মঙ্গলবার
রবিবার
মার্কসবাদের উত্তরাধিকার : মলয় রায়চৌধুরী
শনিবার
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা সম্পর্কে রাজর্ষি দে
নিজের পায়ে কুড়ুল মারার একটা বদভ্যাস আমার চিরকালের। আর তাই নিতান্ত গাড়লের
মতন কথা দিয়ে বসেছি মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা নিয়ে একটা লেখা লিখব। মলয়্দাকেই
কথা দিয়েছি আবার। সম্ভবত Notebook-এর প্রথম সংখ্যায়। কতটা অপরিণামদর্শী হলে
এটা করা যায়? মানে যার কবিতা নিয়ে লিখতে বাঘা বাঘা পণ্ডিতদের শুকিয়ে যায়
তাঁর কবিতা নিয়ে লিখবে আমার মতন এক অর্বাচীন “ফেসবুক কবি”। যাই হোক কথা যখন
দিয়েছি লিখব তো বটেই, কিন্তু আপাতত তাঁর “যা লাগবে বলবেন” কাব্যগ্রন্থ
পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখব। মূল কাজে হাত দেওয়ার আগে হাতমকশো আর কি!
মলয়্দার
কবিতা প্রথম পড়ার এক বিপদ আছে। বিপদ হোলো তরতর করে পড়ে ফেলা যায় না, কেমন
যেন দরজায় ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। অথচ তাঁর কবিতা কিন্তু সম্পূর্ণ
“কাব্যময়তা” রহিত। আসলে তাঁর কবিতার শব্দগুলো পরপর যৌক্তিক কাঠামো মেনে
চলতে চায় না অনেকসময়েই। “নীল চামড়ার বাঁধানো আকাশ সেখানে ধিকিধিকি
ধ্বংসস্তূপ/ আগুনের ব্যারিকেড ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনতলা বাড়ি”- ঘটনার সহজাত
সরলরৈখিক বিন্যাস ভেঙে গেছে। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা শেষ হচ্ছে এভাবে-
“কোনো কারণ নেই, স্রেফ/ চিৎকারের জন্যে চিৎকার/ চিৎকারের ভেতরে চিৎকার”। এই
যে কারণহীনতা, কার্যকারণ সম্পর্কের ভেঙে পড়া তা ছড়িয়ে আছে এই কবিতাগুলোর
ছত্রে ছত্রে। যেন কবিতাগুলো হঠাৎ করে সৃষ্টি হচ্ছে কবির কলমে, আবার হঠাৎ
করে লয় হয়ে যাচ্ছে। কবিতার কোনো “বক্তব্য” নেই, নৈতিক অবস্থান নেই, শুধু
কিছু অভিজ্ঞতা আছে। “আমি এরকম নারীকে সঙ্গম করিনি কখনো/ স্তব্ধতা-ফাটানো
চিৎকারে দুর্গন্ধের শতচ্ছিন্ন নারী জড়িয়ে ধরে”। কবিরা নাকি যে কোনো একটা
সাধারণ আটপৌরে জিনিষের সূত্র ধরেই কবিতাকে খুঁজে পান। তখন আর পাঠকের কাছে
সেই সূত্র সাধারণ দৈনন্দিন থাকে না। এবার এই জিনিষটাকে একটু ঘেঁটে নিন।
মলয়্দার এই কবিতাগুলোয় এইভাবে কোনো দৈনন্দিন বিষয়ের সূত্র ধরে অসীম বা
অরূপকে ধরার প্রচেষ্টা নেই। তিনি যেন “শিল্প”-এর কবর খুঁড়ে রেখেছেন তাঁর
কবিতায়। তাঁর দৈনন্দিনতাই তাঁর কবিতা। প্রতিমুহূর্তের অতিসাধারণ বেঁচে
থাকাই তো তাঁর কবিতা। যেমন হাসপাতালের আনাস্থেসিয়া- “তবু আয়েশে উপভোগ করতে
থাকি অজ্ঞানতার দিকে এগোনো।” কবিতাগুলোয় বারবার ফিরে এসেছে একটাই কথা বেঁচে
থাকা, প্রবলভাবে বেঁচে থাকা- “মরে যাবার কথা মোটেই ভাবি না/ যৌনক্ষমতা শেষ
হয়ে যাবার ভয়ের কথা ভাবি”। বেঁচে থাকার চিৎকার, খিদের চিৎকার- এর থেকে বড়
কবিতা আর কী আছে?
সোমবার
Someone is Hanging by Malay Roychoudhury
Someone is hanging by Malay Roychoudhury
Arun said, “come, lets go and see, at tin factory someone
Is hanging in circles.” I ran with him, hoping to see magic—
They cut canisters and straighten them with a wooden hammer.
How does the person wearing a shirt and dhoti climb so high ?
Wearing specs ! I noticed carefully and exclaimed, “Hey Brother
He is father of my class mate Arabinda ; because of partition
He had to flee from Faridpur, used to teach at a school there,
Had to leave behind his certificates etc in their burning house
That is why did not get any job, at last the sounds of
Beating tins told him everyday, “What a shame ! What a shame !”
How did he climb so high ! Collecting the rope from tied tins
Prepared a noose and now hanging, taking turn, once left
H…i…n…d…u…s…t…a…n… then right.. P…a…k…i…s…t…a…n
H….i….n….d….u….s….t…..a....n….P….a….k….i….s….t….a….n
বৃহস্পতিবার
বুধবার
বঙ্গসংস্কৃতির স্টাড বুল । কৌশিক সরকারের আঁকা
রবিবার
আমাকে বলে কি না ক্ষতিকারক
আমি তো বলেছিলাম, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ । আমি জানতাম, যাঁরা কবি নন তাঁরা সত্যকে সহ্য করতে পারেন না । তাই আমার কবিতা পড়ে তাঁরা আমাকে দেগে দিলেন ‘ক্ষতিকারক’ কবি হিসাবে । ভেবে দেখুন, আমাকে বলা হচ্ছে ‘ক্ষতিকারক’ । কারা বলছেন ? যাঁরা পৃথিবীকে ভয় পান, আমার কবিতায় বলা সত্যকে ভয় পান, ডাক্তারের ছুরিকে ভয় পান । অশোক মিত্র আমাকে ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসাবে দেগে দিয়েছিলেন । তারপর ওনার স্যাঙাতের তিন দশকের শাসনে পশ্চিমবাংলাকে তছনছ করে দেয়া হল, অথচ সুযোগ পেয়েছিলেন একটি সুন্দর সমৃদ্ধ পশ্চিমবাংলা গড়ে তোলার । পৃথক হয়ে যাওয়া বাংলাদেশেও অনেকে মগজে তালিবান পুষে রেখেছেন ; তাঁরা দেশটাকে রসাতলে নিয়ে যাবার প্রয়াস করে চলেছেন । শেষ পর্যন্ত কী হয় তা দেখবো । বুদ্ধদেব বসু আমাকে ‘নির্জনতম কবি’ হিসাবে দেগে দিয়েছিলেন, কেননা আমি ওনার মতন তরুণদের নিয়ে আড্ডা জমাতে পারতাম না । এখন দেখুন, ওনার ভাঙাচোরা ‘কবিতা ভবন’ কিনে নিয়েছে মারোয়াড়ি বিল্ডার । এমনকী রাশবিহারী অ্যাভেনিউয়ের সমস্ত দোকান মারোয়াড়িদের, ‘আদি ঢাকা বস্ত্রালয়ও’ ।অন্নদাশংকর রায় আমাকে দেগে দিলেন, ‘শুদ্ধতম কবি’ হিসাবে, কেননা উনি বাচ্চাদের ছড়া লিখতে ভালোবাসতেন। আমি গরিব ছিলাম বলে রবীন্দ্রনাথের মতন সারা পৃথিবী ঘুরে, বিখ্যাত লোকেদের সঙ্গে মিশে, নেটওয়ার্কিং করতে পারিনি । রবীন্দ্রনাথের মতন জমিদার-ব্যাংকার-নীলচাষি দাদু ছিল না আমার । অথচ ভীতু কবিরা আমাকে বলছে ‘ক্ষতিকর’ -- তারা তো নিজেরাই সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কতো নেটওয়র্কিঙ করলেন, কোনও ফল হল না, কারণ কবিতার সত্য উনি অনুধাবন করতে পারেননি, যদিও ওকাম্পোর মতন এক বান্ধবী ছিল ওনার, মার্গারেট নামে । শংকর-এর ‘চৌরঙ্গী’ আর ‘কত অজানারে’ চল্লিশের বেশি সংস্করণ হয়েছে, ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে ; সমস্যা হলো শংকর বিদেশে নেটওয়র্কিঙ করে উঠতে পারেননি, অতো টাকাকড়ি রোজগারের পরও । আমি জানি, কোনো শান্তিনিকেতন গড়ে যেতে না পারলেও আমি শান্তির কবি। আমার খ্যাতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে জগতজুড়ে । বিভিন্ন দেশের কবিরা আমার কবিতা অনুবাদ করছেন । আমি চাই যে আমার উপন্যাসগুলো বিদেশি ভাষায় অনুবাদ হোক । তাহলে ইউরোপ-আমেরিকার পাঠক জানতে পারবেন বাংলাভাষা কতো উন্নত, আমাদের দেশের উপন্যাস ইউরোপীয় ভাষাগুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে ।
শনিবার
কিন্নর রায় : সেলিম মোরশেদের দিগগজগিরি
সুবিমল মিশ্র সম্বন্ধে সেলিম মোরশেদের উচ্চারণ আছে ব্যক্তিগত ইশতেহার যা সামষ্টিক ও হতে পারে’তে। তিনি বলছেন, ‘সাতশ বছরে বাংলা ভাষার ইতিহাসে সুবিমল মিশ্রের মতো এত ব্যাপক বেপরোয়া এবং গঠনমূলক ভাঙাচোরা আর কেউ করেননি।’
ফাল্গুনী রায়ের ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিশন’ বা সুবিমল বসাকের ‘ইমলিওলা’— নামটা ঠিক লিখলাম তো, কজনে পড়েছি আমরা। পুরো পড়ে, আত্মস্থ না করেই ভান করেছি অতীন্দ্রিয় পাঠিক বা অমল চন্দর গদ্য শৈলী, বিষয় নিয়ে চেষ্টা করেছি কথা কাকলি ফোটাতে?
হাংরি সাহিত্য আন্দোলন অনেকটা যেন সত্তরের প্রায় শেষ লগ্নে শতধ বিভক্ত হয়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া নকশালবাড়ি— রাজনৈতিক আন্দোলন। সবাই তখন ‘হম কিসিসে কম নেহি’। প্রত্যেকেই প্রায় সেন্ট্রাল কমিটি অথবা পলিটব্যুরো। আর কে কতখানি ঘনিষ্ঠ ছিলেন সি এম— চারু মজুমদারের তার বাখানিতে ব্যস্ত। অথবা একদা চারুবাবুর অতি ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখন কতটা চারুবাবু বিরোধী, তা প্রমাণে ব্যস্ত। আসলে বিজয়ীকে কেউ প্রশ্ন করে না। কিন্তু পরাজিত বা আপাত পরাজিতের দিকে ছুটে আসতে থাকে অজস্র প্রশ্ন। একের পর এক।
তখন চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল, অসীম চট্টোপাধ্যায়, সত্যনারায়ণ সিং, চন্দ্রপোল্লা রেড্ডিদের মধ্যে যে আপাত অন্তর্বিরোধ তা আর ফুটে উঠত না সেভাবে। কারণ আগেই লিখেছি, বিজয়ীকে কেউ প্রশ্ন করে না সাধারণ ভাবে, বরং তার স্তুতি করে।
শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর ‘ক্ষুধার্ত সংকলন’-এর ভূমিকাতে লেখেন—
এই ধরণের কথা উঠে আসে উত্তর-নকশালবাড়ি পর্বে। ১৯৭৫-এর ২৬ জুন সংসদ এড়িয়ে ভারতবর্ষের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা ইমার্জেন্সি বা জরুরী অবস্থার আগে পরে, ইমার্জেন্সি পর্বেও টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া সি পি আই (এম-এল)-এর নেতারা এভাবেই কথা বলতে থাকেন প্রায়। ফলে নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে ঘটনা ও মূল্যায়নের সময় জঙ্গল সাঁওতাল ও সৌরীন বসুর লেখার মধ্যে থেকে যায় অনেক অনেক ফারাক।
শৈলেশ্বর ও মলয়ের হাংরি তুলনা প্রতিতুলনা ও তথ্যের মধ্যে থাকে বহু ফারাক ও তীক্ষ্ণতা। ব্যক্তি ঈর্ষা, ব্যক্তিগত বিরোধ, পছন্দ-অপছন্দ অনেক সময় কাজ করে গভীরভাবে।
‘উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা, যে উদ্বাস্তু হয়নি তার পক্ষে বোঝা কোনোদিনই সম্ভব নয়। জীবনের এই ধ্বংসযজ্ঞ মধ্যে থেকেই এসেছিল সেদিন ঐ বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, সুবো আচার্য, প্রদপ চৌধুরী এবং শৈলেশ্বর ঘোষ। বাল্যকালেই তারা যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা নিয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা থাকে তাদের রচনায়। বাংলার সুদূর গ্রামগঞ্জ থেকে এসে কলকাতায় আকস্মিকভাবে মিলিত হয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে তারাই হাংরি জেনারেশনকে আন্দোলনে পরিণত করবে। তাদেরই সৃষ্টি দিয়ে। এবং করেছেও তাই।’
শৈলেশ্বর ঘোষের এই ভূমিকাংশ পড়তে পড়তে মলয় রায়চৌধুরীর আখ্যান ‘নামগন্ধ’, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, কবিতা গ্রন্থ ‘মেঘার বাতানুকূল ঘুঙুর’-এর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল সমর রায়চৌধুরীর ‘সিগারেটের তিরোভাব ও অন্যান্য’, ‘খুল যা সিম সিম’-এর কথা। আসলে সমীর না থাকলে মলয় হন না। সে সব অন্য প্রসঙ্গ, এখন থাক।
‘আনডারগ্রাউন্ড সিনেমা’ ও ‘আনডারগ্রাউন্ড লিটারেচার’ তৃতীয় বিশ্বের নানান দেশে খুবই বেগবান, শক্তিশালী।
আসলে সেলিম মোরশেদের বিষয় ও গদ্য চলনে আমাদের কারও কারও পড়ার টেবিলে গোপনে ভুলেদের কুণ্ডলী পাকান শঙ্খচূড় অথবা গোখরো, যা যে কোনো সময়ে মেলে ধরতে পারে ফণা— তার কুলোপানা চক্কর। এই আকস্মিকতায় দীক্ষিত পাঠক চমকিত— সচকিত হন না। বরং আক্রমণাত্মক ভাষা ও অ্যাগ্রেসিভ বিষয়ের মধ্যে দিয়ে তিনি আক্রমণ করতে থাকেন সব কিছুকে। এমন কি অস্তিত্বকেও।
‘যারা নিয়মিত বাণিজ্যিক কাগজগুলোয় লেখে (অবশ্যই তাদের লেখা একটা মান স্পর্শ করে) প্রতিষ্ঠান হাতের পাঁচ হিসাবে তাঁদের লেখা নিয়ে বলে, ভালো লেখাটাই বড় কথা। আর লেখকরা বলেন, আমাদের লেখার দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন যদি হুবহু ছাপে তবে আপত্তি কেন? আমারা আমাদের ব্যাপক রিডারদেরকে বঞ্চিত করব কেন? জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকতে গিয়ে কী পরিমাণ লেখক নিজেই লাঞ্ছিত হন, তা বলাই বাহুল্য। এই লেখকরা সাহিত্য সম্পাদকদের মুখের দিকে তাকিয়ে লেখেন। আহসান হাবিব ছাড়া এ যাবত কোনো উপযুক্ত এবং সৎ (যদি এই টোটাল প্রক্রিয়ার কোনো সৎ ও উপযুক্ত সাহিত্য সম্পাদক হবার কথা নয়) কোনো সাহিত্য সম্পাদক নেই। যারাই সাহিত্য সম্পাদক কোনো-না-কোনোভাবে লেখালেখির জগতে তারা ব্যর্থ।
‘এদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করলে আপনার লেখা তখন নিন্দনীয় হয়ে উঠবে; সমসাময়িক একজন দুর্বল লেখককে দুর্দান্ত বিশ্লেষণে শিল্পী বানিয়ে এর বিভ্রান্ত রুচির জন্ম দিয়ে আপনাকে ছোট করে রাখবে। আমরা জানি, বিগত বিশ বছরে মধ্যবিত্ত জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-দর্শনে বুৎপত্তি লাভ করেছে। তার জীবন প্রক্রিয়ার ভেতর, বাস্তবতার ভেতর অনেক সপ্রতিভ অভিব্ব্যক্তি রপ্ত করেছে— এইসব করলেও শিল্প-সাহিত্যের টেস্টের ক্ষেত্রে ওই পুতু-পুতু— ধরা, বন্দি হওয়া, ঘোরে-পড়া, এমন ধরণের শিল্প কর্ম যারা পছন্দ করে, তাদের তরল রুচি বলব আমরা। কমিউনিকেটিং লেখা পাঠকরা চায়— পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ও মালিকরা এই কথা বলে আশি মিনিটে শেষ ওয়া একটি দৈনিকের সাময়িকীতে বিশ মিনিটের জন্য কমিউনিকেটিং গদ্য, কবিতা ছাপে। অনেক সময় বিনিয়োগ হিসেবে আধা-সিরিয়াস লেখা দুই-একটা ছেপে অজস্র বস্তাপচা লেখা ছাপার যৌক্তিকতা জায়েজ করে। এটা মোদ্দা কথা যে আমাদের দেশের বুর্জোয়ারা কোটি কোটি টাকা দিয়ে খবরের কাগজ বের করে কেন? এক : তাদের ব্যবসা এবং কালো টাকার ঢাল হিসাবে কাগজটি ভূমিকা রাখে— দুই : এখান থেকে প্রচলিত মূল্যবোধের ওপরই সে ব্যবসা করে। সেই ক্ষোভ আপনি লেখক হিসাবে কীভাবে প্রকাশ করবেন দৈনিকের পাতায়? প্রবীণ লেখকরা বলেন, ক্ষোভ খুব ছোট জায়গায় থাকে। বাণিজ্যিক মিডিয়ার লেখকরা বলেন, শিল্পিত করে ক্ষোভ প্রকাশ করলে বিরোধ কোথায়? কতোটা সুবিধাবাদী দেখুন তারা, ক্ষোভ নিয়ে সব সময় লিখতে হবে এমন কথা বলছি না। তবে ক্ষোভ শিল্পিত করে লিখতে হবে। এমন ধারা মাথায় নিয়ে তারা লিখতে বসেন। দেখুন, কারা সচেতন ভাবে অচেতন এবং স্বতঃস্ফূর্ত লেখার ভাব করে— এঁরা।’
এই মেয়া পরিচালকদের মধ্যে আছেন জ্যোতির্ময় দত্ত, অসিত পাল প্রমুখ। এই মেলাকে সমর্থন করছেন শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্তদের মতো পুরনো মানবেন্দ্রনাথ রায়-পন্থী র্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্টরা, সাফল্য কামনা করছেন ‘মুক্তমেলা’-র। শক্তি, সুনীল, আসছেন এখানে। এই সময়টাতেই শিল্পী অসিত পাল হাসপাতালের গায়ে, ফাঁকা দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকছেন সাপ আর পদ্মফুল— প্রস্ফুটিত পদ্ম। দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ের কাছাকাছি চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের নীল দেওয়ালের গায়ে কালোতে সাপ আর কমল একই সঙ্গে আঁকছেন অসিত। তখন তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেন।
‘মুক্তমেলা’ কে ‘সি আই এ’-র চক্রান্ত বলে ঘোষণা করেন নকশালপন্থী যুব ছাত্ররা ধু-উ-ড়ু-ম, ধু-উ-ড়ু-ম শব্দে বোমা মারলেন সেখানে। ধোঁয়া, আগুন, বিস্ফোরণ। কলকাতার আকাশে তখন চক্কর দেওয়া যায় ‘এয়ার ইন্ডিয়া’-র বিমানে উঠলে। শুধুই কলকাতার আকাশটুকু। এই প্লেনে ওঠার জন্য কাটতে হয় টিকেট।
কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের আবস্থাও একই প্রায়, অর্থাৎ ছবিটা এক।
সেলিম মোরশেদ মনে করেন— ‘বহুলোক মনে করেন অপেক্ষাকৃত সৎভাবে স্বদ্দল থাকাটাও বোধহয় প্রাতিষ্ঠানিক জীবন-যাপন। তাঁরা মনে করেন, না খেয়ে থাকা উস্কোখুস্কো চুল, আর অপরিষ্কার প্যান্ট-শার্ট পরে সারাদিন উঞ্ছবৃত্তি আর গাঁজা-মদ-হেরোইনে আশক্ত থেকে, কোনো যূথবদ্ধ শ্রমের সাথে যুক্ত না থেকে জীবন পারাপারই বোধহয় প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। আমাদের কাছে এগুলোকে অনেক সময় প্রতিবাদের মতো মনে হলেও এগুলো আসলে ক্রেজ। ঠিক কোথায় আঘাত করতে হবে আমরা সেই লক্ষ্যমুখকে সনাক্ত করব ক্রিয়েটিভ এক্সপ্রেশন দিয়ে। ফলে একজন প্রতিষ্ঠান বিরোধী যথেষ্ট সচেতন। শুনে রাখুন, সচেতনতাকে প্রতিষ্ঠান পছন্দ করে না। আপনাকে কম বুদ্ধির লোক করতে পারাই তার লক্ষ্য। অবোধ-আজগুবি-উদ্ভট কথিত কল্পনাকে প্রতিষ্ঠান তারিফ করে তার ওপর লেবাস লাগায়। একজন প্রাতিষ্ঠানিক লেখক একবার আমাদের বলেছিলেন, একজন পাগল তোমাদের চেয়েও বেশি প্রতিষ্ঠান বিরোধী। কেন না সে এই সমাজের সব কিছুতে উদাসীন। বোঝা যায় পাগলের উদাসীনতা লেখকটির পছন্দ। অথচ এই উদাসীনতা কোনো সচেতন লোকের কাম্য নয়। সে সমাজে বাস করলেও সামাজিক ভালো-মন্দের দায়-দায়িত্ব সে নেয় না। ফলে পাগল সামাজিকভাবে শিকার। তার কোনো বিরোধিতা নেই।’
তিনি আমাদের জানান, ‘অধিকাংশ সাহিত্যসম্পাদক মদ্যপ, নারীসঙ্গ লিপ্সু এবং দুর্নীতিবাজ হয়ে থাকে। তারা চিত্রকরের কাছ থেকে পেইনটিং উপহার নেয়— বিনিময়ে তাদের ফলাও করে লেখা ছাপে। এই পেইনটিং নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য চাকরি থেকে রিটায়ারের পর গ্যালারি করে পেইনটিংগুলো বিক্রি করবে। ভাবুন কত নির্লজ্জ তারা। আর এই ধরণের লোকের বাড়িতে লেখকদের বাজার পর্যন্ত করে দিতে হয়। তারপরও সাহিত্য সম্পাদকদের আওতাহীন হয়ে অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েও লেখকরা লেখেন। এরাই প্রতিষ্ঠানের পোষ মানা লেখক।’
প্রতিষ্ঠান নামের চিহ্নিত যাম ও তোরণদের অনায়াসে অস্বীকার করেন এই লেখক। তাঁর ‘সাপলুডো খেলা’ নামের উপন্যাসিকায় দেখি— সেই সঙ্গে পড়িও—
‘কাল কত তারিখ?’ কথা বলার তেমন ইচ্ছে ছিল না সলোমানের, নেহায়েত প্রয়োজনেওই সহকারীকে সে প্রশ্ন করল; তার কণ্ঠস্বর ছিল শীতলতায় পূর্ণ।
‘ছাব্বিশ।’
‘পাওয়ার হাউস থেকে বরাদ্দকৃত মইটি পেতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে আবে। ‘নয়’ উগ্র হয়ে ওঠে অন্ধকারে। কাল সন্ধ্যার পর তারা পিলারে দুর্ঘটনায় পড়বে।
‘…রিলিজিয়ন উদারতার নামে রাষ্ট্রকে সেক্যুলার রাষ্ট্র বলে চালানো হচ্ছে। স্টেট যেখানে রিলিজিয়নের পৃষ্ঠপোষক সেখানে সেক্যুলারিজিমের অর্থ বিকৃত করা হচ্ছে। রিলিজিয়ন বিষয়টি অন্তর্গত। স্টেটকে ভূমিকা শূন্য হতে হবে।’
‘আশি সালে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার এক নাতিশীতোষ্ণ বিকেলে পশ্চিম আকাশ জুড়ে দেখা দেওয়া বেগুনি রঙ আর ডোরাকাটা বাঘের মতো তরতাজা মেঘগুলো একে একে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল উত্তরদিকে। ইতোমধ্যে সে স্কোয়াড্রন লিভার (পাইলট কোর)-এর প্রাপ্য সম্মানের স্বত্বাধিকারী; রাশি রাশি সুখস্বপ্নে গতিশীল আর ‘কৃতকর্মই মানুষকে নির্ধারিত করে দেয় তার আপন গন্তব্য’— এই ধারণায় সতত গতির মুখোমুখি দাঁড়াত ছুরির ফলার মতো ছাব্বিশের জুবায়ের আহমেদ, কালো ঘন ভ্রু জোড়া ভ্রুর অনমনীয় চিত্তের যুবকটি তার বিশ্বাসের ক্ষেত্রসমূহ নিয়ত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উন্মুল করে দিত। কথিত সংস্কারের তাবৎ রক্ত পুঁজমুখ; তার বিশাস আর তার যুক্তির প্রবল্য এতই দৃঢ়তর ছিল যে তার বন্ধুদের কেউ কেউ তাকে রীতিমতো লৌহমানব বলে চিন্তা করতে শুরু করেছিল। এমন কি সে তাই কজেনেছিল আর পর্যায়ক্রমে নিজেকে তৈরি করেছিল এক জন নাস্তিক হিসেবে।
দিনটি তার মৃত্যু অবধি স্মরণীয় কেননা ওই দিনেই তার প্রথম অভিজ্ঞতা হয় যুদ্ধ-বিমান চালনার; সেই বৃহস্পতিবারে পিটি-সিক্স আর মিগ টুয়েন্ট ওয়ানের দুর্দান্ত প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ছয় ফুটের দীর্ঘাকৃতির ইব্নে আজিজ, আফ্রিকান, পরবর্তী কালে যার বসবাস হয় ইরাকের নিভৃত অঞ্চলে। প্রশিক্ষক হিসাবে সারা দুনিয়ায়ই তিনি ছিলেন তুলনাবিহীন একজন মানুষ এবং যার বিশ্বাস ছিল : আহম্মদিয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানী (১৮০৫-১৯০৮) ইমাম মেহেদী ও মসীহ মাউদ হবার যে দাবি করেন তা যথার্থ। আর অবশ্যই ফিরিশতারা তাকে সেই সময় পরিবেষ্টন করে রাখত।’
ফলে ইরাক ও তুরস্ক-সহ অন্যান্য ইসলামিক রাষ্ট্রে কুর্দ ও ইয়াজেদি উপজাতির ওপর হামলা হয়। মূল হামলাকারী কখনও রাষ্ট্রশক্তি, কখনও ‘আই এস আই এস’। মৌলবাদী ‘বোকো হারাম’ নির্যাতন চালায় নারী ও শিশুদের ওপর। তাদের পণবন্দি— জব্দ করে।
মোহাজির মুসলমানরা নির্যাতিত হন পাকিস্তানে। ইনডিয়া থেকে পার্টিশানের আগে পরে যাঁরা পাকিস্তানে চলে গেছেন, মজহবের আনুকূল্য পাবেন বলে, আজও তাঁদের সন্দেহের চোখে চোখে দেখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রশক্তি।
ভারতে অন্ধ শক্তি ভেঙে দেয় বাবরি মসজিদ, ১৯৯২–এর ৬ ডিসেম্বর। তথাকথিত রাম মন্দির নির্মাণের ধুয়ো তুলে মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠ, আবার খাবারের, খাদ্যের ন্যায্য দাবিকে নস্যাৎ করা হয়। কৃষকদের বঞ্চিত করা হয়।
পাকিস্তানের ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াঁদাদ আর একদা পাকিস্থানি প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ সাহেব কী মোহাজির হিসাবে থাকেন সন্দেহ তালিকায়, স্ক্যানারে?
সেলিম মোরশেদের লেখা পড়তে পড়তে হা-অন্ন তৃতীয় বিশ্বের একজন মানুষ হিসাবে, অতি সাধারণ আখ্যানকার হিসাবে মনে এল এইসব কথা। জিজ্ঞাসা। আর তাঁর কথাযাত্রা, আখ্যানসমূহ পড়তে পড়তে অনুভব করি এইসব তথ্যমালা, যা আমার কাছে বড়সড় এক জিজ্ঞাসা চিহ্ন এবং একই সঙ্গে হারিকিরি— কাচ ফলা হয়ে দাঁড়ায়।
শুক্রবার
মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতা বইয়ের প্রচ্ছদ
গোবিন্দ ধর-এর নেয়া মলয় রায়চৌধুরীর টানা সাক্ষাৎকার
সোমবার
বুড়ো বয়সে ঢুকে পড়লেন ক্ষমতাসেবীর দলে
” একজন যিনি কবি হযে় উঠতে চান, তার আত্মবিমোচন পদ্ধতি শুরু হতেই যদি বুঝে যান যে তিনি ক্ষমতার বিপক্ষের লোক নন, তিনি ক্ষমতার পক্ষের লোক; তিনি যে ভাষা পেতে চান সেটি ক্ষমতাকে বিরূপ করে তুলবে — তখন শুরু হয় তার ত্রাসের কাল | ভাষা বিমোচন তো দূরের কথা, এই সংঘর্ষের ক্ষেত্রটি থেকে পলায়নই তার বাঁচার পথ হয় | এমন রচনাকার আমরা দেখেছি যিনি ক্ষমতার ভাষাকে আঘাত করার আপাত একটা মানসিকতা দেখাচ্ছেন কিন্তু অনতিকালেই তিনি ওই পথ ত্যাগ করতে বাধ্য হন | তিনি ঢুকে পডে়ন ক্ষমতাসেবীর দলে |”
শৈলেশ্বর ঘোষ (ভাষা বিমোচন)