শিউলি বসাক নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
শিউলি : সাহিত্য রচনায় এলেন কীভাবে ?
মলয় : বইপোকা ছিলুম শৈশব থেকে । মার্কসবাদ নিয়ে পড়াশুনায় উৎসাহ
দিয়েছিলেন নমিতা চক্রবর্তী,
আমার স্কুলের গ্রন্হাগারিক । ওনার গালে টোল পড়ত । যাদের গালে টোল
পড়ে তারা চিরকাল
আমায় আকর্ষণ করেছেন । যেমন ইমলিতলা পাড়ার কুলসুম আপা,
যিনি আমার সঙ্গে গালিব,
ফয়েজ ও যৌনতার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন । দাদা কলকাতা থেকে প্রচুর
কবিতার বই আনতেন আর বাবা কিনে দিতেন ইংরেজি বই । বাড়ির কাজের লোক
শিউনন্দন কাহার ‘রামচরিত মানস’ মুখস্হ বলতে পারতো ; বাবার দোকানের কর্মী
রামখেলাওন সিং ডাবর বলতে পারতো রহিম, দাদু, কবির । বড়োজ্যাঠা ছিলেন
পাটনা মিউজিয়ামের কিপার অফ পেইনটিংস অ্যাণ্ড স্কাল্পচার্স । জাঠতুতো দিদিরা
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতেন ও গাইতেন । আমি বেহালা বাজানো শেখা আরম্ভ করি ।
এইরকম আবহে লেখালিখির প্রতি আগ্রহ গড়ে ওঠে ।
শিউলি : দেশি-বিদেশি কার কার লেখা পড়তেন আন্দোলন শুরুর আগে?
মলয়: আমি ব্রাহ্ম স্কুলে পড়তুম । নমিতাদি আমাকে ব্রাহ্মদের বই পড়তে দিতেন, যদিও উনি
বলতেন না যে লেখক ও কবিরা ব্রাহ্ম, কেননা তখনকার দিনে সাধারণ বাঙালি পরিবার
ব্রাহ্মদের এড়িয়ে চলতেন । ব্রাহ্ম স্কুলের আগে ক্যাথলিক স্কুলে পড়ার ফলে ওল্ড আর নিউ
টেস্টামেন্টের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ফাদার হিলম্যান ; প্রতি বৃহস্পতিবার বাইবেল ক্লাস হতো,
সংলগ্ন চার্চে । যখন দীপক মজুমদারের পরামর্শে ইতিহাসের দর্শন পড়া আরম্ভ করি তখন বিষয়টা
সম্পর্কে নানা বই পড়া আরম্ভ করেছিলুম । ইতিহাসের দর্শন নিয়ে একটা ধারাবাহিক লেখা
বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । মার্কসবাদের উত্তরাধিকার নামে একটা বই লিখেছিলুম,
দাদা পাণ্ডুলিপি দিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আর আমি দিয়েছিলুম ১৯০০০ টাকা ।
কিন্তু শক্তি তা মদ খেয়ে উড়িয়ে দেন আর বইটা ভুলভাল নোংরাভাবে প্রকাশ করেন ।
আমার এতো রাগ হয়েছিল যে ওনার উল্টোডাঙার বস্তিবাড়ির সামনে সব কপি জড়ো করে
পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলুম।
শিউলি : সাহিত্য আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাই বা কেন মনে করলেন সেই সময়ে?
মলয় : হাংরি আন্দোলন নিছক সাহিত্য আন্দোল ছিল না । আমরা নানা বিষয়ে ইশতাহার
প্রকাশ করেছিলুম আর সেই কারণেই আমাদের হেনস্হা করা হয়েছিল । নিছক সাহিত্য আন্দোলন
করলে আমাদের ওইভাবে আক্রমণ করা হতো না । আন্দোলন আরম্ভ করেছিলুম শেয়ালদা
স্টেশানে উদ্বাস্তুদের ভয়ঙ্কর দুর্দশা প্রতিদিন দেখার পর । দাদা পানিহাটি থেকে সিটি কলেজে যেতো ।
আমিও পানিহাটি গেলে শেয়ালদা দিয়েই যেতুম । এখনকার শেয়ালদা দেখে অনুমান করা যাবে না
তখনকার ভয়াবহ অবস্হা । প্রতিবাদ আর সমাজকে ঢুঁ মারা জরুরি ছিল ।
শিউলি : হাংরি আন্দোলনকে কি দুই পর্বের ধরব ? না কি ’৬৫ তেই শেষ?
‘ক্ষুধার্ত’কে কীভাবে দেখা যেতে পারে?
মলয় : একটাই পর্ব ধরা উচিত । দুর্ভাগ্যবশত আমি লেখা কিছুকাল বন্ধ রাখার পর
শৈলেশ্বর ঘোষ ক্ষুধার্ত আরম্ভ করেছিল, কিন্তু নেতৃত্বের যোগ্যতার অভাবে সারা পৃথিবীতে
ছড়িয়ে দিতে পারেনি । এমনকি অলোক গোস্বামীরা উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করলে
লোক পাঠিয়ে ভণ্ডুল করে দিয়েছিল ; সুভাষ ঘোষকে লোক লাগিয়ে মারধর করেছিল যার
দরুন সুভাষ ঘোষ ক্ষুধার্ত খবর নামে আলাদা পত্রিকা আরম্ভ করে । যতো পত্রিকা আছে সবই
হাংরি আন্দোলনের বলে ধরা উচিত । পরাবাস্তববাদীদের ঝগড়াঝাঁটি হাংরিদের তুলনায়
বহুগুণ বেশি হয়েছিল, অনেকবার দল ভাগাভাগি হয়েছিল ।
কিন্তু পরাবাস্তব বলতে একটাই আন্দোলন বোঝায় ।
শিউলি : বাজারে যে কয়েকটি ‘ক্ষুধার্ত’ সংকলন পাওয়া যায়,
সাধারণ পাঠক সেগুলিকেই হাংরি-সংকলন হিসেবে গ্রহণ করে আসছে,
এই ব্যাপারে আপনার অনুভূতি ও মতামত কী ?
মলয় : জানি । তার কারণ সামগ্রিকভাবে কেউই চেষ্টা করেননি সবাইকে
একত্রিত করে সংকলন প্রকাশ করতে । উইকিপেডিয়ায় দেখলুম প্রচুর নাম অন্তর্ভুক্ত
করা হয়েছে হাংরি আন্দোলনে । আমি অনেককে চিনি না । না চিনলেও আমি তাদের
অন্তর্ভু্ক্ত করতে চাইবো । কেউ নিজেকে হাংরি ঘোষণা করলে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে,
এটাই ছিল আমাদের পন্হা ।
শিউলি : সাহিত্যক্ষেত্রে ‘এস্টাব্লিশমেন্ট’ ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখেন ?
মলয় : এসট্যাবলিশমেন্ট একটা বিমূর্ত ক্ষমতা । সেই ক্ষমতা যারা নিয়ন্ত্রণ করে
তারা নির্দিষ্ট ক্যানন চাপিয়ে দিতে চায় । আমি মনে করি সাগরময় ঘোষের কারণে
বাংলা সাহিত্যে পাল্প ফিকশানের প্রবেশ । গদ্য নিয়ে যারা কাজ করতে চেয়েছে
তাদের সাগরময় ঘোষ পাত্তা দেননি, যেমন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর উদয়ন ঘোষকে ।
শিউলি : কবিতায় শব্দচয়ন কীভাবে করেন? ভেবেচিন্তে, না কি স্বতস্ফূর্ত ?
মলয় : কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া নেই । মনে এলে লিখি, ফেলে রাখি, ঘষামাজা করি,
তাই ভাবনা আর স্বতঃপ্রক্রিয়া দুটোই কাজ করে ।
শিউলি : শ্লীলতা ও অশ্লীলতাকে আপনি কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেন ?
মলয় : ওই বাইনারি বিভাজন এনেছিল প্রটেস্ট্যান্ট পাদরিরা । তার আগে আমাদের
অমন বিভাজন ছিল না । ওদের কারণেই আমাদের রসশাস্ত্র লোপাট হয়ে গেছে ।
তাছাড়া বাংলা সাহিত্যে বহুকাল নিম্নবর্গ আর নিম্নবর্ণের মানুষদের দিনানুদৈনিক
বুলিকে ঢুকতে দেয়া হয়নি ।
শিউলি : হাংরি আন্দোলনের সময় লেখালেখির পাশাপাশি আরও যে ঘটনাগুলি ঘটেছে,
জুতোর বাক্স রিভিউ করতে পাঠানো ইত্যাদি ইত্যাদি; সেগুলি তখন কী মনে করে করা হয়েছিল,
এখনই বা আপনি কী মনে করেন?
মলয় : ওগুলো দিয়েই তো সমাজকে ভিত থেকে নাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, বিশেষ করে
মুখোশ পাঠানোর ব্যাপারটা । অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা আবু সয়ীদ আইয়ুবের চিঠি
পড়লেই টের পাবে যে এলিট সম্প্রদায় কতোটা আঘাত পেয়েছিল ।
শিউলি : হাংরি আন্দোলনের সময় আপনাদের লেখালেখিকে যেভাবে দেখেছেন,
এখনও সেভাবেই দেখেন কি?
মলয় : হাংরি আন্দোলনের সময়ে সারা ভারতবর্ষকে দেখিনি যা গ্রামীণ উন্নয়ন আধিকারিকের
চাকরির অভিজ্ঞতায় জেনেছি । ১৯৭০ থেকে আমার প্যানারমা বিশাল হয়ে গেছে ।
হাংরি আন্দোলনের সময়ে ছিলুম পাটনা শহরের দলিত পাড়া ইমলিতলার ছোটোলোক বর্গের তরুণ ।
শিউলি : নতুন করে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না কখনও ?
মলয় : আমার মনে হয় আর কোনো সাহিত্য আন্দোলন সম্ভব নয় ।
বহু তরুণ আমাকে অনুরোধ করেছেন নতুনভাবে আন্দোলন আরম্ভ করার ।
আমি সবাইকে এই একই কথা বলেছি ।
শিউলি : সমকালীন শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্য আন্দোলনকে সেই সময়ে কীভাবে দেখেছেন,
এখনই বা কীভাবে দেখেন?
মলয় : ওনারা পুরোপুরি সাহিত্যে কেন্দ্রিত ছিলেন ।
সমাজকে নাড়া দেবার অন্য উপায়ের কথা ভাবেননি ।
ওনাদের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না ।
প্রতিষ্ঠানের চাপানো ক্যানন ভেঙে ফেলার পথ
ওনারাও পরের প্রজন্মকে দেখিয়েছেন ।
শিউলি : বাংলা সাহিত্যের ধারায় হাংরি জেনারেশনের গুরুত্ব আপনার চোখে কতখানি ?
সমকালীন শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্য আন্দোলনের গুরুত্ব আপনার চোখে কতটা?
মলয় : এখন তো হাংরি আন্দোলন নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা হচ্ছে ।
পেঙ্গুইন র্যানডাম হাউস থেকে বই বেরিয়েছে । ইনটারনেটে প্রচুর রচনা দেখতে পাই,
হাংরিদের ইনটারভিউ দেখতে পাই । শ্রুতি আর শাস্ত্রবিরিধিদের তেমন উপস্হিতি নেই ।
আমার মনে হয় সব কয়টা আন্দোলন নিয়ে ইংরেজিতে একটা বই বের করে যদি কেউ বিশ্বের
পাঠকদের সামনে নিয়ে আসেন তাহলে ভালো হয় ।
শিউলি : আপনি সাহিত্য আকাদেমি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কী মনে করে?
মলয় : আমি কোনো পুরস্কার নিই না । যেকোনো পুরস্কার যিনি বা যাঁরা দেন তাঁর বা
তাঁদের মূল্যবোধ বহন করে । তৃণমূল এসেই বাংলা অ্যাকাডেমির সদস্যদের ভাগিয়ে দিল
অথচ তাঁরা সবাই জ্ঞানীগুণী মানুষ ছিলেন । কেন ?
কেননা আগের সদস্যরা একটি ভিন্ন মূল্যবোধের বাহক ছিলেন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন