এবার আসা যাক দ্বিতীয় শ্রেণীশত্রুর প্রসঙ্গে।
দেয়াল লিখন পড়ার অভ্যেস আমার বহুদিনের। ডহরবাবুর আঙিনা ভরানোর নিমন্ত্রণ কিংবা নেতাজীর শিগ্রি ফিরে আসার সংবাদ, যেটাই হোক, আজও আমার নজর এড়ায় না। বাল্যকালের অভ্যেস বলে কথা!
সি.পি.আই.এম.এল-এর যত দেয়াল লিখন পড়তাম তার মধ্যে সেরা লাগত, এই বুর্জোয়া ব্যবস্থায় যে যত পড়ে সে তত মূর্খ হয়। বলাবাহুল্য সে বয়সে অত কঠিন কঠিন শব্দের অর্থ বোধগম্য হোত না। কে জানে হয়ত গোটা বাক্যটার অর্থই বুঝতে পারতাম না যদি না লিখনটার হাতে-কলমে প্রয়োগ থাকতো।
শহর জুড়ে তখন স্কুল পোড়ানোর উৎসব চলছে। শুধু পোড়ানো নয়, দু-চারজন শিক্ষক সেজে থাকা শ্রেণীশত্রু বধও চলছে। বেশীর ভাগ স্কুলই বন্ধ থাকছে মাসের পর মাস। কিন্তু আমার ভাগ্য এতটাই মন্দ যে ঠিক সেসময়েই ফ্রি প্রাইমারি থেকে ছাড়িয়ে এনে আমাকে ভর্তি করা হয়েছিল শহরের নামী স্কুলে। সত্যিই গর্ব করার মতো স্কুল। 1898 তে প্রতিষ্ঠিত হয়ে 1918তেই হায়ার সেকেন্ডারি বোর্ডের স্বীকৃতি পাওয়া এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের তালিকায় চিরকালই স্বনামধন্যদের ছড়াছড়ি। পাশ রেকর্ডে বলা চলে প্রায় HMV।
কিন্তু নাম ধুয়ে কি জল খাবো? ওই দেয়াল লিখনের আঁচটুকুও লাগত না আমাদের বিদ্যালয়ে! কে জানে কোন জাদুবলে হেডমাস্টার মশায় কঠোর ভাবেই স্কুলের রাশ ধরে রেখেছিলেন! শুধু এটুকুই নয়, মুকুটে পালকের সংখ্যা বাড়িয়ে নিতেই কি না কে জানে, একবার কিছু ছাত্রের খোঁজে আসা পুলিশ বাহিনীকে স্কুল চত্বর থেকে উনি বের করেও দিয়েছিলেন। অর্থাৎ কুমির এবং বাঘ, দুপক্ষকেই চটিয়েছিলেন। তবুও ওঁর কিংবা আমাদের স্কুলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি।
যেহেতু শৈশব থেকেই আমি লেখাপড়া বিমুখ তাই এতটা নিরাপত্তা অবধারিত ভাবেই আমার ভালো লাগত না। অহরহ খবর পাচ্ছি, আজ অমুক স্কুলে আগুন জ্বললো, কাল তমুক স্কুল বন্ধ হয়ে গেল অথচ আমার সেই একঘেয়ে রুটিন। খেলার মাঠ পেরিয়ে স্কুলে যাবার পথে দেখতাম পুরোন স্কুলের সহপাঠীরা মজাসে ফুটবল পিটছে। দেখে বুকে যন্ত্রণা হোত। রাগ হোত বাবার ওপরে, প্রাইমারি পর্বটা পুরোন স্কুল থেকে পড়লে কী ক্ষতি হোত! না থাকুক অটুট দরজা,জানলা, বেঞ্চ, স্বাধীনতাটা তো অটুট ছিল!
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, আচ্ছা,স্কুলটা যদি আজ রাতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাহলে কতদিন ছুটি থাকতে পারে? প্রতিদিনই আমার ভাবনায় ছাই ঢেলে দিব্যি পঠন পিটন চলত।
অবশেষে এরকম একটা নিশ্চিন্ত দুর্গের মাথাতেও এক সকালে পতপত করে উড়তে দেখা গেল লাল পতাকা। যদিও তাতে কোন প্রতীক চিহ্ন ছিল না, তা না থাকুক, সে সময় একখন্ড লাল কাপড়ই শহর বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে ছিল যথেষ্ট।
সেদিন স্কুলে আসা প্রত্যেক ছাত্রের বুক আনন্দে দুরুদুরু, কতদিন বন্ধ থাকবে স্কুল! অনেকে বলছে বটে অনির্দিষ্টকাল কিন্তু তার মানে কতদিন? সঠিক না জেনে বাড়ি ফেরা যায়?
