( সুবো আচার্য ছিলেন হাংরি আন্দোলনকারী । তাঁর বিরুদ্ধেও গ্রেপতারি পরোয়ানা ছিল । কিন্তু তিনি সেসময়ে ত্রিপুরার একটি গ্রামে গিয়ে গা ঢাকা দেন। পরে পুলিশ কেবল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে শুনে সুবো আচার্য ত্রিপুরা থেকে ফেরেন, এবং দেওঘরে গিয়ে অনুকূল ঠাকুরের শিষ্যত্ব নিয়ে সাহিত্যজগত থেকে উধাও হয়ে যান । স্টেট ব্যাংকের চিফ ম্যানেজার হিসাবে অবসর নেবার পর কলকাতায় ফিরলে 'চন্দ্রগ্রহণ' পত্রিকার সম্পাদক প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁকে খুঁজে বের করে এই সাক্ষাৎকারটি নেন । আগ্রহীরা পড়ে সুবো আচার্যের পলায়ন ও পুনরাবির্ভাব ও নির্বাণের গল্প পাবেন সাক্ষাৎকারটিতে । 'চন্দ্রগ্রহণ' পত্রিকা, বসন্ত সংখ্যা, ২০১৪, ৭ বরদাকান্ত রোড, দমদম, কলকাতা ৭০০ ০৩০, মুঠোফোন : ৯৮৩১৬৭৯৩৭৭ )
প্রশ্ন : আপনার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না । হাংরি আন্দোলন মামলায় যাঁরা রাজসাক্ষী হয়েছিলেন, তাঁদের মুচলেকা থেকে তাঁদের পারিবারিক তথ্য পাওয়া যায় । আপনি যদি আপনার জন্ম, বাবা-মা, পরিবার, বাল্যকাল নিয়ে কিছু বলেন তাহলে ভালো হয় ।
উত্তর: আর দশটা বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা যেভাবে মানুষ হয়, আমিও সেভাবেই মানুষ হয়েছি -- খুব অল্প বয়সেই, দেশভাগের সামান্য আগে আমরা বাঁকুড়ায় চলে আসি --- সেখানেই আমার বড়ো হওয়া --- স্কুল-কলেজের পরে কলকাতায় এসে পড়াশুনো -- প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজের মাধ্যমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ( ড. হরপ্রসাদ মিত্রের সৌজন্যে ) কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসে ভর্তি হই -- পরে এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে, যে একসময় আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে আসি আমার তখনকার বন্ধু প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গে -- মূল কারণ ছিল কবিতা লেখা ও জীবনকে দেখা -- এছাড়া আর কিছু নয় --- তখনও হাংরি জেনারেশানের কারুর সঙ্গে আলাপও হয়নি --- আমার এ সিদ্ধান্ধ একজনই মাত্র সমর্থন করেছিলেন -- তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় -- আয়ওয়া থেকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন --"যেভাবে জীবন কাটাতে চাইছ সেটা দিব্য"-- তারও প্রায় বছরখানেক বাদে যোগাযোগ হয় শৈলেশ্বর, সুভাষ, বাসুদেব, দেবী রায় আর ফালগুনী রায়ের সঙ্গে --- বন্ধুত্ব হয়, ভাববিনিময় হয়, একসঙ্গে উন্মত্ত জীবনযাপন শুরু হয় -- কলকাতার নাড়িনক্ষত্র, অন্ধিসন্ধি, গলিঘুঁজি দেখতে দেখতে চোখের ওপর থেকে যেন একটা পর্দা সরে যায় -- মলয়ের সঙ্গে জীবনে দুবারই দেখা হয়েছে --- একবার দুমকায় সমীরদার কোয়ার্টারে তাঁর আম্ন্ত্রণে গিয়ে -- দ্বিতীয়বার মলয় যখন সাহিত্যসংক্রান্ত মামলা মিটে যাওয়ার পর সুবিমল আর ত্রিদিবকে নিয়ে আমার তখনকার চাকরি স্হলে এসেছিলেন -- তখন সদ্য পিতৃহীন হয়েছি -- বিধবা মা আর এক দাদার সঙ্গে থাকতাম--- সঙ্গী ছিল গ্রন্হ, গ্রন্হ, গ্রন্হ --- লেখা আর লেখা আর লেখা আর বিরতিহীন, একাকী মদ্যপান আর মৃত্যুচিন্তা-- মৃত্যুর চিন্তা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল -- জীবনের এক বিচিত্র উদঘাটন হতে থাকে আমার কাছে --বাড়ির কাছেই ছিল একটা শ্মশান -- মধ্যরাতে ছাদে দাঁড়িয়ে মদ্যপ এক মৃত্যুচিন্তাকাতর যুবা, যে কয়েকবছর আগেও ধর্মতলা এলাকায় সন্ধ্যেয় ট্র্যাফিক অগ্রাহ্য করে উচ্চস্বরে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে রাস্তা পেরোতো--- কলকাতা কিন্তু কবিকে অসন্মান করেনি -- নয়তো কবেই মরে যেতুম -- দেঘরে 'সৎসঙ্গ আশ্রমে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সমীপে পৌঁছোই মৃত্যুরহস্য জানার জন্য -- তাঁরই নির্দেশে আমার দীক্ষা -- তাঁর দুটি মাত্র ছোট বাক্য বুঝতে আমার বছর আষ্টেক সময় লেগেছিল -- জীবনের দিগন্ত খুলে যেতে থাকে -- তাঁরই অনুপ্রেরণায় আমি যাবতীয় ধর্মগ্রন্হ থেকে হাহরণ করতে থাকি সারকথাগুলি--- জীবনের রাস্তাটাই সম্পূর্ণ বদলে যায় -- কথা যদি আমি বলি যে, তিনি সর্বক্ষণ আমার সঙ্গে থাকেন-- তাহলে লোকে পাগল বলবে আমায় । এই যে আপনার প্রশ্নগুলির উত্তর লিখছি এখনও তিনি আমার সঙ্গে আছেন --- ফলে সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া বা অহং নিয়ে মত্ত হহোয়ার কোনো উপায়ই নেই । তাঁর অনন্ত করুণা ও দয়ায় আমি গোটা জীবনটাকে দেখতে পাই -- শুধু দেখি না, মৃত্যুর ওপরে বসে প্রার্থনা করি, "অন্ধজনে দেহ আলো, মৃত্যুজনে দেহ প্রাণ--"
প্রশ্ন : হাংরি আন্দোলনে আপনি কার মাধ্যমে যোগ দিলেন ? কবে নাগাদ আপনার মনে হল যে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আপনি আত্মপ্রকাশ করতে পারবেন ? যে কাজকর্মের জন্য ষাটের অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় হাংরিদের খ্যাতি, তাতে কি অংশ নিতেন ? খালাসিটোলা যাওয়া, গাঁজা-হ্যাশিশ টানা, দলবেঁধে যত্রতত্র যাওয়া, ইত্যাদিতে অংশ নিয়েছেন কি ? হাংরি আন্দোলন মকদ্দমায় আপনার বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল । পুলিশ কি আপনার খোঁজে গিয়েছিল ? গ্রেপ্তার হলে মুচলেকা দিতেন ? মকদ্দমার সময়ে বন্ধুদের সমর্থনে নিম্ন/উচ্চ আদালতে যেতেন ? মকদ্দমার সময়ে আপনি কোথায় থাকতেন ?
উত্তর : আমি, যতদূর মনে পড়ে, শৈলেশ্বর, সুভাষ, বাসুদেব এবং প্রদীপের সঙ্গেই মেলামেশা করতাম -- মলয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয় বহু পরে -- কারুর বেঁধে দেয়া ম্যানিফেস্টো বা নিয়মে লেখার কথা ভাবিনি কখনও, ফলে আমার ব্যাপারটা ছিল আমার মতন । লেখার ব্যাপারে আমার সেরকম কোনও বাসনা ছিল না -- শেক্সপিয়ার এর ঐ লাইনটা আমি খুব সমর্থন করি --"অ্যাম্বিশান ইজ এ থিং হুইচ মেকস অ্যান এনজেল এ সিনার" । প্রতিষ্ঠা বা নানারকম বিশেষণে ভূষিত হওয়া নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই । মলয়ের মামলা চলার সময়ে আমি ত্রিপুরায় থাকতাম -- তেলিয়ামুড়া নামে একটা জায়গায় স্কুলশিক্ষক ছিলাম -- কলকাতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না -- ফলে এদিকের কিছুই জানতাম না । ওখানে ছমাসের বেশি থাকার পর আমি কলকাতায় ফিরে আসি । না, পুলিশ আমার সম্পর্কে কি কি করেছিল জানি না -- তবে, ওরা একটা ক্ষতি করেছিল -- ওদেই অ্যাডভার্স রিপোর্টের জন্য মিনিস্ট্রি অফ এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স এ আমার প্রায় হওয়া একটা চাকরি শেষ অব্দি হয়নি -- মনে পড়ে, খুব ব্যথা পেয়েছিলাম -- বাস্তব ক্ষতি হয়েছিল দুটো -- আমার পিতৃদেব খুব হতাশ অবস্হায় চলে গিয়েছিলেন -- এবং যে মেয়েটি আমার জন্য বহু বছর অপেক্ষা করেছিল, সে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে । কিন্তু এতে ওদের আর কি যায় আসে । আজ আমারও কিছু এসে যায় না । ইট ইজ এ পার্ট অফ দি গেম । ধ্বংস ও সৃষ্টির লীলা ছাড়া একে আর কি বলা যায় !
প্রশ্ন : আপনি কি নিজেকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনে করেন ? অনেকে অভিযোগ করেন যে হাংরিরা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা বলে অথচ গোষ্ঠীপতি দাদা ও বইবাজারের বাণিজ্যিক কর্তাদের ধরে সংকলন প্রকাশ করতে এবং তার জন্য টাকা নিতে, তাদের বাধে না । এ বিষয়ে আপনার অবস্হান যদি স্পষ্ট করেন ।
উত্তর : এই চিন্তা থেকে আমি লক্ষ মাইল দূরে । তাছাড়া আমি বোধহয়, সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলাম না । শক্তি বা সন্দীপন সম্পর্কে কিছু বলতে পারবো না । তবে এদেশে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা বলে প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি লোভ অনেকেরই আছে । সকলেই তো আর সতীনাথ ভাদুড়ি বা শঙ্খ ঘোষ নন । তাছাড়া লেখাটাই তো কথা, মূল ব্যাপার ।
প্রশ্ন : 'কথা ও কাহিনি' প্রকাশিত সংকলনটি সম্পাদনা করেছিলেন সমীর চৌধুরী । সম্পাদকীয় পড়ে আমাদের মনে হয়েছে যে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে সমীর চৌধুরীর কোনো ধারণা ছিল না । তিনি কয়েকজনের রচনা নিয়ে দপ্তরির কাজ করেছেন । আপনি কী বলেন ?
উত্তর : আপনার কথাই তো ঠিক ।
প্রশ্ন : দে'জ থেকে প্রকাশিত হাংরি সংকলনটিকে অনেকে বলেন 'দারা-পুত্র-পরিবার' সংকলন । যে চারজন হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন, তাঁদের রচনা এই সংকলনে নেই । যাঁদের কার্যকলাপের জন্য হাংরি আন্দোলনের খ্যাতি, তাঁদের রচনা নেই । যাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরিয়েছিল, তাঁদের অধিকাংশের রচনা নেই । তার পরিবর্তে আছে অমুকের স্ত্রী, তমুকের শ্যালক, তমুকের আত্মীয়, পাঁচের দশকের কবি, ইত্যাদি । আপনি সৎপথের ধার্মিক মানুষ হয়ে কোন তর্কে এই সংকলনে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করলেন ?
উত্তর : ঐ সংকলনের কথা আমি জেনেছি 'দেশ' পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে -- প্রদীপ চৌধুরীর টেলিফোন পেয়ে । আমি করলে অবশ্যই অন্যরকম হতো । মলয়কে বাদ দেয়া মানে তো শিরচ্ছেদ করা ।
প্রশ্ন : আপনি অনুকূল ঠাকুরের শরণাপন্ন কেন হলেন ? আপনি কি হাংরি আন্দোলনের জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন বা অধঃপতনের পথে চলে যাচ্ছিলেন ? আপনার কি মনে হয়েছিল যে হাংরিদের জীবন প্রকৃতপক্ষে একটি ইঁদুরকল, এবং তা থেকে মুক্তি প্রয়োজন ? হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কি অনুকূল ঠাকুরের মতবিরোধ আছে ? অনেকে তেমনটাই মনে করেন । আপনি কি বলবেন ?
উত্তর : প্রশ্নের প্রথম অংশ সম্পর্কে কিছুই বলবো না । শুধু দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা সম্পর্কে বলি -- বই পড়ে কখনও ভগবানের অনুভূতি হয় না -- ঈশ্বরের জ্ঞান পেতে হলে কি করতে হয় ? ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন, "ঈশ্বর শুদ্ধ মনের গোচর" -- আগে জলে নামতে হবে তবে তো সাঁতার -- ডাঙায় সাঁতার দিলে বুকের ছাল-চামড়া ছিঁড়ে যাবে । কবি সমর সেনের 'বাবু বৃত্তান্ত' পড়লে এমন একটা দৃষ্টান্ত পাবেন যা অফুরন্ত হাসির খোরাক হয়ে আছে । হাংরিরা অসম্পূর্ণ -- ঠাকুর সম্পূর্ণ -- তিনি দ্বন্দ্বাতীতং গান সদৃশং ।
প্রশ্ন : আপনি কোনো কাব্যগ্রন্হ প্রকাশ করেননি কেন ? অথচ আপনি আপনার কবিতা 'কথা ও কাহিনি' এবং 'দে'জ' প্রকাশিত সংকলনে অন্তর্ভুক্তির জন্য দিয়েছেন ? আপনি তো স্টেট ব্যাঙ্কের উঁচু পদে ছিলেন, মাইনেও ভালো পেতেন, তবু কাব্যগপ্রন্হ প্রকাশ করলেন না কেন ? আমরা, সাধারণ পাঠকরা, আপনার একটি কাব্যগপ্রন্হ খুঁজে বেড়াই ।
উত্তর : ভীষণ টাকার অভাব -- নয়তো, প্রকাশক পেলে হয়তো একটি বই বার করা যেতো ।
প্রশ্ন : আপনি কি মেডিটেশন করেন ? মেডিটেশনের সময়ে আপনার মনে কি কোনো কবিতার উন্মেষ ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয় ? এখনকার তরুণ কবিদের মেডিটেশান সম্পর্কে কোনো পথনির্দেশ দিতে পারেন কি ?
উত্তর : পরামর্শ দিলে কেউ কি শুনবেন ? স্বামী বিবেকানন্দের 'ইন সার্চ অফ গড অ্যাণ্ড আদার পোয়েমস' পড়েছেন ? সন্ত কবীরের দোহা পড়লে বিস্ময়ে মূক হয়ে যেতে হয় -- এগুলো সবই মেডিটেশনের পথে পাওয়া -- কবীর পড়তে পড়তে আমি বার বার দেখি রবীন্দ্রনাথের অনেক আগেই তিনি অনেক কথা বলেছেন যা রবীন্দ্রনাথে ঘুরে ফিরে এসেছে । তবে ব্যক্তিটি তো রবীন্দ্রনাথ -- অসম্ভব এবং প্রবল পরিপাক শক্তি ছিল তাঁর । কবীরের ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ রবীন্দ্রনাথ বাংলায় এনেছেন ঈষৎ পরিবর্তিত করে । এবং মনে হবে এসবই রবীন্দ্রনাথের ।
প্রশ্ন : সুভাষ ঘোষ ও বাসুদেব দাশগুপ্ত সিপিএম-এ যোগ দিয়ে ছিলেন, অথচ হাংরি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন । সুভাষ ঘোষের বাড়িতে জ্যোতি বসুর ফোটো ঝোলানো থাকত, লাল ঝাণ্ডার ভাঁড়ার ছিল । তাঁরা দুজনেই সিপিএম-এর মিছিলে অংশ নিতেন । তাঁদের এই রাজনৈতিক কার্যকলাপ কি প্রতিষ্ঠানের আশ্রয়ে তাঁদের সুবিধাভোগী প্রমাণ করে না ? আপনার কি মনে হয় ?
উত্তর : কি জানি, ওদের রাজনৈতিক মতামত নিয়ে কখনও আমার সঙ্গে কথা হয়নি । বাসুদেবের শেষ দিকের রাজনৈতিক উপন্যাস আমার একেবারেই ভালো লাগেনি ।
প্রশ্ন : 'চন্দ্রগ্রহণ' পত্রিকার হাংরি আন্দোলন সংখ্যা ( সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৩ ) পড়ে আপনার কি মনে হয়েছে যে 'কথা ও কাহিনি' এবং 'দেজ' থেকে প্রকাশিত সংকলনগুলির তুলনায় এটি একটি সামগ্রিক কাজ, এবং সেকারণে প্রশংসনীয় ?
উত্তর : কিছুই হয় না --- যতক্ষণ না দেখছি ততক্ষণ কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না ।
প্রশ্ন : আপনি কি জানেন যে হাংরি আন্দোলন নিয়ে পিএইচ ডি এবং এম ফিল হয়েছে ? ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মারিনা ডি হেলার হাংরি আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করেছেন ? ইউটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিল্ম তুলে নিয়ে গেছেন ? ইউ টিউবে হাংরি কবিতা পাঠ করে রেকর্ড করেছেন বাংলাদেশ, আমেরিকা, কানাডা ইত্যাদি দেশের কবিরা ? ফালগুনী রায়ের কবিতা নিয়ে ফিল্ম করেছেন শর্মী পাণ্ডে ? মলয় রায়চৌধুরীর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি নিয়ে ফিল্ম করেছেন মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় ? এই সংবাদগুলো শুনে আপনার কেমন প্রতিক্রিয়া হয় ? 'বাইশে শ্রাবণ' নামে একটি ফিল্মে প্রখ্যাত পরিচালক গৌতম ঘোষ জনৈক হাংরি কবির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, জানেন ? ফিল্মটি আপনি দেখে থাকলে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইব ।
উত্তর : সিনেমাটা আমার সেভাবে দেখা হয়নি । তবে গৌতম ঘোষ একজন ব্রিলিয়ান্ট অভিনেতা -- সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের পরে দুজন আমার খুব প্রিয় পরিচালক -- একজন আমার একদাকালের বন্ধু বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত -- অন্যজন অবশ্যই দি ম্যাসকুলাইন বয় অফ মাই টাইম, গৌতম ঘোষ । তৃতীয়জন সৃজিৎ মুখোপাধ্যায় । তবে যা বর্ণনা শুনেছি, আমরা একটু অন্যরকম ছিলাম । দৃশ্যত আমাদের অবয়বেই খানিকটা পাগলামির ভাব ছিল। কিন্তু আমরা আত্মহত্যা করিনি -- একটা অনুসন্ধান ছিল আমাদের -- সেটা অবিশ্যি এক একজনের এক একরকম । অ্যালেন গিন্সবার্গের তো শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধদর্শনে খুব বিশ্বাস হয়েছিল । যদিও ওঁর ঈশ্বরানুভূতির ব্যাপারটা সেভাবে আমাদের প্রভাবিত করেনি -- যা ওঁদের প্রবল ক্ষতি করেছে তা হল নানা রকমের নেশা । বাহিরের চেষ্টায় কিছু হবে না ভাই -- এটা সম্পূর্ণ অন্তর্গত ব্যাপার । প্রণব, শ্মশানে গেলেই কি সব হয় ? ঈশ্বরলাভের জন্য বহু জন্মজন্মান্তের সুকৃতি লাগে । আর লাগে সংকল্প, লাগে "মুখ্য হরিকথা -নিরূপণ" করে যাওয়া । মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঈশ্বরকে বা মূল উৎসকে খুঁজে পাওয়া -- সেটা হলেই সমস্ত অসম্পূর্ণতা তুচ্ছ হয়ে যায় । কবিতা মানে তো আমার কাছে আজ 'দি জার্নি টোয়ার্ডস দি ইটারনাল ট্রুথ -- আমি কি চাই ? এ টাচ অফ দি ইনফিনিট -- এ টাচ- এ রিয়াল টাচ । কোনো অজ্ঞাত কারণে আমার বেঁচে থাকা নয় । শংকরাচার্য বলতেন --ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা-- বুদ্ধও তাই বলতেন -- সূক্ষ্ম ভাবনা থেকে সূক্ষমতর ভাবনায় যেতে হবে -- বাসনার দাস হলে নির্বাণের পথ বন্ধ হয়ে যায় । সেইজন্যেই সহস্রমুখ চেতনার অধিকারী হতে হয় ।
প্রশ্ন : আপনার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না । হাংরি আন্দোলন মামলায় যাঁরা রাজসাক্ষী হয়েছিলেন, তাঁদের মুচলেকা থেকে তাঁদের পারিবারিক তথ্য পাওয়া যায় । আপনি যদি আপনার জন্ম, বাবা-মা, পরিবার, বাল্যকাল নিয়ে কিছু বলেন তাহলে ভালো হয় ।
উত্তর: আর দশটা বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা যেভাবে মানুষ হয়, আমিও সেভাবেই মানুষ হয়েছি -- খুব অল্প বয়সেই, দেশভাগের সামান্য আগে আমরা বাঁকুড়ায় চলে আসি --- সেখানেই আমার বড়ো হওয়া --- স্কুল-কলেজের পরে কলকাতায় এসে পড়াশুনো -- প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজের মাধ্যমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ( ড. হরপ্রসাদ মিত্রের সৌজন্যে ) কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসে ভর্তি হই -- পরে এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে, যে একসময় আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে আসি আমার তখনকার বন্ধু প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গে -- মূল কারণ ছিল কবিতা লেখা ও জীবনকে দেখা -- এছাড়া আর কিছু নয় --- তখনও হাংরি জেনারেশানের কারুর সঙ্গে আলাপও হয়নি --- আমার এ সিদ্ধান্ধ একজনই মাত্র সমর্থন করেছিলেন -- তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় -- আয়ওয়া থেকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন --"যেভাবে জীবন কাটাতে চাইছ সেটা দিব্য"-- তারও প্রায় বছরখানেক বাদে যোগাযোগ হয় শৈলেশ্বর, সুভাষ, বাসুদেব, দেবী রায় আর ফালগুনী রায়ের সঙ্গে --- বন্ধুত্ব হয়, ভাববিনিময় হয়, একসঙ্গে উন্মত্ত জীবনযাপন শুরু হয় -- কলকাতার নাড়িনক্ষত্র, অন্ধিসন্ধি, গলিঘুঁজি দেখতে দেখতে চোখের ওপর থেকে যেন একটা পর্দা সরে যায় -- মলয়ের সঙ্গে জীবনে দুবারই দেখা হয়েছে --- একবার দুমকায় সমীরদার কোয়ার্টারে তাঁর আম্ন্ত্রণে গিয়ে -- দ্বিতীয়বার মলয় যখন সাহিত্যসংক্রান্ত মামলা মিটে যাওয়ার পর সুবিমল আর ত্রিদিবকে নিয়ে আমার তখনকার চাকরি স্হলে এসেছিলেন -- তখন সদ্য পিতৃহীন হয়েছি -- বিধবা মা আর এক দাদার সঙ্গে থাকতাম--- সঙ্গী ছিল গ্রন্হ, গ্রন্হ, গ্রন্হ --- লেখা আর লেখা আর লেখা আর বিরতিহীন, একাকী মদ্যপান আর মৃত্যুচিন্তা-- মৃত্যুর চিন্তা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল -- জীবনের এক বিচিত্র উদঘাটন হতে থাকে আমার কাছে --বাড়ির কাছেই ছিল একটা শ্মশান -- মধ্যরাতে ছাদে দাঁড়িয়ে মদ্যপ এক মৃত্যুচিন্তাকাতর যুবা, যে কয়েকবছর আগেও ধর্মতলা এলাকায় সন্ধ্যেয় ট্র্যাফিক অগ্রাহ্য করে উচ্চস্বরে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে রাস্তা পেরোতো--- কলকাতা কিন্তু কবিকে অসন্মান করেনি -- নয়তো কবেই মরে যেতুম -- দেঘরে 'সৎসঙ্গ আশ্রমে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সমীপে পৌঁছোই মৃত্যুরহস্য জানার জন্য -- তাঁরই নির্দেশে আমার দীক্ষা -- তাঁর দুটি মাত্র ছোট বাক্য বুঝতে আমার বছর আষ্টেক সময় লেগেছিল -- জীবনের দিগন্ত খুলে যেতে থাকে -- তাঁরই অনুপ্রেরণায় আমি যাবতীয় ধর্মগ্রন্হ থেকে হাহরণ করতে থাকি সারকথাগুলি--- জীবনের রাস্তাটাই সম্পূর্ণ বদলে যায় -- কথা যদি আমি বলি যে, তিনি সর্বক্ষণ আমার সঙ্গে থাকেন-- তাহলে লোকে পাগল বলবে আমায় । এই যে আপনার প্রশ্নগুলির উত্তর লিখছি এখনও তিনি আমার সঙ্গে আছেন --- ফলে সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া বা অহং নিয়ে মত্ত হহোয়ার কোনো উপায়ই নেই । তাঁর অনন্ত করুণা ও দয়ায় আমি গোটা জীবনটাকে দেখতে পাই -- শুধু দেখি না, মৃত্যুর ওপরে বসে প্রার্থনা করি, "অন্ধজনে দেহ আলো, মৃত্যুজনে দেহ প্রাণ--"
প্রশ্ন : হাংরি আন্দোলনে আপনি কার মাধ্যমে যোগ দিলেন ? কবে নাগাদ আপনার মনে হল যে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আপনি আত্মপ্রকাশ করতে পারবেন ? যে কাজকর্মের জন্য ষাটের অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় হাংরিদের খ্যাতি, তাতে কি অংশ নিতেন ? খালাসিটোলা যাওয়া, গাঁজা-হ্যাশিশ টানা, দলবেঁধে যত্রতত্র যাওয়া, ইত্যাদিতে অংশ নিয়েছেন কি ? হাংরি আন্দোলন মকদ্দমায় আপনার বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল । পুলিশ কি আপনার খোঁজে গিয়েছিল ? গ্রেপ্তার হলে মুচলেকা দিতেন ? মকদ্দমার সময়ে বন্ধুদের সমর্থনে নিম্ন/উচ্চ আদালতে যেতেন ? মকদ্দমার সময়ে আপনি কোথায় থাকতেন ?
উত্তর : আমি, যতদূর মনে পড়ে, শৈলেশ্বর, সুভাষ, বাসুদেব এবং প্রদীপের সঙ্গেই মেলামেশা করতাম -- মলয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয় বহু পরে -- কারুর বেঁধে দেয়া ম্যানিফেস্টো বা নিয়মে লেখার কথা ভাবিনি কখনও, ফলে আমার ব্যাপারটা ছিল আমার মতন । লেখার ব্যাপারে আমার সেরকম কোনও বাসনা ছিল না -- শেক্সপিয়ার এর ঐ লাইনটা আমি খুব সমর্থন করি --"অ্যাম্বিশান ইজ এ থিং হুইচ মেকস অ্যান এনজেল এ সিনার" । প্রতিষ্ঠা বা নানারকম বিশেষণে ভূষিত হওয়া নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই । মলয়ের মামলা চলার সময়ে আমি ত্রিপুরায় থাকতাম -- তেলিয়ামুড়া নামে একটা জায়গায় স্কুলশিক্ষক ছিলাম -- কলকাতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না -- ফলে এদিকের কিছুই জানতাম না । ওখানে ছমাসের বেশি থাকার পর আমি কলকাতায় ফিরে আসি । না, পুলিশ আমার সম্পর্কে কি কি করেছিল জানি না -- তবে, ওরা একটা ক্ষতি করেছিল -- ওদেই অ্যাডভার্স রিপোর্টের জন্য মিনিস্ট্রি অফ এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স এ আমার প্রায় হওয়া একটা চাকরি শেষ অব্দি হয়নি -- মনে পড়ে, খুব ব্যথা পেয়েছিলাম -- বাস্তব ক্ষতি হয়েছিল দুটো -- আমার পিতৃদেব খুব হতাশ অবস্হায় চলে গিয়েছিলেন -- এবং যে মেয়েটি আমার জন্য বহু বছর অপেক্ষা করেছিল, সে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে । কিন্তু এতে ওদের আর কি যায় আসে । আজ আমারও কিছু এসে যায় না । ইট ইজ এ পার্ট অফ দি গেম । ধ্বংস ও সৃষ্টির লীলা ছাড়া একে আর কি বলা যায় !
প্রশ্ন : আপনি কি নিজেকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনে করেন ? অনেকে অভিযোগ করেন যে হাংরিরা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা বলে অথচ গোষ্ঠীপতি দাদা ও বইবাজারের বাণিজ্যিক কর্তাদের ধরে সংকলন প্রকাশ করতে এবং তার জন্য টাকা নিতে, তাদের বাধে না । এ বিষয়ে আপনার অবস্হান যদি স্পষ্ট করেন ।
উত্তর : এই চিন্তা থেকে আমি লক্ষ মাইল দূরে । তাছাড়া আমি বোধহয়, সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলাম না । শক্তি বা সন্দীপন সম্পর্কে কিছু বলতে পারবো না । তবে এদেশে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা বলে প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি লোভ অনেকেরই আছে । সকলেই তো আর সতীনাথ ভাদুড়ি বা শঙ্খ ঘোষ নন । তাছাড়া লেখাটাই তো কথা, মূল ব্যাপার ।
প্রশ্ন : 'কথা ও কাহিনি' প্রকাশিত সংকলনটি সম্পাদনা করেছিলেন সমীর চৌধুরী । সম্পাদকীয় পড়ে আমাদের মনে হয়েছে যে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে সমীর চৌধুরীর কোনো ধারণা ছিল না । তিনি কয়েকজনের রচনা নিয়ে দপ্তরির কাজ করেছেন । আপনি কী বলেন ?
উত্তর : আপনার কথাই তো ঠিক ।
প্রশ্ন : দে'জ থেকে প্রকাশিত হাংরি সংকলনটিকে অনেকে বলেন 'দারা-পুত্র-পরিবার' সংকলন । যে চারজন হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন, তাঁদের রচনা এই সংকলনে নেই । যাঁদের কার্যকলাপের জন্য হাংরি আন্দোলনের খ্যাতি, তাঁদের রচনা নেই । যাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরিয়েছিল, তাঁদের অধিকাংশের রচনা নেই । তার পরিবর্তে আছে অমুকের স্ত্রী, তমুকের শ্যালক, তমুকের আত্মীয়, পাঁচের দশকের কবি, ইত্যাদি । আপনি সৎপথের ধার্মিক মানুষ হয়ে কোন তর্কে এই সংকলনে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করলেন ?
উত্তর : ঐ সংকলনের কথা আমি জেনেছি 'দেশ' পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে -- প্রদীপ চৌধুরীর টেলিফোন পেয়ে । আমি করলে অবশ্যই অন্যরকম হতো । মলয়কে বাদ দেয়া মানে তো শিরচ্ছেদ করা ।
প্রশ্ন : আপনি অনুকূল ঠাকুরের শরণাপন্ন কেন হলেন ? আপনি কি হাংরি আন্দোলনের জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন বা অধঃপতনের পথে চলে যাচ্ছিলেন ? আপনার কি মনে হয়েছিল যে হাংরিদের জীবন প্রকৃতপক্ষে একটি ইঁদুরকল, এবং তা থেকে মুক্তি প্রয়োজন ? হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কি অনুকূল ঠাকুরের মতবিরোধ আছে ? অনেকে তেমনটাই মনে করেন । আপনি কি বলবেন ?
উত্তর : প্রশ্নের প্রথম অংশ সম্পর্কে কিছুই বলবো না । শুধু দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা সম্পর্কে বলি -- বই পড়ে কখনও ভগবানের অনুভূতি হয় না -- ঈশ্বরের জ্ঞান পেতে হলে কি করতে হয় ? ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন, "ঈশ্বর শুদ্ধ মনের গোচর" -- আগে জলে নামতে হবে তবে তো সাঁতার -- ডাঙায় সাঁতার দিলে বুকের ছাল-চামড়া ছিঁড়ে যাবে । কবি সমর সেনের 'বাবু বৃত্তান্ত' পড়লে এমন একটা দৃষ্টান্ত পাবেন যা অফুরন্ত হাসির খোরাক হয়ে আছে । হাংরিরা অসম্পূর্ণ -- ঠাকুর সম্পূর্ণ -- তিনি দ্বন্দ্বাতীতং গান সদৃশং ।
প্রশ্ন : আপনি কোনো কাব্যগ্রন্হ প্রকাশ করেননি কেন ? অথচ আপনি আপনার কবিতা 'কথা ও কাহিনি' এবং 'দে'জ' প্রকাশিত সংকলনে অন্তর্ভুক্তির জন্য দিয়েছেন ? আপনি তো স্টেট ব্যাঙ্কের উঁচু পদে ছিলেন, মাইনেও ভালো পেতেন, তবু কাব্যগপ্রন্হ প্রকাশ করলেন না কেন ? আমরা, সাধারণ পাঠকরা, আপনার একটি কাব্যগপ্রন্হ খুঁজে বেড়াই ।
উত্তর : ভীষণ টাকার অভাব -- নয়তো, প্রকাশক পেলে হয়তো একটি বই বার করা যেতো ।
প্রশ্ন : আপনি কি মেডিটেশন করেন ? মেডিটেশনের সময়ে আপনার মনে কি কোনো কবিতার উন্মেষ ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয় ? এখনকার তরুণ কবিদের মেডিটেশান সম্পর্কে কোনো পথনির্দেশ দিতে পারেন কি ?
উত্তর : পরামর্শ দিলে কেউ কি শুনবেন ? স্বামী বিবেকানন্দের 'ইন সার্চ অফ গড অ্যাণ্ড আদার পোয়েমস' পড়েছেন ? সন্ত কবীরের দোহা পড়লে বিস্ময়ে মূক হয়ে যেতে হয় -- এগুলো সবই মেডিটেশনের পথে পাওয়া -- কবীর পড়তে পড়তে আমি বার বার দেখি রবীন্দ্রনাথের অনেক আগেই তিনি অনেক কথা বলেছেন যা রবীন্দ্রনাথে ঘুরে ফিরে এসেছে । তবে ব্যক্তিটি তো রবীন্দ্রনাথ -- অসম্ভব এবং প্রবল পরিপাক শক্তি ছিল তাঁর । কবীরের ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ রবীন্দ্রনাথ বাংলায় এনেছেন ঈষৎ পরিবর্তিত করে । এবং মনে হবে এসবই রবীন্দ্রনাথের ।
প্রশ্ন : সুভাষ ঘোষ ও বাসুদেব দাশগুপ্ত সিপিএম-এ যোগ দিয়ে ছিলেন, অথচ হাংরি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন । সুভাষ ঘোষের বাড়িতে জ্যোতি বসুর ফোটো ঝোলানো থাকত, লাল ঝাণ্ডার ভাঁড়ার ছিল । তাঁরা দুজনেই সিপিএম-এর মিছিলে অংশ নিতেন । তাঁদের এই রাজনৈতিক কার্যকলাপ কি প্রতিষ্ঠানের আশ্রয়ে তাঁদের সুবিধাভোগী প্রমাণ করে না ? আপনার কি মনে হয় ?
উত্তর : কি জানি, ওদের রাজনৈতিক মতামত নিয়ে কখনও আমার সঙ্গে কথা হয়নি । বাসুদেবের শেষ দিকের রাজনৈতিক উপন্যাস আমার একেবারেই ভালো লাগেনি ।
প্রশ্ন : 'চন্দ্রগ্রহণ' পত্রিকার হাংরি আন্দোলন সংখ্যা ( সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৩ ) পড়ে আপনার কি মনে হয়েছে যে 'কথা ও কাহিনি' এবং 'দেজ' থেকে প্রকাশিত সংকলনগুলির তুলনায় এটি একটি সামগ্রিক কাজ, এবং সেকারণে প্রশংসনীয় ?
উত্তর : কিছুই হয় না --- যতক্ষণ না দেখছি ততক্ষণ কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না ।
প্রশ্ন : আপনি কি জানেন যে হাংরি আন্দোলন নিয়ে পিএইচ ডি এবং এম ফিল হয়েছে ? ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মারিনা ডি হেলার হাংরি আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করেছেন ? ইউটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিল্ম তুলে নিয়ে গেছেন ? ইউ টিউবে হাংরি কবিতা পাঠ করে রেকর্ড করেছেন বাংলাদেশ, আমেরিকা, কানাডা ইত্যাদি দেশের কবিরা ? ফালগুনী রায়ের কবিতা নিয়ে ফিল্ম করেছেন শর্মী পাণ্ডে ? মলয় রায়চৌধুরীর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি নিয়ে ফিল্ম করেছেন মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় ? এই সংবাদগুলো শুনে আপনার কেমন প্রতিক্রিয়া হয় ? 'বাইশে শ্রাবণ' নামে একটি ফিল্মে প্রখ্যাত পরিচালক গৌতম ঘোষ জনৈক হাংরি কবির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, জানেন ? ফিল্মটি আপনি দেখে থাকলে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইব ।
উত্তর : সিনেমাটা আমার সেভাবে দেখা হয়নি । তবে গৌতম ঘোষ একজন ব্রিলিয়ান্ট অভিনেতা -- সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের পরে দুজন আমার খুব প্রিয় পরিচালক -- একজন আমার একদাকালের বন্ধু বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত -- অন্যজন অবশ্যই দি ম্যাসকুলাইন বয় অফ মাই টাইম, গৌতম ঘোষ । তৃতীয়জন সৃজিৎ মুখোপাধ্যায় । তবে যা বর্ণনা শুনেছি, আমরা একটু অন্যরকম ছিলাম । দৃশ্যত আমাদের অবয়বেই খানিকটা পাগলামির ভাব ছিল। কিন্তু আমরা আত্মহত্যা করিনি -- একটা অনুসন্ধান ছিল আমাদের -- সেটা অবিশ্যি এক একজনের এক একরকম । অ্যালেন গিন্সবার্গের তো শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধদর্শনে খুব বিশ্বাস হয়েছিল । যদিও ওঁর ঈশ্বরানুভূতির ব্যাপারটা সেভাবে আমাদের প্রভাবিত করেনি -- যা ওঁদের প্রবল ক্ষতি করেছে তা হল নানা রকমের নেশা । বাহিরের চেষ্টায় কিছু হবে না ভাই -- এটা সম্পূর্ণ অন্তর্গত ব্যাপার । প্রণব, শ্মশানে গেলেই কি সব হয় ? ঈশ্বরলাভের জন্য বহু জন্মজন্মান্তের সুকৃতি লাগে । আর লাগে সংকল্প, লাগে "মুখ্য হরিকথা -নিরূপণ" করে যাওয়া । মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঈশ্বরকে বা মূল উৎসকে খুঁজে পাওয়া -- সেটা হলেই সমস্ত অসম্পূর্ণতা তুচ্ছ হয়ে যায় । কবিতা মানে তো আমার কাছে আজ 'দি জার্নি টোয়ার্ডস দি ইটারনাল ট্রুথ -- আমি কি চাই ? এ টাচ অফ দি ইনফিনিট -- এ টাচ- এ রিয়াল টাচ । কোনো অজ্ঞাত কারণে আমার বেঁচে থাকা নয় । শংকরাচার্য বলতেন --ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা-- বুদ্ধও তাই বলতেন -- সূক্ষ্ম ভাবনা থেকে সূক্ষমতর ভাবনায় যেতে হবে -- বাসনার দাস হলে নির্বাণের পথ বন্ধ হয়ে যায় । সেইজন্যেই সহস্রমুখ চেতনার অধিকারী হতে হয় ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন