রবিবার

কলকাতা বিক্রি আছে - পোস্টমডার্ন নাটক : মলয় রায়চৌধুরী

 

কলকাতা বিক্রি আছে - পোস্টমডার্ন নাটক : মলয় রায়চৌধুরী 


নুরুদ্দিন মহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী : আমি সিংহাসন দখল নিয়ে ব্যস্ত ছিলুম বলে ইংরেজগুলো সুবে বাংলায় ঢুকে পড়তে পেরেছিল।৩৬ বছর বয়েসে  বাবা মারা যাবার ৮ দিন পর ৩০ নভেম্বর, ১৬০৫  থেকে আমার ২২ বছরের রাজত্বের শুরু। মনে রাখিস লক্ষ্মীকান্ত, জায়গিরটা আমিই তোদের দিয়েছি, যদিও সুন্দরবনের লাগোয়া বলে তোরা নিতে চাইছিলিস না । তা আমি কী করব বল ! ভবানন্দ মজুমদার ছিল আমাদের খোচর । ওকে ভালো জমিজমা দিতে হলো । তোরা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে আমাদের হেল্প করলে তিন ফসলি জমিজমা পেতিস । যারা ইতিহাস লিখবে তাদের বলে দিস যে কলকাতার জনক আসলে আমি, কেননা আমিই গ্রামগুলো তোদের দিয়েছি।


সুবাহার ইবরাহিম খান : দ্যাখ জোব চার্ণক, জমি আমি দিচ্ছি, তোরা আবার গোয়ার পর্তুগিজদের মতন দুর্গ খাড়া করিসনি যেন  । সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলিকাতা গ্রাম তিনটে  মুঘল সম্রাটের খাসমহলের জমি, বাদশা জাহাঙ্গির সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের দিয়েছে জায়গিরটা । আমি তোকে ব্যবসা করার সুবিধে করে দিলুম । ইতিহাসে লিখতে ভুলিসনি যে কলকাতার জনক আমি ।

 

বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : কিন্তু সুবাহদার, এই গ্রাম তিনটের জায়গিরদারি তো সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের । আমাদের যৎসামান্য আয় হয় গ্রামগুলো থেকে ; প্রজারাও আমাদের ভালোবাসে । ইংরেজরা দিল্লির বাদশাকে মাত্র ষোলো হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিল করে ফেললো । আমরাই তো এই গ্রামগুলোর জনক । 

 

ভিদকুন কুইসলিঙ : আমার আসল নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী খান, ইরান থেকে এসে আলীবর্দী খানের সৈন্যদলে যোগ দিয়েছিলুম, বাংলা বিশেষ বলতে পারি না, ফারসিতে কাজ চালাই । তা যতোই প্রজারা ভালোবাসুক । তোমরা তো ক্লাইভকে তুষ্ট করতে পারোনি । সিরাজের যুদ্ধ আদ্যন্ত এক ‘বেওসা’, যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে মুনশি নবকেষ্টর মতো লোক রাতারাতি মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর হয়ে গেল। শোভাবাজার রাজবাড়ি এখন তাই বিয়ে, অন্নপ্রাশন, উপনয়নের জন্য ভাড়া দেয়া হয়। ওরা মনে করে ওরাই কলকাতার জনক । আমাকেই লোকে অযথা দোষ দ্যায় । এই নবকেষ্ট তো ক্লাইভের জন্যে মানত করে দূর্গাপুজোও করে ফেলল । নবকেষ্টর বংশধররা  জোব চার্ণককে কলকাতার জনক বলে উঠেপড়ে লেগেছিল ; হাইকোর্টে মামলায় হেরে গিয়ে এখন তারা ফিবছর সুতানুটি উৎসব চালায় ।

 

মির্জা মুহম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলা :  শোভাবাজর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব পলাশীর যুদ্ধের আগে  ছিল  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুন্সি, পরে হয়েছিল সুতানুটির তালুকদার। এর পরে ওয়ারেন হেস্টিংসের মুন্সি, তারপর ড্রেক সাহেব তেজাউদ্দীনকে কোম্পানির মুন্সির পদ থেকে সরিয়ে সেখানে বসালে নবকৃষ্ণকে।পলাশীর যুদ্ধের ফলে নবকৃষ্ণের কপাল খুলে গেল। মীরজাফর, রামচাঁদ রায়, আমীর বেগ আর নবকৃষ্ণ মিলে আমার লুকোনো কোষাগার লুঠ করে বহু কোটি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিলে। নবকৃষ্ণ কেবল টাকাই পেলো না ! বাড়তি পাওনা পেল সম্মান ও ক্ষমতা ।১৮৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির রণাঙ্গনে মীরজাফরের বেইমানির দরুণ ইংরেজ সেনপতি ক্লাইভের হাতে আমার পরাজয় ঘটলে সবচেয়ে যারা উল্লসির হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল হিন্দু বিশ্বাসঘাতকরা, নদিয়ার কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ। কোম্পানির জয়কে তারা হিন্দুর জয় বলে প্রচার চালালো। ধূর্ত ক্লাইভও তাদের তেমনই বোঝালো। ক্লাইভের পরামর্শেই তারা পলাশীর যুদ্ধের বিজয়-উৎসব করার আয়োজন করলো।বসন্তকালীন দুর্গাপুজোকে তাঁরা পিছিয়ে আনলো শরৎকালে ! ১৭৫৭ সালে বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দুর্গাপুজো করে তারা পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করলো ! অন্যা হিন্দু জমিদার আর ব্যবসাদাররাও মহা উৎসাহে সেই ফূর্তিতে যোগদান করলো ! হেরে গেলেও, আমিই মালিক । আমাকে কলকাতার জনক মনে করা উচিত ।

 

জুডাস ইসকারিয়ট : আমার আসল নাম রায় দুর্লভরাম । আমাকে কেন কলকাতার জনক মনে করা হবে না ? আমি তো বাংলার নবাবি শাসনামলের একজন কর্মকর্তা। আমি নবাব আলীবর্দী খানের অধীনে উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা পদে ছিলুম। বাংলায় মারাঠা আক্রমণকালে আমি বাংলার নবাবের পক্ষে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই। যদিও পলাশীর যুদ্ধের সময়  নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের সহযোগিতা করেছিলুম আর যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলুম।  বিশ্বাসঘাতকদের জন্যেই তো ক্লাইভ জিতেছিল । আমি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে কলকাতা দখল করে ক্লাইভের মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করে দিতো সিরাজদ্দৌলা।আমাকে কলকাতার জনক মনে করা উচিত।১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মীর কাশিম ইংরেজদের সাথে বক্সারের যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী আমার গলায় বালির বস্তা বেঁধে মুঙ্গেরের দূর্গশীর্ষ থেকে জীবন্ত দেহ নিক্ষেপ করে গঙ্গার বুকে। এভাবেই গঙ্গার বক্ষে সলিল সমাধি হয় আমার।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর : বড় লোকেদের যেন একটা ধারণা ছিল যে ভাল মন্দ বিচার না করিয়া খুব খরচ করিতে পারিলেই সমাজের মধ্যে প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাইবে। মাতৃশ্রাদ্ধে নবকৃষ্ণ দেবের ন’লক্ষ টাকা খরচের পিছনে এই উদ্দেশ্য উঁকি দেয়। তাঁর মাতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে যে সভা হয় এবং যেখানে সমবেত অভ্যাগত ও পণ্ডিতগণের আবাসস্থল এবং কাঙালিদের জন্য পণ্যবীথিকা সংস্থাপিত হয়, তা থেকে উক্ত অঞ্চলের নামকরণ হয় সভাবাজার বা শোভাবাজার (পূর্ব নাম রাসপল্লি)। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভের চেষ্টায় তিনি 'মহারাজা বাহাদুর' উপাধি ও ৬-হাজারি মনসবদারের পদ পান। তাঁর অধীনে আরজবেগী দপ্তর, মালখানা, চব্বিশ পরগনার মাল আদালত, তহশিল দপ্তর প্রভৃতি ছিল। পরে তিনি কোম্পানির কমিটির রাজনৈতিক বেনিয়ান হন।তিনি ও তাঁর বংশজগণ প্রায় শতাধিক বছর ধরে ক্ষমতা ও প্রভাব বহাল রেখেছিলেন।১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভে শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে দুর্গাপূজার আয়োজন করে বিজয় উৎসব পালন করেন। সেই থেকে প্রতি বৎসর শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন হয়ে থাকে। । সিরাজদ্দৌলার কোষাগার থেকে চুরি করা টাকায়  নবকৃষ্ণ দেব রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন ।পলাশির পরে কলকাতার সামাজিক সাম্রাজ্যে তিনি হয়ে উঠলেন প্রায় মুকুটহীন সম্রাট। তাঁর সামাজিক গুরুত্ব তখন রাজনৈতিক নেতাদের থেকে বেশি। এই সামাজিক গুরুত্ব লাভে তাঁকে সাহায্য করেছিল তার সরকারি পদের গুরুত্ব এবং কলকাতার কোম্পানির কর্তাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। নিজের সামাজিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তিনি কলকাতায় ডেকে এনেছিলেন উঁচুদরের কুলীনদের। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দান করেছিলেন জমি, বাড়ি ইত্যাদি। এই সবই দলপতি হওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি। দলপতি হতে প্রয়োজন ছিল বিত্ত-বৈভব প্রদর্শন। তার মাধ্যম ছিল শ্রাদ্ধ, বিয়ে বা অন্য পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অপরিমিত অর্থব্যয়। সে কালে ধনীদের দু’হাতে দানধ্যান করাকে বদান্যতা ভাবলে ভুল হবে। নবকৃষ্ণ কলকাতার দুষ্টক্ষত । আমরা জোড়াসাঁকো পরিবারই কলকাতার জনক; আমাদের ছাড়া কলকাতা অচল ।

 

আজিম-উশ-শান : ঘাবড়াসনি বিদ্যাধর । ব্রিটিশ বসতি  অন্য ভূস্বামীদের আরও আটত্রিশটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা  ১৭১৭ সাল । ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে  তোদের গ্রামের জমিদারি সত্ব দিলেও, অন্য জমিদারদের কাছ থেকে ওরা বাকি গ্রামগুলো কিনতে  পারেনি। তোর টাকাকড়ি জমিয়ে রাখতে পারলি না ; সবাই একগাদা বিয়ে করে গুচ্ছের বাচ্চা পয়দা করলি । যাই হোক, সব গ্রামগুলো তো মুঘল বাদশার । তাই আমিই কলকাতার জনক, মনে রাখিস ।

 

বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : আমরা  ব্রিটিশদের এই তিনটে গ্রাম ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলুম না ।  ব্রিটিশরা মুঘল রাজদরবারে ঘুষ দিয়ে এই গ্রাম তিনটের ইজারা কেনার অনুমতি আদায়ে সমর্থ হয়েছে। এটা ১৬৯৮ সাল । আপনারা ইংরেজদের হাতে গ্রাম তিনটে তুলে দিতে বাধ্য করলেন। ওরা বার্ষিক মাত্র ১,৩০০ টাকা রাজস্বের বিনিময়ে গ্রাম তিনটের ইজারা কিনে নিলে। চুক্তিপত্রটা ফার্সি ভাষায় লেখা ; ভাগ্যিস আমাদের পরিবারে সবাই ফার্সি ভাষা জানে । আপনি তো জানেন এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা জিয়া গঙ্গোপাধ্যায়  সন্ত কামদেব ব্রহ্মচারী নামে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ছেলে লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়  ১৬০৮ সালে  মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে সুন্দরবনের লাগোয়া ভূসম্পত্তি জায়গির হিসেবে পেয়েছিলেন।  মুঘল সম্রাট আকবর আমাদের ‘রায়’ আর জাহাঙ্গির  ‘চৌধুরী’ উপাধি দিয়েছিলেন। তাই ‘রায়চৌধুরী’ আমাদের পদবিতে পরিণত হয়েছে। আমরা দাবি করি না যে আমরা কলকাতার জনক । 

 

আজিম-উশ-শান : আমিই বা কী করব ? শায়েস্তা খান এর উত্তরাধিকারী সুবাহদার ইবরাহিম খান বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য আবার শুরু করতে ব্রিটিশদের ডেকে পাঠিয়েছিল। দুটো প্রধান বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে জব চার্নক নামে ওদের একজন প্রতিনিধি সুবাহদারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছিল। একটা ছিল ইংরেজদের বসতি হুগলি থেকে সুতানুটিতে স্থানান্তরের প্রস্তাবে সরকারকে অবশ্যই রাজি হতে হবে। দ্বিতীয়ত, বার্ষিক পূর্বনির্দিষ্ট ৩০০০ টাকা কর পরিশোধের বিনিময়ে কোম্পানিকে বাংলায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অনুমতি প্রদানকারী একটি ফরমানের দ্বারা সুবাহদার তাদের অনুমতি দেবেন। সুবাহদার ইবরাহিম খান তাদের তোলা দুটো প্রস্তাবই মেনে নিলে । মনে হচ্ছে কলকাতা নামের বাচ্চাটার বাপ অনেকগুলো ।

 

বিদ্যাধর রায়চৌধুরী : হ্যাঁ, জব চার্ণক মারা যাবার পর ওর জামাই  ক্যাপ্টেন চার্লস আয়ারকে আমরা ১৬৯৮ সালের ১১ই নভেম্বর কলকাতা - সুতানুটি - গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটের প্রজাস্বত্ব মাত্র ১৩০০ টাকায় একটি দলিলের দ্বারা দান করে দিতে বাধ্য হয়েছিলুম, তার কারণ আপনারা ঘুষ খেয়ে আমাদের ওপর চাপ দিয়েছিলেন । আমরা এখানকার জায়গিরদার  অথচ মুঘলরা আমাদের গুরুত্ব দিল না । দলিলটা আমরা  সই করেছিলুম আটচালা বাড়িতে, যেখানে আজও আমরা দূর্গাপুজো করি । ক্লাইভের চামচা নবকৃষ্ণদেবের অনেক আগে থেকে আমাদের পুজো হয় । আমরা ক্লাইভের পোঁদে তেল দিতে রাজি হইনি । রাজা বা মহারাজা খেতাব আমাদের দরকার পড়েনি, নবকৃষ্ণ আর কৃষ্ণচন্দ্রর মতন ।

 

বেনেডিক্ট অ্যারনল্ড : আমার আসল নাম মীর মুহম্মদ কাসিম আলী খানশোভাবাজার রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব সম্পর্কে এই কথাটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। পিতৃহীন অবস্থায় কলকাতার কাছে গোবিন্দপুরে এসে থাকতে শুরু করে। বলা ভালো, অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা ছিল। কিন্তু বুদ্ধি ছিল প্রখর। নিজের চেষ্টায় উর্দু, আরবি, ফার্সি শিখেছিল। ইংরেজ সরকারের হয়ে কাজ করার জন্য সমস্ত রকম গুণই তার মধ্যে বর্তমান ছিল।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামান্য মুনশী হিসেবে জীবন শুরু হয় নবকৃষ্ণ দেবের। সরকারি কাজকর্মের পাশাপাশি ওয়ারেন হেস্টিংসকে ফার্সি ভাষা শেখানোর কাজ করতো। বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে রবার্ট ক্লাইভ। সিরাজের পক্ষে আছে মীরজাফর। ক্লাইভ তখন নিশ্চিন্ত ।  সময়মতো নবাবের পক্ষ ত্যাগ করল মীরজাফর। ‘ইনাম’স্বরূপ মীরজাফর নবাবের গদিতে বসল। কিন্তু পেছনে থেকে লাভবান হলো আরও দুজন।  কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দেব। মীরজাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইতিমধ্যেই তারা খুঁজে পেয়েছে সিরাজের গোপন কোষাগার। সবাই সেই বিপুল ধনসম্পত্তি ভাগাভাগি করে নেয়। তা সত্তেও নবকৃষ্ণের ভাগে কম কিছু পড়েনি। দেখতে দেখতে বিশাল ধনদৌলতের মালিক হয়ে গেল নবকৃষ্ণ। শুধু টাকাই নয়, এল সম্মানও। ইংরেজদের পক্ষ নেওয়ার জন্য পেল ‘রাজা বাহাদুর’ খেতাব; অতঃপর ১৭৬৬ সালে ‘মহারাজা বাহাদুর’। সবথেকে বড়ো কথা, গোটা সুতানুটি অঞ্চলের তালুকদার হয়ে গেল । সামান্য মুনশী থেকে বিশাল সাম্রাজ্য ও ধন-দৌলতের মালিক— এমনই চমকপ্রদ উত্থান রাজা নবকৃষ্ণ দেবের। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হল শোভাবাজার রাজবাড়ি । তখন সবে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়েছে। নবকৃষ্ণদেব ভীষণ খুশি। আর এখানেই ধর্মের তাসটি খেললেন চতুর ক্লাইভ। নিজে খ্রিস্টান, মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী; তা সত্তেও নবকৃষ্ণকে বোঝালেন কলকাতায় একটি বিজয় উৎসব করার জন্য। ‘হিন্দু ভাবাবেগ’ রক্ষা পেয়েছে বলে কথা ! কিন্তু কীভাবে হবে উৎসব? নবকৃষ্ণ ঠিক করলেন, দেবী দুর্গার আরাধনা করেই তুষ্ট করবেন ক্লাইভকে। শুরু করবেন বিজয় উৎসব। ১৭৫৭ সালেই নিজের নবনির্মিত ঠাকুরদালানে শুরু করলেন অকাল বোধন। শুরু হল কলকাতার দুর্গাপূজা। তাতে একশো এক টাকা দক্ষিণাও পাঠিয়েছিলেন ক্লাইভ ! বিশাল আয়োজন করে শুরু হল শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো। কালে কালে যা শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গেছে । বিশ্বাসঘাতকের পুজোতে ভোগ খেয়ে বাঙালিও সেই বিশ্বাসঘাতকতা আর কোষাগার চুরির অংশভাক। চুরির টাকা খরচ করে কলকাতার জনক হতে চাইছে ওর বংশধররা । 

 

মহারাজা প্রতাপাদিত্য : মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়   নদীয়ার রাজা আর কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর। ভবানন্দ আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজবংশ শুরু করেছিল । কৃষ্ণচন্দ্রের কৃষ্ণনগরেই তাঁর জন্ম; বাবা রঘুরাম রায়। রক্ষণশীল এই হিন্দু রাজা বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় সমান ব্যুৎপন্ন ছিল। কৃষ্ণচন্দ্র ছিল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন কূটকৌশলী লোক। তার ষড়যন্ত্রে বাংলায় ইংরেজ শাসন কায়েম হয় এবং মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটে। এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ও ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা করে আর ক্লাইভের পক্ষ নিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করেছিল। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নবাব  মীর কাসেম তাকে বন্দি করে মৃত্যুদন্ড দিলে ইংরেজদের সহায়তায় ও মুক্তি পায়। ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের পুরস্কার হিসেবে  ইংরেজ কর্তৃক ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত হয়। তদুপরি ক্লাইভের কাছ থেকে উপঢৌকন হিসেবে পায়  পাঁচটা কামান। সে সময়ে বাংলায় যে বর্গীর আক্রমণ হতো তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ও নিজের রাজধানী ‘শিবনিবাস’ নামের জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। ক্লাইভের চামচা হিসেবে ওরা তো নিজেদের কলকাতার জনক দাবি করতেই পারে ।

জয়চাঁদ : আমার আসল নাম নবকৃষ্ণ দেব ।পলাশীর যুদ্ধের আগে বাংলা অঞ্চলে সাতজন হিন্দু রাজা ছিল। এদের মধ্যে রাজনৈতিক দিক থেকে বিচক্ষণ নদীয়ার শাসক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় উপলব্ধি করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় মুসলমানদের শাসনের দিন ফুরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে ব্রিটিশদের উত্থান ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিষয়টি তিনি অন্য ছয়জন হিন্দু রাজাকেও বোঝাতে সক্ষম হন। কৃষ্ণচন্দ্র অন্য হিন্দু রাজাদের আরও বোঝাতে সক্ষম হন যে, তাদের সনাতন ধর্ম মুসলমানদের হাতে নিরাপদ নয়, বরং ব্রিটিশদের হাতে নিরাপদ। ফলে সব হিন্দু রাজার সমর্থন নিয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় হাত মেলায় রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে। ইংরেজদের সঙ্গে এই সখ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধ-ময়দানে যাওয়ার সময় কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের প্রাসাদে রাত কাটিয়েছিল । যুদ্ধের পর ইংরেজদের সঙ্গে এই সখ্য চললেও নবাব মীর কাশেমের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। এই দ্বন্দ্বের রেশ ধরেই কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে মৃত্যুদণ্ড দেন মীর কাসিম। কিন্তু ক্লাইভের বদান্যতায় বেঁচে যায় আর রাজা খেতাব পায় ।বস্থায় মারা যান উমিচাঁদ

মার্কাস ব্রুটাস : আমাদের  পরিবারের নাম জগত শেঠ । পলাশীর যুদ্ধে একদিকে যেমন ইংরেজদের কূটকৌশল আর অস্ত্রশস্ত্র কাজ করেছিল, অন্যদিকে ঠিক তেমনিভাবে কাজ করেছিল আমার অঢেল টাকা। আমার আসল নাম মহাতাপ চাঁদ। আর  টাইটেল  জগৎ শেঠ, যার অর্থ পৃথিবীর ব্যাংকার। মূলত এই টাইটেলটা প্রথম লাভ করে আমার দাদা ফাতেহ চাঁদ। আমরা মাড়োয়ারি  পরিবার । মূলত সুদের কারবার আর ব্যাংকিংয়ে জড়িত । পলাশীর যুদ্ধের আগেই বংশ পরম্পরায় পিতামহের টাইটেল জগৎ শেঠ আমার নামে যুক্ত হয়।  য় জমিদাররা আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই খাজনা পরিশোধ করতো। আবার নবাবরাও দিল্লিতে খাজনা পাঠাতে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ইংরেজরা এদেশে আসতে থাকলে ইংল্যান্ডের মুদ্রার সঙ্গে ভারতীয় মুদ্রা বিনিময় করার প্রয়োজন দেখা দেয়। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করি আমরা। বিশেষত ইংরেজরা ঘুষ আর দুর্নীতি বাবদ ভারতীয় মুদ্রায় যে অর্থ পেত তা ইংল্যান্ডের মুদ্রায় বা সোনা ও রত্নে বিনিময় করে দিতুম আমরা । তাই ইংরেজদের কাছে আমাদের কদর ছিল। ফলে নবাব সিরাজউদ্দৌলকে পলাশীর যুদ্ধে হারানোর ষড়যন্ত্রে ব্যাপক ভূমিকা নিই । পলাশীর যুদ্ধের পর মীর জাফরের আমলে ভালোই ছিলুম আমি, মহাতাপ চাঁদ আর খুড়তুতো ভাই  মহারাজ স্বরূপ চাঁদ। কিন্তু  মীর কাসিমের সঙ্গে খেয়োখেয়িতে জড়িয়ে পড়লে ওর বিরুদ্ধে  নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করতে বাধ্য হই। পলাশীর যুদ্ধের ছয় বছরের মাথায় ইংরেজদের কাছে  ষড়যন্ত্রমূলক একটি চিঠি লিখেছিলুম । কিন্তু চিঠিটা কেমন করে যেন  মীর কাসিমের হস্তগত হয়। এতে চটে  ওঠে  মীর কাসিম আর আমাকে মুর্শিদাবাদ থেকে তাড়ায় । এদিকে ১৭৬৩ সালে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে হেরে যায়  মীর কাসিম ।  মীর কাসিম এই অপমান মানতে পারেননি। ব্যাটা ছুটে আসে আমাদের নতুন আস্তানা মাংঘরে। মাংঘরে একটি টাওয়ারে আশ্রয় নিয়েও প্রাণ বাঁচতে পারিনি আমি।  মীর কাসিম আর ওর সৈন্যরা আমার, মহাতাপ চাঁদের, আর  স্বরূপ চাঁদসহ  পরিবারের সবার মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করে দ্যায় । এই আত্ম বলিদানের জন্যে আমি দাবি করি যে আমিই কলকাতার জনক ।  

সুশীল চৌধুরী : ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলার নওয়াব  সিরাজউদ্দৌলা ও ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। নওয়াব কলকাতার ইংরেজ বসতি অধিকার করেন (১৮-২০ জুন ১৭৫৬) এবং ইংরেজরা তাঁর প্রকৃত ক্ষতিসমূহের প্রতিবিধান করতে অস্বীকার করলে তিনি তাদের কলকাতা শহর থেকে বিতাড়িত করেন। তিনি এ শহরের নতুন নামকরণ করেন আলীনগর। ইংরেজরা সাহায্যের আবেদন জানালে মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভ এবং ওয়াটসন-এর অধীনে অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনী উপনীত হয় এবং কলকাতা পুনর্দখল করে। নওয়াব কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু কলকাতার কাছে খুব ভোরে ইংরেজরা আকস্মিক আক্রমণ করলে নওয়াব পশ্চাদপসরণ করেন। ইংরেজরা তাঁকে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য প্রস্তাব দেয়। নওয়াব তাঁর প্রধান উপদেষ্টাবৃন্দ ও মন্ত্রীদের পরামর্শক্রমে এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির প্রধান ধারাগুলি হলো ক. নওয়াব ১৭১৭ সালের ফররুখ সিয়ারের ফরমান এ প্রদত্ত সকল সুবিধা ইংরেজদেরকে দেবেন, খ. কোম্পানির দস্তক এর আওতায় বাংলার ভেতর দিয়ে যেসব পণ্যদ্রব্য অতিক্রম করবে সেগুলির ওপর থেকে শুল্ক তুলে নিতে হবে, গ. নওয়াব বিনা বাধায় কলকাতার ইংরেজ দুর্গটিকে সুরক্ষিত করার অনুমতি দেবেন এবং ঘ. কলকাতায় ইংরেজগণ স্বাধীনভাবে মুদ্রাঙ্কন করতে পারবে। এ চুক্তির শর্তাবলি বাংলায় ইংরেজদের অনুকূলে ছিল এবং সেখানে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করেছিল। ১৭৫৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটির কাছে লিখেন যে, এ চুক্তির শর্তাবলি কোম্পানির জন্য ‘একই সঙ্গে সম্মানজনক ও সুবিধাজনক’। সিরাজউদ্দৌলার জন্য এ চুক্তি কিছুটা অপমানকর হলেও তিনি এটি মেনে নেন। তবে তিনি ইংরেজদের সামরিক বাহিনীর ভয়ে ভীত হয়ে একাজ করেন নি। তিনি বরং আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে আসন্ন আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় আলীনগরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এ সময় তিনি খবর পেয়েছিলেন যে, আহমদ শাহ আবদালী দিল্লি ধবংস করার পর (১৭৫৬) বাংলার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। পরবর্তী ঘটনাবলি দ্বারা তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণিত হলেও সম্ভবত তিনি মনে করেছিলেন যে, ওই মুহূর্তে ইংরেজরা নয় বরং আফগানরাই ছিল তাঁর জন্য অধিকতর বিপজ্জনক। এ কারণে তিনি রাজা রামনারায়ণের নেতৃত্বে তাঁর সামরিকবাহিনীর সেরা অংশটি আফগান বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য পাটনায় প্রেরণ করেছিলেন। যদিও এ চুক্তি বেশি দিন স্থায়িত্বলাভ করে নি। এর প্রধান কারণ, ইংরেজরা এর শর্তাবলি মেনে চলে নি। ফলে চুক্তিটি ভেঙ্গে যায় এবং ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। 

আহমদ শাহ দুররানি : আমি সুবে বাঙ্গাল আক্রমণের কথা ভাবিনি । কাফেরদের ধ্বংস করার কাজে ব্যস্ত ছিলুম । সিরাজ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ইংরেজদের তাড়াতে হেল্প করতে পারতুম । আমি শিখ গণহত্যায় কুখ্যাত হয়ে আছি, অমৃতসরে শিখদের পবিত্র স্বর্ণ মন্দিরে হামলা করে  ধংস্ব করে দিয়েছিলুম। এছাড়াও তিনি ১৭৪৬ ও ১৭৬২ সালে হাজার হাজার শিখকে খুন করেছিলুম।আফগানিস্তানে আমাকে লোকে বলে আহমদ শাহ বাবা ।

মার্শাল পেতাঁ : আমার নাম উমিচাঁদ । প্রকৃত নাম ছিল আমির চাঁদ। আমি একজন শিআর জন্মসূত্রে পাঞ্জাবের বাসিন্দা। কিন্তু কলকাতায়  দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছিলুম আর অঢেল ধনদৌলত কামিয়েছিলুম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতেও টাকা খাটিয়েছিলুম আর মুর্শিদাবাদ দরবারে কোম্পানির পক্ষে দালালি করতুম। এতে বেশ লাভবান হই । কলকাতায় অনেক ঘরবাড়ি কিনি । আরও লাভের আশায় আমিও গোপনে লর্ড ক্লাইভ আর মীর জাফরের সঙ্গে যোগ দিই।   পলাশীর যুদ্ধে নবাবকে হারিয়ে যে ধন-সম্পদ পাওয়া যাবে তার পাঁচ অংশ চেয়েছিলুম।  গোপন পরিকল্পনা ফাঁসের হুমকিও দিয়েছিলুম। ক্লাইভ ব্যাটা আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে একটি চুক্তি করেছিল । চুক্তিটার যে দুটো কপি করিয়েছিল তা জানতুম না। যার একটাতে আমাকে অর্জিতব্য সম্পদের  পাঁচ ভাগ দেওয়ার কথা লেখা থাকলেও অন্যটাতে অর্থাৎ মূল কপিতে তা লেখা হয়নি। মূল কপি ব্যাটা আমাকে দেখায়নি । আসল ঘটনা জানার পরে আমি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলুম ।  হ্রাস পায় আমার  স্মৃতিশক্তি।  অসহায় আর করুণ অবস্থায় দশ বছর উন্মাদ ছিলুম । ওই অস্হায় ১৭৬৭ সালে মারা যাই । এই যে ইংরেজদের ঢুকিয়ে আনলুম তাতে তো প্রমাণ হয় যে আমিই কলকাতার জনক ।

হুমায়ুন : দশম শতাব্দীতে যে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে বাংলায় সর্বশ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম বলে গন্য করা হতো, সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার তাঁদের অন্যতম । তা সত্তেও ওদের চরিত্রে ক্ষত্রিয়ের তেজ দেখে  বংশের পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়কে খান উপাধি দিয়েছিলুম । ওরা রায়চৌধুরীর বদলে খান পদবী ব্যবহার করলে ভালো করতো । আফগান সেনাদের প্রধান হয়ে পঞ্চানন তো পাঁচু শক্তিখান নামে আগ্রা, দিল্লি, লাহোর, কাবুলেও খ্যাতি পেয়েছিল । ওকে শের শা্হ সুরি ডেকেছিল ওর পক্ষের সেনাপতি হবার জন্য, কিন্তু যায়নি । অবশ্য ওদের বংশই তো কলকাতার জনক হলো ।

 

পাঁচু শক্তিখান : হ্যাঁ, শের শাহ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল, যাইনি কেননা মোগল সম্রাট আমাকে সন্মান দিয়েছেন ।মারাঠারা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল ওদের সঙ্গে যোগ দিতে । ওদের গেরিলা যুদ্ধশৈলী পছন্দ ছিল না বলে যাইনি ।কে কলকাতার জনক হবে তা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না ।

 

ভোলা ময়রা : আমার নাম ভোলানাথ মোদক।  হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায় জন্মছিলুম। বাবার নাম কৃপানাথ। কলকাতার বাগবাজারে আমার মিষ্টির দোকান ছিল। পাঠশালায় সামান্য লেখাপড়া করলেও সংস্কৃত, ফারসী ও হিন্দিতে জ্ঞান ছিল। পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্র সামান্য পড়েছিলুম। কবির দল তৈরীর আগেও  বহু কবিতা রচনা করেছিলুম। কলকাতার অনেক খবরই রাখি । কলকাতার মাঝখানে এখনকার বিবাদীবাগের লালদিঘির কাছে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছারি আর গৃহদেবতা শ্যাম রায়ের  মন্দির  ছিল।  কাছারির দোল উৎসবের আবিরে দিঘির রং লাল হয়ে যেত বলে এই দিঘির নাম হয়েছিল লালদিঘি। জন অ্যান্টনি নামে এক পর্তুগিজ ভাগ্যান্বেষী সাবর্ণদের কাছারিতে কাজ করতো। তার পৌত্র অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি পরে বিখ্যাত কবিয়াল হয়েছিল।ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে এই কাছারিটা ভাড়া নেয় আর পরে কিনে নেয়। ওখানেই বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সচিবালয় মহাকরণ । আমার মনে হয় আমরা কবিয়ালরা কলকাতার জনক ।

 

মোহনলাল : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের সময় আমি সিরাজের প্রতি অবিচল বিশ্বস্ততায় যুদ্ধ করেছিলুম। যুদ্ধক্ষেত্রে মীর মদনের মৃত্যুর পরেও আমার একক চেষ্টায় যুদ্ধের গতি সিরাজের অনুকূলে ছিল। কিন্তু নিজের অদূরদর্শিতা ও মানসিক দুর্বলতার কারণে সিরাজ,  মীর জাফর প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকদের প্রভাবে যুদ্ধ বন্ধ রাখার আদেশ দেন। ফলত: নবাব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও শোচনীয় পরাজয় ঘটে। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাইনি।  যুদ্ধে আহত হই আর যখন জানতে পারি যে মীর জাফর আমাকে খুন করার জন্য তল্লাশি চালাচ্ছে, তখন গা ঢাকা দিই। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে আমার বড় ছেলে, পূর্নিয়ার নায়েব নাজিম, শ্রীমন্ত লালকে  মিরন খুন করেছিল। ছোট ছেলে হুক্কা লাল পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। আমার বোন ছিল সিরাজের প্রণয়িনী আর আমি তাদের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ময়মনসিংহে চলে যাই। তারপর আমার অজ্ঞাতবাস পর্বের নানা কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে বাংলায়।এই কিংবদন্তিগুলোই কলকাতার জনক ।

কানকাটা দানশা ফকির : ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর যুদ্ধে হেরে যাবার পর, সিরাজদ্দৌলা – তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও চাকর গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান আর সেখান থেকে নৌকাতে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক যাত্রা করেন। তাঁর আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছোতে পারলে ফরাসি সৈনিক মসিঁয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। শেষরক্ষা হয় নি । মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ করে জল কমে যাওয়ায় নাজিমপুরের মোহনায় এসে তাঁর নৌকা চড়ায় আটকে যায়। তিনি নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের কাছে বাজারে আসেন। আমি নবাবকে দেখে চিনে ফেলি কেননা একবার নবাবের শাস্তি পেয়ে আমি একটা কান হারিয়েছিলুম। আমি নবাবের খবর জানিয়ে দিই । মীর জাফরের লোক এসে  সিরাজদ্দৌলাকে বন্দি করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে নিয়ে যায় । এর পরের দিন ৪ জুলাই  মীরজাফরের নির্দেশে তার ছেলে মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদি বেগ নামের এক জল্লাদ সিরাজদ্দৌলাকে খুন করে করে। সিরাজের মৃত্যুর পর তার শব হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেয়া হয়। মীর জাফর আমাকে জমিজমা আর  মোটা ইনাম দিয়েছিল । আমি ধরিয়ে না দিলে কলকাতার জন্ম হতো না ।

কৌস্তুভ দে সরকার : সিরাজের কাছে হেরে গিয়ে, কলকাতা উদ্ধারে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ইংরেজদের তরফ থেকে। এক্ষেত্রেও ইংরেজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রস্তাব করা হয় ক্লাইভের নাম। বিশেষ করে পণ্ডিচেরির দায়িত্বে থাকা পিগটের নামও এসেছিল এ অভিযান পরিচালনায় নেতৃত্বের জন্য; কিন্তু অল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে এমন অভিযানের জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। পক্ষান্তরে হাঁপানি রোগী লরেন্সের পক্ষে বাংলার আর্দ্র-উষ্ণ আবহাওয়ায় অভিযান পরিচালনা করা অনেক কঠিন ছিল। শেষ পর্যন্ত ক্লাইভের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নেতৃত্বের দায়ভার গিয়ে উপস্থিত হয় কর্নেল জন এডলারকর্নের ওপর। তিনি পদাতিক ও নৌযুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন। পাশাপাশি বাংলার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার সাহস ও শক্তিমত্তা তার মধ্যে ছিল। এর পর ইংরেজ বাহিনী সেন্ট ডেভিডের মাটি থেকে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে। আরেক দফা সংঘাতে কেঁপে ওঠার আতঙ্কে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে প্রকৃতিতে।

 

গৌতম বসুমল্লিক : বাংলায় দুর্গাপুজো প্রবর্তনের কৃতিত্ব যাঁরই হোক না কেন, কলকাতায় দুর্গার পুজো প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে, বরিষার ,বেহালা সখের বাজার অঞ্চল,  সাবর্ণ গোত্রীয় রায়চৌধুরী পরিবারের আটচালা মণ্ডপে। তখন অবশ্য কলকাতা শহরে রূপান্তরিত হয়নি, তবে মণ্ডপটি আরও একটি কারণে ঐতিহাসিক। ওই আটচালা মণ্ডপে বসেই ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন তারিখে জোব চার্নকের জামাই চার্লস আয়ারের সঙ্গে ‘সুতানুটি’, ‘গোবিন্দপুর’ ও ‘কলকাতা’ গ্রাম তিনটির হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল রায়চৌধুরী বাড়ির তত্কালীন কর্তাদের সঙ্গে । সুতরাং ওনারাই কলকাতার জনক ।

 

সুবিমল বসাক : সুতানুটী নামটা এসেছে ওই টেক্সটাইল শিল্পের বাড়বাড়ন্ত থেকে। বাঙালির কলকাতার শ্রী ইংরেজ আসার আগে কিরকম ছিল, সেটা ইংরেজরা যে দিল্লির বাদশাকে ১৬০০০ টাকা দিয়েছিল এই তিনটে গ্রাম সুতানুটী, কলকাতা, গোবিন্দপুরের প্রজাসত্ত্ব কেনার জন্য ১৬৯৮ সালে, তা দেখলে টের পাওয়া যায়। সাবর্ণদের ১৩০০ টাকা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সাবর্ণরা তো দেওয়ার মালিক নয়, মোগল আমলে সমস্ত জমিই বাদশার, লোকে প্রজাসত্ত্ব (রেভেনিউ রাইট) কিনতে পারে কেবল, তো কলকাতার সেই প্রজাসত্ত্ব কিনতে বাদশার ফরমান আনতে হয়েছিল। এঁদো জমির জন্য কে ১৬০০০ টাকা দেয়? কলকাতা যদি গণ্ডগ্রাম হত, সেযুগে এই পরিমাণ টাকার ঝুলি হাতে নিয়ে বাদশার দ্বারস্থ হত না ইংরেজ।ব্রিটিশদের আসার আগে সুতানুটি অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বণিক পরিবার ছিলুম আমরা বসাকেরা। আমরা ছিলুম সুতানুটি বাজারে প্রধান বস্ত্রব্যবসায়ী। ব্রিটিশদের আসার পর আমাদের পরিবারের  সমৃদ্ধি ঘটেছিল। আমার পূর্বপুরুষ শোভারাম বসাক (১৬৯০-১৭৭৩)   কোটিপতি ব্যবসায়ী ছিলেন আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বস্ত্র সরবরাহ করতেন। গোবিন্দপুর দুর্গনির্মাণের জন্য ধ্বংস করা হলে বসাকরা উত্তর সুতানুটি হাট (বর্তমান বড়বাজার) অঞ্চলে সরে যায় । পরে মাড়োয়ারিরা আসার ফলে  বসাকেরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সুতানুটি হাটের নামও পরে বদলে  বড়বাজার হয়।  শোভারাম বসাকের উত্তরসূরি রাধাকৃষ্ণ বসাক (মৃত্যু ১৮১১) বেঙ্গল ব্যাংকের দেওয়ান হয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শহরের প্রধান ব্যবসায়িক পরিবারগুলি নগরাঞ্চলীয় সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। শোভারাম বসাক তার উত্তরসূরিদের জন্য সাঁইত্রিশটি বাড়ি রেখে গিয়েছিলেন। রাধাকৃষ্ণ বসাক কেবল বড়বাজারেই রেখে যান ষোলোটি বাড়ি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলকাতার বিকাশ শুরু হলে  বসাকদেরও পতন শুরু হয়।  বসাকদের সঙ্গে সঙ্গে সুতানুটিও কলকাতায় বিলীন হয়ে যায়।  ১৬৯০ সালে সুতানুটিতেই জব চার্ণক প্রথম এসেছিল। এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র কলকাতা শহরটিই বিকশিত হয়ে ওঠেনি, বরং ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূচনায় এখানেই ঘটেছিল। আদি কলকাতার ব্ল্যাক টাউন তথা কলকাতার সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর সুতানুটি আজও কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের কাছে এক পরম আগ্রহের বিষয়। সুতরাং কলকাতার জনক আমরা, জোব চার্ণকের আগে থেকে যারা এখানে ছিলুম ।

কংস নারায়ণ : ১৬ শতকে  বাংলার নবাব দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিল। বাংলা তখন স্বাধীন নবাবের হাতে। পরাক্রান্ত মুঘলদের আটকাতে তাঁরা তৈরি করলেন একশ্রেণীর হিন্দু জনশক্তি। তাঁদেরই একজন ছিলুম আমি ।আমি  নবাবদের সাহায্য নিয়েছিলুম।  নবাবী আমলে কিন্তু দুর্গাপূজা কখনও বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, অবিভক্ত বাংলার  প্রথম দুর্গা পুজোর উদ্বোধন আমি করেছিলুম । তা থেকে প্রমাণ হয় যে ষোড়শ শতকে আমি তখনকার গৌড়ের সুলতানদের কাছ থেকে প্রভূত অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সাহায্য পেতুম। সুতরাং আমার দুর্গাপূজা স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু্–মুসলমানের উৎসব হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল ইংরেজদের বাণিয়া শক্তি। যে যে হিন্দুদের হাতে অর্থ ছিল, তাঁদের হাতে কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না। তাই তাঁরা গোপনে লর্ড ক্লাইভকে সাহায্য করতে শুরু করলেন। এদের পূর্বভাগে ছিলেন কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের শোচনীয় পরাজয়ের পর খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলার রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বিন্যাস ঘটে। রাজতন্ত্র থেকে বাংলার ক্ষমতা এক লাফে চলে যায় বাণিয়াদের হাতে। সেই সময়ে কিন্তু ইংরেজরা সরাসরি ভারতে প্রবেশ করেনি। প্রবেশ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি। আর সেই কম্পানির দৌলতে ইংরেজদের ঘাঁটি হয় কলকাতায়। ফলে তাদের সৌজন্যে কলকাতায় তৈরি হল একশ্রেণীর উচ্চবিত্ত রাজমহল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম শোভাবাজার রাজবাড়ি রাজা নবকৃষ্ণ দেব। নবকৃষ্ণ কলকাতায়  ইংরেজ শক্তিকে তেল মারার জন্য বারোয়ারি দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করেচিল। ইংরেজরা শুধু যোগদানই করেনি, রীতিমতো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল  ছোটলাট ও বড়লাট। আমি ইংরেজদের তেল মারার জন্য দুর্গাপুজো করতুম না ।

 

হাইনরিখ লুশকভ : আমার আসল নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী খান  । আমি  ইরানি বংশোদ্ভূত। আমার বাবার নাম সৈয়দ আহমেদ নাজাফি। আমি বাবা-মা র দ্বিতীয় ছেলে। ইরান থেকে একদম নিঃস্ব হয়ে  বাংলায় এসেছিলুম ভাগ্যান্বেষণে। এখানে এসে বিহারের নায়েব আলীবর্দী খানের অধীনে চাকরি শুরু করি। অনেকেই জানেন না ইরানি ভাষায় খুব সুন্দর গান গাইতে পারতুম আমি । কিন্তু আমি ভালো বাংলা বলতে পারতুম না বলে আলীবর্দী খান নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে সিরাজউদ্দৌলাকে বেছে নেন । পলাশির যুদ্ধে আমি সেই অবহেলার বদলা নিয়েছিলুম ।

 

মীর কাসেম আলী খান : মীর জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমি  ক্ষমতা দখল করেছিলুম। পরে ইংরেজদের সাথে আমার বিরোধ বাধে আর বকসারের যুদ্ধে হেরে যাই ।  ইংরেজদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতুম । অচেনা অবস্থায় দিল্লীতে মারা গিয়েছিলুম । আমার মাথার কাছে পড়ে থাকা একটা পোঁটলায় পাওয়া যায় নবাব মীর কাসেম হিসেবে ব্যবহৃত আমার চাপকান। তা  থেকে লোকে জানতে পারে শবটা বাংলার ভূতপূর্ব নবাব মীর কাসেম আলী খান। জানি না আমার কবর কোথায় । তবে আমিই কলকাতার জনক, কেননা আসল কলকাঠি তো আমিই নেড়েছিলুম ।

ঘনাদা : ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ট্রায়াল অব মহারাজা নন্দকুমার’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, মিডলটনের পত্রালাপ দাখিল করা হলে ওয়ারেন হেস্টিংস ঘুষ নেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হতো। ওয়ারেন হেস্টিংস, তার বন্ধু ইলাইজা ইম্পের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ বের করেছিল। মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি ওয়ারেন হেস্টিংসের জীবন ও কর্মকাল এবং কোলকাতার একটি বিতর্কিত অধ্যায়।মাত্র ২৩ বছর বয়সে সিরাজউদ্দৌলা ১৫ এপ্রিল ১৭৫৬ সালে নবাবী লাভ করেন। তার নবাবীর সময়কাল ছিল মাত্র ১ বছর ২ মাস ৮ দিন অর্থাৎ ৪৩৪ দিন। এ সময়ের মধ্যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা দু’দুবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে কলকাতা অভিযানে স্বয়ং নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ইংরেজদের পরাজিত করেছেন। পূর্ণিয়ার যুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করেছেন। প্রধান সেনাপতি মীর জাফর, সেনাপতি রাজা দুর্লভরাম, উমিচাঁদ, রাজা রায়বল্লভ, ইয়ার লতিফ, জগৎ শেঠ, ঘসেটি বেগম, ইংরেজ সেনাপতি ওয়াটসন, ওয়াটস, ক্লাইভ প্রমুখ সিরাজউদ্দৌলার নবাবীর প্রথম দিন থেকে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে বিশ্বাসঘাতকতা, রাজদ্রোহ ও দেশদ্রোহিতায় লিপ্ত থেকে নবাবকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। তাতে একদিনের জন্য তরুণ নবাবের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো আরাম-আয়েশ ভোগ-বিলাসের সময়-সুযোগ ছিল না। সিরাজউদ্দৌলাই প্রকৃতপক্ষে কলকাতার জনক । 

 

খান আবদুল হাদি :আলিবর্দীর শাসনকালের শেষ দিকে স্বার্থান্বেষী মহল কীভাবে গোটা শাসনতন্ত্রকে নিজেদের হাতের মুঠোয় পুরতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল, সে সম্পর্কে সিরাজকে আমি বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলুম। সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে মীরজাফর আর খাদিম হুসেন খানের একটা বড় অঙ্কের টাকা পকেটস্থ করার বিষয়টা হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়েছিলুম। বস্তুত এই ঘটনাবলী জানার ফলে সিরাজের ভেতরে যে অগ্নিবর্ষী একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল হয়ে উঠেছিল, তা কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল। তাই তারা সিরাজকে দুর্বিনীত, চরিত্রহীন ইত্যাদি নানা অভিধায় অভিহিত করে পলাশী যুদ্ধের পটভূমিকা নির্মাণের কাজটি বেশ জোরদারভাবেই করতে শুরু করে দিয়েছিল। সিরাজই কলকাতার জনক ।

মীর মদন : পলাশীর আমবাগানে আমি আর মোহনলাল  দুই সেনাপতি মিলে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পক্ষে আমৃত্যু লড়াই করেছিলুম। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে অন্য বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিরা নিশ্চেষ্ট থাকলেও আমরা দুজনে ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করি।  প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেয়। মীর জাফর, ইয়ার লতিফ খান, রায় দুর্লভ প্রমুখ নিস্পৃহ থাকলেও আমার গোলন্দাজ বাহিনীর প্রতাপে ইংরেজ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে নবাব বাহিনীর গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও আমি আর মোহনলাল ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলুম। কিন্তু প্রধান সেনাপতি মীর জাফর সিরাজকে বোঝালো যুদ্ধ বন্ধ রাখতে। যুদ্ধ চলার সময়ে গোলার আঘাতে আমি মারা যাই । আমার অনুগত কিছু সৈনিক আমার মৃতদেহকে গোপনে মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের কাছে ভাগীরথী নদী তীরবর্তী ফরিদপুর গ্রামে কবর দে। এখনও ফরিদপুরে ফরিদ খানের সমাধির পাশে অবহেলায় সমাধিস্থ রয়েছি। এছাড়াও পলাশীর স্মৃতিসৌধের কাছে চাষজমির ভেতরে তিনটি অনুচ্চ স্মারক আছে, যা মীর মদন, নৌবে সিং হাজারি আর বাহাদুর খানের স্মৃতিতে তৈরি। পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রের আমবাগান আর নেই । একসময় প্রচুর আমগাছ ছিল। তা ছিল রানি ভবানীর আমবাগান । এখন রাস্তা হয়েছে।  এখানে সমাধিস্থ করা হয় নবাবের আরও দুই বীর কমান্ডার বাহাদুর আলী খান আর ক্যাপ্টেন নৌবে সিং হাজারিকে। বন্দুকধারী ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন বাহাদুর আলী খান। আর গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন নৌবে সিং হাজারি। যুদ্ধের পরপরই এখানে গোপনে তাঁদের সমাধিস্থ করা হয়েছিল। সমাধিস্থলে যাওয়ার কোনো পাকা রাস্তা নেই। পাটখেতের আল ধরে যেতে হয়।

মোহনলাল : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের সময় আমি সিরাজের প্রতি অবিচল বিশ্বস্ততায় যুদ্ধ করেছিলুম। যুদ্ধক্ষেত্রে মীর মদনের মৃত্যুর পরেও আমার একক চেষ্টায় যুদ্ধের গতি সিরাজের অনুকূলে ছিল। কিন্তু নিজ অদূরদর্শিতা ও মানসিক দুর্বলতার কারণে সিরাজ,  মীর জাফর প্রমুখ বিশ্বাসঘাতকদের প্রভাবে যুদ্ধ বন্ধ রাখার আদেশ দেন। ফলত: নবাব বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও শোচনীয় পরাজয় ঘটে। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাইনি।  যুদ্ধে আহত হই আর যখন জানতে পারি যে মীর জাফর আমাকে খুন করার জন্য তল্লাশি চালাচ্ছে, তখন গা ঢাকা দিই। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে আমার বড় ছেলে, পূর্নিয়ার নায়েব নাজিম, শ্রীমন্ত লালকে মীর মিরন খুন করেছিল। ছোট ছেলে হুক্কা লাল পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। আমার বোন ছিল সিরাজের প্রণয়িনী আর আমি তাদের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ময়মনসিংহে চলে যাই। তারপর আমার অজ্ঞাতবাস পর্বের নানা কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে বাংলায় । আমাকে একটি কলঙ্কিত চরিত্র হিসেবেই ব্রিটিশরা তুলে ধরেছিল। অথচ আমি পলাশীর যুদ্ধে সমস্ত রকমের বিরুদ্ধাচরণকে অস্বীকার করে যেভাবে দেশের হয়ে লড়েছিলুম, সে সম্পর্কে ইতিহাস প্রায় নীরব। সিরাজের কলকাতা অভিযানকালেও (১৭৫৬) আমি যে দক্ষতা আর অসমসাহসের পরিচয় রেখেছিলুম, সেই ইতিহাসও বাঙালির কাছে তুলে ধরা হয় না। পূর্ণিয়া অভিযান এবং পূর্ণিয়ার শাসনব্যবস্থার খোলনলচে বদলাতে আমার ঐতিহাসিক অবদানের কথা ব্রিটিশরা চেপে গেছে। পলাশীর পরিপ্রেক্ষিত রচনার ক্ষেত্রে চন্দননগরকে ঘিরে ফরাসি এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির টানাপোড়েনে সিরাজকে সঠিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে আমার আর মীরমদনদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সঠিক। ফলে জগৎ শেঠদের  মতো লোকেরা ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল যে সিরাজ কোনো অবস্থাতেই তাদের হাতের পুতুল হবেন না। জগৎ শেঠের সঙ্গে আমার সংঘাতের স্বরূপটা বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিল মীর জাফর। 

শওকত জঙ্গ : আমি হলুম বাংলার নবাব আলীবর্দী খান-এর নাতি আর সিরাজউদ্দৌলার পিসতুতো ভাই।আলীবর্দী খানের ছিল তিন মেয়ে। তিন মেয়েকেই উনি নিজের বড়ভাই হাজি আহমদ-এর তিন ছেলে, নোয়াজেশ মোহাম্মদের সাথে বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের, সৈয়দ আহমদ খান সওলত জং সাথে মেজ মেয়ে মায়মুনা বেগমের আর জয়েনউদ্দিন আহম্মদের সাথে ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের বিয়ে দেন। তিনি ছিলেন আলীবর্দী খানের মেজ মেয়ে মায়মুনা বেগমের সন্তান। আমিও চেষ্টা করেছিলুম সিরাজকে সরিয়ে সিংহাসনে বসতে । অথচ পলাশীর পর কেউ আমাকে পাত্তা দিল না । 

শশী ঘোষ : কলকাতা বিশ্বের সব থেকে পুরনো শহরের মধ্যে অন্যতম। এমন একটা শহর যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ইতিহাস। এই ইতিহাসে রয়েছে যেমন ভালবাসা ঠিক তেমনি রয়েছে রোমাঞ্চ। ধরুন আপনার কাছে একটা টাইম ট্রাভেল মেশিন আর সেই টাইম ট্রাভেলে করে এসে পৌঁছালেন পুরনো শহরে। কলকাতায় তখন ব্রিটিশ রাজ। আপনার জানার মধ্যে শুধু ধর্মতলা আর স্রেফ কয়েকটা জায়গার নাম। বাকি অংশ শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। ধর্মতলা থেকে রাজভবন হয়ে এগোতে শুরু করলেন অফিসপাড়ার দিকে। এই জায়গা তখন শুধু নির্জন রাজপথ। কলকাতার ওয়েলেসলি প্লেস থেকে কাউন্সিল হাউজ পর্যন্ত এই রাস্তাটিকে তখন বলা হত 'ফ্যান্সি লেন'।মনে হতেই পারে ব্রিটিশ আমলের কোনও ইংরেজের শখ বা শৌখিনতার সঙ্গে এর নিশ্চয় রাস্তার সম্পর্ক আছে। যার জন্যে এর নাম হয়েছে 'ফ্যান্সি লেন'। তবে বলে রাখি আপনার এই মনে হওয়াটা একদমই ভুল। ইংরেজী শব্দ ফ্যান্সির সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।এই 'ফ্যান্সি' কথাটা এসেছে 'ফাঁসি' শব্দ থেকে। আঁতকে উঠলেন বুঝি! ফাঁসি। তাও প্রকাশ্য দিবালোকে। ভরা রাস্তার উপর। জনসাধারণের চোখের সামনে। বীভৎস এই ঘটনার সাক্ষী থেকেছে শহর কলকাতা! সাহেবি উচ্চারণে 'ফাঁসি'টা হয়ে গিয়েছে ফ্যান্সি, ফলে গোটা মানেটাই ঘেঁটে ঘ ! ঐতিহাসিকরা বলছেন, ইংরেজি 'ফ্যান্সি' (Phancy) শব্দটি যে 'শৌখিন' অর্থে ব্যবহৃত হয়, এই রাস্তার নামের মানে মোটেই তা নয়। কলকাতার অন্যতম পুরনো রাস্তা এটি, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু ঘটনা। একটা সময় এর পাশ দিয়ে একটা খাল বা 'ক্রিক' প্রবাহিত হত বলে জানা যায়। এখন অবশ্য সেটি মুছে গেছে। আর্চডিকন হাইড তাঁর 'প্যারোকিয়াল অ্যানালস' এবং 'পেরিশ অব বেঙ্গল' বই দুটিতে সেই বর্ণনা দিয়ে গেছেন— “The creek took a half turn round this battery and kept Eastwards beneath three gated bridges, until the fences turned downwards from it at Fancy Lane.” তখন খুব বেশি দিন হয়নি ইংরেজরা কলকাতায় এসেছে। জোব চার্নক তখনও জীবিত। ডালহাউসির কাছে এখন যেখানে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট, বিলিতি আমলে একেবারেই লালদিঘির প্রায় গা-ঘেঁষা সাহেবপাড়া। গোটা জায়গাটাই ছিল জঙ্গল। লোকজন তখন এই ধারে তেমন ঘেঁষতে সাহস পেত না। লোকজন বিশেষ ছিল না বললেই চলে।চারপাশে শুধু অজস্র গাছ, আর তাঁতে লুকিয়ে থাকতো চোর-ডাকাত। সে অন্য যুগ। অন্য জগৎ। জব চার্নকের কলকাতায় তখন নতুন রাজত্ব। সাহেবদের শৌখিনতা তখন গরিব লোকদের ফাঁসি দেওয়া। অপরাধ তখন যাই থাকুক না কেন একটাই শাস্তি ফাঁসি। ১৮০০ সালের কথা। ঢেঁড়া পিটিয়ে বেড়াচ্ছে কম্পানির লোক। কী, না ব্রজমোহনের ফাঁসী হবে। ব্রজমোহনের অপরাধ একটা মুল্যবান ঘড়ি সে চুরি করেছে। যার দাম ২৫টাকা। সে ফাঁসি হবে প্রকাশ্য স্থানে কোনও চৌমাথায়। বহু লোকের সামনে। চারদিকে থেকে পিল পিল করে লোক আসছে। ফাঁসি দেখবে। আজকের ওয়েলেসলি প্লেসে তখন অনেক বড় বড় গাছ ছিল। সেখানেই বসলো মেলা। রাস্তার মোড়ে একটি গাছের কাছে তৈরি করা হয় ফাঁসির মঞ্চ। ফাঁসি হল। সবাই ইংরেজদের এই ন্যায়পরায়ণতা দেখে ধন্যি ধন্যি করল। সেই সময় থেকেই রাস্তার মাঝখানেই এইভাবে ফাঁসি দেওয়া আরম্ভ হল। অত্যন্ত লঘু অপরাধেও অনেক সময় ফাঁসি দেওয়া হত। রাস্তার ধার ঘেঁষে সার সার ঝুলে থাকত দেহ। ফাঁসি দেওয়া রাস্তাটির নামই পরবর্তীকালে হয়ে যায় 'ফ্যান্সি লেন' যা বর্তমান পান্নালাল রোড। ইংরেজদের মুখে মুখে 'ফাঁসি' শব্দটাই বদলে হয়ে গিয়েছিল 'ফ্যান্সি'। সেই থেকেই এই নাম। পুরনো কলকাতা নিয়ে লেখায় শ্রীপান্থ বলছেন, মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি দেখে সবাই ফিরেছিলেন গঙ্গাস্নান করে।কারণ নন্দকুমার ছিলেন ব্রাহ্মণ। ব্রহ্মহত্যা দেখার মহাপাপ ধুয়ে ফেলতে গঙ্গাস্নানই ছিল সামাজিক বিধান। তবে সাধারণ অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট যে রাস্তা ছিল, সেখানে মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি। গলিটিতেই এখন রয়েছে রাজভবনের স্টাফ কোয়ার্টার্স। আর কিছু অফিস ও দু'একটি দোকান। এবং ব্রিটিশ আমলের চিহ্ন নিয়ে ভেঙে-পড়া পুরোনো বাড়ি। পুরনো কলকাতার এই ভয়ঙ্কর ইতিহাস অনেকেরই হয়তো অজানা। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে নন্দকুমার ছিলেন কলকাতার জনক ।