এরপর থানা পুলিশ সি.আর.পি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল কিন্তু তার পরিবর্তে দারোয়ানকে সঙ্গী করে হেডস্যার সোজা উঠে গেলেন ছাদে এবং পতাকাটা নামিয়ে এনে রেখে দিলেন অফিসে। উপস্থিত ছাত্র শিক্ষকদের তখন অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। এহেন হঠকারিতার কারণে জীবন সংশয় তো শুধু হেডস্যারের নয়, এগারো শত ছাত্র সহ চল্লিশ জন শিক্ষকেরও। কে বাঁচাবে তাদের?
এখানেই শেষ নয়, কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা ব্যতিরেকেই হেডস্যার নির্দেশ দিলেন স্কুল চালু করার। এরপর যথারীতি ঘন্টা বাজল এবং দুরুদুরু বুকে আমাদের গিয়ে বসতে হলো ক্লাসে। অন্যদিন যারা শিক্ষকদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে বাহবা কুড়োত, তাদের ভাগ্যে সেদিন তারিফের হাসিটুকুও জুটল না আর যারা ব্যর্থ হয়ে অন্যদিনের মতোই পিঠ পেতে দিল, তাদের জুটল কঠিনতম বজ্রমুষ্টি।
এভাবেই একদিন-প্রতিদিন-এক হপ্তা-এক মাস। যথা পূর্বং তথা পরং। নির্বিঘ্নে চললো আমাদের অধ্যয়ন তপস্যা। কিছুদিন ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকার পর যখন আমরাও ভবিতব্যকে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ঠিক তখনই একদিন আমাদের সকল কাঁটা ধন্য করে ফুল ফোটার উপক্রম ঘটল।
তখন প্রায় দুপুর একটা, টিফিনের আগের ক্লাসটা চলছে, খানিক পরেই টিফিন তথা খেলাধুলো পর্ব শুরু হবে, সে সময়ই হঠাৎ ‘আগুন আগুন’ চিৎকারে আমরা সবাই নিমেষে ক্লাসের বাইরে। না, কোথাও কোন আগুনের শিখাটুকুও নেই তবু হেডস্যার মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করছেন।
ছুটে এলেন শিক্ষকবৃন্দ। শোনা গেল, হেডস্যার যখন ঘরে বসে কাজ করছিলেন তখন কয়েকটি যুবক আচমকা ঘরে ঢুকে পড়েছিল, ওদের হাতে ছিল কেরোসিনের টিন। উদ্দেশ্য যে আগুন ধরানো, সেটাও নাকি তারা জানিয়েছিল। কোন রকমে ওদের নাগাল মুক্ত হয়ে হেডস্যার বেরিয়ে আসতে পেরেছেন।
যদিও সরেজমিন তদন্তে যুবকবৃন্দ, কেরোসিন টিন কিছুই পাওয়া গেল না এমন কী কেরোসিনের গন্ধটুকুও নয়, তবু এরপর স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়া রুখবে কে? কিন্তু মূল প্রশ্ন তো সেটা নয়, এই ছুটি কতদিনের, প্রশ্নটা সেখানে। উত্তর মেলেনি।
হায়, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়।পরদিনই চালু হয়েছিল স্কুল। এমন কী তার কিছুদিন পর পরীক্ষা পর্ব শুরু হোতেও কোনো অসুবিধে হয়নি। কোন দৈব সেদিন কৃপা করেছিলেন হেডস্যারকে সেটা জানা যায়নি। যেহেতু জানার সাহস ছিল না কিংবা জানানোর মতো সোর্সও ছিলনা তাই জানার তৃষ্ণাটুকুও বোধ করিনি তবে স্বীয় জ্ঞান বলে এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে হেডস্যার শ্রেণীশত্রুই তবে সেটা যেহেতু আমার চোখেই তাই মৃত্যু বরাদ্দ হয়নি।
গল্পটা এখানেই শেষ হোত যদি না অনেকদিন পর এক প্রাক্তন সহপাঠীর আচমকা দেখা পেয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসতাম। কিন্তু বেরসিক কি আর কল্পনার ধার ধারে? আমার ঝাঁপির মুখ চাপা দিয়ে বলেছিল, আরে, লাল পতাকাটা তো উঁচু ক্লাসের কয়েকটা ছেলে টাঙিয়েছিল যাতে পরীক্ষা ভন্ডুল হয়ে যায়! আমাদের স্কুলে ওসব ঘটবে কিভাবে! ভুলে গেলি মহান নেতার একমাত্র ছেলে তখন আমাদের স্কুলেরই ছাত্র ছিল?
তথ্যটা মিথ্যে নয় ঠিকই কিন্তু তাতে কী এসে যায়!
আমার অবিশ্বাসে চটে উঠেছিল তথ্যদাতা, তুই একবারে গাধা, কখনও ভেবে দেখেছিস গার্লস স্কুলেও কেন তখন আগুনের আঁচ লাগেনি?
ততদিনে গার্লস স্কুলের আঁচ আমার শরীরে ভালো মতোই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল। এমন কী ওই স্কুলের কেউ কেউ প্রতিরাতের স্বপ্নেও হাজিরা দিচ্ছিল কিন্তু সেসব তো ভিন্ন ব্যাপার! তার সঙ্গে সহপাঠীর প্রশ্নের মিল কোথায়?
বিস্মিত গাধার পিঠে সস্নেহে চাপড় মেরে সেই সবজান্তা বলেছিল, কারণ সর্বাধিনায়কের একমাত্র মেয়েও তখন গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিল!
খানিকক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে প্যান্টে সেঁটে যাওয়া চোরকাঁটা বেছেছিলাম। কার্য শেষে উঠে পিঠ ঝাড়া দিয়েছিলাম, চলি রে।
এমন নাটকীয় বিদায়ে হয়ত সহপাঠী মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল। হোক গে। কুলোকের কুকথা অলোক কোন দায়ে বিশ্বাস করবে! সেটাও আবার এতদিন পর! কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?
দেয়াল লিখন পড়ার অভ্যেস আমার বহুদিনের। ডহরবাবুর আঙিনা ভরানোর নিমন্ত্রণ কিংবা নেতাজীর শিগ্রি ফিরে আসার সংবাদ, যেটাই হোক, আজও আমার নজর এড়ায় না। বাল্যকালের অভ্যেস বলে কথা!
সি.পি.আই.এম.এল-এর যত দেয়াল লিখন পড়তাম তার মধ্যে সেরা লাগত, এই বুর্জোয়া ব্যবস্থায় যে যত পড়ে সে তত মূর্খ হয়। বলাবাহুল্য সে বয়সে অত কঠিন কঠিন শব্দের অর্থ বোধগম্য হোত না। কে জানে হয়ত গোটা বাক্যটার অর্থই বুঝতে পারতাম না যদি না লিখনটার হাতে-কলমে প্রয়োগ থাকতো।
শহর জুড়ে তখন স্কুল পোড়ানোর উৎসব চলছে। শুধু পোড়ানো নয়, দু-চারজন শিক্ষক সেজে থাকা শ্রেণীশত্রু বধও চলছে। বেশীর ভাগ স্কুলই বন্ধ থাকছে মাসের পর মাস। কিন্তু আমার ভাগ্য এতটাই মন্দ যে ঠিক সেসময়েই ফ্রি প্রাইমারি থেকে ছাড়িয়ে এনে আমাকে ভর্তি করা হয়েছিল শহরের নামী স্কুলে। সত্যিই গর্ব করার মতো স্কুল। 1898 তে প্রতিষ্ঠিত হয়ে 1918তেই হায়ার সেকেন্ডারি বোর্ডের স্বীকৃতি পাওয়া এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের তালিকায় চিরকালই স্বনামধন্যদের ছড়াছড়ি। পাশ রেকর্ডে বলা চলে প্রায় HMV।
কিন্তু নাম ধুয়ে কি জল খাবো? ওই দেয়াল লিখনের আঁচটুকুও লাগত না আমাদের বিদ্যালয়ে! কে জানে কোন জাদুবলে হেডমাস্টার মশায় কঠোর ভাবেই স্কুলের রাশ ধরে রেখেছিলেন! শুধু এটুকুই নয়, মুকুটে পালকের সংখ্যা বাড়িয়ে নিতেই কি না কে জানে, একবার কিছু ছাত্রের খোঁজে আসা পুলিশ বাহিনীকে স্কুল চত্বর থেকে উনি বের করেও দিয়েছিলেন। অর্থাৎ কুমির এবং বাঘ, দুপক্ষকেই চটিয়েছিলেন। তবুও ওঁর কিংবা আমাদের স্কুলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি।
যেহেতু শৈশব থেকেই আমি লেখাপড়া বিমুখ তাই এতটা নিরাপত্তা অবধারিত ভাবেই আমার ভালো লাগত না। অহরহ খবর পাচ্ছি, আজ অমুক স্কুলে আগুন জ্বললো, কাল তমুক স্কুল বন্ধ হয়ে গেল অথচ আমার সেই একঘেয়ে রুটিন। খেলার মাঠ পেরিয়ে স্কুলে যাবার পথে দেখতাম পুরোন স্কুলের সহপাঠীরা মজাসে ফুটবল পিটছে। দেখে বুকে যন্ত্রণা হোত। রাগ হোত বাবার ওপরে, প্রাইমারি পর্বটা পুরোন স্কুল থেকে পড়লে কী ক্ষতি হোত! না থাকুক অটুট দরজা,জানলা, বেঞ্চ, স্বাধীনতাটা তো অটুট ছিল!
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, আচ্ছা,স্কুলটা যদি আজ রাতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাহলে কতদিন ছুটি থাকতে পারে? প্রতিদিনই আমার ভাবনায় ছাই ঢেলে দিব্যি পঠন পিটন চলত।
অবশেষে এরকম একটা নিশ্চিন্ত দুর্গের মাথাতেও এক সকালে পতপত করে উড়তে দেখা গেল লাল পতাকা। যদিও তাতে কোন প্রতীক চিহ্ন ছিল না, তা না থাকুক, সে সময় একখন্ড লাল কাপড়ই শহর বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে ছিল যথেষ্ট।
সেদিন স্কুলে আসা প্রত্যেক ছাত্রের বুক আনন্দে দুরুদুরু, কতদিন বন্ধ থাকবে স্কুল! অনেকে বলছে বটে অনির্দিষ্টকাল কিন্তু তার মানে কতদিন? সঠিক না জেনে বাড়ি ফেরা যায়?
এরপর থানা পুলিশ সি.আর.পি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল কিন্তু তার পরিবর্তে দারোয়ানকে সঙ্গী করে হেডস্যার সোজা উঠে গেলেন ছাদে এবং পতাকাটা নামিয়ে এনে রেখে দিলেন অফিসে। উপস্থিত ছাত্র শিক্ষকদের তখন অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। এহেন হঠকারিতার কারণে জীবন সংশয় তো শুধু হেডস্যারের নয়, এগারো শত ছাত্র সহ চল্লিশ জন শিক্ষকেরও। কে বাঁচাবে তাদের?
এখানেই শেষ নয়, কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা ব্যতিরেকেই হেডস্যার নির্দেশ দিলেন স্কুল চালু করার। এরপর যথারীতি ঘন্টা বাজল এবং দুরুদুরু বুকে আমাদের গিয়ে বসতে হলো ক্লাসে। অন্যদিন যারা শিক্ষকদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে বাহবা কুড়োত, তাদের ভাগ্যে সেদিন তারিফের হাসিটুকুও জুটল না আর যারা ব্যর্থ হয়ে অন্যদিনের মতোই পিঠ পেতে দিল, তাদের জুটল কঠিনতম বজ্রমুষ্টি।
এভাবেই একদিন-প্রতিদিন-এক হপ্তা-এক মাস। যথা পূর্বং তথা পরং। নির্বিঘ্নে চললো আমাদের অধ্যয়ন তপস্যা। কিছুদিন ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকার পর যখন আমরাও ভবিতব্যকে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ঠিক তখনই একদিন আমাদের সকল কাঁটা ধন্য করে ফুল ফোটার উপক্রম ঘটল।
তখন প্রায় দুপুর একটা, টিফিনের আগের ক্লাসটা চলছে, খানিক পরেই টিফিন তথা খেলাধুলো পর্ব শুরু হবে, সে সময়ই হঠাৎ ‘আগুন আগুন’ চিৎকারে আমরা সবাই নিমেষে ক্লাসের বাইরে। না, কোথাও কোন আগুনের শিখাটুকুও নেই তবু হেডস্যার মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করছেন।
ছুটে এলেন শিক্ষকবৃন্দ। শোনা গেল, হেডস্যার যখন ঘরে বসে কাজ করছিলেন তখন কয়েকটি যুবক আচমকা ঘরে ঢুকে পড়েছিল, ওদের হাতে ছিল কেরোসিনের টিন। উদ্দেশ্য যে আগুন ধরানো, সেটাও নাকি তারা জানিয়েছিল। কোন রকমে ওদের নাগাল মুক্ত হয়ে হেডস্যার বেরিয়ে আসতে পেরেছেন।
যদিও সরেজমিন তদন্তে যুবকবৃন্দ, কেরোসিন টিন কিছুই পাওয়া গেল না এমন কী কেরোসিনের গন্ধটুকুও নয়, তবু এরপর স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়া রুখবে কে? কিন্তু মূল প্রশ্ন তো সেটা নয়, এই ছুটি কতদিনের, প্রশ্নটা সেখানে। উত্তর মেলেনি।
হায়, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়।পরদিনই চালু হয়েছিল স্কুল। এমন কী তার কিছুদিন পর পরীক্ষা পর্ব শুরু হোতেও কোনো অসুবিধে হয়নি। কোন দৈব সেদিন কৃপা করেছিলেন হেডস্যারকে সেটা জানা যায়নি। যেহেতু জানার সাহস ছিল না কিংবা জানানোর মতো সোর্সও ছিলনা তাই জানার তৃষ্ণাটুকুও বোধ করিনি তবে স্বীয় জ্ঞান বলে এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে হেডস্যার শ্রেণীশত্রুই তবে সেটা যেহেতু আমার চোখেই তাই মৃত্যু বরাদ্দ হয়নি।
গল্পটা এখানেই শেষ হোত যদি না অনেকদিন পর এক প্রাক্তন সহপাঠীর আচমকা দেখা পেয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসতাম। কিন্তু বেরসিক কি আর কল্পনার ধার ধারে? আমার ঝাঁপির মুখ চাপা দিয়ে বলেছিল, আরে, লাল পতাকাটা তো উঁচু ক্লাসের কয়েকটা ছেলে টাঙিয়েছিল যাতে পরীক্ষা ভন্ডুল হয়ে যায়! আমাদের স্কুলে ওসব ঘটবে কিভাবে! ভুলে গেলি মহান নেতার একমাত্র ছেলে তখন আমাদের স্কুলেরই ছাত্র ছিল?
তথ্যটা মিথ্যে নয় ঠিকই কিন্তু তাতে কী এসে যায়!
আমার অবিশ্বাসে চটে উঠেছিল তথ্যদাতা, তুই একবারে গাধা, কখনও ভেবে দেখেছিস গার্লস স্কুলেও কেন তখন আগুনের আঁচ লাগেনি?
ততদিনে গার্লস স্কুলের আঁচ আমার শরীরে ভালো মতোই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল। এমন কী ওই স্কুলের কেউ কেউ প্রতিরাতের স্বপ্নেও হাজিরা দিচ্ছিল কিন্তু সেসব তো ভিন্ন ব্যাপার! তার সঙ্গে সহপাঠীর প্রশ্নের মিল কোথায়?
বিস্মিত গাধার পিঠে সস্নেহে চাপড় মেরে সেই সবজান্তা বলেছিল, কারণ সর্বাধিনায়কের একমাত্র মেয়েও তখন গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিল!
খানিকক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে প্যান্টে সেঁটে যাওয়া চোরকাঁটা বেছেছিলাম। কার্য শেষে উঠে পিঠ ঝাড়া দিয়েছিলাম, চলি রে।
এমন নাটকীয় বিদায়ে হয়ত সহপাঠী মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল। হোক গে। কুলোকের কুকথা অলোক কোন দায়ে বিশ্বাস করবে! সেটাও আবার এতদিন পর! কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন