প্রদীপ চৌধুরী, ফরাসি কবি, বাঙালি কবি, হাংরি আন্দোলনের কবি : মলয় রায়চৌধুরী
এক
হাংরি জেনারেশন সাহিত্যের আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি, প্রদীপ চৌধুরী ২০২১ সালের ২৫ শে এপ্রিলের সকালে কোভিড -১৯ অসুখে আক্রান্ত হয়ে আটাত্তর বছর বয়সে মারা গেল । বেশ কিছুকাল যাবত ওর দুটো চোখই খারাপ হয়ে গিয়েছিল । লেখালিখি করতে পারছিল না । দুষ্প্রাপ্য বইগুলো, যা এতোকাল যত্ন করে রেখেছিল, মালার্মে, রেঁবো, বোদলেয়ার, ভেরলেন, বুকোস্কি, সিলিন, গিন্সবার্গ, কেরুয়াক, হ্যারল্ড নর্স, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, এমনকী ওর প্রিয় লেখক ডস্টয়ভস্কির বইগুলোও বিক্রি করে দিচ্ছিল একে-একে । আলমারি জুড়ে রাখা বহুকাল যাবত সম্পাদিত ‘স্বকাল/‘ফুঃ’ পত্রিকার কপিগুলো সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরিতে দিয়ে দিলে ভালো হতো । কেমন করে ও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল জানি না । কেননা চোখের ওই অবস্হা নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরোনো তো অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল । হয়তো যারা বই-পত্রিকার লোভে ওর ফ্ল্যাটে হানা দিয়েছিল, তাদের কারোর সঙ্গে ঢুকেছিল ভাইরাসটা ।
জীবনের প্রতিটি ব্যাপারের মতন মৃত্যুও যেন প্রদীপ চৌধুরীর কাছে অপ্রত্যাশিত যাত্রা ছিল না। ২০১৫ সালে আলাইন জেগুকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রদীপ বলেছিল: "আমার জন্য জীবন এবং মৃত্যুর সীমাবদ্ধতা বেঁচে থাকা অভিজ্ঞতার তীব্রতায় বা তার বাইরেও; চৈতন্য, মাংসল, রক্তাক্ত, বর্বর প্রাণীর সহজাত সচেতনতার অবিচ্ছিন্ন দর্শন দ্বারা - সচেতনতার চেতনা পেরিয়ে, একটি দূরপাল্লার বাসে যাত্রায় মাদ্রাজ থেকে কন্যাকুমারী হয়ে টার্মিনাল পেরিয়ে অন্য এক গণ্ডি পেরিয়ে বাতাসকে লাঞ্ছিত করে গিয়ারবক্সকে ঘৃণা করে, কয়ামতের দিনের অন্ধকারকে বের করে দেয়া মায়াপুরুষের সচেতন নিশাচর কাহিনী।”
১৯৪৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে প্রদীপ চৌধুরীর জন্ম । তিন বছর বয়স পর্যন্ত ছিল সেই গ্রামে। তারপর ও আর ওর মা কলকাতায় বাবা প্রমোদরঞ্জন চৌধুরীর কাছে চলে আসে । কলকাতায় প্রদীপের বাবা শিক্ষক হিসাবে চাকরি করতেন । উত্তরণ দাশগুপ্তকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রদীপ বলেছে, “যখন আমি আমার জন্মসূত্রের কথা ভাবি, তখন আমার কাছে একটি লাবণ্যময় প্রাকৃতিক আশ্রয়ের ঝলক মনে পড়ে, ফ্রান্সের গ্রামগুলির সাথে তুলনীয়, পাশাপাশি লিবর্ন এবং বার্গেরাকের মাঝে দর্ডোগন নদীর মতন। জনগণের মধ্যে মূলত হিন্দু জমির মালিক এবং মুসলিম কৃষক। আমাদের বাড়ির তিনপাশে বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেত , বাড়ির একটি টিনের ছাদ ছিল , ফলের গাছ এবং একটি বড় পুকুর মনে আছে । আমার দাদু যখন মারা গেলেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৯ বছর, এবং আমার বাবা তখন ছয় বছরের। সুতরাং, আমার ঠাকুমা আমাদের সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি বেশ ভালভাবে পরিচালনা করেছিলেন । আমার বাবা কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে স্নাতক হন । আমার জন্মের সময়, স্বাধীনতা - এবং দেশভাগ - খুব দ্রুত এগিয়ে আসছিল । বাতাসে অশান্তি ছিল, এমনকি সেই বয়সেও আমি স্বাচ্ছন্দ্যে সুস্থ বোধ করতে পারিনি। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় যাওয়ার পরে, আমি খুব কষ্ট করে গ্রামে ফিরেছি। স্বাধীনতার পরে, কলকাতা ছিল এক ধরণের স্বপ্নের দেশ - বিশেষত লেখকরা, যারা মহানগরের প্রাণবন্ত মুদ্রণ সংস্কৃতি থেকে উপকৃত হয়েছিল। লেটার প্রেসটি ছিল প্রকাশের একমাত্র সম্ভাব্য উপায় এবং হিন্দু শরণার্থীদের দুর্ভোগ তখনকার লেখার মূল বিষয় ছিল। আমার বাবা ত্রিপুরা রাজ্যে শিক্ষা বিভাগে যোগদানের সময় আমরা ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলুম।”
কলকাতায় প্রদীপ থাকতো রিজেন্ট পার্কের আবাসনে । ওর বাবা সময়মতন ওই অঞ্চলের পানাপুকুর-জোলো-জমি সস্তায় কিনে রেখেছিলেন, তার ওপরে তৈরি আবাসনে অন্য ভাইদের সঙ্গে প্রদীপও একখানা ফ্ল্যাট পেয়েছিল । ভাইরা ছিল ওর বন্ধুর মতনই, আড্ডা, মদ খাওয়া, হইচই করতো সবাই মিলে, ছুটিছাটায় । প্রদীপের স্ত্রী গৌরী সরকারি কাজ করতেন আগরতলায়, আসতে চাননি কলকাতায় । প্রদীপ গৌরীকে চাকরি ছাড়িয়ে রিজেন্ট পার্কে আনার কিছুকাল পরেই গৌরী মারা যান । তখনও প্রদীপ ওর ছেলের বিয়ে দেয়নি । পরে দিয়েছিল, আর বেশ ভালোই ছিল ছেলে, ছেলের বউ আর নাতনিকে নিয়ে রিজেন্ট পার্কে । সবাই মিলে ভারতের নানা জায়গায় বেড়াতে যেতো । গৌরী মারা যাবার আগে আমি আমার ছেলে-মেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে প্রায়ই যেতুম ওর ফ্ল্যাটে আড্ডা দিতে, মদ খেতে । দাদা সমীর রায়চৌধুরীও যেতেন । প্রদীপও আসতো আমার নাকতলার ফ্ল্যাটে, আর দাদার বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে । ওর বউ মারা যাবার পর আমাদের যাতায়াত প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । দাদার সম্পাদিত “হাওয়া-৪৯” পত্রিকায় প্রদীপকে নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলুম ; প্রদীপ বলেছিল অমন প্রবন্ধ ওর সম্পর্কে আর কোনও বন্ধু লেখেনি । প্রদীপ বেঁচে থাকতে ওর সম্পর্কে পশ্চিমবাংলার লিটল ম্যাগাজিনে তেমন আলোচনা হতো না, মারা যাবার পরও কোনও সম্পাদকের আগ্রহ দেখলুম না । হয়তো হাংরি আন্দোলনের ভীতি তাঁদের নিষ্ঠাকে কুরে খেয়েছে । ষাটের দশক সম্পর্কে প্রদীপ এই কথাগুলো লিখেছিল, যা আজও সত্য, ‘মিডিওক্র্যাসি তরুণ প্রজন্মের সেন্সিটিভিটিতে এনে দিয়েছিল এক ব্যাপক শূন্যতা।’ তবে, প্রদীপ চৌধুরী হতে চেয়েছিল ফরাসি ভাষার কবি, বাংলার নয় ।
প্রদীপের ফ্ল্যাটে গেলে ও ডেকে নিয়ে যেতো নিজের ঘরে । দেশের-বিদেশের, যারা ওর সঙ্গে আড্ডা দিতে আসতো, তাদের বসাতো ওর কম্পিউটার টেবিলের কাছে চেয়ারগুলোয় । নিজে বসতো বিছানায় পা মুড়ে আর একটু-আধটু দোল খেতো।গাঁজা টানার অভ্যাস বজায় রেখেছিল, তবে কখনও-সখনও বন্ধুরা গেলে ।ওর কম্পিউটার টেবিলে একটি বৈদ্যুতিক কেটলি রাখা থাকতো, যাতে নিজেই কফি পাউডার দিয়ে কফি তৈরি করে অতিথিদের খাওয়াতে পারে, বাড়ির কাউকে অযথা কষ্ট দিতে না হয় । বিস্কিটও থাকতো বইয়ের তাকে। এটা ও শিখে এসেছিল প্যারিস থেকে, যে শহরে যশোপ্রার্থী কবি-লেখক-শিল্পীরা একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন, আর বন্ধুবান্ধব বা সাংবাদিকদের ওইভাবেই আপ্যায়ন করেন ।এরকম ব্যবস্হা অনিল করঞ্জাইয়ের স্টুডিওতেও দেখেছিলুম । আমি যাদের সঙ্গে প্রদীপের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলুম, আর যাদের পত্রিকায় ও লিখতো, গিন্সবার্গ, ফেরলিংঘেট্টি, কার্ল ওয়েইজনার, ক্লদ পেলিউ, ডিক বাকেন, হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড, ব্রুনো সৌরদাঁ, জর্জ ডাউডেন, গ্যারি চিমেন্সকি, আলাইন জিগু প্রমুখের চিঠিগুলো কোথাও গচ্ছিত রেখে গেলে বা ইনটারনেটে আপলোড করলে গবেষকদের কাজে দিতো ।
হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বিদেশের লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের আমিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলুম । সেই সব পত্রিকার বিশেষ হাংরি সংখ্যার প্রকাশনার তোড়জোড় করেছিলুম ; সবায়ের ফোটো যোগাড় করে পাঠিয়েছিলুম। ১৯৮০ সাল নাগাদ প্রদীপ চৌধুরী ত্রিভাষিক পত্রিকা pPhooo সম্পাদনা করলেও, তাতে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনা ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে বা করিয়ে প্রকাশ করেনি । বস্তুত হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখার একটা সংকলন সেই সময়ে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হলে ইউরোপের পাঠকদের কাছে আমরা পৌঁছোতে পারতুম । যেটুকু পৌঁছে ছিলুম তা ইংরেজিতে প্রকাশিত বুলেটিনগুলোর কারণে । বুলেটিনের জন্যই ইউরোপ-আমেরিকার তরুণ কবি আর লেখকরা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন কলকাতায়, আমাদের লেখার অনুবাদ প্রকাশ করতেন ।
একটি সাক্ষাৎকারে প্রদীপকে করা আলাইন জিগুর এই প্রশ্নে, যে, “ভারতের তুলনায়, আন্তর্জাতিকভাবে, বিশেষত ফ্রান্স এবং কানাডার ফরাসিভাষা অঞ্চলে আপনার লেখা ফরাসি ভাষায় অনেক বেশি প্রকাশিত হয়েছে কেন”, এর জবাবে প্রদীপ বলেছিল, “ফরাসি ভাষা ? কুড়ি বছর বয়স না হওয়া অবধি ইংরেজির একটি শব্দও জানতুম না।” এবং তারপরে বেশ উন্নাসিকভাবে বলেছিল; “আজ, যদিও প্রদীপ একজন ব্রিটিশ লেখক হিসাবে বিবেচিত! মনে রাখতে হবে কাফকা চেক ছিলেন, তবে বেছে নিয়েছিলেন জার্মান ভাষায় লিখতে । আমার চেক বন্ধুরা এখনও তাঁকে "বিশ্বাসঘাতক" মনে করে তাঁর "মাতৃভাষায়" না লেখার জন্য । আমাদের সবাইকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? এটি চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাথে কী মেলে ? কয়েকজন বিখ্যাত লেখকের কথা ভাবুন। নবোকভ রাশিয়ান, তারপরে ফ্রেঞ্চ এবং তারপর ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেছিলেন। তখন তিনি কী ছিলেন, একজন রাশিয়ান লেখক নাকি ফ্রেঞ্চ লেখক, না অ্যাংলো-আমেরিকান লেখক? জোসেফ কনরাড সম্পর্কে ভাবুন, তিনি পোলিশ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং লিখেছিলেন অসাধারণ ইংরেজিতে। স্পষ্টতই, আমি এই ধরণের যুক্তির সাথে একমত নই । সুতরাং, বেশিরভাগ জীবন্ত লেখকের চেয়ে আমার আরও জটিল পটভূমি রয়েছে এবং আমি ইতিমধ্যে সমাজের প্রান্তে থাকা একটি গোষ্ঠীর "ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুর" অন্তর্ভুক্ত।
প্রদীপকে আমি জিগ্যেস করেছিলুম যে ফরাসি ভাষায় “হাংরি আন্দোনকারীদের রচনা সংকলন” প্রকাশ করলে না কেন ? প্রদীপ কোনো উত্তর দেয়নি।অথচ ও লিখেছিল, ‘মাথা অব্দি নিজেকে দেখি/ অদ্ভুত সৌন্দর্যের বোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে তোলে/ আমি বুঝতে পারি দেবতা কখন মন্দিরের বেড়া ডিঙিয়ে/ আমার শরীরের প্রতি ভাঁজে ঢুকে পড়েছে/ আর তাঁর বৈদ্যুতিক স্পর্শে/ আমি আরো পবিত্র/ আমি আরো সুন্দর হয়ে উঠেছি।’ আসলে প্রদীপ চৌধুরী বাঙালি কবি নয়, ফরাসি কবি হিসেবে পরিচিতি পেতে চেয়েছিল । তাই বাংলা লিটল ম্যাগাজিনে ওর সাক্ষাৎকার প্রকাশ আর কবিতা নিয়ে আলোচনায় ওর আগ্রহ ছিল না । ফরাসি ভাষা বেশ দেরিতে শিখলেও ফরাসিতে বেশ কয়েকটি বই লিখেছে প্রদীপ । তার মধ্যে উল্লেখ্য : L’Existence phénoménale de Jack Kérouac: Son Influence sur la conscience moderne (Tempus Fugit, Belgique, 1987), Le Faux Nom qu’était Jack Kérouac (N’importe Quelle Route, Montréal, 1987), Québec Kérouac Blues (recueil) (Ecrits Des Forges, Ottawa, Canada, 1989) and Lieux d’asile, Lieux d’exil (recueil) (Poésie Clandestine, St. Lô, France, 1994). লক্ষ্যণীয় যে ফরাসি ভাষায় প্রদীপ লিখেছে জ্যাক কেরুয়াককে নিয়ে ; কোনও বাঙালি কবিকে নিয়ে নয় । নিজের কবিতার অনুবাদসহ ইংরেজিতেও কয়েকটা বই লিখেছিল প্রদীপ : My Rapid Activities (Clandestine, 1965), Skin Disease (Swakal-Pphoo Calcutta), Black Hole (Inkblot, California), The Assassin and the Dahlia (Edition Pphoo, Calcutta 2005) আর Essence and Aroma of Asphodel in Hell (Blue Jacket Press, Japan, 2014). গদ্য-পদ্য মিলিয়ে, বাংলায় প্রদীপের বইয়ের সংখ্যা দশ ।
দুই
ফরাসি ভাষায় লেখালিখি করে হাংরি আন্দোলনের লেবেলকে অতিক্রম করে যেতে চেয়েছিল প্রদীপ চৌধুরী, আমার এরকমটা মনে হয় । প্রদীপ চৌধুরীর নাম সেকারণে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে। কফিহাউসের লোকচক্ষুর অন্তরালে, চিরন্তন বসবাস করছে । স্বেচ্ছায় পৃথিবী ভ্রমণ করেছে, একটি বিদেশী ভাষা অধ্যয়ন করেছে, ওর ‘একলিপ্স’ কবিতার ব্যালে উপস্থাপনা উপভোগ করেছে, (ফরাসি ব্যালে নর্তকী শ্রীমতি ক্রিস্টাইন জুউইম্যানের নৃত্যে ) ; একজন ফরাসী কবি হয়েছে, সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি ব্যাখ্যা করেছে , এবং থেকেছে প্যারিসের কিংবদন্তি বিট হোটেলে । প্রদীপের বক্তব্য ছিল যে ষাটের দশক এমন কালখণ্ড ছিল যখন কবি-লেখক-শিল্পীরা "অবাধে" নিজের গড়ে তোলা স্বাধীনতাবোধে থাকতে পারতেন।ফ্রান্সের কবি-লেখকদের মতন প্যারিসের লাতিন কোয়ার্টারে গিয়েছিল প্রদীপ, কোনও জাঁ দুভাল-এর সন্ধানে ; পায়নি । তার বদলে ওর চেয়ে দীর্ঘাঙ্গী দুজন যৌনকর্মী ওর টাকাকড়ি ছিনতাই করেছিল । তারপর ও লাতিন কোয়ার্টারে একা যেতো না ; ফরাসি বন্ধুদের সঙ্গে যেতো।কলকাতাতেও সোনাগাছিতে যেতো বাসুদেব দাশগুপ্ত আর শৈলেশ্বর ঘোষের সঙ্গে ; মীরা, বেবি আর দীপ্তি নামের বন্ধুনি-যৌনকর্মীদের ডেরায় ।
প্রদীপের স্কুলশিক্ষা ত্রিপুরাতেই হয়েছিল । তা শেষ হবার পর ওর বাবা ওকে শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে এনে ভর্তি করে দেন । উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে, প্রদীপ চৌধুরী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে, শান্তিনিকেতনে ইংরেজিতে স্নাতক ছাত্র হিসাবে যোগদান করে। সেখানে প্রদীপের কবিতা রচনার আগ্রহ দেখে ওকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পত্রিকা ‘সাহিত্যিকা’র সম্পাদক করা হয় । সেই পত্রিকায় ওর সহায়ক ছিলেন ক্ষিতীশচন্দ্র রায়ের মেয়ে শ্রীলা রায় । এই সময়েই হাংরি আন্দোলনের প্রথম বুলেটিনগুলো বিশ্বভারতীতে পৌঁছোনো আরম্ভ হয়েছিল আর প্রদীপ চৌধুরী আকৃষ্ট হয়েছিল হাংরি আন্দোলনে । বুলেটিনে দেয়া ঠিকানায় দেবী রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে কবিতা প্রকাশ করার আগ্রহ দেখায় । আমার সঙ্গে যখন প্রদীপের পরিচয় হয়, তখন ওর কথাবার্তায় কুমিল্লার অদ্ভুত রেশ বজায় ছিল । ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ইংরেজি বুলেটিনে আরও অনেকের সঙ্গে প্রদীপের নামও আছে, হাংরি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে ।
হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত কবিতার ধারা প্রদীপের পছন্দ হয়েছিল । শান্তিনিকেতন থেকে প্রদীপ ‘স্বকাল’ নামের একটা পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করে, যে পত্রিকাটির নাম কিছুদিন ছিল ‘স্বকাল/ফুঃ’ আর ত্রিভাষিক ( ফরাসি/ইংরেজি/বাংলা ) হবার পরে নামকরণ হয় pPhooo । শান্তিনিকেতনে ছাত্রাবাসে থাকার সময়ে প্রদীপের ইনফ্যাচুয়েশান আরম্ভ হয় ঠাকুর পরিবারের এক তরুণীর প্রতি । ‘স্বকাল/ফুঃ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কবিতায় তরুণীটির নাম থাকায় বিশ্বভারতী কতৃপক্ষ প্রদীপকে ডেকে ভর্ৎসনা করেন এবং ভবিষ্যতে অমন কবিতা লিখতে বারণ করেন । কিন্তু একতরফা প্রেমের ছোবলের বিষ থেকে গিয়েছিল ওর শরীরে । প্রদীপ লিখেছে, ‘শব্দের ফ্রেমে বাঁধানো ভালোবাসার নামই কবিতা।’ । সেই থেকে প্রদীপের কবিতা-ভাবনার কেন্দ্রে বাসা বেঁধেছে আত্মধ্বংসী ভালোবাসা। প্রদীপ লিখেছিল, ‘আমি এভাবেই/ সাদা কাগজে আমার যতিরেখাহীন/ ভালোবাসার কথা লিখে গেছি। জন্ম ও মৃত্যুর উপর অতিকায় দুই পা রেখে/ ভালোবাসা/ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে—/ মহাকাব্যের এই কি সূচনা?’ লিখেছিল, ‘হত্যা ও আত্মহত্যা উভয়েই ভালোবাসার সন্তান’। লিখেছিল, ‘তরল নিসর্গে ডুবে আছি ক্রূরতম প্রেমে।’ আর, ‘আমি রাইফেল হাতে সারারাত প্রেমিকার জন্যে অপেক্ষা করি।’ ইনফ্যাচুয়েশান এমনই মারাত্মক ব্যাপার যে প্রদীপ ‘স্বকাল’ পত্রিকার পরের সংখ্যাতেও তরুণীটির নাম উল্লেখ করে প্রণয় নিবেদন করেছিল । ব্যাস, কর্তৃপক্ষ প্রদীপকে এবার বিশ্বভারতী থেকে রাস্টিকেট করার নোটিস দিলো :-
নং. আই.ডি.পি/VII-১০/৬৩-১০ তারিখ ১৮ জুলাই ১৯৬৩
শ্রীপ্রদীপ চৌধুরী
আপনাকে সতর্ক করে দেওয়া সত্তেও এই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ থেকে আপনি বিরত হননি। কর্তৃপক্ষের নির্ণয় অনুযায়ী এই পরিসরে ছাত্র হিসাবে আপনার উপস্হতি কোনোমতেই কাম্য নয় । অতএব আজ দ্বিপ্রহরের পূর্বেই আপনাকে ছাত্রাবাস ত্যাগ করার আদেশ দেওয়া হচ্ছে এবং জানানো হচ্ছে যে যতো সত্বর সম্ভব আপনি আপনার ট্রান্সফার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে নিন ও সমস্ত বকেয়া চুকিয়ে দিন ।
কালিদাস ভট্টাচার্য পি.সি দাশগুপ্ত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত
অধ্যক্ষ বিদ্যাভবন প্রোকটর বিভাগীয় প্রধান
শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী ইংরেজি
বিশ্বভারতী প্রদীপের বাবাকেও চিঠি দিয়ে জানালো বিশ্বভারতী থেকে ওর বহিষ্কারের কথা :-
নং. সি.এস.এস VII-I/৬৩/৭৯ তারিখ ১৮ জুলাই ১৯৬৩
শ্রীপ্রমোদরঞ্জন চৌধুরী
প্রিয় মহাশয়
শ্রীমান প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর ।
কয়েক মাস পূর্বে ‘স্বকাল’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় সে জনাকয় ছাত্রীর নামোল্লেখ করে একটি অর্ধ-অশ্লীল কবিতা লেখে । প্রচ্ছদে জানানো হয় যে পত্রিকাটি বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন হতে প্রকাশিত । তাকে ডেকে সতর্ক করে দিয়ে জানানো হয় যে ভবিষ্যতে যেন কোনো সংখ্যায় বিশ্বভারতীর নাম না থাকে এবং অশ্লীল কবিতা বা রচনা প্রকাশিত না হয়, অন্যথা তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে ।
পরবর্তী সংখ্যায় কেবল যে বিশ্বভারতীর নাম ছিল তা নয়, সঙ্গে অত্যন্ত অশ্লীল একটি কবিতে দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই, যা একজন ছাত্রের কাছ থেকে আশা করা যায় না, যদি তার রুচি অত্যন্ত নোংরা না হয় । অতএব বিশ্বভারতীর ছাত্র হিসাবে তার উপস্হিতি সম্ভব নয় এমন একটি নির্ণয় নেওয়া হয় এবং তাকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে বলা হয় । আদেশের একটি কপি পাঠানো হল ।
শ্রীমান প্রদীপ চলে যাবার পর অ্যাকাউন্টস অফিসার জানিয়েছে যে ৪৫৫ টাকার বিশাল অঙ্ক সে বাকি রেখে গেছে।
কালিদাস ভট্টাচার্য
অধ্যক্ষ বিদ্যাভবন
শান্তিনিকেতন
শান্তিনিকেতন থেকে লাথি খাওয়াটা প্রদীপ চৌধুরীর জন্য জরুরি ছিল ; তার ফলে কবিতাকে আঁকড়ে বেঁচে থাকতে ও বাধ্য হলো । ও লিখেছিল, ‘একমাত্র ভালোবাসার শর্তহীন সংক্রমণই/ মানুষকে মানুষের মধ্যে ধরে রাখতে পারে।’ তারপর থেকে প্রদীপের কাছে, ‘উত্তেজনার পর সাবলীল রেতঃপাত/ এই আমার কবিতা।’ লাথি খেয়ে প্রদীপ বুঝতে পেরেছিল, ’ এই নিরন্তর, অবিরাম কামনা-প্রবাহে জীবনের মৌলিক গুণগুলি হারিয়ে যায়, প্রবল হয়ে ওঠে অর্থলিপ্সা, খাদ্যলিপ্সা ও ক্ষমতালিপ্সা। একমাত্র চূড়ান্ত সংকটের সময়ই মুখোশ আলগা হয়ে বেরিয়ে পড়ে প্রকৃত চেহারা। এই সংকটের সময়ই দরকার হয় প্রবল ঝাঁকুনির।’ লাথি খেয়ে ও বলতে পারলো, ‘আমার জীবন এক কারফিউ উৎসব।’ ও লিখতে পারলো, ‘কবিতাই আদিম ও আধুনিক মানুষের যাবতীয় জিজ্ঞাসা এবং অন্তর্ঘাতের, শিক্ষিত ও ভুল-শিক্ষিত মানুষের চেতনা ও অবচেতনার যাবতীয় সংঘাতলুপ্তির একমাত্র উপায়।’ লিখতে পারলো, ‘নতুনত্ব ব্যাপারটাই এক ধরনের নাশকতা, সুতরাং প্রকৃত প্রস্তাবে আমার কবিতা পুরোপুরিই বিধ্বংসী, অর্থাৎ মনুষ্যোচিত।’ লিখতে পারলো, ‘আমি বিশ্বাস করি আমার আত্মার প্রতি আমার ততটাই শ্রদ্ধা, যা না হলে এমন পাশবিক অবস্থায় আমার বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না।’
প্রদীপের বাবা শান্তিনিকেতনে পৌঁছে ৪৫৫ টাকার বিশাল অঙ্ক মিটিয়ে প্রদীপকে নিয়ে ফিরে গেলেন ত্রিপুরা। সেখানে কুলাই নামে এক গঞ্জের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন ওর বাবা ।বাবার সঙ্গে বাড়ি ফেরার দরুন সেখানকার কবি-লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ত্রিপুরাকেও হাংরি আন্দোলনে যুক্ত করেছিল প্রদীপ চৌধুরী। সেসময়ে ওর সম্পাদিত ‘স্বকাল’ সাহিত্যপত্র ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত হয়েও হয়ে উঠেছিল বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ত্রিপুরার যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে যে নামগুলো আমার মনে আছে তা হলো অজিতকুমার ভৌমিক, অরুণ বণিক, শঙ্খপল্লব আদিত্য, সেলিম মুস্তাফা, রসরাজ নাথ, রত্নময় দে, প্রণব দেবনাথ, সুজিত দেব প্রমুখ । ১৯৮০ সালে ত্রিভাষিক হবার পর pPhooo পত্রিকায় এই কবিদের আর দেখা মেলেনি বটে কিন্তু ওনারা নিজেরাই “অনার্য” নামে হাংরি পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করেন । ত্রিপুরার হাংরি আন্দোলনের অন্যতম কবি সেলিম মুস্তাফা লিখেছেন, ‘প্রদীপ চৌধুরীর “কবিতাধর্ম” নামে একটি অসাধারণ ব্যক্তিগত গদ্য রয়েছে, যাতে কবিতা সম্পর্কে কোন তথাকথিত বক্তব্য নেই, বরং এমন কিছু আছে যা একজন কবিকে দাঁড় করিয়ে দেয় তার নিজেরই মুখোমুখি, এবং জ্বলে উঠতে পারে নিজের ভেতর নতুন একটি প্রদীপ-শিখা ! কিন্তু গদ্যটি এখানে টাইপ করে দেয়া সম্ভব নয় । আজ একটি কবিতা দিচ্ছি ।’
নাগরিক উপকথা
শহরের ব্যস্ত স্কোয়ারে এখন ভীড় করেছে
আমাদের প্রিয় লোকজন, কে একজন
দুই হাত উপরে তুলে মুঠো মুঠো আগুন
কার মুখের উপর ছুঁড়ে দিচ্ছে
আর তার ১ ফুট দূরে কামানের গোলার মতো
চোখ বড় করে আরেকজন, সরাসরি
সিনেমা পোস্টারের দিকে তাকিয়ে আছে ।
এসো, আমরা সেখানে গিয়ে দাঁড়াই !
একজন যুবক আমার কাছে হঠাৎ চেয়ে নেয়
দেশলাই ! সিগ্রেট না জ্বেলে
সে হঠাৎ ছুটে যায়, কিছু দূরে
বিশাল বাড়ির সামনে; পকেট থেকে
বোতল বের করে যুবক সারা গায়ে
ছড়িয়ে দেয় পেট্রোল
মাত্র একটি কাঠি প্রস্তুত শ্রেণীর মত,
দপ্ করে জ্বলে ওঠে চোখ,
চারদিকে বাঁধভাঙা পাখির সঙ্গীত—
স্বাধীনতা, এসো তার পুড়ে যাওয়া দেখি !
মিথ্যা নিয়মের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাবা
কাউকে রেহাই দেয় না, তাই তো বালিকা
কেবল একবার হারিয়ে যাওয়া অপরাধে
আর ফিরে যেতে পারেনি মনিহারি-
মেলা থেকে আলের ধারের ঘরে,
মই লাগিয়ে একদিন আব্রুহীন রাস্তা থেকে তাকে
উঠিয়ে দেয়া হয় গম্বুজনগরে;
সেখান থেকে রোজ সন্ধ্যায় চুঁইয়ে পড়ে
বীর্য ও আতরের গন্ধ— এসো,
নতমুখে কাঁপতে কাঁপতে আমরা
অপেক্ষা করি, কাঁদি ।
এই ধারাবাহিকতা একদিন খোলসের মতো
সকলের শরীর থেকে খসে পড়বে
যেদিন লালাভেজা জড়িয়ে থাকা
শরীর থেকে তুমি ছাড়িয়ে নেবে নিজেকে
আর আমাদের সম্মিলিত উত্তাপ
ছিঁড়ে কুটি কুটি টাইফুন মেঘের মতো
নিজেকে আছড়ে দেবে ১ জন কবির কাছে
তুমিই কবিতা, তুমি কাছে এসো !
পূর্ব গোলার্ধের সবাইর সঙ্গে আমরাও
দেখব একদিন অস্তগামী সূর্য
গলিত সোনার মতো শরীর বিছিয়ে দিয়েছে
শহরের আর গ্রামের
গ্রামের আর শহরের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে
আর তখুনি পিঠভর্তি চুল এলিয়ে
গম্বুজ থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে
আমাদের বোন;
তার মুখে গর্বিত ও অর্থপূর্ণ হাসি ।
তিন
কলকাতায় কলেজে ভর্তি করার উদ্দেশে ওর বাবা ওকে পাণ্হনিবাস নামে একটা মেসে রেখে দেখা করেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে । প্রমোদরঞ্জন চৌধুরী চাইছিলেন প্রদীপ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোক আর রাসটিকেশনের বদনাম কাটিয়ে উঠুক । কিন্তু প্রদীপের জীবন-পরিস্হিতি ও পরিবেশ ওকে গড়ে তুলছিল হাংরি আন্দোলনের একজন উল্লেখ্য কবি হিসেবে । কলকাতায় বসবাসের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রদীপ চৌধুরী লিখেছে, ‘কলকাতা যেন এক বিরাট আতঙ্কের কারখানা, একটি অর্ধসমাপ্ত গ্রাম, ধর্মে ও যৌনমিলনে সমান আতঙ্ক, আমার চারদিকে উদ্ধারহীন ভিড়, যন্ত্রচালিত যানবাহন, ব্যাধিলিপ্ত মানুষের মুখ–-ধ্বংস বলব একে? একে সৌন্দর্য বলব?’ লিখেছে, ‘আমার চারপাশে যা ঘটে চলেছে তাকে মুখোশধারী পুরুষ বা স্ত্রীলোকের বিরক্তিকর একঘেয়ে প্রদর্শনী ছাড়া কিছু মনে হয় না’।কলকাতায়, প্রদীপ টের পেলো, ‘অর্থ, ক্ষমতা আর যৌনতা শাসিত আমাদের এই সভ্যতায় অনুভূতিপ্রবণ মানুষ সবসময়েই নিজেকে এক বিকট কালো গর্তে নিক্ষিপ্ত বলে অনুভব করে, যা থেকে বহির্গমনের কোনও পথ নেই।’ আর, ‘দিন রাত একটার পর একটা অসুখ হাতবদল হয়ে যাচ্ছে, বুলেটের মতো একের পর এক মানুষের কপালে গিয়ে ধাক্কা মারছে জীবাণু, ভয়াবহতার মধ্যে লিপ্ত থাকতে থাকতে কুস্বপ্নকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিচ্ছি আমরা।’
পান্হনিবাসে থাকতে ও ভার নিয়েছিল একটা হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করার, কেননা সেসময়ে হাংরি জেনারেশন শুনলে প্রেসগুলো ছাপতে চাইতো না । সংবাদপত্র আর সান্ধ্য কাগজগুলোতে আমাদের নিয়ে নানারকম গল্প ছাপা হচ্ছিল । আমার লেখা রাজনীতি বিষয়ক বুলেটিনের বিষয়বস্তু নিয়ে যুগান্তরে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন কৃষ্ণ ধর। আনন্দবাজার, স্টেটসম্যান, জনতা, দর্পণ ইত্যাদি পত্রিকায় কার্টুন ছাপা হয়েছিল আমার আর দেবী রায়ের। বুলেটিন ছাপাবার খরচ চিরকাল আমিই দিতুম ; অনেকসময়ে দাদা দিতো । এই বুলেটিনেই আমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা ছিল । কলকাতা পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইশ্যু করলো । খবর শুনে প্রদীপ চৌধুরী আর সুবো আচার্য পালিয়ে গিয়েছিল ত্রিপুরার কুলাইতে । সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলো । শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার বিরুদ্ধে বয়ান আর মুচলেকা দিয়ে সরকারি সাক্ষী হতে রাজি হলেন । প্রদীপ কখনও এই সরকারী সাক্ষীদের ঘটনাটা উল্লেখ করতো না । চেপে যেতো । প্রদীপকেও পুলিশ ত্রিপুরায় গিয়ে পাকড়াও করে কলকাতায় নিয়ে এলো । প্রদীপও ছাড়া পেয়ে গেল । প্রদীপকে গ্রেপ্তারের জন্য কলকাতার পুলিশ এসেছে খবর পেয়ে সুবো আচার্য ত্রিপুরার একটা গ্রামে গিয়ে লুকিয়েছিল । সকলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ আর লেখায় ‘অশ্লীলতা” । আমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাকে নিম্ন আদালত অশ্লীল ঘোষণা করেছিল । কবিতা ও কবি উভয়ের সাহিত্যের স্বাধীনতার সত্যিকারের মশাল বহনকারী প্রদীপ বলেছিল: “অশ্লীলতা? কেউ অশ্লীল কিছু বলার সাথে সাথে তার অন্তর্ জগতে অশ্লীলতার অস্তিত্ব প্রকাশিত হয়। ‘এ্যাসেস্ট পার্সিপি’ - ব্রিটিশ দার্শনিক বার্কলে-র এই তত্ত্বের কোনও বক্তব্য যদি বিশ্বাস করা হয়, তবে এটি স্পষ্ট যে আজও যে লোকেরা সাহিত্যে অশ্লীলতার ছোঁয়া পায় তারা হ'ল এমন লোক যাদের জীবনের অশ্লীলতার জন্য নিন্দা করা দরকার। ”
ক্রিমিনালরা তাদের অপরাধের জায়গাটা আরেকবার দেখতে যায় বলে প্রবাদ । প্রদীপও গিয়েছিল দেখতে পান্হনিবাস মেস । ও লিখেছে, “আমি প্রায় পাঁচ দশক পরে সেখানে গিয়েছিলাম। রাস্তার পাশের অন্যান্য সমস্ত বিল্ডিং ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং নতুন-নতুন বাড়ি উঠে এসেছে, তবে হোটেলটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সেটা অন্ধকার এবং উদ্ভট। সুবো এবং আমার ছাদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটা ঘর ছিল। সমস্ত গোষ্ঠীর কবিরা সেখানে আসতেন । হ্যাঁ, হাংরিদের বলা যায় "স্বর্গোদ্যানের ভবঘুরে"। ইউরোপীয়রা আমাকে "বর্বর আত্মা" বলত। আমাদের আর কীই করা উচিত ছিল? আমাদের ভাগ্য এইভাবে পূর্ব নির্ধারিত ছিল । ব্যাপারটাকে একাডেমিক এবং স্ব-পরিবেশন করা মধ্যবিত্ত মানগুলির বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ বলতে পারা যায়।” প্রদীপ মাঝে-মাঝে শান্তিনিকেতনে যেতো । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখতো এখন ছাত্র আর ছাত্রীরা পরস্পরের সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ ; প্রেম করে, যৌন সম্পর্ক করে, প্রায় সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন ।