 

সুপ্রীতি বর্মণ : কলকাতা শহরকে ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে ১৭৫৬ সালের জুন মাসে সিরাজ অতর্কিতে কলকাতা আক্রমণ করেন। ইতিমধ্যে কোম্পানি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছিল। ২০ জুনের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার পতন ঘটে। ফলে ভারতীয়রা শহরের দখল নেন।এরপর সেনাপতি মানিকচাঁদের হাতে দুর্গের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা রাজধানীতে ফিরে আসেন, ১২ জুলাই । কলকাতার নতুন নাম দেন – আলিনগর । এই নামটার একটা ধারা মেনেই – বর্তমান কলকাতার একটা অংশের নাম – আলিপুর ।

 

আলীবর্দী খান : ১৭৫৬ সালে কলকাতায় দুর্গনির্মাণে বিরক্ত হয়ে আমার নাতি নবাব সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করেছিল। কলকাতা অধিকারের পর সিরাজ এই শহরের নাম বদল করে আমার নামানুসারে ‘আলিনগর’ রেখেছিল । ১৭৫৮ সালে ইংরেজরা কলকাতা পুনরুদ্ধার করলে পুরোনো নামটা আবার বহাল হয়। তবে সিরাজের কলকাতা দখল ছিল ইংরেজদের কাছে এক দুঃস্বপ্নের সময়। এই যুদ্ধে গোবিন্দপুর, সুতানুটি, কলকাতা ও চিৎপুরের মধ্যে কেবলমাত্র ‘হোয়াইট টাউন’ নামে পরিচিত কলকাতা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ‘ব্ল্যাক টাউন’ খুব একটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। কেবল বড়োবাজারে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল আর ইংরেজরা গোবিন্দপুর গ্রামটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। হুগলি নদীর চল্লিশ কিলোমিটার ভাটিতে ফলতায় ইংরেজরা পালিয়ে যায়। আলিনগর নাম থেকে প্রমাণিত যে আমিই কলকাতার জনক । 

মহারাজা নন্দকুমার : পলাশীর ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে মীর জাফর দেওয়ান নিযুক্ত করে সব সময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন। নন্দকুমার ভূষিত ছিল মহারাজা উপাধীতে। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস এর সাজানো মিথ্যা মামলায় আসামীর কাঠগড়ায় তার বিচার হয়। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস তাকে শেষ পর্যন্ত এই বিচারের রায়ে শেওড়াগাছে ঝুলতে হয় ফাঁসী কাষ্ঠে। মহারাজ নন্দকুমারের সাথে মীর জাফরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মীর জাফর তার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজ কর্ম নন্দকুমারের পরামর্শনুসারে করতেন। তার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তার মুখে কিরীটেশ্বরী দেবীর চরণামৃত তুলে দিয়েছিলেন।

ধিরুভাই অম্বানি : বাঙালি বাড়ির বউরা আমার বউয়ের মতন হলে আজ পশ্চিমবাংলা অনেক ধনী রাজ্য হতো । একটা উদাহরণ দিই । দ্বারকানাথের ইংরেজ-সংসর্গ তাঁর মা বা স্ত্রী কেউই ভাল চোখে দেখেননি। দ্বারকানাথ এ ব্যাপারে স্ত্রীর মতামত অগ্রাহ্য করলে দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতেও ইতি টানেন। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে, দিগম্বরী হিন্দু পণ্ডিতদের ডেকে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে একত্রে পানভোজন করা স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদের বিধানও চেয়েছিলেন। পণ্ডিতেরা নিদান দেন, ‘স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার সেবা অবশ্য কর্তব্য, তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্তব্য।’ স্ত্রীর সাংসারিক দায়িত্বটুকু পালন করা ছাড়া দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখেননি। কাজের সূত্রে দ্বারকানাথের সঙ্গে যত বার কথা বলতে হত, তত বারই নাকি তিনি গঙ্গাজলে চান করতেন, এমন কথাও শোনা যায়। সুতরাং দ্বারকানাথই কলকাতার জনক।

জয়িতা ভট্টাচার্য : কলকাতায় ইংরেজরা তাদের বসতির বাইরে দুর্গপ্রাচীরের মতো প্রতিরক্ষা বেষ্টনী তৈরির চেষ্টা নিলে নবাবের নির্দেশে তা ধ্বংস করা হয়। একইভাবে ফরাসিরা প্রাচীর নির্মাণ করলেও তারা নবাবকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, এটা কোনো দুর্গ না, বরং স্থাপত্যিক কাঠামোর সংস্কার করা হচ্ছে মাত্র। নবাব ফরাসিদের কথা বিশ্বাস করলেও ইংরেজদের বিশ্বাস করতে চাননি। ফলে ফরাসিরা তাদের দুর্গপ্রাচীর টিকিয়ে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করা হয় ইংরেজদের দুর্গ। তবে এখানকার মূল বাস্তবতা হচ্ছে, ইংরেজরা যে দুর্গপ্রাচীর নির্মাণ করেছে, সেটা যতটা না নবাবের বিরুদ্ধে যায়, তার চেয়ে ঢের ফরাসিদের প্রতিরোধে কার্যকর হতো। এক্ষেত্রে তার খালা ঘষেটি বেগমের চক্রান্ত করার সুযোগ হয়ে যায়। পাশাপাশি কুশলী ইংরেজ গভর্নর রজার ডেরেক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইলেন। সব মিলিয়ে যুবক সিরাজদ্দৌলার পক্ষে এ ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনায় উপযুক্ত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়নি। ক্ষিপ্ত সিরাজদ্দৌলা এবার প্রতিটি ক্ষেত্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করে কলকাতার দিকে অগ্রসর হন। ইংরেজরা প্রথম থেকেই নবাবকে প্রতিরোধ করার মতো সাহস রেখেছিল; কিন্তু তাদের সামরিক ছাউনিতে উপযুক্ত সংখ্যায় সৈন্য ছিল না। এতে তাদের মনে ত্রাস সৃষ্টি হয়। তাই তারা নবাবের বাহিনীর আগমন বুঝতে পেরে কুঠি ত্যাগ করে। গভর্নর ডেরেক সপরিবারে চেপে বসেন একটি জাহাজে। এর পর পুরো কুঠি নবাবের আনুকূল্যে চলে যায়। আর কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যার গাঁজাখুরি গল্প ফাঁদা  হয় ঠিক এর পর পরই। কলকাতার পতন হলে ভারতে অবস্থানরত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসেন। দীর্ঘ বৈঠকের পর কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ছয় সপ্তাহের প্রস্তুতি চলে সেন্ট ডেভিড দুর্গে। 

বাহাদুর শাহ জাফর : মূলত জোব চার্ণকের সহস্র দোষ ছিল এবং সুতানুটিতে যখন সে  ১৬৯০ সালে পৌঁছেছিল  তার তিনবছর পরই সে যৌনরোগের কারণে দেহত্যাগ করে তাই কখনই তাঁকে কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠাতা বলা সম্ভব নয়। এরপর ১৬৯৬সালে চার্লস আয়ার(জোব চার্ণকের জামাই) কলিকাতা কুঠীর এজেন্ট হিসাবে নিযুক্ত হয়। সেই সময় চার্লস আয়ার চক্রান্ত করে আওরঙজেবের পৌত্র পাটনা-নিবাসী আজিম উস শানের থেকে একটা সনদ নিয়ে আসে। এই সনদটি আনবার জন্য আজিম উস শানকে ষোল হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছিল কোম্পানি । তাতে লেখা থাকে যে বাংলার সকল জমিদারদের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু সাবর্ণরা এই আদেশপত্রে সাক্ষর করতে রাজি ছিলেন না তবুও সম্রাটের আদেশ মতন বড়িশার আটচালায় চার্লস আয়ারের সাথে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের প্রজাসত্ত্ব হস্তান্তরিত হয় বার্ষিক ১৩০০টাকা খাজনার বিনিময়ে। এই খাজনা ব্রিটিশ কোম্পানি ১৭৫৭ সাল অবধি সাবর্ণদের দিতো । সুতরাং কলকাতা কখনই বিক্রি করে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় বড় বর ইমারত তৈরি হলেও প্রথম ইমারতটি তৈরি হয়েছিল জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীদের আমলেই। সুতরাং সাবর্ণরা প্রজাসত্ত্ব হস্তান্তরিত করেছিল, জমিদারিসত্ত্ব নয়। এই প্রজাসত্ত্ব ছিল বাদশাহের অধীনস্থ তালুকদারের অধিকার। কেন না, অন্যান্য জায়গীরের মতন সুতানুটি, কলিকাতা এবং গোবিন্দপুরের জমিদারিসত্ত্ব বিক্রি করার অধিকার সাবর্ণদের ছিল না। সুতরাং এতদিন যারা এই বিক্রি করার গল্প সাজিয়েছেন তারা নিতান্তই ব্রিটিশ তোষণের জন্যই করেছেন এর কোন বাস্তবিক ভিত্তি নেই। সুতরাং কলকাতার জনক আজিম উস শান ।

 মীর মোহাম্মদ আলী খান : লোকে আমাকে মীরণ নামে এক ডাকে চেনে । আমি পলাশী ষড়যন্ত্রের পরবর্তী ঘটনাগুলোর প্রধানতম নায়ক। আমিই সিরাজের মূল হত্যাকারী, সিরাজের মাতা আমেনা বেগম, সিরাজের ভাই মির্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছিলুম । আমারই নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে খুন করে। শুধু খুন  নয় ; সিরাজউদ্দৌলার লাশকে আমি ক্ষত বিক্ষত করে তারই প্রিয় হাতির পিঠে  বেঁধে গোটা মুর্শিদাবাদ শহর ঘুরিয়েছিলুম যাতে সবাই এই বীভৎস দৃশ্য দেখে যেনো পরবর্তীতে বাংলার বুকে বিদ্রোহ করতে না পারে।  সিরাজের মা আমেনা বেগম তার ছেলের লাশ দেখার জন্য দৌড়ে হাতির কাছে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান আর সে’সময় মীরণের স্যাঙাতরা সিরাজের মাকে কিল, চড় ও ঘুষি মেরে আবার জেলখানায় বন্দী করে রাখে। হাতিটা কিন্তু সে সময় সিরাজের লাশ তার পিঠে নিয়ে আমেনা বেগমের সামনে বসে পড়ে। আমার মৃত্যু ঘটে বজ্রপাতে। মীর জাফর তখনও বাংলার নবাব। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই পিতার কানে সে সংবাদ পৌঁছেছিল। তিনি মীরণের মৃত্যু শুনে বেঁহুশ হয়ে পড়েন। মুর্শিদাবাদে মীরণের লাশ, নিয়ে আসা হলো। কি বীভৎস বিকৃত পোড়ালাশ। পিতাকে না দেখতে দিয়ে লাশ দাফন করা হলো। এভাবেই মীরণের মৃত্যু। এটা আর কিছুই নয় আসল ঘটনাকে চাপা দেওয়ার একটা কৌশল মাত্র। মীরণকে খুন করে ইংরেজদের নির্দেশে মেজর ওয়ালস্। তবে  এই ঘটনাটা ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইংরেজরা বজ্রপাতে মীরণের মৃত্যুর মিথ্যা গল্প বানিয়েছিল।

 মোহাম্মদী বেগ : আমি ছিলুম নবাব আলীবর্দী খাঁর খাস চাকর। আলীবর্দী খাঁর আমল থেকেই তাঁর পরিবারের একজন সদস্যরূপে তাঁরই স্নেহছায়ায় আমি বেড়ে উঠি। সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গেও আমার বিশেষ সখ্যতা ছিল। সিরাজউদ্দৌলাকে মীরণের নির্দেশে হত্যা করেছিলুম আমি । আমি একটা খঞ্জর দিয়ে আঘাত করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলুম। দিনটি ছিল ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ৩’রা জুলাই। নবাব সিরাজ এ সময় আমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি । তিনি কেবল আমার কাছ থেকে দু’রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। বলাবাহুল্য  সিরাজের সেই অন্তিম ইচ্ছাও প্রত্যাখ্যান করেছিলুম।  সংসারের দাম্পত্য কলহে বদ্ধ উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলুম আর একদিন কুঁয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করি। 

 ইয়ার লতিফ খান : আমি ছিলুম নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি।  পলাশী ষড়যন্ত্রের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলুম। পলাশীর যুদ্ধের মাঠে আমার সেনারা মীর জাফর, রায় দুর্লভের বাহিনীর মতন কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধের পরে বখরা দেবার ভয়ে ইংরেজরা আমাকে খুন করে লাশ লোপাট করে দিয়েছিল ।

মেহের উন নিসা বেগম : লোকে আমাকে ঘসেটি বেগম নামেই বেশি চেনে । আমি  নবাব আলীবর্দী খানের বড় মেয়ে। বিয়ে হয়েছিল নওয়াজিস মুহম্মদ শাহমাত জং-এর সাথে  যিনি  ঢাকার নায়েব নাজিম নিযুক্ত হয়েছিলেন। নিঃসন্তান হওয়ায় আমি আর আমার স্বামী সিরাজউদ্দৌলার ছোটো ভাই ইকরামউদ্দৌলাকে দত্তক নিয়েছিলুম। কিন্তু ইকরামউদ্দৌলা তরুণ বয়সে গুটিবসন্তে মারা যায়।  নওয়াজশ মুহম্মদ দুঃখে মারা যান। আমি উত্তরাধিকার সূত্রে  স্বামীর  প্রচুর সম্পদ পেয়েছিলুম । নবাব আলীবর্দী খান মারা যাবার পরে, আমি চেষ্টা করছিলুম দ্বিতীয় বোন মায়মুনা বেগমের ছেলে শওকত জংকে সিংহাসনে বসানোর। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসতে করতে সমর্থ হয়। শেষে, তিনি আলীবর্দী খানের সেনাপতি মীর জাফর, ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ আর উমিচাঁদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করি। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা হেরে যাবার পর ইংরেজরা মীর জাফরকে নবাব বানায়।মীর জাফর, আমাকে ঢাকার জিনজিরা প্রাসেদে বন্দি করে রেখে ডিয়েছিল। কিন্তু আমাকে বিপদজনক শত্রু মনে করে, মীর জাফরের ছেলে  মীরন আমাকে ১৭৬০ সালে মুর্শিদাবাদ ফেরত নিয়ে আসার আদেশ দেয়। , মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে আমাদের নৌকো খরস্রোতা বুড়ীগঙ্গা নদীতে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আমাকে নৌকায় তুলে বুড়ীগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে মেরে ফেলে। আমার আর্তনাদ আহাজারী নদীর কিনার থেকে নিশুতি রাতে পথচারীরা শুনতে পেয়েছিল।

ওয়াটস : আমি কোম্পানির একজন আমলা । পলাশীর যুদ্ধে  ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল আমার। আমি পাল্কীতে করে বউ  সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে চুক্তিতে মীর জাফরের স্বাক্ষর এনেছিলুম। পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানীর কাছ থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় ইংল্যান্ডে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাই।

 

প্রদোষচন্দ্র মিত্র : সাম্রাজ্যবাদের পূজারিরা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জোব চার্নককে কলকাতার ‘বাবা’র আসনে বসানোর যত অপচেষ্টাই করুন না কেন, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের এবং ভারতবর্ষের মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করবেনই। প্রসঙ্গত শেষ বার যখন চার্নক সুতানুটিতে এসেছিলেন তখন তিনি বর্তমান বেনেটোলা আর শোভাবাজারের মধ্যবর্তী মোহন টুনির ঘাটে নেমেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। তবে জোব চার্নক কলিকাতা বা গোবিন্দপুরে আসেননি, কারণ তিনি গুপ্তরোগে আক্রান্ত ছিলেন। এবং তাঁর অবস্থা ছিল বড়োই শোচনীয়। প্রায় দু’শো লোক তখন জ্বরে ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত। তার ওপর তিনিও আক্রান্ত। শেষ বয়সটা সুতানুটিতে কাটিয়ে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। তা হলে তাঁকে কেন কলকাতার জনক বলা হবে? তা ছাড়া কলকাতা নামের উৎপত্তি বহু প্রাচীন গ্রন্থেই পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের অনুমান, কলকাতা দু’ হাজার বছরের পুরোনো এক জনপদ। ‘আইন-ই-আকবরি’র রাজস্ব আদায়ের খতিয়ানে ‘কলিকাতা’ নামের উল্লেখ আছে। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে (১৪৯৫-৯৬), কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ কলিকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। ওলন্দাজ বণিক ফান ডেন ব্রুক-এর অঙ্কিত মানচিত্রেও কলকাতার উল্লেখ রয়েছে। ‘পদ্মাবতী’র রচনাকাল আনুমানিক ১৬৪৫-৫২ সাল। সেই গ্রন্থেও কলকাতা রয়েছে। তা হলে কখনোই জোব চার্নককে কলকাতার জনক বলা যায় না। তা ছাড়া চার্নক আসার বহু আগে থেকেই কলকাতা ধীরে ধীরে শহরে রূপান্তরিত হতে শুরু করে – পাকাবাড়ি, পাকা রাস্তা, বাণিজ্যনগরীর নানান কাজও শুরু হয়ে যায় চার্নক আসার বহু আগে থেকেই। তাই এ তত্ত্ব কখনোই সমর্থনযোগ্য নয় যে জোব চার্নক কলকাতার জনক ।

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন