শ্বসন অথবা শাসন প্রণালী
প্রস্তাব এসেছিল মলয় রায়চৌধুরীর যে কোনো একটি গদ্য কিংবা কবিতা সংকলন নিয়ে আলোচনা করার, কিন্তু আমি তো ফোরেনসিক আলোচক নই। কোনো রচনাকে পোস্টমর্টেম টেবিলে ফেলে, ফালাফালা করে, মাংস-কৃমি খুঁটে বের করে, ভালো কিংবা মন্দ লাগাকে তত্ত্বের কড়াপাকে নাড়াচাড়া করে বিশ্লেষণ করতে শিখিনি। কোনো রচনা যদি পারে হ্যাঁচকা টানে গভীর সমুদ্রে ফেলে দিয়ে হাঙরের ঢেউয়ে লুটোপুটি খাওয়াতে তাহলে তারপর যা পারি তাহলো গ্রন্থটির খোলা পাতার সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে। অনেক ক্ষণ। দীর্ঘক্ষণ। তারপর বড় জোর সমমনস্ক কারো সঙ্গে পাঠ প্রতিক্রিয়াটুকু বিনিময় করতে পারি। তাই কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিলাম আমার অপারগতার কথা কিন্তু ওরা ওই পাঠ প্রতিক্রিয়াটুকুতেই রাজী হওয়ায় বেছে নিলাম,“ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস” উপন্যাসটি।
কেন এই নির্বাচন, সেটা এক কথা্য় বলা যাবে না। পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। প্রধান কারণ অবশ্যই, এটা কবি মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম উপন্যাস যা লিখিত হয়েছিল ১৯৯১-৯৩তে এবং হাওয়া ঊনপঞ্চাশ প্রকাশনী থেকে ১৯৯৪ তে প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময়ই আজীবন ভ্রাতৃবৎসল সমীর রায়চৌধুরী আমাকে উপন্যাসটি উপহার দিয়ে পড়ে দেখতে অনুরোধ করেছিলেন।বইটা নিয়েছিলাম বটে কিন্তু পড়িনি। অবহেলা বশতঃ ফেলে রেখেছিলাম, অন্ততঃ মাস খানেক তো বটেই। তারপর কী জানি কেন, একদিন পড়তে শুরু করেছিলাম! তারপর আর ফেলে রাখতে পারিনি। প্রায় এক সিটিঙেই শেষ করেছিলাম ছিয়ানব্বই পাতার এই উপন্যাসটি। স্বীকার করতে অসুবিধে নেই, পাঠ শেষে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে এরপর এই চব্বিশ টাকা মূল্যের বইটির অনধিক চব্বিশ বছর আমার সঙ্গী হয়ে থাকতে অসুবিধে হয়নি। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, এর মধ্যে আমার বাসভূমির বদল ঘটেছে। নিজস্ব শহর এবং পৈত্রিক দ্বিতল বাড়ি(যার একতলায় নিজস্ব লাইব্রেরি ছিল)ছেড়ে এসে মাথা গুঁজতে হয়েছে ভিন শহরের ছশো স্কোঃ ফুঃ- র এক শয়নকক্ষ সমৃদ্ধ ফ্ল্যাটে। মাপজোখের তথ্যটা জানানোর কারণ, স্থান সমস্যার কারণে ইচ্ছে অনিচ্ছায় আমাকে অনেক বইপত্রর মায়া ত্যাগ করে আসতে হয়েছে। এমন কী নিজের গল্প সংকলনের দু/তিন কপি বাদ দিয়ে বাকিগুলো অকাতর বিলিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম অথচ কী আশ্চর্য, এই বইটির ক্ষেত্রে ততটা নিস্পৃহ হোতে পারিনি!কিছু বাছাই বইপত্রের মাঝখানে ছোট্ট উপন্যাসটি আজও মুখ গুঁজে রয়েছে। এখন পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার স্বার্থে ফের যখন উপন্যাসটি পড়ছি তখনও অবাক হয়ে লক্ষ করছি এই রচনার বিষয়বস্তু এবং গদ্যশৈলী প্রথমদিন আমাকে যতটা আকৃষ্ট করেছিল, আজও ততটাই করছে। বাধ্য হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করছি, তবে কি চব্বিশ বছর ধরে এই উপন্যাসটি আমার সঙ্গ ছাড়েনি এই কারণে যে একদিন আমাকে দিয়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখিয়ে ছাড়বে,তাই?
হোতেই পারে এটা নিছকই আমার মনগড়া কল্পনা! হয়ত এই ভাবনা আমাকে তৃপ্তি দিচ্ছে! সে যা হোক মোদ্দা কথা হলো আপাততঃ এটাই প্রধান কারণ।
যারা উপন্যাসটি পড়েননি তারা কেউ জানতে চাইতেই পারেন, কী এমন মনিমাণিক্যের সন্ধান জুগিয়েছে মাত্র ছিয়ানব্বই পাতার এই উপনাস!কৌতুহলটা অবাঞ্ছিতও নয়, কিন্তু এ প্রসঙ্গে পরে কথা হবে। আপাতত জানাতে হবে, কেন আমি সেদিন মলয়ের উপন্যাসটির ব্যাপারে প্রথমে আগ্রহ দেখাইনি? কেন অবহেলায় ফেলে রেখেছিলাম? আমি যে ততদিনে মলয় রায়চৌধুরীর নাম শুনিনি কিংবা ওঁর লেখাপত্র পড়িনি, তা তো নয়! তাহলে?
এই বিবমিষা প্রসঙ্গে কথা বলতে হলে আমাকে ব্যক্তি মলয় রায়চৌধুরী প্রসঙ্গে ঢুকতেই হবে এবং সেটা যে খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে, তাতো নয়। হাংরি ম্যানিফেস্টো অনুযায়ী বাসুদেব দাশগুপ্ত বাদে সব হাংরি গদ্যকারই লেখার মালমশলা তুলে এনেছেন নিজের জীবন থেকে এবং কোনো মীথ-মেটাফর-অ্যালিগরির ধার না ধেরে সরাসরি সেসব তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। ওদের কাছে, যা কিছু ব্যক্তিগত সেটাই অশ্লীল। ওরা সন্ধান করেছেন গা-গতরের ভাষার। মেধার কর্টেক্সে পেনসিল ডুবিয়ে শিল্পচর্চা করার ঘোর বিরোধী ওঁরা প্রত্যেকেই। বন্ধুদের সঙ্গে যতই বিরোধিতা থাকুক মলয়ও বরাবর একই কাজ করেছেন, করে আসছেন। তিনি এবং তাঁর সাহিত্য, একে অন্যের পরিপূরক। তিনিও কোনদিন কল্পনাশ্রিত সাহিত্যচর্চা করেননি। সরাসরি বলেছেন-- দেখি খুল্লামখুল্লা লেখার চেষ্টা করে কতোটা কি তুলে আনতে পারি! উপন্যাস লিখতে বসে ঘটনা খুঁড়ে তোলার ব্যাগড়া হয় না। জীবনকেচ্ছা লিখতে বসে কেচ্ছা-সদিচ্ছা-অনিচ্ছা মিশ খেয়ে যেতে পারে, তার কারণ আমি তো আর বুদ্ধিজীবি নই। জানি যে মানুষ ঈশ্বর গণতন্ত্র আর বিজ্ঞান হেরে ভুত…..বাঙালি সাহিত্যিকদের চাঁদমারি ভাগ্য যে তাঁদের ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় না। বাংলা পাল্প ফিকশন হলো ঘোলা জলের আয়নায় মুখদর্শন…...সাহিত্যজগত থেকে ছিঁড়ে নিজেকে আলাদা না করলে লেখালিখি করা যায় না….আমি সাহিত্যিক লাউডগাগিরিতে ভুগি না, বুঝলেন তো! আমার লেখালিখি নিছক সাহিত্য নয়। গণপাঠককে আনন্দ দেবার জন্য নয় তা। পাঠককে চৌচির করে তার ভেতরে সমাজরাষ্ট্রের গুগোবর ভরে দেবার জন্য। আর আমি শিল্প ব্যাপারটার বিরুদ্ধে , কেননা আমাকে সারিয়ে প্রাচীন গ্রিক হেলেনিক সমাজের যোগ্য করে তোলা যাবে না। আমি চাই না যে আমার শবযাত্রায় কবি লেখকরা ভিড় করুক। একজনকেও চাই না…আমি লেখালিখি বেছে নিইনি, লেখালিখি আমাকে বেছে নিয়েছে ….প্রথম আদিম মানুষ যেমন পাথরের ছোরা আবিষ্কার করেছিল তেমনই আমি নিজের লেখালিখির অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছি।
যারা এই উপন্যাসটি পড়েছেন তারা হযত ধুঁয়ো তুলবেন,কই, এই উপন্যাসে তো ম্যালা চরিত্র! তাদের একেক জনের জীবন একেক রকম। এবং তারা কেউ মলয় রায়চৌধুরী নন। মলয় রায়চৌধুরী নামে একটি চরিত্র আছে বটে কিন্তু সারা উপন্যাসে তার উপস্থিতি মোটে দুবার, দু লাইনে। এবং সেই চরিত্রের ভূমিকাও নিছকই একজন আমোদগেঁড়ের।
উদ্ধৃত করতেই পারেন বইটির ভেতরের পাতায় লিখে দেয়া লাইনগুলো ,” ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস একটি কাল্পনিক উপন্যাস। চরিত্র, ঘটনা বা সংস্থার সঙ্গে মিল ঘটে গিয়ে থাকলে তা আকস্মিক।”
আমার কাছে একটি আপত্তিও গ্রহণযোগ্য হবে না কারণ উপন্যাসটি পাঠের পর কারুরই বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে এই উপন্যাসেও মলয় নিজেকেই ব্যবহার করেছেন। প্রতিটা চরিত্রই তার খুব কাছের মানুষজন। এই লুকাছুপির কারণ, উপন্যাসটির ব্যাকপ্রাউন্ড ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং উপন্যাস রচনা কালীন সময়ে যেহেতু মলয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অধিকর্তা পদে কর্মরত তাই জীবিকা স্বার্থেই এই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ এবং ওইসব ফর্মগত ছলচাতুরী। ঘরপোড়া গরুর তো সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরানোর কারণ থাকেই। এসব তুচ্ছ বিষয় বাদ দিলে যা থাকে তার সবকিছু মলয়সুলভই।
অতএব এরপর আমি নিশ্চিন্তে এই উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে নির্দ্বিধার ব্যক্তি মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে কিছু কথা বলতেই পারি এবং সেই বলাটা আদৌ শিবগীতি হবে না। তারচেও বড় কথা হলো, ইতিহাসের স্বার্থেই ওসব কথা আমি বলতে বাধ্য। বর্তমান সময় থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আমাকে পিছিয়ে যেতেই হবে। জানাতেই হবে যে, কিভাবে কিভাবে একদা মলয় রায়চৌধুরীর সংস্পর্শে এসেছিলাম।
আজ যেমন বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রই ওঁর রচনার সঙ্গে পরিচিত, সেদিন, আটের দশকের শুরুতে আমার কিন্তু তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিষয়ে জানকারি বাড়াতে গিয়ে মলয়ের নাম শুনেছিলাম বটে কিন্তু সেটা ছিল জাস্ট উল্লেখ মাত্র। তৎকালীন ক্ষুধার্ত লেখকবৃন্দ অনেক নামের সঙ্গে মলয়ের নামটুকু জানিয়ে ছিলেন বটে, ওঁর ক্যারিশ্মা সম্পর্কে কোনো তথ্যই ফাঁস করেননি। সেদিন তাই সবার লেখা পড়লেও মলয়ের লেখার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। ওঁর,” প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” শুধু যে পড়িনি, তা নয়, জানতামও না যে ওই কবিতার কারণেই রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত কেস কাছারি ঘটেছিল। বরং জানতাম শৈলেশ্বরের একটি কবিতাই ছিল ওই মোকদ্দমার কারণ।
অন্যভাবেও মলয় সম্পর্কে জানার কিংবা ওঁর লেখাপত্র পড়ার সুযোগ ছিল না। কোথাও পাওয়া যেত না মলয়ের লেখাপত্র। মলয়ের সঙ্গে যোগাযোগেরও সুযোগ ছিল না কারণ অভিমান এবং ক্যারিয়ার গোছানোর কারণে মলয় তখন ছিলেন স্বেচ্ছা অজ্ঞাতবাসে।
তো মলয় রায়চৌধুরীর কিরিয়া করমের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে তিরাশি/চুরাশি নাগাদ, ‘পথের পাঁচালী’ পত্রিকার পাতায়। পুনরাবির্ভাবেই ফের শোরগোল মাচিয়ে দিলেন মলয়। হাংরি আন্দোলেন ওঁর ভূমিকার কথা সেই প্রথম জানলাম বটে কিন্তু সেই জানকারির পুরোটাই ছিল ভাসাভাসা। কারণ তথ্যের পরিবর্তে ওই সাক্ষাতকারের পুরোটাই ছিল প্রাক্তন সহলেখকদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিষোদ্গার এবং অহং সর্বস্ব রণহুঙ্কার। (যে অভ্যেস মলয় আজও বজায় রেখেছেন। ভালোমন্দ কিম্বা ভদ্রতা-অভদ্রতার তোয়াক্কা না রেখে কারণে-অকারণে ছোড়া মলয়ের ইগোয়িস্ট হুঙ্কার চোখে পড়েনি এমন পাঠক আজ বিরল। অবশ্য দৃষ্টি আকর্ষণের এই কৌশলটা যে পুরো বিফলে যায়নি তার প্রমাণ, এপার ওপার বাংলা মিলিয়ে আজ মলয় রায়চৌধুরীর পাঠক সংখ্যা নেহাত কম নয়।)
সেদিন কিন্তু বিরক্তই হয়েছিলাম। শুধু আমি নই, বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রেরই একই রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। সেটাই ছিল স্বাভাবিক কারণ মলয়ের ঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বী,শৈলেশ্বর ঘোষ ততদিনে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান বিরোধী কবি। উল্টোদিকে মলয় নতুন প্রজন্মের কাছে বিলকুল অচেনা। প্রাক্তণেদরও মলয়ও একদা এতটাই উত্যক্ত করেছিলনে যে তারাও মলয়কে পাত্তা দিতে চাননি।
মলয় রায়চৌধুরীর দ্বিতীয় উপস্থিতি সম্ভবত চোখে পড়েছিল ‘কবিতা দর্পন’ পত্রিকায়। সেই একই রকম খোট্টা পালোয়ান সুলভ আস্ফালন। যথারীতি সবার কাছে বিরক্তিকর।
মলয়ের তৃতীয় উপস্থিতি ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায়। একমাত্র এই উপস্থিতির মাত্রা ছিল ভিন্ন রকম। মহাদিগন্ত পত্রিকা সেদিন হাংরি মামলার খুঁটিনাটি( দলিল দস্তাবেজ সহ) প্রকাশ করেছিল। বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরা প্রকৃত সত্য জানতে পেরেছিল। সেই প্রথম আমরা পড়েছিলাম মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ সহ আরও কিছু লেখাপত্র। বুঝেছিলাম, সেদিনের হাংরি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠানের ভিত কাঁপিয়ে দেয়া, আন্তর্জাতিক নজর আকর্ষন করা, সবকিছুর পেছনেই ছিল মলয় রায়চৌধুরীরই প্রধান ভূমিকা এবং মোকদ্দমা-জেল-জরিমানা এবং নিশর্ত মুক্তিপর্বের পর সত্যি সত্যিই সেই হাংরি অান্দোলনের মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল। যা ছিল সেটা শুধুই ক্ষুধিত প্রজন্মের সাহিত্য, যার চালিকা শক্তি ছিলেন শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, অরুনেশ ঘোষেরা। সেটা আদৌ আন্দোলন ছিল না। মলয়ের মতো আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা ওদের কারো ভেতরই ছিল না।
এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে মলয় রায়চৌধুরীর পুনঃপ্রতিষ্ঠার মঞ্চটা সাজিয়ে দেয়ার পেছনে ডঃ উত্তম দাশের নিখুঁত সম্পাদনার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কে জানে. হয়ত স্বভাবগত কারণে মলয় এই গুরুত্বকে অস্বীকার করবেন, হয়ত একই রকম অহঙের উদগার তুলবেন কিন্তু তাতে ইতিহাসের কিছু এসে যায় না। ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট।
হ্যাঁ, মহাদিগন্ত পর্বের পরই মলয়ের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছিল। ঠিকানা জোগার করে একটা চিঠিও পাঠিয়ে ছিলাম। কিন্তু মলয় সেই চিঠিকে সাক্ষাতকারের রূপ দিয়ে এবং আমাকে শৈলেশ্বরের অনুচর ঠাউরে নিয়ে যে উত্তর দিয়েছিলেন তাতে সেদিন আমার সদ্য যুবক শরীর রাগে ঘৃণায় রী রী করে জ্বলে উঠেছিল। লেখাটির ছত্রে ছত্রে শুধু গরিলা সুলভ বুক চাপড়ানি এবং অপরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা। ছিল পেশার অহঙ্কার। একটা লাইন তো এমনও ছিল যে, ওই সাক্ষাতকার প্রকাশ করলে আমি নাকি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাব! বলাবাহুল্য মলয় রায়চৌধুরী মারফত নিজেকে বিখ্যাত বানানোর প্রবৃত্তি সেদিন অবহেলায় ত্যাগ করতে পেরেছিলাম।
মলয়ের তৃতীয় সাক্ষাতকার পড়ি অরুনেশ ঘোষ সম্পাদিত ‘ জিরাফ’ পত্রিকায়। সেখানেও সেই একই রকম বিষোদ্গার এবং বুক চাপড়ানির সিক্যুয়েল। আজও মনে আছে একটা প্রশ্নের উত্তরে অরুনেশকে বলেছিলেন,“ লন্ডন স্কুল অফ ইকনোমিক্সে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, সাহিত্যের কারণে ভর্তি হইনি। সুতরাং বুঝতেই পারছ, যা যোগ্যতা ছিল তাতে তোমার মতো গাঁয়ের স্কুলে মাস্টারির চাকরি জোগাড় করতে আমার কোন অসুবিধেই হোত না।”
ভদ্র এবং অস্পষ্টবাদী হিসেবে আমারও যে খুব সুনাম আছে তেমন কিন্তু নয় তবু সেদিন মলয় রায়চৌধুরীর ওই ঝাঁঝ সামলানো আমার পক্ষে অস্বস্তিকরই হয়েছিল। সুতরাং এরপর দুজন ঘেঁটিত্যাড়ার ভেতর দুস্তার ব্যবধান জেগে ওঠাটাই ছিল স্বাভাবিক। বড়জোর ওঁকে হয়ত শহীদের স্বীকৃতি দিতাম কিন্তু কী এক দুর্জ্ঞেয় কারণে শেষ অবধি তেমনটা হোল না! এরপর থেকে যেখানে যত লেখাপত্র প্রকাশিত হোত মলয় নিয়মিত সেসবের জেরক্স কপি আমাকে পাঠাতেন। বেশীর ভাগই ছিল কবিতা কিংবা যুযুৎসীয় প্যাঁজ পয়জার। পড়তাম সেসব। কবিতাগুলো ভালো লাগত না। অন্যগুলো থেকে শেখার চেষ্টা করতাম লেজে পা দেয়া মানুষকে অপমান করার কৌশল।
শুধু লেখাপত্র নয়, কাঁপা কাঁপা অথচ সুন্দর হস্তাক্ষরে মলয় কখনও কখনও পোস্টকার্ডও পাঠাতেন। সৌজন্য বশতঃ সেসবের উত্তরও দিতাম। ব্যস, এই অবধিই। আমার পত্রিকার জন্যও কখনও মলয়ের লেখা চাইনি, মলয়ও কখনও আগ বাড়িয়ে পাঠাননি।
মলয়ের সুবাদেই এরপর সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। সহোদর হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু তিনি ছিলেন ভিন্ন চরিত্রের মানুষ তাই আমাদের সখ্য গড়ে উঠতে বেশী দেরী হয়নি। দিনকে দিন সেই সখ্য নিবিড়তর হয়ে উঠেছিল। যে কোনো বিষয়ে খোলাখুলি মত বিনিময় করতে আমরা কখনও দ্বিধা দেখাইনি। পরবর্তিতে সমীরকে নিয়ে আমার পত্রিকা ‘গল্পবিশ্ব’ এ ক্রোড়পত্রও প্রকাশ করেছিলাম। সমীর রায়চৌধুরীকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত সেটাই প্রথম কাজ।
সমীর রায়চৌধুরী প্রসঙ্গে অনেক কিছু বলার আছে কিন্তু সেসবের জন্য এই পরিসর উপযুক্ত নয়। এখানে শুধুই মলয় রায়চৌধুরী এবং ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস। আপাততঃ সে প্রসঙ্গে ফেরা যাক।
তো পড়লাম উপন্যাসটা। এবং চমকে উঠলাম। এ কোন মলয় রায়চৌধুরী! অনর্গল আঁচড়ানি কামড়ানির ফাঁকে ফাঁকে কিভাবে রপ্ত করলেন এই ভাষা! কর্কশ মানুষটার ভেতরে এই পেলব কথনভঙ্গী ছিল নাকি কখনও? মানুষের অন্তরকে খুঁটিয়ে দেখার মতো রঞ্জন রশ্মী ছিল নাকি ওঁর চোখে! ছিল নাকি এতটা সোহাগ, প্রশ্রয় ওঁর অন্তরে? কই, টের পাইনি তো!
সত্যি বলতে কী সেদিন আমার পাঠ অভিজ্ঞতাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল এই উপন্যাস। ভঙ্গী এবং প্লট মারফত।
ভঙ্গীর কথায় পরে আসব। প্রথমে বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে আসা যাক।
কীভাবে ব্যাখ্যা করব এই উপন্যাসের প্লট। শিল্পনীতি মোতাবেক কোনো বাঁধা রুটম্যাপই তো নেই! বাঁধাই সড়কে চলতে চলতে মলয় অনায়াসে পথ বদলে উঠে পড়েছেন ফুটপাথে,সেখান থেকে দ্দে ছুট কানা গলিতে, নাহ্, গলিটা আদৌ অন্ধা নয়, দেয়ালের ফোঁকড় দিয়ে পথ বের করে নেমে পড়েছেন মাঠে ঘাটে। ফলো করতে গিয়ে আমার নাজেহাল দশা। কখনও চলা থামিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ছেন বটে খোলা মাঠে, দেখছেন বটে আকাশ বাতাস চরাচর কিন্তু আমার পরিশ্রম থামছে কই!
কথাগুলোতে কারুর হেঁয়ালি ঠেকলে আমি লাচাড়। কারণ, রচনাটা আদৌ একমাত্রিক নয়,বরং বহুস্তরীয়। ফলে ঠিক করা মুশকিল হয় কাকে শনাক্ত করব এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র হিসেবে? পাঁচ ফিটের ফর্সা, গালফোলা কোঁকড়া চুল, চনমনে অবাঙালি চেহারা বেপরোয়া সুশান্ত ঘোষকে? যে কিনা উপন্যাসের প্রথম পাতাতে হাজির হওয়া মাত্র ইন্দিরা গান্ধীকে সম্বর্ধনা জানাতে জোগার করা হাতির শুঁড়ের মৃদু আদরে ঘাড় ভেঙে ফেলে, চাকরীর পাশাপাশি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যায় ব্যবসা ধান্দায়, জমি পুনর্দখলের অভিপ্রায়ে গুন্ডা ভাড়া করতে গিয়ে নিজেই দখল হয়ে গিয়ে বাধ্য হয় চোদ্দ বছরের এক নাবালিকাকে বিয়ে করে জমি মাফিয়াদের ঘরজামাই হয়ে যেতে!
নাকি বাবার আত্মহত্যার সুবাদে চাকরি পাওয়া অতনু চক্রবর্তিকে? কিন্তু সে তো ভীষন অন্তর্মুখি! কথা বলতে হবে, এহেন আতঙ্কে সে কারুর মুখোমুখি হোতে চায় না। ধুতি পঞ্জাবী পরে। সর্বোপরি নারীসঙ্গ বিহীন। দলে ভিরে মদ মেয়েমানুষবাজী করতে গিয়েও সবকিছু কেমন দরকচা করে ফেলে! সঙ্গমের অভিজ্ঞতা হয় বটে এক সময়, কিন্তু সেই ঘটনায় পুরুষালির বিন্দুমাত্র ছিঁটেফোটা থাকে না, বরং তা যেন গণধর্ষনের ফাঁদে পড়ে ভার্জিনিটি খোয়ানোর এক মেয়েলি কিস্যা।
তাহলে মানসী বর্মন? যে কিনা ডিভোর্সী কিম্বা ডির্ভোসী নয়। ননীদা আর সুলতানার বাচ্চার সারোগেট মাদার হওয়ার মতো সাহস দেখিয়ে ফেলে বটে কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনা। শেষ অবধি গ্রামে গিয়ে নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। এই সাহসিকতা এবং সততার পরও কিনা মানসী বর্মনের গচ্ছিত রেখে যাওয়া ব্যাগের ভেতর পাওয়া যায় রাশি রাশি নোট!
কিন্তু ননীদা কিংবা সুলতানাকেই বা বাদ দেই কিভাবে! অবসরের পর যাকে বিয়ে করলেন ননীদা তাকে সুশান্ত এবং অতনু দেখেছিল হোটেলের কামরায় ঢুকতে এবং বেরতে।
প্রধান চরিত্র হওয়ার যোগ্যতা অরিন্দমেরই বা কম কিসে! স্বামীর অনুপস্থিতিতে পাশের ফ্ল্যাটের মহিলাকে যৌন খোরাক জোগাতে জোগাতে প্রথমে পাগল এবং পরে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় অরিন্দ। বহুদিন পর তার সন্ধান পাওয়া যায় এক গ্রাম্য রেলস্টেশন। চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে চাকরিতে ফের যোগ দেয় অরিন্দম এবং দৃঢ়তার সঙ্গে জানায় যে পাগল সে আদৌ হয়নি কখনো,যৌন কাতরতা থেকে মুক্তি পেতেই সে মানসিক চিকিৎসালয়ে ভর্তি হয়েছিল। অর্থাত চলতি কথায় যাকে আমরা বলি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার। এবং এরপর সত্যি সত্যি একদিন ফ্ল্যাট ছেড়ে অফিস কোয়ার্টারে এসে ওঠে অরিন্দম। তারপর বদলি হয়ে কোলকাতায় চলে যায়, চিরতরে।
এরকম আরও অজস্র চরিত্র আছে এই উপন্যাসে, কাহিনী বিন্যাসের ক্ষেত্রে যাদের ভূমিকা এক তিলও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
শুধু মানব চরিত্রের কথাই বা বলছি কেন? চরিত্র হিসেবে প্রাধান্য পাবার ক্ষেত্রে বিহার রাজ্যটাই খুব এলেবেলে নাকি! দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা বিহারের জাতপাতের রাজনীতি, মাফিয়া সন্ত্রাস, অপহরণ ব্যবসা এবং পোকামাকড়ের চেও অসহায় ভাবে সাধারণ মানুষকে গণহত্যার শিকার বানানো, কয়েক পুরুষ ধরে বিহারবাসী হওয়ার সুবাদে মলয় সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরেছেন। যদিও এসব ঘটনা যে বহুদিন ধরেই বিহারি সংস্কৃতির অঙ্গ সে বিষয়ে টুকচাক বিবরণ মিডিয়া আমাদের জানিয়েছে। সেসব ছিল ওদের নিজস্ব ব্যাপার, কিন্তু মলয়ের আঁখো দেখা হাল তুলে ধরেছে চাঁদমারিতে কিভাবে ক্রমশঃ ঢুকে পড়েছে কয়েক পুরুষ ধরে ওই রাজ্যে বাস করা বাঙালী পরিবারগুলোও। ফলতঃ স্ত্রী কন্যা পুত্র সহ বেঁচেবত্তে থাকার সোশ্যাল সিক্যুরিটি জোগাড় করতে গিয়ে তাদের সামনে রয়ে গিয়েছে মাত্র দুটো পথ। হয় নিজের বাঙালি পরিচয়কে মুছে ফেলে পুরোপুরি বিহারি হয়ে যাওয়া, নতুবা পূর্ব পুরুষের ভিটে ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়া।
এসবের পাশাপাশি এই উপন্যাসে আরও একটা চরিত্র আমাকে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করেছে, সেটা হলো বাতিল পচা নোট। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনের ফুটপাতে বরাবরই কিছু মানুষকে টেবিল পেতে বসে থাকতে দেখেছি, যাদের পেশা বাট্টার বিনিময়ে ছেঁড়া ফাটা নোট বদলে ঝাঁ চকচকে নোট দেয়া। এটুকু জানতাম যে দালালগুলো এরপর ওই ছেঁড়া ফাটা নোটগুলোকে ব্যাঙ্কের কাউন্টার থেকে বদলে নেয় কিন্তু ব্যাঙ্ক ওই অচল নোটগুলোর কি গতি করে সেটা জানা ছিল না। জানার কথাও নয়, কারণ এই সংক্রান্ত তথ্য কোথাও কোনদিন নজরে পড়েনি। সাহিত্যও পারেনি তেমন জ্ঞান জোগাতে। মলয় রায়চৌধুরীর আগে কেউ এহেন পটভূমিকায় কোনদিন গল্প/ উপন্যাস কিছুই লেখেন নি। পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী এরকম অনেক লেখকের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, সুতরাং দায়িত্ব নিয়েই বলছি কথাটা। হয়ত না লেখার অজুহাত, বিষয়টাকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ প্লট মনে না করা। আর এখানেই মলয় রায়চৌধুরীর বৈশিষ্ট। একটা না প্লটকে এমন জবরদস্ত প্লট হিসেবে তুলে ধরেছেন যে পড়তে পড়তে শিউরে উঠেছি। নোট বদলের ভেতর এত দুর্নীতি আছে! নোটের বান্ডিলগুলোকে বাতিল করার জন্য পাঞ্চিং মেশিনে ফেলে যে ছ্যাঁদা করা হয় তাতে স্বেচ্ছায় আঙুল বাড়িয়ে দেয় কিছু মানুষ? সরকারের থেকে কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য এতবড় আত্মত্যা! হ্যাঁ, আত্মত্যাগই বলবো, কারণ ওই ক্ষতিপূরণের পণ দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেয়া যাবে, চাষের জমি কেনা যাবে কিম্বা জমি রক্ষার জন্য কেনা যাবে বন্দুক।
এখানেই শেষ নয়। এরপর আছে রাশি নোট বাতিল হওয়ার পর সেসবের সদগতি পর্ব। কি করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সেসব বাতিল বস্তা পচা নোট নিয়ে? ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস মারফত জানলাম, জাস্ট কেরোসিন ঢেলে চুল্লীতে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। প্রক্রিয়াটা শবদাহরই মতো। চুল্লীর চিমনি দিয়ে একই রকম গলগলিয়ে ধোঁয়া ওঠে, বিশ্রী কটু গন্ধে চারপাশ ম ম করে ওঠে, আগুন দেয়ার সময় একই ভঙ্গিতে ‘হরিধ্বনি’ কিম্বা ‘ রাম নাম সৎ হ্যায়’ উচ্চারণ করা হয়।
হ্যাঁ, এরপরই আমার কাছে উপন্যাসটা সার্থকনামা হয়ে ওঠে। একদিকে বিহারের টুঁটি চেপা সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ অন্যদিকে দিনের পর দিন রাশিরাশি বাতিল বস্তাপচা নোট গোনা, বাতিল করা এবং পোড়ানো, সর্বোপরি দুর্নীতির করাল থাবা ঘাড়ের ওপর সদা উদ্যত, সামন্য ভুলে জীবন কিংবা জীবিকা তছনছ হয়ে যাবার বিপুল সম্ভাবন। এই জীবনকে ডুবজল ছাড়া আর কী বা বলা যেতে পারে! আর যে কোনো প্রাণী যেহেতু সামান্য শ্বাসটুকু নেয়ার তাগিদে মরীয়া হয়ে ওঠে, অক্সিজেনের খোঁজে বেপরোয়া ঢুঁ মেরে বেরায়, এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোও সেটাই করেছে। তাদের সমস্ত আচরণগুলোই ডুবজলে থেকে বাঁচার সন্ধান করার প্রবণতা।
প্লট বিষয়ে আমি আর কিছু বলব না। বলাটা অপ্রয়োজনীয়ও, কারণ আমি এখানে উপন্যাসটির পাঠ অভিজ্ঞতার কথাই জানাতে চেয়েছি। এবং সেটা সাধ্যমত জানানোর চেষ্টা করেছি। যারা এই উপন্যাসটি আদৌ পড়েননি তারা কিভাবে এই রচনা মারফত প্রকৃত সাহিত্যের স্বাদ পাবেন? সাহিত্যের ঝাঁজ কান নয়, মন দিয়ে গ্রহণ করতে হয়।
না বলার আরও একটি কারণ হলো, অধিকাংশ পাঠকই প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সিলেবাসের বাইরে কিছু পড়তে আগ্রহী নন। খবরের কাগজের পাতায় ডঃ বাবুরা যা প্রেসক্রাইব করেন, ওরা সেটাই পড়েন। এর বাইরে গিয়ে অহেতুক ঝুঁকি নিয়ে সময়-অর্থের অপচয় ঘটাতে চাননা। যদি বা ওসব প্রেসক্রাইবড বই ভালো না লাগে তবু ঠোঁট ফাঁক করেন না। পাছে লোকে নন এলিট রিডার ভাবে! তাদের কেউ যদি ভুল করেও আমার লেখাটি পড়েন তাহলেও হয়ত মলয়ের লেখাপত্রের প্রতি আগ্রহী হবেন বলে মনে হয় না। তাহলে আর বেগার খাটনি খাটা কেন!
তবুও যারা মলয়ের লেখাপত্রের সঙ্গে সামান্য হলেও পরিচিত অথচ এই উপন্যাসটি পড়ে উঠতে পারেননি তাদের জন্য ওরঁ বাক্যরচনা তথা চিত্রকল্প নির্মাণের কিছু কিছু নমুনা পেশ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। কারণ তাছাড়া বোঝা সম্ভব হবে না, প্রথম উপন্যাসেই মলয় রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের চলতি ধারা থেকে হঠকে কিভাবে নিজস্ব ভোকাবলারি আলাদা করে নিয়েছিলেন। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যকে অনেকেই আধুনিকতার চরম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন কিন্তু আমার মনে হয়েছে মলয়ের গদ্যশৈলী তারচে ১০০ গুণ আধুনিক। এবং সংখ্যায় স্বল্প হলেও পরবর্তী প্রজন্মের কিছু কিছু গদ্যকারের রচনায় আমি এই শৈলীর ছায়া দেখেছি। সেসব প্রয়াসকে অক্ষমও বলা যাবে না। এভাবেই তো সাহিত্যের উঠোন ক্রম বিস্তারিত হয়।
তো আসুন নমুনা পেশের ময়দানে। উপন্যাসটি শুরু হচ্ছে এভাবে--“ লাশগুলোকে নামানো হচ্ছিল হোসপাইপ কেটে থামানো পাটনা-মুখো দরোজা জানলা বাথরুমের পাল্লাহীন গয়া প্যাসেঞ্জারের অন্ধকার লাগেজ ভ্যান থেকে, একের পর এক আদুল গা তামাটে পুরুষের পেশীদার শরীর ঠান্ডা কাঠ, পুণ্যলাভের জন্য পুড়তে যাবে গঙ্গায় আর এই লেভেল ক্রসিং থেকে, যেখানে রাস্তার ধারে ফোলডিং চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে ল্যাম্পপোস্টের তলায় বসে স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রমাণপত্র দিয়ে চলেছে পাটনা কর্পোরেশনের গণসেবক ডাক্তার সুনীলরঞ্জন নাহাবিশ্বাস ওরফে বিসওয়াজজি, শ্মশানঘাট কাছেই বলে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফুলকো মেলার জমজমাট ভিড় আগেভাগে তৈরি, তাদের বাঁশের মাচান, ফুল, শাদা আর গোলাপি থান কাপড়, ঠ্যালা, রিকশা, ট্যাকসি, ধুপ, সিঁদুর, খুচরো টাকা পয়সা, খই বাতাসা, কাতাদড়ি, মাটির কলসি; বিহারী সংস্কৃতির মড়াপোড়ার যা কিছু।”
প্রথম প্যারাগ্রাফে এহেন নিষ্ঠুর বর্ণনার পরই মলয় লেখেন,“ ঘনসবুজ কচি আমের থুতনিতে হাত দিয়ে আদর করছিল একটা প্রৌঢ় আমপাতা। গাছের প্রায়ান্ধকার গোড়ায়, আধভিজে উইপোকার মেটেরঙা দেউড়ি। মিহিন আবেগপ্রবণ বাতাস বেড়াতে বেরিয়েছে হাত ধরাধরি করে। আকাশে দীঘল ফোলাফোলা মেঘ। অনেক দূরে, ওইদিকে, একাধটা ঠুনকো বিদ্যুতের অদৃশ্য আওয়াজ। এখন রূপসী মর্জির বিকেল। অল্প বয়সী কয়েকটি খেটে খাওয়া কাক চলে গেল দক্ষিণ থেকে উত্তরে। একটু আগে সামনের ছাতিম গাছে যে চড়াই পাখিগুলো স্থূল রঙ্গরসিকতায় মশগুল রেখেছিল নিজেদের, তারাও এখন চুপচাপ। রাস্তার ওপারে ধনী আর উদার কাঁঠালগাছ। রোদ্দুর বোধহয় গাছের ছায়া মাড়ায় না এ অঞ্চলে। চারদিকের এমন অতীন্দ্রিয় জগতের আভাস পেয়ে ছোটছোট গোলগোল নুড়ির দল উদাসীন শুয়ে আছে কালভার্টের তলাকার ছিপছিপে নালার কিনার বরাবর।”
বাতিল নোটের অজানা জগত বিষয়ে মলয় জানকারি দেন এভাবে, “ কতো রকমের নোট যোগাড় করে আনে দালাল নোটবদলকারীরা! এতো সূক্ষ্ম জোড়াতালি, সাদা চোখে টের পাওয়া যায় না কিচ্ছু। অফিসাররা পরখ করার জন্যে, টেবিলের এনামেল গামলার জলে ছাড়লে, কিছুক্ষণে আলাদা হয়ে ছিতরে যায় তাপ্পি দেয়া জোড়াতালি নোট। হয়তো দুকোণের সংখ্যাগুলো আলাদা, আদ্দেক আসলের সঙ্গে জোড়া আদ্দেক নকল, কিংবা কুড়ি টাকায় দু টাকার তাপ্পি, পাঁচশো টাকায় পাঁচ টাকা, সাতটা একশো টাকার নানান টুকরো জুড়ে একটা আস্ত। নোট যত পচা, যতো বেশী নষ্ট, আবদার ততো বেশি, অনুমোদনের নিয়ম ততো খুঁতখুঁতে, পাশ করার অফিসারের পাদানি ততো উঁচু। জুড়ে জুড়ে কাঠ হয়ে গেছে যেসব নোটের প্যাকেট বান্ডিল, গায়ে গা মিলিয়ে আলাদা হতে চায় না, উইচাটা থিকথিকে, গ্রামীন আটচলায় ছিল সোঁদা দেয়ালবন্দী, খামারবাড়ির মাটির অযাচিত গভীরে কলসিবন্ধ, গাছতলায় পোঁতা গুমোট কাঠের বাক্সে, আত্মহত্যাকারিণীর সঙ্গে জ্বলে খাক বা আধসেঁকা ঝুরঝুরে, চেহারা পাল্টে কাগজ না নোট বোঝার উপায় নেই।”
এতো গেল নোটের বিবরণ, নোট গুনিয়েদের দশাটা কিরকম?
“ পুরানো হিলহিলে নোটের স্যাঁতসেঁতে গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলোয় অতনুর অ্যালার্জি হয়েছিল চাকরিতে ঢুকেই। জ্বর, নাকের জলে রুমাল ভিজে ধুতির খুট ভিজে সহ্যশক্তি না গজানো অব্দি অ্যানালজেসিক আর অ্যালার্জির বড়ি খেয়ে অর্ধ নিমীলিত, ক্যানটিনের বেঞ্চে বা ডিসপেনসারির স্ট্রেচারগাড়িতে। বড়ো খাজাঞ্চি বলেছিলেন এ চাকরির অনেক হ্যাপা কিন্তু সয়ে যাবে, এরপর যদি আস্তাকুঁড়ে শোও তাহলেও অসুখে পড়বে না।
ওদের সংস্থায় প্রত্যেক বছর একজন পাগল হয়। গেলবার দুবেজি হয়েছিল, তার আগের বছর এম কে ঝা পাগল হয়ে আর ফেরেনি। আসছে বারে কার পালা কে জানে।”
ব্যস, এনাফ। আর একটি উদ্ধৃতিও আমি দেব না। নাহলে পাঠককে প্রভাবিত করার দোষে অপরাধী হওয়ার পুরো সম্ভাবনা থাকবে। না,তেমন কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই। গোটা রচনাটি মারফত আমি শুধু বোঝাতে চেয়েছি, এই উপন্যাসটি আজও আমাকে কতটা প্রভাবিত করে রেখেছে। জানাতে চেয়েছি চুটকির ইশারায় ডেকে এনে মলয় রায়চৌধুরী কিভাবে আমাকে আচমকা ডুবজলে ঠেলে দিয়েছিলেন। স্বস্তি এটুকুই যে এই জলের অপর নাম জীবনও। এর গভীর অতলে আমি পেয়েছি জীবনের সার সত্য।
একদা মলয় আমাকে লিখেছিলেন,“ আমি মলয়, মলয় রায়চৌধুরী।আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করিনা, প্রতিষ্ঠানই আমার বিরোধিতা করে। কারণ আমিই প্রতিষ্ঠান।”
কথাগুলোকে সেদিন মলয়ের হামবাগপণার নমুনা মনে হলেও আজ আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে মলয় রায়চৌধুরী সত্যিই এক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান ওঁর বিরোধিতা করে কারণ মলয় স্থির কোনো অচলায়াতন নন। ভাষাকে পিতা এবং সন্তান গন্য করে প্রতি মুহুর্ত্বে তাকে শ্রদ্ধা এবং লালন পালন করে চলেছেন। আজকের লেখকের সামনে এক নয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, সম্ভব হলে আমাকে অতিক্রম করে দেখাও, হে মুন্সীরা!
বাংলাভাষা তথা সাহিত্য নিয়ে যে যতই হতাশ হোক না কেন আমি নিশ্চিত পরবর্তি প্রজন্ম এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেই। কিন্তু কবে, তা জানিনা। কেননা ওই যে মলয়, মলয় রায়চৌধুরী, আজও ছুটে চলেছেন। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে বলছেন, ছুঁয়ে দেখাও। পরক্ষণেই স্যাঁৎ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন