যে লেখকের কলমের ভরকেন্দ্র হল মনস্হিতির বোধ ও উপলব্ধির,
একাকীত্বের খুল্লমখুল্লা জবানবন্দি, তাঁর সামনে দাঁড়াতে অস্বস্তি হয়।
প্রচলিত জনপ্রিয় সাহিত্যের ফিল-গুড ব্যাপারটা হারিয়ে যায় দুম করে, কারণ
এতটা সততা তীব্র ও অসহনীয়। কিভাবে মলয় রায়চৌধুরী তাঁর লেখায় আত্মপ্রক্ষেপণ
ঘটিয়েও নিরপেক্ষ হয়ে যান, সামাজিক ঘটনার দ্রষ্টা হন, নির্মম সমালোচনায়
শাণিত ইস্পাত হয়ে ওঠেন, তাঁর নিজের এই বাছাই সঙ্কলনটি পড়লে টের পাওয়া যায় ।
কিভাবে মলয় রায়চৌধুরী তাঁর লেখায় আত্মপ্রক্ষেপণ ঘটিয়েও নিরপেক্ষ হয়ে যান,
সামাজিক ঘটনার দ্রষ্টা হন, নির্মম সমালোচনায় শাণিত ইস্পাত হয়ে ওঠেন, সেটা
বোঝা যাবে এই বইটা পড়লে। আর তাই নেক্রোফিলিয়া বা শবদেহের সঙ্গে সংগমের মত
বিষয় তাঁর হাতে পড়ে হয়ে ওঠে অন্তর্ঘাতের মাধ্যম। মলয় নিজেকেই যেন ছুরি দিয়ে
কোপাতে থাকেন, আর তখন যে রক্তপাত হয় সেটাই তাঁর লেখালিখি। নেক্রোপুরুষ,
স্বমেহনের দর্শন, অথবা ডিসটোপিয়ার দেশ, যাই পড়ি না কেন, মলয় সেখানে নিজের
মাংসের টুকরোই সাজিয়ে রেখেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার যে মলয় রায়চৌধুরী বাংলা
সাহিত্যে কালজয়ী লেখক হতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন বাঁক বদলের জন্য, যেন
সেটাই তাঁর কাজ। মলয়ের সেরা লেখা কোনটা? সম্ভবত মলয়ও জানেন না। কেননা তিনি
সেরা লেখা লিখতে চাননি কখনো, চেয়েছিলেন চলমান সাহিত্যের ওপর হাতুড়ির ঘা
মেরে নিজের ভাষাটাকে প্রতিষ্ঠা করতে। কতটা সফল হয়েছেন, সময় বলবে। কিন্তু এই
সঙ্কলনটা পড়লে বোঝা যায়, এত বয়েসে এসেও মলয় গেরিলা আক্রমণের রণনীতি থেকে
পিছু হটবার পাত্র নন।
ব্যক্তিগতভাবে আমি সবথেকে বেশি তড়িদাহত হয়েছই নেক্রোপুরুষ নামক গদ্যটি পড়ে। এটা এতই অন্যরকম যে একে গল্প, উপন্যাস, কনফেশন এরকম কোনও খোপে ঢুকিয়ে দিতে না পেরে 'গদ্য' নামক একটি সাধারণীকৃত উপাধি বাধ্য হয়ে ব্যবহার করতে হল। বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার শব্দ তখনই শোনা যায়, যখন তা শোনার জন্যে কেউ থাকে। সাহিত্যের কাজ কী? ক্যাথারসিস করা? মানে, মোক্ষণ? বরং মলয়ের লেখা প্রতিমুহূর্তে ক্যাথারসিসের উল্টোদিকে হাঁটে, নেক্রোপুরুষ তার প্রধান উদাহরণ। মোক্ষণ করা, শান্তি দেওয়া তাঁর কাজ নয়, বরং আপাতশান্তির বোধটাকে আঘাত করাই মূল উদ্দেশ্য! নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া’র গড্ডালিকা স্রোতগুলোর পালটা স্রোত সাহিত্যে-জীবনযাপনে আসে। আর, যতোটা ‘সংস্কৃতি’ ঠিক করে দেওয়া রাষ্ট্র থাকবে, ততটাই থাকবে রাষ্টনির্মিত, তথা পুঁজিনির্মিত সেই ‘সংস্কৃতিকে’ প্রত্যাখ্যান। হয়তো সমান্তরাল, তবু থাকবে। প্রবলভাবেই। অনেকটা এরকম
"হ্যাঁ, আমি মেয়েদের শবের সঙ্গে প্রেম করে পরম সন্তোষ পাই। নাঃ, পেতুম বলা ভাল। মেয়েদের শব মাত্রেই, হোয়াট ইউ কল, সচ্চিদানন্দময়ী, যাদের বুকের ভেতরে আর বাইরে লেজার আলো কিং কোবরার মতন কুণ্ডলী পাকিয়ে ওত পেতে থাকে, আচমকা বেরিয়ে জাপটে ধরে, আলোয় আলো করে দেয় অস্তিত্বকে"। (নেক্রোপুরুষ)
আত্মস্বীকৃতি, ঐতিহ্যের নামে স্খলনের সর্বস্ব বিনাশী যে সাহিত্যরাজনৈতিক প্রকল্প মলয় গ্রহণ করেছেন, খুব অস্তিত্বগত কারণেই মূলধারার সাহিত্যের পক্ষে তাকে হজম করা সম্ভব হয়নি। তাই এক সময়ে একে হাংরি, ক্ষুৎকাতর এবম্বিধ বহু অভিধায় ভূষিত করা হয়েছিল। কিন্তু সত্যি বলতে কি হাংরি রূপকেও আর বেঁধে ফেলা যাচ্ছে না মলয় রায়চৌধুরির লেখাকে। কিং কোবরা যখন অস্তিত্বকে আলোয় আলো করে দিচ্ছে, এমন উপমা তো আমাদের ধ্রুপদী সাহিত্য থেকেই সারজল সংগ্রহ করে নিয়েছে বলা চলে। পূর্বজদের থেকে ঋণ নিয়ে তারপর ট্র্যাডিশনকে আক্রমণ করা, অসম্ভব শক্তিশালী কলম ছাড়া এমন হওয়া সম্ভব নয়। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, অন্তত এই বাছাই সংকলন পড়ে এমনটাই মনে হয়েছে যে মলয় রায়চৌধুরীর আক্রমণ পণ্যবাহী সভ্যতাজাত ব্রয়লার সংস্কৃতির প্রতি। বাংলার আবহমান ট্র্যাডিশনের কাছে দিনের শেষে তাই নতজানু থেকে তিনি উচ্চারণ করতে পারেন "আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে বাংলা ভাষা আমার স্বদেশ নয়" (আমার স্বদেশঃ বাংলা ভাষার জন্য প্রেমের কবিতা)
বহু আগে আর্থার মিলার বলেছিলেন, ‘ভাষাকে যে আক্রমণ সরে সেই ভাষাকে বাঁচায়।’ মলয় রায়চৌধুরি একই সঙ্গে হন্তারক ও পরিত্রাতা হিসেবে নিজেকে খুঁড়তে চাইছেন। এই যাত্রাপথ কঠিন, এবং সকলের জন্য নয়।
ব্যক্তিগতভাবে আমি সবথেকে বেশি তড়িদাহত হয়েছই নেক্রোপুরুষ নামক গদ্যটি পড়ে। এটা এতই অন্যরকম যে একে গল্প, উপন্যাস, কনফেশন এরকম কোনও খোপে ঢুকিয়ে দিতে না পেরে 'গদ্য' নামক একটি সাধারণীকৃত উপাধি বাধ্য হয়ে ব্যবহার করতে হল। বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার শব্দ তখনই শোনা যায়, যখন তা শোনার জন্যে কেউ থাকে। সাহিত্যের কাজ কী? ক্যাথারসিস করা? মানে, মোক্ষণ? বরং মলয়ের লেখা প্রতিমুহূর্তে ক্যাথারসিসের উল্টোদিকে হাঁটে, নেক্রোপুরুষ তার প্রধান উদাহরণ। মোক্ষণ করা, শান্তি দেওয়া তাঁর কাজ নয়, বরং আপাতশান্তির বোধটাকে আঘাত করাই মূল উদ্দেশ্য! নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া’র গড্ডালিকা স্রোতগুলোর পালটা স্রোত সাহিত্যে-জীবনযাপনে আসে। আর, যতোটা ‘সংস্কৃতি’ ঠিক করে দেওয়া রাষ্ট্র থাকবে, ততটাই থাকবে রাষ্টনির্মিত, তথা পুঁজিনির্মিত সেই ‘সংস্কৃতিকে’ প্রত্যাখ্যান। হয়তো সমান্তরাল, তবু থাকবে। প্রবলভাবেই। অনেকটা এরকম
"হ্যাঁ, আমি মেয়েদের শবের সঙ্গে প্রেম করে পরম সন্তোষ পাই। নাঃ, পেতুম বলা ভাল। মেয়েদের শব মাত্রেই, হোয়াট ইউ কল, সচ্চিদানন্দময়ী, যাদের বুকের ভেতরে আর বাইরে লেজার আলো কিং কোবরার মতন কুণ্ডলী পাকিয়ে ওত পেতে থাকে, আচমকা বেরিয়ে জাপটে ধরে, আলোয় আলো করে দেয় অস্তিত্বকে"। (নেক্রোপুরুষ)
আত্মস্বীকৃতি, ঐতিহ্যের নামে স্খলনের সর্বস্ব বিনাশী যে সাহিত্যরাজনৈতিক প্রকল্প মলয় গ্রহণ করেছেন, খুব অস্তিত্বগত কারণেই মূলধারার সাহিত্যের পক্ষে তাকে হজম করা সম্ভব হয়নি। তাই এক সময়ে একে হাংরি, ক্ষুৎকাতর এবম্বিধ বহু অভিধায় ভূষিত করা হয়েছিল। কিন্তু সত্যি বলতে কি হাংরি রূপকেও আর বেঁধে ফেলা যাচ্ছে না মলয় রায়চৌধুরির লেখাকে। কিং কোবরা যখন অস্তিত্বকে আলোয় আলো করে দিচ্ছে, এমন উপমা তো আমাদের ধ্রুপদী সাহিত্য থেকেই সারজল সংগ্রহ করে নিয়েছে বলা চলে। পূর্বজদের থেকে ঋণ নিয়ে তারপর ট্র্যাডিশনকে আক্রমণ করা, অসম্ভব শক্তিশালী কলম ছাড়া এমন হওয়া সম্ভব নয়। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, অন্তত এই বাছাই সংকলন পড়ে এমনটাই মনে হয়েছে যে মলয় রায়চৌধুরীর আক্রমণ পণ্যবাহী সভ্যতাজাত ব্রয়লার সংস্কৃতির প্রতি। বাংলার আবহমান ট্র্যাডিশনের কাছে দিনের শেষে তাই নতজানু থেকে তিনি উচ্চারণ করতে পারেন "আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে বাংলা ভাষা আমার স্বদেশ নয়" (আমার স্বদেশঃ বাংলা ভাষার জন্য প্রেমের কবিতা)
বহু আগে আর্থার মিলার বলেছিলেন, ‘ভাষাকে যে আক্রমণ সরে সেই ভাষাকে বাঁচায়।’ মলয় রায়চৌধুরি একই সঙ্গে হন্তারক ও পরিত্রাতা হিসেবে নিজেকে খুঁড়তে চাইছেন। এই যাত্রাপথ কঠিন, এবং সকলের জন্য নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন