হাংরি সাহিত্যের সংগ্রহশালা

শুক্রবার

অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ৭ )

Aftershock শুরু হলো তারপর । শৈলেশ্বরের হাত ঝাপটানিতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে সরে গেলেন অনেকে। অরুণেশ তো সরে গিয়েছিলেনই সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁর কিছু কাছের মানুষজনকেও যাদের কাউকে কাউকে আমরাও কাছের মানুষ ভাবতাম। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু এসে গেল না। বরং কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পের কভারে লিখে দিলাম, “সত্যের ঘাত অসহ্য হলে বুর্জোয়া ভাইরাসেরা গড়িয়ে যায় নিজস্ব ভাগাড়ের দিকে।” লিখে দিলাম, “ জানি পাঠক, তুমি পাজামা কিংবা পেন্ডুলাম নও।”
কিন্তু আমাদের কিছু না এসে গেলেও একজনের গিয়েছিল, সুভাষ ঘোষের। চটে গিয়েছিল সুভাষ-শৈলেশ্বর রসায়ন। যদিও নিজস্ব অবস্থান এবং অসহায়তার কথা বন্ধু ‘শৈলেশ’কে আপ্রাণ বোঝাতে চেয়েছিলেন সুভাষ কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই ব্যর্থতা এতটাই চরমে উঠেছিল যে খোদ কোলকাতাতেই শৈলেশ্বরের ইশারায় সুভাষকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিতও হোতে হয়েছিল। বাল্যবন্ধুর সেই লাঞ্ছনা সংবাদ উত্তরবঙ্গের অনুচরদের কাছে পৌঁছে দিতে দ্বিধা দেখাননি শৈলেশ্বর ঘোষ।
হ্যাঁ, ততদিনে এক অলিখিত নিয়মে ক্ষুধার্ত শিবির ত্রিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে যেটা আমাদের আদৌ অভিপ্রেত ছিল না। এক শিবিরের অধিনায়ক শৈলেশ্বর ঘোষ। অন্য শিবিরের অধিনায়ক মলয় রায়চৌধুরী এবং তৃতীয় শিবির কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, যার নেতৃত্বের দায় জোর-জবরদস্তি চাপিয়ে দেয়া হলো সুভাষের কাঁধে। অথচ আমরা কোনদিনই কারো নেতৃত্বকে স্বীকার করার মতো অবস্থানে ছিলাম না। সুভাষও অপচেষ্টা করেনি চেপে বসার তবু ইতিহাসের রসিকতা বোধের ফের একবার প্রমাণ পাওয়া গেল। ইতিহাসের রসিকতা বলার কারণ সেই ষাটের দশকে প্রকাশিত সুভাষের একটি গদ্যগ্রন্থের নাম ছিল,‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট।’ নামকরণের সেই ক্ষণে সুভাষ কি আদৌ ধারণা করতে পেরেছিলেন ভাবী সময় কোনদিন তাকে সত্যি সত্যি এমন জায়গাতেই এনে দাঁড় করাবে?
রসিকতা দূরে থাক, মূল সত্য এটাই যে, এরপরও সুভাষ ঘোষের কোনো নিজস্ব শিবির ছিল না। ছিল না নিজস্ব অনুচর বাহিনী। ছিল না সঙ্গী নির্বাচনের উপযুক্ত কোনো মেটাল ডিটেক্টর। এমন কী মনমতো হাংরি ইতিহাস লেখারও কোনো অ্যাজেন্ডা ছিল না। যা ছিল তা শুধু ঘাড় নীচু করে লিখে যাওয়া, নিজের লেখা পাঠ করে শোনানোর পাশাপাশি তরুণ লেখকদের লেখা শোনা এবং মতামত দেয়া। এছাড়া বেঁচে থাকার অন্য কোনো উদ্দেশ্যও ছিল না সুভাষের। যে কোনো যৌথতায় বিনা আমন্ত্রণে হাজির হোতে আপত্তি ছিল না কোনো।
আমাদের অবাধ্য হওয়ার নমুনা পাওয়া মাত্র শৈলেশ্বর ঘোষ ভিন্ন শিবিরের খোঁজার পালা শুরু করে দিয়েছিলেন। সৃষ্টিশীলতা, ইতিহাস প্রসিদ্ধি এবং ক্ষুরধার বুদ্ধির ত্র্যহস্পর্শে পেয়েওছিলেন তৃতীয় প্রবাহের সন্ধান। তবে এক্ষেত্রে খানিকটা সমঝোতা করতে উনি রাজী হয়েছিলেন। যেমন ওই শিবির কবি শৈলেশ্বরকে স্বীকৃতি দিলেও ক্ষুধার্ত আন্দোলনের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতিশীল ছিল না। অবশ্য তখন শৈলেশ্বরের তাতে আর কিছু এসে যায় না। মলয়ের লাগাতার আক্রমণে ক্ষুধার্ত আন্দোলন তখন শৈলেশ্বরের কাছে বোঝা স্বরূপ।
যথারীতি সে পর্বও দীর্ঘদিন লাস্টিং করলো না। করার কথাও নয়, জানতাম আমরা। কিভাবে জানতাম বলতে চাইছি না। অহেতুক তৃতীয়পক্ষকে টেনে কী লাভ! বরং সেসময়ের একটা শ্লোগানের কথা বলি-- “অস্তিত্ব পুড়ছে, আসুন সেই আলোয় আমরা পরস্পকে শনাক্ত করি।”

আগুন নিয়ে যতই কাব্য রচিত হোক, আগুন বেচারি বড্ড অবোধ। পুড়িয়ে ফেলেই তার তৃপ্তি, শনাক্তকরণের ধার ধারে না। আমিও তো তুষার রায় নই যে এতদিন পর ছাই ঘেঁটে বলে দেবো পাপ ছিল কিনা!
শৈলেশ্বর, সুভাষ, অরুণেশকে নিয়ে অনেক কথাই হলো, এবার অন্য হাংরিদের প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।



  • এর দ্বারা পোস্ট করা আমরা পঞ্চপাণ্ডব এই সময়ে ১১:২৫ PM কোন মন্তব্য নেই:
    এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!X-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন
    লেবেলসমূহ: অলোক গোস্বামী, আভাঁ গার্দ, মলয় রায়চৌধুরী

    বুধবার

    অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ৬ )

    কিন্তু অরুণেশ হাত তুলে নিলেই তো কেসটা চুকেবুকে যায় না। শেষ না দেখে ছাড়ার বান্দা শৈলেশ্বর ঘোষ নন। আরেক জন তো রয়েছে, সে দিক কৈফিয়ত।
    কে সে? সুভাষ ঘোষ। সুভাষ ঘোষ কেন? কারণ ততদিনে বেশ কয়েকবার উত্তরবঙ্গে এসেছেন সুভাষ। আমরাও গিয়ে থেকেছি ওর বাড়িতে। সুতরাং উত্তরবঙ্গ নামক ফ্রন্টটিকে দেখভালের অলিখিত দায়িত্ব সুভাষের ওপরই ন্যস্ত করেছিলেন শৈলেশ্বর। যদিও প্রকৃত ঘটনাটা ছিল উল্টো। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়মিত লেখা দেয়া এবং আমাদের লেখাপত্রের পাঠ প্রতিক্রিয়া জানানো ছাড়া সুভাষের অন্য কোনো ভূমিকাই ছিল না। এমন কী ফালগুনি রায়ের রচনা প্রকাশ করার যে পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করেছিলাম, সেটাও ছিল আমাদের নিজস্ব। কিন্তু সে কথা শৈলেশ্বর ঘোষ বিশ্বাস করলে তো!
    বাল্যবন্ধু তথা একসঙ্গে বালুরঘাট ছেড়ে মহানগরে আসা শৈলেশ্বরের আজ্ঞাকে মান্যতা দিতে বাধ্য হলেন সুভাষ ঘোষ। এলেন শিলিগুড়িতে। জমিদারী মানসিকতাকে ঘৃণা করা এবং নামাবলি খান খান করার কাজে আস্থা রাখা সত্বেও বন্ধুর ক্রোধে বিচলিত সুভাষ সমঝোতার কথা বলতে চাইলেন আমাদের সঙ্গে। স্বজন ধ্বংসী যুদ্ধে মূলতঃ কারা লাভবান হবে, বোঝাতে চাইলেন। সাদা বাংলায় যাকে বলে, কুরুক্ষেত্র থেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরাতে চাইলেন। এবং ব্যর্থ হলেন। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ আমাদের প্রতিবাদ কোনো ব্যক্তিগত অসূয়া কিংবা নেতৃত্বের লোভ জাত ছিল না। আমরা কোনো গদীর ভাগ চাইনি যে সমঝোতা করবো, বরং চেয়েছি, ফের একবার আন্দোলিত হোক বাংলা সাহিত্য। শুধু মাত্র কয়েকজন ব্যক্তি নন, সেই আন্দোলনের শরিক হোন প্রতিটি সাহিত্য পিয়াসী মানুষ। অন্ততঃ যারা,‘সৎ সাহিত্য’-- এমত শব্দবন্ধে আস্থা রাখেন। আর তার জন্য যেহেতু স্ববিরোধিতা মুক্ত হওয়াটা জরুরী তাই আঙুল তুলেছিলাম স্ব-ত্রুটিগুলোর বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো, আমাদের আঙুল কিন্তু কারো কোনো ব্যক্তিগত ত্রুটি-বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ওঠেনি। উঠেছিল সাহিত্য কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার স্ববিরোধিতা নিয়ে। এবং সেসবের লক্ষ্য শুধুই শৈলেশ্বর ঘোষ ছিলেন না, প্রায় সবাই ছিলেন। এমন কী নিজেদের ছাল চামড়া খুলে নিতেও দ্বিধা ছিল না আমাদের।
    সুতরাং সম্মীলিত ভাবে দূত সুভাষকে চেপে ধরা হলো । না, কমরেডশিপে আস্থা রাখা মানুষটিকে এক তিলও সরানো গেল না । বন্ধু শৈলেশ সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করা তো দূরস্থান, শুনতেও নারাজ। বাকি বন্ধুদের ক্ষেত্রেও সেই একই নীতি। কিন্তু আমরা যে পাল্টা যুক্তিগুলো তুলে ছিলাম সুভাষের পক্ষে সম্ভব হয়নি সেসব খন্ডন করাও। খন্ডন করতেও চাননি হয়তো। কেননা সমঝোতার পরিণতি কী--সেটা সুভাষ হাড়ে হাড়ে জানতেন। তাছাড়া কবি শৈলেশ্বরকে তো আমরা কখনই অস্বীকার করিনি! যেভাবে করতে চাইনি বাংলা সাহিত্যে ক্ষুধার্ত আন্দোলনের ভূমিকা।
    স্থির করা হলো পত্রিকার তরফ থেকে এমন একজন ক্ষুধার্তের সাক্ষাতকার নেয়া হবে যিনি সোজা সাপ্টা প্রশ্নের উত্তর সোজা সাপ্টা ভাবেই দেবেন। কোনো ছেঁদো দার্শনিকতার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে বিষয়টা ঘুলিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না।
    কিন্তু কে সেই ব্যক্তি?

    বলাবাহুল্য দুই সনত্, অরুণেশ এবং শৈলেশ্বরের নাম ধর্তব্যের মধ্যেই আসেনি। প্রদীপ চৌধুরী বহুবছর আগেই তাঁর পত্রিকা, ‘স্বকাল’ এ ক্ষুধার্ত আন্দোলনের মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন সুতরাং সাক্ষাৎকারের জন্য তিনিও উপযুক্ত। চেষ্টাও করেছিলাম কিন্তু ওঁর বাং-ফরাসী আদব কায়দার খোলস ভেঙে শাঁসে প্রবেশ করাটা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হওয়ায় পরিকল্পনা ক্যানসেলড।
    মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাতকার নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না কারণ হয়ত দেখা যাবে সব প্রশ্ন দূরে ঠেলে মলয় প্রমাণ করতে শুরু করেছেন গোটা ভারতে কবি মাত্র দুইজন, উনি আর বাল্মীকি। অবশ্য কপালমন্দ হলে বাল্মীকির ওটুকু প্রাপ্তিযোগও জুটবে কিনা সন্দেহ!
    তো সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য যে নামটা অবশিষ্ট থাকে সেটা হলো সুভাষ ঘোষ। সেদিন একমাত্র সুভাষকেই উপযুক্ত মনে হয়েছিল কারণ লক্ষ্য করেছিলাম, শুধু বিষয় নয়,আঙ্গিক মারফতও প্রথম থেকে একমাত্র সুভাষই নিজেকে এতটাই অস্পৃশ্য করে তুলতে পেরেছেন যে প্রতিষ্ঠানের কোনদিন সাধ্য হবে না ওকে ছোঁয়ার।একমাত্র ওর রচনাতেই রয়েছে গা-গতরের গন্ধ। বুর্জোয়া নিউক্লিয়াসের বিরুদ্ধে ওকেই দেখছি ক্রমাগত কামান দাগিয়ে চলতে।
    মিথ,মেটাফর,অ্যালিগরী,সিম্বলিজমকে সপাটে লাথি মেরে উড়িয়ে সুভাষই লিখতে পেরেছেন--
    --“পটলের সন্তান পটল হয়--আলুর সন্তান নিখাদ আলু--কুকুরের সন্তান আদ্যন্ত কুকুর এক--মানুষের সন্তান মানুষ কি না আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি--”

    --“এখানে স্পেডকে স্পেড বলা হয় না। এটা বুর্জোয়াদের মুক্তমেলার দেশ--মুক্ত বাজারের দেশ--এটা বুর্জোয়াদের রূপক জগৎ--রূপক দেশ--রূপক মানুষ রূপক জীবন ভালোবাসে--রূপক তথা খোলসটা ছিঁড়ে দিলাম। দগদগে চেহারা বেরিয়ে পড়ল। গেল গেল রব উঠল। হ্যাঁ,ওরা ওই বিত্তবান,মধ্যবিত্ত,এলিট শ্রমিক, পোষা টিয়া ময়না--টিয়া ময়না ওই এদেশের এলিট,অ্যাকাডেমি বাজারজাত লেখক,কবি।”
    সেই সাক্ষাৎকারটিতে রাখা হয়েছিল চোখা চোখা প্রশ্ন কিন্তু হায় হতভাগ্য, প্রায় সব ক’টা প্রশ্নই কৌশলে এড়িয়ে গেলেন সুভাষ ঘোষ। যেটুকু বললেন সেটা প্রায় না বলার মতই, তবুও ওই বলাটুকুই ছিল আমাদের কাছে যথেষ্ট।
    শুধু আমাদের কাছে নয়,শৈলেশ্বর ঘোষের কাছেও। ওই সাক্ষাৎকারটি থেকে দুটো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন তিনি, দূত হিসেবে সুভাষ চূড়ান্ত ব্যর্থ এবং এই ব্যর্থতা মূলতঃ বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর। শৈলেশ্বর নিশ্চিত হয়ে গেলেন, উত্তরবঙ্গের এই পাল্টা অভুত্থান মূলতঃ সুভাষ ঘোষেরই উস্কানিজাত। শৈলেশ্বরকে হঠিয়ে ক্ষুধার্ত রথের প্রধান সারথি হতে চাইছেন সুভাষ। যদিও রথটি তখন মূলতঃ তিন চাক্কায় ভর করে চলছিল, দুটি চাক্কা শৈলেশ্বর এবং সুভাষ। অন্য চাক্কার অর্ধেক প্রদীপ চৌধুরী, বাকি অর্ধেক অরুণেশ ঘোষ।
    সুভাষ লিখেছিলেন--“ কামরোগ ভয় আমার--
    নামরোগ ভয় আমার--
    ‘আমি’রোগ ভয় আমার--ক্ষমতারোগ-”
    লিখেছিলেন,“ দান,ভিক্ষাবৃত্তি,হ্যাংলামিপনা যদিও আমাদের জাতীয় মজ্জায় প্রায় অন্তর্ভুক্ত কিন্তু আমি তার কেউ নই--দাদা ধরা,বাবা ধরা আজকাল জলচল হয়েছে--দেখে ঘেন্না ধরে--”

    আমরা যারা অনেক পরে সুভাষ ঘোষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তারা জানতাম ওইসব লেখা সুভাষ নিছকই বানিয়ে বানিয়ে লেখেননি, একদম প্রাণের কথা। ক্যাডার-লিডার নয়, সুভাষ বিশ্বাস করেন কমরেডশিপে। এবং সেই বিশ্বাস ছিল এতটাই দৃঢ় এবং সুপ্রোথিত যে সেটাকে,‘সৌভ্রাতৃত্ব বোধ’ নামক ছেঁদো অভিধায় অপমানিত করা চলে না।
    সুভাষের সঙ্গে বাল্যবন্ধুত্বের সুবাদে ওই সব তথ্য শৈলেশ্বরেরও জানা ছিল কিন্তু সন্দেহ বহোত খতরনাক চিজ। অভ্যেস মোতাবেক অতীত ভুলে যেতে অসুবিধে হলো না শৈলেশ্বরের। মনগড়া অভিমানে আহত হলেন শৈলেশ্বর।মফঃস্বলের ছেলেদের বাড়াবাড়ি দেখে অহঙে আঘাত পেলেন। কে না জানে, কবিকে যদি বা আঘাত করা যায়, নেতাকবিকে আঘাত করা অত সোজা নয়! অহং চোট গ্রস্ত হলে সে কাউকে ছেড়ে কথা কয় না। কইতে জানে না। সুতরাং এবার শুরু হলো প্রত্যাঘাতের পালা।
    অথচ কবি শৈলেশ্বরকে কিন্তু কখনই অস্বীকার করিনি আমরা। করা যায় না। কিভাবে ভুলব সেই সব অমোঘ লাইন--
    বৃক্ষাকাশে কবিতা টাঙাবো না আমরা, শোবার ঘরেই গাছ সঞ্চার হয়েছে,
    গাছেতে ভূমধ্যাকর্ষণ হয় চোরাচালান বোঝে— শোবার ঘরেই চলে
    অহরহ বিক্ষোভ-আক্রমণ; গাছের সঙ্গেই সুদীর্ঘকাল ফলে ওঠে
    ভালবাসাবাসি— কলকাতায় দশবছর খারিজ নীলাম
    দরসরবরাহ নিদ্রাপ্রেমের মূল্যবৃদ্ধি— ফাটকায় হাতবদল
    দিনমান হৃদয় চিৎ— দিনমানভর তেত্রিশ হিজরের গর্ভ হয়
    দিনমান ধরে হে ঘোড়া ভৌতিক ক্ষুধা কবিতার ।

    কিন্তু সেইডা পাগোল মনডারে বুঝাই ক্যামনে! এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। ফের সেই কথায় আসি।
    সদ্য প্রকাশিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বগলে নিয়ে এক ঠা ঠা দুপুরে আমি হাজির হয়েছিলাম শৈলেশ্বরের বাড়ির গেটে। একা। ইচ্ছে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি বসে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবো। যেহেতু স্মরণে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি তাই আস্থা ছিল শৈলেশ্বরের প্রজ্ঞা,ব্যক্তিত্ব,যুক্তিবোধ তথা ভদ্রতাবোধের ওপর। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শৈলেশ্বর আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন এবং যৌথ আলোচনাই পারবে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নতুন উদ্যমে একসাথে পথ চলা শুরু করতে। কিন্তু দুভার্গ্য বশতঃ তেমন কিছু ঘটলো না। বেল বাজাতেই গেটের ওপারে শৈলেশ্বর। আমাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেললেন।
    --কী চাই!
    মিনমিন করে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলবো।
    --কে আপনি?
    এক এবং দুই নম্বর প্রশ্নের ভুল অবস্থান দেখে হাসি পাওয়া সত্বেও চেপে গিয়ে নাম বললাম।
    --কি কথা?
    --গেটটা না খুললে কথা বলি কিভাবে!
    --কোনো কথার প্রয়োজন নেই। চলে যান।
    --এভাবে কথা বলছেন কেন?
    --যা বলছি ঠিক বলছি। যান। নাহলে কিন্তু প্রতিবেশীদের ডাকতে বাধ্য হবো।

    এরপর স্বাভাবিক কারণেই খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম কারণ আমার চেহারাটা যেরকম তাতে শৈলেশ্বর যদি একবার ডাকাত, ডাকাত বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তাহলে হয়ত জান নিয়ে ফেরার সুযোগ পাবো না। তবে 'ছেলেধরা' বলে চেল্লালে ভয় পেতাম না। সমকামিতার দোষ না থাকায় নির্ঘাত রুখে দাঁড়াতাম।
    ভয় পাচ্ছি অথচ চলেও যেতে পারছি না। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে আরও খানিকটা জানা বোঝা জরুরি।
    --ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। তবে পত্রিকার নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সেটা রাখুন।
    এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন শৈলেশ্বর।
    --কোন পত্রিকা?
    --কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
    --নেব না। যান।

    এরপর আর দাঁড়াইনি। দাঁড়ানোর প্রয়োজনও ছিল না। ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি ব্যক্তি শৈলেশ্বর ঘোষকে চিনতে ভুল হয়নি আমাদের। আর এই সমঝদারি এতটাই তৃপ্তি দিয়েছিল যে অপমানবোধ স্পর্শ করারই সুযোগ পায়নি। (ক্রমশ)
    এর দ্বারা পোস্ট করা আমরা পঞ্চপাণ্ডব এই সময়ে ১১:৫৮ PM কোন মন্তব্য নেই:
    এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!X-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন
    লেবেলসমূহ: Aloke Goswami, Malay Roychoudhury

    অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ৫ )

    পত্রিকাটা ফিরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম অরুণেশদাকে, এসব কী!
    অরুণেশ ঘোষ সন্ত সুলভ ভঙ্গীতে বলেছিলেন,এই গুলান কোলকাত্তাই পায়জামো। বাদ্দাও এইসব। শুদু ল্যাখা গুলান পড়ো,ওইটাই আসোল।
    কিন্তু এটুকু সান্ত্বনায় স্বস্তি মিললো না। ওই যে কথায় আছে “নাল্পে চ সুখ মস্তি” সেটাকে মান্যতা দিয়ে মাথার ভেতরে একগাদা প্রশ্ন উসখুসিয়ে উঠল। যেমন, পুলিশ তো হাজতে কত কিছুই ভয় দেখিয়ে লিখিয়ে নেয় সেজন্যই আদালতে সেসব মুচলেখা ধোপে টেকে না। আদালতে দাঁড়িয়ে যেটা বলা হয় সেটাই আইন সম্মত হয়। সেখানে তো প্রত্যেকেই মলয়ের পক্ষে কথা বলেছিলেন, সেজন্যই সরকারি উকিল ওদের হোস্টাইল ডিক্লেয়ার করেছিল। কেসটাও ধোপে টেকেনি, ডিসমিস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মলয় তো সে কথা কোথাও বলেননি! (আজও বলেন না মলয় রায়চৌধুরী। কী জানি কেন! হয়ত পরমবীর চক্র হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে!) তাছাড়া কে নেতৃত্ব দিয়েছিল সেটার চে’ও বড় কথা কারা সেই আন্দোলনের ধারা বহন করে চলেছে। মামলা পর্ব মিটে যাবার পর মলয় বাদে বাকিরাই ফের ক্ষুধার্ত পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন সেই ধরণেরই কবিতা/গদ্য যা কিনা একদা রাষ্ট্রর অস্বস্তির কারণ হয়েছিল। তখন কোথায় ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী? বন্ধুদের প্রতি রাগে/দুঃখে/ অভিমানে কেউ লেখালিখিই ছেড়ে দেয় নাকি! অবশ্য অভিমানবোধ কার কতটা তীব্র হবে সেটা তো মেপে বলা যায় না তবু মলয় যখন সেই অভিমানের ভার থেকে রেহাই পেয়েছেন তখন ফের পূর্বধারায় যুক্ত হয়ে ক্ষুধার্ত আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলুন না, আটকাচ্ছে কিসে!
    এসব কৌতূহলের উত্তর যেহেতু খোদ মলয় রায়চৌধুরীই দিতে পারেন তাই একটা চিঠি লিখলাম ওঁকে। প্রায় চার/পাঁচ পাতার চিঠি।
    কয়েকদিনের ভেতর উত্তর এসেছিল। না, চিঠির উত্তরে চিঠি নয়, এসেছিল সাক্ষাৎকার। গোটা চিঠিটাকে সাক্ষাৎকারে রূপ দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলেন মলয়।
    মন্দ হোত না যদি তাতে থাকতো আমার তোলা প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু তার পরিবর্তে আমার অনুসন্ধিৎসা মলয়ের কাছে শৈলেশ্বর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের দুসরা অধ্যায় বোধ হয়েছিল। সুতরাং ছত্রে ছত্রে ছিল অবহেলা, অপমান এবং গরিলা সুলভ বুক চাপড়ানো। ওই স্ব-সৃষ্ট সাক্ষাৎকারেই মলয় আমাদের অবস্থানকে চিহ্নিত করেছিলেন,‘উত্তরবঙ্গের হাংরি ছিটমহল’ হিসেবে। বলেছিলেন, প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার এমন এক জ্বলন্ত লাভা যা ঠান্ডা হোতে কয়েক শতাব্দী লেগে যাবে।
    এই অবধি ঠিকই ছিল। হয়তো সাক্ষাৎকারটি ছেপেও দিতাম কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে যদি না মলয় ওতে বলতেন,তিনি আর প্রতিষ্ঠান বিরোধী নন। এখন প্রতিষ্ঠান তাঁর বিরোধিতা করে। তিনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমরা টের পাবো ওই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করলে। রাতারাতি নাকি ইতিহাসভূক্ত হয়ে পড়বে আমাদের পত্রিকা!
    আমাদের আপত্তিটা জেগেছিল ওখানেই। যে ইতিহাসের প্রকৃত স্বরূপ জেনে আমাদের ভেতরে বিবমিষা জেগে উঠেছে, এরপর সেই ইতিহাসের অংশ হতে চায় কে? সুতরাং অগ্রাহ্য করা হলো কল্পিত সাক্ষাতকারটিকে। পাশাপাশি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের পাতায় প্রকাশ করা হলো একটি যৌথ প্রতিবেদন যার মূল বক্তব্য ছিল কোনো আন্দোলনের পতাকা বহন করে ইতিহাসের কমা-সেমিকোলন হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমাদের। না,আমরা কারুর পিতৃত্ব স্বীকার করে নিতে রাজী নই। তাবৎ সত্যকে পরখ করে দেখে,শুনে,বুঝে নিতে চাই আমরা। আমাদের চোখ এতটাই ছোট যে শুধু মানুষকে চোখে পড়ে, মানুষের মাথার পেছনে থাকা জ্যেতির্বলয় নয়।
    ব্যস,এরপরই মৌচাকে ঢিল পড়লো। রটিয়ে দেয়া হলো, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এখন মলয়ের অঙ্গুলীহেলন বন্দী। একবার ভাবুন, সময়ের চরম রসিকতাটার কথা। মলয় ভাবছেন, আমরা শৈলেশ্বরের প্রম্পট করা ডায়ালোগ মুখস্থ বলছি। শৈলেশ্বর ভাবছেন উল্টোটা। হায়রে নেতৃত্ব এবং তার লড়াই! এরপর থেকে দুই মহারথী জীবনভর শুধু কামড়াকামড়ি করে গেলেন, তুই বিড়াল না মুই বিড়াল। চালিয়ে গেলেন অনুগামী বাছাই অভিযান। আর তাই শৈলেশ্বর প্রণীত হাংরি ইতিহাস বই থেকে বাদ গিয়েছেন তারা যাদের সন্দেহ করা হয়েছিল মলয় শিবিরের লোক। মলয় প্রণীত ইতিহাস বইয়েও ঘটেছে ঠিক তার উল্টো।
    সাহিত্য যেহেতু আমাদের কাছে দুলাল ভড়ের তালমিছরি ছিল না তাই ছবি এবং সহি মিলিয়ে দেখার তোয়াক্কা না করে, দুই মোরগের লড়াইকেই একতিল পাত্তা না দিয়ে প্রকাশিত হয়ে চললো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের পর পর সংখ্যাগুলো। ক্ষুধার্তদের ব্যবহৃত শ্লোগান--বুর্জোয়া নিউক্লিয়াসে কামান দাগো, তখন আমাদেরও শ্লোগান। ফারাক শুধু এটুকই যে সেই কামানের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ক্ষুধার্তবৃন্দও। পাবার কথাও নয়। কেননা ক্ষুধার্তদের লেখাপত্রই আমাদের শিখিয়ে ছিল--প্রতিষ্ঠানের চে’ও বড় শত্রু আত্মপ্রতিষ্ঠান। সেটারও বিরোধিতা করাটা একজন লেখকের অবশ্য কর্তব্য।
    এসবের পাশাপাশি আমরাই প্রথম অবনী ধরের গল্প পুনর্মুদ্রণ করেছিলাম। আমরাই প্রথম প্রকাশ করেছিলাম ফালগুনি রায়ের কবিতা সঙ্কলন।
    কিন্তু আমাদের কাজগুলো ক্ষুধার্তদের কাছে তো আমল পেলই না বরং আমাদের শ্লোগানগুলো ওদের কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল। নেতা হওয়াই যার জীবনের প্রধান লক্ষ্য, যিনি কোনদিনই বিরোধিতা সহ্য করতে পারেননি, মলয় হাজির হওয়ার পর যার আসন টলে উঠেছে সেই শৈলেশ্বর ঘোষ খুব স্বাভাবিক কারণেই আমাদের ওপরে চটে উঠলেন। সমস্ত কার্যকারণের প্রতিনিয়ত জবাবদিহি চাইতে লাগলেন। না, সরাসরি আমাদের কাছে নয়। অরুণেশ ঘোষের কাছে। কিন্তু অরুণেশ কী কৈফিয়ত দেবেন? আমরা তো ওঁকেও ছেড়ে কথা কইছি না! ব্যাখ্যা চাইছি ওঁর বক্তব্যের--
    ” সচেতন থাকার অর্থ জাগ্রত থাকা নয়,সীমাবদ্ধ থাকা। আমি এই সীমাবদ্ধতা কাটাতে চাই। একটা লেখার শুধু শব্দের দায়িত্ব কেন, তার দাড়ি-কমার দায়িত্বও একজন লেখক নেয়,যখন সে শুধু মাত্রই নির্মাণ করে। তৈরি করে। ইগো আর বুদ্ধি দিয়ে। আর যে তা করে না,যার ক্ষেত্রে একটা পুরো লেখা ‘হয়ে ওঠে’, সে শুধু শব্দের দায়িত্ব নেয়না, নেয় গোটা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের। তার জগতের। মূল কথা হল ‘লেখকের নিজস্ব জগৎ।’ সেটা ঠিক থাকলে সব ঠিক আছে। আর সেটা না থাকলে শব্দগুলো তো মৃত আবর্জনা মাত্র।”
    কি বলবো এই চিন্তাকে অরুণেশদা, ক্ষুধার্ত চেতনা, নাকি হঠযোগ?

    জাঁতাকল থেকে রেহাই পেতে এরপর অরুণেশ শিলিগুড়ি চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দিলেন। বন্ধ করে দিলেন কথাবার্তার সম্পর্কটুকুও। আমাদের মতো বালখিল্যদের কারণে শৈলেশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করাটা ওঁর কাছে অযৌক্তিক বোধ হলো।
    কান্ডটা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেনি কারণ আমরা জানতাম দুজনের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের কথা। জানতাম শৈলেশ্বর সম্পর্কে ওঁর মূল্যায়ন,“ কিছু মানুষ, গোটা পৃথিবীতেই যাদেরকে আঙুলে গোনা যায়, যারা সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে ঘর ছেড়ে, যাদের এ কারণেই ভন্ড মিথ্যার পূজারী সমাজ পরিত্যক্ত শিশুর মতো ছুঁড়ে দিয়েছে অন্ধকারে পথের আবর্জনায়, শৈলেশ্বর তাদেরই একজন।”
    আহা, ভাবতে খারাপ লাগে, আর মোটে কয়েকটা মাস বেঁচে থাকলেই অরুণেশ জেনে যেতে পারতেন বন্ধুর পশ্চিমবঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন মেলার উদ্বোধনের দায়িত্ব পাবার খবর। জেনে স্বস্তি পেতেন, ভন্ড মিথ্যার পূজারী সমাজ পরিত্যক্ত শিশুর মতো যাদের ছুঁড়ে দিয়েছে অন্ধকারে পথের আবর্জনায়, শৈলেশ্বর তাদেরই একজন নয় আর।

    Image may contain: one or more people and people sitting
    Image may contain: 2 people

    এর দ্বারা পোস্ট করা আমরা পঞ্চপাণ্ডব এই সময়ে ৫:১৯ AM কোন মন্তব্য নেই:
    এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!X-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন

    মঙ্গলবার

    অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ৪ )