ছাড়া পাবার পর প্রদীপের বাবা ওকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিলেন ।বিশ্বভারতীতে প্রদীপের এক শিক্ষক, কেনেথ এস উডরফ, যিনি ইংরেজি বিভাগের ভিজিটিঙ প্রফেসর ছিলেন, এই বহিষ্কারে অসন্তুষ্ট হন। তিনি ছিলেন কবিতার দুর্দান্ত প্রেমিক এবং আমেরিকান কবি কেনেথ প্যাচেনের বন্ধু। অধ্যাপক উডরফ প্রদীপদের মিল্টন পড়াতেন। ওকে বহিষ্কার করার পরে, উডরফ কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ইংরেজী বিভাগের দায়িত্বে থাকা শেকসপীয়ার বিষয়ে খ্যাত অধ্যাপক সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্তের কাছে একটি দীর্ঘ সুপারিশপত্র লিখেছিলেন, যা প্রদীপকে স্নাতকোত্তর ছাত্র হিসাবে ভর্তি হতে সাহায্য করেছিল। সেখানে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর হবার পর প্রদীপ হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা শিখতে গেল । তুলনামূলক সাহিত্য কেন পড়লেন না, এই প্রশ্নে উত্তরণ দাশগুপ্তকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রদীপ বলেছে, বুদ্ধদেব বসু, যিনি নিজে একজন অগ্রণী কবি এবং বাংলা সাহিত্যের কল্লোল আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব, চেয়েছিলেন যে প্রদীপ যেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে যোগদান করে। উনি বোদলেয়ার, হোল্ডারলিন এবং রিল্কে অনুবাদ করেছিলেন এবং, আধুনিক বাংলা কবিতার বিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছিলেন, কিন্তু, ইংরেজী বিভাগ দৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়িয়েছিল এবং এটি খুব বিখ্যাতও ছিল। এছাড়াও, বুদ্ধদেব বসু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেন সেই বছর। মনে হয়েছিল তিনি চলে গেলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কবিতা থাকবে না। অন্যদিকে, ডাঃ সেনগুপ্ত জোর দিয়েছিলেন যে ইংরেজী বিভাগ বিশিষ্ট পণ্ডিত এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সাথে যুক্ত। তাই আমি ইংরাজিকে বেছে নিয়েছিলাম ।”
বিশ্বভারতী থেকে যাদবপুরে গিয়ে সেখানকার ছাত্রসংস্কৃতি অবাক করেছিল প্রদীপকে । ও জানিয়েছে, “যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বেশ অদ্ভুত ছিল। আমি শান্তিনিকেতনে অনেক বেশি মুক্ত সম্পর্কে অভ্যস্ত ছিলুম। আমি যখন ‘সাহিত্যিকা’ পত্রিকার সচিব ছিলুম তখন আমার সহকারী সচিব ছিলেন একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত সচিব ক্ষিতীশ রায়ের কন্যা শ্রীলা রায়। শ্রীলা আর ওর বড় বোন রুচিরার সাথে আমার খুব ভাল বন্ধুত্ব ছিল। অন্যান্য কয়েকজন তরুণীর সাথেও আমার অন্তরঙ্গতা ছিল। যাদবপুরে ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন। যাদবপুরে দেখলুম, আমার ক্লাসের ছাত্ররা মেয়েদের সাথে একসাথে বসে না। ক্লাস শেষ হওয়ার সাথে-সাথেই ছেলেরা বাইরে গিয়ে পরের ক্লাস শুরু না হওয়া পর্যন্ত বারান্দায় অপেক্ষা করত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ ভবনের প্রথম তলায় ইংরেজি এবং তুলনামূলক সাহিত্যের বিভাগগুলির মধ্যে একটি সাধারণ শৌচাগার রয়েছে। সুবো আচার্যের সাথে আমার সেখানে পরিচয় হয়েছিল । ও বলেছিল: “আমি একটা কবিতা লিখেছি যা প্রত্যেকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আপনি কি এটা প্রকাশ করবেন? " আমি বলেছিলুম: "হ্যাঁ, আমি নিশ্চয়ই প্রকাশ করব।" ঘটনাটা ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে ছিল। একই দিন সুবো এবং তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে গেলাম। আমরা সরাসরি ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে, যৌনকর্মীদের এলাকার মধ্যে একটি বাড়িতে, গিয়েছিলুম। তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের সুবো আচার্যকে শিক্ষকরা বলেছিলেন যে ও যদি পড়াশুনায় মনোনিবেশ করে তবে তাঁরা নিশ্চিত যে সুবো বিদেশে যাবে। তবে তা কখনই হয়নি।” হাংরি মামলার পর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সেই যে বাঁকুড়ার জাজপুর গ্রামে নিজের বাড়ি চলে গেল তারপর আর কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।সুবো আচার্য যোগ দিল অনুকুল ঠাকুরের আশ্রমে এবং ঋত্বিক হয়ে আশ্রম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল।
ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা পড়তে গিয়ে বেশ কয়েকজন ভারতীয় কবির সঙ্গে প্রদীপের পরিচয় হয়েছিল । দক্ষিণ ভারতের বহু নামকরা কবি আর দলগুলির সাথে দেখা করেছিল, যাদের কেউ-কেউ পরবর্তীতে অন্ধ্র প্রদেশের বিপ্লবী লেখক সমিতিতে যোগদান করেছিলেন যেমন দিগম্বর কাভালুর কবি নিখিলেশ্বর ও ভারভরা রাও । ইংরেজি নতুন তরঙ্গ লেখকদের সাথে সাক্ষাত ঘটেছিল প্রদীপের । তার মধ্যে উল্লেখ্য আওরঙ্গাবাদের সুকৃত পলকুমার, চেন্নাইয়ের আর এস রামচন্দ্রন, লখনউয়ের খালিদ কাদরী এবং ব্যাঙ্গালোরের বীণা ইয়েলবার্গী। এঁদের থেকেই, মনে হয়, প্রদীপ ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় কবিতা লেখার উৎসাহ পেয়েছিল । ‘স্বকাল’ নামটা বর্জন করে পত্রিকার নাম রাখে ‘ফুঃ । ত্রিভাষিক হবার কারণে পত্রিকার নামকরণ করে ইংরেজি বা ফরাসিতে pPhooo.
পত্রিকাটা ত্রিভাষিক ( বাংলা/ইংরেজি/ফরাসি) হবার পরে প্রদীপ তাতে ব্রায়ন জিসিন, ক্লদ পেলিউ, জেফ নটল, কার্ল ওয়েইসনার, হ্যারল্ড নর্স, চার্লস প্লাইমেল, এড স্যান্ডার্স, নরম্যান সহ বেশ কয়েকটি বিট / কাউন্টার-কালচার কাট-আপ কবি-লেখকদের প্রকাশ করেছিল। অন্যদের মধ্যে ছিল ওগ মুস্তিল এবং চার্লস বুকোভস্কি। বাংলা অক্ষরে নিজেদের কবিতার অনুবাদ দেখে বিদেশি কবিরা নিশ্চয়ই আহ্লাদিত হতেন । প্রদীপ চৌধুরীও ডাক পেতো বিদেশে যাবার আর থাকা-খাওয়ার খরচ সংগ্রহের । ফ্রান্সে বাংলা কবিতা সম্পর্কে বক্তৃতা আর সাক্ষাৎকার দিয়ে ইউরোপের অন্যত্র ঘোরাঘুরির খরচ জোগাড় করে ফেলতে পারতো । কলকাতায় একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়িয়ে আর টিউশানি করে যা রোজগার হতো তা তো সংসার খরচ আর পত্রিকা প্রকাশ ও বিদেশে পাঠানোয় খরচ হয়ে যেতো । pPhooo পত্রিকার ফরাসি লেখক হ্যারি রুডলফ উলকেনস প্রথম আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রদীপকে, আর যাওয়া-আসা-থাকার খরচ দিয়েছিলেন । তাঁর ব্যালেরিনা স্ত্রী প্রদীপের ‘গ্রহণ’ কবিতা কোরিয়োগ্রাফ করে ইউরোপের নানা জায়গায় প্রদর্শন করেছিলেন । তারপর কোনও মেয়র আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকে ‘পোয়েট ইন রেসিডেন্স’ হয়ে প্রায়ই ইউরোপ গিয়েছিল ।
চার
ফরাসি ভাষার কবি হতে চাইছিল বলে হাংরি আন্দোলনের খ্যাতি-কুখ্যাতির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার মনে হয়েছিল প্রদীপের, আর তাই ও “হাংরি জেনারেশনের মৃত্যু” ঘোষণা করে লালকালিতে বুলেটিন ছাপিয়ে লিখেছিল, “আমি কোন জেনারেশনের নই ...আধুনিক পৃথিবী এবং পৃথিবীর যাবতীয় জেনারেশন- প্রকৃতপক্ষে অধঃপতিত নষ্ট সর্বহারা ভীরু উন্মাদ নির্বাক চোর অন্ধ সন্ন্যাসী কমরেড অভিযাত্রী নষ্টদেহ গলিত অন্তকরণহীন যক্ষাক্রান্ত শুধুই-লাশ স্থাবর অস্থাবর প্রানীজগতের সকলের শিরা উপশিরার চেতন-অচেতন অবসেসড আত্মার এক অলৌকিক সামগ্রিকতার আমি এক খুবই ছোট অথবা অতিশয় বিশাল প্রতিবিম্ব মাত্র।আমি পাগল প্রতিভাবান দুটোর কোনোটাই নই,কারণ এই শব্দগুলির অর্থ আজো আমার কাছে পরিষ্কার নয়,যেরকম পরিষ্কার নয় ঈশ্বর শয়তান কবিতা পাপ সতত আদর্শ চেহারা বর্ণমালা এবং মানুষের কনসেপ্ট-অথবা এগুলি আমার কাছে আউটডেটেড হয়ে গেছে।আলাদা আলাদা ভাবে যে কোনো শব্দই অর্থহীন”।
হাংরি জেনারেশনের মৃত্যু ঘোষণা করে প্রদীপ লিখেছিল, “ সামন্ত সভ্যতার রমরমা দিনে কবিতার ‘পবিত্রতা’ অক্ষত রাখতে আমরা যারা একত্রিত হয়েছিলাম এবং আক্রমণ করেছিলাম ইমারত সভ্যতা ও কালোটাকার বিকার থেকে জাত বাবুকালচার ও বাবু সাহিত্যকে ,জীবনের বিশাল থাপ্পড় তাদের কাকে কোথায় ছিটকে দিয়েছে, তাদের কে কোথায় কিভাবে বেঁচে আছেন আমি জানিনা। শুধু জানি আমরা ছিলাম তাই কার্ফ্যু জারি করেও ওরা প্রত্যুষ ঢেকে দিতে পারেনি। ...কখনো হয়ত দেখা হবে একই বইয়ের দুই মলাটের ভিতর,বন্ধু বন্ধুর পাশে,পূর্ণ মানুষ পূর্ণ মানুষের সঙ্গে,রেস্তোঁরায় চা –কফি খাওয়া হবে, কিন্তু তা হাংরি হিসেবে নয়... অথবা একই আকাশের নিচে, গণমিছিলে, ৮০ কোটি , ৮০,০০০ কোটি মানুষের সংগে ,সকলের সমষ্টিগত শব্দের সিম্ফনি যখন অন্য গ্রহকে অনুপ্রাণিত করবে, সেই তো আমার সম্পূর্ণতা।... প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হবার আগেই আমি হাংরি জেনেরাশনের মৃত্যু ঘোষণা করি“।
‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ গ্রন্হের লেখিকা মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরীকে মাইকেল লিমিনাস একটি সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি কি হাংরি আন্দোলনকে একটি নির্দিষ্ট সাহিত্য ও শৈল্পিক আন্দোলন হিসাবে বিবেচনা করেন নাকি আপনি মনে করেন এটি ব্যক্তি-কবির মনের অবস্থা থেকে উৎসারিত?” উত্তরে মৈত্রেয়ী বলেছিলেন, “আমি মনে করি ওদের আন্দোলনে দুটিই উপস্হিত। বিটদের চেয়েও বেশি, হাংরি আন্দোলনকারীরা তাদের পরিস্থিতি ও পরিবেশের ফসল ছিল। ওদের কাজগুলোয় বেশ কয়েকটি প্রশ্নের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় যা একইসাথে মোকাবেলা করা প্রয়োজন মনে করেছিল ওরা। ওদের মানসিক স্হিতি ওদের শৈল্পিক উৎসারণের দিকে পরিচালিত করেছে, যার ফলস্বরূপ আন্দোলন নিজেই একটা গতি পেয়ে গিয়েছিল।” বইটি লেখার সময়ে প্রদীপের সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেছিলেন মৈত্রেয়ী, এবং ওনার বক্তব্যে প্রদীপের অস্তিত্বের বয়ানের খোলোশা হয় । সোনাগাছি যাওয়া আরম্ভ করে প্রদীপ লিখেছিল, ‘নপুংসক ও গণিকাপল্লীতে ওৎ পেতে আছে সাকার ঈশ্বর, মুণ্ডহীন ভালোবাসা, কেউ কাউকে সুপ্রভাত জানাচ্ছে না।’ লিখেছিল, ‘উন্মাদ পথিক তুমি কোন জন্মান্তরের প্রেত খুঁজে বেড়াও/ যার মুখোমুখি হতে তুমি বদ্ধপরিকর।’ ‘আমি পৃথিবীর অদ্ভুত দৃষ্টিহীনতায় অবাক হয়ে যাই।’
প্রদীপের মৃত্যুর পর ওর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ইংরেজি ভাষার কবি শ্রীমন্তী সেনগুপ্ত লিখেছেন, “আমেরিকার বিট প্রজন্মের গ্রন্হগুলোর প্রথম প্রকাশক ও কবি লরেন্স ফের্লিংহেট্টি প্রদীপ চৌধুরী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ওনার কবিতা প্রমাণ করে যে কবিতা এখনও আমাদের স্বপ্ন তৈরির কাম্যযন্ত্র, আমাদের কাছে তা একটি ক্ষুধার্ত প্রাণী, যা আমাদের সকলকে গ্রাস করে।’ শ্রীমন্তী লিখেছেন, “প্রদীপ, সম্ভবত, আমেরিকা এবং ইউরোপ জুড়ে কাউন্টার-কালচার আন্দোলনের সাথে বাংলা এবং ভারতের অন্যতম নির্ভরযোগ্য সংযোগ ছিলেন। তাঁর আজীবন বন্ধু, ফরাসি কবি এবং সহযোগী ব্রুনো সৌরদাঁ তাকে ‘বাংলার পবিত্র আগুন’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। প্রদীপ চিঠিপত্র আদান-প্রদান বজায় রেখেছিলেন । তিনি অ্যালেন গিন্সবার্গ, কার্ল ওয়েইজনার, ক্লদ পেলেইউ, কবিরাজ জর্জ ডাউডেন, লরেন্স ফের্লিংহেট্টি, চার্লস বুকোভস্কি এবং অন্যান্যদের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব লালন করেছিলেন। তাঁর ত্রিভাষিক সাহিতিক প্রকাশনা pPhooo ষাটের দশকের প্রতিষ্ঠানবিরোধী চিন্তাবিদদের এবং শিল্পীদের জন্য একটি সাধারণ ভিত্তি গড়েছিল এবং দেশে ও বিদেশে তুলনামূলকভাবে সম্মানিত হয়েছিল পত্রিকাটি ।”
রমিত দে প্রদীপ চৌধুরী সম্পর্কে লিখেছেন , “প্রদীপ চৌধুরীকে চিহ্নিত করতে গেলে আমাদের ফিরে ফিরে আসতে হবে এমনই এক আবহাওয়ায় যেখানে তিনি একটি জেনেরাশনের অন্যতম কান্ডারী আবার সেখানেই নিজের হাতে সেই জেনেরাশনের মৃত্যুও ঘোষনা করছেন তিনি-এ যেন শিল্প পেরোনো এক শিল্পী, যেন কবিতার দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো সেই পরবাসী পর্যটকটি যিনি শব্দের নগ্ন থেকে নগ্নতরের কাছে নতজানু হতে চাইছেন ,ফিরে ফিরে আসছেন শিল্পের অস্থির শৃঙ্গারগুলির কাছে,সুগন্ধ দংশনগুলির কাছে।কবি মাত্রই কুড়ানি, প্রত্যক্ষতায় বৃদ্ধি পেতে পেতে স্বেচ্ছাচারে পূর্ণ করে তোলেন তাঁর কবিতাযাপন।সেখানে তিনি তাঁর নিজস্ব স্বকীয়তাকেই বারবার চেতনার ক্ষুধা তেষ্টায় নবীকরন করতে থাকেন।সময়হীন গুহার ভেতর রেখে দিয়ে যান নিজেরই কবন্ধ শরীর আর কোলাহলপূর্ণ ছায়া।আর জীবনের দৃঢ়অর্গল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রদীপ চৌধুরী এমনই এক কবি এমনই এক সর্বহারা ,কবিতা ছাড়া যার চূড়ান্ত বলে কিছু নেই,কবিতাকেই তিনি করেছেন ‘আলটিমেট সিন্থেসিস’।কবিতার সর্বগ্রসী চক্রব্যুহ থেকে সংস্কার থেকে সচরাচর আমাদের পৌঁছতে দেরী হয়ে যায় যে অনুনভব একটা জাগরনের কাছে সেখানেই মাঝেসাঝে প্রদীপ চৌধুরীর মত মূল্যবোধ বিতরনী সভায় জামা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসা কিছু কবিকে পেয়ে যাই আমরা।প্রতিমূর্হতে কবিতা যার কাছে একটা আন্দোলন ,সন্ধি মূর্হতেও সিঁড়ি ভাঙ্গার মূর্হুতেও যিনি কবিতায় খুঁজে চলেছেন “জীবন থেকে জীবনের যাবার বাকী ইতিহাস”।
প্রদীপের বিখ্যাত কবিতাগুলোর মধ্যে উল্লেখয় হলো “চর্মরোগ” কাব্যগ্রন্হের প্রথম কবিতা ; পড়া যাক সেটা:
মৃত-ক্যাকটাস এবং পোড়া বালির ওপর আমার বিছানা পাতা রয়েছে, লোমশ এবং কর্কশ বিছানার ওপর আমার চোখ আমার মুখের ভেতর বিস্ফারিত,আমার চারদিকে শরীরময় গরম নিশ্বাস,যৌনউত্তেজনার ব্যথা,অসহ্য গুমোট এক ধরনের আরাম,আমাকে এখুনি কিছু হারাতে হবে,অথবা পেতে,একহাজার রঙীন বেলুন ফেটে পড়ে,আমার নাভিতে এই অস্বস্তি,সমুদ্রের নীচে আগুনের মতো টকটকে ফুটে আছে কি সব গাছের আগায় ।
নীল পৃথিবীর উপর এভাবে মাঝে মাঝে আমার বিমূঢ় চলাফেরা আমার শীর্ণ ঠ্যাং ঢেউয়ের দিকে ফিরে ছটফটিয়ে ছিঁড়ে যেতে চায়।শরীর থেকে আলাদা হয়ে,মেয়েদের ঘাড়ে দাঁত ফুটিয়ে আমি কোন শান্তি পাচ্ছিনা,ঘুমুচ্ছি,জড়িয়ে ধরছি পাথরের মতো মসৃণ পাছা,একেবারে ফ্রেসকোর মতো চুপচাপ অবস্থার মধ্যে মিউজিয়মে তলিয়ে থাকতে পারি।আশ্চর্য !
আমি আমার সব অসম্পূর্ণতার কথা বুঝতে পারি, গলির ভেতর এই নামহীন কোলাহল,সমস্ত চাপ আমার শরীরে ভর করেছে,প্রত্যেক দেয়ালে নিস্তেজ চুন-সুড়কি,আমার চোখের সামনেই এই পতন ঘটে গেল, আমি জানতাম নির্সগের ভেতর দাঁড়িঁয়ে থাকতে থাকতে কি পাশবিকভাবে আমি পাৎলুন ছিঁড়্রে ফেলতে চেয়েছি,আমি আমার ঘিলু বদল করতে চাই, কিংবা উপড়ে ফেলতে ,পশু-পাখী,পাখীর ডিম ও আগুনের হল্কার উপর আমার এই নির্বিকার প্রভূত্ব,বেকার বেকার ---
লোমকূপ ছিঁড়ে শিশ দিতে দিতে আমার সর্বশরীর কেঁপে উঠছে, প্রতিটি লোমহীন গর্ত,আলাদা আলাদা আমার নাভি ও আমা লিঙ্গ,আমার উরু আমার বয়স,আমার ডায়েরী,আমার নাড়িনক্ষত্র,আমার বয়স,আমার নার্ভাসনেস,আমার হাতকড়া, নভালজিন।আমার স্বার্থপরতা ও সততা,গুজবসঞ্চিত মা-বাবা,ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছে, সমুদ্রের পেটের ভেতর আমি পাখিদের গোঙানি শুনতে পাচ্ছি, ৫ ই ফেব্রুয়ারী তার যবতীয় আবির্ভাব মুছে ফেলছে রোমান ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ।
পাঁচ
প্রদীপ চৌধুরীর মৃত্যুতে রাজা সরকার এই কথাগুলো লিখেছেন । বোঝা যায় যে প্রদীপ কতোটা প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন উত্তরবঙ্গে পরের প্রজন্মের কবি ও লেখকদের । ত্রিপুরার মতন উত্তরবঙ্গেও প্রদীপ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন হাংরি আন্দোলন ।
১৯৭৭-৭৮ সাল। লেখালেখির শুরুতে আমরা কতিপয় যুবক তখন এই রাজ্যের এক প্রান্তিক শহরের বাসিন্দা। শহরটির নাম শিলিগুড়ি। চোখের সামনে তখন লেখালেখি বলতে ছিল এক শ্রেণীর বৈঠকি সময়ক্ষেপণের নামে সাহিত্য চর্চা। তবু মাঝেমধ্যে হাতে যে দুই একখান ভালো বাংলা বই বা পত্রিকা আসতো না তা নয়---আসতো। গোগ্রাসে গিলতামও সে সব। কিন্তু খিদের উপশম হতো না তাতে। বরং অস্থিরতা বেড়েই চলে। সময় গড়ায়। গড়িয়ে গড়িয়ে আশির দশকের শুরুতে এসে আমরা নোঙর তুলে নিই। অপ্রতুল যোগাযোগের মধ্যেও একটা আপ্রাণ চেষ্টা জারি রাখি। ঘটনাক্রমে এই সময় একটি ঠিকানা আসে হাতে। ঠিকানাটি প্রদীপ চৌধুরীর। আগরতলার। ওই সময় উনি আগরতলাতেই থাকতেন। চিঠি লিখি । উত্তর পাই। ঘটে বিস্তারিত যোগাযোগ। আমাদের বইপত্রের আবদার মেটাতে তিনি একসময় কিছু বইপত্র পাঠিয়ে দেন কোচবিহারের অরুণেশ ঘোষের কাছে এবং আমাদের সংগ্রহ করে নিতে বলেন। চেনা লেখাজগতের বাইরের সব লেখাপত্র পত্রিকা ও বই। সেই সব বই গেলা খুব সহজ হলো না। মাথা বোঝাই হয়ে গেলো দ্বিধা দ্বন্দ্বে প্রশ্নে সংশয়ে। আজ বলা বাহুল্য সেই সব বই ছিল ক্ষুধার্ত প্রজন্মের বই পত্র পত্রিকা। তারমধ্যে কবিতার বই প্রদীপ চৌধুরির' অন্যান্য তৎপরতা ও আমি', 'চর্মরোগ,' ৬৪ ভূতের খেয়া' । শৈলেশ্বর ঘোষের ' জন্ম নিয়ন্ত্রণ', 'অপরাধীদের প্রতি'। গদ্যের বই সুভাষ ঘোষের 'আমার চাবি' ও যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট'। প্রদীপ চৌধুরী সঙ্গে আমার পত্রালাপ জারি থাকে। সেই সব পত্রালাপও কম উদ্দীপনাময় ছিল না। তাঁর পাঠানো বই পত্রিকা সংগ্রহের সূত্রে ১৯৮০ সনেই আমার পরিচয় ঘটে কোচবিহারের অরুণেশ ঘোষের সঙ্গে। হাতে পাই তাঁর কবিতা গ্রন্থ 'শব ও সন্ন্যাসী'। তারপরের এক দুই বছরের মধ্যে আমরা পেতে থাকব বাসুদেবের গল্পগ্রন্থ 'রন্ধনশালা' ও ফালগুনি রায়ের কবিতা গ্রন্থ 'নষ্ট আত্মার টেলিভিশন' । প্রতিটি বইই আমাদের জন্য কিছু না কিছু বদ্ধ দরজা খোলার সহায়ক হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে এরপর সেই সব কতিপয় প্রান্তিক যুবকের ভাবনা বিশ্বটি একটা বিপজ্জনক কৌণিক গতিপথ ধরে ধাবিত হতে শুরু করেছিল। আর এর সূচিমুখটি তৈরি করে দিয়েছিলেন এক আত্মস্থ কবিতাপ্রাণ মানুষ প্রদীপ চৌধুরী।
উত্তরবঙ্গে হাংরি জেনারেশনের প্রসার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, হাংরি পত্রিকা ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ এর সম্পাদক অলোক গোস্বামী তাঁর রচনা ‘মেমরি লোকাল’-এ এই কথাগুলো লিখেছিলেন, তা থেকে হাংরিদের মধ্যে অবনিবনার যৎসামান্য আইডিয়া হবে, আর এই অবনিবনার সঙ্গে পরাবাস্তববাদীদের নিজেদের অবনিবনার যথেষ্ট মিল আছে :-
“নব্বুই দশকে সদ্য প্রকাশিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বগলে নিয়ে এক ঠা ঠা দুপুরে আমি হাজির হয়েছিলাম শৈলেশ্বরের বাড়ির গেটে। একা। ইচ্ছে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি বসে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবো। যেহেতু স্মরণে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি তাই আস্থা ছিল শৈলেশ্বরের প্রজ্ঞা,ব্যক্তিত্ব,যুক্তিবোধ তথা ভদ্রতাবোধের ওপর। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শৈলেশ্বর আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন এবং যৌথ আলোচনাই পারবে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নতুন উদ্যমে একসাথে পথ চলা শুরু করতে। কিন্তু দুভার্গ্যবশতঃ তেমন কিছু ঘটলো না। বেল বাজাতেই গেটের ওপারে শৈলেশ্বর। আমাকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন।
--কী চাই!
মিনমিন করে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলবো।
--কে আপনি?
এক এবং দুই নম্বর প্রশ্নের ভুল অবস্থান দেখে হাসি পাওয়া সত্বেও চেপে গিয়ে নাম বললাম।
--কি কথা?
--গেটটা না খুললে কথা বলি কিভাবে!
--কোনো কথার প্রয়োজন নেই। চলে যান।
--এভাবে কথা বলছেন কেন?
--যা বলছি ঠিক বলছি। যান। নাহলে কিন্তু প্রতিবেশীদের ডাকতে বাধ্য হবো।
এরপর স্বাভাবিক কারণেই খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম কারণ আমার চেহারাটা যেরকম তাতে শৈলেশ্বর যদি একবার ডাকাত, ডাকাত বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তাহলে হয়ত জান নিয়ে ফেরার সুযোগ পাবো না। তবে 'ছেলেধরা' বলে চেল্লালে ভয় পেতাম না। সমকামিতার দোষ না থাকায় নির্ঘাত রুখে দাঁড়াতাম।
ভয় পাচ্ছি অথচ চলেও যেতে পারছি না। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে আরও খানিকটা জানা বোঝা জরুরি।
--ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। তবে পত্রিকার নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সেটা রাখুন।
এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন শৈলেশ্বর।
--কোন পত্রিকা?
--কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
--নেব না। যান।
এরপর আর দাঁড়াইনি। দাঁড়ানোর প্রয়োজনও ছিল না। ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি ব্যক্তি শৈলেশ্বর ঘোষকে চিনতে ভুল হয়নি আমাদের। আর এই সমঝদারি এতটাই তৃপ্তি দিয়েছিল যে অপমানবোধ স্পর্শ করারই সুযোগ পায়নি।
শৈলেশ্বরের হাত ঝাপটানিতে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ থেকে সরে গেলেন অনেকে। অরুণেশ ঘোষ তো সরে গিয়েছিলেনই, সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁর কিছু কাছের মানুষজনকেও, যাদের কাউকে কাউকে আমরাও কাছের মানুষ ভাবতাম। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু এসে গেল না। বরং ‘কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প’-এর কভারে লিখে দিলাম, “সত্যের ঘাত অসহ্য হলে বুর্জোয়া ভাইরাসেরা গড়িয়ে যায় নিজস্ব ভাগাড়ের দিকে।” লিখে দিলাম, “ জানি পাঠক, তুমি পাজামা কিংবা পেন্ডুলাম নও।”
কিন্তু আমাদের কিছু না এসে গেলেও একজনের গিয়েছিল, সুভাষ ঘোষের। চটে গিয়েছিল সুভাষ-শৈলেশ্বর রসায়ন। যদিও নিজস্ব অবস্থান এবং অসহায়তার কথা বন্ধু ‘শৈলেশ’কে আপ্রাণ বোঝাতে চেয়েছিলেন সুভাষ, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই ব্যর্থতা এতটাই চরমে উঠেছিল যে খোদ কোলকাতাতেই শৈলেশ্বরের ইশারায় সুভাষকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিতও হোতে হয়েছিল। বাল্যবন্ধুর সেই লাঞ্ছনা সংবাদ উত্তরবঙ্গের অনুচরদের কাছে পৌঁছে দিতে দ্বিধা দেখাননি শৈলেশ্বর ঘোষ।
হ্যাঁ, ততদিনে এক অলিখিত নিয়মে ক্ষুধার্ত শিবির ত্রিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে যেটা আমাদের আদৌ অভিপ্রেত ছিল না। এক শিবিরের অধিনায়ক শৈলেশ্বর ঘোষ। অন্য শিবিরের অধিনায়ক মলয় রায়চৌধুরী এবং তৃতীয় শিবির ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’, যার নেতৃত্বের দায় জোর-জবরদস্তি চাপিয়ে দেয়া হলো সুভাষের কাঁধে। অথচ আমরা কোনদিনই কারো নেতৃত্বকে স্বীকার করার মতো অবস্থানে ছিলাম না। সুভাষও অপচেষ্টা করেননি চেপে বসার, তবু ইতিহাসের রসিকতা বোধের ফের একবার প্রমাণ পাওয়া গেল। ইতিহাসের রসিকতা বলার কারণ সেই ষাটের দশকে প্রকাশিত সুভাষের একটি গদ্যগ্রন্থের নাম ছিল,‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট।’ নামকরণের সেই ক্ষণে সুভাষ কি আদৌ ধারণা করতে পেরেছিলেন ভাবী সময় কোনওদিন তাঁকে সত্যি সত্যি এমন জায়গাতেই এনে দাঁড় করাবে?
রসিকতা দূরে থাক, মূল সত্য এটাই যে, এরপরও সুভাষ ঘোষের কোনো নিজস্ব শিবির ছিল না। ছিল না নিজস্ব অনুচর বাহিনী। ছিল না সঙ্গী নির্বাচনের উপযুক্ত কোনো মেটাল ডিটেক্টর। এমন কী মনমতো হাংরি ইতিহাস লেখারও কোনো অ্যাজেন্ডা ছিল না। যা ছিল তা শুধু ঘাড় নীচু করে লিখে যাওয়া, নিজের লেখা পাঠ করে শোনানোর পাশাপাশি তরুণ লেখকদের লেখা শোনা এবং মতামত দেয়া। এছাড়া বেঁচে থাকার অন্য কোনো উদ্দেশ্যও ছিল না সুভাষের। যে কোনো যৌথতায় বিনা আমন্ত্রণে হাজির হতে আপত্তি ছিল না কোনো।
আমাদের অবাধ্য হওয়ার নমুনা পাওয়া মাত্র শৈলেশ্বর ঘোষ ভিন্ন শিবিরের খোঁজার পালা শুরু করে দিয়েছিলেন। সৃষ্টিশীলতা, ইতিহাস প্রসিদ্ধি এবং ক্ষুরধার বুদ্ধির ত্র্যহস্পর্শে পেয়েওছিলেন তৃতীয় প্রবাহের সন্ধান। তবে এক্ষেত্রে খানিকটা সমঝোতা করতে উনি রাজী হয়েছিলেন। যেমন ওই শিবির কবি শৈলেশ্বরকে স্বীকৃতি দিলেও ক্ষুধার্ত আন্দোলনের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি ছিল না। অবশ্য তখন শৈলেশ্বরের তাতে আর কিছু এসে যায় না। যথারীতি সে পর্বও দীর্ঘদিন লাস্টিং করলো না। করার কথাও নয়, জানতাম আমরা। কিভাবে জানতাম বলতে চাইছি না। অহেতুক তৃতীয়পক্ষকে টেনে কী লাভ ! বরং সেসময়ের একটা শ্লোগানের কথা বলি-- “অস্তিত্ব পুড়ছে, আসুন সেই আলোয় আমরা পরস্পকে শনাক্ত করি।”
উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রসার সম্পর্কে রাজা সরকার লিখেছেন,”প্রসঙ্গত ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’এ সুভাষ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর আমরা নানা ভাবে আক্রান্ত বোধ করতে থাকি। সেই সাক্ষাৎকারে হাংরি কনসেপ্ট নিয়ে সুভাষের কথায় অনেকে অস্বস্তি বোধ করেন। অনেকেই আন্দোলন নিয়ে সুভাষের কথার বিরোধিতা করতে গিয়ে আমাদেরও তার সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। সঙ্ঘ ভাঙা মানুষেরা বোধ করি কোনও সঙ্ঘ আর পছন্দ করেন না। কিন্তু ততদিনে পাশাপাশি আমরা জেনে যাচ্ছি যে হাংরিদের অভ্যন্তরীণ মত পার্থক্য, মামলা কেন্দ্রিক কিছু ব্যক্তিগত বিভেদের সালতামামি। এসব অগ্রাহ্য না করতে পারলেও আমরা আমাদের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলাম। ততদিনে কিছুটা বিস্মৃত হয়ে যাওয়া ফালগুনী রায় ও অবনী ধর এর লেখা আমরা আমাদের কাগজে পুনঃ প্রকাশ করতে শুরু করি। হাংরি লেখকদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইও ঐসময় ‘কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পের’ লেখকদের নিজ উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ।”
অলোক গোস্বামী আর রাজা সরকারের বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায়, পরাবাস্তববাদীদের মতনই, শৈলেশ্বর ঘোষের হয়তো মনে হয়েছিল যে কলকাতায় তিনি হাংরি আন্দোলনের যে কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাইছেন তাতে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করছেন সুভাষ ঘোষ । তাঁর আচরণ ছিল হুবহু আঁদ্রে ব্রেতঁর মতন । সুভাষ ঘোষের আচরণ ছিল লুই আরাগঁর মতন ; লুই আরাগঁ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন বন্ধু আঁদ্রে ব্রেতঁ থেকে, মতান্তরের কারণে ।পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে আঁদ্রে ব্রেতঁর সঙ্গে অনেকের সম্পর্ক ভালো ছিল না, দল অজস্রবার ভাগাভাগি হয়েছিল, অথচ সেসব নিয়ে বাঙালি আলোচকরা খিল্লি করেন না, যতোটা হাংরি আন্দোলনের দল-ভাগাভাগি ও বিবাদ নিয়ে করেন। ইংরেজিতে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী হাংরি আন্দোলন নিয়ে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে একটি বই লিখেছেন, পেঙ্গুইন র্যাণ্ডাম হাউস থেকে প্রকাশিত । সেই বইটি বাংলা পত্রপত্রিকায় আলোচিত হল না । ইংরেজিতে হাংরিদের সম্পর্কে সংকলিত “লিটারেচার অফ দি হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট : আইকনস অ্যাণ্ড ইমপ্যাক্ট” বইটিও আলোচিত হল না ; হাংরি আন্দোলনের চিত্রশিল্পী অনিল করঞ্জাই সম্পর্কে জুলিয়েট রেনল্ডসের লেখা ‘রোডস অ্যাক্রস দি আর্থ : অন দি লাইফ, টাইমস অ্যাণ্ড আর্ট অফ অনিল করঞ্জাই’ বইটির আলোচনা হল না । অথচ বিট ও পরাবাস্তব আন্দোলন সম্পর্কে লেখা প্রায় সব বইই আমেরিকান ও ইউরোপীয় পত্রিকায় আলোচনা হয় । মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী তাঁর বইতে লিখেছেন যে, “আন্দোলনটি সম্পন্ন হওয়ার পরে, বিশ্ব তাদের ভারতবর্ষের সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে মর্মভেদী, সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাবশালী এবং উদ্ভাবনী শিল্পীর দল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যাদের জীবন একটি অসাধারণ ফ্রেমে বিস্তৃত হয়েছিল, ফলে অনেকের কাছে বৃহত্তর চিত্রটি ছিল পরিবর্তিত ।”
ছয়
শঙ্খ ঘোষকে উদ্দেশ্য করে লেখা এক প্রবন্ধে প্রদীপ চৌধুরী বলেছিল, “আমরা ইউনিকর্ন নই । আমাদের পরিণতি কোনো কমিটমেন্টের সঙ্গে যুক্ত নয় । আপনি সার্ত্র এবং সুররিয়ালিস্ট এমনকী গিন্সবার্গের কবিতা আমাদের পাশাপাশি রেখে পড়ুন । একদিন কমিটমেন্টের এই প্রশ্ন থেকে সুররিণালিজম ভেঙে গিয়েছিল । অসহায় ননকমিটেড আর্তিকে এক নির্মম নাটকের নায়ক হয়ে কাটাতে হয়েছিল বছরের পর বছর পাগলাগারদে । আর সমগ্র প্যারিসময় নিন্দা, অপপ্রচার, এসব করে ব্রেতঁ গোষ্ঠী আর্তোর একটা বালও কাঁপাতে পারেননি । আমরা কমিটেড নই, কিন্তু আর্তোর মতো উদ্ধারহীন এবং সাবজেকটিভও নই । জীবন ও সভ্যতার প্রত্যেক শিরা উপশিরার সঙ্গে আমরা অবশ্যই যুক্ত, ( বলার যা অপেক্ষা রাখে না ) । এটাকে এক ধরণের এনগেজমেন্ট বলতে পারেন, জরায়ুর সঙ্গে শিশুর যে ধরনের এনগেজমেন্ট । ব্লেক, বোদলেয়ার, জীবনানন্দ দাশ থেকে আপনি পর্যন্ত -- আপনারা সকলেই শহরের অলিগলিতে প্রচুর ঘোরাঘুরি করলেন । এর রঙ্গমঞ্চ, সুপারমার্কেট, নেপথালিন দেওয়া মুত্রাগারগুলি ব্যবহার করলেন । কিন্তু কিছুতেই মাঝরাতে এসপ্ল্যানেডের পিচের ওপরে আছড়ে পড়ে চুমু খেতে পারলেন না এর ভালোবাসাহীন আত্মাকে । আপনারা কবি, তাই নির্ধারিত চেয়ারগুলিই অধিকার করে নিলো আপনাদের ।”
-----------------------------------------------XXXXXXXXX---------------------------------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন