদিকে পৃথকভাবে নির্দিষ্ট করেন না ; করেন মূল্যবোধকে । শাসনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমাজ ও জনসমাজ যে-মূল্যবোধ, তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে দমননীতি-সম্মতির বিভিন্ন হাতিয়ারকে ব্যবহার করে, তাকেই মলয় প্রতিষ্ঠান ভাবেন, এবং তা একটি প্রক্রিয়া । প্রতিষ্ঠান এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সে তার কর্ষিকাগুলি ছড়িয়ে দেয় । রাষ্ট্র থাকলে যেমন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থাকবে, সমাজ -- সে রাষ্ট্রীয় বা জন যাই হোক, থাকলেই প্রতিষ্ঠান থাকবে । আর প্রতিষ্ঠান থাকলেই তার কর্তৃত্ব থাকবে , যে-সমাজে প্রতিষ্ঠানটি শিকড় গাড়ে, শাঁসে-জলে বাড়ে, তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য হিংস্র ও অহিংস্র নানা উপায় সে অবলম্বন করে । এর বিরুদ্ধে লড়াই তাই মূল্যবোধের, চৈতন্যের । আর এ লড়াই সার্বিক ; ব্যক্তিগত ও বৃহত্তর মাত্রা উভয় স্তরেই । মলয়ের জীবনকাহিনির যেটুকু অংশ তাঁর লেখাতেই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এই লড়াইয়ের একটা ছবি পাই । অবশ্য এ বৃত্তান্ত পরবর্তী সময়ের, ১৯৬১-১৯৬৫-এর মধ্যে তিনি তরতাজা যুবক হিসাবে কী ভাবতেন, তা জানা যায় না । সেই সময়ের দিনপঞ্জিকাটি থাকলে আরও বোঝা যেত । কারণ ওই যে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠান একটা প্রক্রিয়া, একটি মূল্যবোধ, তাতেই স্পষ্ট ১৯৬১-৬৫-এর মলয় রায়চৌধুরী আর ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মলয় রায়চৌধুরী যেমন এক নন, তেমনি সেই সময়ের প্রতিষ্ঠান আর এখনকার প্রতিষ্ঠান, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে হুবহু এক নয় । ১৯৬৫ থেকে ২০০০-এর মধ্যে এখানে সময় খুব দ্রুত এগিয়েছে-পিছিয়েছে, একটা অপরিবর্তনীয় গতিতত্বে যেন নানা ওলটপালটের মধ্যে আবার আগের স্হিতাবস্হায় ফিরে গেছে, কিন্তু আরও চরিত্রহীন, আরও নপুংসক হয়ে । আমরা যারা মলয়ের সমবয়সী প্রায়, তাদের কাছে ১৯৬১-১৯৬৫-এর মলয়ের নৈরাজ্যিক প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, ওই সময়ে নঞর্থক মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল সামাজিক দায়হীন । কিন্তু আজকের অবসন্নতায় ওই বিদ্রোহকে সদর্থক মনে হয় । বিশেষ সময়ে অ্যানার্কিও তো সদর্থক বৈপ্লবিক হতে পারে । মলয় রায়চৌথুরীর ১৯৬০র দশকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ও তারপরে নীরব থেকে ১৯৮০র দশকে অন্যভাবে দেখা দেওয়া, আমাদের মধ্যবিত্ত বিদ্রোহের এক প্রতীকি চিত্র । সেই ১৮২০-৩০এর দশকের ডিরোজিয়ানদের সময় থেকেই এই পরম্পরা আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেনিতে আছে । ওই বিদ্রোহটাও যেমন সত্যি আবার প্রতিষ্ঠানে ঢুকে যাওয়াও তেমনি সত্যি । উপনিবেশ ও ১৯৪৭-এর পরের অব-উপনিবেশের বাস্তবে ক্রিয়াশীল উৎপাদন সম্পর্কশূন্য বৃহত্তর জনসমাজ ও জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগত ও ব্যক্তিগত এই বিদ্রোহ , এই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে তুচ্ছ করা অনৈতিহাসিক, কারণ মধ্যশ্রেনির ইতিহাসের নিরন্ধ্র অবসন্নতা ও করুণ আত্মসমর্পণে, ট্র্যাজেডি নয় ফার্সে, এই ক্ষণস্ফূলিঙ্গগুলিই একমাত্র বাঁচবার ইঙ্গিত । এদের ব্যক্তিক ও গোষ্ঠীগত ব্যর্থতা প্রায় অনিবার্যই ছিল । তবু, তারা যে কম্পন নিয়ে এসেছে, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে হয় । মলয় রায়চৌধুরীর নিজের সাক্ষেই বোঝা যায়, একটা টানবাপোড়েন গোড়া থেকেই ছিল । মলয় দেখাতে চেয়েছেন তিনি প্রায় স্কুলে পড়াশুনা ন-করার ভূমি থেকে এসেছেন । তাঁর দাদা সমীরই তাঁদের বাড়ির প্রথম স্কুলে-পড়া, কলেজে-পড়া । অর্থাৎ যে ঔপনিবেশিক শিক্ষায় বাঙালি মধ্যবিত্ত জারিত, তার শেকড় তাঁদের পরিবারে ছড়ায়নি, তাঁর প্রজন্মেই এর সূত্রপাত । কিন্তু ওই প্রথম প্রজন্মেই এই শিক্ষার ধার তীক্ষ্ণ হয় ; ‘এদিকে মলয় আমার ছোটোভাই তখন অর্থনীতির স্নাতকোত্তর ক্লাসের শেষ বছরের ছাত্র । সারাদিন ঘাড় গুঁজে বিস্তর বই পড়ে ; সমাজ নিয়ে, পৃথিবী নিয়ে অনেক ভাবনা, কথায়-কথায় এঙ্গেলস, কিয়ের্কেগার্দ, মার্কস, স্পেঙ্গলার ইত্যাদি থেকে উদ্ধৃতি দেয় । পাটনায় গেলে আমাকে কেবলই বলে, “সাহিত্য এইভাবে এলোমেলো হয় না ; একটা পরিকল্পনা মতো এগোনো উচিত । কী বলতে চাও, করতে চাও, সবার আগে সেটা ঠিক করো, আন্দোলন চালাও । আন্দোলন দরকার।”...’ সমীরের এই ছবিতে কোনও নৈরাজ্যবাদী মলয়কে পাই না । বরঞ্চ ইয়োরোপমুখী এক যুবককে, যে পরিকল্পনা চায় । এই যুবক অব-উপনিবেশের যুদ্ধ-দাঙ্গে-দুর্ভিক্ষ-দেশভাগ ধর্ষিত কলকাতায় এসে পালটায়, কলকাতা তাঁকে পালটায় । তাঁর অ-নাগরিক অভ্যাস কলকাতায় বেমানান -- কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত অ-নাগরিক অভ্যাসকে তিনি প্রলেতারিয় ভাবছিলেন । নিজেকে শ্রেনিচ্যূত করতে চাইছিলেন । আর এই জন্যই একটা জীবনযাপন বেছে নিয়েছিলেন যা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের পক্ষে দুঃসহনীয় । ঠিক যেমন একদা ডিরোজিয়ানরা বেছেছিলেন -- তখন মদ্যপান, গোমাংসভক্ষণ ছিল হিন্দু ভদ্রলোকের পক্ষে ক্রোধের কারণ, যদিও অনেক ভদ্রলোকই আড়ালে মদ্যপায়ী, বেশ্যাগমনে অভ্যস্ত । । কিন্তু ডিরোজিয়ানরা এসব করছিলেন প্রকাশ্যে, একটা বিদ্রোহের আদলে। মলয় নিজেদের অবস্হাকে বলেছেন ‘ষাট দশকীয় ফাটিচার’ । কলকাতার সাহিত্য মহলে আর্টেমিস-ক্রেসিডা-ইউলিসিস এসব নামে অস্বস্তিবোধ করতেন তিনি, কিন্তু “আমাদের মগজে রেজিস দেবরে, আরনেসতো চে ভারা, ফিদেল কাসত্রো নামগুলো বরঞ্চ মিহিন ঘণ্টাধ্বনি শোনাচ্ছে ।” এঁরাও সকলেই বিদেশের -- তবে অন্য ভূবনের । ষাট দশকের কলকাতার বিপরীত টানেই পাটনার সিরিয়াস যুবক মলয় রায়চৌধুরী তাঁর প্রতিষ্ঠাবিরোধিতার নৈরাজ্যিক আকাশে মুক্তি চাইলেন । এই কলকাতাই তাঁকে বুঝিয়েছিল, ‘ষাটের দশকে সুস্হতা সত্যিই অবাস্তব ছিল।’ মলয়ের এই সিদ্ধান্ত ইতিহাস-বোধে উজ্বল। ষাটের দশকে যে সুস্হভাবে বাঁচা অবাস্তব ছিল, তার প্রমাণ সেই দশক জুড়ে নানা ধরনের বিদ্রোহ যার শীর্ষবিন্দু নকশাল অভ্যূথ্থান । মলয়দের আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনের একদিকের পূর্বাভাস । তিনি দেবরে, গ্বেভারা, কাসত্রোর কথা বলেছেন, তাতে বোঝা যায় তাঁর অন্তরে তিনি, ব্যক্তিগত নানা ট্যাবু ভাঙার মধ্যেই, একটা রাজনৈতিক বীক্ষা বহন করতেন । ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ নামে বইও লিখেছিলেন । এই বীক্ষা তাঁর বিদ্রোহে সেইভাবে উপরিস্তরে আসেনি, কিন্তু অনেক হাংরি যে পরে নকশাল হয়েছিল, তার কারণ কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত কারাগার ভেঙে ফেলার আগ্রহ । মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন, তিনিও গুণ্ডা-মাস্তান হয়ে যেতেন, কবিতা না-লিখলে । নিজেকে কবিতা লেখার ক্রিমিনাল বলেও অভিহিত করেছেন । আর এক -এক করে সেই কবিদের নাম করেছেন যাঁদের জেলে বা জেলের বাইরে খুন করা হয় । মলয় নকশাল প্রসঙ্গ আনেন তাঁর ‘হাংরি কিংবদন্তি’ বইতে । ঠিকই করেন । মলয়ের বিদ্রোহ ছিল দক্ষিণ ও বাম দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই -- অন্তত মলয় তাঁর পঠন-পাঠন থেকে, বুদ্ধিগত জগৎ জগৎ কোনও সময়েই রাজনৈতিক বীক্ষার অন্তঃসলিলা স্রোতকে ফেলে দিতে পারেননি । জীবনযাপনের নৈরাজ্যের মধ্যেই একটা বুদ্ধিগত, মননগত স্তর তাঁর থেকেই গিয়েছিল । কবিতা ও সাহিত্যকে কেন্দ্রবিন্দু রাখায় ব্যক্তিক জীবনযাপনের তীব্র নেশাগ্রস্ত নৈরাজ্যই তাঁর কাছে বিদ্রোহের মূল ধরণ হয়ে ওঠে । এটাকে মেলাতে চান কবিতায় । কিন্তু হাংরি প্রজন্মের সাহিত্যগত কীর্তি কবিতায় নয়, গদ্যে । ওই কিংবদন্তি, ওই ছাপ থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের মূল্যায়ন করলে, গদ্যই থাকবে ; অন্তত আমার মতো পাঠকের কাছে, যার চিন্তাভাবনাকে, নকশাল অভ্যূথ্থান, ব্যর্থ হলেও ওলোটপালট করে দিয়েছিল। ওই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা অবশ্যই স্পষ্ট, তবুও । তেমনি ষাটের দশকে একদল যুবকের ব্যক্তিক জীবনের নিরুদ্দেশযাত্রী হওয়ার তাৎপর্য এখন ধরা পড়ে । এই নিরুদ্দেশযাত্রার মূল্য অবশ্যই তাদের দিতে হয়েছে । তবে যেহেতু নকশাল বিদ্রোহ রাষ্ট্রকে খানিকটা ভীত করে তুলেছিল, তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস জনসমাজের সমর্থনে এ-বিদ্রোহের ওপর ভয়াবহভাবে নেমে আসে । ওই বাস্তব অসহ্য-লাগা যুবকদের হত্যা করে, অনেককেই সারা জীবনের মতো পঙ্গু করে দেয় । এই বঙ্গে এ-আন্দোলন নির্মমভাবে দমিত হলেও, ওই প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ সম্পর্কে একটা প্রশ্ন, সংশয় ও আন্দোলন রেখে গেছে । তার আগের মলয়দের হাংরি আন্দোলন জেল-মামলাতেই শেষ হয় । মলয়ও সেই নকশালদের মতো, যাঁরা শেষ পর্যন্ত এই সমাজে, প্রতিষ্ঠানে নানাভাবে আত্মস্হ হয়ে যান ; এমনকি ওই অতীতকে কাজে লাগিয়ে, পুঁজি করেন । এ সত্ত্বেও মলয় রায়চৌধুরীর ষাটের দশকের বিদ্রোহ মিথ্যা হয়ে যায় না, অন্তত তিনি তাকে তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের মতো ( সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ ) প্রকাশ্যে পুঁজিও করেননি । এ-প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, মলয় রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানবিরোধি বিদ্রোহ যে পুলিশ-আদালত-জেল-মামলার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তার নিষ্পত্তি কিন্তু প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপেই হয় । তাঁর বন্ধুরা তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য ও মুচলেকা দিয়ে মুক্তিলাভ করেন । মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন, “লালবাজারে পুলিশ কমিশনার বললেন, তিনি আমাকে সাব ইন্সপেক্টরের চাকরি দিতে চান, কারণ সাজা হবার ফলে ( দুশো টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড ) আর কোথাও চাকরি হওয়া মুশকিল । পরে জেনেছি অ্যালেন গিন্সবার্গ পুপুল জয়াকরকে চিঠি লেখার পর জয়াকর তা ইন্দিরা গান্ধিকে জানান ; দিল্লির নির্দেশে কলকাতার বাঙালি পুলিশ তখন ফাঁপরে।” মলয় রায়চৌধুরীর পাশে এসে দিল্লির প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছিল, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক স্তরভেদ আছে । আর লক্ষণীয় গিন্সবার্গের ভূমিকা । তিনি কিন্তু ‘কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রীডাম’-এর পাণ্ডাদের সাহায্য চেয়েছিলেন -- আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রত্যাখ্যান করেন এ সাহায্যের আবেদন । প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের নেতার এরকম আশ্রয় থেকে বোঝা যায় মলয়দের নিয়ে এসট্যাবলিশমেন্ট খেলছিল । নকশাল-আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে এই বঙ্গেও ওই খেলা নানাভাবে দেখা যায় । তার আগে সন্ত্রস্ত প্রতিষ্ঠান তাদের একের পর এক হত্যা করেছে -- আর সেই হত্যার এ-বঙ্গের প্রতিষ্ঠানের নায়করা পরবর্তী বাম-রাজত্বে থেকেছেন ; শুধু তা-ই নয়, উন্নতি করেছেন । যেমন, যে সোমেন চন্দকে নিয়ে আজ বামপন্হী মহল উচ্ছ্বসিত, যাঁর হত্যার বিরুদ্ধে ধিক্কার বারবার উচ্চারিত, তাঁর হত্যার ‘প্রকৃত ঘটনা হল এই যে, সোমেন চন্দ রেলওয়ে শ্রমিকদের নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে শুধু ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন । ঢাকার নারিন্দাপুল পার হয়ে বটগাছের কাছেই আর. এস. পির ঘাতকবাহিনী ঘিরে ফ্যালে সোমেন চন্দকে । তারপর নির্মমভাবে হত্যা করে।’ এই আর.এস.পি এখন বামফ্রণ্টের শরিক ও মন্ত্রী । এরাই ফ্যাসিস্ট বাহিনীর মদতদাতা ছিল । প্রতিষ্ঠান কতো খেলাই খেলে, কতো রঙই বদলায় । মলয় রায়চৌধুরীও ওই খেলার পুতুল হয়ে ছিলেন । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় তিনি মামলা-আদালত জেল-জরিমানার যে ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন, প্রতিষ্ঠানই তার থেকে তাঁকে বাইরে নিয়ে আসে । অবশ্য মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে এসব কথা এখন অবান্তর। কারণ তাঁর সম্পর্কে এখন আমি যে লিখছি তা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বা আদালত-মামলা জেল-জরিমানার বৃত্তান্তের জন্য নয় । মলয় নামক একজন কবি ও ঔপন্যাসিকই আমার আগ্রহের মূলে । তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার তাৎপর্যই এই সূত্রে বিবেচ্য । এক একজন পাঠক এক একজন লেখক ও আন্দোলনকে নিজের নিজের মতন করে দেখেন । আমার কাছে শুধু মলয়ই নয়, গোটা হাংরি জেনারেশনের লেখকদেরই গদ্য যতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, কবিতাকে তেমন মনে হয়নি । যে-কোনও কারণেই হোক, কবিরা, বোধহয় ইয়োরোপ আমেরিকা কবিদের জীবনকাহিনি শুনে পঞ্চাশের দশক থেকে ব্যক্তিজীবনের হুল্লোড় ও নানারকম কাজ কারবারকে গুরুত্ব দিতে থাকেন, ফল হয় কবিতার অধঃপতন যা এখনও চলছে । মলয়ও তাই করেছিলেন । কিন্তু গদ্যে একেবারে বিপরীত । হাংরি আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে মলয় লিখেছেন, ‘স্হিতাবস্হা ভাঙার ভাষাই নয় কেবল, ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার চেষ্টাই চালিয়েছেন ।’ গদ্যে এটাই প্রকৃত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালার’ নামও করতে পারি । কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে এটা আদৌ হয়নি। ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার কোনও লক্ষণই নেই । আর যেহেতু জীবনযাপন কবিতাকে চিৎ করে ফেলছিল, সেহেতু ওই জীবনযাপনের তাৎক্ষণিক অনুভূতি কবিতায় এমনভাবে অন্তত মলয়ের কবিতায় আসতে চাইছিল, যাতে কবিতার থেকে ওই অনুভূতিই বড়ো হয়ে ওঠে । জীবন কবিতাকে খেয়ে ফেললে মুশকিল, জীবনের ক্ষুধাকে কবিতার রসায়নে দাঁড়াতে হয় । আজ এই ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ভাবতে অবাক লাগে মলয়ের বেশ কাঁচা কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ অতো হৈ-চৈ, অতো শিরঃপীড়ার কারণ কেন হয়েছিল । একেবারে মধ্যবিত্ত ভাষা জর্জরিত মধ্যবিত্ত কবিতা এটি :- “অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা যোনিকেশরে কাচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম আমি বুঝতে পারছি না কি জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায় কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই শুভা আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ করতে দাও দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও বেসামাল হৃদয়বেত্তার স্বর্ণসবুজে” যে-নিম্নবর্গীয় ভাষার আক্রমণে ভাষার স্হিতিস্হাপকতাকে বিপন্ন করার ভাবনা মলয়ের, এই উদ্ধৃতিতে তার কি কোনও চিহ্ণ আছে ? যোনি, স্তন, বীর্য -এসবই সংস্কৃত শব্দ । এদের নিম্নবর্গীয় শব্দ মলয় ব্যবহার করেননি । এসব শব্দ এলিট পরম্পরায় বহু ব্যহৃত । আর ‘অশ্লীল’ এই ধারণাটির স্হান-কাল-পাত্র আছে । এখন আর তথাকথিত অশ্লীল দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ঘুম কাড়া যায় না, কারণ সামগ্রিক প্রতিষ্ঠানই তো অশ্লীল --- অশ্লীল অর্থনীতি, অশ্লীল রাজনীতি, অশ্লীল সমাজ, রাস্তায় ঘাটে একেবারে মধ্যবিত্ত ছোকরাই দু-তিন-চার অক্ষরের শব্দ প্রকাশ্যে বলে । নিম্নবর্গীয়দের অশ্লীল শব্দের যে পেশলতা, যে চিত্রকল্প, যে জোর, তা এই অশ্লীলতায় নেই -- মলয়ের কবিতায় ‘পাজামায় শুকিয়ে যাওয়া বীর্যের’ মতোই সৃষ্টিহীন, অসুস্হ । আসলে ষাটের দশকে মলয় রায়চৌধুরী এক ধরনের আরোপিত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায় মেতেছিলেন, অথচ তাঁর চৈতন্যে গভীর বোধ ছিল । সেই বোধ জীবনযাপনের তীব্রতায় হারিয়ে যেতে থাকে । তাঁর মনে হয়, অশ্লীলতা বুঝি শুধু যৌনতাবাচক শুধু কতকগুলি শব্দ । এটা যে সামগ্রিক মূল্যবোধ-জনিত, আর প্রতিষ্ঠান যে অশ্লীল হয়ে উঠেছে সব দিক দিয়ে, বাইরের পোশাকের আড়ালে অশ্লীল, সেটা হয়তো বুঝতে পারেননি । ১৯৬৫ সালের পর মলয় এর থেকে বেরিয়ে আসেন । মলয় তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার, প্রত্যাখ্যানের যথার্ধ পরিচয় রাখেন তখন, যখন তিনি ওই ষাটের দশকের জীবনযাপনের গণ্ডি থেকে সরে এসেছেন, আপাতদৃষ্টিতে যেন প্রচলিত মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্যে এসেছেন । ‘তারপর দেড় দশক আমার লেখালিখি ছেড়ে যায় । জীবন কাটানোর ভাবনায় বন্ধুবান্ধবে আত্মপ্রকাশে আর্থিক অবস্হায় এই দেড় দশকে আমূল পরবর্তন ঘটে যায় আমার মগজে ও শরীরে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইতিহাসে ।’ ‘এখন তো আমার সেই সময়ের জীবনটাকে ভয়াবহ মনে হয় । এখন ভালো চাকরির পাতি-বুর্জোয়া আরামে প্রতিবাদ প্রতিরোধের লেখালিখি অনেক আরামদায়ক আর সহজ।’ ‘ক্রমশ একলা থাকার মধ্যেই নিজের আরাম আনন্দ শান্তি টের পাই ।’ অর্থাৎ এখন জীবনযাপন মলয়ের লেখাকে ছাপিয়ে যায় না । প্রতিবাদ-প্রতিরোধের লেখাই তো ষাটের দশকে মলয় লিখতে চেয়েছিলেন, তাতে পুলিশ, আদালত, অশ্লীলতার অভিযোগ, জেল-জরিমানা, লকাপে রাতকাটানো । এখন সেটা অনেক আরামদায়ক ও সহজ । কেন ? তবে কি প্রতিষ্ঠান তার মূল্যবোধ পালটেছে ? নাকি তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান, ও তাঁর সহযোগীরা ( এমনকি হাংরি আন্দোলনকারীরা ) খড়্গহস্ত হয়েছিল, লেখার জন্য নয়, জীবনযাপনের জন্য । তুলনা করছি না, ডিরোজিয়ানদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল, তারাও ঔপনিবেশিক সরকারি উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন, এমনকি ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়নের অন্যতম উদ্যোক্তার জীবনীও তাঁরা পরবর্তীকালে লিখেছেন । সেই সময়ের জীবনটাকে ভয়াবহ মনে হয় -- এখানেও জীবনের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া । শিল্পের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া বোধহয় এটাই যে ওই জীবনযাপন থেকে সরে আসার পর, পাতি-বুর্জোয়া জীবনে লগ্ন হওয়ার মধ্যেই মলয় যথার্থ প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখা লিখলেন । আমার মতে কবিতায় নয়, গদ্যে । মলয় তাঁর শেষ জীবনে এখনও কোনও সরকারি-বেসরকারি শক্তিকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হননি, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সে-অর্থে হাত মেলাননি । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আসলে একটা প্রত্যাখ্যান ( তিনি অকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন ) । আমাদের অব-ঔপনিবেশিক বাস্তবে এখন এই প্রত্যাখ্যান বিশেষ জরুরি । মলয়ও জানেন, কোনও সামূহিকের সঙ্গে মেলা যায় না ; একলা হওয়া অনিবার্য মলয় ওই নিঃসঙ্গ প্রত্যাখ্যানের স্বপ্নে এখনও স্হির । দেড় দশক পরে যে কবিতা লেখেন, তাতে ওই প্রত্যাখ্যানের চেতনা, যা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার চেয়ে অনেক গভীরতলের :- ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা শব্দগহ্বর খেয়ে নোকরশাহির রাজয় এনেছি এদেশে তথাকথিত অশ্লীলতা নেই, কিন্তু আছে নোকরশাহির চেতনা, আছে ভাষার প্রতিষ্ঠানকে ভাঙার ‘মুখচোরা’ সংকল্প । হাতের কাছেই রয়েছে মলয়ের উপন্যাস ‘নামগন্ধ’ । প্রকাশিত ১৯৯৯ সালে । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার, প্রাতিষ্ঠানিক স্হিতাবস্হার মূল্যবোধের বিরুদ্ধের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস । স্হিতাবস্হা ও ভাষার স্হিতাবস্হা ভাঙার মূল্যবোধের এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বোঝা যায় মলয় রায়চৌধুরী এখন কোথায় দাঁড়িয়ে । “ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়ায়, গলির তলপেটের ঘিঞ্জি গলির ছমছমে অজানায় হনহনিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বড়ো রাস্তায় পৌঁছোবার পথ খুঁজে পায় না ওরা, আদিত্য আর অরিন্দম, খুঁজে পায় না শহরের নির্লিপ্ত নাগরিকতায় গিয়ে মিশে যাবার দরোজাটাকে । টাকরা শুকিয়ে গেছে অনভ্যস্ত অরিন্দমের । পা চালানোর ফাঁকে ফাঁকে ডানদিকে, এস.কে.চ্যাটার্জি লেন লেখা রাস্তাটায়, গোটা তিরিশেক লোকের মাথা-গিজগিজে ভিড়, চলছে ঝাড়পিটের তুমুল।” একটি খুনের পটভূমিতে এই ভাষা বাঙময়, স্হিতাবস্হাকে টলিয়ে দেয় : ভোটবাগানের ভুলভুলাইয়া, এই সময়ের রাজনীতির ছবি হয়ে ওঠে । ‘গলির তলপেট’ চিত্রকল্পটি ছমছমে, হনহনিয়ে শব্দ অর্থময় ; ‘চলছে ঝাড়পিটের তুমুল’ -- প্রায় কবিতার মতো ভাষা ধরিয়ে দেয় বাস্তবকে । মলয় শুরু করেন ওই রাস্তায় হত্যা ও উঁচু চাকরি-করা অরিন্দম ও পুলিশে চাকরি-করা আদিত্যকে দিয়ে, যাকে ‘ক্রনোটপ’ বলে, সেদিক থেকেও এই রাস্তা তাৎপর্যপূর্ণ । ‘নামগন্ধ’ গত কয়েক দশকের এই বঙ্গের সার্বিক চরিত্রহীন হয়ে যাওয়ার বৃত্তান্ত । এ বৃত্তান্তে অরিন্দম ও যিশু বিশ্বাস দুটি দিক । এই চরিত্রহীনতার মধ্যে এর সাক্ষী হয়েও তারা স্হিতাবস্হার বাইরে যেতে চেয়েছিল দুই নারীকে নিয়ে । বস্তুত ওই দুটি নারী মধ্যবিত্ত ও সামাজিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে যেন চিত্রকল্প । মধ্য চল্লিশের যিশু বিশ্বাস পঞ্চাশ বছরের খুশিদিকে নিয়ে চলে আসতে চেয়েছিল । খুশি তার ‘দাদা’ ভবেশ মণ্ডলের হাতে যেন বন্দিনী । ভবেশ মণ্ডল পঞ্চাশ দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত সময়ের যেন বিবর্তনের প্রতিমূর্তি । বিদ্রোহ, অভ্যূথ্থানকারী ভবেশের পরিণতি তো এই সময়ের সাম্যবাদী দলেরই পরিণতি । এই পরিণতিতে খুশি বন্দী হয়ে যায় । যিশু যেন ওই বন্দিনীকে উদ্ধার করতে চায় । দীঘদিন পরে উধাও হয়ে যাওয়া ভবেশকাকে যিশু আবিষ্কার করে । পালটে যাওয়া ভবেশকাকা । আর তার হাতে বন্দি সেই খুশিদি, যে হয়তো শেষ বাঙালিনী । যিশু এই খুশির শরীরেই বাঁচতে চায়, এ কোনও শারীরিক টান নয়, এ যেন এক ঐতিহাসিক বাঁচবার আবেগ -- ভবেশকাকাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে । যিশুর হাত ধরে পাঠক পৌঁছে যায় এখনকার গ্রামীণ বাস্তবে --- আলু চাষ, হিমঘর, কিছুটা তাঁত, এসবের রাজনীতি-অর্থনীতিতে ধরা পড়ে এই সময়। আদিত্য নামক পুলিশ কর্মচারীর সূত্রে এই সময়ের শাসন, আমলা, এই বাস্তবের স্তরটি আসে । আদিত্যর ব্যক্তিগত বৃত্তান্তও দেখায় সময়ের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে । অন্য দিকে প্রমে পড়ার বাতিকগ্রস্ত উচ্চপদের অরিন্দম মধ্যবিত্ত পচনকে সরাসরিভাবে দেখায় । এই পচনের নানাছবির মধ্যে শেওড়াফুলিতে পিসিমার বাড়ির যে-ছবি আঁকা হয়, তাতে এই শ্রেনির পচে যাওয়ার কদর্য রূপ প্রকট হয়ে ওঠে । “স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বড়ো বউদি, এমেবিয়েড, হাতে টলমলে গেলাস, ফর্সা, ভারিক্কি গতরকে একত্রিত করে পাছ-ঘেঁষটে উঠে বসে আর বাঁহাতে অরিন্দমের গলা আঁকড়ে, নিজের কানা ভরা গেলাস দাঁতে দাঁত অরিন্দমের ঠোঁটের ওপর উলটে দিলে । খাবিনে মানে, তোর গুষ্টি খাবে, জানিস আজ আমার জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী । বিশাল বুকের মধ্যে অরিন্দমের মাথা ঠাশা ।” তারপর শুরু হয় অশ্লীল গল্প বলার পর্ব । লেখকের মন্তব্য : ‘আমরা সবাই মিথ্যাগ্রস্ত মাতাল। বাঙালি মধ্যবিত্তের এ এক অদ্ভুত যাযাবর হামাগুড়ি।’ এই হামাগুড়ির প্রাক ইতিহাসও বলা হয় : এখন নোংরা নোংরা মোদো চুটকিতে মধ্যবিত্তের খোঁয়ারি উঠছে । অধ্যাপিকা ছুটকিও মাতাল, কোকা-কোলার সঙ্গে রাম ভালোবাসে । অরিন্দমের কোলে পা, অরিন্দম আলতা পরায় । সমগ্র মধ্যবিত্ত ল্যাংটো হয়ে যায় বিবরণে । ‘নামগন্ধ’ এই বিবিধ পচনের প্রতিবাদ -- যিশুর খুশিদি আর অরিন্দমের কেটলিউলি সেই প্রতিবাদের, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের, গত চার-পাঁচ দশকের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নারী । এরা মধ্যবিত্ত সীমার বাইরের । দু-জন এদের মধ্যেই মধ্যবিত্ত প্রতিষ্ঠানেরই মূল্যবোধের কারাগার ভাঙতে চেয়েছিল । এই দুই নারীকে অবলম্বন করে এরা পেরিয়ে যেতে চেয়েছিল তাদের শ্রেনিকে, ওই ভবেশকাকা তথা এই সমাজের ক্রিয়াকে । ওই শেওড়াফুলিতে প্রতিবিম্বিত মধ্যবিত্ত বাস্তবকে । কিন্তু পারল না । আকস্মিক দুর্ঘটনায় রিন্দম-কেটলিউলি আর ডাকাত-ডাকাত চিৎকারে যিশু বিশ্বাসের মৃত্যু হয় । আপাত আকস্মিক এই ঘটনা দুটি এই সময়ের গর্ভে স্বাভাবিক । যেমন স্বাভাবিক উপন্যাসের শুরুর হত্যাটি । আর শেষে আরেক ইতিহাসের স্তর আবিষ্কৃত । খুশি ভবেশ কাকার বোন নয় । যিশুর মৃত্যুর সময় একটা পুরোনো হলদে কাগজের পাতা উড়তে থাকে, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের খবরের কাগজ । এক নাতনির হারিয়ে যাবার বিজ্ঞাপন, দিয়েছেন দাদু মিনহাজুদ্দিন । মেয়েটির নাম খুশবু । ডাক নাম খুশি । ভয়ংকর শব্দে ইতিহাস ফেটে পড়ে -- ইতিহাসের গন্ধ, ‘নামগন্ধ’ ছড়ায় -- খুশি, পঞ্চাশ বছরের খুশি হয়ে ওঠে অর্ধশতাব্দীর সময়, ইতিহাস, আবেগ, শরীর । তাকে আমরা পাই না -- সময়ের আকস্মিক মোচড় হত্যা করে নানাভাবে । প্রতিষ্ঠান খেয়ে ফেলে তাদের । আর এর বিরুদ্ধে কবি মলয় রায়চৌধুরী দাঁড়ান এই গদ্যেই । কী অনবদ্য কবিতা উঠে আসে যিশুর আবিষ্কারে :- “খালি পায়ে, বাগানের ঘাসপথ বেয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়ায় যিশু । আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে গেছে বাতাস । বাতাসের ডাঁটো স্ট্যাচু যেন । সব স্হির । ডানপাড়ের বিশাল গাছে তেঁতুলপাতাও কাঁপছে না । বাঁধানো ঘাটে বয়ঃসন্ধির বালিকার মতন একধাপ ওপরে তো একধাপ নীচে খেলা করবার পর ক্লান্ত হয়ে গেছে টলমলে পুকুর।” কিংবা :- “জনশ্রুতির মতন বাতাস বইছে।...মদগর্বিত ষাঁড়। মদিরেক্ষণা মৌমাছি । ভিজে চিলের মতন ডানা ঝুলিয়ে রয়েছে ঝিমন্ত কলাগাছগুলোর ছেঁড়া পাতা। কঞ্জুস হাওয়ার তাপে বাবলাগাছগুলোর গায়ে কাঁটা দিয়েছে । পথিপার্শ্বে উইপোকাদের বিজয়স্তম্ভ । মার্জিত চেহারার খেজুর গাছ, গলায় খেজুর ছড়ার মালা।” অথবা :- “চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে কালবৈশাখির ছেতরানো মেঘে, কিন্তু পূর্ণিমার আগাম আভায় নির্জন বধির অন্ধকারকে মনে হয় হাস্যোজ্বল । নিরলস সাধনায় মগ্ন স্হির সন্ধ্যাবাতাস আচমকা হাওয়ার জন্য অপেক্ষমান । নেশাগ্রস্তের মতন মাথা ঝুঁকিয়ে আছে গাছগুলো । বুনো সুগন্ধ ছড়াচ্ছে সিসলকাঁটার গুড়িসুড়ি ঝোপ।” এই উদ্ধৃতিগুলিতে, উপমা-চিত্রকল্পে, ভাষার স্বাতন্ত্র্যে, যে-কবিতাময়তা, তাতে থাকে ভাষার স্হিতিস্হাপকতাকে আক্রমণ, অথবা নতুন স্হিতিস্হাপকতা গড়া । খুশি ও কেটলিউলি হিন্দু অরিন্দম আর খ্রিস্টান যিশুর, মধ্যবিত্তের বাঁচবার পথ, কেটলিউলি-মেয়েটার শরীর জুড়ে প্রাচীন নিষাদকুলের নাচ লুকিয়ে আছে যেন । এর চাউনি রৌদ্রোজ্জ্বল । চিরপ্রদোষ-মাখা শ্যামাঙ্গিনী । আর খুশিদিকে দেখে যিশুর মনে হয়, চাষি মেয়ের শ্রমসোহাগী পেশল বাহু ঝুলে আছে । ওই প্রাচীন নিষাদকুল, ওই শ্যামলিনী, চাষি মেয়ের পেশল বাহুই আমাদের প্রতিষ্ঠানের, কবন্ধ মূল্যবোধের বাইরে আনতে পারে । এ সম্ভাবনার দরোজা কি খুলবে ? মলয় রায়চৌধুরীর এ-প্রশ্নকেই রেখে দেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার তাৎপর্য এখানেই । মলয় এভাবেই ষাটের দশক থেকে পালটেছেন -- যেতে চাইছেন সময়ের গভীরে, তার নাভিকেন্দ্রে ।

Prof Nissim Ezekiel : The Hungry Generation

Prof Nissim Ezekiel : The Hungry Generation The Hungry Generation Movement in Bengali literature, which took Calcutta by surprise in 1961, and became instantaneously known through TIME magazine, has withstood all odds, and is now a historical and cultural force to reckon with. The movement has grown to uncontrollable proportions. All sorts of groups have emerged at various places in West Bengal claiming to be of Hungry Strain. The major Hungry Generation writers and poets are in their late forties now: Subimal, Malay, Basudeb, Subhas, Saileswar, Pradip and others. They have always been at the receiving end from the media due to their uncompromising stand. Except for Debi Ray, who broke with the Hungries quite early, none of them are invited to participate in the national or regional TV and radio programmes, official workshops/seminars/recitals/readings. The Hungry writers, better known as the Hungry Generation, are immensely popular among students and young writers today, as they are considered the voice of conscience in a Bengali society shattered by internecine political struggles of the post-partition years. Interesting, though, the Hungry Generation writers, poets and artists do not function as a group any more. But they remain the only avant garde figures in Bengali literature, always experimenting, always questioning, expressing themselves in ultimate terms. “The Movement”, as the renowned critic Dr Uttam Das has said, “is an important event in the history of Bengal”. Malay Roychoudhury(b. 1939), the towering avant garde poet who pioneered the Hungry movement in Bengali literature, is a legend by himself. Still uncompromising, and therefore not supported by the Bengali media, all his collections have so far been published by his friends and relatives. Despite being hailed by TIME magazine as an outstanding poet, he remains as controversial as he was in 1961 when he entered the literary scene in Calcutta with a whiff of liberated form, and an uninhibited approach towards expression of Indian thought concerning self and society, love and destruction, politics and despair. Malay had given up writing sometime in 1966 after some of his friends has betrayed and testified against him. But he returned with a vengeance in 1983, and took the Bengali scene by storm. His poems have been translated into almost all Indian languages as well as into Spanish, German, French, Russian and Italian. He has translated Ginsberg, Lorca and Neruda into Bengali. Malay’s collection of verse includes Shoytaner Mukh, Jakham, Kabita Sankalan, and the recently published collection revealing violence, fear and agony, in Medhar Batanukul Ghungur. Although once the leader of the fierce Hungry Generation movement, Malay now lives the life of a recluse in Bombay. The poets of the younger generation look at him with awe and inspiration. We feel he is the ultimate representative of his kind of poetry. (Courtesy: Prof Nissim Ezekiel, Editor, The Indian P.E.N., Mumbai, 1987)

শুক্রবার

সমীর সেনগুপ্ত : মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাসত্রয়ী

মলয় রায়চৌধুরীর ডুবজলে,জলাঞ্জলি, নামগন্ধ উপন্যাসত্রয়ী : সমীর সেনগুপ্ত যাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি, আর যাকে চিনি না — তাদের কাজ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, বা এমনকি ভাবতে গেলেও — দৃষ্টিভঙ্গীতে একটা তুলনাত্মক পরিবর্তন এসে যেতে বাধ্য । আজ যদি আমাকে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় কিংবা নরেন্দ্রনাথ মিত্র সম্পর্কে লিখতে বলা হয়, আমার রচনা কিছু পরিমাণে নিরঙ্কুশ হবেই — কারণ এঁদের কাউকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতুম না, এঁদের কাজ বিষয়ে আমার হাতে আছে শুধুই এঁদের কাজ, আর হয়তো কিছি দ্বৈতীয়িক তথ্য, মানুষটিকে আমার জানা নেই । অর্থাৎ একটি বিন্দুতে আছি আমি, আর একটি বিন্দুতে আছে তাঁর কাজ — সম্পর্কটা দ্বিমাত্রিক ; কিন্তু যে-মুহূর্তে আমি মানুষটিকে জানছি সেই মুহূর্তে সম্পাদ্যটি তৃতীয় একটি আয়তন পাচ্ছে, তাঁর কাজ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন প্রভাবিত হচ্ছে আমার মনের মধ্যে নির্মিত তাঁর ভাবমূর্তির দ্বারা । সঙ্গে সঙ্গেই অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা । মলয় রায়চৌধুরীকে আমি চিনি — ঘনিষ্ঠতা যাকে বলে হয়তো নেই, কিন্তু মানুষটিকে জানি, এবং পছন্দ করি, তাঁর কাণ্ডজ্ঞান অত্যন্ত সূক্ষ্ম বলে এক ধরণের শ্রদ্ধাবোধও আছে ভিতরে ভিতরে l তাছাড়া অনেক বিষয়েই মলয়ের পড়াশোনা ও অন্তর্দৃষ্টি আমাকে বিস্মিত করে, এবং লেখা পড়ে মনে হয় দুনিয়াদারির অভিজ্ঞতাতেও মলয় রায়চৌধুরী আমার চেয়ে এগিয়ে — কিন্তু মলয়ের কাজ আমি সাধারণভাবে পছন্দ করি না । মলয়ের সঙ্গে কোথাও আমার একটা আদর্শগত দূরত্ব আছে বলে মনে করি, এবং সে দূরত্ব অসেতুসম্ভব । তফাতটা সাহিত্যসংক্রান্ত বোধের, এবং রুচির । দীর্ঘ দিন ধরে, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আমাকে এক দিকে নিয়ে গেছে, মলয়কে সম্পূর্ণ অন্য দিকে । ফলে, মলয় যাকে কবিতা বলে মনে করেন, আমার কাছে তা অগ্রাহ্য, মলয়ের যা সাহিত্যিক আদর্শ, আমার কাছে তা মনোযোগের যোগ্য নয়, এবং আমার বিচারে যা সাহিত্যের ধ্রুবপদ, মলয়ের বিচারে — মলয়ের লেখা পড়ে মনে হয়, তা শুচিবায়ুগ্রস্ত, উচ্চমন্য, গজদন্তমিনারবাসীদের জন্য, গজদন্তমিনারবাসীদের দ্বারা রচিত । এই যেখানে পরিস্হিতি, সেখানে মলয় রায়চৌধুরীর লেখার আলোচনার প্রস্তাব আমার বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করা উচিত ছিল । কারণ বিরুদ্ধ আলোচনা স্বাগত হলেও, পক্ষপাতপূর্ণ আলোচনা না করাই উচিত । আর, মলয়ের লেখা আমার ভালো লাগে না, এটা এমনকিছু একটা জরুরি কথা নয় যে, ভুরি পরিমাণ কালি-কাগজ খরচ করে সে-কথাটা বলে বেড়াতে হবে । কিন্তু আসল ব্যাপারটা অতো সরল নয় । মলয় রায়চৌধুরীর লেখা আমার ভালো লাগে না এতে কোনও ভুল নেই ঠিকই, কিন্তু বোধহয় কুড়ি বছর পর আমি একটি উপন্যাস রাত জেগে পড়ে উঠলাম, সেটি মলয় রায়চৌধুরীর ‘জলাঞ্জলি’ । রাত সাড়ে বারোটায় বইটা হাতে করে শুতে গিয়েছিলাম, যখন শেষ করে উঠলাম, তখন কাক ডাকতে আরম্ভ করেছে। এবং পড়তে পড়তে মনে পড়ল, বছর কয়েক আগে মলয় ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপহার দিয়েছিলেন, সেটি পড়তে আরম্ভ করেও সেদিন আপিস-টাপিস বাদ দিতে হয়েছিল । কারণ মলয় প্রথম থেকেই এমন এক জগতে আমাকে নিয়ে প্রবেশ করেন, যা আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত — শুধু অপরিচিত নয়, অচিন্ত্যনীয় । এ কোন পৃথিবী যা বাতিল নোটের দুর্গন্ধ-স্তূপকে ঘিরে ঘিরে আবর্তিত হয় — বাস্তব সেখানে ওই টাকর ভাগাড়ের ভিতর থেকে ভাপের মতো ধোঁয়াতে থাকে । টাকা — কারেন্সি নোট, যা আমাদের সমস্ত সুখের-দুঃখের, প্রাপ্তির-অপ্রাপ্তির, সার্থকতার-অসার্থকতার জগদ্দল প্রতীকমাত্র, ওগুলোর মধ্যে চিরন্তনতা নেই । নেই যে, সেটা আমরা বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারলেই, কথাটা আমাদের উপলব্ধিকে স্পর্শ করে না । যেমন দশ কোটি টাকা মানে কত টাকা আমি বুদ্ধি দিয়ে বুঝি, কিন্তু পুরোপুরি বুঝি না, তেমনি কারেন্সি নোটের নশ্বরতার ব্যাপারটাও, মলয় না-বোঝালে, কোনও দিন সত্যি-সত্যি বুঝতে পারতুম কিনা সন্দেহ । আমরা সবাই জানি কারেন্সি নোট হাতে হাতে ঘুরে একদিন নোংরা হয়, ধারগুলো এবড়োখেবড়ো হয়ে যায়, কাগজ ল্যাতপেতে হয়ে যায়, ভাঁজে ভাঁজে মাঝখানটা ফুটো হয়, ক্রমে সেই ফুটোটা বড় হতে হতে নোটতা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায় । তারপর কী হয় ? নিশ্চয়ই কোনও না কোনও ভাবে নষ্ট করে ফেলা হয় নোটখানা । কিন্তু সেই কোনও না কোনও ভাবে ব্যাপারটা যে কী ব্যাপার সেটা কখনই জানতে পারতুম না, মলয় রায়চৌধুরীর লেখা না পড়লে । ‘কারেন্সি’ মানেই আমরা জানি যেটা আছে, যেটা কারেন্ট অর্থাৎ বর্তমান, যেটা আমি ও আমার প্রতিবেশীর মধ্যে যোগসূত্র । এবং এইরকম একটা বিভ্রান্তি আমাদের মনে, ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়ে যায় যে, আজ যেটা বর্তমান আছে কালও সেটাই বর্তমান থাকবে । আমরা যারা টাকার বাজারের প্রত্যন্তসীমায় জীবন কাটাই, হঠাৎ হাতে এক গোছা চকচকে নোট এসে পড়লে তাদের মনটা খুশি হয়ে ওঠে, তাদের বউয়েরা সেগুলো পাট করে আলমারির ভেতরের দিকে রেখে দেয়, অথচ কোনও তো কারণ নেই, তেলতেলে অর্ধগলিত নোটের চেয়ে তার তো ক্রয় ক্ষমতা বেশি নয় । তাহলে কেন গ্রেশাম সাহেবের নিয়ম সারা পৃথিবী ভরে সত্য, নতুন নোট হাতে পেতে কেন সারা পৃথিবীর মানুষ লালায়িত ? জানি না । আর মলয় যে মানুষগুলির বর্ণনা করেন, তারা ওই গলিত নোটের মতোই বহুব্যবহৃত পুরোনো ভাবনাচিন্তার জগতের মানুষ । তারা যা ভাবে, যেভাবে ভাবে তা বহু বহু পুরুষ ধরে তাদের পূর্বজরা ভেবে এসেছে । কিন্তু মলয় রায়চৌধুরীর লেখার তলায় তলায় এই বার্তা থাকে, যে এই ভাবনাটাই শেষ কথা নয়, ধ্রুব নয়, নতুনভাবেও চিন্তা করা সম্ভব — মলয় রায়চৌধুরীর অতনু হঠাৎ গলিত নোট গোনার আরামের চাকরি ছেড়ে, গ্যাজেটে ক্যাসেটে সাজানো ফ্ল্যাট ফেলে রেখে একদিন উধাও হয়ে যায়, অনেকদিন পর তার খোঁজ পাওয়া যায় গভীর জঙ্গলের মধ্যে রেডবুক থেকে মন্ত্র পড়ে নকশাল তরুণতরুণীদের গণবিবাহ দিচ্ছে । পুরোনো নোট ধ্বংস করে ফেলবার পদ্ধতিটা মলয় দেখান, নতুন নোট তৈরি হওয়ার পদ্ধতিটা দেখান না — সেটা আমাদের আন্দাজ করে নিতে হয় । মলয়ের উপন্যাসের জগতেও, বাতিল ভাবনার মানুষেরা রাজত্ব করে, মনে হয় তারাই রাজত্ব করে যাবে — কিন্তু না, অতনুরাও তাদের মধ্যে থাকে, তাদের রাজত্ব তলায় তলায় টলমল করছে । পুরোনো নোটের মতো তারাও একদিন বাতিল হয়ে যাবে — এটাই কি মলয় রায়চৌধুরীর বার্তা ? কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয় রাত জেগে মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস পড়ে ওঠার । আমাদের ঘটনাহীন মধ্যবিত্ত জীবনের সবচেয়ে নীরস নীরক্ত নির্বর্ণ অংশ আমাদের চাকরিজীবনের কাহিনি । মলয়ও চাকরিটা করতেন একঘেয়ে ঘটনাহীন — ব্যাঙ্কের নিস্তরঙ্গ চাকরি । কিন্তু মলয় আরও একবার প্রমাণ করলেন, যে বেড়াতে জানে, তার কাছে লিলুয়াভ্রমণও রোমাঞ্চকর হতে পারে ; যে দেখতে জানে, তার কাছে ব্যঙ্কের আপিসঘর হয়ে উঠতে পারে আমাজন অববাহিকার চেয়েও রহস্যময় । চরিটপগুলি, শুধু জীবন্ত বললে কিছুই বলা হয় না, বাঁধা বুলি হয়ে গেছে– স্পন্দমান, তাদের কথোপকথন স্পষ্ট শোনা যায় এতো বেশি জীবন্ত । মলয়ের লেখা পড়তে পড়তে স্পষ্ট দেখতে পাই সেই সব যুবক যুবতীদের, যারা রাত জেগে পড়াশোনা করে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো ফল দেখিয়ে, প্রতিযোগীতামূক পরীক্ষায় অন্যদের হটিয়ে, অবশেষে একটা গালভরা ডেজিগনেশনওয়ালা চাকরিতে ঢুকলো । এবার যুবকটি একটি নারী সংগ্রহ করবে, যুবতীটি একটি পুরুষকে — তারপর একটা বাড়ি, তারপর সন্তান — অন্য পাঁচ সাধারণ মানুষ যেভাবে জীবন কাটায়, মানুষের পক্ষে যে-জীবন স্বাভাবিক বলে সামাজিকভাবে সীকৃত, সে-জীবনের মূলস্রোতের শরিক হবার পথে কঠিনতম বাধাটি অতিক্রম করল সে । কিন্তু কী চাকরি ? না, দিনের পর দিন একটা বন্ধ ঘরে বসে পুরোনো নোংরা নোট গোনা, সপ্তাহে পাঁচ-ছয় দিন, দিনে সাত-আট ঘণ্টা, আর কোনও কাজ নেই, শুধু নোংরা নোট বাণ্ডিল বেঁধে বেঁধে, গর্ত করে করে, পোড়াবার জন্য পাঠানো । এর চেয়ে অবাস্তব কোনও অবস্হার কথা কল্পনা করা কঠিন । কাজ মানে এমনকিছু যা মানুষের সত্যিকারের বেঁচে থাকার পদ্ধতিটার সঙ্গে যুক্ত । কুমোর যখন হাঁড়ি গড়ে তখন হাঁড়িটার সঙ্গে মানবসমাজের যোগাযোগের সূত্রটি সে খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পায় — হয়তো জিগ্যেস করলে বুঝিয়ে দিতে পারে না, কিন্তু নিজে বোঝে তাতে কোনও সন্দেহ নেই । কিন্তু টাকা, কারেন্সি নোট — আধুনিক মানবসমাজের এই অপরিহার্য উপজাত, এর সঙ্গে মানুষের উপভোগের, অথবা প্রয়োজনের নিবৃত্তির, কোনও প্রত্যক্ষ যোগ নেই, কারণ এটি আদৌ কোনও ভোগ্যপণ্য নয় । টাকা চিবিয়ে খিদে মেটে না, টাকা গায়ে জড়ালে শীত কাটে না — পুড়িয়ে আগুন করলে খানিকটা কাটতে পারে হয়তো । অথচ খিদের সময়ে খাবার পেলে যত খুশি হই, টাকা হাতে পেলে ততটাই খিশি হই — কারণ টাকাটার সাহায্যে পৌঁছোনো যাবে পছন্দমতো খাবারের কাছে । ব্যাপারটার অন্তর্গত হেত্বাভাস যে কত সত্য তা টের পাওয়া যায় ঘটনাটাকে চরমে টেনে নিয়ে গেলে — ধরা যাক সেই ‘অশনিসংকেত’ ছবিতে — ভিখারিনী মেয়েটি যখন অনাহারে মৃত্যুপথযাত্রী, যখন তার শরীরে আর খাদ্যসন্ধানের বল অবশিষ্ট নেই, তখন তার পাশে এক বাণ্ডিল টাকা রেখে গেলে যা হতো । কিন্তু টাকা ও খাদ্যের পার্থক্যটা বুঝতে চাইলে ক্ষুধায় অমন মৃত্যুপথযাত্রী হতে হয় — যে অভিজ্ঞতা জীবনে, অন্তত মলয়ের গল্পের পাঠকদের জীবনে, ঘটবার সম্ভাবনা খুব বেশি বলে মনে হয় না । আমি যে চাকরিটা করতাম সেটাও খুব বর্ণহীন চাকরি — কিন্তু সত্যিকারের বর্ণহীন চাকরি বলতে কী বোঝায় মলয়ের লেখা পড়ে তা বুঝতে পারলাম । আসলে আমরা তথাকথিত লেখাপড়া শিখে যেসব শাদা কলারের চাকরি করি তার কোনওটার সঙ্গেই তো আসলে বেঁচে থাকা ব্যাপারটার কোনও যেগ নেই, কাজেই তার মধ্যে থেকে কৃত্রিমতার কটূ স্বাদ ছাড়ানো যায় না কোনও মতেই । মনে আছে একবার ওপরওয়ালার সঙ্গে নিষ্ফল ঝগড়া করে নিজের ঘরে ফিরে এসে ভাবছিলাম কাল থেকে আর আপিসে না এলে কী হয় । ভাবতে ভাবতে জানলার পর্দা সরাতে দূরে ভারত ব্যাটারির কারখানার চিমনিটায় চোখ পড়ল । একটা লোক এই বৈশাখের ভরা দুপরে তেতে থাকা চিমনিটা বেয়ে উঠে যাচ্ছে । আমি দেখতে লাগলাম । ক্রমেই উঠে যাচ্ছে লোকটি, তারপর মাটি থেকে প্রায় একশো ফুট ওপরে দাঁড়িয়ে চিমনি সাফ করতে লাগল । নিয়নের আলো জ্বালা পর্দাটানা ঠাণ্ডা ঘরে বসে বসে আমি ভাবতে লাগলাম, ও লোকটি কি চাকরি ছেড়ে দেবার কথা ভাবে কখনও ? আর, শুধুই তো নোট গোনা নয়, ব্যবহারযোগ্য নোটে আলাদা করে, অব্যবহার্যগুলো বাণ্ডিল বেঁধে, সই মেরে, ফুটো করে পোড়াতে পাঠানো নয় ( এ পর্যন্ত তবু তো আমরা আন্দাজ করতে পারি ), তার মধ্যে থেকেও মানুষের বেঁচে থাকার বিচিত্র প্রয়াস কাজ করে যেতে থাকে । কীভাবে বিকট বিকারের ভিতর দিয়েও জীবন তার মূল ছন্দে ফিরে আসার চেষ্টা করে তার অসম্ভব বর্ণনা আমরা মলয়ের লেখা থেকে পেয়ে যাই । ‘…শিমুলতলা দেওঘর থেকে ফেরার পর দিনই, অতনুর সেকশনে, ঝপাং শব্দে ডাইস মেশিনে গর্ত করে নোট নষ্ট করছিল রসিক পাসওয়ান, চাপরাশি । ব্যস্ততার মাঝে, অতনুর কপালে এসে ছিটকে লাগল রসিকের তর্জনীর কাটা ডগাটা, লেগে, ওর কপালে রক্তের টিপ পরিয়ে, ওরই টেবিলে পড়ল । বুঝে ওঠামাত্র ও স্তম্ভিত । পেটে মোচড় দিয়ে বমি উঠে আসছিল আরেকটু হলে । পকেট থেকে রুমাল বার করে প্রায়-নির্বিকার রসিক জড়িয়ে নিলে আঙুলে আর আঙুলের টুকরোটা দেখাতে গেল খাজাঞ্চিকে । সুশান্ত জানিয়েছিল, ওদের আঙুলটাঙুল বীমা করিয়ে রেখেছে অফিস । দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে বীমা করানো থাকে । আঙুলকাটার অঢেল ক্ষতিপূরণ দিতে হয় । তর্জনীর জন্যে মোটা টাকা পাবে ।… ….বরাদ্দ ছুটির শেষে রসিক পাসওয়ান কাজে যোগ দিলে সুশান্ত জানতে চেয়েছিল, “কী গো, আঙুলের ঘা শুকিয়ে গেছে তো ? কাটলে কেন আঙুলটা, জেনেশুনে ?” “…নাতনির বিয়ে দিলুম । ছুটিও পেলুম, টাকাও ।” রসিক পাসওয়ান অমায়িক । এই ঘটনার পর অতনু লক্ষ করেছে, সুখচৈতি রাম, হরবিলাস, টাঙোয়া মাহতো, রামপুজন সিং, খলিল আহমেদ সকলেরই একটা বা দুটো আঙুল কাটা ।…’ ( ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, পৃ. ৩১ ) ঘটনাটা যে লক্ষ করছে, অতনু, তাকে লাক্ষণিকভাবে সুকুমার, বাঙালি মধ্যবিত্ত চরিত্রের প্রতিনিধি করে তুলে মলয় চমৎকার নাটকবোধের পরিচয় দিয়েছেন । অতনু এমনই এক যুবক, ‘নিজের মাইনের টাকা ওব্দি অন্যের সামনে গুনতে লজ্জা করে অতনুর । চাকরির প্রথম মাইনের একটা পাঁচ টাকার প্যাকেট, লুকিয়ে গুনতে গিয়ে, পায়খানায় পড়ে গিয়েছিল ।’ খাঁটি বাঙালি মধ্যবিত্ত চরিত্র, এই চরিত্রটিকে আমরা এতো ভালো করে চিনি যে বলার নয় । যে নিজের স্বার্থের গুরুতর হানি ঘটাতে রাজি আছে, কিন্তু নিজের সুকুমারত্ব বিসর্জন দিতে রাজি নয় । টাকা যে দিচ্ছে, তার সামনে গুনে না-নিলে গোনা না-গোনা সমান, এ-কথা ইকনমিকসের স্নাতকোত্তর দুনিয়াদারির মেধাবী ছাত্র অতনু বোঝে না এমন নয়, কিন্তু এই অনুশাসন পালন করতে তার মধ্যবিত্ত পারিপার্শ্বিকে বেড়ে ওঠা মূল্যবোধে ভয়ংকরভাবে আটকায় । তার চোখের সামনেই রসিক পাসওয়ানের আঙুল বিসর্জন দেবার ঘটনাটি ঘটে যায় বলে মলয়ের পাঠক, আমরা যারা মনে মনে অতনুর সগোত্র, ধাক্কাটা আমাদের আরও বেশি করে লাগে । আর টাকা গুনতে অতনুর কেমন লাগে তারও চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন মলয় :- ‘…রোজ সাড়ে দশটায় অফিসে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে ভেজা ভেজা হতদরিদ্র নিকষ নোটের বিষণ্ণ আমন্ত্রণ অতনুকে ছেয়ে ফ্যালে, ধূসর বিষাদমুখো নোটের ভেষজ অন্ধকূপে ও চাকরি করে চলে ভারাক্রান্ত, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, ঝেঁপে আসে নোটের খাঁ-খাঁ করা দুর্গন্ধ, ম ম করে ন্যাতানো শ্বাসরুদ্ধকর ছাতাপড়া নোট । যেন ওৎ পেতে থাকে হাড়হাভাতে নোটেরা ।’ কিন্তু এই গদ্যভঙ্গী আমার পছন্দ নয়, অনেক শব্দের ব্যবহার আমার রুচিতে আটকায়, ‘হাড়হাভাতের’ ব্যবহার জীবনানন্দের ভুল প্রয়োগ বলে মনে হয় । তা ছাড়া, আমি ভেবে পাই না নোটের গন্ধ কী করে ‘ঝেঁপে আসে’, দুর্গন্ধ কেমন করে ‘খাঁ খাঁ’ করতে পারে ? কিন্তু এটাও সেই সঙ্গে মানতে হয় যে মলয় রায়চৌধুরীর অভ্যাসবিরোধী শব্দব্যবহার দিয়ে, শালীন বাংলার অচলিত বাক্যগঠন দিয়ে, মলয় একটা কোথাও পৌঁছোতে পারেন । কিন্তু সেটা কতখানি মলয়ের ভাষাব্যবহারের কারণে আর কতখানি মলয়ের অচেনা অভিজ্ঞতার, মলয়ের অজ্ঞাত জগতের কাহিনির অমোঘ আকর্ষণে তা নিয়ে তর্ক থেকে যেতে পারে । মলয় যেন প্রতিজ্ঞা করে কোমর বেঁধে বসেন যে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত বাংলা রচনাশৈলী কিছুতেই ব্যবহার করবেন না । তা মলয় না করুন, তবে চেষ্টাটা নতুন নয়, মলয়ের আগে অনেকে করেছেন এবং করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন — এবং মলয়ের পদ্ধতিতে আটপৌরে কথোপকথন রচনার কতখানি সাফল্য পাওয়া সম্ভব তা নিয়ে আমার সন্দেহ যায় না । অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, মলয় রায়চৌধুরীর ভাষা এমনিতেই যথেষ্ট লক্ষ্যভেদী, তাকে দুশ্চেতার দ্বারা আরও বেশি চোখা করবার কোনও তো দরকার দেখি না । কেন মলয় ‘ঠিক আছে’কে ‘ঠিকাছে’ লিখবেন, কোনও দরকার তো নেই । বাংলা উচ্চারণে আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতাই হচ্ছে, হলন্ত ব্যঞ্জনের পর স্বরবর্ণ থাকলেই, সন্ধির সামান্যতম সুযোগ থাকলেই তাকে সন্ধি করে উচ্চারণ করা হয় । কিন্তু লেখার সময় আমরা সেগুলো করি না । লিপিনির্দিষ্ট ভাষার একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ চেহারা আছে, প্রাদেশিক উচ্চারণ যাই হোক, লিপিকে তা প্রভাবিত করে না ; করলে অকারণ নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয় । আর খুব নতুনও নয় চেষ্টাটা — আজ থেকে একশো বছর আগে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘করলে’ পরিবর্তে ‘কল্লে’ চালাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন, এমনকি তাঁর সাহিত্যিক পুত্রও, অন্তত এ-ব্যাপারে তাঁকে অনুসরণ করেননি । মলয় কোথাও কথ্য উচ্চারণকে অনুসরণ করে অনাকাঙ্খিত সন্ধি করেছেন, কোথাও করেননি । ওই একই অনুচ্ছেদে আগের বাক্যেই ‘কুকুরের ল্যাজ’কে ‘কুকুরের্ল্যাজ’ করেননি, বা ‘কন্ঠস্বর শুনে’কে ‘কন্ঠস্বর্শুনে’ করেননি, বা পরের বাক্যে ‘ওর কাছে’কে ‘ওর্কাছে’ করেননি । এসব করে পাঠককে শুধু প্রতিহতই করা হয় । মলয় যদি বলেন উনি পাঠক টানতে চান না, তাহলে সম্পূর্ণ নিজের ডিকশন তৈরি করুন, যেমন করেছিলেন কমলকুমার মজুমদার তাঁর ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এ — শ্রেষ্ঠ উদাহরণটাই দিলুম । মলয় রায়চৌধুরীর হাতে অস্ত্র আছে, অন্তত যে পাঠক ‘একালের রক্তকরবী’তে প্রকাশিত তাঁর ‘জলাঞ্জলি’ উপন্যাস পড়বেন, তাদের ঘায়েল করার । যখন মলয় গ্রামে কাজ করতে যাওয়া শহুরে ছেলেমেয়েদের বিষয়ে লেখেন :- ‘…চাষের জমিতে দাঁড়িয়ে গম-যবের তফাৎ করতে পারে না । রবি-খরিফ জানে না । জানে না কদ্দিনে আখ হয়, পাট হয় । অড়রডাল গাছ দেখতে কেমন । এক হেকটরে কত জয়াধান সম্ভব । কত ঘণ্টার শ্রম লাগে এক কুইন্টাল টমাটো কিংবা চন্দ্রমুখী আলু তুল;তে । জলবিভাজক কাকে বলে । খাল আর নালার তফাৎ।…পানচাষে অনুখাদ্য মিশ্রণ কতটা হবে, কেমনভাবে পুঁততে হয় আলফা আলফা গাছ, নাবি বোনা আমন ধান কখন পাশকাঠি ছাড়ে, স্বর্ণকুমারী জাতের ধানে খোলপচা রোগ হলে কী করা উচিত।…’ যে-পাঠকের উদ্দেশে এসব মলয় লিখেছেন, সে পাঠক তালগাছ আর নারকেল গাছে তফাৎ করতে পারে না, কাক শালিক ছাড়া পাখি চেনে না, চেহারা দেখে হাসাহাসি আলাদা করতে পারে না — তার কাছে প্রত্যেকটি মন্তব্য টাইসনের আপার কাট । অথবা সেই অতনু, অতনু চক্রবর্তী, পায়খানায় লুকিয়ে মাইনের নোট গুনতে গিয়ে যার একতাড়া পাঁচ টাকার নোট নোংরায় পড়ে গিয়েছিল, সুখের চাকরি আর সাজানো ফ্ল্যাটবাড়ি ফেলে রেখে যে উধাও হয়ে গিয়েছিল একদিন, তাকে তার সহকর্মী আবিষ্কার করে হাজারিবাগে, হাণ্টারগঞ্জের কাছে ( সত্যি কি হান্টারগঞ্জ জায়গা আছে কোনও ? থাকতে পারে, জানি না ; এটুকু জানি ‘একালের রক্তকরবী’র বেশির ভাগ পাঠকই জানে না । আমার অবস্হান আমি গোপন করবার চেষ্টা করছি না, পাঠক লক্ষ করবেন ) গভীর জঙ্গলের মধ্যে ছয়-সাত জোড়া কিশোর-কিশোরীর গণবিবাহ দিচ্ছে । ‘…বিয়ের কোনও দশকর্মের ব্যাপার নেই । পুরুতও তো নে । খদ্দরের ঘি-রঙা পাঞ্জাবি, নোংরা শাদা পায়জামা, পায়ে কেডস, ঘাড় ওব্দি উস্কোখুস্কো চুল, একজন লোক একটা ছোট্ট লাল মলাটের বই থেকে মন্তর পড়ছে আর বর কনেরা সবাই মিলে তা আউড়ে যাচ্ছে । লোকটার মাথার ওপর মশার ঘূর্ণায়মান হ্যালো । উৎকর্ণ হতে, অরিন্দম বুঝতে পারল, আরে, সংস্কৃত তো নয়, বিয়ের মন্তর নয় । লোকটাতো ইংরেজিতে মন্তর পড়ছে, পরিষ্কার ভালো ইংরেজিতে আর আবোল তাবোল উচ্চারণে সেগুলো তারস্বরে ওগরাচ্ছে হবু স্বামী-স্ত্রী । …ইংরেজিতে কী পাঠ করছে কান পেতে শোনে অরিন্দম আর স্তম্ভিত হয়ে যায় । চীনে ছাপানো রেডবুক থেকে উদ্ধৃতি পাঠ করছে, বিখ্যাত সব কোটেশান, জানে ও।’ সত্যি বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে খুব, কিন্তু অবিশ্বাস করাটা রক্তে বসে গেছে । মলয় রায়চৌধুরী কি সত্যি কথা বলছেন ? তাহলে মলয়ের সব কৌণিকতা ক্ষমার্হ, সকল চালিয়াতি অবহেলার যোগ্য । এই কারণেই ক্ষমার্হ, যে মলয় আমাদের , এই দুর্ভাগা কলকাতাবাসী জন্মস্নবদের, বিশ্বাসহীনতার পাকা দেয়ালে একটা ফুটো করতে পেরেছেন । মলয়ের লেখা পড়ে মুহূর্তের জন্যও মনে হয়, এমন কেন সত্যি হয় না, আহা । সত্যের একটা গরম হাওয়া বয়ে যায় আমাদের মিথ্যের সাজানো বাগানের ওপর দিয়ে, আমাদের সযত্নলালিত কালচেসবুজ গাছপালা পলকে শুকিয়ে ওঠে ।শুধু মনে হয়, এই কথাগুলো যদি পুরোপুরি আমাদের চেনা ও বিশ্বাস্য ভাষায় বলতেন মলয় ! মলয়ের কাহিনি ও মলয়ের পাঠকের মাঝখানে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে মলয়ের দেহরক্ষী মাস্তান মলয়ের বাংলাভাষা, তার কোমরে গোঁজা চেম্বার গুরুপাঞ্জাবির তলা থেকে উঁচু হয়ে আছে, তার বীরাপ্পনের মতো চৌগোঁফা স্পষ্ট দেখা যায় । পাঠককে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখলেই সে কড়া গলায় বলে, ‘ভিড় বাড়াবেন না দাদা, নিজের কাজে যান…’ আর, মলয় রায়চৌধুরীর কোনও উপন্যাসেরই শেষটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, অবশ্য । প্রথম যখন ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ পড়েছিলাম, জুডি ও জুলিকে বিশ্বাসের অযোগ্য বলে মনে হয়নি, বিশেষ করে ‘ভালোবাসা চিরকাল ক্ষণস্হায়ী’ জাতীয় মন্তব্যের সঙ্গে । মলয়ের বর্ণনার গুণ হচ্ছে ডিটেলের কাজ চমৎকার — যা দিয়ে একটা ঘটনা বিশ্বাসযোগ্যতা পায় । চারুলতা যে বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল, তার জন্য ভূপতির খবরের কাগজের হরফগুলো অবধি তার সময়ের সপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছে । শুনেছি, শতরঞ্জকে খিলাড়িতে যে আগ্নেয়াস্ত্রগুলো দেখানো হয়েছিল, যোধপুররাজের অস্ত্রাগার থেকে নিজের হাতে বেছে সেগুলোকে নির্বাচন করেছিলেন পরিচালক — আর কিছু নয়, বন্দুকের কুঁদোয় রিভলভারের হাতলে তৈরির তারিখটা লেখা থাকে, সেটা ১৮৫৮ বা তার আগেকার তারিখ হওয়া চাই । সে তারিখ কেউ পড়তে পারুক বা না পারুক । ডিটেলের ব্যাপারে মলয় রায়চৌধুরীও সেই একই পথের পথিক । চমৎকার ডিটেলের কাজ মলয়ের, বর্ণিত বিষয় ছবির মতোই স্পষ্ট হয়ে ওঠে । দুয়েকটা উদাহরণ দিই, মলয়ের লেখা যাঁরা পড়েননি, তাঁদের জন্যে, ‘নামগন্ধ’ থেকে :- ‘…ক্যামাক স্ট্রিট ভিড়ে ভিড়াক্কার । রাস্তার দুপাশে পুলিশের জিপ, লরি, খাকি, লাঠি, রেব্যান, খইনি, এলাহি । আদিত্যকে দেখতে পেল । আদিত্য যিশুকে আসতে দেখে, রেব্যান চশমা পরে নিলে । হাতে বেটন । বুকে নামের তকমা । গটগটিয়ে রোয়াব । প্রোমোশান পেয়ে গেল নাকি, ওপরওলাদের টাকা খাইয়ে । ওঃ, তুই তো একদম উত্তমকুমারের পাইরেটেড ভার্সান…’ অথবা, পাটনার বারিপথের বর্ণনা, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’-এ । কোনও রাস্তার এমন জীবন্ত বর্ণনা, অন্তত বাংলায় ক্বচিৎ পড়েছি :- ‘…বারিপথের দুপাশে সমস্ত ফাঁকা জায়গায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে চট টাঙিয়ে অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িকুড়ির ষষ্ঠীপূজক ছটমাইয়ার সংসার, ভাত, ডাল, রুটির দোকান, চুলকাটার, তাড়ির, গাঁজার, জুয়ার, চেলেভাজার, খাজা আর বেসনলাড্ডুর, রিকশ আর ঠ্যালা রাখার, বাঁশ আর শালখুঁটির, টিপ-সিঁদুর-চুড়ির পশরা-দোকান, নানান দেবী-দেবতার মিনিমন্দির । বারিপথের সমান্তরাল, গঙ্গার পাশ দিয়ে, পশ্চিমে পাটনা সাহেব থেকে পুবে খগোল ওব্দি এগিয়ে গেছে, দুপাশে ঝকমকে দোকানপশরা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল টাউনহল গোলঘর সাজিয়ে অশোক রাজপথ । সারা পাটনা শহর দেখা যায় গোলঘরের টঙ থেকে, দুর্ভিক্ষের শস্যভাঁড়ার ছিল মন্বন্তরে, এখনও তাই, গর্ভগৃহে চেঁচালে তেইশবার প্রতিধ্বনি হয় । পায়ে পায়ে ক্ষয়ে গর্ত হয়ে গেছে গোলঘরের একশো চুয়াল্লিশটা সিঁড়ি । মেরামতের টাকা ফি-বছর ভাগাভাগি হয় । রাস্তা সারাবার বরাদ্দও তাই, নালি-নর্দমা পড়ে আছে কন্ঠরুদ্ধ হয়ে…’ ডিটেলের কাজে এর চেয়ে ভালো পথবর্ণনার একমাত্র দৃষ্টান্ত, বাংলায়, যা আমার মনে পড়ছে, তা হল সকাল বেলাকার চিৎপুর রোডের সেই বর্ণনাটি :- ‘… সকালবেলাকার প্রথম সূর্যকিরণ পড়িয়াছে শ্যাকরাগাড়ির আস্তাবলের মাথায়, আর এক সার বেলোয়াড়ি ঝাড়ওয়ালা মুসলমানদের দোকানের উপর । গ্যাসল্যাম্পগুলোর গায়ে সূর্যের আলো এমনি চিকমিক করিতেছে, সেদিকে চাহিবার জো নাই !…ম্যুনিসিপালিটির শকট কলিকাতার আবর্জনা বহন করিয়া অত্যন্ত মন্হর হইয়া চলিয়া যাইতেছে । ফুটপাথের পার্শ্বে সারি সারি শ্যাকরাগাড়ি আরোহীর অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া ; সেই অবসরে অশ্বচর্মাবৃত চতুষ্পদ কঙ্কালগুলো ঘাড় হেঁট করিয়া অত্যন্ত শুকনো ঘাসের আঁটি অন্যমনস্কভাবে চিবাইতেছে ; তাহাদের সেই পারমার্থিক ভাব দেখিলে মনে হয় যে, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহারা তাহাদের সম্মুখস্হ ঘাসের আঁটির সঙ্গে সমস্ত জগৎসংসারের তুলনা করিয়া সারবত্তা ও সরসতা সম্বন্ধে কোনো প্রভেদ দেখিতে পায় নাই । দক্ষিণে হৃতচর্ম খাসির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কতক দড়িতে ঝুলিতেছে, কতক খণ্ড খণ্ড আকারে শলাকা আশ্রয় করিয়া অগ্নিশিখার উপরে ঘুষ খাইতেছে এবং বৃহৎকায় রক্তবর্ণ কেশবিহীন শ্মশ্রুলগণ বড়ো বড়ো হাতে মস্ত মস্ত রুটি সেঁকিয়া তুলিতেছে।…’ কলকাতায় এত সাহিত্যিকের ভিড়, আজ পর্যন্ত কালীঘাটের মন্দিরে যাবার রাস্তাটার এরকম একটা বর্ণনা দিলেন না কেউ । কিন্তু কথা হচ্ছিল মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাসের শেষ করার পদ্ধতি নিয়ে । ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ পড়ে চমক লেগেছিল, মনে হয়েছিল খুব ঔচিত্যময় সমাপ্তি । কিন্তু ‘নামগন্ধ’ পড়ে খটকা লাগল একটা । কোথায় যেন একটা মিল আছে শেষটায়, আগের বইখানার সঙ্গে । খুশির সঙ্গে জুডি-জুলির একটা মিল আছে এটা মাথার পেছন দিকটায় মনে হচ্ছিল, কিন্তু মিলটা কোথায় ঠিক ধরতে পারছিলাম না । ‘জলাঞ্জলি’ পড়ে উঠে পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা । উপন্যাসের শেষে মলয় রায়চৌধুরী একটা রগরগে মোচড় দিতে ভালোবাসেন । যে-উপকরণ, যে-দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী সাহিত্যে এসেছেন, সেই ঋদ্ধতা কম মানুষের থাকে । মলয়ের যা পশ্চাৎপট, মলয়ের স্মৃতিকথা পড়ে বুঝতে পারলাম, তা সাধারণ কলকাতাবাসী ঘটি বা বাঙাল মধ্যবিত্তের কল্পনার অতীত । উত্তরপাড়ার পড়ন্ত আভিজাত্যের বিলীয়মান ছায়া ছেড়ে পাটনার নিম্নমধ্যবিত্ত বস্তিপাড়া ঘুরে মলয় যেখানে পৌঁছোলেন তা ধারণায় আনতে পাঠকের কয়েক জন্ম কেটে যাবে ।

সোমবার

সোনালী মিত্র : মলয় রায়চৌধুরীর জন্মদিন

প্রিয় মানুষ, প্রিয় কবি, অজস্র সৌরবছর তোমার জন্মদিনের উৎসব আলোক বর্তিকা হয়ে ফুটে থাকুক প্রতিটি সাহিত্যমননে। প্রেম জেনো, শ্রদ্ধা জেনো,প্রণাম জেনো, ভালোবাসা জেনো। কিই বা দিতে পারি! বারবার উৎসর্গ হোক কলম তোমার পায়ের কাছে। ক্রমশ উর্দ্ধ সত্তরের প্রেমে ডুবে যাচ্ছে বসন্তবর্ষীয় আয়ু, সারসার দিয়ে রক্তকীট ...বাস্তুতন্ত্রের বিষাক্তফণা ধেয়ে গেল গঠনপক্ত মধ্যে তিরিশের দিকে ,তাদেরও হারিয়ে দিতে পারে বুকে লাটখেয়ে যাওয়া তোমার সাদা চুলের ঘোড়া। ছুটছে ,ছুটছে ছত্রপতি শিবাজি চত্বর পেরিয়ে মহানভারত দরজায় উড়িয়ে দিচ্ছে সবুজ পতাকার স্নেহ। পতাকার দন্ডে আত্মমৈথুনরত সাহিত্যচেতনা। থ্রিজি নেটওয়ার্কেও কেন গিলে নিতে পারছি না সমগ্র তুমিকে! পিচ্ছিলজাত পরমান্নে ফসকে যাওয়ার খেলা। উফ! আর পারছি না কেন!জ্বলে যাচ্ছে সৃষ্টিশীল তুরুপ? কেন ডুবে যাচ্ছি তোমার মধ্যে? তোমার থেকে তোমার আগুন জ্বলানো বীর্যক্ষয়ী শব্দের শরীরে? সেখানে আউসের শীষে সোনালী শিল্পের ক্ষণজন্ম তেমন ভাবে জরুরী কি? সেখানে আমাদের মত সহস্র তামাটে চামড়ার ছড়াছড়ি যারা চিচিং ফাঁক মেলে ধরে সিঁধিয়ে নিয়েছিল ছয় ফুট আট ইঞ্চির আত্মঘাতী ধাতব সমীকরণ ... দশেরার রাবণ মারতে মারতে আমিও পুরুষ বিরোধী হয়ে উঠছি সময়? আমিও সেঁটে নিচ্ছি তকমা !নারীবাদী হলে কতটুকু লাভ চেটেপুটে নেওয়া যায় ক্যালকুলেশনে বইয়ে দিচ্ছি ফেসিয়ালে লোমতোলা মোম ত্বক! আমার শিরায় -প্রতিশিরায় একশ ছিনে জোঁক বাসা বাঁধবে বলে নি, আমার জঙ্ঘার মধ্যবিত্ত গুহায় ঘোলা রসে তোমার নাম নিয়ে প্যান্টি ভিজিয়ে যাবে এমন ও ঘটে নি প্রিয় পুরুষ। তবুও তোমার প্রেমে পড়া যায়! গত এককুড়ি রমনীর মত বুকের ওড়না সরিয়ে বলতেই পারি আমিই বা কম কিসে! যারা তোমার শীতঘুম ভাঙণের অহরহ নায়িকা , চোখ তুলে দেখ নব্বই মিলিয়ন উষ্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি শূন্যদশকের খাতা জুড়ে।একশ শ্বাপদ হামলে পড়েছে নারীর রাসালো খাদ্যের দিকে। সন্ধ্যারতি থেকে ভোরের নামাজে তক ছুড়ে দিচ্ছে মুঠোমুঠো উপঢৌকন উপাচারে। আমি ওদের পাত্তা দিই না.... তোমার কথা ভেবে,বালিসে চুমু খেতে খেতে এটা তো জানি কগজের গায়ে উষ্ণতা দিতে সক্ষম বলেই আমার আগে ও পিছের রাধাবিন্দুর একচ্ছত্র সম্রাট তুমি। অগ্রজ "শুভা" মহলক্ষ্মী হলে তুমি শঙ্খ -চক্র -গদা - পদ্মে তেভাগার নারায়ন , রূপের পরে কয়েকটা শূন্য বসালেই জলন্ত সূর্যের তাপ ক্রমশ হ্রাস। তখন কাকে আগ্রাধিকার দিয়ে বলবে প্রিয় তোর শ্রীমুখ ঐশ্বর্যের উপর অন্নপূর্ণা! ঐশ্বর্যের উপর নিটোল ফিগার এঞ্জেলিনা তথাস্ত ঠোঁটের আগমন! না মশাই কেবল রূপের মহিমা নই... সন্ন্যাসী এবং শরীরখোড় ঈশ্বর এলেও তরতর করে লিখে যেতে পারি বিশ্বাসঘাতিনী শব্দ। তোমার মত একচাদরের নীচে নারী ও শিল্পকে সঙ্গমরত করে বলতে পারি নারী ও শিল্পের মত বিশ্বাসঘাতিনী আর কিছু নেই. প্রেমিকার চোখের দিকে চোখ রেখে জেগে ওঠা পুরুষাঙ্গের মত অস্থির কলমের দিব্যি -ঘাড়ের নীচে কামড়ে ধরে থাকা ক্ষুদার্থ বাঘিনীরদল তোমার শিরদাঁড়া ভাঙা জন্তুটাকেও নাড়িয়ে চাড়িয়ে তারাও বলতে পারে- যৌবন থেকে শিল্প পযর্ন্ত গল্পকে টেনে নিয়ে যাওয়াও একটা আর্ট, যৌনতা থেকে কবিতা পর্যন্ত সৃষ্টিকে সফলতা দেওয়াও একটা আর্ট। শুধু সেখানেই তুমি-আমি কি সফল! "ওরা"বলে, নষ্ট শব্দের কচকচি ঘাঁটার চেয়ে তোমার আর্থ্রাইটিস ভোগা অঙুল ঢের বেশি ভাল। যাদের জড়িয়ে বলতে পারি, যে শিশুদের জন্ম দিয়েগেল বাতক্ষয়িত আঙুল তারা তোমার বীর্যের চেয়েও দামী। শ্লেষ্মা কষ্টে হৃদপিণ্ড জাগা বুকে শেষ বারের মত ভরে নাও বিশুদ্ধ অক্সিজেন আর একবার তোমার নীচে আরাম গ্রহণকারিনী নারীটিকে ভেবে ছড়িয়ে দাও বীর্য ৩০০০০০০ শিশু উড়ে যাক গ্রিক মিথোলজির দিকে সাবর্ণ লাম্পট্য আমপ্লিফিয়ার ছিঁড়েখুড়ে নারীর পরম মমতার দিকে বেঁচে থাক মাইলের পর মাইল নায়িকা ও পুরুষের পুনঃমিলনের পরে সৃষ্টি ইতিহাস।