    বইমেলা থেকে ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরলাম। কাঁধে করে নিয়ে এলাম ক্ষুধার্ত পত্রিকা এবং ক্ষুধার্ত লেখকদের বইপত্র। মাথার ভেতর ঠেসে আনলাম অরূপ বাণী--হাও টু বি এ গুড প্রতিষ্ঠান বিরোধী ( ওরফে ক্ষুধার্ত)। শুধু মাথায় রাখাটা যেহেতু যথেষ্ট নয় তাই সেসব জ্ঞান উগরে দিলাম যে যার কলমে। প্রকাশিত হোতে শুরু করলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।যথারীতি বিজ্ঞাপনের তোয়াক্কা না রেখে পকেটের টাকায়।
    মনোজ রাউতের ধৃতরাষ্ট্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করা হলো শৈলেশ্বর ঘোষের প্রবন্ধ সংকলন, ‘প্রতিবাদের সাহিত্য।’ অরুণেশ ঘোষের গদ্যগ্রন্থ,‘অপরাধ আত্মার নিষিদ্ধ যাত্রা।’ গাঁটের একটা কড়িও না খরচ করে বই প্রকাশের মত মহান ঘটনা দুজনের জীবনেই সেই প্রথম।
    যথারীতি তুলকালাম কান্ড ঘটে গেল উত্তরবঙ্গের সাহিত্য জগতে। আমাদের ভেতরে ক্ষুধার্ত আন্দোলনের পুনরুত্থানের ভূত দেখতে থাকলো উত্তরবঙ্গ সাহিত্য প্রতিষ্ঠান। কিভাবে আমাদের প্রতিহত করা যায় সেসবের পরিকল্পনা ভাঁজা শুরু হলো। সে এক উৎকট পরিস্থিতি। প্রতিষ্ঠানের স্ব-নিযুক্ত দালালবৃন্দ না পারছে আমাদের অস্বীকার করতে, না পারছে স্বীকার করতে।
    ঘটনা প্রবাহ যেদিকে চলছিল তাতে হয়তো সত্যি সত্যিই ক্ষুধার্ত আন্দোলনের পুনারুত্থান ঘটে যেত এবং নকশাল আন্দোলনের মতো উত্তরবঙ্গই হোত তার এপিসেন্টার। কিন্তু কী আশ্চর্য, ঘটনা গড়ালো উল্টো দিকে! ক্ষুধার্তদের বই/পত্রিকা যত পড়ি তত বিভ্রান্তি বাড়ে। আবিষ্কার করি, সুভাষ এবং শৈলেশ্বরের চিন্তা ভাবনার মধ্যে থাকা বিস্তর ফারাক! প্রদীপ চৌধুরীর পত্রিকা পড়ে বিভ্রান্তি বেড়ে দ্বিগুণ হয়। অরুণেশ ঘোষের লেখাপত্র থেকে সেই বিভ্রান্তি বেড়ে দাঁড়ায় চৌগুণ। সুবো আচার্য তো শ্রীশ্রী ঠাকুরের পাদপদ্মে বিশ্বরূপ দর্শন করছেন! সুবিমল বসাক সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। কেন?
    ভাবনায় পড়ে যাই, কোনটাকে বলব ক্ষুধার্ত চেতনা! কেউ লিখছেন প্রতিবাদের সাহিত্য কেউ বলছেন প্রতিবাদ নাকি প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়! কেউ একগাছা দড়ির এক প্রান্ত নিজের কোমরে বেঁধে অন্য প্রান্ত অসীমের কোমরে বাঁধার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তো অন্য জন গা-গতরের শব্দ ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছে! কেউ লিখছে জাদুবাস্তববাদী গল্প কেউ বলছে লেখাকে মিথ, মেটাফর, অ্যালিগরি মুক্ত করতে। যামু কই? একজন ক্ষুধার্ত আন্দোলনের মৃত্যু ঘোষণা করছেন, অন্যজন সর্বধর্ম সমন্বয়ের চেষ্টা করে বলেছেন, ক্ষুধার্ত চেতনা যার যার তার তার। বেশ। মেনে নেয়াই যেত কিন্তু তাহলে ক্ষুধার্ত সাহিত্য ওদের ঘোষনা মোতাবেক আন্দোলন হয় কিভাবে! বিচ্ছিন্ন কর্মসূচিকে আন্দোলন বলা যায়?
    আমাদের এই দোলাচলের মাঝে ঘটে গেল আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাহিত্য সমুদ্রে মাথা চাড়া দিলো সাবমেরিন মলয়।মলয় রায়চৌধুরীকে সাবমেরিন বলার কারণ মামলার নিষ্পত্তির পর মলয় রীতিমত ডিক্লেয়ার করে ক্ষুধার্তদের সঙ্গে যাবতীয় সংশ্রব ত্যাগ করেছিলেন এবং জীবিকার উন্নতিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু উনি যে তলে তলে আক্রমণ হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেটা বোঝা যায়নি।
    সব জানপহেচান চুরমার করে দিতে ‘পথের পাঁচালি’ পত্রিকায় ভেসে উঠলেন মলয়।এবং কামান দাগলেন। খানিকটা চুনসুরকি খসে পড়লো। উঁকি দিলো ইটের সামান্য অংশ। জানা গেল, শৈলেশ্বর ঘোষ নয়, মলয় রায়চৌধুরীই ছিলেন ওই আন্দোলনের মূল হোতা। জানা গেল, ক্ষুধার্তদের অনেকেই হাজতে মুচলেকা দিয়ে জামিন নিয়েছিলেন। এবং সে কারণেই মলয় রায়চৌধুরীর জামিন মিলতে ঝামেলা হয়েছিল।
    সামান্য চুনসুরকির খসে পড়া থেকে খানিকটা জানা গেল বটে কিন্তু মানা গেল কি? না। সেটা সম্ভবও নয় কারণ একেই তো ভিন্ন ইতিহাস জানছি অন্যদিকে জানা ইতিহাসের মালিকরা চোখের সামনে। সেদিক থেকে মলয় রায়চৌধুরী সম্পূর্ণ অচেনা। তার ওপরে আবার বাড়তি বোঝা মলয়ের উৎকট বুক চাপড়ানি। তাছাড়াও ওই লেখায় এত আঙসাঙ কথা ছিল যে চট করে বিশ্বাস করতে অসুবিধেই হয়েছিল।
    হয়ত খামতিটা মলয়ও বুঝেছিলেন তাই পরের মিসাইলটা দাগলেন ডঃ উত্তম দাশের হাত দিয়ে। ডঃ দাশ তার ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখলেন, তাতে মালমশলা হিসেবে ব্যবহার করলেন মামলা সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র। কেস ডায়েরি, মুচলেকা, সাক্ষদান পর্ব, আদালতের রায়, সবকিছুর সার্টিফায়েড কপি এই প্রথমবার প্রকাশ্যে এলো। ফলে এই বিস্ফোরণটির তীব্রতা ছিল মারাত্মক। প্রকৃত সত্য জানাজানি হয়েছিল। আমরাও বুঝলাম একদা শৈলেশ্বর দ্বারা পেশ করা তথ্যের পুরোটাই ছিল গোঁজামিলে ভরা।
    মহাদিগন্ত পত্রিকাটা আমার হাতে এসেছিল অদ্ভুত ভাবে। এবার সেই গল্প।
    কোচবিহার থেকে অরুণেশদাকে নিয়ে আমি, রাজা, মনোজ রওনা দিয়েছিলাম মাথাভাঙার উদ্দেশ্যে।হঠাৎ মাথাভাঙা কেন? কারণ পৃথিবীতে ওটাই একমাত্র স্থান যেখানে অরুণেশদা খুব স্বচ্ছন্দ থাকতেন। এই স্বাচ্ছন্দ যোগানোর দায়ভার স্বেচ্ছায় নিয়েছিল মাথাভাঙা বয়েজগণ। কারা তারা? তারা প্রায় প্রত্যেকই বিখ্যাত কবি। যেমন নিত্য মালাকার,সন্তোষ সিংহ, অনুভব সরকার, কমল সাহা।

    নবদ্বীপ থেকে মাথাভাঙায় গিয়ে থিতু হওয়া নিত্য মালাকারের কবি পরিচয় বাংলা কবিতা জগতের প্রায় সবাই জানেন। জানেন সন্তোষ সিংহের কথাও। তবে সন্তোষদা সম্পর্কে একটা বিশেষ তথ্য হয়ত অনেকের জানা নেই সেটা হলো স্বপ্নে পাওয়া বেশকিছু কবিতা নিয়ে একটা বই আছে সন্তোষদার যার ভূমিকা লিখেছিলেন ডঃ অশ্রুকুমার সিকদার।
    সবচে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো স্বভূমিকায় এরা প্রত্যেকে উজ্জ্বল হওয়া সত্বেও এদের অরুণেশ অনুরাগ ছিল অসীম। প্রায় শেষদিন পর্যন্ত অরুণেশ ঘোষকে ওরা ভালোবাসা দিয়েছেন। সব রকম ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন অরুণেশ ঘোষের।
    বিষয়টাকে আশ্চর্যজনক বলার কারণ অসূয়াক্লিন্ন সাহিত্য পরিবেশে এমন প্রীতি সহজে চোখে পড়ে না। বলাবাহুল্য অরুণেশদারও যথেষ্ট প্রিয়স্থান ছিল মাথাভাঙা, তা তিনি যতই বলুন না কেন জটেশ্বরের বেশ্যাপাড়ার পরিবেশই ছিল তাঁর কাছে প্রিয়তম স্থান।
    মাথাভাঙার কথা বলতে গিয়ে আরও একজনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে--সুব্রত রায়। কবিতা লেখা এবং কবিতা কেন্দ্রিক জীবন যাপন, দুটো নেশাতেই বুঁদ ছিল। এমন ছেলের কাছে অরুণেশ ঘোষ যে একমাত্র অনুসরণযোগ্য কবি হবেন তাতে আর সন্দেহ কিসের?
    বেশীদিন কবিতা লিখতে পারেনি সুব্রত। বেঁচে থাকলে তো লিখবে? আত্মহত্যা করেছিল। হয়ত আরো আগেই কাজটা করে বসতো নেহাত সন্তোষদা প্রতিনিয়ত তার প্রিয় ছাত্রটিকে আগলে রাখার চেষ্টা করতেন তাই কিছুদিন বাড়তি আয়ু পেয়েছিল সুব্রত।
    আমরা অনন্য, ফালগুনি এবং এরকম আরও কিছু নাম জানি কিন্তু পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে ওরকম কত যুবক যে উন্মাদের মতো সাহিত্যকে ভালোবেসে সর্বস্বান্ত হয়েছে তাদের খবরও রাখি না! আজ মনে হয়, সাহিত্যকে বোধহয় পরস্ত্রীর মতো ভালোবাসতে হয়। কামনা যতই উদগ্র হোক তাতে বাধ্যতামূলক ভাবেই খানিকটা সংযম বজায় রাখতে হয়।এই সম্পর্ককে কখনও পরিণতি দিতে চাইতে নেই, চোরাগোপ্তা আকর্ষণটুকু বজায় রেখে চলতে হয়।
    থাক তত্ত্বকথা, ওই সফরেই অরুণেশের ব্যাগে আচমকা পেয়ে গিয়েছিলাম ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকার সেই সংখ্যাটি। কিন্তু অরুণেশদা কিছুতেই দেবেন না পত্রিকাটা, ভালো কইরে বোঝার চেষ্টা করো হাংরি ফিলজফিটারে। আগেই এই সব ল্যাখা পড়লে সব গুলায় যাবে।
    কিন্তু আমাকে রুখিবে কে! প্রায় জবরদস্তি ম্যাগাজিনটা কেড়ে নিয়ে কোচবিহার থেকে মাথাভাঙা যাত্রাপথে ভিড় বাসের মেঝেতে বসে পত্রিকাটা শেষ করেছিলাম। এবং স্বীকার করতে বাধা নেই, সত্যিই মাথার ভেতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। কারণ সেদিনই তথ্য প্রমাণে জেনেছিলাম শৈলেশ্বর ঘোষ রচিত ‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি শূণ্য বিছানায়’ কবিতাটা নয় বরং মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটাকেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। জেনেছিলাম, হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট মলয়ের নেতৃত্বেই ঘটেছিল এবং কেসটাও সাজানো হয়েছিল মলয়েরই বিরুদ্ধে। 

    এর দ্বারা পোস্ট করা আমরা পঞ্চপাণ্ডব এই সময়ে ৫:৩৯ AM কোন মন্তব্য নেই:
    এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!X-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন

    অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ৩ )

    তো, হইহই করে প্রকাশিত হলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। কিছুদিন পরই কোলকাতা বইমেলা। এক সন্ধ্যায় পত্রিকা বগলদাবা করে আমরা জনা কয়েক জেহাদি রওনা দিলাম কোলকাতায়। যে উত্তেজনাসহ রাতভর যাত্রাটা সেবার পাড়ি দিয়েছিলাম সেটা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব, কারণ--
    ১. সেই প্রথম আমাদের কোলকাতা বইমেলা অভিযান।
    ২. সঙ্গে ভিন্ন মেজাজের পত্রিকা যার ফ্রন্টপেজে লেখা--Bombard the Headquarter.
    ৩. আমাদের জন্য খালাসিটোলায় অপেক্ষা করবেন শৈলেশ্বর ঘোষ।

    এই তৃতীয় উত্তেজনাটার ঝাঁজ অন্য দুটোর চে’ অধিকই ছিল। সেটাই স্বাভাবিক। হাংরি কিংবদন্তি শৈলেশ্বর ঘোষ, যিনি লিখেছেন, "আমরা বাতিল করে দিয়েছি সেইসব সাহিত্য যা মানুষ উপভোগ করে এবং জীবনের বিরুদ্ধে অপরাধ করে। আমরা বাতিল করে দিযে়ছি সেই কবিত্ব যা হিজড়ের শীৎকার ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা বাতিল করে দিয়েছি সেই ন্যাবা ধরা ভাষা যা আজকের ভয়ার্ত আত্মাকে আমূল ঝাঁকায় না। আমরা বাতিল করে দিয়েছি সেই কবিতা যা মানুষকে শব্দের খোঁয়াড়ে বন্দি করে রাখে অভিজ্ঞতাকে মুক্তি দিতে জানে না," তিনি কিনা উত্তরবঙ্গের কয়েকজন অখ্যাত যুবকের জন্য অপেক্ষায় থাকবেন, ভাবা যায়!
    ট্রেনজার্নির ধকলকে প্রশ্রয় না দিয়ে তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া পর্ব সেরে সদলবলে বেরিয়ে পড়তে হলো হোটেল ছেড়ে। অতিরিক্ত উত্তেজনায় এতটাই তাড়াতাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলাম যে তখনও খালাসিটোলার দরজাই খোলেনি। শৈলেশ্বরও এসে পৌঁছননি। সময় কাটাতে আমরা ইতিউতি ঘোরাঘুরি করলাম। মনে আছে, ফুটপাথ থেকে একটা সানগ্লাস কিনেছিল সমীরণ ঘোষ এবং গোটা বইমেলা পর্বে সেটা প্রায় সর্বক্ষণই চোখে এঁটে রেখেছিল, অনেকটা অরণ্যদেব স্টাইলে। তবে টকটকে ফর্সা সমীরণকে ওই কালো সানগ্লাসে মন্দ দেখাচ্ছিল না।
    অবশেষে দোর খুললো খালাসিটোলার। বেঞ্চের দখল নিয়ে বসার খানিক পরই শৈলেশ্বর ঘোষ এলেন। মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম শৈলেশ্বরের দিকে। ছিপছিপে চেহারা, দুধসাদা ধুতিপাঞ্জাবী। চশমার কাচ ভেদ করে ফেটে পড়ছে তীব্র বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি।
    প্রচুর কথাবার্তা হয়েছিল। যেহেতু তখনও তেমন পড়াশোনা করে উঠতে পারিনি তাই জ্ঞানভান্ডার পূর্ণ করতে অজস্র প্রশ্ন করেছিলাম শৈলেশ্বরদাকে। সেসবের উত্তরও পেয়েছিলাম। পান্ডিত্য কাবু করে ফেলেছিল আমাদের।
    জেনেছিলাম ক্ষুধার্ত আন্দোলন মূলতঃ শৈলেশ্বর ঘোষেরই মস্তিষ্ক প্রসূত এবং যে কবিতাটির কারণে অশ্লীলতার অভিযোগ সংক্রান্ত্র মামলাটা রাষ্ট্র রুজু করেছিল সেটা ছিল ওঁরই রচিত “তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি শূন্য বিছানায়”।
    জেনেছিলাম, কেসটা ছিল বিখ্যাত এক সংবাদ হাউসের ষড়যন্ত্র। ক্ষুধার্ত লেখকদের প্রতিভার কারণে ওদের লেখকদের পাছে রুটি রুজি বন্ধ হয়ে যায়, সেই ভয়ে পরোক্ষে চাপ দিয়ে পুলিশকে বাধ্য করেছিল ক্ষুধার্তদের গ্রেপ্তার করতে। কিন্তু রাতারাতি জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক স্তরে শোরগোল ওঠায় হালে পানি না পেয়ে সবাইকে জামিনে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তারপর অশ্লীলতা প্রমাণ করতে না পেরে, কেসে হেরে গিয়ে সবাইকে বেকসুর খালাস দিতে রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছিল।

    চোখ গোল গোল করে গিলেছিলাম গোটা ইতিহাস। তারপর সোজা বইমেলায়। শৈলেশ্বরদা মাঝ পথে নেমে গিয়েছিলেন ট্যাক্সি থেকে। আমাদের দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিলেন কয়েকজন যুবককে, যারা প্রতিদিন আমাদের বইমেলায় সঙ্গ দিতো, মেলা শেষে পৌঁছে দিতো হোটেলে। হাইকমান্ডের হুকুম বলে কথা! সেদিন কিন্তু নিজেদের নজরবন্দি মনে হয়নি বরং এমন ভি.আই.পি ট্রিটমেন্ট পেয়ে গর্ববোধ করেছিলাম।
    বইমেলাতেই একজন ঝাঁকড়া চুলো, মোটাসোটা, পরণে প্যান্ট শার্ট এবং কাঁধে ঝোলা নেয়া একজন এলেন রাজা সরকার এবং সমীরণ ঘোষের খোঁজে। বুঝলাম ওদের পূর্ব পরিচিত। আমাদের সঙ্গেও পরিচয় ঘটলো। জানলাম, উনি সুভাষ ঘোষ, হাংরি গদ্যকার। ততদিনে ওঁর গদ্যগ্রন্থ ‘আমার চাবি’ পড়া হয়ে গিয়েছে। ওতে থাকা ‘হাঁসেদের প্রতি’ গদ্যটা, যেটা নিয়ে পুলিশের মাথব্যথা ছিল, সেটাও প্রায় মুখস্থ। এছাড়াও পড়েছি থ্রু গাড়ির টিকিট, যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট।
    পরিচয় পর্বের আনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সুভাষ ঘোষ। ঝোলা থেকে বের করে উপহার দিলেন গদ্যসঙ্কলন--অ্যামবুশ।
    নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম হলো। অনুভব করলাম, দুপুরে পাশে বসে সঙ্গ দেয়া সত্বেও শৈলেশ্বর ঘোষের সঙ্গে যে যোজন খানেক দূরত্ব বজায় ছিল এখন সেটা উধাও। আবেগ সম্বল ইতিহাস প্রসিদ্ধ মানুষটি নিমিষে হয়ে উঠলো আমাদের সবার অতি আপন সুভাষদা।আর আমাদের প্রতি সুভাষদার সম্ভাষণ? থাক সে কথা। বরং এটুকু বলা যায় যে কথাবার্তা থেকে মালুম করা যায়নি যে সেদিনই সদ্য পরিচয়!
    সেবারই সুভাষদা আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কোলকাতায় থেকে যা। আর ফিরিস না।
    আমার চাকরির বয়স তখন সবে কয়েক মাস। ছুটি পাবো না জন্য অফিসে না জানিয়ে বহোত ঝুঁকি নিয়েই বইমেলায় গিয়েছিলাম।
    আমার শঙ্কা বিন্দুমাত্র পাত্তা পায়নি সুভাষদার কাছে।
    --ওহ,তবে তো তোর চাকরি চলেই গ্যাছে। যাক, চিন্তা করিস না, আমি জোগাড় করে দেব। থেকে যা।

    যেহেতু সদ্য আলাপ তাই তখনও জানা হয়ে ওঠেনি হাংরি আন্দোলনের কারণে লাইব্রেরিয়ানশিপের পাকা চাকরিটি চলে যাবার পর থেকে জীবিকার দিক থেকে আর কোনদিন থিতু হতে পারেননি সুভাষ ঘোষ। পরবর্তীতে কেমিষ্টের ডিগ্রি নিয়ে নতুন পেশায় নেমেছিলেন বটে কিন্তু মালিকের অসাধুতাকে বরদাস্ত না করা এবং শ্রমিক আন্দোলনকে সমর্থন করার কারণে একটার পর একটা চাকরি থেকে বিতাড়িতই হয়েছেন। এবং এই সংকট সুভাষের আমৃত্যু বজায় ছিল।

    এর দ্বারা পোস্ট করা আমরা পঞ্চপাণ্ডব এই সময়ে ৫:৩৫ AM কোন মন্তব্য নেই:
    এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!X-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন

    অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ২ )

    ‘এবং বিকল্প’ কর্তৃপক্ষ আমাদের সবাইকে একই জায়গায় রেখেছিলেন। উৎপলদা, কালীদা, নিত্যদার সঙ্গে গল্পগুজব হলেও অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলাম অরুণেশদা আমাকে এড়িয়ে চলতে চাইছেন! তা বলে কুশল মঙ্গল সংবাদ জিজ্ঞেস করেননি তা নয় কিন্তু আমাদের দুজনের সম্পর্ক তো ওটুকুতে সীমাবদ্ধ নয়। আবার কী হলো! ততদিনে ওর পথ থেকে তো আরও দূরে সরে গিয়েছি, এই বামনের ক্ষীণ ছায়া তো ওঁর উঠোনে পড়ার কথা নয়!
    বিস্মিত হলেও ওই অবহেলাকে গুরুত্ব দিইনি। কারণ আমি তো জানি একটা দিনরাত, পরদিন পুরোটা এবং রাতে একই ট্রেনে ফেরা, কতক্ষণ পারবে এড়িয়ে থাকতে?
    বিকেল হোতেই সবাই চলে গেলাম অনুষ্ঠান মঞ্চে। সবাই জীবনানন্দ বিষয়ে দু-চার কথা বললাম। অরুণেশদা স্বকীয় ভঙ্গীতে শুরু করলেন, জীবনানন্দ দাশ একজন ক্ষতিকর কবি। কেননা প্রথাগত পরম্পরার বিরুদ্ধে গিয়েই বিদ্রোহ করেছেন জীবনানন্দ এবং সেই যাত্রার পরিণাম হিসেবে যে অখ্যাতি ও অনিশ্চিত জীবন জুটবে তাও বোধহয় ছিল কবির কাঙ্খিত। অথচ চুপিসারে তিনি বাংলা সাহিত্যে যে বিপ্লব ঘটিয়ে গেলেন তা সাবালক হতেই সাহায্য করেছে আমাদের।
    অনুষ্ঠান শেষে আমি চলে গিয়েছিলাম মালদহের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতে। বাকিদের খোঁজ রাখিনি। অনেক রাতে হোটেলে ফিরে দেখেছিলাম অরুণেশদা এক নাগাড়ে বকে চলেছেন নিত্য মালাকারকে। নিত্যদা বসে আছেন অধোবদনে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, অপরাধ খুবই গর্হিত। হাফ বোতল হুইস্কি নিত্যদার হেফাজতে রাখা ছিল, কথা ছিল অনুষ্ঠান শেষে দুজনে পান করবেন কিন্তু অসাবধানতা বশতঃ বোতলটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। আহা, ভালোমানুষ নিত্যদা, মুখ বুঁজে লড়ে যাচ্ছেন ক্যারি প্যাক থেকে খানিকটা হলেও অমৃত ছেঁকে তোলা যায় কিনা!
    এতক্ষণে বুঝেছিলাম সকাল থেকে অরুণেশদার আমাকে এড়িয়ে চলার কারণ। ভাগীদার কমাতে চেয়েছিলেন।হা ঈশ্বর, বরং মুখ ফুটে বললে তো আমি একটা আস্ত বোতল উপহার দিতে পারতাম!
    পরদিন শহর ঘোরাঘুরি এবং আড্ডা শেষে একসাথে ট্রেনে ফেরা। ট্রেন খানিকটা এগোতেই ফের গন্ডগোল বাঁধলো। একদিকে আমি আর নিত্যদা অন্যদিকে একা অরুণেশ ঘোষ। বিষয় রাজনীতি। তখনও তৃণমূল ক্ষমতায় আসেনি। তোড়জোর শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে থাকা অরুণেশদাও যুক্ত হয়ে পড়েছেন ওই তোড়জোরের সঙ্গে। সেটা অবশ্য খুব বড় কোনো ব্যাপার নয়। তখন পরিস্থিতিটাই তেমন ছিল। অরুণেশদা তো শুধু সমর্থক ছিলেন, যারা এতদিন বামফ্রন্টের ঘি মাখন খেয়েছেন তারাও ফ্রন্টে নেমে পড়েছেন। আমাদের আপত্তি ছিল ব্যক্তি অরুণেশ নয়, কবি অরুণেশ ঘোষকে নিয়ে যিনি বিরোধিতা করতে নেমে লিখছেন--থুঃ বুদ্ধ থুঃ/ খা কুকুরের গু/ থুঃ বিনয় থুঃ/ খা ক্যাডারের গু/ থুঃ বিমান থুঃ/ খা মানুষের গু।
    ওরকম নিকৃষ্ট লাইনগুলো কিনা অরুণেশ ঘোষের কলমে, ভাবা যায়! ওগুলোকে কবিতা তো দূরের কথা ছড়াও বলা যায় কি? ভাগ্যিস তখনও কথাঞ্জলী আবিষ্কৃত হয়নি তাই অমন আপত্তি তুলতে পেরেছিলাম। এখন হলে কোনটাকে কবিতা, কোনটাকে ছড়া কিংবা কোনটা দুটোই নয় সে ব্যাপারে সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গেলে হয়ত সাতদিনের ফাঁসী হয়ে যেত!
    কিন্তু অরুণেশ ঘোষকে বোঝাবে এমন বাপের ব্যাটা কে আছে! তার ওপরে আবার আমাকে সমর্থন করছিল ওঁর প্রিয়সাথী নিত্য মালাকার। ব্যস, প্রধান সাহেব রেগে ফায়ার।(প্রধান সাহেব নামকরণটা কালীকৃষ্ণ গুহর। কারণ জানতে চাওয়ায় কালীদা বলেছিলেন, ও তো হাবেভাবে পঞ্চায়েত প্রধান।যদিও কবি হিসেবে অরুণেশকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন কালীদা। ওটা জাস্ট সমবয়সীদের ইয়ার্কি।)
    মনে আছে, রাগে অন্ধ হয়ে মাঝরাতে ট্রেন থেকে নেমে পড়েছিলেন অরুণেশদা,যাবেন না সি.পি.এমের দুই দালালের সঙ্গে। দুজনে বহু কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফের ট্রেনে তুলেছিলাম।
    পরদিন সকাল হোতেই রণাঙ্গন ফের শান্ত। চোখ মেলে দেখি বেঞ্চে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন অরুণেশদা। আমাকে চোখ মেলতে দেখেই মুখে দুষ্টু হাসি, ঘুম হইলো?
    এরপর অবশ্য টেলিফোনে মাঝে মধ্যে দুজনের কথা হোত। মৃত্যুর কিছুদিন আগে কালীপুজোর রাতে ফোন করে অরুণেশদা গর্বিত স্বরে জানিয়ে ছিলেন, হুইস্কির একটা গোটা বোতল খুলে বসেছেন এবং আমাকে মিস করছেন!
    শুনে সুখী হয়েছিলাম দুটে কারণে। প্রথম কারণ, এবার আমাকে সঙ্গী পেতে চেয়েছেন এবং দ্বিতীয় কারণ, এবার বোতলটা অন্ততঃ ভাঙেনি।
    এর কিছুদিন পর আচমকা অরুণেশদার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। বিবরণ জানার পর বিস্ময় হয়ে উঠেছিল চৌগুণ।
    দিনটা ছিল ২৪ আগষ্ট, ২০১১। ২৩ অগষ্ট রাতেও সুস্থ ও সবল ছিলেন অরুণেশ। বইপত্র ও নিজের লেখার মধ্যে নিমগ্ন ছিলেন। পরের দিন সকালে স্নান করতে চলে যান বাড়ির সামনে একটি ছোট্ট পুকুরে। বেশিরভাগ দিন বাড়িতেই স্নান করতেন। মাঝে মধ্যে পুকুরে যেতেন। অরুণেশ স্নান করে ফিরে খেতে বসবেন তাই বৌদি খাবার সাজিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু কোথায় অরুণেশ? খোঁজ খোঁজ। বহুক্ষণ পরে দেহ আবিষ্কৃত হয়েছিল পুকুরের জলের তলায়।
    কিন্তু এসব তো বহু পরের কথা! সাত তাড়াতাড়ি অরুণেশদাকে মেরে ফেলছি কেন? কথা তো হচ্ছিল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আরম্ভপর্ব নিয়ে! এরপরও তো দীর্ঘদিন বাঁচবেন অরুণেশ ঘোষ, শুরু হবে মতাদর্শগত লড়াই, তৈরি হবে দূরত্ব। সুতরাং পিছিয়ে যাওয়া যাক।
    এর দ্বারা পোস্ট করা আমরা পঞ্চপাণ্ডব এই সময়ে ৫:৩০ AM কোন মন্তব্য নেই:
    এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!X-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন

    অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ১ )

    একটা সাহিত্য অনুষ্ঠানে গিয়ে আচমকাই পরিচয় ঘটেছিল রাজা সরকার, সমীরণ ঘোষ এবং মনোজ রাউতের সঙ্গে। যদিও ওদের সচরাচর কোনো সাহিত্য অনুষ্ঠানে দেখা যেত না তবু তিনটে মুখই আমার পরিচিত ছিল। সেটাই স্বাভাবিক, শহরে কজনই বা লেখালিখি করতো! জানা ছিল ওদের পত্রিকার নাম কুরুক্ষেত্র, ঋত্বিক এবং ধৃতরাষ্ট্র। ওরা আমাকে গুরুত্ব দিতো না জন্য আমিও ওদের এড়িয়ে চলতাম। সেদিন কিভাবে যেন দূরত্বটা ঘুচে গিয়েছিল! অনুষ্ঠান শেষে আমরা চারজন দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম। শুধু সেদিন নয়, তার পরের দিনও। এমন কী তার পরের পরের পরের দিনও। অবশ্য দিন না বলে সন্ধ্যে বলাটাই সঠিক হবে।
    আড্ডা দিচ্ছি বটে কিন্তু টের পাচ্ছি তেমন জমছে না। আমার লেখালিখি নিয়ে ওদের তিনজনেরই কোনো মাথাব্যথা নেই। ওদের লেখাপত্র নিয়ে আমি মাথা খাটাতে চাইছি বটে কিন্তু হালে পানি পাচ্ছি না কারণ ওদের লেখালিখির ধরণ ছিল আমার ঘরানার চে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। এমন কিছু শব্দ সেসব লেখায় থাকত যেগুলোকে এতদিন অশ্লীল বলেই মেনে এসেছি।তাছাড়াও পুরোটাই এমন খিটকেলে ধরণের যে চাইলেও এগোনো যাচ্ছে না। এরকম পরিস্থিতিতে বন্ধুত্বও এগোনর কথা নয়। আচ্ছা, দেখা হবে, এরকম কিছু একটা বলে উঠে পড়া এবং ভবিষ্যতে ওপথ না মাড়ানোটাই ছিল স্বাভাবিক পন্থা। কিন্তু তেমনটা হলো না। কেন? জানি না। কে জানে, পুরোন দিনের গল্পে যেমন থাকত, বিধাতা অলক্ষে দাঁড়াইয়া হাসিলেন, প্রথমদিনের আলাপের ক্ষণে হয়ত তেমন কিছু ঘটেছিল! হয়ত কেন, আলবত ঘটেছিল। নাহলে আমি কেনই বা একতরফা ভাবে প্রতি সন্ধ্যেয় হাঁ করে ওদের কথা গিলে যাব? কেনই বা ওদের পরামর্শ মোতাবেক নিজের পাঠক্রম বদলে নেব!
    রাজা, মনোজ এবং সমীরণের সঙ্গে যে ততদিনে হাংরিদের যোগাযোগ ঘটে গিয়েছে, সেটা কিন্তু তখন জানতাম না। অবশ্য জেনেই বা কী হোত, আমি তো হাংরি আন্দোলন কী বস্তুু সেটাই জানতামই না!
    ওদের সুবাদে পরিচিত হলাম হাংরি সাহিত্যের সঙ্গে। পড়লাম সুভাষ, শৈলেশ্বর, ফালগুনি, প্রদীপ, বাসুদেব, অরুণেশদের লেখাপত্র। পড়ে কাঁচামাথা ঘুরে যাবার উপক্রম। এর নাম সাহিত্য! সেই কবে থেকে সাহিত্য পড়ে আসছি, সেসবে যৌন বিবরণও যথেষ্টই ছিল কিন্তু খানিকটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। এরকম সরাসরি নয়। পড়ে শরীর কিছুটা গরম হোত। কিন্তু এরা যেন চামড়া তুলে নিয়ে লালাভ শরীরটা দেখাচ্ছে। পড়তে গিয়ে গা ঘুলিয়ে ওঠে ! ভাবি, এসবও যদি সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে থাকে তবে তা কখনই সরস্বতীর আশীর্বাদ পুষ্ট হোতে পারে না বরং অভিশাপগ্রস্ত বলা যেতে পারে। হয়ত সে কারণেই এদের জেল জরিমানা ঘটেছিল।
    তবে এদের ভেতরে বাসুদেব দাশগুপ্তর লেখাপত্র খানিকটা টেনেছিল। ওর টেকনিকে খানিকটা মুগ্ধতা জেগেছিল। মনে হয়েছিল সর্বাংশে অভিনব। তাবলে বাসুদেবের সব লেখাই যে ভালো লেগেছিল, তা নয় কেননা কিছু গল্পকে পূর্বদোষেই দুষ্ট মনে হয়েছিল।
    দুঃখ পেয়েছিলাম। আচ্ছা, যাদের এত পড়াশোনা, কলম যাদের এতটা শক্তিশালী তারা কেন শব্দ সচেতন নন! অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে কি সুখ পান? কেন লেখেন এমন? বিশেষ করে অশ্লীলতার দায়ে রাষ্ট্র কর্তৃক অভিযুক্ত হওয়ার পরও!
    এসব প্রশ্নের উত্তর জেনে নিতে পড়লাম ওদের সাক্ষাতকার এবং প্রবন্ধগুলো। চোখের সামনে থেকে বন্ধ জানালা খুলে গেল। জানলাম, সাহিত্য নিছকই বিনোদনের মাধ্যম নয়। বরং বিনোদনের সাহিত্য এক আফিম। পাঠক রুচি নামক ইওটোপিয়াকে সামনে রেখে শিল্প সংস্কৃতির যে বেসাতি চালু আছে তার মূল উদ্দেশ্য শুধুই মুনাফা নয়,জনচেতনাকে দাবিয়ে রাখাও। সাহিত্য এবং জীবনকে একই মুঠোয় ধরতে হয়।
    জানলাম, সত্য যদি শিব হয়েও থাকে কিন্তু সেটা আদৌ সুন্দর নয়। তাছাড়া সত্য কখনও একমাত্রিক হয় না। বরং জীবনের মূল সত্যকে গোপন করতেই কলাকৈবল্যবাদ কিংবা প্রগতিশীলতার তত্ত্বের জন্ম।
    এতদিন জানতাম, লিটল ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠানের আঁতুড় ঘর। এখানে হাঁটতে শিখে কবি/লেখকবৃন্দ দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ে প্রতিষ্ঠানের বারান্দায়। ব্যস, খোলা বারান্দায় এরপর যতখুশী নাচানাচি, জাগলারি, হাতসাফাই দেখানোর অনন্ত স্বাধীনতা। বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে পাঠককূল সেসব দেখে জীবন সার্থক করে তুলবে। ওই ভিড়ের মধ্যে থাকা কয়েকজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক কলার তুলে বলবেন, বন্ধুগণ, ওই যে প্রোদুনোভা ভল্ট স্পেশালিস্টকে দেখছেন, উনি আমার সাপ্লাই।
    এবার জানলাম,লিটল ম্যাগাজিন কোনো সমান্তরাল সাহিত্য সৃষ্টির আখড়া নয়, বরং প্রচলিত সাহিত্যের বিপরীতে এর অবস্থান। লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আরেকটি শব্দ ওতপ্রোত জড়িত- আন্দোলন। যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য,পাঠককে সচেতন করে তার প্রত্যাশা বাড়ানো। লিটল ম্যাগাজিন বাজারি রুচির তোয়াক্কা তো রাখেই না বরং তেজস্ক্রিয় ভাষা মারফৎ প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। কারণ প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণা সব সময়ই ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। জীবনের তলা থেকে উঠে আসে না। গা গতরের ভাষা ব্যবহার করে ভাষাকে এলিটিজম থেকে মুক্ত করাটাই লিটল ম্যাগাজিনের প্রধান কাজ। পাঠককে ঘা মেরে জাগাতে ভাষা সন্ত্রাস ঘটাতে হবে। একমাত্র সেভাবেই প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা যাবে। পরিচিত হলাম নতুন শ্লোগানের সঙ্গে, প্রতিবাদের সাহিত্য।
    কিন্তু কেমন হবে সেই সব লেখাপত্র? পড়লাম,মানিক-জীবনানন্দ-জগদীশ-সতীনাথ-শান্তিরঞ্জন-অদ্বৈত-দস্তেয়ভস্কি- মিলার- জেঁনে- র‍্যাঁবো- বারোজ - কামু- কাফকা। পড়লাম মার্কসবাদ সংক্রান্ত কিছু লেখাপত্রও। কারণ একমাত্র মার্কসবাদই তাত্ত্বিক ভাবে প্রমাণ করেছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নিছকই আবেগ সঞ্জাত কোনও রোমান্টিক আগ্রহ নয়। এর সুস্পষ্ট আর্থ- সামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। একমাত্র মার্কসবাদীরাই জানে, বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে যুক্ত করতে না পারলে প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা অসম্ভব।
    জানলাম, বুঝলাম কিন্তু মেনে নিলাম কি? যদি মেনে নিয়ে থাকি কেন নিলাম? এসব কূট প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফের নিজের প্রসঙ্গে ফিরতে হবে। ত্রুটি মার্জনীয়।
    এমন এক পরিবারে জন্মেছি যাদের ঝুঁকি বহির্ভূত জীবন যাপন করে চলাটাই একমাত্র লক্ষ্য। কোনো ঝুট ঝামেলার আভাসটুকু পেলে সঙ্ঘারামে খিল এঁটে বসে থাকাটাই ছিল পারিবারিক রেয়াজ। মনুষ্য জীবন কি খইমুড়ি নাকি যে অহরহ ফুটবে? তার চাই নিস্তরঙ্গ জীবন।সুতরাং স্নেহ-প্রীতি-সম্মান-ভক্তি-শ্রদ্ধা -শৃঙ্খলা, এজাতীয় কিছু শব্দের প্রতি পরিবারের প্রত্যেকের ছিল অন্ধ আনুগত্য। প্রতিবাদ নামক শব্দটার ধার কাউকেই খুব একটা ধারতে দেখিনি। 
    এর দ্বারা পোস্ট করা আমরা পঞ্চপাণ্ডব এই সময়ে ৫:৩৬ AM কোন মন্তব্য নেই:
    এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!X-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন
    লেবেলসমূহ: অলোক গোস্বামী, মনোজ রাউত, রাজা সরকার

    রবিবার

    মলয় রায়চৌধুরীকে উত্তরপাড়ার ঠিকানায় লেখা ফাদার পিয়ের ফালোঁর চিঠি



    প্রিয়বরেষু
    আপনার ‘হাংরি জেনারেশনের কাব্যদর্শন’ ও ‘আমার অমীমাংসিত শুভা’ গত বৃহস্পতিবার পেয়েছি। অবশ্য আপনি এপ্রিল মাসেই বই দুটি পাঠিয়েছেন কিন্তু আমি আর যাদবপুরে পড়াই না বলে বইগুলি সেখান থেকে ঘুরে-ঘুরে দেরিতে আমার এই নতুন ঠিকানায় পৌঁছে এল । বইয়ের জন্য আমি কৃতজ্ঞ । আপনার সঙ্গে বহুদিন আলাপ করার ইচ্ছা আমার ছিল ; হয়তো পত্রালাপে সেই ইচ্ছা পুরোভাবে মিটবে না -- সাক্ষাৎভাবে আলাপ পরিচয় হলে আরও খুশি হতাম । যদি কোনোদিন কলকাতায় আসেন আর একটু অবসর যদি আপনার থাকে তবে কিছুক্ষণের জন্য আমার বাসায় আসুন গল্প হবে, অনেক প্রশ্ন করব, শুনতে চাই বহুরকম কথা ।
    .
    আপনার শুভাগ্রাফ পড়েছি ; একবার নয়, কয়েকবার । কবি আমি কোনোকালে ছিলাম না, তাছাড়া আমি বিদেশি । তাই কাব্যের বিচার করার সাহস বা অধিকার আমার নেই । তা সত্ত্বেও আপনার কবিতা পড়েছি । পড়তে পড়তে অনেক ভেবেছি, এখনও ভাবছি।
    .
    কী যে ভেবেছি তা সহজে বলতে পারব না । একটু-আধটু বলতে যদি চেষ্টা করি, তাহলে কিছু মনে করবেন না ।
    .
    আপনি একটা হতাশা আর বিতৃষ্ণার মুখোশ পরেই লেখেন ; তবু আমার বিশ্বাস, আপনার এই মুখোশ-পরা কৃত্রিমতা নয় ; আমরা সবাই কোনো একটা মুখোশ পরি, আদর্শবাদিতার মুখোশই হোক কিংবা আদর্শ প্রত্যাখ্যানের মুখোশ । তাতে অসত্য হয় না, মুখোশ তো চাই-ই । কিন্তু কয়েকজনের বেলায় বিশেষ ইচ্ছা মনে জাগে, মুখোশ-খোলা অবস্হায় তাঁদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তাঁদের ব্যক্তিগত পরিচয় লাভ করার।
    .
    শুনেছি, আপনার নামে অনেক অভিযোগ অনেকে তোলে । গালাগালিও দেয় । আমার কিন্তু সেইরকম ইচ্ছা একটুও হল না । আপনার ‘আর্তনাদের’ ভাষা সম্পূর্ণভাবে বুঝি না, মাঝে-মাঝে তা ভালো লাগছেও না, কিন্তু আপনার অনুভূতির আন্তরিকতা উপলব্ধি করতে পারি । যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানসর্বস্ববাদ ইত্যাদির সস্তা মোহ এবং হৃদয়াবেগ ও ভাববিলাসের অবাস্তব কল্পনার অতীত আরও কিছুর অনুসন্ধান করেছেন । আত্মতৃপ্ত ও আত্মপ্রবঞ্চনাকারী অনেককে আপনি ভাব ও ভাষার ধাক্কায় সজাগ করে তুলতে চান, তা মনে করি । অসুন্দরের মিথ্যা আপনাকে ভীষণভাবে বিরক্ত করে । জানি না, আমার এইসব কথা, কতখানি সত্য । তাই আলাপ করার ইচ্ছা আছে । আমার ভাষায় বহুদিন পূর্বে লেখা কতগুলি কবিতা সেদিন পড়ছিলাম -- Tristan Corbiere-এর Les Amours Jaunes আর Laforgue-এর Complaintes । পড়েছেন কি ? পড়লে আপনার বোধহয় ভালোই লাগত । আপনার কাব্যদর্শন আমার খুবই ভালো লেগেছে । আমিও দর্শন ও সাহিত্য অবিচ্ছেদ্য বলে মনে করি । যদিও ‘দর্শনের’ ওপরে অধিকতর মূল্যবান জিনিস রয়েছে, যাকে আমরা ‘বিশ্বাস’ বলি । ‘বিশ্বাস’ বলতে আত্মবিশ্বাসও বোঝায়, মানুষের প্রতি আর ভগবানের ওপর বিশ্বাস স্হাপনও বোঝায় । কিন্তু অনেকের একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে, তারা বিশ্বাস জিনিসটা সহজ ও সারশূন্য মনোবিলাস মনে করে । তারা কোনোদিন আপনার মতো যুক্তিবাদের গণ্ডি কিংবা ভাবালুতার শূন্যতা প্রত্যক্ষ করেনি । সত্যকার বিশ্বাসের উদ্ভব নৈরাশ্য ও মোহমুক্তির অতল থেকেই ।
    .
    অনেক বকেছি, এলোমেলোভাবে, মাফ করুন । 
    প্রীতি জানবেন ।
    পি. ফালোঁ
    .
     ( ফাদার  পিয়ের ফালোঁর ( ১৯১২ - ১৯৮৫ ) বাংলা জ্ঞান অত্যন্ত সড়গড় ছিল, উচ্চারণেই যা ফারাক বোঝা যেত, জিভ থেকে সাহেবিয়ানার আড়টুকু সরেনি। দেখতে অনেকটা মুনিঋষিদের মতো, পিঠে বইপত্রের ঝোলা, চোখে সোনালি ফ্রেমের গোল চশমা, শুকনাসা, হাসি হাসি মুখ, ফাদার ফালোঁকে প্রায়ই দেখা যেতো যাদবপুর অঞ্চলে এবং পরে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায়।  ফাদার পিয়ের ফালোঁ বেলজিয়াম থেকে মিশনারি হয়ে এই দেশে এসে, বাংলা ও সংস্কৃতে এম এ করেছিলেন। পড়াতেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল আর কলেজে। থাকতেন গোলাম মহম্মদ রোডে ‘শান্তিভবন’-এ। )

    এর দ্বারা পোস্ট করা আমরা পঞ্চপাণ্ডব এই সময়ে ১১:২৮ PM কোন মন্তব্য নেই:
    এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!X-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা মলয় রায়চৌধুরীর ১৬.৬.১৯৬৩ তারিখের পোস্টকার্ড

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা মলয় রায়চৌধুরীর ১৬.৬.১৯৬৩ তারিখের পোস্টকার্ড

    কী ঠিক করলেন সুনীলদা ? হাংরি জেনারেশনের de jure নেতৃত্বটা গ্রহণ করবেন, নাকি de facto নেতাকেই নেতা ভেবে রাগ করে থাকবেন ?
    মলয়
    এর দ্বারা পোস্ট করা আমরা পঞ্চপাণ্ডব এই সময়ে ৫:৩৩ AM কোন মন্তব্য নেই:
    এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!X-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন
    লেবেলসমূহ: মলয় রায়চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, Hungry Generation., Hungryalism, Malay Roychoudhury

    শনিবার

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়-এর ২১.১.১৯৬১ তারিখের চিঠি

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়-এর ২১.১.১৯৬১ তারিখের চিঠি

    প্রিয় সুনীলবাবু,
    .
    মাত্র এই পৃষ্ঠা এবং এর উল্টোপাতাটুকু লিখব, অর্থাৎ আগে থেকেই একটা সংযম আরোপ করে নিচ্ছি । চিঠিটা পাঠাব অনেকদিন পরে, অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত পাঠাব কিনা খুবই সাবধান হয়ে গেছি আমি ।
    .
    এই সাবধানতা, আপনার সম্পর্কে, মূলত একটিমাত্র কথা, যা আপনাকে জানানোর । আপনার ব্যবহার আমাকে সাবধান করে দিয়েছে । কোনোরকম সচেতন মনোযোগ না দিয়ে, শেষের দিকে আমি আপনার সঙ্গে মেলামেশা করছিলাম; যাবতীয় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ধরে নিয়েছিলাম আমি আপনার বন্ধু । যে-ভাবেই তার সংজ্ঞা করা যাক, যে-কোনো বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও আপনাকে আমার বন্ধু ভেবেছিলাম ।শেষ পর্যন্ত এই ধারণা আমার হয়ে গিয়েছিল । শেষ পর্যন্ত মানে এই যে তার আগে বহুদিন তা হয়নি, বহু সময় লেগেছিলল এ-জন্যে অনেক স্বার্থত্যাগ ( চারিত্রিক ) আমি করেছিলাম, দাম দিয়েছিলাম এর । পুরো দাম দিলে একটা জিনিশ আমি পাব, আমি আশা করেছিলাম । তারপর আপনি আমাকে সাবধান করে দিলেন ।
    .
    ৬-ই ডিসেম্বরে মধ্যরাতে ইডেন হসপিটাল রোডের মুখে দাঁড়িয়ে যে-সব কথা আপনি আমাকে বলেন, তা-ই আমাকে সাবধান করে দেয় । অবশ্য অতটা অপ্রত্যাশিত লাগা উচিত হয়নি, কারণ গত এক বছরে মাঝে-মাঝেই অপমান করেছেন, কোথাও একটা প্রত্যাশা আমার সেদিন থাকা উচিত ছিল । সত্যি, আজ মনে পড়ছে অনেকবার, পাঁচ বার কি ছ’বার, আমাকে সকলের সামনে অপমান করেছিলেন । অপমান করা আপনার সঙ্গত হয়েছিল কি হয়নি, সে-কথা ভাবছি না । কারণ, এটাই ভাবছি যে, অপমান হচ্ছে অপমান । এবং বন্ধুকে কেউ অপমান করে না ।
    .
    যে বন্ধু নয়, অবশ্য তাকে করে। কিন্তু ওই যে বললাম, আমার শেষ পর্যন্ত ধারণা জন্মে যায় যে আমি আপনার বন্ধু, বা আরো কতো বড়ো ভুল, আপনি আমার বন্ধু । আগের অপমানগুলি আমি ক্রমশ ভুলে যাই । কিন্তু আপনি অনুতপ্ত দেখে ৬-ই ডিসেম্বরের অপমানও আমি পাছে ভুলে যাই, তাই পরদিন হাসতে-হাসতে, ‘কী মশাই, are you angry with me’ জিজ্ঞাসা করেছিলেন বলে আজ পর্যন্ত আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ আমার হয়নি।
    .
    শেষ পর্যন্ত আপনার অনুরক্ত হয়ে পড়া ছাড়া আমার উপায় ছিল না । বন্ধুত্ব আমার কাছে বড় আশার জিনিশ ছিল । অন্য কোনো human value সম্পর্কে আমি সুনিশ্চিতভাবে জানতে পারিনি, যেমন প্রেম, ভাতৃত্ব, দেশ বা বাবা-মার সম্পর্কে অনুভব, এইসব । বন্ধুত্ব সম্পর্কে কিছুটা পেরেছিলাম । যতদিন ভুল ধারণা ছিল, বন্ধুত্ব ছিল বেঁচে থাকার একটা আশ্বাস, একমাত্র মানে ।
    ইতি
    প্রীতিসহ
    সন্দীপন
    এর দ্বারা পোস্ট করা আমরা পঞ্চপাণ্ডব এই সময়ে ১১:৫১ PM কোন মন্তব্য নেই:
    এটি ইমেল করুনএটি ব্লগ করুন!X-এ শেয়ার করুনFacebook-এ শেয়ার করুনPinterest এ শেয়ার করুন
    নবীনতর পোস্টসমূহ পুরাতন পোস্টসমূহ হোম
    এতে সদস্যতা: পোস্টগুলি (Atom)

    এতে সদস্যতা

    পোস্টগুলি
    Atom
    পোস্টগুলি
    সব কটি মন্তব্য
    Atom
    সব কটি মন্তব্য

    মোট পৃষ্ঠাদর্শন

    ব্লগ সংরক্ষাণাগার

    • ►  2023 (34)
      • ►  অক্টোবর (1)
      • ►  সেপ্টেম্বর (3)
      • ►  আগস্ট (2)
      • ►  জুলাই (5)
      • ►  জুন (2)
      • ►  মে (1)
      • ►  এপ্রিল (1)
      • ►  মার্চ (8)
      • ►  ফেব্রুয়ারী (4)
      • ►  জানুয়ারী (7)
    • ►  2022 (62)
      • ►  ডিসেম্বর (5)
      • ►  নভেম্বর (4)
      • ►  অক্টোবর (21)
      • ►  সেপ্টেম্বর (5)
      • ►  আগস্ট (12)
      • ►  জুন (5)
      • ►  মে (5)
      • ►  এপ্রিল (1)
      • ►  ফেব্রুয়ারী (1)
      • ►  জানুয়ারী (3)
    • ►  2021 (101)
      • ►  ডিসেম্বর (7)
      • ►  নভেম্বর (14)
      • ►  অক্টোবর (32)
      • ►  সেপ্টেম্বর (4)
      • ►  আগস্ট (14)
      • ►  জুলাই (16)
      • ►  মে (6)
      • ►  এপ্রিল (2)
      • ►  ফেব্রুয়ারী (2)
      • ►  জানুয়ারী (4)
    • ▼  2020 (97)
      • ►  ডিসেম্বর (6)
      • ►  নভেম্বর (3)
      • ►  অক্টোবর (3)
      • ►  সেপ্টেম্বর (9)
      • ►  আগস্ট (5)
      • ►  জুলাই (12)
      • ►  জুন (13)
      • ▼  মে (10)
        • অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ৭ )
        • অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ৬ )
        • অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ৫ )
        • অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ৪ )
        • অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ৩ )
        • অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ২ )
        • অলোক গোস্বামী : উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন ( ১ )
        • মলয় রায়চৌধুরীকে উত্তরপাড়ার ঠিকানায় লেখা ফাদার পিয়ে...
        • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা মলয় রায়চৌধুরীর ১৬.৬.১৯৬৩...
        • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়-এর ...
      • ►  এপ্রিল (4)
      • ►  ফেব্রুয়ারী (4)
      • ►  জানুয়ারী (28)
    • ►  2019 (46)
      • ►  ডিসেম্বর (4)
      • ►  নভেম্বর (7)
      • ►  অক্টোবর (3)
      • ►  আগস্ট (3)
      • ►  জুলাই (2)
      • ►  জুন (2)
      • ►  মে (1)
      • ►  এপ্রিল (1)
      • ►  মার্চ (9)
      • ►  ফেব্রুয়ারী (10)
      • ►  জানুয়ারী (4)
    • ►  2018 (279)
      • ►  ডিসেম্বর (10)
      • ►  নভেম্বর (8)
      • ►  অক্টোবর (28)
      • ►  সেপ্টেম্বর (17)
      • ►  আগস্ট (64)
      • ►  জুলাই (24)
      • ►  জুন (13)
      • ►  মে (13)
      • ►  এপ্রিল (64)
      • ►  মার্চ (24)
      • ►  জানুয়ারী (14)
    • ►  2016 (5)
      • ►  অক্টোবর (5)
    • ►  2014 (1)
      • ►  মে (1)
    • ►  2012 (1)
      • ►  নভেম্বর (1)
    • ►  2011 (3)
      • ►  অক্টোবর (2)
      • ►  ফেব্রুয়ারী (1)
    ওয়াটারমার্ক থিম. Blogger দ্বারা পরিচালিত.