তখন জাতীয় পার্টির পরামর্শ তথা আদেশে জলপাই আর খাকি পোশাকের যৌথ উদ্যোগে
মফঃস্বলের অলিতে গলিতে লাশের ছড়াছড়ি। পাড়া নিবাসীদের রাজনৈতিক সচেতনতা
বৃদ্ধির সুবিধার্থে লাশগুলো এশিয়ান মুক্তিসূর্যের আলো শরীরে মেখে পড়ে থাকত
অনেকক্ষণ।
সচরাচর মৃত্যু সংবাদ পেলে মাছির মতো দর্শকদের ঝাঁপিয়ে পড়াটা চিরকালের রেওয়াজ কিন্তু তখন এই ধরণের মৃত্যুগুলো এতটাই ত্রাসের সঞ্চার করত যে সবাই সেঁদিয়ে থাকত ঘরের ভেতর। বলা তো যায় না যদি বুকফাটা শোক আচমকা প্রকাশিত হয়ে পড়ে, আহা রে, ---বাবুর ছেলেটা.....!
তাবলে মৃতের পরিচয় গোপন থাকত না, কিভাবে যেন ছড়িয়ে পড়ত শহরময়! এ ব্যাপারে কাদের মুখ্য এবং কাদের গৌণ ভূমিকা থাকত সেটা জানার মতো সাহস কারোরই ছিল না।
তখন সব গলিরই এক বা একাধিক এহেন শিক্ষামূলক লাশের গৌরব থাকত।
সবারই যদি সেই গৌরব থেকে তাহলে আমরাই বা পিছিয়ে থাকব কেন? সম মর্যাদা দান করতে এক সকালে আমাদের গলিতেও আবিষ্কৃত হলো একটি লাশ। এক্ষেত্রেও কয়েক ঘন্টার মধ্যেই চলে এলো নিহত যুবকের নাম ধাম। জানা গেল মৃত যুবক আমাদের পাড়ার নয়। তাহলে এখানে লাশটা এলো কিভাবে? ডেকে এনে খুন করা হয়েছে? নাকি কারো সঙ্গে দেখা করতে এখানে এসেছিল, ফেরা হয়নি?
কে দেবে এসব উত্তর! শুধু এটুকু জানা গেল যে আজ রাতে পাড়ায় মিলিটারি নামবে। গোটা এলাকায় রেইড করা হবে। কোনো যুবক ছাড় পাবে না। সবাইকে অ্যারেস্ট করা হবে না, এনকাউন্টারও করে দেয়া হবে কাউকে কাউকে।
বলাবাহুল্য বিরোধী মনোভাবাপন্নদের পাড়া ছাড়ার ধুম শুরু হয়ে গেল।কিন্তু আমাদের ওপরতলার বিপুদা বেঁকে বসলো, আমাদের দলের ছেলে খুন হয়েছে। আমি কেন পালাবো? পালাবে তো ওরা!
--ওরা মানে! তুই জানিস কারা মেরেছে?
--আলবত জানি। সবার নাম বলে দিতে পারি। শুধু আমি কেন, পুলিশও জানে। পুলিশ ওদের চাকর তাই ধরার সাহস নেই।
এরপর মিলিটারি সংক্রান্ত সংবাদ কতটা সঠিক কিংবা সংবাদদাতা আদৌ নির্ভরযোগ্য কিনা, সেসব সন্দেহের অবকাশই থাকেনা। বাড়ির চারঘর ভাড়াটে পরিবারই নিশ্চিত হয়ে যায় পাড়ার অন্য বাড়িগুলো যদি বা রেহাই পায়, আমাদের কাঠের দোতলার রেহাই নেই। তারচেও বড় কথা হলো সবাইকে প্রত্যক্ষ করতে হবে বিপুদার নৃশংস মৃত্যু।
ব্যাপারটা যেহেতু মেনে নেয়াটা কঠিন তাই বিপুদার মা, বাবার সঙ্গে অন্য তিনটি পরিবারও দায়িত্ব নিলো বিপুদাকে বোঝানোর। যৌথ চাপাচাপিতে বিপুদা ঘর ছাড়ল বটে কিন্তু তাতেও কি স্বস্তি আছে? চারদিকে তো বিপ্লবী অস্তিত্বের ছড়াছড়ি! সুতরাং বাড়ি লোকদের প্রচেষ্টা শুরু হলো সেই অস্তিত্বের প্রমাণ লোপাটের। খাটের তলার বাক্স থেকে খুঁজে বের করা হলো রাশি রাশি বই,লিফলেট, পুস্তিকা। সবকিছু আগুনে পুড়িয়ে ছাইগুলোও জলে ধুয়ে দেয়া হলো। মার্কস,লেনিন,স্ট্যালিন,হোচিমিনের ছবিগুলো দেয়াল থেকে খুলে প্লাস্টিকের প্যাকেটে পুড়ে রেখে দেয়া হলো যৌথ ঘুঁটের গাদার একদম নীচে। রইলো শুধু পেন্সিল স্কেচের রবীন্দ্রনাথ। 'বুর্জোয়া কবি' আখ্যা পেয়ে যাওয়ায় ওঁর ছবিতে বিপদ হবে না, হয়ত এরকম ধারণা থেকেই ওই ছাড়।
সে যাক,এখন এ বাড়িতে যে বিপ্লব থাকে সে নিতান্তই সুবোধ বালক। মাসীর মেয়ের বিয়েতে গতমাসে আসামে গিয়েছে। শিগ্রি ফিরবে।
প্রমাণ লোপাটের অপরাশেন শেষে সবার চোখে মুখে যখন তৃপ্তির ছোঁয়া ঠিক তখনই আমার চোখে পড়েছিল টেবিলের নীচে পড়ে থাকা সবুজ রেক্সিনে বাঁধানো একটা বই। কাউকে টের পেতে না দিয়ে বইটা তুলে নিয়ে এসে রেখে দিয়েছিলাম পড়ার বইখাতার স্তূপে।
সংবাদদাতার সততা প্রমাণ করে শেষ রাতে পাড়া ঘিরে ফেলল সি.আর.পি। সংগে পুলিশ। ভোর হোতেই শুরু হয়ে গেল বাড়ি বাড়ি তল্লাশি। বাড়ি চেনানোর দায়িত্বে থাকলো চেনা কিছু যুবক। পাড়ার কিছু ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনে ভ্যানে তোলা হলো। কী আশ্চর্য, এসবই ঘটছিল চারপাশে, আমাদের বাড়িটাকে বাদ দিয়ে! তবে কি রেহাই পেলাম আমরা? নাঃ, সেই আশাটুকুকে সমূলে বিনাশ করে পুলিশ এলো। হাতের খাতা দেখে রোল কলের ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলো, বিপ্লব কোন ঘরে থাকে? এবং উত্তরের তোয়াক্কা না রেখেই কাঠের সিঁড়ি মচমচিয়ে উঠে গেল দোতলায়।
ততক্ষণে সব কটা পুলিশ ভ্যানই ভর্তি হয়ে যাওয়ায় বিপুদার দুই দাদাকে গোটা কয়েক চড় চাপড় দিয়ে বিপুদার বাবাকে, ওসব আসাম ফাসাম দেখাবেন না। ছেলেকে বলুন সারেন্ডার করতে। নাহলে কিন্তু আপনারা কেউ রেহাই পাবেন না, হুকুম দিয়ে চলে গিয়েছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বাহিনী। রেহাই পেয়ে গিয়েছিলাম অন্য তিনটি পরিবার। না, প্রমাণের জন্য কোনো তল্লাশির প্রয়োজন বোধ করেনি ওরা। সুতরাং সবকিছুর পাশাপাশি রেহাই পেয়েছিল ওই সবুজ রেক্সিনের বইটাও।
আজও আমার সঙ্গে আছে বইটা। ম্যাক্সিম গোর্কির ছোট গল্প। সুযোগ পেলেই উল্টেপাল্টে দেখি কারণ ওটা তো নিছকই বই নয়, আমার প্রথম চুরি করা বই। রাশিয়ান সাহিত্য প্রাঙ্গনে আমার প্রথম পদক্ষেপ। ওই বই থেকেই জেনেছিলাম ‘ভিভা’ শব্দটার অর্থ জিন্দাবাদ।
সচরাচর মৃত্যু সংবাদ পেলে মাছির মতো দর্শকদের ঝাঁপিয়ে পড়াটা চিরকালের রেওয়াজ কিন্তু তখন এই ধরণের মৃত্যুগুলো এতটাই ত্রাসের সঞ্চার করত যে সবাই সেঁদিয়ে থাকত ঘরের ভেতর। বলা তো যায় না যদি বুকফাটা শোক আচমকা প্রকাশিত হয়ে পড়ে, আহা রে, ---বাবুর ছেলেটা.....!
তাবলে মৃতের পরিচয় গোপন থাকত না, কিভাবে যেন ছড়িয়ে পড়ত শহরময়! এ ব্যাপারে কাদের মুখ্য এবং কাদের গৌণ ভূমিকা থাকত সেটা জানার মতো সাহস কারোরই ছিল না।
তখন সব গলিরই এক বা একাধিক এহেন শিক্ষামূলক লাশের গৌরব থাকত।
সবারই যদি সেই গৌরব থেকে তাহলে আমরাই বা পিছিয়ে থাকব কেন? সম মর্যাদা দান করতে এক সকালে আমাদের গলিতেও আবিষ্কৃত হলো একটি লাশ। এক্ষেত্রেও কয়েক ঘন্টার মধ্যেই চলে এলো নিহত যুবকের নাম ধাম। জানা গেল মৃত যুবক আমাদের পাড়ার নয়। তাহলে এখানে লাশটা এলো কিভাবে? ডেকে এনে খুন করা হয়েছে? নাকি কারো সঙ্গে দেখা করতে এখানে এসেছিল, ফেরা হয়নি?
কে দেবে এসব উত্তর! শুধু এটুকু জানা গেল যে আজ রাতে পাড়ায় মিলিটারি নামবে। গোটা এলাকায় রেইড করা হবে। কোনো যুবক ছাড় পাবে না। সবাইকে অ্যারেস্ট করা হবে না, এনকাউন্টারও করে দেয়া হবে কাউকে কাউকে।
বলাবাহুল্য বিরোধী মনোভাবাপন্নদের পাড়া ছাড়ার ধুম শুরু হয়ে গেল।কিন্তু আমাদের ওপরতলার বিপুদা বেঁকে বসলো, আমাদের দলের ছেলে খুন হয়েছে। আমি কেন পালাবো? পালাবে তো ওরা!
--ওরা মানে! তুই জানিস কারা মেরেছে?
--আলবত জানি। সবার নাম বলে দিতে পারি। শুধু আমি কেন, পুলিশও জানে। পুলিশ ওদের চাকর তাই ধরার সাহস নেই।
এরপর মিলিটারি সংক্রান্ত সংবাদ কতটা সঠিক কিংবা সংবাদদাতা আদৌ নির্ভরযোগ্য কিনা, সেসব সন্দেহের অবকাশই থাকেনা। বাড়ির চারঘর ভাড়াটে পরিবারই নিশ্চিত হয়ে যায় পাড়ার অন্য বাড়িগুলো যদি বা রেহাই পায়, আমাদের কাঠের দোতলার রেহাই নেই। তারচেও বড় কথা হলো সবাইকে প্রত্যক্ষ করতে হবে বিপুদার নৃশংস মৃত্যু।
ব্যাপারটা যেহেতু মেনে নেয়াটা কঠিন তাই বিপুদার মা, বাবার সঙ্গে অন্য তিনটি পরিবারও দায়িত্ব নিলো বিপুদাকে বোঝানোর। যৌথ চাপাচাপিতে বিপুদা ঘর ছাড়ল বটে কিন্তু তাতেও কি স্বস্তি আছে? চারদিকে তো বিপ্লবী অস্তিত্বের ছড়াছড়ি! সুতরাং বাড়ি লোকদের প্রচেষ্টা শুরু হলো সেই অস্তিত্বের প্রমাণ লোপাটের। খাটের তলার বাক্স থেকে খুঁজে বের করা হলো রাশি রাশি বই,লিফলেট, পুস্তিকা। সবকিছু আগুনে পুড়িয়ে ছাইগুলোও জলে ধুয়ে দেয়া হলো। মার্কস,লেনিন,স্ট্যালিন,হোচিমিনের ছবিগুলো দেয়াল থেকে খুলে প্লাস্টিকের প্যাকেটে পুড়ে রেখে দেয়া হলো যৌথ ঘুঁটের গাদার একদম নীচে। রইলো শুধু পেন্সিল স্কেচের রবীন্দ্রনাথ। 'বুর্জোয়া কবি' আখ্যা পেয়ে যাওয়ায় ওঁর ছবিতে বিপদ হবে না, হয়ত এরকম ধারণা থেকেই ওই ছাড়।
সে যাক,এখন এ বাড়িতে যে বিপ্লব থাকে সে নিতান্তই সুবোধ বালক। মাসীর মেয়ের বিয়েতে গতমাসে আসামে গিয়েছে। শিগ্রি ফিরবে।
প্রমাণ লোপাটের অপরাশেন শেষে সবার চোখে মুখে যখন তৃপ্তির ছোঁয়া ঠিক তখনই আমার চোখে পড়েছিল টেবিলের নীচে পড়ে থাকা সবুজ রেক্সিনে বাঁধানো একটা বই। কাউকে টের পেতে না দিয়ে বইটা তুলে নিয়ে এসে রেখে দিয়েছিলাম পড়ার বইখাতার স্তূপে।
সংবাদদাতার সততা প্রমাণ করে শেষ রাতে পাড়া ঘিরে ফেলল সি.আর.পি। সংগে পুলিশ। ভোর হোতেই শুরু হয়ে গেল বাড়ি বাড়ি তল্লাশি। বাড়ি চেনানোর দায়িত্বে থাকলো চেনা কিছু যুবক। পাড়ার কিছু ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনে ভ্যানে তোলা হলো। কী আশ্চর্য, এসবই ঘটছিল চারপাশে, আমাদের বাড়িটাকে বাদ দিয়ে! তবে কি রেহাই পেলাম আমরা? নাঃ, সেই আশাটুকুকে সমূলে বিনাশ করে পুলিশ এলো। হাতের খাতা দেখে রোল কলের ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলো, বিপ্লব কোন ঘরে থাকে? এবং উত্তরের তোয়াক্কা না রেখেই কাঠের সিঁড়ি মচমচিয়ে উঠে গেল দোতলায়।
ততক্ষণে সব কটা পুলিশ ভ্যানই ভর্তি হয়ে যাওয়ায় বিপুদার দুই দাদাকে গোটা কয়েক চড় চাপড় দিয়ে বিপুদার বাবাকে, ওসব আসাম ফাসাম দেখাবেন না। ছেলেকে বলুন সারেন্ডার করতে। নাহলে কিন্তু আপনারা কেউ রেহাই পাবেন না, হুকুম দিয়ে চলে গিয়েছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বাহিনী। রেহাই পেয়ে গিয়েছিলাম অন্য তিনটি পরিবার। না, প্রমাণের জন্য কোনো তল্লাশির প্রয়োজন বোধ করেনি ওরা। সুতরাং সবকিছুর পাশাপাশি রেহাই পেয়েছিল ওই সবুজ রেক্সিনের বইটাও।
আজও আমার সঙ্গে আছে বইটা। ম্যাক্সিম গোর্কির ছোট গল্প। সুযোগ পেলেই উল্টেপাল্টে দেখি কারণ ওটা তো নিছকই বই নয়, আমার প্রথম চুরি করা বই। রাশিয়ান সাহিত্য প্রাঙ্গনে আমার প্রথম পদক্ষেপ। ওই বই থেকেই জেনেছিলাম ‘ভিভা’ শব্দটার অর্থ জিন্দাবাদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন